মেঘে মেঘে

কখনো ভাবিনি ঘন নীল আকাশ আর কাশফুলের মত মেঘ দেখে একদিন বিরক্তি আসবে, কান্না পাবে, চেপে রাখা আশঙ্কা চাগাড় দিয়ে উঠবে

কয়েক বছর হল বর্ষাকাল এসে পড়লেই আতঙ্কে ভুগি — যদি এই বর্ষাই শেষ হয়! যদি আগামী বছর থেকে আমাদের জনপদে আর বৃষ্টি না হয়! যদি দেখতে দেখতে আমাদের সুজলাং সুফলাং জায়গাটা মরুভূমি হয়ে যায়!
ছোটবেলায় কত পাখির বাসা দেখেছি বাড়ির আশপাশের নানারকম গাছে। চড়াইয়ের বাসা, শালিকের বাসা, কোকিলের বাসা, কাকের বাসা। আর সবচেয়ে সুন্দর বাবুইয়ের বাসা। আজকাল তো আর দেখি না, আমার মেয়ের সাত বছর বয়স হয়ে গেল। ছবির বাইরে বাবুই পাখির বাসা তো সে দেখে উঠল না! কেমন দেখতে হাঁড়িচাচাকে? মেয়ে জানে কি? যখন আতঙ্ক মাথায় ওঠে, তখন ইতিউতি তাকিয়ে তত পাখি তো দেখি না যত আমার সাত বছর বয়সে দেখেছি! এভাবে পাখিরা যদি হারিয়ে যেতে পারে, বৃষ্টিও তো হারিয়ে যেতেই পারে! পারে না?
আমার আশঙ্কা এত তাড়াতাড়ি এত ভয়ানক সত্যি হয়ে উঠবে আমিও ভাবিনি। বৃষ্টিতে ভেজা আমার বড় প্রিয়। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অনেক সময় এমন মুহূর্তে বৃষ্টি নামে যখন কিছুতেই ভেজার উপায় নেই। তবু, প্রতি বর্ষায় অন্তত একবার ভিজে চুপচুপে না হয়ে আমি ছাড়ি না। গত কয়েক বছর প্রথম সুযোগেই ভেজার চেষ্টা করি। কেবলই আতঙ্ক — এই যদি আমার জীবনের শেষ বৃষ্টি হয়!
এবার বর্ষায়, কি সৌভাগ্য, সেদিন আমাদের নবগ্রামে ঠিক সন্ধ্যের মুখে আকাশ অন্ধ করে বৃষ্টি এল। ঠিক আমার ছুটির দিনটায়। ঐ দিন আমি বিকেল, সন্ধ্যের বিনিময়ে ভাত-কাপড়ের সংস্থান কিনতে নদীপারের শহরে যাই না। উল্লসিত হয়ে নেমে পড়লাম বাড়ির উল্টোদিকের মাঠে। কড়কড়ে বাজের ধমক অগ্রাহ্য করে বৃষ্টির সাথে আমার নির্লজ্জ অভিসার। আশ মিটিয়ে ভিজে ঘরে ফিরেছি যখন তখনো ঝমঝমিয়ে রমরমিয়ে বৃষ্টি চলছে। ইউটিউবে চালিয়ে দিলাম “আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে।” আমার মতই একা একা উত্তমকুমার ভিজছেন আর লাজুক মাধবী গাছের তলায় বসে গাইছেন। সেদিন মাথা মুছতে মুছতে হৃষ্ট চিত্তে ভেবেছিলাম, যাক, আমরা এবারও বেঁচে গেলাম। আষাঢ়ের গোড়াতেই যখন এমন বৃষ্টি, তখন এ মরসুমে আর মরুভূমি দেখতে হচ্ছে না।
কিন্তু সেই শেষ। তারপর হপ্তাদুয়েক হয়ে গেল, বৃষ্টির আর দেখা নেই। অথচ আকাশে মেঘ আছে, মাঝে মাঝে সূর্যকে ম্লান করে দিয়ে আশা জাগিয়েও ব্যালে নাচের সুন্দরীদের মত হালকা সেসব মেঘ মঞ্চ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে একদিন সকালের দিকে জানলার দিকে চোখ পড়তেই দেখি আকাশের বেশ মাজা রঙ হয়েছে আর ছিটেফোঁটা ঝরছেও বটে। ভাবলাম এই বুঝি প্রতীক্ষার অবসান হল। সবে গুনগুন শুরু করেছি, মেয়ে আমার ফিসফিসিয়ে বলল “বাবা, এখনই গেয়ো না। ভাল করে শুরু হোক আগে।” আমল দিচ্ছিলাম না, কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যেই দেখলাম সাঁইত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার চেয়ে সাত বছরের আশঙ্কাই বেশি সত্যি। বৃষ্টি থেমে গেল।
সেই থেকে আকাশে মেঘ দেখে অদ্ভুত পীড়া হচ্ছে। কখনো ভাবিনি ঘন নীল আকাশ আর কাশফুলের মত মেঘ দেখে একদিন বিরক্তি আসবে, কান্না পাবে, চেপে রাখা আশঙ্কা চাগাড় দিয়ে উঠবে।
মধ্যরাত পেরিয়ে যখন নির্জনে বাড়ি ফিরি সেই সময় বালি ব্রিজের উপর ভেসে চলা কিছু কৃশকায় মেঘের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ জানালাম। বললাম “কেরালায় এত বৃষ্টি, হিমাচলে, অরুণাচলে, আসামে, বিহারে, এমনকি উত্তরবঙ্গের কিছু জেলা বানভাসি আর তোমরা কিনা উড়ে বেড়াচ্ছ, একফোঁটা বৃষ্টি নেই ভাগীরথীর এপারে ওপারে? কিসের অভাব তোমাদের? কী পেলে মোটাসোটা হয়ে ঝরে পড়ে একটু শান্তি দেবে?
কি বেইজ্জত যে হতে হল কী বলব। তারা বলল “যা চাই তা পারবে দিতে? তোমাদের তো আদ্ধেক পুকুর চুরি হয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলোতে সক্কলে মিলে আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলে মজিয়ে ফেলেছ। গাছ যা ছিল সেসবও সাফ করে কংক্রিট দিয়ে সৌন্দর্যায়ন করেছ। বলি জলীয় বাষ্প কই যে খেয়ে দেয়ে মোটা হব? আমরা কি তোমার বাথরুমের শাওয়ার নাকি, যে ইচ্ছে মত খুললেই জল পড়বে?”
মাথা নীচু করে শোনা ছাড়া উপায় ছিল না। অপমান হজম করে নিয়ে বললাম “তাহলে কি কোনদিন আর আমাদের ছোটবেলার বর্ষা ফেরত পাব না?” তারা হাত উল্টে বলল “সে কথা কি বলা যায়? মৌসুমীর কখন কী মর্জি হবে সে তো আর আমরা বলতে পারি না। সে আমাদের মালকিন বলে কথা। তবে বাপু যা চাইবে ভেবে চেয়ো। কোন বছর আমরা প্রাণ ভরে ঢাললে তো আবার তোমরা এক গলা জলে হাবুডুবু খাবে। জল উপচে পড়ার জায়গাগুলো তো আর কিছু রাখোনি।”
কোন মতে বললাম “তাহলে উপায়? হয় অনাবৃষ্টি নয় অতিবৃষ্টি — এই কি আমাদের ভবিষ্যৎ? আমার মেয়ের তবে রাস্তার জলে কাগজের নৌকো ভাসানো হবে না? বড় হয়ে মাধবী হওয়া হবে না?”
“কালবেলা তো নিজেরাই ডেকে এনেছ। এখন শঙ্খবেলা চাইলে হবে বাছা?” বলতে বলতে তারা কোন দিকে যে উড়ে গেল রাতের অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

ভূতের ভবিষ্যৎ

আমাদের দেশেও কিন্তু বিশ্বব্যাপী মার্কসবাদ বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের সময়ে ঐ মতবাদ গাড্ডায় পড়েনি, জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে অন্তত কমেনি ২০০৮-০৯ পর্যন্ত।

ভারতীয় ফ্যাসিবাদ ভূত দেখেছে। কমিউনিজমের ভূত।

এই পোস্টটা প্রাথমিকভাবে বন্ধু অমিত এর প্রশ্নমালার উত্তর। তিনটে প্রশ্নেরই উত্তর একবারে দিতে গেলে পোস্টটা অতিদীর্ঘ হয়ে যেত, আমার ওয়ালে কেউ প্রবন্ধ পড়তে আসে বলে মনে হয় না। আর আমার নিজেরও অতখানি লিখতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। তাই তিনটে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা তিনটে আলাদা আলাদা পোস্টে করার চেষ্টা করছি। অবশ্য উত্তরগুলো সব আমার কাছে আছে এমন দাবী করার মত মূর্খ আমি নই। সত্যি কথাটা হল অমিতের করা প্রশ্নগুলো আমি নিজেও নিজেকে করি অনেকসময়। সেগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। খুঁজতে খুঁজতে এখন অব্দি যা যা পেয়েছি সেগুলোই এখানে উত্তর হিসাবে লিখছি। আমার ধারণা আমাদের দুজনের মত আরো অনেকেই এই প্রশ্নগুলো নিজেকে বা অন্যদের করেন। তাঁদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই এর চেয়েও জোরালো উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। সেগুলো ভাগ করে নিলে সমৃদ্ধ হব।

১) সমাজতন্ত্রের ভবিষ‍্যৎ কি কেবল সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের শ্রেণীকক্ষে অধ‍্যয়ন ও গবেষণার বিষয় হয়ে থাকা? বাস্তব পৃথিবীতে এর প্রয়োগের সম্ভাবনা আজকের দিনে কতটা?

প্রথমেই বলি, এই প্রশ্নটা সেই আশির দশকের শেষে অর্ধেক পৃথিবীজুড়ে কমিউনিস্ট দেশগুলোর পতনের সময় থেকেই করা হয়ে আসছে। তার কারণ মনে করা হয়েছিল ক্ষমতা চলে গেল মানেই মার্কসবাদী/সমাজতন্ত্রবাদী পার্টিগুলো ধ্বংস হয়ে গেল এবং সমাজতন্ত্র নামক ব্যবস্থাটা যে চলে না সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। অতএব মানুষের আর এই আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটার প্রতি কোন আকর্ষণই থাকবে না।
কিন্তু সেরকমটা ঘটেনি। মিখাইল গরবাচেভের আমলে নিষিদ্ধ ঘোষিত রুশ কমিউনিস্ট পার্টি, গণশত্রু বলে চিহ্নিত কমিউনিস্ট পার্টি এখন পুতিনের রাশিয়ায় প্রধান বিরোধী শক্তি। ২০১৬য় হওয়া দুমার নির্বাচনে পুতিনের নিজের পার্টি ইউনাইটেড রাশিয়া ছাড়া আর যে তিনটে মাত্র পার্টি দুমায় জায়গা করে নিতে পেরেছিল তার মধ্যে একটা কমিউনিস্ট পার্টি (KPRF)। তাও তো কিভাবে পুতিনের রাশিয়ায় ভোট হয় তা নিয়ে অনেক লেখাপত্র আছে ইন্টারনেটে। ঐ নির্বাচনে যেমন অর্ধেক রাশিয়ান ভোট দিতেই আসেননি। পুতিন ২০১৬ তেই লেনিনকে বেশ গালমন্দ করেছিলেন, তবু গতবছর তাঁর সরকারকে রুশ বিপ্লবে উপলক্ষে একটু নাচনকোঁদন করতেই হল। মোদীকে যেমন এখনো গান্ধী, আম্বেদকরের নাম করতেই হয়। এ থেকে ঐ প্রয়াত আইকনদের আজকের দিনের জনপ্রিয়তার আঁচ পাওয়া যায়।
শুধু রাশিয়ার ব্যাপার নয়, পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে আজ অব্দি কমিউনিস্ট পার্টি বা সাধারণভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসীরা বিভিন্ন কোয়ালিশন সরকারে থেকেছে। অতএব মানুষ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারাকে একেবারে বাতিল করে দিয়েছে বলার মত কিছু ঘটেনি।
ইউরোপে যা ছিটেফোঁটা, লাতিন আমেরিকায় তাই-ই সুস্পষ্ট। এক দশক আগে কলকাতা ঘুরে যাওয়া উগো শাভেজের নেতৃত্বে বামপন্থী সরকারগুলো (তাঁর নেতৃত্বাধীন পার্টিগুলো কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি নয়) কিভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ভর দিয়ে নিজেদের মধ্যে জোট গড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেজ না ধরেই ঐ মহাদেশে বিকল্প অর্থনীতি চালাচ্ছিল সেগুলো সবাই জানে। শাভেজের অকালমৃত্যুর পর প্রবল প্রতিআক্রমণ হয়েছে। তার উপর নেতৃস্থানীয় ভেনেজুয়েলা, যার মূলধন খনিজ তেলের ভান্ডার, আন্তর্জাতিক বাজারে সেই তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে। ব্রাজিলে দিলমা রুসেফের সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগে পদচ্যুত করা হয়েছে অথচ এখনো কিছু প্রমাণ হল না। এইসব বিপর্যয় সত্ত্বেও বামদিকেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উরুগুয়ে এখনো যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি। বোধহয় সেইজন্যেই সে দেশের কথা আমরা এদেশে বসে বড় একটা শুনতে পাই না। আমিও জানতাম না। সেদিন লাতিন আমেরিকার বর্তমান অবস্থা নিয়ে ইকুয়েডরের বামপন্থী নেতা রাফায়েল কোরেয়ার একটা লেখায় দেখলাম তিনি প্রশ্ন তুলেছেন — ভেনেজুয়েলা যদি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ব্যর্থতার প্রমাণ হয়, তাহলে উরুগুয়ে সাফল্যের প্রমাণ নয় কেন?
কিউবার কথা এখনো বলিনি। পঞ্চাশ বছরের উপর অর্থনৈতিক অবরোধে থাকা একটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে অবরোধকারী আমেরিকাও মুখ খোলে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তার ভরসার জায়গা। সেটা ভেঙে পড়ার পরেও কিন্তু কিউবা ভেঙে পড়েনি। ফিদেল কাস্ত্রো সম্প্রতি মারা যাওয়ার পর কমিউনিস্টবিরোধী সংবাদমাধ্যমও স্বীকার করেছে যে কিউবানদের একটা ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান আছে। “একনায়ক” কাস্ত্রো মারা যাওয়ার পর যখন রাউল ওবামার সঙ্গে করমর্দন করলেন, তখন এদেশ, ওদেশ, সব দেশেই অনেকে বাঁকা হেসে বলেছিলেন “এইবার ওসব সোশালিজম টিজম ভুলে পুঁজিবাদের কোলেই এসে বসতে হবে।” এখন অব্দি কিউবা কোলে এসে বসেনি বোধহয়, কারণ বসলে তার প্রচারটা এমন জমিয়ে হত যে তার আওয়াজে লাল সন্ত্রাসমুক্ত কলকাতায় বসেও দিব্যি দাঁতকপাটি লেগে যেত।
এই প্রসঙ্গে একবার ব্রিটেনের লেবার পার্টির কথাও বলে নেওয়া যাক। এখন সে পার্টির নেতা জেরেমি করবিন, যিনি দীর্ঘদিন শীর্ষ নেতৃত্বের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি কারণ তিনি “ভীষণ বামপন্থী”। দুজনেই লেবার পার্টির নেতা কিন্তু টোনি ব্লেয়ারের সাথে করবিনের তফাত ততটাই যতটা রাহুল গান্ধী আর মানিক সরকারের। করবিন যেভাবে সাইকেলে চেপে নিজের এলাকায় ঘুরে বেড়ান আর পকেটের নোটবুক বার করে লোকের অভাব অভিযোগ লিখে নেন, সেটা পড়লে আমাদের এখানকার পুরনো কমিউনিস্ট নেতাদের মনে পড়তে বাধ্য। এই করবিন লেবার পার্টির নেতা হলে পার্টিটা সিপিএমের মত নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেবে — এই ছিল বেশিরভাগ পন্ডিতের পূর্বানুমান। অথচ গত ভোটে লেবারদের শক্তি বেড়েছে, ব্রেক্সিটের পরে। বিদেশনীতি নিয়ে করবিনের কথাবার্তা নেটে পড়ে দেখা যেতে পারে। প্রকাশ কারাত লিখে দেন বোধহয়।
এদিকওদিক বেশকিছু বন্ধু আছে আমার যারা কোথাও বামপন্থীদের জন্য কিছু উৎসাহব্যঞ্জক দেখলেই লিঙ্কটা আমায় পাঠিয়ে দেয়। তাদের দৌলতে ইদানীং জানতে পারছি আমেরিকাতেও নাকি ছেলেপুলেরা কমিউনিস্ট, সোশালিস্ট শব্দগুলো শুনলে অতটা নাক সিঁটকোচ্ছে না। কিন্তু ওসব আমি এখন কানে তুলছি না। ছোটবেলায় পাড়া প্রতিবেশীরা “তোমার ছেলে/মেয়ে অনেক বড় হবে” বললে মায়েরা যেমন বিড়বিড় করে “বালাই ষাট” বলে আর কি।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই যে আমাদের মনে হচ্ছে সমাজতন্ত্র বুঝি পাঠ্যবইয়েই সেঁধিয়ে গেছে, বাইরে কোথাও নেই, সেটা কিন্তু ঘটনা নয়। ব্যবহারিক রাজনীতিতেও সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলো লেনিনের মূর্তি যখন প্রথম ভাঙা শুরু হয় তার আড়াই দশক পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছে। লক্ষ্য করুন, আমি আগাগোড়া সমাজতান্ত্রিক শব্দটাই ব্যবহার করছি, সমাজতন্ত্র নয়। কারণ লেনিন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইতে বারবার বলেছেন সর্বহারার একনায়কতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর চেষ্টা করে একটা বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্র। সমাজতন্ত্রে পৌঁছলে পর কেমনভাবে চলতে হবে সেটা আমরা জানি না, মার্কসও লিখে যাননি।

“যে রাজনৈতিক রূপের আওতায় সমাজের সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন সম্ভব হইতে পারে, কল্পনাবিলাসীরা সেই রূপ ‘আবিষ্কার’ করিবার জন্য ব্যস্ত ছিল….
সমাজতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সমগ্র ইতিহাস পর্যালোচনা করিয়া মার্কস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, রাষ্ট্র অন্তর্হিত হইতে বাধ্য, এবং তাহার অন্তর্ধানের সংক্রমণ পর্বে (রাষ্ট্র হইতে অ-রাষ্ট্র সংক্রমণ) রাষ্ট্র গ্রহণ করিবে ‘শাসকশ্রেণী রূপে সংগঠিত মজুরশ্রেণী’র রূপ। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ স্তরের রাজনৈতিক রূপ আবিষ্কার করিতে মার্কস আত্মনিয়োগ করেন নাই।” (পৃ ৫৫; রাষ্ট্র ও বিপ্লব; ভি আই লেনিন; ত্রয়োদশ মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০০৮; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড)

সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনব্যবস্থাও, ভেঙে পড়বার আগে অব্দি সমাজতন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছয়নি। সত্তর বছর তার জন্যে যথেষ্ট বলেও মনে হয় না। আমাদের কবির ভাষায় “সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।”
এখন কেউ বলতেই পারেন “কমিউনিস্টগুলো হচ্ছে এইরকম ফালতু মাল। নিজের দেশে কী হচ্ছে তার ঠিক নেই, কেবল রাশিয়া, চীন, লাতিন আমেরিকা… যত্তসব।” সমালোচনাটা উড়িয়ে দিচ্ছি না। জবাব দিচ্ছি।
প্রথমত, আমি চীনের কথা বলিনি। কারণ চীনে লাল পতাকা টাঙিয়ে রেখে যেটা চলছে সেটা কোন সংজ্ঞা অনুযায়ী কমিউনিজম হতে পারে না। ওটা সমাজতান্ত্রিক পথই নয়। চীন ঘুরে আসা জাপানি কমিউনিস্ট পার্টির এক সদস্য ২০০৪ সালেই আমাকে বলেছিল “পশ্চিমবঙ্গের কৃষক চীনের কৃষকের চেয়ে অনেক ভাল আছে।” এখন চীন সম্পর্কে যা সংবাদ আমরা পাই তাতে সেই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে কিন্তু বিশ্বব্যাপী মার্কসবাদ বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের সময়ে ঐ মতবাদ গাড্ডায় পড়েনি, জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে অন্তত কমেনি ২০০৮-০৯ পর্যন্ত। বরং সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর শক্তি বাড়তে বাড়তে ২০০৪ এর লোকসভা নির্বাচনের পরে তারা নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাওবাদীদের হিসাবে আনলামই না।
মজার কথা, এদেশে মার্কসবাদীদের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করল যখন তাদের সরকার সমাজতান্ত্রিক নীতিবিরোধী নানা কাজকর্ম করতে শুরু করল, যার সবচেয়ে হাতেগরম উদাহরণ সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। ত্রিপুরায় কখনো যাইনি, নির্দিষ্ট করে তেমন কিছু জানি না। কিন্তু ত্রিপুরা তো ভারতের বাইরে নয়, আর ভারতও বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রাচীন ভূখণ্ড নয় কেবল। ফলে আজ ভারতে বামপন্থা যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন সেটা আমার কাছে খুব অবাক করার মত নয়, সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও সন্দিহান করে তুলছে না। এমনিতেও সংসদীয় গণতন্ত্রে কোন দলের সরকার চিরকাল চলতে পারে না। কেরালায় বামপন্থী সরকার আগামীদিনে না-ই থাকতে পারে। আগেও গেছে, ফিরে এসেছে। সরকারে নেই মানে হাপুস নয়নে কাঁদা ছাড়া কিছু করার নেই, আমার নীতি আদর্শ সব বৃথা হয়ে গেল — এরকম চিন্তাভাবনা যারা করে তারা ইতিমধ্যেই পাতলা হতে শুরু করেছে। মনে হয় সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যতের পক্ষে সেটা ভালই।
সামগ্রিকভাবে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবতে গেলে অনেকেই আজকাল বলেন মার্কস-এঙ্গেলস যে শ্রমিকশ্রেণীর কথা বলেছিলেন, সেই শ্রেণী কি আর আছে? আগামীদিনে তো আরো থাকবে না, কারণ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এসে যাচ্ছে। তাহলে বিপ্লবটা করবে কে? সমাজতন্ত্র ব্যাপারটারই বা প্রয়োজন কোথায়? সবকটাই ভাববার মত প্রশ্ন।
আমার ধারণা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যা করবে তা হল বিপুল পরিমাণে কর্মঠ অথচ কর্মহীন শ্রমিকশ্রেণী তৈরি করা (যেটা অটোমেশনের ধাক্কায় ইতিমধ্যেই কিছুটা হয়েছে এবং হচ্ছে)। এবং সে শ্রমিকদের একটা বড় অংশ হবে মার্কসের দেখা শ্রমিকদের থেকে একদম আলাদা। লেখাপড়া না জানা বা কম জানা নয়, বরং আমার মত সেন্ট্রালি এসি অফিসে কাজ করা, এসি ট্যাক্সি চড়া, ছুটির দিনে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় খেয়ে অভ্যস্ত শ্রমিকশ্রেণী। এদের সাথে যোগ হবে বাড়তে থাকা গরিব মানুষ। আজ তাদের যতই ঘেন্না করি, তাদের বিক্ষোভ, তাদের মিছিলকে যতই কর্মনাশা বলে দেগে দিই, সেদিন “অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।” সেই কম্বো বিস্ফোরক হতে পারে, কারণ যে যত বেশি হারায় সে তত বেশি ক্ষিপ্ত হয়। তার ফল কী হবে সেটা নির্ভর করছে সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব প্রয়োগের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, মানে যে রাজনীতিবিদরা, তাঁদের উপরে।
আলোচনাটা শেষ করি এরিক হবসবমের কথা বলে। গতবছর এই মার্কসবাদী ঐতিহাসিকের জন্ম শতবর্ষ গেল। ওঁর সম্পর্কে একটা লেখায় পড়ছিলাম, উনি একটা মজার paradox (স্ববিরোধ) এর কথা লিখেছিলেন। সেটা এই যে বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব পুঁজি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে দু দুবার বেঁচে গেছে। দুবারই বাঁচিয়েছে কে? মার্কসবাদ। প্রথমবার জন মেনার্ড কেইন্স গ্রেট ডিপ্রেশনের মুখে এসে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কিছু কিছু অর্থনৈতিক নীতি পুঁজিবাদী দেশগুলোকে শিখিয়ে দিলেন, জনগণের অসন্তোষ ঠান্ডা হল। দ্বিতীয়বার যুদ্ধের ময়দানে ফ্যাসিবাদকে হারিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঁচিয়ে দিল বড় বড় পুঁজিবাদী দেশগুলোকে।
এখন কথা হচ্ছে কমিউনিস্ট দেশগুলো তো আর নেই, এদিকে বাজার বাড়তে বাড়তে তার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। তাই এখন কিউবার পুঁজিবাদের দরকার হোক আর না-ই হোক, পুঁজিবাদের কিউবার বাজারটা দরকার। আর ভারত, চীনকে তো দরকারই। তা লাভের বখরা নিয়ে যদি লেগে যায় যুদ্ধ, ঠেকাবে কে?
ওদিকে মেরুর বরফ গলছে, ট্রাম্প বলছে “ওসব বাজে গল্প। তেল আমি পোড়াবই।” মোদী জঙ্গল কেটে হাইওয়ে বানিয়ে দিচ্ছে যাতে আরো ব্যবসা, আরো মুনাফা হয়। যারা লাভের কড়ি গোনে তারা বলছে “চুলোয় যাক গ্রহটা। আমার লাভের কড়ি বাড়া চাই।” তা গ্রহটা সত্যিই যখন চুলোয় যাবে (স্টিফেন হকিংকে যদি নির্বোধ বলেন, তাহলে আলাদা কথা। নইলে আর শ খানেক বছরের ব্যাপার) তখন ঐ ট্রাম্পসুলভ ধনীরা নাহয় Wall-E ছবিটার মত মহাশূন্যে অত্যাধুনিক মহাকাশযানে ভেসে বেড়াবে। আমাদের সন্তানেরা এবং তাদের সন্তানেরা যাবে কোথায়? তাহলে এখন উপায়?
ভাবতে গেলেই মনে হয় না, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, উদারনৈতিক অর্থনীতি — এসবে লাগাম দরকার? আরো ভাবলে হয়ত মনে হবে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে না ভেবে ভাবা দরকার যে সমাজতন্ত্র প্রয়োগ না করা গেলে সভ্যতার ভবিষ্যৎ কী?

%d bloggers like this: