ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

অ্যালাস্টেয়ার কুককে নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আছে। টেস্ট ক্রিকেটে বারো হাজারের বেশি রান করা ব্যাটারকে এমনিতেই কোনো ক্রিকেটপ্রেমী ভোলেন না। তার উপর কুক জীবনের প্রথম এবং শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধেই, আর দুটোতেই তিন অঙ্কের রান করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ২০১১ সালে ভারতের অভিশপ্ত ইংল্যান্ড সফরের সময়ে এজবাস্টন টেস্টে ক্রিকেটজীবনের সর্বোচ্চ স্কোরেও (২৯৪) পৌঁছন। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলা কুক এখনো দাপটে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছেন। এ মরসুমে এসেক্সের এই ওপেনারের গড় এখন ৬০। পাঁচটা ম্যাচেই তিনটে শতরান করে ফেলেছেন এবং দুই দশকব্যাপী প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কেরিয়ারে আগে কখনো যা পারেননি, তা ঘটিয়ে ফেলেছেন গত ম্যাচে। দুই ইনিংসেই শতরান করেছেন।

এদিকে কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে। জো রুটের কাছে ইংল্যান্ডের কর্মকর্তা, ক্রিকেটপ্রেমী – সকলেরই বিরাট আশা ছিল। কিন্তু ব্যাটার হিসাবে যথেষ্ট সফল হলেও অধিনায়ক হিসাবে রুট একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। গত আঠারোটা টেস্টের মধ্যে মাত্র একটা জিতেছে ইংল্যান্ড। ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যে যে কারণে ইংল্যান্ডের এমন হাঁড়ির হাল, তার অন্যতম হল ওপেনারদের ব্যর্থতা। কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে অনেককে নির্বাচকরা সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু কেউই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। কুক ইতিমধ্যে স্যার অ্যালাস্টেয়ার কুক হয়ে গেছেন। মানে ক্রিকেট মাঠে তাঁর কীর্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং রানী এলিজাবেথ। জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড সম্প্রতি খোলনলচে বদলে ফেলেছে। নতুন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার রব কী, নতুন টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস আর টেস্ট দলের কোচের দায়িত্বে এসেছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। দেশটার নাম ভারত হলে এতদিনে হাউস অফ কমন্সে সব দলের সাংসদরা মিলে রেজলিউশন পাস করাতেন, নতুন অধিনায়ক আর কোচকে কুককে অবসর ভেঙে ফিরে আসতে বলতেই হবে। কুক নিজেও শতমুখে সংবাদমাধ্যমকে বলে বেড়াতেন, তিনি এখনো দারুণ ফিট এবং জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন।

কিন্তু দেশটার নাম ইংল্যান্ড। কয়েকদিন আগে কুককে এক সাক্ষাৎকারে রব কীর নিয়োগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ভালই তো। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের এখন একেবারে নতুন করে শুরু করা উচিত। নিজের সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। বরং বলেই দিলেন যে পুরনো সবকিছু ভুলে এগোনো উচিত।

স্নেহময় জ্যাঠামশাইরা পরীক্ষায় ফেল করা ভাইপোদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যে এরকম বলতেন। তা কুকজেঠুর বয়স কত? সাঁইত্রিশ বছর চার মাস। চলতি আইপিএলে গত ম্যাচটা (তা-ও বিপক্ষের দ্রুততম বোলার লকি ফার্গুসন কোনো অজ্ঞাত কারণে বল করতে এলেন বিরাট আর ফ্যাফ দু প্লেসি সেট হয়ে যাওয়ার পর এবং মাত্র দু ওভার বল করলেন) বাদ দিলে চূড়ান্ত ব্যর্থ (তিনটে ম্যাচে প্রথম বলে আউট; ১৪ ম্যাচে ৩০৯ রান, গড় ২৩.৭৬) বিরাট কোহলির বয়স কত? সাড়ে তেত্রিশ। অর্থাৎ কুক বিরাটের বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাঁর এখনকার ফর্ম দেখে মনে করা অমূলক নয় যে অবসর না নিলে তিনি এতদিনে শচীন তেন্ডুলকরের টেস্ট ক্রিকেটে মোট রানের রেকর্ড (১৫,৯২১) আর সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড (২০০) – দুটোরই কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন। অথচ এখন কনিষ্ঠরা পারছে না দেখেও ফিরে আসার নাম করছেন না। বোর্ডও এখন পর্যন্ত তাঁর নাম করেনি। ভক্তরা কেউ কেউ সোশাল মিডিয়ায় কুকের নাম ভাসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও তা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করছেন না। এদিকে বিরাটকে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক – অনেকেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি নাকি একটানা অনেকদিন খেলে ফেলেছেন, কদিন বিশ্রাম নিলেই হইহই করে রানে ফিরবেন। বিরাটও গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচের আগে আইপিএলের সরাসরি সম্প্রচারকারী সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বললেন তাঁর উপর দিয়ে সত্যিই অনেক ধকল গেছে, তাই বিশ্রাম নিলে ভালই হয়। মজার কথা, বিশ্রাম নেওয়া যে প্রয়োজন সেটা তাঁর আইপিএলের শেষ লগ্নে এসে খেয়াল হল। বিরাট মনে করেন আমাদের প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট রবি শাস্ত্রীর চেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর নেই। তিনি শুধু বিরাটকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেননি, বলেছেন বিশ্রামের পর বিরাট আরও ছ বছর খেলতে পারে। অর্থাৎ কুক যে বয়সে ফর্মে থেকেও জ্যাঠামশাইয়ের ভূমিকা উপভোগ করছেন, বিরাট সেই বয়সেও খেলে যাবেন। অথচ বিরাটের ফর্ম কিন্তু এবারের আইপিএলে হঠাৎ উধাও হয়েছে এমন নয়। এই সাইটেই আগে লিখেছি, কোনো ধরনের ক্রিকেটেই তিনি তেমন প্রভাব ফেলতে পারছেন না অনেকগুলো বছর হয়ে গেল।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নতুন করে শুরু করার কাজটা আগেই করেছে, কারণ আইসিসি টুর্নামেন্টে বারবার ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা দরকার। শাস্ত্রীর জায়গায় এসেছেন রাহুল দ্রাবিড় আর সাদা বলের অধিনায়ক করা হয়েছিল রোহিত শর্মাকে। বিরাট টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ছাড়া অন্যগুলোর লাগাম নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন, বোর্ড সে গুড়ে বালি দিয়ে পরে টেস্ট ক্রিকেটেও রোহিতকেই নেতা করে দিয়েছে। তা রোহিতের বয়স কত? পঁয়ত্রিশ। টেস্ট ক্রিকেট কোনোদিনই রোহিতের সেরা মঞ্চ ছিল না। ন বছর আগে টেস্ট অভিষেক হলেও এতদিনে মোটে পঁয়তাল্লিশটা টেস্ট খেলেছেন, শতরান মাত্র আটটা। বিদেশে প্রথম শতরান পেলেন গত ইংল্যান্ড সফরে। তিনি আসলে সাদা বলের যম। অথচ গত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে বিরাটের পাশাপাশি তিনিও ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবার আইপিএলেও মোটেই রানের মধ্যে নেই (১৩ ম্যাচে ২৪৮ রান; গড় ২০.৪৬)। একাধিকবার আইপিএল খেতাব জয়ী মুম্বাই ইন্ডিয়ানস যে এবার পয়েন্ট টেবিলের একেবারে তলায় পড়ে আছে, তার অন্যতম কারণ রোহিতের খারাপ ফর্ম।

এ বছর ফের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি। স্বয়ং অধিনায়ক এরকম ফর্মে থাকলে দলের অবস্থা কী হবে? উপরন্তু দলের সবচেয়ে বড় তারকা বিরাটকে দীর্ঘদিন ধরে টি টোয়েন্টির উপযোগী দেখাচ্ছে না। তিনি ইদানীং এত সাবধানে ব্যাট করছেন (বৃহস্পতিবার গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে ৫৪ বলে ৭৩ রান করার আগে অব্দি স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৩.৪৬), যে তিনি বড় রান করলে দলের মোট রান ভাল জায়গায় পৌঁছনো শক্ত। অথচ এই দুই তারকা থাকতে ঋতুরাজ গায়কোয়াড়, রাহুল ত্রিপাঠী, রাহুল টেওটিয়াদের মত বড় শট নিতে পারা ব্যাটারদের দলে জায়গা হবে না।

তবে ভারতীয় ক্রিকেট যে ভারত দেশটার মতই পিছন দিকে এগোতে চাইছে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই দুজন নন। সাঁইত্রিশ বছরের কুক যদি জেঠু হন, আগামী ৭ জুলাই একচল্লিশে পা দিতে চলা মহেন্দ্র সিং ধোনি নিঃসন্দেহে পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর যে ইচ্ছামৃত্যু, তা সেই ২০১১ সালেই প্রমাণ হয়ে গেছে। দল পরপর আটটা টেস্ট হারার পরেও ধোনির অধিনায়কত্ব যায়নি, বরং সে প্রস্তাব নির্বাচন কমিটির মিটিংয়ে তোলার পরে মোহিন্দর অমরনাথের নির্বাচকের চাকরি গিয়েছিল। ভারতের একদিনের ক্রিকেটের দলও ধোনিকে বয়ে বেড়িয়েছে বছর চারেক। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল আর বড় শট নিতে পারেন না, অন্য প্রান্ত থেকে কেউ সে কাজটা করলে তিনি বড়জোর এক-দুই রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখতে পারেন, যা অনেকসময় জেতার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবু তাঁকে অবসর নিয়ে প্রশ্ন করলে বেজায় রেগে যেতেন। ২০১৬ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে ভারতের বিদায়ের পর তো নির্লজ্জতার শিখরে উঠেছিলেন। এক অস্ট্রেলিয় সাংবাদিক এই প্রশ্ন করায় তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনের ডায়াসে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি ধোনির অবসর দেখতে চান কিনা। তিনি তো আর ভারতীয় নন, যে কোনো আত্মীয় পরিজন থাকবে যে ধোনির জায়গায় খেলতে পারে।

এন শ্রীনিবাসনের থেকে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন বলেই ধোনি একদিনের ক্রিকেট খেলতে পেরেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপ অব্দি। অথচ ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে চার, ছয় মারার ক্ষমতা তো বটেই, গড়ও কমে গিয়েছিল। কেরিয়ারের ব্যাটিং গড় যেখানে পঞ্চাশ, সেখানে এই চার বছরের গড় নেমে এসেছিল চুয়াল্লিশে। চারে নেমে খেলতে না পারলে টিভি স্টুডিওতে বসে বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বলতেন ধোনিকে পাঁচে খেলানো উচিত। পাঁচে না পারলে বলতেন ছয়ে। অর্থাৎ দল তাঁকে বয়ে বেড়াত। কালে ভদ্রে একটা ম্যাচে উইনিং স্ট্রোক নিলেই ফের সবাই মনে করিয়ে দিত, ধোনি সর্বকালের সেরা ফিনিশার। আর ধোনিকে এসব জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বারবার বলতেন, আগের মত অত ছয় মারেন না তো কী হয়েছে? তিনি তো ফিট আছেন। যেন খেলাটা ক্রিকেট নয়, জিমন্যাস্টিক্স।

আসলে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে অনেক সমস্যা মিটে যায়। তাই ধোনি নির্বিঘ্নেই খেলে ফেলেন আরও একটা বিশ্বকাপ। কিছু বিশেষজ্ঞ আর অন্ধ ভক্ত আজও বলেন “যদি গাপ্টিলের থ্রোটা উইকেটে না লাগত…”। ভুলে যান যে ধোনি সেদিন পঞ্চাশে পৌঁছতে লাগিয়েছিলেন বাহাত্তরটা বল, মাত্র একটা চার আর একটা ছয় মেরেছিলেন। রবীন্দ্র জাদেজা ৫৯ বলে ৭৭ রান করেছিলেন বলে নিউজিল্যান্ডের জয়ের ব্যবধান আরও বড় হয়নি – এটুকুই সান্ত্বনা। নইলে শেষ ওভারে ধোনির ভেলকি দেখানোর সম্ভাবনা আরও আগেই শেষ হয়ে যেত। রাজনীতিতে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু খেলার মাঠে পরিণাম বদলানো যায় না।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

এতদিন পরে হৃদয় খুঁড়ে আবার এসব বেদনা জাগাতে হচ্ছে, কারণ এবারের আইপিএলে ধোনি ওই জাদেজাকেই হাসির পাত্র বানিয়ে ছেড়েছেন। এমনিতে চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক শ্রীনিবাসনের কোম্পানি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের অন্যতম ডিরেক্টর ধোনি। সুপার কিংস দলটা সে অর্থে তাঁর নিজের সম্পত্তি। যার ব্যাট, যার উইকেট তাকেই খেলতে নেব না – এ জিনিস পাড়া ক্রিকেটেই চলে না, আইপিএলে কী করে চলবে? ফলে ধোনির উইকেটরক্ষায় যতই শিথিলতা আসুক, ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতা যতই কমে যাক, এ দলে তিনি যতদিন খেলতে চাইবেন ততদিনই খেলবেন। সমস্যা হল, তিনি কেবল খেলছেন না, খেলতে গিয়ে অন্যদের কোণঠাসা করছেন। আইপিএল শুরু হওয়ার মুখে ঘটা করে ঘোষণা করা হয়েছিল, পিতামহ অধিনায়কের সিংহাসনটি স্নেহভাজন জাদেজার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরু হতেই দেখা গেল ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তন – সবকিছুতেই ধোনির কথাই শেষ কথা। জাদেজা নেহাতই রাবার স্ট্যাম্প। অবশ্য তাতেও সুপার কিংস দলের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হওয়া আটকায়নি। কিন্তু ব্যাটে, বলে ব্যর্থ জাদেজা নটা খেলার মধ্যে ছটা হারার পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে চাইলেন। ধোনি মুকুট ফিরিয়েও নিলেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঋতুরাজ সিংয়ের মত তরুণতর কাউকে দায়িত্ব দিলেন না। তাহলে মরসুমের শুরুতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন ছিল? জাদেজাও তো তেত্রিশ পেরিয়েছেন, কচি খোকাটি নন। তাঁর হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে কোন মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের আশা ছিল? জাদেজা এই মুহূর্তে চোট-আঘাতের কারণে মাঠের বাইরে। এই টানাপোড়েনে তাঁর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল কিনা তিনি মাঠে না ফেরা পর্যন্ত জানা যাবে না। যদি ধরে থাকে, তাহলে সুপার কিংসের চেয়ে বেশি ক্ষতি কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট দলের।

আসলে বাকি পৃথিবী সামনের দিকে তাকাতে চায়, আর আমরা চাই অতীতের গৌরবে বুঁদ হয়ে থাকতে। এ আমাদের জাতীয় চরিত্র। তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে অতি বড় ক্রিকেটারেরও ক্ষমতা কমে আসে, আজ না কমে থাকলেও পরের বড় টুর্নামেন্টটা আসতে আসতে যে কমে যেতে পারে – এসব কথা না তাঁরা নিজেরা মানেন, না তাঁদের ভক্তকুল মানে। তারকারা আয়নায় মুখ দেখতে পান না, কারণ মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। ফলে ব্যাটে বলে হচ্ছে না, পা বলের লাইনে যাচ্ছে না, রিফ্লেক্স কমে গেছে, বহু বছর ধরে অতিমাত্রায় জিম করার ফলে টানা দু ঘন্টা ব্যাট করলেই পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে – এসব যখন ক্রিকেটার নিজে বুঝতে শুরু করেন, তখনো সবাই মিলে কানের কাছে বলতে থাকে “ও কিছু নয়। কদিন ব্রেক নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” এমনটাই এনডর্সমেন্টের যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে হয়ে আসছে। যেনতেনপ্রকারেণ চল্লিশ অব্দি খেলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন শচীন। ধোনি ভাবলেন তিনিই বা কম কিসে? হয়ত পঁয়তাল্লিশকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছেন। বিরাট ভাবছেন তিনি তো কোনো অংশে ধোনির চেয়ে কম যান না। রোহিত সবে অধিনায়ক হলেন, পঞ্চাশ ওভার আর কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে তাঁরও ঝুড়ি ঝুড়ি রান আছে। তিনিই বা চল্লিশ অব্দি খেলার কথা ভাববেন না কেন? “ক্রিকেটের ঈশ্বর” তো শচীন, কুক তো নন। ফলে টেওয়াটিয়া, ত্রিপাঠীদের বেলা মেঘে মেঘেই বাড়বে।

ঋদ্ধিমান সাহার বেলায় দ্রাবিড় ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই ছেলেখেলা তিনি চলতে দেবেন না। এই ২০২২ সালেও উনবিংশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের গন্ধে মাতাল বাঙালি তা নিয়ে বিস্তর গোল করেছিল। এবারের আইপিএলে গুজরাট টাইটান্সের ওপেনার হিসাবে ঋদ্ধিমানের সাফল্যে আবার গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দল নির্বাচনের সময়ে যদি তরুণদের সুযোগ দেওয়ার নীতি ভুলে গিয়ে তারকাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু মানতেই হবে, পোর্টফোলিওতে যথেষ্ট পরিমাণ এনডর্সমেন্ট থাকলে ঋদ্ধিমানের বয়সও ঢেকে যেত।

*সব পরিসংখ্যান ১৯ মে, বৃহস্পতিবারের গুজরাট টাইটান্স বনাম রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ম্যাচ পর্যন্ত

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

ঝুলন সেরা বাঙালি ক্রিকেটার? মোটেই না

ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে লেখা অসম্ভব। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে অনায়াসে লেখা যেত। রেকর্ড বইয়ে সর্বোচ্চ রানের ওপেনিং জুটির তালিকার একেবারে শীর্ষে পঙ্কজ রায়ের নাম ছিল ঠিকই, কিন্তু রেকর্ড বই ইতিহাস নয়। একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলার পাকাপাকি জায়গা তৈরি করেছেন দুজন। একজন অবসর নেওয়ার দেড় দশক পরেও সারাক্ষণ সংবাদের শিরোনামে, বাঙালির নয়নের মণি। অর্থাৎ সৌরভ গাঙ্গুলি। অন্যজন কে, বাজি রেখে বলতে পারি, আপনি ভুরু কুঁচকে ভাবছেন।

এই শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে ফিক্সিং কেলেঙ্কারির বিপর্যয় কাটিয়ে অধিনায়ক হিসাবে সৌরভ যখন ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বদলে দিচ্ছিলেন, সেই সময়েই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাইতে একটি একদিনের ম্যাচে ভারতের হয়ে খেলতে শুরু করেন ঝুলন গোস্বামী। সে বছরই টেস্ট অভিষেক। ঝুলনের শুরুটা সৌরভের মত সাড়া জাগানো হয়নি। প্রথম টেস্টে এই ডানহাতি জোরে বোলার কোনো উইকেট পাননি। কিন্তু গত কুড়ি বছর ধরে ভারতের মহিলা দলের প্রায় সমস্ত স্মরণীয় জয়ে ঝুলনের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ২০০৬ সালে ভারতীয় মহিলারা ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতেন। প্রথম টেস্টে লেস্টারে নৈশপ্রহরী হিসাবে ঝুলন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতরান করেন। আর টনটনের দ্বিতীয় টেস্টে তিনি একাই একশো। প্রথম ইনিংসে ৩৩ রানে পাঁচ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রানে পাঁচ উইকেট। একদিনের ক্রিকেটে ঝুলন প্রকৃতপক্ষে একজন কিংবদন্তি। চলতি বিশ্বকাপে তিনি মহিলাদের বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হলেন, তারপরেই মেয়েদের একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসাবে ২৫০ উইকেটের মালিক হলেন।

যাঁরা মেয়েদের ক্রিকেটের খবর রাখেন তাঁরা জানেন, ভারতের মহিলাদের দলে এই মুহূর্তে দুজন আছেন যাঁরা সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়েন। কীর্তির দিক থেকে অধিনায়ক মিতালী রাজ যদি মেয়েদের ক্রিকেটের শচীন তেন্ডুলকর হন, ঝুলন অবশ্যই কপিলদেব। দুটো দশক জুড়ে ভারতীয় বোলিংকে নেতৃত্ব দেওয়া কত শক্ত, তা কপিলদেবের চেয়ে ভাল কে-ই বা জানে? ঝুলনের নামটা মাথায় আসেনি বলে জিভ কাটছেন নাকি? কাটবেন না, কারণ দোষ আপনার নয়। শুধু যে মহিলাদের ক্রিকেট টিভিতে অনেক কম দেখানো হয় আর কাগজে অনেক কম লেখা হয় তা-ই নয়, কপিলদেব ১৬ বছরে খেলেছেন ১৩১টা টেস্ট আর ২২৫টা একদিনের ম্যাচ। ঝুলন কুড়ি বছরে ২০১ খানা একদিনের ম্যাচ (২২ মার্চ, ২০২২ তারিখে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ পর্যন্ত) খেললেও টেস্ট খেলেছেন মাত্র বারোটা। একদিনের ম্যাচের সংখ্যাটাও আসলে কপিলের সাথে তুলনীয় নয়, কারণ কপিলের কেরিয়ারের বেশ খানিকটা সময়ে একদিনের ক্রিকেট ছিল লম্বা টেস্ট সিরিজের শেষ পাতে মিষ্টির মত। কিন্তু ঝুলনের দু বছর আগে অভিষেক হওয়া জাহির খান বারো বছরেই দুশো একদিনের ম্যাচ খেলে ফেলেছিলেন।

ভারতীয় পুরুষদের ক্রিকেটের মহীরুহ যাঁরা, তাঁদের ঝুলিতে একটা জিনিস আছে যা বাংলার গৌরব সৌরভের ঝুলিতে নেই। ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ রিকি পন্টিংয়ের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া সৌরভের হাতে বিশ্বকাপ ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা দুরমুশ করে চতুর্থবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। কিন্তু কপিলদেব বিশ্বকাপ জিতেছেন, সুনীল গাভস্করও সেই দলে ছিলেন। বিশ্বসেরার মেডেল গলায় ঝুলিয়েছে শচীন তেন্ডুলকর আর মহেন্দ্র সিং ধোনিও। ব্যক্তিগত কৃতিত্বে ঝলমলে কেরিয়ারে ঝুলন আর মিতালীর ও জিনিসটার স্বাদ এখনো পাওয়া হয়নি। পেতে গেলে চলতি বিশ্বকাপে দুজনকেই নিজেদের সেরা ফর্মের কাছাকাছি থাকতে হবে। প্রথম চারটে ম্যাচে নীরব থাকার পর পঞ্চম ম্যাচে মিতালীর ব্যাট কথা বললেও পার্থক্য গড়ে দিতে পারেনি। বাংলাদেশ ম্যাচে দল জিতে গেলেও মিতালী আবার ব্যর্থ। ঝুলন মন্দ খেলছিলেন না, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে একেবারেই ফ্লপ, সহজ বাংলাদেশ ম্যাচে ছিলেন স্বমহিমায়। গতবার ফাইনালে উঠেও ইংল্যান্ডের কাছে হারতে হয়েছিল। বাকি রইল দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। সেটা জিততে পারলে এখনো ভারতের সেমিফাইনালে পৌঁছবার সম্ভাবনা আছে। যদি শেষপর্যন্ত স্মৃতি মান্ধনা, পূজা বস্ত্রকর, শেফালি বর্মার মত তরুণদের সাথে মিতালী, ঝুলন, হরমনপ্রীতদের সুর মিলে যায় তাহলে ৩ এপ্রিল ক্রাইস্টচার্চে প্রথম বাঙালি হিসাবে ঝুলন ছুঁয়ে ফেলবেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সঙ্গে থাকবেন শিলিগুড়ির রিচা ঘোষ।

চিন্তা করবেন না। এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকতা দেখাতে না পারা ভারতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত ঘটনা ঘটে গেলেও ঝুলনকে আমরা কেউ সেরা বাঙালি ক্রিকেটার বলার ধৃষ্টতা দেখাব না। মহিলাদের ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাক আর না-ই থাক, শিগগির জেনে যাব যে মেয়েদের ক্রিকেটের বোলারদের গড় গতি ছেলেদের চেয়ে কম। আরও নানা তথ্য থেকে প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে না যে মেয়েদের বিশ্বকাপ জয় আর ছেলেদের বিশ্বকাপ জয় এক নয়। সেরেনা উইলিয়ামসকে ও দেশে কেউ রাফায়েল নাদাল, রজার ফেডেরার বা নোভাক জোকোভিচের চেয়ে কম বড় খেলোয়াড় ভাবে না। তা বলে আমাদেরও যে ওভাবে ভাবতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি।

আরও পড়ুন কালোর জন্যে কাঁদা, অথচ সাদা মনে কাদা

তাছাড়া সৌরভের বায়োপিক হওয়ার আগেই যে বলিউড ঝুলনের বায়োপিক বানিয়ে ফেলছে, সে কি কম স্বীকৃতি? তাতে আবার ঝুলনের চরিত্রে অভিনয় করছেন ছেলেদের ক্রিকেট দলের অধিনায়কের অভিনেত্রী স্ত্রী। এর চেয়ে বেশি কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে ঝুলনের মত একজন শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারের? ঢ্যাঙা, কালো মেয়ে মাঠে উইকেট তুলতে পারে, রান করতে পারে। কিন্তু পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে যখন তার জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখতে যাব, তখন পর্দায় একটা টুকটুকে মেয়ে না থাকলে চলবে কেন? আমরা মণিপুরি মেরি কমকে পর্দায় দেখি পাঞ্জাবি অভিনেত্রীর অবয়বে, বাংলার ঝুলনকেও সেভাবেই দেখব। দেখে পপকর্ন খেতে খেতে হাততালিও দেব। দেশের ক্রিকেট বোর্ডই যখন মহিলা ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক পুরুষদের ধারেকাছে হওয়া উচিত বলে মনে করে না, দলটার নিয়মিত খেলতে পাওয়া উচিত বলেও মনে করে না, তখন আমরা সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা সব সমান করে ভাবতে যাব কেন? আমাদের কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখার জন্য কেন ছটফট করব?

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত জনগণমন

ব্র্যান্ড বুদ্ধ। কথাটা এই শতকের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এতটাই জনপ্রিয় যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিজের দলের সদস্যরা, যাঁদের তাত্ত্বিক ভাবে ব্র্যান্ডিং ব্যাপারটা নিয়েই প্রবল আপত্তি থাকার কথা, তাঁরাও বেশ সন্তোষ প্রকাশ করতেন। যদি ধরে নেওয়া যায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সত্যিই একটি ব্র্যান্ড, তাহলে মানতেই হবে সে ব্র্যান্ড রীতিমত জনপ্রিয় হয়েছিল। শতকের প্রথম দশকের দুটো নির্বাচনেই বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন দল তথা জোট হই হই করে জিতেছিল। ব্র্যান্ড বুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত এবং সফল ব্র্যান্ড মোদি। মানতেই হবে ব্র্যান্ড নির্মাণের মুন্সিয়ানাও সেখানে অনেক বেশি। কারণ একজন লেখাপড়া জানা ভদ্রলোককে নির্ভরযোগ্য প্রশাসক হিসাবে তুলে ধরার চেয়ে গোটা রাজ্যে গণহত্যা চলার সময়ে ক্ষমতাসীন নেতাকে গোটা দেশ চালানোর পক্ষে বিকল্পহীন প্রশাসক হিসাবে তুলে ধরা বহুগুণ কঠিন। ব্র্যান্ড নির্মাণ মানেই হল যা না থাকলেও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না তাকেই অপরিহার্য বলে প্রতিষ্ঠা করা, যার বিকল্প আছে তাকে নির্বিকল্প হিসাবে ঘোষণা করা। তাই কেবল ভালো বললে চলে না, তুলনায় যেতে হয়। আর সকলের চেয়ে ভালো, এ পর্যন্ত যা যা দেখেছেন, সবার চেয়ে ভাল — এইসব বলতে হয়। তাই নরেন্দ্র মোদি কোনো শিশুর দিকে তাকিয়ে হাসলেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি কোনো শিশুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন — এই জাতীয় প্রচারের প্রয়োজন পড়ে।

রাজনীতিবিদের ব্র্যান্ড নির্মাণ করার চেয়ে খেলোয়াড়দের ব্র্যান্ড নির্মাণ করা সহজ। কারণ তাঁরা কাজের অঙ্গ হিসাবেই সাধারণ মানুষের নিরিখে অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা করে থাকেন। অভিনেতারাও করেন বটে, কিন্তু তা অবশ্যই পূর্বনির্ধারিত; চিত্রনাট্য এবং প্রযুক্তির সহায়তায় করা। আজকের দিনের দর্শকরা জানেন কোনটা ক্যামেরার কারসাজি, কোথায় আসল নায়ক হল ভিএফএক্স। কিন্তু বিরাট কোহলির দিকে যখন বাউন্সার ধেয়ে আসে, তখন তিনি পুল করতে পারলে তবেই বল মাঠের বাইরে যাবে। ওখানে ফাঁকি চলে না। তাই তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা এমনিতেই বেশি। কিন্তু ওতে সন্তুষ্ট হলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ড নির্মাণ সম্ভব নয়।

গাড়ির টায়ার থেকে টিএমটি বার, পেশাগত শিক্ষার সাইট থেকে পটেটো চিপসের বিকল্প স্ন্যাকস যাঁকে দিয়ে বিক্রি করাতে হবে — তিনি যে কেবল দারুণ খেলোয়াড় নন, অন্য সকলের চেয়ে, এমনকি আগে যাঁরা ক্রিকেট খেলেছেন তাঁদের সকলের চেয়ে ভাল; নিদেনপক্ষে সর্বকালের সেরাদের মতই ভাল, তা প্রতিষ্ঠা না করলে চলে না। এই কারণেই সারা পৃথিবীর খেলাধুলোয় বর্তমানের তারকাদের সর্বকালের সেরার আসনে বসানোর হুড়োহুড়ি।

অতীতে কোনো খেলোয়াড় সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়েন কিনা সে আলোচনা শুরু হতো তাঁর কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে বা কেরিয়ার শেষ হলে। কিন্তু শচীন তেন্ডুলকর যখন মধ্যগগনে, তখনই এই মর্মে বিপুল প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারণ তখন বিপুল টাকার চুক্তি নিয়ে ওয়ার্ল্ড টেল এসে পড়েছে ভারতীয় ক্রিকেটে, শচীনকে ধনী করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মার্ক মাসকারেনহাস। অশীতিপর ডন ব্র্যাডম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছেন, ‘এই ছেলেটাকে দেখে আমার নিজের কথা মনে পড়ে।’ ব্যাস! আর যায় কোথায়? সর্বকালের সেরা হিসাবে শচীনের এমন জোরদার ব্র্যান্ডিং হল, কাগজে এমন লেখালিখি, টিভিতে এমন বিজ্ঞাপন যে আমরা যারা সুনীল গাভস্করের খেলা দেখিনি; কপিলদেব, ইয়ান বোথাম, ভিভ রিচার্ডসদের তাঁদের সেরা সময়ে দেখিনি; তারা নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলাম — সবার উপরে শচীন সত্য, তাহার উপরে নাই। সর্বকালের সেরার মুকুটের জন্য শচীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আমরা বড়জোর ব্রায়ান লারাকে মানতে রাজি ছিলাম, কোনো প্রাক্তনকে মোটেই নয়।

ব্র্যান্ডিংয়ের সেই ট্র্যাডিশন আজও সমান তালে চলছে। শচীন অবসর নিয়েছেন বলে তো আর ব্যবসা থেমে থাকতে পারে না, অতএব পরবর্তী GOAT (গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম — এই অভিধাটি সোশাল মিডিয়ার যুগে নতুন আমদানি, শচীনের সময়ে চালু হয়নি) হয়ে গেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তাঁর কেরিয়ার শেষের দিকে যেতেই বিরাট। প্রত্যেক প্রজন্মেই আগের গোটের নৈপুণ্যকে অতিক্রম করে এসে যাচ্ছেন নতুন গোট। মানবিক দক্ষতার এত দ্রুত বিবর্তন হয় জানলে হয়ত চার্লস ডারউইন ওরিজিন অফ স্পিসিজ নিজে হাতে পুড়িয়ে দিতেন।

গোট প্রচার ভোট প্রচারের মতই শক্তিশালী। শচীনের আমলে কেবল সাংবাদিককুল আর বিজ্ঞাপন ছিল প্রচারযন্ত্র। এখন যুক্ত হয়েছে সোশাল মিডিয়া। কেবল প্রচার নয়, ভিন্নমতের প্রতিকারও সেখানে হয়ে থাকে। ট্যুইটারে একবার বলে দেখুন, বিরাট নিঃসন্দেহে বড় ব্যাটার। কিন্তু সর্বকালের সেরা বলার সময় হয়েছে কি? পঙ্গপালের মত ধেয়ে আসবেন বিরাটভক্তরা। আক্রমণ শুরু হবে আপনি যে ক্রিকেটের ‘ক’ বোঝেন না সেই ঘোষণা দিয়ে। ক্রমশ আপনি যে মোগ্যাম্বোসুলভ খলনায়ক তা বলা হবে। তারপর প্রমাণ করা হবে আপনি দেশদ্রোহী; নামটা মুসলমান হলে সোজা পাকিস্তানি। গালিগালাজ ইত্যাদি তো আছেই। বলা যেতেই পারত যে এসবের সাথে খেলার বা খেলোয়াড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। ক্রীড়ানুরাগীরা কালে কালে এরকম জঙ্গিপনা করে আসছেন, সোশাল মিডিয়া আসায় পাড়ার রকের জঙ্গিপনা জনপরিসর পেয়ে গেছে মাত্র। দুঃখের বিষয়, তা বলা যাবে না। কারণ দু’টি।

প্রথমত, এমন আক্রমণ কেবল রাম শ্যাম যদু মধুরা করে না। সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার, ভেরিফায়েড হ্যান্ডেলওলা উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, ডাক্তার, উকিল — কেউই বাদ যান না। দ্বিতীয়ত, বিরাট নিজেও একাধিকবার ট্রোলদের মত আচরণ করেছেন।

ভারতের শাসক দলের মত ভারতের ক্রিকেট দলও সমালোচনা মোটেই বরদাস্ত করে না সেই ধোনির আমল থেকেই। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই মাইনে দিয়ে ধারাভাষ্যকার রাখে। দল হারুক আর জিতুক, ভারতীয় ক্রিকেটারদের সমালোচনা করেছ কি মরেছ। ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন হর্ষ ভোগলে। অমিতাভ বচ্চনের টুইট রিটুইট করে ভোগলের ধারাভাষ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন ভারত অধিনায়ক ধোনি। তারপরই ভোগলের কন্ট্র্যাক্ট চলে যায়। বিরাট ক্রিকেটের মেধাবী এবং মনোযোগী ছাত্র; তিনি বড়দের দেখে যা শিখেছেন তা তাঁদের চেয়ে ঢের বেশি জোর দিয়ে করেন। ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালীন অনুশীলনের সময়ে তিনি এক ভারতীয় সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল ওই সাংবাদিক বিরাট আর অনুষ্কা শর্মার সম্পর্ক নিয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা লিখেছেন। পরে যখন জানা যায় সেই নিবন্ধ অন্য এক সাংবাদিকের লেখা, তখন বিরাট ক্ষমা চান। অর্থাৎ ভুল লোককে গালিগালাজ করা হয়েছে বলে ক্ষমা চান। এই ঘটনায় টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বিরাটকে বুঝিয়েছেন যে ভবিষ্যৎ ভারত অধিনায়কের এরকম ব্যবহার সাজে না। যদিও বিরাট তখন ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হয়ে গিয়েছেন।

২০১৮ সালে বিরাটের কোপে পড়েন এক ক্রিকেটপ্রেমীও। দোষের মধ্যে, তিনি বলেছিলেন ভারতের চেয়ে অন্য দেশের ব্যাটারদের খেলা দেখতে তাঁর বেশি ভালো লাগে। বিরাট তাঁকে সটান বলে দেন, তাহলে অন্য দেশে গিয়েই থাকা উচিত। দেশের শাসক দল বিজেপি ও তার ট্রোলরা তখন অনলাইন এবং অফলাইন — সর্বত্র সরকারবিরোধী কথা বললেই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। অবশ্য এরকম প্রতিধ্বনিতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আচমকা নোটবন্দির ঘোষণা করার সাতদিন পরে সাংবাদিক সম্মেলনে বিরাট বলেছিলেন, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওটা তাঁর দেখা সেরা সিদ্ধান্ত।  বিরাট ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস কতখানি জানেন সে প্রশ্ন তোলা নিষ্প্রয়োজন, কারণ যিনি গোট তিনি তো কেবল খেলার গোট নন, তিনি সর্বজ্ঞ।

ব্র্যান্ডিংয়ের এমনই মহিমা, যে সাংবাদিক সম্মেলনে অপছন্দের প্রশ্ন শুনলেই রেগে যাওয়ার ধারাবাহিক ইতিহাস, কাগজে কী বেরোল তা নিয়ে সাংবাদিককে আক্রমণ করা এবং বিতর্কিত সরকারি সিদ্ধান্তকে সাত তাড়াতাড়ি সমর্থন করার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বিরাটের অধিনায়কত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে বড় অংশের বিজেপিবিরোধী মানুষ নিঃসন্দেহ, যে বিরাটকে সরিয়ে দেওয়া আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মহম্মদ শামির পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলেন বলে অমিত শাহের নির্দেশে তাঁর পুত্র জয় শাহ ও বশংবদ সৌরভ গাঙ্গুলি মিলে বিরাটকে একদিনের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, আর টেস্টের নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছেন।

আরও পড়ুন সকলেই চুপ করে থাকবে, শামিকে মানিয়ে নিতে হবে

বিরাটের কথা উঠলেই যে দেশের বেশিরভাগ মানুষের যুক্তিবোধ ঘুমিয়ে পড়ে, সবটাই আবেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় — এখানেই ব্র্যান্ড নির্মাতাদের সাফল্য। নানা মহল থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এখন আর আগের জায়গায় নেই। কিন্তু সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তার সময়েও তিনি এভাবে ডান, বাম, মধ্যপন্থীদের এক করে ফেলতে পারেননি। রাজনীতিতে এবং সমাজে যেসব প্রবণতার চরম নিন্দা করে থাকেন মোদিবিরোধীরা, সেগুলোই বিরাটের মধ্যে দেখা গেলে সকলে জাতীয়তাবাদী হয়ে পড়েন। প্রযুক্তির সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি বলে অধিনায়ক সদলবলে হাস্যকর অসভ্যতা করলেও কেউ বলেন না, বিদেশের মাঠে অধিনায়ক প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাষ্ট্রদূত। তিনি এই আচরণ করতে পারেন না, এর জন্যে শাস্তি হওয়া উচিত। উল্টে উঠে আসে বনলতা সেনগিরির যুক্তি (যাকে ইংরেজিতে বলা হয় হোয়াট্যাবাউটারি) — এরকম যখন সাহেবরা করত তখন কোথায় ছিলেন? এখন আমাদের জোর হয়েছে, তাই বিরাট করছে। বেশ করছে। রাজনীতিবিদদের গুন্ডাসুলভ কথাবার্তার যাঁরা অহরহ নিন্দা করেন, তাঁরাও বিরাটের নেতৃত্বাধীন দলের খেলার মাঠে অকারণ চিৎকার, খেলার পরেও সাংবাদিক সম্মেলনে এসে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলাকে আগ্রাসনের যুক্তিতে সমর্থন করেন। বিজেপি কথিত যে ‘নিউ ইন্ডিয়া’ অনেকের প্রবল অপছন্দ, সেই ভারতের বৈশিষ্ট্যগুলোই বিরাটের শরীরী ভাষায় দেখে একই লোকেদের যে উল্লাস– সেটাই ব্র্যান্ডিংয়ের জয়পতাকা।

সরকারি দল, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ এবং সহায়ক সংবাদমাধ্যম যখন বলে তারা ক্ষমতায় আসার আগে ভারতে কোনো উন্নয়ন হয়নি, বিদেশে ভারতের কোনো সম্মান ছিল না, ভারতীয়রা ভীতু বলে পরিচিত ছিল; তখন প্রতিবাদ করার লোক পাওয়া যায়। অথচ শাস্ত্রী, বিরাট এবং তাঁদের ভগবান বানিয়ে তোলা সংবাদমাধ্যম গত কয়েক বছর ধরে প্রচার করে যাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেট দল আগে আক্রমণাত্মক ছিল না, লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না, ক্রিকেটাররা মুখের মত জবাব দিতে পারতেন না ইত্যাদি। এই প্রোপাগান্ডা হাঁ করে গিলছেন প্রায় সবাই। ইতিহাস বিকৃত করা অথবা অস্বীকার করার যে ধারা এ দেশে চালু হয়েছে, সেই ধারারই অংশ এসব। যেন ১৯৭৬ সালে পোর্ট অফ স্পেনে নেহাত মিনমিন করে মোহিন্দর অমরনাথ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সুনীল গাভস্কররা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চতুর্থ ইনিংসে ৪০৬ রান তুলে জয় ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন। যেন স্টিভ ওয়র বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০০৩-০৪ মরসুমে সমানে সমানে লড়েনি ভারতীয় দল। যেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর কপিলদেব অপরাজিত ১৭৫ করতে পেরেছিলেন লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছাড়াই। ১৯৮১ সালে আগের টেস্টেই বাউন্সারে আহত হয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়া সন্দীপ পাতিলের অ্যাডিলেড টেস্টে ডেনিস লিলি, রডনি হগ, প্যাসকোকে বাইশটা চার আর একটা ছয় মেরে ১৭৪ রান করাও বোধহয় সম্ভব হয়েছিল আক্রমণাত্মক না হয়েই।

একটা প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত বিপক্ষে যাওয়ায় বিরাট নেশাগ্রস্তের মত স্টাম্প মাইক্রোফোনে টিভি সম্প্রচারকারীকে ধমকেছেন, সহ অধিনায়ক কে এল রাহুল গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটাকেই অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু ম্যাচের পর বিরাট ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কয়েকটা অর্থহীন কথা বলেছেন। “মাঠের ভিতরে ঠিক কী ঘটছিল বাইরের লোকেরা তো জানে না, আমরা জানি। আমি এখন বলব না যে আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কারণ তখন যদি আমরা চার্জড আপ হয়ে গোটা তিনেক উইকেট নিয়ে নিতাম তাহলেই খেলাটা ঘুরে যেত।” মনে করুন ২০০৭-০৮ মরসুমে সিডনি টেস্টের কথা। অস্ট্রেলিয় তৃতীয় আম্পায়ারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে ভারত কোণঠাসা হয়, তারপর শেষ দিনে স্রেফ রিকি পন্টিংয়ের মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে আম্পায়াররা সৌরভকে ড্রপ পড়া বলে আউট দেন, দল হেরে যায়। ভারত অধিনায়ক অনিল কুম্বলে মাঠের ভিতরে ছেলেমানুষের মত হাত-পা ছোঁড়েননি, চিৎকার করেননি। কিন্তু খেলার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন “এখানে একটা দলই ক্রিকেটের স্পিরিট অনুযায়ী খেলছিল।” এসব লড়াকু মনোভাব নয়, আগ্রাসন নয়, সাহসিকতা নয় — এমনটাই শিখে গেছি আমরা।

বিরাটের নেতৃত্বে নতুন কী ঘটেছে আসলে? ভারতীয় দল অনেক বেশি জয়ের মুখ দেখেছে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবার, দ্বিতীয়বার টেস্ট সিরিজ জিতেছে। কিন্তু সেই জয় আকাশ থেকে পড়েনি। বিরাটের দলের এই স্মরণীয় জয়গুলো এসেছে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়। সৌরভের আমলে শুরু হয়েছিল বিদেশে নিয়মিত টেস্ট ম্যাচ জেতা। জয়ের সংখ্যা বাড়ে ধোনির আমলে, বিরাটের আমলে আরম্ভ হয়েছে সিরিজ জয়। তার কৃতিত্ব অনেকটাই জোরে বোলারদের, নেতা হিসাবে অবশ্যই বিরাটেরও। উপরন্তু জয়ের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বিরাটের আমলে ভারত ইংল্যান্ডে সিরিজ জেতেনি, নিউজিল্যান্ডেও নয়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা হয়নি, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও দু’বারের চেষ্টায় প্রথমবার সিরিজ জিতে নতুন ইতিহাস তৈরি করা যায়নি। কিন্তু বিরাট বন্দনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এসব কথা বলতে গিয়েও ঠারেঠোরে জওহরলাল নেহরুকে ছোট করার ঢঙে আগের অধিনায়কদের এক হাত নেওয়া হয়। বলা হয় বিরাটের আগে কোনো অধিনায়ক নাকি জোরে বোলারদের এত গুরুত্ব দেননি। ঘটনা হল, আগে কোনো অধিনায়ক একসাথে এতজন ভাল জোরে বোলার পাননি। ভারতীয় ক্রিকেটে একসময় বিষাণ সিং বেদিকে বোলিং ওপেন করতে হয়েছে, এমনকী দু-একবার গাভস্করকেও। কারণ বিশ্বমানের জোরে বোলার কেউ ছিলেন না। সে পরিবর্তনও এসেছে ধারাবাহিকভাবেই।

প্রথমে এসেছেন কপিলদেব। তাঁর কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে জাভাগাল শ্রীনাথ, পিছু পিছু ভেঙ্কটেশ প্রসাদ। পরবর্তীকালে জাহির খান, আশিস নেহরারা। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছনো হত না পেস ত্রয়ীকে ছাড়া। সে ত্রয়ী তৈরিই হত না অধিনায়ক সৌরভ প্রায় অবসর নিয়ে ফেলা শ্রীনাথকে খেলতে রাজি না করালে। সৌরভের সময়েই সাড়া জাগিয়ে এসেছিলেন ইরফান পাঠান, যাঁর অলরাউন্ডার হতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। রাহুল দ্রাবিড় অধিনায়ক থাকার সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারতের হয়ে অল্প কিছুদিন রীতিমত গতিময় বোলিং করেছিলেন মুনাফ প্যাটেল আর বিক্রম রাজবীর সিং। প্রথম জন ক্রমশ গতি কমিয়ে ফেলেন, দ্বিতীয় জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে পারেননি। রাহুলের আমলেই উঠে এসেছিলেন শান্তাকুমারণ শ্রীশান্ত, রুদ্রপ্রতাপ সিংরা। ইতিমধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে, জোরে বোলারদের প্রতি যত্ন বেড়েছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে জোরে বোলিং সহায়ক পিচ তৈরিও শুরু হয়েছে। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামিদের রাত্রির বৃন্ত থেকে ফুটন্ত সকাল ছিঁড়ে আনার মত করে বিরাট নিয়ে আসেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সুযোগ না পাওয়া একজন অধিনায়কের পক্ষে তা সম্ভবও নয়।

এসব গোপনীয় তথ্য নয়, কিন্তু এখন কারো মনেই পড়ে না। কারণ আমাদের মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে, আর বিজ্ঞাপন ঢেকেছে বিরাটের মুখে। তাই একদিনের ক্রিকেটের দল একের পর এক বিশ্ব স্তরের টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হোক, বিরাটকে সরানো চলবে না। তিনি বিবৃতি দেবেন “টেস্ট আর একদিনের দলের নেতৃত্ব দিতে তৈরি থাকার জন্য টি টোয়েন্টির নেতৃত্ব ছেড়ে দিচ্ছি।” তবু আমাদের মনে হবে না, ভদ্রলোক অধিনায়কত্বকে জমিদারি মনে করছেন। তিনি গোট, তাঁর সাত খুন মাফ।

বস্তুত, ব্র্যান্ডিংয়ের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারলে দেখতে পেতাম, বিরাট (৯৯ টেস্টে ৭৯৬২ রান, গড় ৫০.৩৯, শতরান ২৭) টেস্ট ক্রিকেটে দারুণ এবং নিজের সময়ের সেরা ব্যাটারদের অন্যতম। কিন্তু গোট তো নয়ই, তাঁকে সর্বকালের সেরাদের একজন বলার সময়ও আসেনি। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে স্টিভ স্মিথ (৮২ টেস্টে ৭৭৮৪ রান, গড় ৫৯.৮৪, শতরান ২৭), কেন উইলিয়ামসন (৮৬ টেস্টে ৭২৭২ রান, গড় ৫৩.৪৭, শতরান ২৪) বরং তাঁর চেয়ে বেশি ধারাবাহিক। কেবল রানের দিক থেকে টেস্টের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দশে ঢুকতে হলেও বিরাটকে এখনো জনা কুড়ি খেলোয়াড়কে টপকাতে হবে। শুধু ভারতীয়দের মধ্যেও তিনি আপাতত ছয় নম্বরে। দলের জন্য যা আরও চিন্তার, তা হল গত কয়েক বছরে তাঁর পারফরম্যান্স গ্রাফ ক্রমশ নামছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে শেষ শতরানের পর থেকে হিসাব করলে তাঁর গড় ২৮.১৪।

আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি এই মুহূর্তে রানের দিক থেকে দু’নম্বরে, গড়ে এক নম্বর (৯৫ ম্যাচে ৩২২৭ রান, গড় ৫২.০৪), অধিনায়কত্বের রেকর্ডও ভাল। একদিনের ক্রিকেটের অধিনায়কত্বের রেকর্ডও নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় সাদা বলের ক্রিকেটে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জয়ের বিশেষ মূল্য নেই আজকের ক্রিকেটে। কারণ টি টোয়েন্টি যুগে দলগুলোর দ্বিপাক্ষিক ওয়ান ডে ম্যাচ খেলার আগ্রহ ক্রমশ কমছে। চার বছর অন্তর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে এক বছর অন্তর টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অর্থাৎ একটি দল পাঁচ বছরে চারটি বিশ্বকাপ খেলছে। সুতরাং দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলো বিশ্বকাপের প্রস্তুতি মাত্র। লক্ষ করে দেখুন, অস্ট্রেলিয়ার যে দল সদ্য ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি জিতল, সেই দলের সঙ্গে কিছুদিনে আগেই যে দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরেছিল তার বিস্তর তফাত। সুতরাং বিশ্বকাপে বা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রান করতে না পারলে বা ট্রফি জিততে না পারলে অন্য সময়ের ফলাফলের বিশেষ গুরুত্ব থাকে না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে আইপিএলের মত ফ্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট। সেখানে ব্যাটে প্রচুর রান থাকলেও নেতা বিরাট কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থ। রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের নেতা হিসাবে তাঁর প্রাপ্তি শূন্য।

যে ক্রিকেটে বিরাট সত্যিই সর্বকালের সেরাদের আসনের দাবিদার, তা হল একদিনের ক্রিকেট (২৫৫ ম্যাচে ১২২২০ রান, গড় ৫৯.০৩, শতরান ৪৩)। এখানে তাঁর সমসাময়িকরা কেউ ধারে কাছে নেই। শচীনের ৪৯ শতরানের রেকর্ডের থেকে মাত্র ছয় ধাপ দূরে আছেন বিরাট। গড়ের দিক থেকে তিনি আপাতত তিন নম্বরে, কিন্তু সামনের দু’জন খেলেছেন মাত্র গোটা তিরিশেক ম্যাচ। দুশোর বেশি ম্যাচ খেলেছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে তাঁর ব্যাটিং গড়ই সর্বোচ্চ। কিন্তু মুশকিল হল, ৫০ ওভারের খেলায় যাঁরা সর্বকালের সেরা হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত, অর্থাৎ ভিভ রিচার্ডস, শচীন, রিকি পন্টিং, সনৎ জয়সূর্য, কুমার সঙ্গকারা বা ধোনি — তাঁদের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের পাশে বিরাট ফ্যাকাশে (২৬ ম্যাচে ১০৩০ রান, গড় ৪৬.৮১, শতরান ২)। অথচ খেলে ফেলেছেন তিনটে বিশ্বকাপ। বিশেষত নক আউট স্তরে তাঁকে একবারও স্বমহিমায় দেখা যায়নি। বিশ্বকাপে রান এবং শতরানের দিক থেকে সবার উপরে থাকা শচীন তো বটেই, তিলকরত্নে দিলশান (২৭ ম্যাচে ১১১২ রান, গড় ৫২.৯৫, শতরান ৪), হার্শেল গিবসের (২৫ ম্যাচে ১০৬৭ রান, গড় ৫৬.১৫, শতরান ২) মত ক্রিকেটারদেরও বিরাটের চেয়ে বেশি স্মরণীয় পারফরম্যান্স রয়েছে। ফর্ম থাকলে আগামী বছর ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে হয়ত তিনি এই অভাব পুষিয়ে দেবেন।

একথা ঠিক যে পরিসংখ্যান দিয়ে সব কিছু প্রমাণ হয় না। কারণ পরিসংখ্যানে ধরা থাকে না পিচের অবস্থা, ম্যাচের পরিস্থিতি বা খেলোয়াড়ের শারীরিক অসুবিধা। ধুম জ্বর গায়ে বা বাউন্সারে মাথা ফেটে যাওয়ার পর করা ৩০ রানের মূল্য পরিস্থিতির বিচারে শতরানের চেয়েও বেশি হয় অনেকসময়। ব্যাটিংয়ের ল্যাজকে সঙ্গে নিয়ে আহত ভিভিএস লক্ষ্মণের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট জেতানো ইনিংসের মূল্য সংখ্যায় মাপা যায় কখনো? গত বছর রবিচন্দ্রন অশ্বিন আর হনুমা বিহারীর অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট বাঁচানো জুটির ওজনও ওই ম্যাচের স্কোরকার্ড দেখে উপলব্ধি করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাটিং কতটা ভাল তা প্রতিপক্ষের বোলিংয়ের মান না জেনে বিচার করা মূর্খামি। কারণ ক্রিকেট খেলায় একমাত্র বোলিংটাই ক্রিয়া; ব্যাটিং আর ফিল্ডিং হল প্রতিক্রিয়া।

কিন্তু পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে আলোচনা করলে বিরাটকে আর তত বিরাট মনে হবে না হয়তো। কারণ তখন বলতেই হবে, তাঁর কেরিয়ারের বড় অংশে সারা পৃথিবীতে এমন জোরে বোলার বিরল, যিনি যে কোনো পিচে যে কোনো আবহাওয়ায় দিনের যে কোনো সময়ে ঘন্টায় নব্বই মাইল বা তার বেশি গতিতে বল করতে পারেন। বড়জোর অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসন আর দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইন, মর্নি মর্কেলের কথা ভাবা যেতে পারে। নব্বই আর শূন্য দশকে কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, প্যাট্রিক প্যাটারসন, অ্যালান ডোনাল্ড, শোয়েব আখতার, ব্রেট লি, শেন বন্ডরা ছিলেন। সত্তর ও আশির দশকে ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয় ধরানো পেস চতুর্ভুজ, অস্ট্রেলিয়ার লিলি-থমসন, নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হেডলি, ইংল্যান্ডের বব উইলিস, পাকিস্তানের আক্রাম-ইউনিস। আরও বলতে হবে, তত গতিময় না হলেও এখন মিচেল স্টার্ক, জশ হেজলউড, জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, টিম সাউদিদের মত সুইং ও সিম করাতে পারা বোলাররা আছেন। কিন্তু বিশ্বমানের স্পিনার বলতে শুধু নাথান লায়ন। আজাজ প্যাটেল যতই এক ইনিংসে দশ উইকেট নিন, নিউজিল্যান্ড স্পিন সহায়ক উইকেট নয় বলে পরের ম্যাচেই তাঁকে খেলায়নি। আর ছিলেন ইয়াসির শাহ, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বিরাটের তাঁর বিরুদ্ধে খেলা হয়নি। অত্যন্ত মাঝারি মানের অ্যাডাম জাম্পা বা আদিল রশিদের বিরুদ্ধে কিন্তু বিরাটকে স্বচ্ছন্দ দেখায় না।

২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি ৫০ ওভারের খেলা দু প্রান্ত থেকে দুটি আলাদা বলে খেলা হবে — এই নিয়ম চালু করে। আগে একটি বলেই গোটা ইনিংস খেলার নিয়ম ছিল। সাধারণত ৩৫-৪০ ওভার নাগাদ সেই বলের সাদা রং নষ্ট হয়ে গিয়ে ব্যাটারদের দেখতে অসুবিধা হত, বল নরম হয়ে যাওয়ায় মারতে অসুবিধায় পড়তে হত, অনেকসময় বলের আকৃতিও যেত বিগড়ে। তেমন হলে আম্পায়াররা বল বদলাতে পারবেন, কিন্তু সেই বল আনকোরা নতুন হবে না, হবে একটু পুরনো বল। আগে হয়ে যাওয়া খেলাগুলোর মাঠ থেকে সংগ্রহ করে আনা অনেকগুলো বলের মধ্যে থেকে আম্পায়াররা বল বেছে নেবেন — এই ছিল নিয়ম। দুটো বলে খেলা শুরু হওয়ায় রিভার্স সুইং প্রায় বন্ধ, কারণ বল তেমন পুরনো হচ্ছে না। একই কারণে স্পিনারদের পক্ষে বল ঘোরানোও বেশি শক্ত হয়ে গেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রভাবে বাউন্ডারিও যে ছোট করে ফেলা হয়েছে, সচেতন টিভি দর্শকও তা বুঝতে পারেন। স্বভাবতই ব্যাটিং আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। শতরানের সংখ্যা বেড়েছে, আগে ব্যাট করলে তিনশো রান করে নিশ্চিন্ত থাকার দিন শেষ।

১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি খেলা হয়েছিল প্রথম একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ, আর প্রথম দ্বিশতরান এসেছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেটার বেলিন্দা ক্লার্কের ব্যাট থেকে। পুরুষদের ক্রিকেটে দ্বিশতরান এসেছে আরও ১৩ বছর পরে শচীনের ব্যাট থেকে। অথচ ২০১১ থেকে গত ১১ বছরে বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ক্রিস গেল, মার্টিন গাপ্টিল, ফখর জমান — সকলেই দ্বিশতরান করেছেন। একা রোহিত শর্মাই তিনটে দ্বিশতরানের মালিক। একদিনের ক্রিকেটে যাঁদের গড় পঞ্চাশের বেশি, তাঁদের মধ্যে মাইকেল বিভান আর নেদারল্যান্ডসের রায়ান টেন দুশখাতাকে বাদ দিলে সকলেরই কেরিয়ারের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ২০১১ সালের অক্টোবরের পরে।

বলা বাহুল্য, এসব পরিবর্তন বিরাটের সুবিধা হবে বলে কেউ করে দেয়নি। তিনি যে নিয়মে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তার মধ্যে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দিয়েছেন। কিন্তু সর্বকালের সেরাদের পাশে বসাতে হলে বা একেবারে গোট বলতে হলে এমন তুল্যমূল্য আলোচনা যে করতেই হয়। আসলে ওসব ব্র্যান্ডিংয়ের কারসাজি। আশা করা যায় ভক্তরা না বুঝলেও বিরাট নিজে সে কথা বোঝেন, ফলে মেসিসুলভ মূঢ়তায় কোনো লম্বকর্ণের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না। এখনো যে অনেক কিছু অর্জন করা বাকি আছে, তা বুঝলে তিনি আরও বড় ক্রিকেটার হতে পারবেন। ভারতীয় দলও আরও অনেক বেশি জয়ের মুখ দেখবে। ইতিহাস পারফরম্যান্স বোঝে। মন কি বাত বোঝে না, স্টাম্প মাইক কি বাতও বোঝে না।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

%d bloggers like this: