কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন?

এ দেশের ক্রিকেটমহল এখন ভীষণ ব্যস্ত। ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইপিএল চলছে। নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। লখনৌ সুপারজায়ান্টস অধিনায়ক কে এল রাহুল তো এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে গুরুতর চোট পাওয়ার পরে হার নিশ্চিত জেনেও দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। অতঃপর চোটের প্রভাবে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলতে পারবেন না, সামনের মাসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলতে পারবেন না। এমন বীরত্বের জন্যই তো জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান ক্রিকেটাররা। মুশকিল হল, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগত এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর দাবি, মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন আক্রমণের অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, ক্রিকেটারদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

গত ২৮ এপ্রিল ভিনেশ বলেন, ক্রিকেটারদের তো আমাদের দেশে পুজো করা হয়। তাঁরা আমাদের পক্ষ যদি না-ও নেন, অন্তত একটা নিরপেক্ষ বার্তা দিয়েও তো বলতে পারেন যে দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কেবল ক্রিকেটার নয় অবশ্য, সব খেলার তারকাদের কাছেই আবেদন ছিল ভিনেশের। তারপর থেকে অভিনব বিন্দ্রা আর নীরজ চোপড়া – ভারতের ইতিহাসে যে দুজন অলিম্পিকে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন, দুজনেই ওই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। সদ্যপ্রাক্তন টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাও দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বিশেষ হেলদোল নেই। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র মহিলাদের জাতীয় দলের শিখা পাণ্ডে মুখ খুলেছেন। সদ্য চালু হওয়া মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনার কোনো বক্তব্য নেই। জাতীয় দলের অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌরও চুপ। প্রাক্তনদের মধ্যে হরভজন সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ইরফান পাঠান সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। একমাত্র নভজ্যোৎ সিং সিধু সশরীরে ভিনেশ, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল কপিলদেব ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কবে ন্যায়বিচার পাবে?

স্পষ্ট বক্তা হওয়ার জন্য যাঁর বিপুল খ্যাতি, সেই বিরাট কোহলি স্পিকটি নট। যাবতীয় বাহাদুরি গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খরচ করছেন। নারীবাদীরা প্রায়শই বিরাটকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি জীবনে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার অবদান স্বীকার করেন বলে, তাঁর ব্যর্থতায় ট্রোলরা অনুষ্কাকে টার্গেট করলে বিরাট মুখ খোলেন বলে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে বিরাটই একমাত্র পুরুষ যিনি নিজের বউকে ভালবাসেন। তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন একমাত্র অস্কার মঞ্চে বউকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্রিস রককে ঘুঁষি মেরে দেওয়া উইল স্মিথ। দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি বিরাটের ভালবাসা আমাদের পাড়ার রানাদার পর্ণা বউদির প্রতি ভালবাসার চেয়ে মহত্তর কিছু মোটেই নয়। বরং হয়ত কিছুটা নিকৃষ্টতরই। কারণ রানাদা রাস্তাঘাটে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে কাউকে বিশ্রীভাবে কথা বলতে দেখলে অন্তত একটু ধমকা-ধমকি করেন। কিন্তু দেশের লাঞ্ছিত মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে বিরাটের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

মনে রাখা ভাল, অনুষ্কা নিজেও কম নারীবাদী নন। তিনি একদা সুনীল গাভস্করের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ গাভস্কর বলেছিলেন অনুষ্কার বোলিংয়ে অনুশীলন করে বিরাটের লাভ হবে না। সেই অনুষ্কাও আজ চুপ। চুপ মানে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। দুটিতে কেমন জীবন উপভোগ করছেন তার তত্ত্বতাল্লাশ দিব্যি দিয়ে যাচ্ছেন টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে। তবে গাভস্করের বিরুদ্ধে লম্বা বিবৃতি দিয়েছিলেন, অলিম্পিয়ান মহিলাদের প্রতিবাদ নিয়ে এক লাইনও লেখেননি। অবশ্য পরীক্ষায় আনকমন প্রশ্ন এসে গেলে আমরাও সে প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম।

গম্ভীর আবার দিল্লি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। সেই দিল্লির যন্তর মন্তরেই কুস্তিগীরদের অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। যদিও ওই এলাকা গম্ভীরের কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু তিনি একজন জনপ্রতিনিধি তো বটেন। অবশ্য উনি সাংসদের দায়িত্ব খুব মন দিয়ে কোনোদিন পালন করেছেন বলে অভিযোগ নেই। উনি সারাবছর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ান, আইপিএলের সময়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন। কদিন পরে হয়ত ওই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সারাবছরই বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াবেন। কারণ লখনৌ সুপারজায়ান্টসে তাঁর পদটির নাম গ্লোবাল মেন্টর, আর ওই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার টি টোয়েন্টি লিগে দল কিনে বসে আছেন। আর কোথায় কোথায় কিনবেন কে বলতে পারে? এমন বিশ্বনাগরিকের কি আর যন্তর মন্তরের অবস্থান বিক্ষোভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কূপমণ্ডূকতা মানায়?

পিভি সিন্ধু, সায়না নেহওয়ালদেরও মুখে কুলুপ। ছবারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কম তো পিটি ঊষা গোত্রের, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির অতি ঘনিষ্ঠ, তাই নীরব। গত কয়েকদিন অবশ্য তাঁর রাজ্য মণিপুরে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। বিজেপি তাঁকে এত গুরুত্ব দেয় যে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে বলতে হচ্ছে “মাই স্টেট ইজ বার্নিং, কাইন্ডলি হেল্প”। যে নিখাত জারীনকে একসময় স্রেফ জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে অবজ্ঞা করতেন মেরি, সেই দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিখাত কিন্তু সরব হয়েছেন।

প্রাক্তন সাংসদ ভারতরত্ন ‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ডাগআউটে নিদ্রা গিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন? তবু তো দয়া করে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মুখ খুলেছেন। লর্ডসের ব্যালকনির চিরস্মরণীয় ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ভারী বিনীতভাবে বলেছেন, ওদের লড়াই ওরা লড়ুক। আমি তো খবরের কাগজে পড়ছি, যা জানি না তা নিয়ে তো কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে শচীন, সৌরভ দুজনেই কন্যাসন্তানের পিতা।

সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় তারকা খেলোয়াড়দের যা ইতিহাস, তাতে এঁরা মহম্মদ আলি হয়ে উঠবেন বলে কেউ আশা করে না। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা কিন্তু সাতে পাঁচে না থাকার নীতি অনেকটাই ত্যাগ করেছেন। ওঁরা এখন শচীন বা ঊষার মত শাসক দলের প্রসাদ গ্রহণ করে রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন, এ পদ সে পদ গ্রহণ করছেন, গম্ভীরের মত ভোটে লড়ে সাংসদ বা বিধায়কও হচ্ছেন। যাঁদের অত এলেম নেই তাঁরাও কোহলির মত করে নোটবন্দি হওয়া মাত্রই তা কত বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন তার বিরোধিতা করে টুইট করেছিলেন। সেওয়াগের মত কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস। শহিদ হওয়া সৈনিকের মেয়েকে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার জন্য ট্রোল করতেও ছাড়েননি। কেবল সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দরকার পড়লেই এঁরা কেউ নীরব হয়ে যান, কেউ এক-দু লাইনে কাজ সারেন। সেওয়াগ, কপিলদেব, হরভজন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মানুষ। কুস্তিগীরদের আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন হরিয়ানার কুস্তিগীররাই। তা না হলে এতেও ওই তিন প্রাক্তন মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

যে পদকজয়ী অলিম্পিয়ানরা আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি-ঘনিষ্ঠই ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে বা জয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করতে এঁদেরও কামাই ছিল না। এখন চোখের জলে সেসবের দাম দিতে হচ্ছে। এখনো যে মহাতারকারা নীরব, তাঁদের দেখে একটাই ভয় হয়। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়মোলারের অনুসরণে এঁদের না কোনোদিন আওড়াতে হয়, প্রথমে ওরা এসেছিল কুস্তিগীরদের জন্যে। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কুস্তিগীর নই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ক্রিকেট জেনেশুনে বিশ করেছে পান

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে।

শোয়েব আখতার যখন বল করতেন, মনে হত গোলাবর্ষণ করছেন। এখন বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার সময়েও প্রায় একই মেজাজে থাকেন। আজকাল প্রাক্তন ক্রিকেটাররা ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে কথা বলার সময়ে অতি মাত্রায় সাবধানী। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চটে গেলে এ দেশে ধারাভাষ্যের মহার্ঘ সুযোগ পাওয়া যাবে না, কোনো একটা ভূমিকায় আইপিএলের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজে ঢুকে সারা বছরের রোজগার দু-আড়াই মাসে করার সুযোগও হাতছাড়া হবে। শোয়েব পাকিস্তানি হওয়ায় ও দুটো দরজাই তাঁর জন্যে বন্ধ। সম্ভবত সে কারণেই নিজের দেশের বাবর আজম সম্পর্কে যেরকম তীর্যক মন্তব্য করেন, বিরাট কোহলি সম্পর্কেও সেভাবেই কথা বলেন। কোহলিকে আক্রমণ করে কদিন আগে বলেছেন “আমি কোহলিকে অনুরোধ করব ও যেন ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত খেলে। তাহলে আরও ৮-৯ বছর সময় পাবে। ভারত ওকে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থাতেও খেলাবে এবং একশোটা শতরান করা পর্যন্ত খেলতে দেবে। আমার মনে হয় ও অবসর পর্যন্ত অন্তত ১১০ খানা শতরান করে ফেলবে।”

কোনো সন্দেহ নেই ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যক্তিপূজা এমন প্রবল, যে কপিলদেবকে রিচার্ড হেডলির টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড ভাঙার জন্য, আর শচীন তেন্ডুলকরকে শততম শতরান করতে দেওয়ার জন্য, খেলোয়াড় হিসাবে ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও খেলতে দেওয়া হয়েছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনি অবশ্য রেকর্ড ভাঙার জন্য খেলে যাননি। তাঁর ফিনিশ করার ক্ষমতা ফিনিশ হয়ে গিয়ে থাকলেও বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের কোম্পানির ডিরেক্টরকে বাদ দেয় কোন নির্বাচকের সাধ্যি? বরং সেই ২০১১ সালে নির্বাচক কমিটির বৈঠকে ধোনিকে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় নির্বাচক মহিন্দর অমরনাথের চাকরিই নট হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কোহলিও যদ্দিন ইচ্ছা খেলে যেতেই পারেন। কিন্তু শোয়েবের ভুল হয়েছে অন্য জায়গায়।

কোহলির এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতরানের সংখ্যা ৭৫ (টেস্ট ২৮, একদিনের ক্রিকেট ৪৬, আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ১)। যতদিন পর্যন্তই খেলুন, আরও ২৫ খানা শতরান কোথা থেকে আসতে পারে ভেবে দেখুন। পরপর দুটো ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে ব্যর্থ হওয়ার পর (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্মরণীয় ইনিংসটা বাদ দিলে) ৩৪ বছরের কোহলিকে আর ওই ফরম্যাটে খেলানো হবে কিনা দেবা ন জানন্তি। বয়স বাড়লে টেস্টে শতরান করা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে যায় তা তো কোহলির গত চার বছরের খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাহলে হাতে রইল পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট, যাতে কোহলিকে এখনো মাঝে মধ্যে স্বমহিমায় দেখা যায়। কিন্তু ওই ফরম্যাটটির নিজেরই যে বাঁচা দায়।

শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। মাত্র ছমাস পরেই পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ, তাও আবার ভারতে। যেখানে পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের প্লাস্টিক বল দিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হলেও খেলা দেখতে লোক জমে যায়। এই তো কদিন আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়া একদিনের সিরিজ হয়ে গেল, তার আগে বাংলাদেশে সিরিজ হল। সেখানে গুরুত্বহীন ম্যাচে হলেও ঈশান কিষণ দ্বিশতরান করলেন, কোহলি শতরানের খরা কাটালেন। এমন সময়ে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট নিয়ে এমন কথা কেন? ঘটনা হল, যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে। সারা পৃথিবীতে টি টোয়েন্টি লিগগুলোর, মানে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের যত রমরমা হচ্ছে, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের দর্শক তত কমছে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, যে কর্মকর্তারাও চান না ওটা বেঁচে বর্তে থাক। নইলে ১৩ নভেম্বর ২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ফাইনালের পর ১৭, ১৯ আর ২২ তারিখ কেন তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড? মাত্র চারদিন আগে দাপটে কুড়ি ওভারের বিশ্ব খেতাব জয় করা ইংল্যান্ড তিনটে ম্যাচেই গোহারা হারে। সেই ফলাফলকে গুরুত্ব না দিলেও হয়ত চলে, ইংল্যান্ডের পর্যুদস্ত হওয়ার দায় ক্লান্তির উপর চাপানো তো একেবারেই চলে না, কারণ ইংল্যান্ডের একদিনের দলের অনেকেই ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলে ছিলেন না। কিন্তু আসল কথা হল অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ইংল্যান্ড খেলছে আর গ্যালারিতে মাছি তাড়ানোরও লোক নেই – এ জিনিস দুদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। খেলাগুলোর টিভি রেটিংয়ের অবস্থাও ছিল শোচনীয়।

এটা একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। ভারতেও যে কোনো দলের সঙ্গে খেলা থাকলেই মাঠ ভরে যাওয়ার দিন চলে গেছে। আইপিএলে টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে, সাংবাদিকরা সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে বাধ্য হন “দয়া করে কেউ টিকিট চাইবেন না।” কিন্তু পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে অন্তত কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মত বড় শহরে সে সমস্যা হয় না। শুধু যে দর্শকদের আগ্রহ কমছে তা নয়, খেলোয়াড়দেরও আগ্রহ কমছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস ইতিমধ্যেই একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে বসে আছেন। মানে গত বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় এবার বিশ্বকাপে খেলবেন না। তাঁর বয়স কিন্তু মাত্র ৩১। গতবছর জুলাই মাসে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর ডিসেম্বরে অবশ্য স্টোকস বলেছিলেন তিনি শুধু বিশ্বকাপটা খেলার কথা ভেবে দেখতেও পারেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার যে কারণগুলো দেখিয়েছিলেন, সেগুলো লক্ষ করার মত। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, বড্ড বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। তিন ধরনের ক্রিকেটের ধকল তাঁর শরীর নিতে পারছে না।

এই সমস্যা একা স্টোকসের নয়। ইংল্যান্ডের জোরে বোলার জোফ্রা আর্চার চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বসেছিলেন বেশ কয়েক বছর, চলতি আইপিএলে মাঠে ফিরলেন। ভারতের যশপ্রীত বুমরা কবে ফিরবেন এখনো পরিষ্কার নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় সব দলের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররাই বারবার চোট পাচ্ছেন, বিরাম নিতে হচ্ছে। কারণ আইপিএল দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেই ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জয়যাত্রা এখন ম্যাগেলানের মত পৃথিবী পরিক্রমায় বেরিয়েছে। পাকিস্তান সুপার লিগ, লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশের সঙ্গে এ বছর থেকে যোগ হল দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টোয়েন্টি আর সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আইএল টি টোয়েন্টি। শেষের দুটো আবার ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে আইপিএলের ঠিক পরেই। দুটো লিগেই দল কিনেছেন চেন্নাই সুপার কিংস, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, কলকাতা নাইট রাইডার্স, দিল্লি ক্যাপিটালস, লখনৌ সুপার জায়ান্টস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রাজস্থান রয়ালসের মত দলের মালিকরা। ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলো খেলোয়াড়দের যা পারিশ্রমিক দিচ্ছে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কম্ম নয়। ফলে ছাড়তে হলে একজন ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে খেলাই যে ছাড়বেন, ফ্র্যাঞ্চাইজের খেলা নয়, তা বলাই বাহুল্য। টেস্টের প্রতি স্টোকসের ভালবাসা আছে বলে একদিনের ক্রিকেট ছেড়েছেন, কেউ টেস্ট খেলাও ছাড়তে পারেন।

ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বোর্ড মিলে বিশ্ব ক্রিকেটকে যে ছাঁচে ঢেলেছে ২০১৪ সাল থেকে, তাতে অনেক ক্রিকেট বোর্ডেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ফলে ক্রিকেটারদের ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডও বাধ্য হয়েছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ট্রেন্ট বোল্টকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে অব্যাহতি দিতে। অর্থাৎ তিনি হয়ত টেস্ট ক্রিকেট আর খেলবেনই না, একদিনের ক্রিকেট কতটা খেলবেন তাতেও সন্দেহ আছে। আইপিএলের পারিশ্রমিকের সঙ্গে অবশ্য ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডও এঁটে উঠতে পারবে না অদূর ভবিষ্যতে। ইংল্যান্ডের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজের প্রতিবেদক টিম উইগমোর গত সপ্তাহেই লিখেছেন, আইপিএলের ক্রিকেটাররা যে পারিশ্রমিক পান তা আরও তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। কারণ এত বড় ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া লিগ পৃথিবীর অন্য যেসব খেলায় আছে, সেখানে দলগুলো মোট রাজস্বের অর্ধেক বা তারও বেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ (বাস্কেটবল লিগ) এনএফএল (আমেরিকান ফুটবল লিগ) এবং এমএলএসে (বেসবল লিগ) অন্তত ৪৮% দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ফুটবলের প্রিমিয়ার লিগ ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে রাজস্বের ৭১% খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের পিছনে ব্যয় করেছিল। সেখানে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো ব্যয় করে ১৮% বা তারও কম।

আরও পড়ুন বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

অতএব বুঝতেই পারছেন, শুধু পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট কেন, সারা বছর ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলে বেড়িয়ে ভবিষ্যতে টেস্ট ক্রিকেট খেলার উৎসাহও কজন ক্রিকেটারের থাকবে সন্দেহ। স্বভাবতই খেলার গুণমানের তফাত হবে, দর্শকদের আগ্রহেও ভাঁটা পড়বে। যেমন এই মুহূর্তে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে হচ্ছে। টেস্টের দর্শক ভারতেও কমে গেছে বেশ কিছুদিন হল। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে সপ্তাহান্তে কোহলির শতরান পূর্ণ করার দিনেও গ্যালারিতে মানুষের চেয়ে চেয়ার বেশি দেখা যাচ্ছিল। তবু কৌলীন্য আছে বলে কোহলি, স্টোকস, জো রুটের মত খেলোয়াড়রা এখনো ওই ক্রিকেটটা খেলতে চান। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের কিন্তু অবস্থা সঙ্গীন। বাঁচিয়ে রাখতে কী করা যায়? স্টোকস বলেছিলেন, সম্প্রতি রবি শাস্ত্রীও বলেছেন খেলাটাকে চল্লিশ ওভারে নামিয়ে আনার কথা। রোহিত বলেছেন নয়ের দশকের মত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট ফিরিয়ে আনা যায় কিনা ভেবে দেখা উচিত। কিন্তু খেলোয়াড়দের ম্যাচ খেলার সংখ্যা যদি না কমে, ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের পরিমাণ কমানোর দিকে যদি কর্তারা নজর না দেন, তাহলে চল্লিশ ওভারের ম্যাচ খেলতেই বা সেরা খেলোয়াড়দের কী করে পাওয়া যাবে?

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে। ওখানেই তো যত মধু। আইপিএলে দল বাড়িয়ে ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, কারণ মিডিয়া স্বত্ব বেচে পাওয়া টাকার পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০১৮-২২ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকায়, আর ২০২৩-২৭ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকায়। আইপিএল নামক এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল নিজেদের সূচিতে প্রতি বছর আড়াই মাস খালি রেখেছে। কারণ আইপিএলে ম্যাচের সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। বাড়তে বাড়তে ২০২৭ সালে তা পৌঁছবে ৯৪-তে। সঙ্গে থাকবে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ। তারপর পঞ্চাশ (বা চল্লিশ ওভারের) খেলা খেলবেন কারা? সে বছর বিশ্বকাপেই বা কতজনকে ফিট অবস্থায় পাওয়া যাবে? তাই বলছিলাম, কোহলি যদি ২০৩১ অব্দি খেলেও ফেলেন, শতরানের সেঞ্চুরির জন্য সবচেয়ে লাগসই ফরম্যাটটার অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ।

এই সময় কাগজের অধুনালুপ্ত রাবিবারিক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত

ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

অ্যালাস্টেয়ার কুককে নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আছে। টেস্ট ক্রিকেটে বারো হাজারের বেশি রান করা ব্যাটারকে এমনিতেই কোনো ক্রিকেটপ্রেমী ভোলেন না। তার উপর কুক জীবনের প্রথম এবং শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধেই, আর দুটোতেই তিন অঙ্কের রান করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ২০১১ সালে ভারতের অভিশপ্ত ইংল্যান্ড সফরের সময়ে এজবাস্টন টেস্টে ক্রিকেটজীবনের সর্বোচ্চ স্কোরেও (২৯৪) পৌঁছন। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলা কুক এখনো দাপটে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছেন। এ মরসুমে এসেক্সের এই ওপেনারের গড় এখন ৬০। পাঁচটা ম্যাচেই তিনটে শতরান করে ফেলেছেন এবং দুই দশকব্যাপী প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কেরিয়ারে আগে কখনো যা পারেননি, তা ঘটিয়ে ফেলেছেন গত ম্যাচে। দুই ইনিংসেই শতরান করেছেন।

এদিকে কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে। জো রুটের কাছে ইংল্যান্ডের কর্মকর্তা, ক্রিকেটপ্রেমী – সকলেরই বিরাট আশা ছিল। কিন্তু ব্যাটার হিসাবে যথেষ্ট সফল হলেও অধিনায়ক হিসাবে রুট একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। গত আঠারোটা টেস্টের মধ্যে মাত্র একটা জিতেছে ইংল্যান্ড। ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যে যে কারণে ইংল্যান্ডের এমন হাঁড়ির হাল, তার অন্যতম হল ওপেনারদের ব্যর্থতা। কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে অনেককে নির্বাচকরা সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু কেউই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। কুক ইতিমধ্যে স্যার অ্যালাস্টেয়ার কুক হয়ে গেছেন। মানে ক্রিকেট মাঠে তাঁর কীর্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং রানী এলিজাবেথ। জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড সম্প্রতি খোলনলচে বদলে ফেলেছে। নতুন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার রব কী, নতুন টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস আর টেস্ট দলের কোচের দায়িত্বে এসেছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। দেশটার নাম ভারত হলে এতদিনে হাউস অফ কমন্সে সব দলের সাংসদরা মিলে রেজলিউশন পাস করাতেন, নতুন অধিনায়ক আর কোচকে কুককে অবসর ভেঙে ফিরে আসতে বলতেই হবে। কুক নিজেও শতমুখে সংবাদমাধ্যমকে বলে বেড়াতেন, তিনি এখনো দারুণ ফিট এবং জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন।

কিন্তু দেশটার নাম ইংল্যান্ড। কয়েকদিন আগে কুককে এক সাক্ষাৎকারে রব কীর নিয়োগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ভালই তো। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের এখন একেবারে নতুন করে শুরু করা উচিত। নিজের সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। বরং বলেই দিলেন যে পুরনো সবকিছু ভুলে এগোনো উচিত।

স্নেহময় জ্যাঠামশাইরা পরীক্ষায় ফেল করা ভাইপোদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যে এরকম বলতেন। তা কুকজেঠুর বয়স কত? সাঁইত্রিশ বছর চার মাস। চলতি আইপিএলে গত ম্যাচটা (তা-ও বিপক্ষের দ্রুততম বোলার লকি ফার্গুসন কোনো অজ্ঞাত কারণে বল করতে এলেন বিরাট আর ফ্যাফ দু প্লেসি সেট হয়ে যাওয়ার পর এবং মাত্র দু ওভার বল করলেন) বাদ দিলে চূড়ান্ত ব্যর্থ (তিনটে ম্যাচে প্রথম বলে আউট; ১৪ ম্যাচে ৩০৯ রান, গড় ২৩.৭৬) বিরাট কোহলির বয়স কত? সাড়ে তেত্রিশ। অর্থাৎ কুক বিরাটের বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাঁর এখনকার ফর্ম দেখে মনে করা অমূলক নয় যে অবসর না নিলে তিনি এতদিনে শচীন তেন্ডুলকরের টেস্ট ক্রিকেটে মোট রানের রেকর্ড (১৫,৯২১) আর সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড (২০০) – দুটোরই কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন। অথচ এখন কনিষ্ঠরা পারছে না দেখেও ফিরে আসার নাম করছেন না। বোর্ডও এখন পর্যন্ত তাঁর নাম করেনি। ভক্তরা কেউ কেউ সোশাল মিডিয়ায় কুকের নাম ভাসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও তা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করছেন না। এদিকে বিরাটকে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক – অনেকেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি নাকি একটানা অনেকদিন খেলে ফেলেছেন, কদিন বিশ্রাম নিলেই হইহই করে রানে ফিরবেন। বিরাটও গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচের আগে আইপিএলের সরাসরি সম্প্রচারকারী সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বললেন তাঁর উপর দিয়ে সত্যিই অনেক ধকল গেছে, তাই বিশ্রাম নিলে ভালই হয়। মজার কথা, বিশ্রাম নেওয়া যে প্রয়োজন সেটা তাঁর আইপিএলের শেষ লগ্নে এসে খেয়াল হল। বিরাট মনে করেন আমাদের প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট রবি শাস্ত্রীর চেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর নেই। তিনি শুধু বিরাটকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেননি, বলেছেন বিশ্রামের পর বিরাট আরও ছ বছর খেলতে পারে। অর্থাৎ কুক যে বয়সে ফর্মে থেকেও জ্যাঠামশাইয়ের ভূমিকা উপভোগ করছেন, বিরাট সেই বয়সেও খেলে যাবেন। অথচ বিরাটের ফর্ম কিন্তু এবারের আইপিএলে হঠাৎ উধাও হয়েছে এমন নয়। এই সাইটেই আগে লিখেছি, কোনো ধরনের ক্রিকেটেই তিনি তেমন প্রভাব ফেলতে পারছেন না অনেকগুলো বছর হয়ে গেল।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নতুন করে শুরু করার কাজটা আগেই করেছে, কারণ আইসিসি টুর্নামেন্টে বারবার ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা দরকার। শাস্ত্রীর জায়গায় এসেছেন রাহুল দ্রাবিড় আর সাদা বলের অধিনায়ক করা হয়েছিল রোহিত শর্মাকে। বিরাট টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ছাড়া অন্যগুলোর লাগাম নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন, বোর্ড সে গুড়ে বালি দিয়ে পরে টেস্ট ক্রিকেটেও রোহিতকেই নেতা করে দিয়েছে। তা রোহিতের বয়স কত? পঁয়ত্রিশ। টেস্ট ক্রিকেট কোনোদিনই রোহিতের সেরা মঞ্চ ছিল না। ন বছর আগে টেস্ট অভিষেক হলেও এতদিনে মোটে পঁয়তাল্লিশটা টেস্ট খেলেছেন, শতরান মাত্র আটটা। বিদেশে প্রথম শতরান পেলেন গত ইংল্যান্ড সফরে। তিনি আসলে সাদা বলের যম। অথচ গত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে বিরাটের পাশাপাশি তিনিও ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবার আইপিএলেও মোটেই রানের মধ্যে নেই (১৩ ম্যাচে ২৪৮ রান; গড় ২০.৪৬)। একাধিকবার আইপিএল খেতাব জয়ী মুম্বাই ইন্ডিয়ানস যে এবার পয়েন্ট টেবিলের একেবারে তলায় পড়ে আছে, তার অন্যতম কারণ রোহিতের খারাপ ফর্ম।

এ বছর ফের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি। স্বয়ং অধিনায়ক এরকম ফর্মে থাকলে দলের অবস্থা কী হবে? উপরন্তু দলের সবচেয়ে বড় তারকা বিরাটকে দীর্ঘদিন ধরে টি টোয়েন্টির উপযোগী দেখাচ্ছে না। তিনি ইদানীং এত সাবধানে ব্যাট করছেন (বৃহস্পতিবার গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে ৫৪ বলে ৭৩ রান করার আগে অব্দি স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৩.৪৬), যে তিনি বড় রান করলে দলের মোট রান ভাল জায়গায় পৌঁছনো শক্ত। অথচ এই দুই তারকা থাকতে ঋতুরাজ গায়কোয়াড়, রাহুল ত্রিপাঠী, রাহুল টেওটিয়াদের মত বড় শট নিতে পারা ব্যাটারদের দলে জায়গা হবে না।

তবে ভারতীয় ক্রিকেট যে ভারত দেশটার মতই পিছন দিকে এগোতে চাইছে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই দুজন নন। সাঁইত্রিশ বছরের কুক যদি জেঠু হন, আগামী ৭ জুলাই একচল্লিশে পা দিতে চলা মহেন্দ্র সিং ধোনি নিঃসন্দেহে পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর যে ইচ্ছামৃত্যু, তা সেই ২০১১ সালেই প্রমাণ হয়ে গেছে। দল পরপর আটটা টেস্ট হারার পরেও ধোনির অধিনায়কত্ব যায়নি, বরং সে প্রস্তাব নির্বাচন কমিটির মিটিংয়ে তোলার পরে মোহিন্দর অমরনাথের নির্বাচকের চাকরি গিয়েছিল। ভারতের একদিনের ক্রিকেটের দলও ধোনিকে বয়ে বেড়িয়েছে বছর চারেক। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল আর বড় শট নিতে পারেন না, অন্য প্রান্ত থেকে কেউ সে কাজটা করলে তিনি বড়জোর এক-দুই রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখতে পারেন, যা অনেকসময় জেতার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবু তাঁকে অবসর নিয়ে প্রশ্ন করলে বেজায় রেগে যেতেন। ২০১৬ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে ভারতের বিদায়ের পর তো নির্লজ্জতার শিখরে উঠেছিলেন। এক অস্ট্রেলিয় সাংবাদিক এই প্রশ্ন করায় তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনের ডায়াসে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি ধোনির অবসর দেখতে চান কিনা। তিনি তো আর ভারতীয় নন, যে কোনো আত্মীয় পরিজন থাকবে যে ধোনির জায়গায় খেলতে পারে।

এন শ্রীনিবাসনের থেকে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন বলেই ধোনি একদিনের ক্রিকেট খেলতে পেরেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপ অব্দি। অথচ ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে চার, ছয় মারার ক্ষমতা তো বটেই, গড়ও কমে গিয়েছিল। কেরিয়ারের ব্যাটিং গড় যেখানে পঞ্চাশ, সেখানে এই চার বছরের গড় নেমে এসেছিল চুয়াল্লিশে। চারে নেমে খেলতে না পারলে টিভি স্টুডিওতে বসে বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বলতেন ধোনিকে পাঁচে খেলানো উচিত। পাঁচে না পারলে বলতেন ছয়ে। অর্থাৎ দল তাঁকে বয়ে বেড়াত। কালে ভদ্রে একটা ম্যাচে উইনিং স্ট্রোক নিলেই ফের সবাই মনে করিয়ে দিত, ধোনি সর্বকালের সেরা ফিনিশার। আর ধোনিকে এসব জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বারবার বলতেন, আগের মত অত ছয় মারেন না তো কী হয়েছে? তিনি তো ফিট আছেন। যেন খেলাটা ক্রিকেট নয়, জিমন্যাস্টিক্স।

আসলে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে অনেক সমস্যা মিটে যায়। তাই ধোনি নির্বিঘ্নেই খেলে ফেলেন আরও একটা বিশ্বকাপ। কিছু বিশেষজ্ঞ আর অন্ধ ভক্ত আজও বলেন “যদি গাপ্টিলের থ্রোটা উইকেটে না লাগত…”। ভুলে যান যে ধোনি সেদিন পঞ্চাশে পৌঁছতে লাগিয়েছিলেন বাহাত্তরটা বল, মাত্র একটা চার আর একটা ছয় মেরেছিলেন। রবীন্দ্র জাদেজা ৫৯ বলে ৭৭ রান করেছিলেন বলে নিউজিল্যান্ডের জয়ের ব্যবধান আরও বড় হয়নি – এটুকুই সান্ত্বনা। নইলে শেষ ওভারে ধোনির ভেলকি দেখানোর সম্ভাবনা আরও আগেই শেষ হয়ে যেত। রাজনীতিতে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু খেলার মাঠে পরিণাম বদলানো যায় না।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

এতদিন পরে হৃদয় খুঁড়ে আবার এসব বেদনা জাগাতে হচ্ছে, কারণ এবারের আইপিএলে ধোনি ওই জাদেজাকেই হাসির পাত্র বানিয়ে ছেড়েছেন। এমনিতে চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক শ্রীনিবাসনের কোম্পানি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের অন্যতম ডিরেক্টর ধোনি। সুপার কিংস দলটা সে অর্থে তাঁর নিজের সম্পত্তি। যার ব্যাট, যার উইকেট তাকেই খেলতে নেব না – এ জিনিস পাড়া ক্রিকেটেই চলে না, আইপিএলে কী করে চলবে? ফলে ধোনির উইকেটরক্ষায় যতই শিথিলতা আসুক, ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতা যতই কমে যাক, এ দলে তিনি যতদিন খেলতে চাইবেন ততদিনই খেলবেন। সমস্যা হল, তিনি কেবল খেলছেন না, খেলতে গিয়ে অন্যদের কোণঠাসা করছেন। আইপিএল শুরু হওয়ার মুখে ঘটা করে ঘোষণা করা হয়েছিল, পিতামহ অধিনায়কের সিংহাসনটি স্নেহভাজন জাদেজার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরু হতেই দেখা গেল ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তন – সবকিছুতেই ধোনির কথাই শেষ কথা। জাদেজা নেহাতই রাবার স্ট্যাম্প। অবশ্য তাতেও সুপার কিংস দলের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হওয়া আটকায়নি। কিন্তু ব্যাটে, বলে ব্যর্থ জাদেজা নটা খেলার মধ্যে ছটা হারার পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে চাইলেন। ধোনি মুকুট ফিরিয়েও নিলেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঋতুরাজ সিংয়ের মত তরুণতর কাউকে দায়িত্ব দিলেন না। তাহলে মরসুমের শুরুতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন ছিল? জাদেজাও তো তেত্রিশ পেরিয়েছেন, কচি খোকাটি নন। তাঁর হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে কোন মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের আশা ছিল? জাদেজা এই মুহূর্তে চোট-আঘাতের কারণে মাঠের বাইরে। এই টানাপোড়েনে তাঁর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল কিনা তিনি মাঠে না ফেরা পর্যন্ত জানা যাবে না। যদি ধরে থাকে, তাহলে সুপার কিংসের চেয়ে বেশি ক্ষতি কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট দলের।

আসলে বাকি পৃথিবী সামনের দিকে তাকাতে চায়, আর আমরা চাই অতীতের গৌরবে বুঁদ হয়ে থাকতে। এ আমাদের জাতীয় চরিত্র। তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে অতি বড় ক্রিকেটারেরও ক্ষমতা কমে আসে, আজ না কমে থাকলেও পরের বড় টুর্নামেন্টটা আসতে আসতে যে কমে যেতে পারে – এসব কথা না তাঁরা নিজেরা মানেন, না তাঁদের ভক্তকুল মানে। তারকারা আয়নায় মুখ দেখতে পান না, কারণ মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। ফলে ব্যাটে বলে হচ্ছে না, পা বলের লাইনে যাচ্ছে না, রিফ্লেক্স কমে গেছে, বহু বছর ধরে অতিমাত্রায় জিম করার ফলে টানা দু ঘন্টা ব্যাট করলেই পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে – এসব যখন ক্রিকেটার নিজে বুঝতে শুরু করেন, তখনো সবাই মিলে কানের কাছে বলতে থাকে “ও কিছু নয়। কদিন ব্রেক নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” এমনটাই এনডর্সমেন্টের যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে হয়ে আসছে। যেনতেনপ্রকারেণ চল্লিশ অব্দি খেলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন শচীন। ধোনি ভাবলেন তিনিই বা কম কিসে? হয়ত পঁয়তাল্লিশকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছেন। বিরাট ভাবছেন তিনি তো কোনো অংশে ধোনির চেয়ে কম যান না। রোহিত সবে অধিনায়ক হলেন, পঞ্চাশ ওভার আর কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে তাঁরও ঝুড়ি ঝুড়ি রান আছে। তিনিই বা চল্লিশ অব্দি খেলার কথা ভাববেন না কেন? “ক্রিকেটের ঈশ্বর” তো শচীন, কুক তো নন। ফলে টেওয়াটিয়া, ত্রিপাঠীদের বেলা মেঘে মেঘেই বাড়বে।

ঋদ্ধিমান সাহার বেলায় দ্রাবিড় ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই ছেলেখেলা তিনি চলতে দেবেন না। এই ২০২২ সালেও উনবিংশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের গন্ধে মাতাল বাঙালি তা নিয়ে বিস্তর গোল করেছিল। এবারের আইপিএলে গুজরাট টাইটান্সের ওপেনার হিসাবে ঋদ্ধিমানের সাফল্যে আবার গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দল নির্বাচনের সময়ে যদি তরুণদের সুযোগ দেওয়ার নীতি ভুলে গিয়ে তারকাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু মানতেই হবে, পোর্টফোলিওতে যথেষ্ট পরিমাণ এনডর্সমেন্ট থাকলে ঋদ্ধিমানের বয়সও ঢেকে যেত।

*সব পরিসংখ্যান ১৯ মে, বৃহস্পতিবারের গুজরাট টাইটান্স বনাম রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ম্যাচ পর্যন্ত

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

ঝুলন সেরা বাঙালি ক্রিকেটার? মোটেই না

ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে লেখা অসম্ভব। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে অনায়াসে লেখা যেত। রেকর্ড বইয়ে সর্বোচ্চ রানের ওপেনিং জুটির তালিকার একেবারে শীর্ষে পঙ্কজ রায়ের নাম ছিল ঠিকই, কিন্তু রেকর্ড বই ইতিহাস নয়। একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলার পাকাপাকি জায়গা তৈরি করেছেন দুজন। একজন অবসর নেওয়ার দেড় দশক পরেও সারাক্ষণ সংবাদের শিরোনামে, বাঙালির নয়নের মণি। অর্থাৎ সৌরভ গাঙ্গুলি। অন্যজন কে, বাজি রেখে বলতে পারি, আপনি ভুরু কুঁচকে ভাবছেন।

এই শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে ফিক্সিং কেলেঙ্কারির বিপর্যয় কাটিয়ে অধিনায়ক হিসাবে সৌরভ যখন ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বদলে দিচ্ছিলেন, সেই সময়েই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাইতে একটি একদিনের ম্যাচে ভারতের হয়ে খেলতে শুরু করেন ঝুলন গোস্বামী। সে বছরই টেস্ট অভিষেক। ঝুলনের শুরুটা সৌরভের মত সাড়া জাগানো হয়নি। প্রথম টেস্টে এই ডানহাতি জোরে বোলার কোনো উইকেট পাননি। কিন্তু গত কুড়ি বছর ধরে ভারতের মহিলা দলের প্রায় সমস্ত স্মরণীয় জয়ে ঝুলনের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ২০০৬ সালে ভারতীয় মহিলারা ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতেন। প্রথম টেস্টে লেস্টারে নৈশপ্রহরী হিসাবে ঝুলন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতরান করেন। আর টনটনের দ্বিতীয় টেস্টে তিনি একাই একশো। প্রথম ইনিংসে ৩৩ রানে পাঁচ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রানে পাঁচ উইকেট। একদিনের ক্রিকেটে ঝুলন প্রকৃতপক্ষে একজন কিংবদন্তি। চলতি বিশ্বকাপে তিনি মহিলাদের বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হলেন, তারপরেই মেয়েদের একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসাবে ২৫০ উইকেটের মালিক হলেন।

যাঁরা মেয়েদের ক্রিকেটের খবর রাখেন তাঁরা জানেন, ভারতের মহিলাদের দলে এই মুহূর্তে দুজন আছেন যাঁরা সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়েন। কীর্তির দিক থেকে অধিনায়ক মিতালী রাজ যদি মেয়েদের ক্রিকেটের শচীন তেন্ডুলকর হন, ঝুলন অবশ্যই কপিলদেব। দুটো দশক জুড়ে ভারতীয় বোলিংকে নেতৃত্ব দেওয়া কত শক্ত, তা কপিলদেবের চেয়ে ভাল কে-ই বা জানে? ঝুলনের নামটা মাথায় আসেনি বলে জিভ কাটছেন নাকি? কাটবেন না, কারণ দোষ আপনার নয়। শুধু যে মহিলাদের ক্রিকেট টিভিতে অনেক কম দেখানো হয় আর কাগজে অনেক কম লেখা হয় তা-ই নয়, কপিলদেব ১৬ বছরে খেলেছেন ১৩১টা টেস্ট আর ২২৫টা একদিনের ম্যাচ। ঝুলন কুড়ি বছরে ২০১ খানা একদিনের ম্যাচ (২২ মার্চ, ২০২২ তারিখে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ পর্যন্ত) খেললেও টেস্ট খেলেছেন মাত্র বারোটা। একদিনের ম্যাচের সংখ্যাটাও আসলে কপিলের সাথে তুলনীয় নয়, কারণ কপিলের কেরিয়ারের বেশ খানিকটা সময়ে একদিনের ক্রিকেট ছিল লম্বা টেস্ট সিরিজের শেষ পাতে মিষ্টির মত। কিন্তু ঝুলনের দু বছর আগে অভিষেক হওয়া জাহির খান বারো বছরেই দুশো একদিনের ম্যাচ খেলে ফেলেছিলেন।

ভারতীয় পুরুষদের ক্রিকেটের মহীরুহ যাঁরা, তাঁদের ঝুলিতে একটা জিনিস আছে যা বাংলার গৌরব সৌরভের ঝুলিতে নেই। ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ রিকি পন্টিংয়ের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া সৌরভের হাতে বিশ্বকাপ ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা দুরমুশ করে চতুর্থবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। কিন্তু কপিলদেব বিশ্বকাপ জিতেছেন, সুনীল গাভস্করও সেই দলে ছিলেন। বিশ্বসেরার মেডেল গলায় ঝুলিয়েছে শচীন তেন্ডুলকর আর মহেন্দ্র সিং ধোনিও। ব্যক্তিগত কৃতিত্বে ঝলমলে কেরিয়ারে ঝুলন আর মিতালীর ও জিনিসটার স্বাদ এখনো পাওয়া হয়নি। পেতে গেলে চলতি বিশ্বকাপে দুজনকেই নিজেদের সেরা ফর্মের কাছাকাছি থাকতে হবে। প্রথম চারটে ম্যাচে নীরব থাকার পর পঞ্চম ম্যাচে মিতালীর ব্যাট কথা বললেও পার্থক্য গড়ে দিতে পারেনি। বাংলাদেশ ম্যাচে দল জিতে গেলেও মিতালী আবার ব্যর্থ। ঝুলন মন্দ খেলছিলেন না, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে একেবারেই ফ্লপ, সহজ বাংলাদেশ ম্যাচে ছিলেন স্বমহিমায়। গতবার ফাইনালে উঠেও ইংল্যান্ডের কাছে হারতে হয়েছিল। বাকি রইল দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। সেটা জিততে পারলে এখনো ভারতের সেমিফাইনালে পৌঁছবার সম্ভাবনা আছে। যদি শেষপর্যন্ত স্মৃতি মান্ধনা, পূজা বস্ত্রকর, শেফালি বর্মার মত তরুণদের সাথে মিতালী, ঝুলন, হরমনপ্রীতদের সুর মিলে যায় তাহলে ৩ এপ্রিল ক্রাইস্টচার্চে প্রথম বাঙালি হিসাবে ঝুলন ছুঁয়ে ফেলবেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সঙ্গে থাকবেন শিলিগুড়ির রিচা ঘোষ।

চিন্তা করবেন না। এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকতা দেখাতে না পারা ভারতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত ঘটনা ঘটে গেলেও ঝুলনকে আমরা কেউ সেরা বাঙালি ক্রিকেটার বলার ধৃষ্টতা দেখাব না। মহিলাদের ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাক আর না-ই থাক, শিগগির জেনে যাব যে মেয়েদের ক্রিকেটের বোলারদের গড় গতি ছেলেদের চেয়ে কম। আরও নানা তথ্য থেকে প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে না যে মেয়েদের বিশ্বকাপ জয় আর ছেলেদের বিশ্বকাপ জয় এক নয়। সেরেনা উইলিয়ামসকে ও দেশে কেউ রাফায়েল নাদাল, রজার ফেডেরার বা নোভাক জোকোভিচের চেয়ে কম বড় খেলোয়াড় ভাবে না। তা বলে আমাদেরও যে ওভাবে ভাবতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি।

আরও পড়ুন কালোর জন্যে কাঁদা, অথচ সাদা মনে কাদা

তাছাড়া সৌরভের বায়োপিক হওয়ার আগেই যে বলিউড ঝুলনের বায়োপিক বানিয়ে ফেলছে, সে কি কম স্বীকৃতি? তাতে আবার ঝুলনের চরিত্রে অভিনয় করছেন ছেলেদের ক্রিকেট দলের অধিনায়কের অভিনেত্রী স্ত্রী। এর চেয়ে বেশি কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে ঝুলনের মত একজন শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারের? ঢ্যাঙা, কালো মেয়ে মাঠে উইকেট তুলতে পারে, রান করতে পারে। কিন্তু পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে যখন তার জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখতে যাব, তখন পর্দায় একটা টুকটুকে মেয়ে না থাকলে চলবে কেন? আমরা মণিপুরি মেরি কমকে পর্দায় দেখি পাঞ্জাবি অভিনেত্রীর অবয়বে, বাংলার ঝুলনকেও সেভাবেই দেখব। দেখে পপকর্ন খেতে খেতে হাততালিও দেব। দেশের ক্রিকেট বোর্ডই যখন মহিলা ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক পুরুষদের ধারেকাছে হওয়া উচিত বলে মনে করে না, দলটার নিয়মিত খেলতে পাওয়া উচিত বলেও মনে করে না, তখন আমরা সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা সব সমান করে ভাবতে যাব কেন? আমাদের কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখার জন্য কেন ছটফট করব?

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত জনগণমন

ব্র্যান্ড বুদ্ধ। কথাটা এই শতকের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এতটাই জনপ্রিয় যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিজের দলের সদস্যরা, যাঁদের তাত্ত্বিক ভাবে ব্র্যান্ডিং ব্যাপারটা নিয়েই প্রবল আপত্তি থাকার কথা, তাঁরাও বেশ সন্তোষ প্রকাশ করতেন। যদি ধরে নেওয়া যায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সত্যিই একটি ব্র্যান্ড, তাহলে মানতেই হবে সে ব্র্যান্ড রীতিমত জনপ্রিয় হয়েছিল। শতকের প্রথম দশকের দুটো নির্বাচনেই বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন দল তথা জোট হই হই করে জিতেছিল। ব্র্যান্ড বুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত এবং সফল ব্র্যান্ড মোদি। মানতেই হবে ব্র্যান্ড নির্মাণের মুন্সিয়ানাও সেখানে অনেক বেশি। কারণ একজন লেখাপড়া জানা ভদ্রলোককে নির্ভরযোগ্য প্রশাসক হিসাবে তুলে ধরার চেয়ে গোটা রাজ্যে গণহত্যা চলার সময়ে ক্ষমতাসীন নেতাকে গোটা দেশ চালানোর পক্ষে বিকল্পহীন প্রশাসক হিসাবে তুলে ধরা বহুগুণ কঠিন। ব্র্যান্ড নির্মাণ মানেই হল যা না থাকলেও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না তাকেই অপরিহার্য বলে প্রতিষ্ঠা করা, যার বিকল্প আছে তাকে নির্বিকল্প হিসাবে ঘোষণা করা। তাই কেবল ভালো বললে চলে না, তুলনায় যেতে হয়। আর সকলের চেয়ে ভালো, এ পর্যন্ত যা যা দেখেছেন, সবার চেয়ে ভাল — এইসব বলতে হয়। তাই নরেন্দ্র মোদি কোনো শিশুর দিকে তাকিয়ে হাসলেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি কোনো শিশুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন — এই জাতীয় প্রচারের প্রয়োজন পড়ে।

রাজনীতিবিদের ব্র্যান্ড নির্মাণ করার চেয়ে খেলোয়াড়দের ব্র্যান্ড নির্মাণ করা সহজ। কারণ তাঁরা কাজের অঙ্গ হিসাবেই সাধারণ মানুষের নিরিখে অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা করে থাকেন। অভিনেতারাও করেন বটে, কিন্তু তা অবশ্যই পূর্বনির্ধারিত; চিত্রনাট্য এবং প্রযুক্তির সহায়তায় করা। আজকের দিনের দর্শকরা জানেন কোনটা ক্যামেরার কারসাজি, কোথায় আসল নায়ক হল ভিএফএক্স। কিন্তু বিরাট কোহলির দিকে যখন বাউন্সার ধেয়ে আসে, তখন তিনি পুল করতে পারলে তবেই বল মাঠের বাইরে যাবে। ওখানে ফাঁকি চলে না। তাই তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা এমনিতেই বেশি। কিন্তু ওতে সন্তুষ্ট হলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ড নির্মাণ সম্ভব নয়।

গাড়ির টায়ার থেকে টিএমটি বার, পেশাগত শিক্ষার সাইট থেকে পটেটো চিপসের বিকল্প স্ন্যাকস যাঁকে দিয়ে বিক্রি করাতে হবে — তিনি যে কেবল দারুণ খেলোয়াড় নন, অন্য সকলের চেয়ে, এমনকি আগে যাঁরা ক্রিকেট খেলেছেন তাঁদের সকলের চেয়ে ভাল; নিদেনপক্ষে সর্বকালের সেরাদের মতই ভাল, তা প্রতিষ্ঠা না করলে চলে না। এই কারণেই সারা পৃথিবীর খেলাধুলোয় বর্তমানের তারকাদের সর্বকালের সেরার আসনে বসানোর হুড়োহুড়ি।

অতীতে কোনো খেলোয়াড় সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়েন কিনা সে আলোচনা শুরু হতো তাঁর কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে বা কেরিয়ার শেষ হলে। কিন্তু শচীন তেন্ডুলকর যখন মধ্যগগনে, তখনই এই মর্মে বিপুল প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারণ তখন বিপুল টাকার চুক্তি নিয়ে ওয়ার্ল্ড টেল এসে পড়েছে ভারতীয় ক্রিকেটে, শচীনকে ধনী করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মার্ক মাসকারেনহাস। অশীতিপর ডন ব্র্যাডম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছেন, ‘এই ছেলেটাকে দেখে আমার নিজের কথা মনে পড়ে।’ ব্যাস! আর যায় কোথায়? সর্বকালের সেরা হিসাবে শচীনের এমন জোরদার ব্র্যান্ডিং হল, কাগজে এমন লেখালিখি, টিভিতে এমন বিজ্ঞাপন যে আমরা যারা সুনীল গাভস্করের খেলা দেখিনি; কপিলদেব, ইয়ান বোথাম, ভিভ রিচার্ডসদের তাঁদের সেরা সময়ে দেখিনি; তারা নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলাম — সবার উপরে শচীন সত্য, তাহার উপরে নাই। সর্বকালের সেরার মুকুটের জন্য শচীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আমরা বড়জোর ব্রায়ান লারাকে মানতে রাজি ছিলাম, কোনো প্রাক্তনকে মোটেই নয়।

ব্র্যান্ডিংয়ের সেই ট্র্যাডিশন আজও সমান তালে চলছে। শচীন অবসর নিয়েছেন বলে তো আর ব্যবসা থেমে থাকতে পারে না, অতএব পরবর্তী GOAT (গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম — এই অভিধাটি সোশাল মিডিয়ার যুগে নতুন আমদানি, শচীনের সময়ে চালু হয়নি) হয়ে গেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তাঁর কেরিয়ার শেষের দিকে যেতেই বিরাট। প্রত্যেক প্রজন্মেই আগের গোটের নৈপুণ্যকে অতিক্রম করে এসে যাচ্ছেন নতুন গোট। মানবিক দক্ষতার এত দ্রুত বিবর্তন হয় জানলে হয়ত চার্লস ডারউইন ওরিজিন অফ স্পিসিজ নিজে হাতে পুড়িয়ে দিতেন।

গোট প্রচার ভোট প্রচারের মতই শক্তিশালী। শচীনের আমলে কেবল সাংবাদিককুল আর বিজ্ঞাপন ছিল প্রচারযন্ত্র। এখন যুক্ত হয়েছে সোশাল মিডিয়া। কেবল প্রচার নয়, ভিন্নমতের প্রতিকারও সেখানে হয়ে থাকে। ট্যুইটারে একবার বলে দেখুন, বিরাট নিঃসন্দেহে বড় ব্যাটার। কিন্তু সর্বকালের সেরা বলার সময় হয়েছে কি? পঙ্গপালের মত ধেয়ে আসবেন বিরাটভক্তরা। আক্রমণ শুরু হবে আপনি যে ক্রিকেটের ‘ক’ বোঝেন না সেই ঘোষণা দিয়ে। ক্রমশ আপনি যে মোগ্যাম্বোসুলভ খলনায়ক তা বলা হবে। তারপর প্রমাণ করা হবে আপনি দেশদ্রোহী; নামটা মুসলমান হলে সোজা পাকিস্তানি। গালিগালাজ ইত্যাদি তো আছেই। বলা যেতেই পারত যে এসবের সাথে খেলার বা খেলোয়াড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। ক্রীড়ানুরাগীরা কালে কালে এরকম জঙ্গিপনা করে আসছেন, সোশাল মিডিয়া আসায় পাড়ার রকের জঙ্গিপনা জনপরিসর পেয়ে গেছে মাত্র। দুঃখের বিষয়, তা বলা যাবে না। কারণ দু’টি।

প্রথমত, এমন আক্রমণ কেবল রাম শ্যাম যদু মধুরা করে না। সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার, ভেরিফায়েড হ্যান্ডেলওলা উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, ডাক্তার, উকিল — কেউই বাদ যান না। দ্বিতীয়ত, বিরাট নিজেও একাধিকবার ট্রোলদের মত আচরণ করেছেন।

ভারতের শাসক দলের মত ভারতের ক্রিকেট দলও সমালোচনা মোটেই বরদাস্ত করে না সেই ধোনির আমল থেকেই। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই মাইনে দিয়ে ধারাভাষ্যকার রাখে। দল হারুক আর জিতুক, ভারতীয় ক্রিকেটারদের সমালোচনা করেছ কি মরেছ। ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন হর্ষ ভোগলে। অমিতাভ বচ্চনের টুইট রিটুইট করে ভোগলের ধারাভাষ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন ভারত অধিনায়ক ধোনি। তারপরই ভোগলের কন্ট্র্যাক্ট চলে যায়। বিরাট ক্রিকেটের মেধাবী এবং মনোযোগী ছাত্র; তিনি বড়দের দেখে যা শিখেছেন তা তাঁদের চেয়ে ঢের বেশি জোর দিয়ে করেন। ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালীন অনুশীলনের সময়ে তিনি এক ভারতীয় সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল ওই সাংবাদিক বিরাট আর অনুষ্কা শর্মার সম্পর্ক নিয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা লিখেছেন। পরে যখন জানা যায় সেই নিবন্ধ অন্য এক সাংবাদিকের লেখা, তখন বিরাট ক্ষমা চান। অর্থাৎ ভুল লোককে গালিগালাজ করা হয়েছে বলে ক্ষমা চান। এই ঘটনায় টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বিরাটকে বুঝিয়েছেন যে ভবিষ্যৎ ভারত অধিনায়কের এরকম ব্যবহার সাজে না। যদিও বিরাট তখন ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হয়ে গিয়েছেন।

২০১৮ সালে বিরাটের কোপে পড়েন এক ক্রিকেটপ্রেমীও। দোষের মধ্যে, তিনি বলেছিলেন ভারতের চেয়ে অন্য দেশের ব্যাটারদের খেলা দেখতে তাঁর বেশি ভালো লাগে। বিরাট তাঁকে সটান বলে দেন, তাহলে অন্য দেশে গিয়েই থাকা উচিত। দেশের শাসক দল বিজেপি ও তার ট্রোলরা তখন অনলাইন এবং অফলাইন — সর্বত্র সরকারবিরোধী কথা বললেই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। অবশ্য এরকম প্রতিধ্বনিতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আচমকা নোটবন্দির ঘোষণা করার সাতদিন পরে সাংবাদিক সম্মেলনে বিরাট বলেছিলেন, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওটা তাঁর দেখা সেরা সিদ্ধান্ত।  বিরাট ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস কতখানি জানেন সে প্রশ্ন তোলা নিষ্প্রয়োজন, কারণ যিনি গোট তিনি তো কেবল খেলার গোট নন, তিনি সর্বজ্ঞ।

ব্র্যান্ডিংয়ের এমনই মহিমা, যে সাংবাদিক সম্মেলনে অপছন্দের প্রশ্ন শুনলেই রেগে যাওয়ার ধারাবাহিক ইতিহাস, কাগজে কী বেরোল তা নিয়ে সাংবাদিককে আক্রমণ করা এবং বিতর্কিত সরকারি সিদ্ধান্তকে সাত তাড়াতাড়ি সমর্থন করার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বিরাটের অধিনায়কত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে বড় অংশের বিজেপিবিরোধী মানুষ নিঃসন্দেহ, যে বিরাটকে সরিয়ে দেওয়া আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মহম্মদ শামির পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলেন বলে অমিত শাহের নির্দেশে তাঁর পুত্র জয় শাহ ও বশংবদ সৌরভ গাঙ্গুলি মিলে বিরাটকে একদিনের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, আর টেস্টের নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছেন।

আরও পড়ুন সকলেই চুপ করে থাকবে, শামিকে মানিয়ে নিতে হবে

বিরাটের কথা উঠলেই যে দেশের বেশিরভাগ মানুষের যুক্তিবোধ ঘুমিয়ে পড়ে, সবটাই আবেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় — এখানেই ব্র্যান্ড নির্মাতাদের সাফল্য। নানা মহল থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এখন আর আগের জায়গায় নেই। কিন্তু সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তার সময়েও তিনি এভাবে ডান, বাম, মধ্যপন্থীদের এক করে ফেলতে পারেননি। রাজনীতিতে এবং সমাজে যেসব প্রবণতার চরম নিন্দা করে থাকেন মোদিবিরোধীরা, সেগুলোই বিরাটের মধ্যে দেখা গেলে সকলে জাতীয়তাবাদী হয়ে পড়েন। প্রযুক্তির সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি বলে অধিনায়ক সদলবলে হাস্যকর অসভ্যতা করলেও কেউ বলেন না, বিদেশের মাঠে অধিনায়ক প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাষ্ট্রদূত। তিনি এই আচরণ করতে পারেন না, এর জন্যে শাস্তি হওয়া উচিত। উল্টে উঠে আসে বনলতা সেনগিরির যুক্তি (যাকে ইংরেজিতে বলা হয় হোয়াট্যাবাউটারি) — এরকম যখন সাহেবরা করত তখন কোথায় ছিলেন? এখন আমাদের জোর হয়েছে, তাই বিরাট করছে। বেশ করছে। রাজনীতিবিদদের গুন্ডাসুলভ কথাবার্তার যাঁরা অহরহ নিন্দা করেন, তাঁরাও বিরাটের নেতৃত্বাধীন দলের খেলার মাঠে অকারণ চিৎকার, খেলার পরেও সাংবাদিক সম্মেলনে এসে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলাকে আগ্রাসনের যুক্তিতে সমর্থন করেন। বিজেপি কথিত যে ‘নিউ ইন্ডিয়া’ অনেকের প্রবল অপছন্দ, সেই ভারতের বৈশিষ্ট্যগুলোই বিরাটের শরীরী ভাষায় দেখে একই লোকেদের যে উল্লাস– সেটাই ব্র্যান্ডিংয়ের জয়পতাকা।

সরকারি দল, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ এবং সহায়ক সংবাদমাধ্যম যখন বলে তারা ক্ষমতায় আসার আগে ভারতে কোনো উন্নয়ন হয়নি, বিদেশে ভারতের কোনো সম্মান ছিল না, ভারতীয়রা ভীতু বলে পরিচিত ছিল; তখন প্রতিবাদ করার লোক পাওয়া যায়। অথচ শাস্ত্রী, বিরাট এবং তাঁদের ভগবান বানিয়ে তোলা সংবাদমাধ্যম গত কয়েক বছর ধরে প্রচার করে যাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেট দল আগে আক্রমণাত্মক ছিল না, লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না, ক্রিকেটাররা মুখের মত জবাব দিতে পারতেন না ইত্যাদি। এই প্রোপাগান্ডা হাঁ করে গিলছেন প্রায় সবাই। ইতিহাস বিকৃত করা অথবা অস্বীকার করার যে ধারা এ দেশে চালু হয়েছে, সেই ধারারই অংশ এসব। যেন ১৯৭৬ সালে পোর্ট অফ স্পেনে নেহাত মিনমিন করে মোহিন্দর অমরনাথ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সুনীল গাভস্কররা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চতুর্থ ইনিংসে ৪০৬ রান তুলে জয় ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন। যেন স্টিভ ওয়র বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০০৩-০৪ মরসুমে সমানে সমানে লড়েনি ভারতীয় দল। যেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর কপিলদেব অপরাজিত ১৭৫ করতে পেরেছিলেন লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছাড়াই। ১৯৮১ সালে আগের টেস্টেই বাউন্সারে আহত হয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়া সন্দীপ পাতিলের অ্যাডিলেড টেস্টে ডেনিস লিলি, রডনি হগ, প্যাসকোকে বাইশটা চার আর একটা ছয় মেরে ১৭৪ রান করাও বোধহয় সম্ভব হয়েছিল আক্রমণাত্মক না হয়েই।

একটা প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত বিপক্ষে যাওয়ায় বিরাট নেশাগ্রস্তের মত স্টাম্প মাইক্রোফোনে টিভি সম্প্রচারকারীকে ধমকেছেন, সহ অধিনায়ক কে এল রাহুল গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটাকেই অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু ম্যাচের পর বিরাট ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কয়েকটা অর্থহীন কথা বলেছেন। “মাঠের ভিতরে ঠিক কী ঘটছিল বাইরের লোকেরা তো জানে না, আমরা জানি। আমি এখন বলব না যে আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কারণ তখন যদি আমরা চার্জড আপ হয়ে গোটা তিনেক উইকেট নিয়ে নিতাম তাহলেই খেলাটা ঘুরে যেত।” মনে করুন ২০০৭-০৮ মরসুমে সিডনি টেস্টের কথা। অস্ট্রেলিয় তৃতীয় আম্পায়ারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে ভারত কোণঠাসা হয়, তারপর শেষ দিনে স্রেফ রিকি পন্টিংয়ের মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে আম্পায়াররা সৌরভকে ড্রপ পড়া বলে আউট দেন, দল হেরে যায়। ভারত অধিনায়ক অনিল কুম্বলে মাঠের ভিতরে ছেলেমানুষের মত হাত-পা ছোঁড়েননি, চিৎকার করেননি। কিন্তু খেলার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন “এখানে একটা দলই ক্রিকেটের স্পিরিট অনুযায়ী খেলছিল।” এসব লড়াকু মনোভাব নয়, আগ্রাসন নয়, সাহসিকতা নয় — এমনটাই শিখে গেছি আমরা।

বিরাটের নেতৃত্বে নতুন কী ঘটেছে আসলে? ভারতীয় দল অনেক বেশি জয়ের মুখ দেখেছে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবার, দ্বিতীয়বার টেস্ট সিরিজ জিতেছে। কিন্তু সেই জয় আকাশ থেকে পড়েনি। বিরাটের দলের এই স্মরণীয় জয়গুলো এসেছে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়। সৌরভের আমলে শুরু হয়েছিল বিদেশে নিয়মিত টেস্ট ম্যাচ জেতা। জয়ের সংখ্যা বাড়ে ধোনির আমলে, বিরাটের আমলে আরম্ভ হয়েছে সিরিজ জয়। তার কৃতিত্ব অনেকটাই জোরে বোলারদের, নেতা হিসাবে অবশ্যই বিরাটেরও। উপরন্তু জয়ের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বিরাটের আমলে ভারত ইংল্যান্ডে সিরিজ জেতেনি, নিউজিল্যান্ডেও নয়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা হয়নি, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও দু’বারের চেষ্টায় প্রথমবার সিরিজ জিতে নতুন ইতিহাস তৈরি করা যায়নি। কিন্তু বিরাট বন্দনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এসব কথা বলতে গিয়েও ঠারেঠোরে জওহরলাল নেহরুকে ছোট করার ঢঙে আগের অধিনায়কদের এক হাত নেওয়া হয়। বলা হয় বিরাটের আগে কোনো অধিনায়ক নাকি জোরে বোলারদের এত গুরুত্ব দেননি। ঘটনা হল, আগে কোনো অধিনায়ক একসাথে এতজন ভাল জোরে বোলার পাননি। ভারতীয় ক্রিকেটে একসময় বিষাণ সিং বেদিকে বোলিং ওপেন করতে হয়েছে, এমনকী দু-একবার গাভস্করকেও। কারণ বিশ্বমানের জোরে বোলার কেউ ছিলেন না। সে পরিবর্তনও এসেছে ধারাবাহিকভাবেই।

প্রথমে এসেছেন কপিলদেব। তাঁর কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে জাভাগাল শ্রীনাথ, পিছু পিছু ভেঙ্কটেশ প্রসাদ। পরবর্তীকালে জাহির খান, আশিস নেহরারা। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছনো হত না পেস ত্রয়ীকে ছাড়া। সে ত্রয়ী তৈরিই হত না অধিনায়ক সৌরভ প্রায় অবসর নিয়ে ফেলা শ্রীনাথকে খেলতে রাজি না করালে। সৌরভের সময়েই সাড়া জাগিয়ে এসেছিলেন ইরফান পাঠান, যাঁর অলরাউন্ডার হতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। রাহুল দ্রাবিড় অধিনায়ক থাকার সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারতের হয়ে অল্প কিছুদিন রীতিমত গতিময় বোলিং করেছিলেন মুনাফ প্যাটেল আর বিক্রম রাজবীর সিং। প্রথম জন ক্রমশ গতি কমিয়ে ফেলেন, দ্বিতীয় জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে পারেননি। রাহুলের আমলেই উঠে এসেছিলেন শান্তাকুমারণ শ্রীশান্ত, রুদ্রপ্রতাপ সিংরা। ইতিমধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে, জোরে বোলারদের প্রতি যত্ন বেড়েছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে জোরে বোলিং সহায়ক পিচ তৈরিও শুরু হয়েছে। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামিদের রাত্রির বৃন্ত থেকে ফুটন্ত সকাল ছিঁড়ে আনার মত করে বিরাট নিয়ে আসেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সুযোগ না পাওয়া একজন অধিনায়কের পক্ষে তা সম্ভবও নয়।

এসব গোপনীয় তথ্য নয়, কিন্তু এখন কারো মনেই পড়ে না। কারণ আমাদের মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে, আর বিজ্ঞাপন ঢেকেছে বিরাটের মুখে। তাই একদিনের ক্রিকেটের দল একের পর এক বিশ্ব স্তরের টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হোক, বিরাটকে সরানো চলবে না। তিনি বিবৃতি দেবেন “টেস্ট আর একদিনের দলের নেতৃত্ব দিতে তৈরি থাকার জন্য টি টোয়েন্টির নেতৃত্ব ছেড়ে দিচ্ছি।” তবু আমাদের মনে হবে না, ভদ্রলোক অধিনায়কত্বকে জমিদারি মনে করছেন। তিনি গোট, তাঁর সাত খুন মাফ।

বস্তুত, ব্র্যান্ডিংয়ের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারলে দেখতে পেতাম, বিরাট (৯৯ টেস্টে ৭৯৬২ রান, গড় ৫০.৩৯, শতরান ২৭) টেস্ট ক্রিকেটে দারুণ এবং নিজের সময়ের সেরা ব্যাটারদের অন্যতম। কিন্তু গোট তো নয়ই, তাঁকে সর্বকালের সেরাদের একজন বলার সময়ও আসেনি। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে স্টিভ স্মিথ (৮২ টেস্টে ৭৭৮৪ রান, গড় ৫৯.৮৪, শতরান ২৭), কেন উইলিয়ামসন (৮৬ টেস্টে ৭২৭২ রান, গড় ৫৩.৪৭, শতরান ২৪) বরং তাঁর চেয়ে বেশি ধারাবাহিক। কেবল রানের দিক থেকে টেস্টের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দশে ঢুকতে হলেও বিরাটকে এখনো জনা কুড়ি খেলোয়াড়কে টপকাতে হবে। শুধু ভারতীয়দের মধ্যেও তিনি আপাতত ছয় নম্বরে। দলের জন্য যা আরও চিন্তার, তা হল গত কয়েক বছরে তাঁর পারফরম্যান্স গ্রাফ ক্রমশ নামছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে শেষ শতরানের পর থেকে হিসাব করলে তাঁর গড় ২৮.১৪।

আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি এই মুহূর্তে রানের দিক থেকে দু’নম্বরে, গড়ে এক নম্বর (৯৫ ম্যাচে ৩২২৭ রান, গড় ৫২.০৪), অধিনায়কত্বের রেকর্ডও ভাল। একদিনের ক্রিকেটের অধিনায়কত্বের রেকর্ডও নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় সাদা বলের ক্রিকেটে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জয়ের বিশেষ মূল্য নেই আজকের ক্রিকেটে। কারণ টি টোয়েন্টি যুগে দলগুলোর দ্বিপাক্ষিক ওয়ান ডে ম্যাচ খেলার আগ্রহ ক্রমশ কমছে। চার বছর অন্তর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে এক বছর অন্তর টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অর্থাৎ একটি দল পাঁচ বছরে চারটি বিশ্বকাপ খেলছে। সুতরাং দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলো বিশ্বকাপের প্রস্তুতি মাত্র। লক্ষ করে দেখুন, অস্ট্রেলিয়ার যে দল সদ্য ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি জিতল, সেই দলের সঙ্গে কিছুদিনে আগেই যে দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরেছিল তার বিস্তর তফাত। সুতরাং বিশ্বকাপে বা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রান করতে না পারলে বা ট্রফি জিততে না পারলে অন্য সময়ের ফলাফলের বিশেষ গুরুত্ব থাকে না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে আইপিএলের মত ফ্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট। সেখানে ব্যাটে প্রচুর রান থাকলেও নেতা বিরাট কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থ। রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের নেতা হিসাবে তাঁর প্রাপ্তি শূন্য।

যে ক্রিকেটে বিরাট সত্যিই সর্বকালের সেরাদের আসনের দাবিদার, তা হল একদিনের ক্রিকেট (২৫৫ ম্যাচে ১২২২০ রান, গড় ৫৯.০৩, শতরান ৪৩)। এখানে তাঁর সমসাময়িকরা কেউ ধারে কাছে নেই। শচীনের ৪৯ শতরানের রেকর্ডের থেকে মাত্র ছয় ধাপ দূরে আছেন বিরাট। গড়ের দিক থেকে তিনি আপাতত তিন নম্বরে, কিন্তু সামনের দু’জন খেলেছেন মাত্র গোটা তিরিশেক ম্যাচ। দুশোর বেশি ম্যাচ খেলেছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে তাঁর ব্যাটিং গড়ই সর্বোচ্চ। কিন্তু মুশকিল হল, ৫০ ওভারের খেলায় যাঁরা সর্বকালের সেরা হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত, অর্থাৎ ভিভ রিচার্ডস, শচীন, রিকি পন্টিং, সনৎ জয়সূর্য, কুমার সঙ্গকারা বা ধোনি — তাঁদের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের পাশে বিরাট ফ্যাকাশে (২৬ ম্যাচে ১০৩০ রান, গড় ৪৬.৮১, শতরান ২)। অথচ খেলে ফেলেছেন তিনটে বিশ্বকাপ। বিশেষত নক আউট স্তরে তাঁকে একবারও স্বমহিমায় দেখা যায়নি। বিশ্বকাপে রান এবং শতরানের দিক থেকে সবার উপরে থাকা শচীন তো বটেই, তিলকরত্নে দিলশান (২৭ ম্যাচে ১১১২ রান, গড় ৫২.৯৫, শতরান ৪), হার্শেল গিবসের (২৫ ম্যাচে ১০৬৭ রান, গড় ৫৬.১৫, শতরান ২) মত ক্রিকেটারদেরও বিরাটের চেয়ে বেশি স্মরণীয় পারফরম্যান্স রয়েছে। ফর্ম থাকলে আগামী বছর ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে হয়ত তিনি এই অভাব পুষিয়ে দেবেন।

একথা ঠিক যে পরিসংখ্যান দিয়ে সব কিছু প্রমাণ হয় না। কারণ পরিসংখ্যানে ধরা থাকে না পিচের অবস্থা, ম্যাচের পরিস্থিতি বা খেলোয়াড়ের শারীরিক অসুবিধা। ধুম জ্বর গায়ে বা বাউন্সারে মাথা ফেটে যাওয়ার পর করা ৩০ রানের মূল্য পরিস্থিতির বিচারে শতরানের চেয়েও বেশি হয় অনেকসময়। ব্যাটিংয়ের ল্যাজকে সঙ্গে নিয়ে আহত ভিভিএস লক্ষ্মণের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট জেতানো ইনিংসের মূল্য সংখ্যায় মাপা যায় কখনো? গত বছর রবিচন্দ্রন অশ্বিন আর হনুমা বিহারীর অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট বাঁচানো জুটির ওজনও ওই ম্যাচের স্কোরকার্ড দেখে উপলব্ধি করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাটিং কতটা ভাল তা প্রতিপক্ষের বোলিংয়ের মান না জেনে বিচার করা মূর্খামি। কারণ ক্রিকেট খেলায় একমাত্র বোলিংটাই ক্রিয়া; ব্যাটিং আর ফিল্ডিং হল প্রতিক্রিয়া।

কিন্তু পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে আলোচনা করলে বিরাটকে আর তত বিরাট মনে হবে না হয়তো। কারণ তখন বলতেই হবে, তাঁর কেরিয়ারের বড় অংশে সারা পৃথিবীতে এমন জোরে বোলার বিরল, যিনি যে কোনো পিচে যে কোনো আবহাওয়ায় দিনের যে কোনো সময়ে ঘন্টায় নব্বই মাইল বা তার বেশি গতিতে বল করতে পারেন। বড়জোর অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসন আর দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইন, মর্নি মর্কেলের কথা ভাবা যেতে পারে। নব্বই আর শূন্য দশকে কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, প্যাট্রিক প্যাটারসন, অ্যালান ডোনাল্ড, শোয়েব আখতার, ব্রেট লি, শেন বন্ডরা ছিলেন। সত্তর ও আশির দশকে ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয় ধরানো পেস চতুর্ভুজ, অস্ট্রেলিয়ার লিলি-থমসন, নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হেডলি, ইংল্যান্ডের বব উইলিস, পাকিস্তানের আক্রাম-ইউনিস। আরও বলতে হবে, তত গতিময় না হলেও এখন মিচেল স্টার্ক, জশ হেজলউড, জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, টিম সাউদিদের মত সুইং ও সিম করাতে পারা বোলাররা আছেন। কিন্তু বিশ্বমানের স্পিনার বলতে শুধু নাথান লায়ন। আজাজ প্যাটেল যতই এক ইনিংসে দশ উইকেট নিন, নিউজিল্যান্ড স্পিন সহায়ক উইকেট নয় বলে পরের ম্যাচেই তাঁকে খেলায়নি। আর ছিলেন ইয়াসির শাহ, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বিরাটের তাঁর বিরুদ্ধে খেলা হয়নি। অত্যন্ত মাঝারি মানের অ্যাডাম জাম্পা বা আদিল রশিদের বিরুদ্ধে কিন্তু বিরাটকে স্বচ্ছন্দ দেখায় না।

২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি ৫০ ওভারের খেলা দু প্রান্ত থেকে দুটি আলাদা বলে খেলা হবে — এই নিয়ম চালু করে। আগে একটি বলেই গোটা ইনিংস খেলার নিয়ম ছিল। সাধারণত ৩৫-৪০ ওভার নাগাদ সেই বলের সাদা রং নষ্ট হয়ে গিয়ে ব্যাটারদের দেখতে অসুবিধা হত, বল নরম হয়ে যাওয়ায় মারতে অসুবিধায় পড়তে হত, অনেকসময় বলের আকৃতিও যেত বিগড়ে। তেমন হলে আম্পায়াররা বল বদলাতে পারবেন, কিন্তু সেই বল আনকোরা নতুন হবে না, হবে একটু পুরনো বল। আগে হয়ে যাওয়া খেলাগুলোর মাঠ থেকে সংগ্রহ করে আনা অনেকগুলো বলের মধ্যে থেকে আম্পায়াররা বল বেছে নেবেন — এই ছিল নিয়ম। দুটো বলে খেলা শুরু হওয়ায় রিভার্স সুইং প্রায় বন্ধ, কারণ বল তেমন পুরনো হচ্ছে না। একই কারণে স্পিনারদের পক্ষে বল ঘোরানোও বেশি শক্ত হয়ে গেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রভাবে বাউন্ডারিও যে ছোট করে ফেলা হয়েছে, সচেতন টিভি দর্শকও তা বুঝতে পারেন। স্বভাবতই ব্যাটিং আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। শতরানের সংখ্যা বেড়েছে, আগে ব্যাট করলে তিনশো রান করে নিশ্চিন্ত থাকার দিন শেষ।

১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি খেলা হয়েছিল প্রথম একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ, আর প্রথম দ্বিশতরান এসেছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেটার বেলিন্দা ক্লার্কের ব্যাট থেকে। পুরুষদের ক্রিকেটে দ্বিশতরান এসেছে আরও ১৩ বছর পরে শচীনের ব্যাট থেকে। অথচ ২০১১ থেকে গত ১১ বছরে বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ক্রিস গেল, মার্টিন গাপ্টিল, ফখর জমান — সকলেই দ্বিশতরান করেছেন। একা রোহিত শর্মাই তিনটে দ্বিশতরানের মালিক। একদিনের ক্রিকেটে যাঁদের গড় পঞ্চাশের বেশি, তাঁদের মধ্যে মাইকেল বিভান আর নেদারল্যান্ডসের রায়ান টেন দুশখাতাকে বাদ দিলে সকলেরই কেরিয়ারের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ২০১১ সালের অক্টোবরের পরে।

বলা বাহুল্য, এসব পরিবর্তন বিরাটের সুবিধা হবে বলে কেউ করে দেয়নি। তিনি যে নিয়মে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তার মধ্যে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দিয়েছেন। কিন্তু সর্বকালের সেরাদের পাশে বসাতে হলে বা একেবারে গোট বলতে হলে এমন তুল্যমূল্য আলোচনা যে করতেই হয়। আসলে ওসব ব্র্যান্ডিংয়ের কারসাজি। আশা করা যায় ভক্তরা না বুঝলেও বিরাট নিজে সে কথা বোঝেন, ফলে মেসিসুলভ মূঢ়তায় কোনো লম্বকর্ণের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না। এখনো যে অনেক কিছু অর্জন করা বাকি আছে, তা বুঝলে তিনি আরও বড় ক্রিকেটার হতে পারবেন। ভারতীয় দলও আরও অনেক বেশি জয়ের মুখ দেখবে। ইতিহাস পারফরম্যান্স বোঝে। মন কি বাত বোঝে না, স্টাম্প মাইক কি বাতও বোঝে না।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

বিরাট অপসারণ: দুই পুরনো বন্ধুর অস্ট্রেলিয় সিদ্ধান্ত

রবি শাস্ত্রী আর বিরাট একদিনের ক্রিকেটের দলের জন্য এত বছরেও একজন চার নম্বর খুঁজে পাননি; কুলদীপ যাদব, যজুবেন্দ্র চহলকে তাঁদের আজ মনে হয়েছে দারুণ প্রতিভা, কাল ভেবেছেন আবর্জনা।

এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে। ভারত আপাতত টেস্টে এক নম্বর দল, টি টোয়েন্টিতে দু নম্বর। একমাত্র একদিনের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া তিন, ভারত চার। এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ঝুলিতে তেমন বড় সাফল্য নেই অনেকদিন হল। নিজের দেশে পরপর দুবার ভারতের কাছে টেস্ট সিরিজ হেরেছে। বল ট্যাম্পারিং, অশ্লীল এস এম এসে জর্জরিত। সুতরাং বলাই যায়, অস্ট্রেলিয়ার সে রাম নেই। কিন্তু সে অযোধ্যাও নেই বললে ভুল হবে। ব্যক্তির চেয়ে দল বড় — তাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি বদলায়নি। ওটাই দীর্ঘমেয়াদি দলগত সাফল্যের চাবিকাঠি। ওভাবেই পরপর তিনটে বিশ্বকাপ জেতা দল গড়ে ওঠে।

ভারতীয় ক্রিকেটে এ সংস্কৃতি কোনোদিন ছিল না। এখানে শচীন তেন্ডুলকরের অবসর বর্ণময় করে তুলতে আলাদা সিরিজের আয়োজন হয়। এই তারকাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে জোর ধাক্কা দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয় গ্রেগ চ্যাপেল। যে দুজন ঘটনার কেন্দ্রে ছিলেন, তাঁদের একজন এখন ভারতীয় দলের কোচ। অন্যজন বোর্ড সভাপতি। সেই রাহুল দ্রাবিড় আর সৌরভ গাঙ্গুলির যুগলবন্দিতে বিরাট কোহলির দুটো মুকুট গেছে, পড়ে আছে একটা

মনে রাখা ভাল, সৌরভ অধিনায়ক হওয়ার আগে টিম ইন্ডিয়া কথাটার প্রচলন হয়নি। সবাই জানত দিল্লি লবি, মুম্বাই লবি ইত্যাদির কথা। প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা ‘টিম’ হয়ে উঠতেন না, যা বিদেশে মুখ থুবড়ে পড়ার বড় কারণ ছিল। সে ঐতিহ্য ভেঙে নতুন উত্তরাধিকার তৈরি করেছিলেন সৌরভই। ফলে সে কালের বঙ্গ মিডিয়া সৌরভের অধিনায়কত্ব চলে যাওয়ায় রাহুলকে যতই মিচকে শয়তান বা বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করে থাক, সৌরভ বিলক্ষণ বুঝতেন দলের স্বার্থ সবার উপরে। আর সে স্বার্থ রাহুলের হাতে নিরাপদ। না বুঝলে ওই ঘটনার পরেও এত বছর দুজনের বন্ধুত্ব অম্লান থাকত না। বোর্ড সভাপতি হয়ে সৌরভ রাহুলকে প্রথমে ‘এ’ দলের দায়িত্বে, পরে সিনিয়র দলের দায়িত্বে আনতেন না।

র‍্যাঙ্কিং যা-ই বলুক, সাদা বলের ক্রিকেটে একগুচ্ছ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতে একের পর এক আইসিসি প্রতিযোগিতায় যে দল ব্যর্থ, সে দলের নেতৃত্ব বদলের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সৌরভ, রাহুলদের সময় হলে হয়ত সেমিফাইনাল, ফাইনালে উঠলেই প্রশংসা করা যেত। গত এক দশকে সাফল্যের যে খতিয়ান মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট, রোহিত নিজেরাই তৈরি করেছেন — তাতে এখন আর সেমিফাইনালে উঠলেই হাততালি দাবি করা চলে না।

রবি শাস্ত্রী আর বিরাট একদিনের ক্রিকেটের দলের জন্য এত বছরেও একজন চার নম্বর খুঁজে পাননি; কুলদীপ যাদব, যজুবেন্দ্র চহলকে তাঁদের আজ মনে হয়েছে দারুণ প্রতিভা, কাল ভেবেছেন আবর্জনা। এরকম অনেক উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা যায়, কেন সাদা বলের ক্রিকেটে তাঁদের উত্তরাধিকার বলতে পড়ে থাকবে অশ্বডিম্ব। সে আলোচনা বড় পরিসরের জন্য তোলা থাক।

আপাতত যা বলার, তা হল সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক স্টিভ ওয়কেও অস্ট্রেলিয়া ২০০৩ বিশ্বকাপের দলে রাখেনি। কারণ তিনি মন্থর হয়ে যাচ্ছিলেন, ব্যাটে রান ছিল না। আমাদের বিরাট আন্তর্জাতিক ম্যাচে শেষ শতরান করেছেন ২৩ নভেম্বর ২০১৯,  কলকাতায়। একদিনের ক্রিকেটে শেষ শতরান ১৪ আগস্ট ২০১৯, পোর্ট অফ স্পেনে। তাঁর সামগ্রিক গড় যেখানে প্রায় ষাট, সেখানে ওই শতরানের পর থেকে গড় ৪৩.২৬। অধিনায়কত্ব থাক, উনি বরং ব্যাটিংয়ে মন দিয়ে শচীনের শতরানের রেকর্ড ভাঙুন। মাত্র সাত পা দূরে আছেন।

আরও পড়ুন বিরাট, রোহিত, রাহুলদের সত্য রচনা চলছে চলবে

বিরাটভক্তদের অভিমান হচ্ছে, এই কড়া সিদ্ধান্তটা নিদেন পক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করা হল না বলে। অন্যায় অভিমান নয়, তবে কিনা বিরাট নিজেও সাংবাদিক সম্মেলনের বিশেষ ভক্ত নন। অপ্রিয় প্রশ্ন এলে কেমন রেগে যান, ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন। তাঁকে সরানোর সিদ্ধান্ত সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলে অপ্রিয় প্রশ্নই বেশি আসত নির্ঘাত। প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মার বয়স হয়েছে। তাঁর সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করার ঝুঁকি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হওয়া বোর্ড সভাপতি না নিয়ে ভালই করেছেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

সবাই চুপ করে থাকবে, মানিয়ে নিন শামি

পাকিস্তান ম্যাচে হিন্দুরা খারাপ পারফরম্যান্স করলে সন্দেহ করার কিছু নেই, মুসলমানকে সন্দেহ করতে হবে — এই মানসিকতার বিরুদ্ধে কুম্বলে, শচীনরা একটাও কথা বলেননি।

ঘটনা ১

রাজস্থানের বাসিন্দা নাফিসা আত্তারি গত মঙ্গলবার তাঁর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, বুধবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। কারণ তিনি সোশাল মিডিয়ায় রবিবারের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তান জিতে যাওয়ার পর আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন।

ঘটনা ২

কাশ্মীরের শ্রীনগরের শের-এ-কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অফ মেডিকাল সাইন্সেস আর গভমেন্ট মেডিকাল কলেজের ছাত্রছাত্রী, ওয়ার্ডেন ও ম্যানেজমেন্টের লোকেদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে মামলা দায়ের করেছে পুলিস। অভিযোগ পাকিস্তানের জয়ে উল্লাস করা, বাজি পোড়ানো ইত্যাদি। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়নি, তবে পুলিস বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। ক্যাম্পাসে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।

ঘটনা ৩

রবিবার ভারত-পাক ম্যাচের পর একটি দক্ষিণপন্থী ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা হয় যে মুসলমান পাড়ায় পাকিস্তান জেতার পর বাজি পোড়ানো হয়েছে। পুলিস তদন্ত করে দেখে যে ওই পাড়ায় সেদিন বিয়ে ছিল এবং বাজি আসলে সেখানেই পোড়ানো হচ্ছিল। যারা ফেসবুক পোস্টটি করেছিল, তারা দোষ স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। পুলিস তাদের প্রত্যেককে দিয়ে ২৫ হাজার টাকার বন্ড জমা করিয়েছে।

ঘটনা ৪

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছেন পাকিস্তানের জয় যারা উদযাপন করেছে তাদের বিরুদ্ধে সিডিশন ল, অর্থাৎ দেশদ্রোহবিরোধী আইন প্রয়োগ করা হবে। আগ্রাতে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ইতিমধ্যেই ।

সব ঘটনা উল্লেখ করা গেল না, নিশ্চিতভাবেই অনেক ঘটনা বাদ পড়ে গেল। পাঠকরা নিজেদের জানা ঘটনা এই তালিকায় জুড়ে নিতে পারবেন। এমন ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা সম্ভব হলে তা কুড়ি বিশের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের একমাত্র মুসলমান ক্রিকেটার মহম্মদ শামির কাছে পাঠানো যেতে পারে। তাতে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কিছু উপশম হলেও হতে পারে। কারণ এই ঘটনাগুলো জানলে তিনি বুঝতে পারবেন, পাকিস্তানের কাছে ভারত হেরে যাওয়ার পর থেকে তাঁকে যা সহ্য করতে হয়েছে তা ভারতের সাধারণ মুসলমানদের দুর্গতির তুলনায় কিছুই নয়। তাঁকে নাহক অনলাইন গালাগালি সহ্য করতে হয়েছে, জামিন অযোগ্য ধারায় পুলিশ কেস তো আর হয়নি। চাকরিও খোয়াতে হয়নি। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ উঠেছে মাত্র, সে অভিযোগের ভিত্তিতে অন্তত গ্রেপ্তার করা হয়নি। শামির নিয়োগকর্তা যে ক্রিকেট বোর্ড, সে বোর্ডের সেক্রেটারি যখন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র, তখন দেশে ফিরলেও যে শামিকে ৩.৫ ওভারে ৪৩ রান দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সে নিশ্চয়তা এ মুহূর্তে ভারতের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বীর নেই।

ফুটবলপ্রেমীরা জানেন ১৯৬৯ সালে একটা ফুটবল ম্যাচের জন্য হন্ডুরাস আর এল সালভাদোরের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। মানে খেলার জন্য যুদ্ধ হওয়ার ইতিহাস আছে। কিন্তু ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হল যুদ্ধের জন্য খেলা — গত পাঁচ দিনের ঘটনাবলী তা প্রমাণ করে দিয়েছে। পাকিস্তানের গণতন্ত্র নিয়ে অতি বড় পাকিস্তানিও গলা তুলে কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করেন। আর ভারত এখন এত মহান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যে ক্রিকেট ম্যাচে অন্য দেশের দলকে সমর্থন করলে চাকরি হারাতে হয়, গ্রেপ্তার হতে হয়, এমনকি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে হয়। কিন্তু সে কথা বললে অর্ধেক বলা হয়। কোনো ভারতীয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এমনকি ইংল্যান্ডকেও সমর্থন করতে পারেন। জেলে যেতে হবে না। যত দোষ পাকিস্তানকে সমর্থন করলেই। কেবল অন্ধ ক্রিকেটভক্তরা নয়, ক্রিকেটাররা পর্যন্ত তা-ই মনে করেন। প্রাক্তন ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর রবিবারই টুইট করেছিলেন, যারা ভারতের জয়ে বাজি পোড়াচ্ছে তারা ভারতীয় হতে পারে না। তিনি অবশ্য এখন বিজেপি সাংসদ, তাই এমন মন্তব্য তাঁর থেকে অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু বীরেন্দ্র সেওয়াগও তীর্যক টুইট করতে ছাড়েননি। তাঁর বক্তব্য দীপাবলিতে ভারতের বেশকিছু এলাকায় বাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অথচ পাকিস্তান জেতার পরে লোকে বাজি পোড়াচ্ছে। তারা বোধহয় ক্রিকেটের জয় উদযাপন করছে। তাহলে দীপাবলিতেই বা বাজি পোড়ালে দোষ কী? এই ভণ্ডামির কী প্রয়োজন? সব জ্ঞান দীপাবলির বেলাতেই কেন? সীমান্তের ওপারের ওঁরাও কিছু কম যান না। এক মন্ত্রী বলেছেন এই জয় ইসলামের জয়। প্রাক্তন ক্রিকেটার ওয়াকার ইউনিস লাইভ টিভিতে বলেছেন, রিজওয়ানের ব্যাটিংয়ের চেয়েও তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার হল হিন্দুদের মধ্যে গিয়ে নমাজ পড়া। অর্থাৎ এতগুলো লোক তক্কে তক্কে ছিল যুদ্ধ করবে বলে — ধর্মযুদ্ধ।

আরও পড়ুন এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট; ওঁরা গ্ল্যাডিয়েটর নন, ক্রিকেটার

কিন্তু এতেও সবটা বলা হল না। কারণ পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত বিরাট কোহলি চার-ছয় মারার সময়ে উল্লাস করার জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে খবর নেই। ওয়াকারকেও তাঁর মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে টুইট করতে হয়েছে । কিন্তু সেওয়াগ, গম্ভীররা ওসবের ধারে কাছে যাননি। কারণ পাকিস্তানি মন্ত্রী, প্রাক্তন ক্রিকেটাররা যেমন শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করেছেন, এঁরা মনে করেন এঁরাও তেমনই শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করেছেন। কে সেই শত্রু? উত্তরটা খুব সোজা। কানে বাজির আওয়াজ এলেই যাদের সম্বন্ধে মনে হয় নির্ঘাত ওরাই পোড়াচ্ছে এবং পাকিস্তান জিতেছে বলেই পোড়াচ্ছে, তারাই শত্রু, তারাই দেশদ্রোহী। অর্থাৎ আপনি ভারতীয় হয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন করেও বেঁচে যেতে পারেন, যদি মুসলমান না হন।

নেহাত গা জোয়ারি মন্তব্য করা হল? মুসলমানদের দিকে ঝোল টেনে কথা বলা হল মনে হচ্ছে? মহম্মদ শামিকে রাম, শ্যাম, যদু, মধুর ‘গদ্দার’ ইত্যাদি বলা দেখেই সে সন্দেহ দূর হয়ে যাওয়ার কথা। যদি তারপরেও সন্দেহ থাকে, তাহলে শামির সমর্থনে ভারতীয় প্রাক্তন ক্রিকেটারদের টুইটগুলো লক্ষ করবেন। গম্ভীর, সেওয়াগ তো বটেই; অনিল কুম্বলে, ভারতীয় ক্রিকেটের মৌনীবাবা শচীন তেন্ডুলকর — সকলেই শামি যে নির্দোষ সেই মর্মে টুইট করেছেন। সকলেরই বক্তব্য মোটামুটি এক। শামি চ্যাম্পিয়ন বোলার; খেলার মাঠে একটা খারাপ দিন যে কোনো খেলোয়াড়ের যেতে পারে; শামি, আমরা তোমাকে ভালবাসি, ইত্যাদি। একজনও কিন্তু বলেননি, শামি ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলে, আমরাও ভারতের হয়ে খেলেছি। ওকে সন্দেহ করা আর আমাদের সন্দেহ করা একই কথা। যারা তা করে তাদের মত ফ্যান আমাদের দরকার নেই। ইংল্যান্ডের ফুটবল দলের অধিনায়ক হ্যারি কেন কিন্তু পেনাল্টি শুট আউটে গোল করতে ব্যর্থ কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের সমর্থনে ঠিক এই কথাই বলেছিলেন। শচীনরা বলেননি, কারণ ওঁরা খুব ভাল করে জানেন শামি মুসলমান বলেই সে সন্দেহের পাত্র। উইকেট না পেলেও, মার খেলেও যশপ্রীত বুমরা, ভুবনেশ্বর কুমার, রবীন্দ্র জাদেজা সন্দেহের পাত্র নয়। পাকিস্তান ম্যাচে হিন্দুরা খারাপ পারফরম্যান্স করলে সন্দেহ করার কিছু নেই, মুসলমানকে সন্দেহ করতে হবে — এই মানসিকতার বিরুদ্ধে কুম্বলে, শচীনরা একটাও কথা বলেননি। তাঁরা তবু মুখ খুলেছেন, অধিনায়ক ডাকাবুকো কোহলির থেকে পাওয়া গেছে বিরাট নীরবতা। সমালোচকদের বিরুদ্ধে কথার ফুলঝুরি ছোটানো কোচ রবি শাস্ত্রীরও মুখে কুলুপ। এমনকি টিমের বড়দা (মেন্টরের বাংলা প্রতিশব্দ পরামর্শদাতা। ধোনির জন্য সেটা বড্ড ম্যাড়মেড়ে নয়?) মহেন্দ্র সিং ধোনিও চুপ।

কেনই বা চুপ থাকবেন না? ওঁরাও তো আমার, আপনার মত কাগজ পড়েন, টিভি দেখেন, সোশাল মিডিয়া ঘাঁটেন। ফলে ওঁরা দেশের অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ওঁরা হয়ত জানেন গুজরাটের আনন্দ (আমুল খ্যাত) শহরের মঙ্গলবারের ঘটনা। সেখানে একটি নতুন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ব্যাঙ্কোয়েট হলের উদ্বোধন আটকাতে বিরাট জনতা হাজির হয় গত পরশু। তারা গঙ্গাজল দিয়ে এলাকা শুদ্ধিকরণের প্রয়াস করেছে। স্লোগান দিয়েছে, ভারতে থাকতে হলে জয় শ্রীরাম বলতে হবে। হিন্দু এলাকায় মুসলমান মালিকের হোটেল থাকবে, এ অনাচার তারা মানতে রাজি নয়। খবরে প্রকাশ, হোটেলটির তিন মালিকের একজন হিন্দু। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।

ধোনি ঝাড়খন্ডের মানুষ, দিব্যি বাংলা বলতে পারেন। রাঁচিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজনদের মধ্যেও বাঙালি আছেন। তাঁর প্রতিভা প্রথম চিনেছিলেন কেশব ব্যানার্জি নামের এক বাঙালি মাস্টারমশাই। ফলে ধোনি হয়ত ত্রিপুরার খবরও রাখেন। হয়ত ভাল করেই জানেন, ওই রাজ্যে কীভাবে মুসলমান খ্যাদানো চলছে কদিন ধরে আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মালিকানায় চলা সংবাদমাধ্যম চোখ বুজে আছে। এই পরিবেশের মধ্যে ধোনির কী দায় পড়েছে মুসলমান সতীর্থের হয়ে মুখ খোলার?

এত ঘটনা না জানলেও আইপিএল খেলা তারকা ক্রিকেটাররা বিলক্ষণ জানেন, এক গ্রাম মাদক উদ্ধার না হওয়া সত্ত্বেও শাহরুখ খানের ছেলেকে তিন সপ্তাহ কারাবাস করতে হল। ইতিমধ্যে তদন্তকারী অফিসারের বিরুদ্ধে নানা কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠে এসেছে। যে দেশে অর্ণব গোস্বামীর জামিনের জন্য মধ্যরাতে আদালত বসতে পারে, সে দেশে আদালতের সময়ই হয় না মাসের পর মাস, বছরের পর বছর উমর খালিদের জামিনের আবেদন শোনার। শার্জিল ইমাম যে কথা বলেননি তার জন্য, সিদ্দিক কাপ্পান যে প্রতিবেদন লেখেননি তার জন্য, মুনাওয়ার ফারুকি যে কৌতুক করেননি তার জন্য এবং আরিয়ান খান যে মাদক নেননি তার জন্য — কারাবাস করতে পারেন। একজন আদানির বন্দরে কয়েক হাজার গ্রামের মাদক পাওয়া গেলেও তেমন হেলদোল হয় না আইনের রক্ষকদের, একজন খানকে রেভ পার্টিতে পাওয়া গেলেই সে কেবল মাদকাসক্ত নয়, মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যায় সারা দেশের চোখে — এ কথা আমাদের মত ক্রিকেট তারকারাও জানেন। তাই তাঁরা চুপ করেই থাকবেন।

শামি, আপনি মানিয়ে নিন। আপনার চেয়ে অনেক দূরে, অনেক নীচে থাকা ভারতীয় মুসলমানরা প্রতিনিয়ত যেমন মানিয়ে নিচ্ছেন।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: