পূজার ছলে তোমায় ভুলে

যে লোক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসে নেতৃত্ব দিয়েছে, রক্তকরবীর ভূমিকায় লিখেছে এই নাটক রূপক নয়, সরকারী গণহত্যার প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছে, কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য গান লিখেছে, নেতাজী কংগ্রেস ত্যাগে বাধ্য হওয়ায় রুষ্ট হয়ে গান্ধীজিকে চিঠি লিখেছে — সেই লোকের ছবি দেখিয়ে বাঙালি ছেলেমেয়েকে শেখায় “নম কর। ঠাকুর।” কোন বাঙালি? যে বাঙালি স্কুলের শেষ ধাপে থাকা ছেলেমেয়েকে পইপই করে শেখায় “কলেজে যাবে পড়াশোনা করতে, রাজনীতি করতে নয়”

rabindranath

একদা এক সহপাঠিনীকে আমার বেশ পছন্দ ছিল, প্রায় প্রেমে পড়ে যাই যাই অবস্থা। অন্য একজনের প্রতি আকর্ষণ প্রবলতর না হলে হয়ত প্রেমে পড়েই যেতাম সেইসময়। সে যা-ই হোক, সহপাঠিনীটির প্রতি আমার দুর্বলতার একটা বড় কারণ ছিল তার রবীন্দ্রপ্রীতি। মেয়েটিকে দেখতে বিলক্ষণ ভাল, আমার সাথে চিন্তাভাবনায় দিব্য মিল বলে মনে হত। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা মেয়েটির গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত চমৎকার লাগত। সে রবিবাবুর গল্প, কবিতা, উপন্যাসও গুলে খেয়েছিল। অতএব আমি ভীষণই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম একসময়। এখন ভেবে শিউরে উঠি, সত্যিই তার প্রেমে পড়ে গেলে কি দুর্দশাই না হত দুজনেরই।
অন্য অনেক হাফসোলপর্ব পেরিয়ে আমার গিন্নীর সাথে প্রেম, অতঃপর বিবাহের পরে ক্রমশ আবিষ্কার করলাম যে আমার সেই সহপাঠিনী আদ্যন্ত মুসলমানবিদ্বেষী। ভারতবর্ষ দেশটা যে হিন্দুদের এবং আর সকলেরই এখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকা উচিৎ — এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। জানতে পেরে শুধু অবাক নয়, রীতিমত আহত হয়েছিলাম। প্রেমিকা না-ই হল, বন্ধু তো বটে। এমন একজন মতের মানুষকে পরম বন্ধু ভেবে বসেছিলাম বুঝতে পারলে নিজের বোধবুদ্ধি সম্পর্কেই প্রশ্ন জাগে মনে। অবশ্য সেটা ২০১৪ গোড়ার দিক। অনেক কাছের লোককেই অচেনা লাগতে শুরু করার সময়। এখনকার মত অতটা গা সওয়া হয়নি তখনো ব্যাপারটা। কিন্তু অভ্যেস হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত আমার যেটা অবিশ্বাস্য লাগত সেটা হল রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকা একজন মানুষের মধ্যে মানবতাবোধের এরকম অভাব, ভারতীয়ত্ব সম্পর্কে এরকম একপেশে ধারণা কী করে জয়ী হয়?
পরবর্তীকালে আরো অনেকের সাথে মিলিয়ে দেখে যা বুঝলাম সেটা হল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের বাঙালিদের এত যে গর্ব, এত গদগদ ভাব — সব ভাঁওতা। রবীন্দ্রনাথকে আমরা বহুকাল হল বাদ দিয়েছি, পড়ে আছে এক ঠাকুর। লক্ষ্মীর পাঁচালি যেমন লোকে বুঝে বা না বুঝে গড়গড় করে পড়ে আমরা তেমন ওঁর গোটা কুড়ি গান আর ডজনদুয়েক কবিতা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিখি এবং পারফর্ম করি। কথাগুলো কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে না। ফলে যে প্রতিযোগিতায় ‘ভারততীর্থ’ আবৃত্তি করে প্রথম হয় সে রামমন্দির নির্মাণে করসেবা করতে অযোধ্যা চলে যায়। যে দিদিমণি রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় “বাংলার মাটি বাংলার জল” গায় সে মুসলমান ছাত্রীর এনে দেওয়া জল খায় না। আরো দেখলাম রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো বড় একটা কেউ পড়ে না। ফলে রবীন্দ্রনাথকে একজন অরাজনৈতিক, সাঁইবাবাসুলভ লোক বলেই বেশিরভাগ বাঙালি মনে করে।
কি আশ্চর্য! যে লোক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসে নেতৃত্ব দিয়েছে, রক্তকরবীর ভূমিকায় লিখেছে এই নাটক রূপক নয়, সরকারী গণহত্যার প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছে, কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য গান লিখেছে, নেতাজী কংগ্রেস ত্যাগে বাধ্য হওয়ায় রুষ্ট হয়ে গান্ধীজিকে চিঠি লিখেছে — সেই লোকের ছবি দেখিয়ে বাঙালি ছেলেমেয়েকে শেখায় “নম কর। ঠাকুর।” কোন বাঙালি? যে বাঙালি স্কুলের শেষ ধাপে থাকা ছেলেমেয়েকে পইপই করে শেখায় “কলেজে যাবে পড়াশোনা করতে, রাজনীতি করতে নয়।”
এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের শক্তি নন, আমাদের দুর্বলতা। যে কোন মধ্যমেধার চলচ্চিত্র পরিচালক বা নিম্নরুচির মেগা সিরিয়াল নির্মাতা একখানা লাগসই রবীন্দ্রসঙ্গীত গুঁজে দিয়েই নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে অন্তত পয়সা উঠে যাবে। লেখাপড়া জানা বাঙালিও এমন বিহ্বল হয়ে দেখবে যে মনে হবে ঋত্বিক বা সত্যজিতের ছবি দেখছে।
আসলে ভদ্রলোকের থেকে আমরা নিয়েছি লবডঙ্কা কিন্তু দিয়েই চলেছি — অবজ্ঞা। জেনে এবং না জেনে। “তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি”।

মার্কস বাদ?

পুঁজিবাদের উদ্ভব কি কৃষিবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে? সেই পৃথিবী এতদিনে বদলায়নি?

marx

একশো বছরের বেশি হল দুনিয়ায় মার্কসবাদী আর মার্কসবিরোধী — দু ধরণের লোকই আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। দু পক্ষেরই অনেক ভাল ভাল যুক্তি আছে। কিন্তু বেশকিছু উঁচু ডিগ্রিধারী লোককেও দেখতে পাই মার্কসবাদ সম্পর্কে অত্যন্ত হাস্যকর কিছু যুক্তি দেন। সেগুলো এত দুর্বল যে তার প্রতিযুক্তি দিতে মার্কসবোদ্ধা হতে লাগে না। তারই কয়েকটা প্রতিযুক্তিসহ নীচে দিলাম —
১) সাম্য ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। প্রকৃতিবিরোধী। অতএব সাম্যবাদী সমাজ একটি ইউটোপিয়া।

তাই তো! কিন্তু একটা অসুবিধা হয়ে গেল যে! সমাজ, রাষ্ট্র — এগুলোও অস্বাভাবিক। প্রকৃতিবিরোধী। এগুলো মানুষ বানিয়েছে। এগুলোকেও ফেলে দেওয়া দরকার তাহলে। প্রযুক্তি ব্যাপারটা তো ভীষণভাবেই প্রকৃতিবিরোধী। অতএব বাড়ির জলের লাইন, বিদ্যুতের লাইন কাটিয়ে দিন, হাতের ফোনটা এখনই ছুঁড়ে ফেলে দিন, জামাকাপড় ত্যাগ করে সপরিবার উলঙ্গ হয়ে থাকুন। আসলে বাড়িটাও প্রকৃতিবিরোধী। অতএব জঙ্গলে চলে গিয়ে পর্ণকুটিরেই থাকা উচিৎ।

২) মার্কসবাদের উদ্ভব হয়েছিল শিল্পবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে। এখন আর সেই মতবাদের কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই কারণ পৃথিবী বদলে গেছে।

আচ্ছা পুঁজিবাদের উদ্ভব কি কৃষিবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে? সেই পৃথিবী এতদিনে বদলায়নি?

৩) কমিউনিস্ট শাসন সব দেশেই গুলাগ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচুর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অত্যন্ত দমনমূলক শাসনব্যবস্থা। সেই শাসনব্যবস্থার প্রবক্তার তত্ত্বের কোন দাম নেই।

প্রথমত, আপনি কি জানেন মার্কসবাদী মানেই বলশেভিক বা চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নয়? পিট সিগার আর এরিক হবসবম দুজন প্রসিদ্ধ মার্কসবাদী। কিন্তু দুজনেই বলশেভিক শাসনের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন। এমনকি চে গেভারাও বলেছেন। উদাহরণ হিসাবে আরো বলা যায় যে কিউবাতে কাস্ত্রো যেভাবে শাসন চালিয়েছেন তার সাথে কিন্তু রাশিয়া বা চীনের পার্থক্য বিস্তর।

দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট শাসন ছাড়া পৃথিবীর আর কোন শাসনব্যবস্থাই কি কারো মৃত্যুর কারণ হয়নি? ভারতে বিয়াল্লিশের মন্বন্তরে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছিল তারা কোন কমিউনিস্ট শাসনের প্রজা? কদিন আগে টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এখনো এদেশে বছরে ১২০০০ কৃষক আত্মহত্যা করেন। তাঁদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী কোন কমিউনিস্ট সরকার? ১৯৯১ এর পর থেকে সারা পৃথিবীতে অপুষ্টিজনিত কারণে যত শিশুর মৃত্যু হয়েছে তাদের জীবনের দাম দেবে কোন কমিউনিস্ট সরকার? নাকি ঐ মৃত্যুগুলো দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে?
জারের গুলাগ পরে স্তালিনের গুলাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অত্যন্ত অন্যায় কোন সন্দেহ নেই। মার্কসবাদে কোথাও গুলাগের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে বলে জানি না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যদি গুলাগের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করত, চমৎকার হত। কিন্তু গুয়ান্তানামো বে জিনিসটা কী? আবু ঘ্রাইবটা কী ব্যাপার? সিঙ্গাপুরের যে একনায়ক কয়েকবছর আগে মারা গেলেন তাঁর রাজত্বে বিরোধীরা কেমন ছিলেন? কেমন আছেন আজকের তুরস্কের বিরোধীরা, রাশিয়ার বিরোধীরা, ভারতের বিরোধীরা, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধীরা? যত দোষ মার্কস ঘোষ? স্তালিন, মাও, পল পটের দোষে যদি মার্কসবাদ বাতিল করতে হয় তাহলে পুঁজিবাদী দেশগুলোর কতজন শাসকের দোষে কতবার পুঁজিবাদ বাতিল হওয়া উচিৎ?

৪) মার্কসবাদ গরীবদের জন্য। পুঁজিবাদ উন্নয়নের মাধ্যমে গরীবদের বড়লোক করে দিচ্ছে। অতএব মার্কসবাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

দারুণ সুসংবাদ। কবে কখন কোথায় এটা হচ্ছে খবর দেবেন, প্লিজ। পুঁজিবাদের ঝান্ডা নাড়তে ছুটে যাব কথা দিচ্ছি। আপাতত যা দেখছি আমেরিকা, ফ্রান্সের মত দেশেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব নাকি বেড়েই চলেছে। তাই লোকে খচে বোম হয়ে এমনসব লোকেদের ভোট দিচ্ছে যাদের দেখে বড় বড় পুঁজিবাদীদেরও মাথায় হাত। আর বাকি বিশ্বের কথা ছেড়েই দিন। আমরা তো তৃতীয় বিশ্ব। এখানে একই শহরে এন্টিলা আর ধরভি। ফোন বলছে “জিও”, মন বলছে “মর”। এই বাজারে মার্কস ফার্কস চলে নাকি?

বিজ্ঞান, অপবিজ্ঞান ও কাঁচকলা

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের লোকেরা আজকে জে এন ইউ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মার খেতে দেখে যেন ভাববেন না আপনাদের উপরে কোন আক্রমণ আসবে না। যে উদাহরণটা দিলাম ওটা যে কোনদিন সত্যি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রাচীন ভারতের বিমান প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। অমর্ত্য সেনকে যারা মূর্খ বলে তারা যে অশোক সেনকে বেশিদিন পন্ডিত বলে মানবে এমন মনে করা যুক্তিসঙ্গত নয়

১৯৮০র দশকে যখন প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডিও পেরোইনি তখন থেকেই আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম যে উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা না করে উপায় নেই। অর্থাৎ চাকরিবাকরি পাওয়া যাবে না। একটু বড় হতেই শুনলাম শুধু বিজ্ঞান পড়াও যথেষ্ট নয়, ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। নাহলে লেখাপড়া করার মানেই হয় না। ঘটনাচক্রে আমার বাবা শিক্ষক, একজন বাদে অন্য জ্যাঠারা শিক্ষক/অধ্যাপক, মামা মাসিরাও ঐ পেশায়, এমনকি মায়ের মামা মাসি, মেসোরাও অনেকে তাই। কিন্তু যা বুঝতাম সেটা হল ওঁদের সময়ে মাস্টার হওয়া ভাল ছিল কিন্তু আমার প্রজন্মের ভদ্রঘরের ছেলেকে (মেয়ে হলে অন্যরকম চলতে পারে, কারণ “সেই তো বিয়ে দিতে হবে”) ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে।
কতকটা নিকটাত্মীয়দের বেশিরভাগ শিক্ষকতায় থাকার ফলে, অনেকটাই বাবা-মায়ের ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার সুবাদে আর খানিকটা বরাবর অতি সাধারণ ছাত্র হওয়ার ফলে আমার উপরে বিজ্ঞান পড়ার বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চাপ কখনো এসে পড়েনি। নিজের ইচ্ছামতই স্কুল ছাড়ার পরে কলা বিভাগের ছাত্র হতে পেরেছিলাম। তারপর ইংরিজি সাহিত্যের অযোগ্য ছাত্রও হতে পেরেছিলাম। কিন্তু অনেক যোগ্যতর সহপাঠীকে দেখেছি যারা এই স্বাধীনতাটা পায়নি। গান বাজনায় প্রবল আগ্রহ, নিচু ক্লাস থেকেই রাজনৈতিকভাবে খুব সচেতন, বইপাগল অনেক সহপাঠীকে দেখেই মনে হত, এখনো হয়, যে তারা সাহিত্য বা সমাজবিজ্ঞানে ভাল অবদান রাখতে পারত। যারা পারেনি তাদের অপরাধ তারা পরীক্ষায় চমৎকার নম্বর পেত। ভাল নম্বর পাওয়া ছেলেদের ইংরিজিতে যাকে humanities বলে তা নিয়ে পড়াশোনা করা একেবারে বারণ ছিল। ফলে তারা এদেশের লক্ষ লক্ষ ডাক্তারের একজন হয়েছে বা কোন বহুজাতিকের হয়ে সফটওয়্যার কোড লিখে দিন কাটাচ্ছে। যারা কোনভাবে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়ে ধ্যাড়াতে পেরেছিল তারা তবু উপকৃত হয়েছে, সাহিত্যের বা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায়, শিক্ষকতায় সরে এসে নিজের বিষয়কে এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। যারা অন্ততপক্ষে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ব্যর্থ হতে পেরেছিল তারাও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণায় বা মাস্টারিতে প্রাণ ঢেলে দিয়ে সুখী হয়েছে।
এ থেকে যা প্রমাণ হয় তা হল প্রায় চল্লিশ বছর আগে থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে চালু ধারণা হল সমাজবিজ্ঞান এবং সাহিত্য ফালতু বিষয়, বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে ব্যর্থ হলে বা মেধায় না কুলোলে তবেই ওগুলো পড়া যেতে পারে। ওগুলো এমনকি দ্বিতীয় পছন্দও নয় অনেকের কাছেই। শুধু মাড়োয়ারি নয়, অনেক বাঙালি পরিবারেও দেখেছি উচ্চ মাধ্যমিকে খারাপ নম্বর পেলে বি কমে ঢুকে পড়তে বলা হত। এর একটা কারণ এই যে কোন এক অজ্ঞাত কারণে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল কলাবিভাগে পড়লে অর্থকরী চাকরি পাওয়া যায় না। ততদিনে কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের ভদ্রস্থ মাইনে দিতে শুরু করেছে।
এই মানসিকতার পরিবর্তন তখনো হয়নি যখন অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রায় এক দশক পরে শিল্পে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের প্রভাবে চাকরিবাকরি কমতে শুরু করল। এই যে সকলকে ঠেলেঠুলে বিজ্ঞান প্রযুক্তি পড়ানো এই প্রবণতাকে কিছুটা সদর্থক বলা যেত যদি এর কারণটা শুধুই পেশাগত না হয়ে মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা হত। কিন্তু ঘটনা একেবারেই সেরকম ছিল না। আমাদের এক অধ্যাপক আবশ্যিক বাংলার ক্লাসে একবার বলেছিলেন “তোমরা এতজন যে বিজ্ঞানে অনার্স পড় তার কারণ এই নয় যে তোমরা সবাই বিজ্ঞানকে খুব জরুরী জিনিস মনে কর। তোমরা পড় কারণ একটা প্রচার আছে যে বিজ্ঞান পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যায়। যদি কুসংস্কারে অনার্স পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যেত তাহলে তোমরা কুসংস্কারেই অনার্স পড়তে।” কথাটা বলে তিনি অনেক ছাত্রের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, কিন্তু কথাটা সত্যি। সেসময়ে যারা লেখাপড়া করেছে তারা নিজের মনে জানে যে কথাটা সত্যি।
এতে কার ক্ষতি হয়েছে? বরাবর ভাবতাম যাদের জোর করে অপছন্দের বিষয় পড়ানো হয়েছে বুঝি শুধু তাদেরই ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি একটা বিরাট সামাজিক ক্ষতি হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাদের ইতিহাসজ্ঞান বলে প্রায় কিচ্ছু নেই কারণ স্কুলে ইতিহাস পড়ার সময়ে এদের বলা হয়েছিল ওটা জরুরী বিষয় নয়, “মুখস্থ করে নম্বর পেয়ে গেলেই যথেষ্ট। মন দিয়ে অঙ্ক, বিজ্ঞান পড়”। ফলে আজকে আপনি এদের বলুন ভগৎ সিংকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, এরা পত্রপাঠ বিশ্বাস করে ফেলবে। এদের বলুন জওহরলাল নেহরু দেশের জন্য কিছুই করেননি, এরা বিশ্বাস করে ফেলবে। কারণ স্কুলের ইতিহাস বইতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস যা পড়া হয়েছিল তার বিন্দুবিসর্গও এদের মনে নেই। মনে রাখার দরকার নেই ভেবে পড়লে মনে থাকার কথাও নয়। এদের বলুন নেহরুর বদলে সর্দার প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের চেহারা অন্যরকম হত। বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করে নেবে কারণ সন্দেহ হতে গেলে যে প্রাথমিক পড়াশোনা থাকতে হয় সেটাই নেই। থাকলে গুগল করেই জানতে পারত যে সর্দার নেহরুর চেয়ে ১৪ বছরের বড় এবং ১৯৪৭এ দেশ স্বাধীন হয় আর সর্দার মারা যান ১৯৫০এ। প্রধানমন্ত্রী হলেই বা তিনি দেশটা গড়ার সময় পেতেন কখন?
কিন্তু ক্ষতির শেষ শুধু ইতিহাসচেতনাহীনতায় নয়। আরো বড় ক্ষতি এই যে ভারতীয়দের বিরাট অংশ মনে করে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোর কোন কার্যকারিতা নেই, এগুলো অধ্যয়ন করতে কোন মেধা লাগে না, যে কেউ এগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে। এই চিন্তার কারণেই সোশাল মিডিয়ায় এবং তার বাইরেও দেখবেন বলা হয় যাদবপুর, জেএনইউ, এফ টি আই আই তে যারা পড়ে তারা হল “ফ্রি লোডার”, তাদের কোন কাজ নেই, শুধু নেশা করে। চট করে কোন আই আই টি সম্পর্কে এরকম বলতে শুনবেন না। অথচ আই আই টির ছেলেমেয়েরাও সরকারী ভর্তুকি পায়, তাদের কেউ কেউও নেশা করে। কেউ বলছে “অমর্ত্য সেন অর্থনীতির কী বোঝেন? ওনার থেকে বড়বাজারে যে ব্যবসা চালায় সে ভাল বোঝে।” আবার কেউ হয়ত বলছে “ফলি নরিম্যান চিফ জাস্টিস ছিলেন বলেই কিসে সিডিশন হয় জানেন তা প্রমাণ হয় না। উকিলরা সব বদমাইশ।”
অথচ কখনো শুনবেন না কেউ বলছে “এ পি জে আব্দুল কালাম বিজ্ঞানের কী বুঝত?” শুনবেন না কারণ গড়পড়তা লোকের ধারণা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করে তারা মেধাবী এবং তাদের কাজ দেশের কাজে লাগে। সমাজবিজ্ঞানের আওতায় কী পড়ে, সেগুলো যে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে নির্ধারক ভূমিকা নেয়, বস্তুত একজন প্রযুক্তিবিদ বা পদার্থবিদের কাজের চেয়ে একজন অর্থনীতিবিদ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর কাজের প্রভাবই যে একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনে বেশি প্রত্যক্ষ সেকথা বোঝার শক্তি লেখাপড়া জানা ভারতবাসীর অধিকাংশেরই আজ নেই। অথচ যদি সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব কম হত তাহলে উমর খালিদকে বাস্তার নিয়ে সেমিনারে বক্তৃতা দিতে আটকানো হত না, আই আই এস সি র পদার্থবিদ্যার কোন গবেষককে আটকানো হত স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কোন বক্তৃতা দেওয়া থেকে। বলা হত “এসব বলা যাবে না। এগুলো বেদবিরোধী।”
প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের লোকেরা আজকে জে এন ইউ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মার খেতে দেখে যেন ভাববেন না আপনাদের উপরে কোন আক্রমণ আসবে না। যে উদাহরণটা দিলাম ওটা যে কোনদিন সত্যি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রাচীন ভারতের বিমান প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। অমর্ত্য সেনকে যারা মূর্খ বলে তারা যে অশোক সেনকে বেশিদিন পন্ডিত বলে মানবে এমন মনে করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়েছে তার ফল এখন কতদিন ভোগ করতে হবে কে জানে? নতুন বাবা-মায়েরা যদি সন্তানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করেন তাহলে সুদূর ভবিষ্যৎটা ভাল হয়।
দায়িত্বটা অবশ্য শেষ অব্দি শিক্ষাব্যবস্থাকেই নিতে হবে। প্রেসিডেন্সির দুশো বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেছিলেন উচ্চশিক্ষায় কলাবিভাগের ছাত্রছাত্রীদেরও অঙ্ক শেখানো উচিৎ। পন্ডিত মানুষ, হয়ত ঠিকই বলেছেন, তবে দেশের এই দুঃসময়টা কেটে গেলে বোধহয় আগে দরকার স্কুলস্তর থেকে যত্ন করে ইতিহাস পড়ানোর সাথে সাথে একেবারে প্রাথমিক স্তরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতি পড়ানো।

আদিখ্যেতা নিপাত যাক

বাংলা ছবির পোস্টারে আজকাল আকছার ছবির নাম, পাত্রপাত্রীদের নাম লেখা হয় রোমান হরফে। ছবি দেখতে ঢুকেও দেখা যায় নাম দেখানো হচ্ছে রোমানে। এসব দেখে দর্শকের কিছু মনেও হয় না কারণ অনেক দর্শক, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা, বাংলা অক্ষর পড়তেই পারেন না — এটাই তো বাস্তব। তাহলে আবার “আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই” উদ্ধৃত করার ন্যাকামি কেন?

বছরে দুটো দিন ভারতীয় বাঙালির বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম উথলে ওঠে। যেসব হতভাগ্য শিশু উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনি আর নাককাটা রাজাকে চেনে না, সুকুমারের আশ্চর্য জগৎ থেকে বঞ্চিত তাদের বাবা-মায়েরাও ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ বিদীর্ণ করে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে নানা কথা লেখে। ভারতবর্ষের বাঙালি এভাবে কাকে ফাঁকি দিতে চায় বুঝি না।
বাংলা টিভি সিরিয়ালে গল্পের পরিস্থিতি অনুযায়ী হিন্দি ছবির গান বাজানো হয়, দীর্ঘদিন হল বাংলা ছায়াছবি তৈরি হচ্ছে তামিল, তেলুগু ছবির গল্প টুকে, বলিউডি নাচ গান সহযোগে। সেসব সিনেমা, সিরিয়াল যে কেউ দেখছে না তা-ও নয়। উনিশশো আশি নব্বইয়ের দশকে, নাহয় সিপিএমের দোষেই, চালু হয়েছিল ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতা। সে স্কুল ভাল কি মন্দ দেখার দরকার নেই, নামটা কলকাতার কোন বিখ্যাত স্কুলের মত শোনালেই হল। এখন আবার নতুন প্রবণতা হয়েছে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার জায়গা থেকেও সরিয়ে হিন্দীকে সেই জায়গাটা দেওয়া। সেটা না করে আর উপায় নেই কারণ বহুকাল হল কে কত শিক্ষিত তার প্রমাণ হিসাবে ধরা হয় তার গড়গড়িয়ে ইংরিজি বলতে পারার ক্ষমতাকে, ইদানীং আবার নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করতে গেলে কথার মধ্যে “ইয়ার”, “ঠিক হ্যায়,” “ক্যা বাত করতা হ্যায়” এসব বলা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। তা হোক। আপনি কেমন ভাষায় কথা বলবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু তাহলে আবার একুশে ফেব্রুয়ারি বা পয়লা বৈশাখ নিয়ে গদগদ হওয়ার কী আছে?
বাংলা ছবির পোস্টারে আজকাল আকছার ছবির নাম, পাত্রপাত্রীদের নাম লেখা হয় রোমান হরফে। ছবি দেখতে ঢুকেও দেখা যায় নাম দেখানো হচ্ছে রোমানে। এসব দেখে দর্শকের কিছু মনেও হয় না কারণ অনেক দর্শক, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা, বাংলা অক্ষর পড়তেই পারেন না — এটাই তো বাস্তব। তাহলে আবার “আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই” উদ্ধৃত করার ন্যাকামি কেন?
দেখুন তো, কিরকম পিছিয়ে পড়া মানসিকতা আমার! বাংলা বাংলা করতে গিয়ে এই বিশ্বায়নের যুগে বাঙালিরা পিছিয়ে পড়ুক আর কি। আমি একেবারে মৌলবাদী, তাই না?
মজার কথা হচ্ছে বাঙালি যখন বাংলার কদর করত তখন তারও সারা ভারতবর্ষে কদর ছিল। আর বাংলার কদর করার জন্যে বাঙালি কখনো অন্য ভাষার দোর বন্ধ করে দেয়নি। ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এবং সবচেয়ে ভাল ইংরিজি বাঙালিই শিখেছিল। কিন্তু তারজন্যে আমাদের পূর্বসুরিরা মাতৃভাষাকে বিসর্জন দেননি। সতীদাহ প্রথা রদের জন্য দিল্লীশ্বরের পক্ষ থেকে ইংল্যান্ডে বক্তৃতা দিতে যাওয়া রামমোহন রায় বহুভাষাবিদ ছিলেন, বাংলাতেও পন্ডিত। মাইকেল মধুসূদনের মত ইংরিজি পরবর্তীকালের কোন কনভেন্টশিক্ষিত বাঙালির আয়ত্ত হয়েছে কি?
বাংলা সাহিত্যও অন্য ভাষার সাহিত্যের রস টেনে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে শুরু থেকেই, সে বিদ্যাসাগরের দিকেই তাকান আর বুদ্ধদেব বসুর দিকেই তাকান। আমাদের সেরা কবিদের উপর ইংরিজি এবং ফরাসী কবিতার প্রভাব নিয়ে আস্ত বই লেখা যায়। এমনকি যে কবি “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি/ তাই পৃথিবীর রূপ আমি খুঁজিতে যাই না আর” লিখেছেন তিনিও সব দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন না।
বাংলার রঙ্গমঞ্চও তো গিরীশ ঘোষ থেকে শুরু করে শম্ভু মিত্র হয়ে সুমন মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত বিদেশী নাটকের থেকে যেমন নিয়েছে তেমন ফিরিয়েও দিয়েছে।
সুতরাং মাতৃভাষার চর্চা করার জন্য বাঙালির মৌলবাদী হওয়ার দরকার কখনো পড়েনি, পড়বেও না। বাঙালি কখনো ভাষা নিয়ে মৌলবাদী হয়নি বলেই ফাদার দ্যতিয়েন বলে এক দূরবিদেশী আজীবন বাংলার চর্চা করে গেলেন। বাংলা নাটকেরও তো পথ চলা শুরু রুশদেশের গেরাসিম লেবেদেফের হাত ধরে।
তবে আপনি বাংলার চর্চা করবেন কি করবেন না সেটা আপনার ব্যাপার। ইচ্ছে হলে আপনি, আপনার পরিবার খাঁটি সাহেব হয়ে উঠুন, কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বছরে দুদিন বাংলা ভাষার জন্যে কান্নাকাটি কোন পাপ স্খালনের জন্যে?

সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক

সে তখন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলমান প্রধান এলাকার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। চাকরিটা নিয়েছিল কলেজের চাকরি পাওয়া পর্যন্ত নমো নমো করে করবে বলে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ওকে এমনভাবে ভালবাসায় বেঁধেছে যে ও পড়েছে দোটানায়। আমাকে ফোন করার কারণ ঐ স্কুলের পরিচালন সমিতির দুর্নীতি। স্কুলের উন্নয়নের জন্য আসা সরকারী টাকা অন্য খাতে খরচা করা হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক ভাল মানুষ, পণ্ডিত। কিন্তু ঐ গ্রামেরই বাসিন্দা। ফলে জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করতে ভয় পান। সেই সুযোগে স্কুলের উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুনেছে আমি সাংবাদিক। তাই ফোন করেছে। যদি কাগজে এই দুর্নীতির খবর ছাপা যায়, দোষীদের শাস্তি হয়

৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এবং তারপরের কয়েকদিন এখনো ছবির মত মনে আছে। খুব চেনা কোন কোন মানুষের ভেতরের পশুকে সেই প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম। আমার বয়স তখন দশ। বড় হওয়ার গতিটা ঐ বয়সে বাড়তে শুরু করে। বলা যায় ৯২-৯৩ সালের ঐ দিনগুলো সেই গতিটাকে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এর প্রায় ছবছর পরে, ২৬শে জুলাই, ১৯৯৮ আমি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হই। আবাসিক কলেজ হওয়াতে বাড়ি ছেড়ে নিজ দায়িত্বে থাকার সেই শুরু। তার আগে ধর্মের আমার জীবনে কোন দৈনন্দিন ভূমিকা ছিল না। বাবা নাস্তিক, মা আস্তিক হলেও নিয়মিত পূজার্চনার পাট ছিল না বাড়িতে। রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মীয় পরিবেশ যে আমার বিশেষ ভাল লাগত না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দেদার আড্ডা দেওয়ার সুযোগ সে অস্বস্তি ভুলিয়ে দিত। কিছুটা সেইজন্যেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে কলেজের তিনবছরও দিব্যি ওখানে কাটিয়ে দিয়েছি।
ঘটনাচক্রে বিদ্যামন্দিরে আমার পাঁচ বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন প্রথম এনডিএ সরকারের পাঁচ বছরের মধ্যেই পড়ে। সব ব্যাপারেই ধর্মের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা তখন শুরু হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও ধর্ম নিয়ে, ধর্মের ঝান্ডাধরা রাজনীতি নিয়ে প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক হত। অবশ্য তখন মতান্তর মানেই মনান্তর ছিল না। যা-ই হোক আমার এক সহপাঠী ছিল যে মুসলমানদের দুচক্ষে দেখতে পারত না। সে বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা হিন্দু। তাকে আমি এবং আরো কয়েকজন কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না যে তার মত অভিজ্ঞতা অনেক মুসলমানেরও বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। তার মানে যেমন সব হিন্দু খুনে নয়, তেমনি সব মুসলমানও তার পরিবারের উপর অত্যাচার করা লোকেদের মত নয়। সে কিছুতেই মানত না। সে ঘুরেফিরেই বলত “ওরা ঐরকমই”। ২০০৩ এ কলেজ ছাড়ার পর থেকে আর তার সাথে যোগাযোগ নেই।
২০১০ সালের এক সকাল। নাইট ডিউটি করে এসে আমার তখন মাঝরাত। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। আমার পেশায় এরকম হলে প্রথমেই লোকে ভাবে বসের ফোন। চাকরিটা গেছে হয়ত। আমি সেকথা ভেবেই ধড়মড়িয়ে উঠে ফোনটা ধরেছি। দেখি অজানা একটা নম্বর। বসের ফোন নয় যখন তখন কেটে দেব ভেবেছিলাম। তারপর মনে হল মিটিয়ে দেওয়াই ভাল, নইলে আবার করতে পারে। কথা বলতে গিয়ে দেখি এ আমার সেই বন্ধু।
আমার বন্ধু প্রতিবাদ করতে গিয়ে গালাগালি খেয়েছে ছাত্রছাত্রীদের সামনে। আমাদেরই কোন সহপাঠীর থেকে। সে তখন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলমান প্রধান এলাকার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। চাকরিটা নিয়েছিল কলেজের চাকরি পাওয়া পর্যন্ত নমো নমো করে করবে বলে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ওকে এমনভাবে ভালবাসায় বেঁধেছে যে ও পড়েছে দোটানায়। আমাকে ফোন করার কারণ ঐ স্কুলের পরিচালন সমিতির দুর্নীতি। স্কুলের উন্নয়নের জন্য আসা সরকারী টাকা অন্য খাতে খরচা করা হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক ভাল মানুষ, পণ্ডিত। কিন্তু ঐ গ্রামেরই বাসিন্দা। ফলে জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করতে ভয় পান। সেই সুযোগে স্কুলের উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুনেছে আমি সাংবাদিক। তাই ফোন করেছে। যদি কাগজে এই দুর্নীতির খবর ছাপা যায়, দোষীদের শাস্তি হয়।
আমি তাকে বোঝালাম যে বহু গ্রামের স্কুলেই এই জিনিস ঘটে। ফলে বেশ বড় অংকের আর্থিক দুর্নীতি না হলে কাগজ ছাপতে রাজি হবে না। যদি হয়ও, শাস্তি দেওয়া তো কাগজের হাতে নয়। প্রশাসনিক নড়াচড়া না হলে দোষীদের রোষ এসে পড়বে ওরই উপরে। তাতে ওর ভীষণ বিপদ ঘটতে পারে। তাতে সে আমায় বলল “ঠিকই বলেছিস। কো এড স্কুল তো। কখন কি বদনাম দিয়ে দেবে! কিন্তু দুঃখটা কী জানিস তো? এই স্কুলের ছেলেমেয়েরা কি গরীব তুই ভাবতে পারবি না। এত গরীব আমি তুই চোখে দেখিনি। তাদের জন্য স্কুল। কত কষ্ট করে একটু লেখাপড়া করে এরা। অধিকাংশ মুসলমান আর কিছু আদিবাসী। এদের জন্য সরকারের স্কিম আছে। সেই টাকা ছোটলোকগুলো মেরে নিচ্ছে! আমার আর কি? নেট পাশ করে গেছি, বেশি পেছনে লাগলে চলে যাব। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে বল তো, প্রতীক?” আমি পরামর্শ দিলাম গোপনে ডি আই প্রমুখের সাথে যোগাযোগ করতে। বন্ধু বারবার বলে গেল ছেলেমেয়েগুলো কত কষ্ট করে, ঐ গ্রামের লোককে কি প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বেঁচে থাকতে হয়। গ্রামের সরল সোজা মানুষের উপর মাতব্বররা কিভাবে ছড়ি ঘোরায় সেকথাও বলল। কিন্তু একবারও বলল না “মুসলমান তো। ওরা ঐরকমই।”
বন্ধুটি ধর্মান্ধ — এই ধারণা নিয়েই কলেজ ছেড়েছিলাম। সেদিন ভুল প্রমাণিত হলাম। সেই আনন্দে আমার সেই সকালে আর ঘুম এলো না

জল পড়ে। পাতা নড়ে

এরপরে যা খেয়াল হওয়ায় চমকে উঠলাম তা হল বিশ্ববরেণ্য হয়ে ওঠার পরেও নিজের মানবিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সচেতনতা

vidyasagar

দুটো অতিপরিচিত লাইন সেদিন ঘোল খাইয়ে দিল ।
সন্ধ্যেবেলা এক অগ্রজ সাংবাদিকের ফোন “জল পড়ে । পাতা নড়ে । কার লেখা রে ?” অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পত্রপাঠ জবাব দিলাম “বিদ্যাসাগর । বর্ণপরিচয়ে আছে ।”
প্রতিপ্রশ্ন “ঠিক তো ? রবীন্দ্রনাথ নয় তো ?”
বাঙালির ছেলে । যে কোন বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের নামটা চলে এলে একটু বেশি সতর্ক হতেই হয় । আমি তাই বললাম “আচ্ছা চেক করে জানাচ্ছি ।” সহকর্মীদের দু’একজনকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি দুটো নামই উঠে আসছে । অগত্যা বিপদে পড়লে সমস্ত বুদ্ধিমান পুরুষের যা করা উচিৎ ঠিক তাই করলাম । গিন্নীর শরণ নিলাম । তিনি কন্যার বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ ঘেঁটে জানালেন “জল পড়ে । পাতা নড়ে ” কোথ্থাও নেই । প্রথম ভাগের তৃতীয় পাঠে আছে “জল পড়ে । মেঘ ডাকে ।” আর অষ্টম পাঠে আছে “জল পড়িতেছে । পাতা নড়িতেছে ।”
রহস্য ঘনীভূত হল দেখে এক অধ্যাপক বন্ধুকে ফোন করলাম । সে একবাক্যে “রবীন্দ্রনাথ” বলল । কিন্তু কোন্ বইতে আছে মনে করতে পারল না । আমারই মনে হল হয়ত সহজ পাঠ হবে । নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আবার সহধর্মিনীর সাহায্য নিতে হল । তিনি জানালেন রবীন্দ্রনাথ রচিত সহজ পাঠের প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ তো বটেই এমনকি বিশ্বভারতী সংকলিত তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগেও জল পড়েনি, পাতা নড়েনি ।
রহস্যের সমাধান যে দূর অস্ত সেকথা সেই অগ্রজকে জানাতেই তিনি মনে করিয়ে দিলেন জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষারম্ভ’ অধ্যায়ে লিখেছেন
“আমরা তিনটি বালক একসঙ্গে মানুষ হইতেছিলাম । আমার সঙ্গীদুটি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়ো । তাঁহারা যখন গুরুমশায়ের কাছে পড়া আরম্ভ করিলেন আমারও শিক্ষা সেই সময়ে শুরু হইল । কিন্তু সে-কথা আমার মনেও নাই ।
কেবল মনে পড়ে, “জল পড়ে পাতা নড়ে ।’ আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা ।”
অতএব লাইনদুটো রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা হতেই পারে না ।
অকাট্য যুক্তি । কিন্তু তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন হবে কী করে ? কবিগুরুর আদিকবিটি তাহলে কে ? বিদ্যাসাগর না হলেও অন্য কেউ তো বটে ? নাকি জীবনস্মৃতি লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করায় নিত্য বর্তমান ঘটমান বর্তমানের চেহারা নিয়েছে ? এই সেদিন পর্যন্তও তো বঙ্গসন্তানদের লেখাপড়া বর্ণপরিচয় দিয়েই শুরু হত । আর রবীন্দ্রনাথের তো শিক্ষারম্ভ বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই ।
কোথায় পাব উত্তর ? গুগল জ্যাঠাকে জিজ্ঞেস করে দেখলাম বিন্দুবিসর্গ জানে না এব্যাপারে । আমার সিধুজ্যাঠা নেই বলে আফশোস করতে করতে বাড়ি পৌঁছলাম । তারপর হঠাৎ ক্যাপ্টেন স্পার্কের মত মস্তিষ্কে একটা স্পার্ক হল । মনে পড়ল প্রশান্ত পাল রচিত রবিজীবনীর কথা । কী যেন পড়েছিলাম এই ব্যাপারে ! খুলে বসলাম ।
দেখি প্রথম খন্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে (রবীন্দ্রজীবনের চতুর্থ বৎসর) আছে
“যদিও রবীন্দ্রনাথের জন্য বিশেষ করে বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগ কেনার উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবু এই বইটিও তাঁর প্রথম শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেই মনে হয় ।” এরপর জীবনস্মৃতির উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে প্রশান্ত পাল লিখছেন “এই বর্ণনা বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগকেই মনে করিয়ে দেয় । অবশ্য সে ক্ষেত্রেও আমাদের দ্বিধা সম্পূর্ণ কাটে না । কারণ উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় পাঠে ‘জল পড়ে’ বাক্যটি থাকলেও ‘পাতা নড়ে’ বাক্যটি নেই এবং অষ্টম পাঠে বাক্যদুটিকে পাওয়া যায় একেবারে গদ্যাত্মক চেহারায় — ‘জল পড়িতেছে । পাতা নড়িতেছে ‘ — যাকে আদিকবির প্রথম কবিতা বলা শক্ত ।”
এরপর আছে আরেকটা বইয়ের আলোচনা যে বইতে রবীন্দ্রনাথ পড়েন “হিরণ্যকশিপুর পেট চিরছে নৃসিংহ অবতার” । অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন সিদ্ধান্ত করেছেন এইটা শিশুবোধক নামে একটা বই এবং এটাকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের পড়া প্রথম বইয়ের মর্যাদা দিয়েছেন । কিন্তু প্রশান্ত পাল ভিন্নমত । তিনি ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবই দিয়ে প্রমাণ করেছেন ওটা রবীন্দ্রনাথের পড়া প্রথম বই নয় । তিনি লিখছেন “এই পর্বে দু-দফায় যে বই কেনা হয়েছে, তাতে আমরা ‘প্রথম ভাগ’ [দাম দেখে বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগ হওয়াই সম্ভব বলে মনে হয়], বর্ণপরিচয় ও শিশুশিক্ষা-র কথাই জানতে পেরেছি, শিশুবোধক কেনা হয়েছে এমন কোন ইঙ্গিত মেলেনি ।”
এর কিছু পরে প্রশান্ত পাল লিখছেন
“রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারম্ভ হয়েছিল শিশুশিক্ষা দিয়ে এবং তার পরে সম্ভবতঃ বর্ণপরিচয়ের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল । তারও পরে পড়েছিলেন শিশুবোধক, আর এই শিশুবোধকেই পেয়েছিলেন মূলপাঠসহ চাণক্যশ্লোকের বাংলা পদ্যানুবাদ । আর এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পুরো ইতিহাসটিকে গুছিয়ে আনতে পারি এইভাবে : বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগ দিয়ে সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ যখন ভাদ্র [Sep 1864] থেকে শিক্ষারম্ভ করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁদের সঙ্গী ছিলেন না ; তিনি পাঠশালায় যেতে শুরু করলেন পৌষ মাস [Jan 1865] থেকে, শিশুশিক্ষা অবলম্বনেই তাঁর অক্ষর পরিচয় হয়, কিন্তু বর্ণযোজনা শেখেন বর্ণপরিচয় থেকে — ‘কর খল’ এবং ‘জল পড়িতেছে । পাতা নড়িতেছে” পাঠই তিনি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভাবী মহাকবির সমস্ত চৈতন্য গদ্যের সেই সাদাসিধে রূপের অন্তরে নিহিত ছন্দটুকু আবিষ্কার করে গদ্যের ঘটমান বর্তমানকে কবিতার নিত্য বর্তমানে পরিণত করেছে ।”
রহস্যের সমাধান হল । আমাদের সকলের পরিচিত লাইনদুটো বিদ্যাসাগরের রচনা নয়, রবীন্দ্রনাথের রচনাও নয় ; একটা ভুল উদ্ধৃতিমাত্র ।
কিন্তু এরপরে যা খেয়াল হওয়ায় চমকে উঠলাম তা হল বিশ্ববরেণ্য হয়ে ওঠার পরেও নিজের মানবিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সচেতনতা । জীবনস্মৃতির মুখবন্ধে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন
“জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে — তাহা কোন্-এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা । তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রং পড়িয়াছে তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে — সে-রঙ তাহার নিজের ভান্ডারের, সে-রঙ তাহাকে নিজের রসে গুলিয়া লইতে হইয়াছে ; সুতরাং পটের উপর যে ছাপ পড়িয়াছে তাহা আদালতে সাক্ষ্য দিবার কাজে লাগিবে না ।”
আমরা ওঁকে ঠাকুর বানিয়েছি কিন্তু উনি কখনোই আমাদের পাল্লায় পড়ে ভুলে যাননি যে আর পাঁচজনের মত ওঁরও ভুল হওয়া স্বাভাবিক এবং অনিবার্য।

বয়স হচ্ছে

ইতিমধ্যে এক মনোযোগী ছাত্রী হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ পা পিছলে রাস্তার হাঁটুজলে ঝপাং । হাতের খাতা “ভেসে যায় অলকানন্দা জলে”। সে প্রথমে লজ্জিত পরে হর্ষিত । তারস্বরে সঙ্গী ছেলেটাকে ডাকছে ” অ্যাই, কোথায় গেলি ? শিগগির আয় ।” ছেলে অমনি দৌড়ে এসে হাত ধরে তুলতে গেছে । কিন্তু মেয়ের চিৎকৃত নির্দেশ “আগে খাতা আগে খাতা ।” রোগা প্যাংলাটি দেখলাম কোন শালপ্রাংশু মহাভুজ বলীর চেয়ে কোন অংশে কম নয় । একহাতে পৃথুলা সঙ্গিনী আর অন্য হাতে তার হৃদি, থুড়ি খাতা, সে দিব্যি তুলে নিল

বয়সটা যে চল্লিশের দিকে এগোচ্ছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম গত পরশু বিকেলে । অফিস যাওয়ার পথে কলেজ স্ট্রিট গেছি গোটাদুয়েক বইয়ের খোঁজে । যেতে হবে ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে । আমার পরিষ্কার মনে পড়ল ওটা সূর্য সেন স্ট্রিটে । বীরবিক্রমে পুঁটিরাম পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন প্রায় রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে গেছি তখন মনে হল এবার স্মৃতি ব্যর্থ হয়েছে এটা মেনে নেওয়া উচিৎ । নিজের স্মৃতির উপর গর্বটাকে লক্ষ্মী ছেলের মত পিঠের ব্যাগে লুকিয়ে ফেলে এক প্রবীণার কাছে পথনির্দেশ চাইলাম । তিনি জানালেন দোকানটা কফি হাউসের আশেপাশে । প্যারামাউন্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, তখনও দোকানটার চেহারা কিছুতেই মনে পড়ছে না । অগত্যা একজন নবীন দোকানকর্মীর সাহায্য চাইলাম । তিনি একেবারে কোন্ বাড়িটা তা-ও বলে দিলেন ।
আমি যখন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের সামনে তখন ঝুপ করে নেমে পড়ল বৃষ্টি । ব্যাগ থেকে লটঘটে ছাতাটা বার করে খুলতে খুলতেই একটু ভিজে গেলাম ।
এন বি এ তে ঢুকতে গিয়ে দেখি তার সামনে একগাদা তরুণ তরুণী ভিড় জমিয়েছে । আমার মত তাদের অফিস যাওয়ার তাড়া নেই । তাই বৃষ্টি থেকে বাঁচবার তাগিদও তাদের যৎসামান্য । কোন একটা ছাউনির নীচে দাঁড়ানো যতটা না প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি ঘন হয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে আড্ডা দেওয়ার জন্যে । ঐ ভাবনাহীন প্রাণগুলোকে এড়িয়ে ঢুকে পড়লাম দোকানে । সেখানে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন আগলে বসে আছেন কয়েকজন প্রায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক যাঁদের চোখ ঢেকে ফেলেছে সিঁড়িতে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলো । বৃষ্টি দেখার আর উপায় নেই । আমার প্রবেশে ওঁরা একটু নড়েচড়ে বসেছিলেন কিন্তু আমি এমন একটা বই চেয়ে বসলাম যে হতাশ গলায় ওঁদের একজনকে বলতে হল “ও বই আর পাওয়া যায় না । অনেকদিন হল ।”
যা-ই হোক এক বন্ধুর জন্যে উপহার কেনার ছিল । সে বইটা শেলফের উপরেই রাখা ছিল । সেইটে কিনে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি আরো বেড়েছে, সেইসঙ্গে ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও । ভাবছি অনুজ অনির্বাণকে কফি হাউসে আসতে বলি, বহুবার প্রতিশ্রুত আড্ডাটা মারা যাবে । তারপর ভাবলাম এত বৃষ্টিতে আসবেই বা কী করে ? ভাবতে ভাবতে কফি হাউসের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি । বাইরের চেহারাটা দেখেই বুঝতে পারছি ভেতরে আমাকে আরো বেমানান, এমনকি হাস্যকর, দেখাবে । তাই বাইরেই কোনমতে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
বৃষ্টি কমার নাম নেই । রাস্তা দিয়ে বহু ছেলেমেয়ে ছাতা ছাড়াই দিব্য হেঁটে যাচ্ছে আমার কেজো জীবনকে মুখ ভেঙচিয়ে । কেউ কেউ ভিজতে ভিজতে হঠাৎ বৃষ্টি থেকে বাঁচার ভান করে ফুটপাথে এসে উঠছে । তাদের জায়গা ছাড়তে ছাড়তে আমি ক্রমশ কোণঠাসা । এমন সময়ে দেখি কফি হাউস থেকে একলাফে রাস্তায় নেমে পড়ে একটি মেয়ে তার প্রেমিকটিকে ভিজতে ডাকছে । ছোঁড়া এমন আহাম্মক (অথবা সাইনাসের রুগী) যে হাতের ছাতাখানা দেখিয়ে বলছে “তোর ছাতাটা বার কর না ।” দেখেই আমার মনে হল এ শালা শঙ্খবেলা দ্যাখেনি । শেষ অব্দি অবশ্য মেয়েটিরই জিৎ । সে বিজয়গর্বে গদগদ হয়ে প্রেমিককে বগলদাবা করে সংস্কৃত কলেজ পেরিয়ে উধাও হল ।
এইসব দেখতে দেখতে কখন এক ফুটপাথস্থ বই বিক্রেতার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি ! তিনি ঝাঁজিয়ে উঠলেন । আমি দেখলাম এখানে আমার না দাঁড়ানোই শ্রেয় । ময়ূরদের পাড়ায় দাঁড়কাকের দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অন্যায় । অতএব ঐ বৃষ্টিতেই রাস্তায় নেমে পড়লাম ।
জায়গা খুঁজতে খুঁজতে মনে হল হিন্দু স্কুলের সামনের পাঠ্য বইয়ের দোকানগুলো, যেগুলোকে বরাবর বইপাড়ার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় দোকান বলে মনে হয় আমার, সেগুলোর ছাউনিই আমার উপযুক্ত আশ্রয় । কারণ সেখানে দেখি পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু জানে না এমন ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা-মায়েদের ভিড় । আমার মত বা আরেকটু বড় মাপের ভুঁড়ি নিয়ে অনেকেই সেখানে আছে ।
সবে ওখানে দাঁড়িয়ে ছাতাটা বন্ধ করেছি, কোথা থেকে বেগুনী আর নীল শাড়ি পরা দুটো মেয়ে একটা ছাতায় আধাআধি ভিজতে ভিজতে এসে হাজির । একজন আরেকজনকে প্রচন্ড বকছে “তোকে বললাম শাড়ির ঝামেলা করিস না । এখন কী হবে ? হাঁটাও যাচ্ছে না ঠিক করে । কী ভারী হয়েছে শাড়িটা !”
অন্য বেচারির উত্তর “আমি কী করে জানব এরকম বৃষ্টি হবে ? সকাল থেকে রোদই ছিল ।”
এদের ঝগড়া উপভোগ করতে করতেই ভাবছি এত বৃষ্টিতে জল ঠেঙিয়ে অফিস যাব কী করে । হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সেই দুশ্চিন্তার কথা লিখেও ফেলেছি । ইতিমধ্যে এক মনোযোগী ছাত্রী হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ পা পিছলে রাস্তার হাঁটুজলে ঝপাং । হাতের খাতা “ভেসে যায় অলকানন্দা জলে”। সে প্রথমে লজ্জিত পরে হর্ষিত । তারস্বরে সঙ্গী ছেলেটাকে ডাকছে ” অ্যাই, কোথায় গেলি ? শিগগির আয় ।” ছেলে অমনি দৌড়ে এসে হাত ধরে তুলতে গেছে । কিন্তু মেয়ের চিৎকৃত নির্দেশ “আগে খাতা আগে খাতা ।” রোগা প্যাংলাটি দেখলাম কোন শালপ্রাংশু মহাভুজ বলীর চেয়ে কোন অংশে কম নয় । একহাতে পৃথুলা সঙ্গিনী আর অন্য হাতে তার হৃদি, থুড়ি খাতা, সে দিব্যি তুলে নিল ।
ততক্ষণে আমার নিজেকে আবার পাতিকাক মনে হচ্ছে । দুঃখে কা কা করে ডেকে উঠতে যাব, অমনি ফোনটা বেজে উঠল । সহকর্মী অর্ণবের ফোন “তুমি আমহার্স্ট স্ট্রিট ক্রসিং এ চলে আসতে পারবে ? আমি ওলাতে আছি । তোমায় তুলে নেব তাহলে ।” আমাকে তখন হেঁটে আন্দামান যেতে বললেও চলে যেতাম, আমহার্স্ট স্ট্রিট তো কোন্ ছার । Damsel না হলেও আমি তখন প্রবল distressed । সহকর্মীটি shining ওলায় আমাকে উদ্ধার করল ।

নিভৃতে যতনে

ধরা পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছি তখন । ভাবছি বাবা কি জানতে পেরে গেছে এক সহপাঠিনীর সম্পর্কে আমার দুর্বলতা ? আমি তো আমার দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছাড়া কাউকে বলিনি ! এমনকি মেয়েটাকেও কিছু বলিনি । বলার সাহসই নেই । সে আমার চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভাল, কি সুন্দরী কি সুন্দরী !

তখন সবে খিস্তি শিখছি । রোজ বিকেলে আর কেউ না থাকলেও আমরা দুজন মিলেই ক্রিকেট খেলতাম । একদিন শুনি বন্ধুটি উইকেট পুঁততে পুঁততে গুনগুন করে গাইছে “হাসপাতালের বেডে টি বি রোগীর সাথে খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা । তবু রেডিওটা টিভিটার সাথে সুর ধরে সারে জাঁহা সে আচ্ছা” । আমি এরকম আজব গান জম্মে শুনিনি । গানে খিস্তি ! ভাল লাগল বললে ভুল হবে তবে নতুন লাগল নিঃসন্দেহে । রাতে খেতে বসে বললাম “জানো এরকম নাকি একটা গান বেরিয়েছে ।” মা শুনেই ছ্যা ছ্যা করে উঠল । বাবা বলল “আমিও কোথায় একটা শুনলাম ! মাইকে বাজছিল । এসব হুজুগের গান । দুদিন খুব চলবে । তারপর আর খুঁজে পাওয়া যাবে না ।” আমার কৌতূহল কমল না ।
স্কুলে অনেক সহপাঠী দেখলাম গায়কের খুব ভক্ত । একজন আমাকে ক্যাসেটের নাম (অ্যালবাম বলতে তখন শুধু ছবি সাঁটার বই-ই জানতাম), অন্যান্য গানগুলো সম্পর্কে তো বললই, নচিকেতার অতীত বর্তমান সম্বন্ধেও বেশ কিছু জ্ঞান দিয়ে দিল । আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে গানগুলো শুনতে । কী করে যে শুনি ! তার কিছুদিন আগেই কয়েকটা গানহীন বছর কাটানোর পর বাবার বকেয়া মহার্ঘ ভাতার কিছুটা দিয়ে ফিলিপসের টু ইন ওয়ান কেনা হয়েছে । বাড়িতে নিয়ে এসে চালানো উচিৎ হবে না বুঝতে পারছি । ভাবছি বন্ধুটার বাড়ি একদিন যাওয়া যায় কিনা ।
হঠাৎ একদিন বাবা বলল “দ্যাখ তো বড়দার কাছে নচিকেতার ক্যাসেট আছে কিনা ?”
আমার অবসরপ্রাপ্ত বড়দাজেঠু গান আর বইয়ের পোকা । বোধহয় সেইজন্যেই মনটা আশ্চর্যরকমের জোয়ান । জগন্ময় মিত্রও শোনে আবার সুমন, নচিকেতাও শোনে । দৌড়ে নিয়ে এলাম । বাবার ভাবান্তরের কারণ জানার চেয়ে গানগুলো শোনার আগ্রহ ছিল অনেক বেশি । তারপর একঘন্টা ধরে দু পিঠের গানগুলো বাপ ছেলে মিলে শুনলাম । মা তিতিবিরক্ত । বাবাকে বলল “তুমিও বসে বসে এইসব গান শুনছ ?”
বাবা বলল “শুনতেই হবে । সময়ের ধ্বনি । কান না পাতলে যে সময়টাকে চেনা যাবে না । আমাদের যুব ফেডারেশনের শঙ্কর খুব জোর দিয়ে আজকে বলল ‘আপনি শুনে দেখুন, হাবুলদা । আপনার যদি খারাপ লাগে আমি নিজে শোনা ছেড়ে দেব ।’ তাই ভাবলাম শুনে দেখি । ভাল গান । হতাশায় ভরপুর । এত হতাশ যে খিস্তি দিচ্ছে । বেশ করছে । খিস্তি দেওয়ার মত হলে দেবে না ? ছেলেপুলেদের চাকরি নেই বাকরি নেই । খিস্তি দেবে না তো কি ? কিন্তু গলায় সুর আছে, গানে প্রাণ আছে ।”
“সে তো সুমনের গানও সময়ের গান । ওর তো খিস্তি দিতে লাগে না ?” মা বলল ।
“ওর গান সুন্দর করে সত্যি কথা বলে তাই ভাল । এর গান কর্কশ করে সত্যি কথা বলে তাই ভাল । দুটোই ভাল ।”
মা নাক সিঁটকে বলল “কিন্তু এ গান বেশিদিনের নয় । সুমনের গান থাকবে ।”
“হতে পারে । কিন্তু সে বিচার ইতিহাস করবে । আমি কে ?”
তারপরেই বাবা আমায় জিজ্ঞেস করল কোন্ গানটা সবচেয়ে ভাল লাগল । সত্যি কথাটা লজ্জায় বলতে পারলাম না । বললাম “শুধু বিষ শুধু বিষ দাও ।” বাবা বলল “বাজে কথা বলিস না । তোর সবচেয়ে ভাল লেগেছে “লাল ফিতে সাদা মোজা । আমি তোর বাপ রে ।”
ধরা পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছি তখন । ভাবছি বাবা কি জানতে পেরে গেছে এক সহপাঠিনীর সম্পর্কে আমার দুর্বলতা ? আমি তো আমার দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছাড়া কাউকে বলিনি ! এমনকি মেয়েটাকেও কিছু বলিনি । বলার সাহসই নেই । সে আমার চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভাল, কি সুন্দরী কি সুন্দরী ! ওরকম একটা মেয়ের যে আমাকে পছন্দ হতেই পারে না তা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই । তাছাড়া ও কাউকে বলে দিলে আমার বাবার মানসম্মান থাকবে না । বাবা আমায় বকবে কি মারবে সে তো পরের কথা । ফলে কায়দা করে তার নাম না লিখে কিছু বোগাস কবিতা লেখা ছাড়া আর কিছুই তো আমি করিনি ! তাও বাবা বুঝে গেল !
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, তখনই বাবা বলল “এই বয়সে সব কথা বাড়ি এসে আমাদের বলবি । বন্ধুর মত । মাকে হোক বা আমাকে হোক । তাহলে আমরা তোকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচাতে পারব । তবে একটা কথা আমাদেরও বলবি না । নীলাঞ্জনার কথা । তাকেও বলবি না । শুধু নিজের মনে তার সাথে কথা বলবি । এই বয়সে প্রেমে পড়লে স্বভাব ভাল থাকে যদি প্রেম ‘করা’ ব্যাপারটা মাথায় না ঢোকে । ভালবাসার চেয়ে ভাল জিনিস তো নেই । প্রথমবার এটা হলে নিজের মধ্যে প্রাণভরে অনুভব করতে হয় । বিশেষ করে প্রথম প্রেমের অনুভূতি আর ফেরত পাওয়া যায় না । এটা বলাবলি করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলিস না । ভালবাসাটা তোর । সে ভালবাসে কি না বাসে তাতে কী এসে গেল ?”
আজকে মনে হচ্ছে বাবা হওয়ার একটা বড় শিক্ষা আমার বাবা আমাকে সেদিনই দিয়েছে।

ভালবাসা কারে কয়

বেশ ছোটবেলাতেই আমার একটা বদভ্যাস হয়েছিল — প্রেমে পড়ার। জার্মান কবি শিলার একটা মজার কথা বলেছিলেন “মানুষ প্রেমে পড়ে বলে কবিতা লেখে না। কবিতা লেখে বলে প্রেমে পড়ে।” হয়ত সেভাবেও এই বদভ্যাসটা হয়ে থাকতে পারে।
যখন বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন দীর্ঘদিনের পরিচিত এক প্রাক্তন সহপাঠিনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। সে বেচারি কিন্তু এর বিন্দু বিসর্গ জানে না। এক বন্ধুর থেকে ফোন নম্বর নিয়ে তার বাড়িতে ফোন করি। করে চুপ করে থাকি যতক্ষণ না সে হ্যালো হ্যালো বলতে বিরক্ত হয়ে ফোন ছেড়ে দেয়। অন্য কেউ ফোন ধরলে কেটে দিয়ে আবার করি। সেবার সরস্বতী পুজোর সময়ে রোখ চাপল এবার “প্রপোজ” করবই। কোনবার ঐ ছুটিতে বাড়ি আসতাম না। সেই উপলক্ষ্যে এলাম। এক বন্ধুর সেই মেয়েটির বাড়িতে প্রসাদ খাওয়ার নেমন্তন্ন ছিল। তার সহায়তায় আমারও নেমন্তন্ন হল। গেলাম। কখনো তাকে শাড়ি পরে দেখিনি। এমনিতেই আমি ক্যাবলা, আরো কেবলে গেলাম। প্রগল্ভ আমি সেদিন এতটাই চুপচাপ ছিলাম যে সে বলতে বাধ্য হল “তুই তো আজ কথাই বলছিস না।”
পরদিন বিকেলে হোস্টেলে ফেরত যাওয়া। রিকশায় ওঠার সময়ে বাবার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বললাম আমি চলে গেলে ওটা পড়তে। বাবা অবাক। চিঠির প্রথম লাইনটা ছিল “বাবা, মনে হচ্ছে প্রেমে পড়েছি।” তারপর সেই মেয়েটির নামধাম ইত্যাদি।
হোস্টেলে ফেরার হপ্তাখানেক পরে বাবার চিঠি এল। তার সব কথা এখানে প্রাসঙ্গিক নয় কিন্তু বাবা লিখেছিল “Love is not just an emotion. It is a height to be achieved.” সেই উচ্চতায় উঠতে পেরেছি কিনা জানি না তবে চেষ্টা করে গেছি। আর শর্টকাট হিসাবে কখনো ভ্যালেন্টাইনস ডে কার্ড, ভেলভেটের হৃদপিন্ড, দামী চকোলেট — এসবের সাহায্য নিইনি। তাতেও কিন্তু আমাকে প্রেমিক হিসাবে অনেকেই অবিশ্বাস করেনি। যার সাথে গত ন’বছরের অভিন্ন জীবন, সে-ও করেনি।
আজকাল ভাবনা হয় আমার মেয়ের যখন প্রেমে পড়ার বয়স হবে তখন সে-ও বহুজাতিক গোলকধাঁধায় হারিয়ে গিয়ে প্রেমকে উপহারের মূল্যে আর উদ্ঘাটনের প্রাবল্যে মাপতে শিখবে না তো?

গায়কের মৃত্যু

subirsen

গায়কের মৃত্যু হয় কখন? যখন অনুগত সুরও অবাধ্য হয়ে ওঠে? যখন নিজের যশে আকন্ঠ মত্ত তিনি নতুন সুরের সন্ধান ছেড়ে দেন? নাকি সুর ছেড়ে গেলেও নাছোড়বান্দা গায়ক যখন অভ্যেসের দাস হয়ে দীর্ঘকাল গেয়ে যাওয়ার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন? এসব প্রশ্নের উত্তর যার কাছে যা-ই হোক, “সুর আর গান থেমে গেলে সবাই আমাকে ভুলে যাবে” — এই আশঙ্কা থেকে কোন গায়ক কখনো মুক্ত হতে পারেন না। রূঢ় সত্যটা হল কোন কোন গায়কের মৃত্যু হয় না। বাকিরা নিতান্ত মর। সুবীর সেন হয়ত অমর গায়কদের দলে পড়বেন না। জীবদ্দশাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ শ্রোতার কাছে তিনি রিমেক গানের ক্যাসেটের ফোল্ডারে লেখা নামমাত্রে পরিণত। তবু স্মৃতি বলে একটা জিনিস আছে, নস্ট্যালজিয়া বলে একটা গলার কাছে আটকে থাকা জিনিস আজও আছে। আর সেসব জিনিস গানকে যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে, আর কিছুকে তেমন নয়। মায়ের গলায় প্রথম শোনা কোন গান, ছেলেমানুষী প্রেমের দিনগুলোয় ভাল লাগা কোন গান কি কখনো হারিয়ে যায় স্মৃতি থেকে? সে যতই সাধারণ গায়কের গাওয়া গান হোক না কেন।
মনে পড়ছে এক বন্ধুর মুখে শোনা গল্প। তার বাবা -মায়ের প্রেমের বিয়ে। আমার বন্ধু এবং তার বোন স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রী যখন, তখনও দাম্পত্যকলহে বিশেষ সুবিধে না করে উঠতে পারলেই ওদের বাবা গেয়ে উঠতেন “এত সুর আর এত গান…” আর ওর মা গলে জল হয়ে যেতেন। কারণ ওঁদের প্রেমের প্রদোষে, যখন ভদ্রলোক সাহস করে মনের কথা ভদ্রমহিলাকে বলে উঠতে পারছিলেন না, তখন ঐ গানটি গেয়েই বাজিমাত করেছিলেন।
কালের নিয়মে আমার বন্ধুর বাবা-মা একদিন আর থাকবেন না। কিন্তু বন্ধুটি সুবীর সেনকে কখনো ভুলবে না। যখন ওঁরা থাকবেন না তখন সুবীর সেন আরও বেশি করে থাকবেন আমার বন্ধুর সাথে। সীমাবদ্ধ হলেও এ এমন অমরত্ব যা থেকে কোন গায়ককে বঞ্চিত করার সাধ্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত সমালোচকেরও নেই।

%d bloggers like this: