অনন্ত আনন্দধারার খানিকটা ধরা পড়েছে নীহারিকা ছবিতে

নীহারিকা এমন একটা কাজ করেছে যা বাংলা সিনেমা শুধু নয়, বাংলা সাহিত্য থেকেও আমাদের কালে উবে গেছে। তা হল জীবন সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তোলা। কাকে বলে আনন্দ? কোনটা স্বাধীনতা? ভাল থাকা বেশি জরুরি, নাকি সাফল্যে থাকা? এসব প্রশ্ন আমার সময়ের কোন বাংলা ছবিকে তুলতে দেখেছি? মনে পড়ে না।

বেশ কিছুকাল হল, পশ্চিমবঙ্গে বসে বাংলা ছবি দেখা বেশ শক্ত। কারণ বাংলা ছবি তৈরি হয় কম। টালিগঞ্জ পাড়া থেকে প্রধানত দুরকম ছবি বেরোয় – ‘wannabe হিন্দি’ ছবি আর ‘wannabe ইংরিজি’ ছবি। সেসব ছবির বাঙালিয়ানা বলতে সংলাপটুকু। দ্বিতীয় ধরনের ছবিতে আবার সংলাপও বেশ খানিকটা ইংরিজি। অতি সাম্প্রতিককালে তৃতীয় এক ধরনের ছবি তৈরি হচ্ছে, সেগুলো ‘wannabe সর্বভারতীয়’। ফলে নীহারিকা কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাংলা ছবি দেখতে তৃষিত হৃদয় জয় করে ফেলে, কারণ প্রথম ফ্রেম থেকেই পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য একখানা খাঁটি বাংলা ছবি দেখান।

এ ছবির গৃহবধূরা গা ভর্তি গয়না পরে থাকে না, কাঞ্জিভরম পরে শুতে যায় না। স্কুলপড়ুয়া মেয়ের মা পরনের সাধারণ শাড়ির আঁচলটা কোমরে বেঁধে নিয়ে নাচ শেখান। যেমনটা চিরকাল বাঙালি মায়েদের করে আসতে দেখেছি। কয়েক মিনিট যেতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, পরিচালক ইন্দ্রাশিস এবং ক্যামেরার দায়িত্বে থাকা শান্তনু দে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঘরের সব জায়গায় সমান আলো পৌঁছনোর দরকার নেই। ইন্টেরিয়র ডেকরেটরের হাতে সাজানো ছবির মত ঘর তাঁরা দেখাতে চান না। কলকাতার পুরনো বাড়ির সেইসব সিঁড়ি, যেগুলো দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকে, সেগুলোকে সেভাবেই পর্দায় আনা হয়েছে। এখানে স্নান করে খালি গায়ে গামছা পরেই ঘরে আসেন ভুঁড়িওলা জ্যাঠামশাই। পরিচালক সিক্স প্যাক খুঁজতে বেরোননি। এখানে মাতাল বাবা বাইরে থেকে নেশা করে এসে মাকে পাড়া জানিয়ে নোংরা কথা বলে এবং দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে পেটায়। ঢুলুঢুলু আলোয় ড্রইংরুমে বসে স্কচ খেয়ে চার অক্ষরের ইংরিজি গালি দেয় না।

চারিদিকের ঝলমলে আলোয় যাঁদের ক্লান্ত লাগে, আজকের জীবনযাত্রার প্রচণ্ড গতিতে যাঁদের হাঁসফাস লাগে – নীহারিকা ছবিটা তাঁদের জন্য। প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে পর্দার নরম আলোর উপশম পেতে হলে এই ছবি দেখে ফেলুন। ক্রমশ গতি বাড়িয়ে চলা জীবনের নানাবিধ শব্দে যদি আপনার কান এবং মস্তিষ্ক পরিশ্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলেও ঘন্টা দুয়েক সময় বার করে এই ছবি দেখে আসা ভাল। শান্তনু যেমন আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি, সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকারও নেপথ্য সঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন অতি সামান্য। নৈঃশব্দ্য কথা বলেছে দর্শকের কানে কানে, যার জন্যে সাউন্ড ডিজাইনার সুকান্ত মজুমদারেরও বাহবা প্রাপ্য। শব্দ পরিহার করার এই সংযমও আজকের বাংলা ছবিতে সুলভ নয়। তবে এসব তো খুঁটিনাটি। সবচেয়ে বড় কথা, নীহারিকা এমন একটা কাজ করেছে যা বাংলা সিনেমা শুধু নয়, বাংলা সাহিত্য থেকেও আমাদের কালে উবে গেছে। তা হল জীবন সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তোলা। কাকে বলে আনন্দ? কোনটা স্বাধীনতা? ভাল থাকা বেশি জরুরি, নাকি সাফল্যে থাকা? এসব প্রশ্ন আমার সময়ের কোন বাংলা ছবিকে তুলতে দেখেছি? মনে পড়ে না। ইতিমধ্যেই বহু আলোচিত এই ছবির যৌনতার দিকটা। সেখানেও বেশকিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন পরিচালক। কোনটা সম্মতি, কোনটা স্বাভাবিকতা, কোনটাই বা বিকৃতি? এসবের উত্তর যে সাদায় কালোয় হয় না সবসময়, শান্তনুর ক্যামেরায় ফুটে ওঠা আলো আর আঁধারের মাঝখানেও লুকিয়ে থাকতে পারে – তা সাহস করে দেখিয়েছেন।

বছর বিশেক আগেও কাহিনিচিত্র কথাটা বাংলায় রীতিমত ব্যবহৃত হত। শনি বা রবিবার দূরদর্শনে বাংলা ছবি শুরু হওয়ার আগে ঘোষক/ঘোষিকা বলতেন “আজ দেখবেন বিজ্ঞাপনদাতা দ্বারা আয়োজিত কাহিনিচিত্র…”। ইদানীং যে শব্দটা আমরা ভুলে গেছি, তার একটা কারণ বোধহয় এই, যে আমাদের পরিচালকরা সিনেমায় গল্প কীভাবে বলতে হয় তা ভুলে গেছেন। যদি এমন হত যে তাঁরা বাংলা সিনেমাকে গল্পের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছেন, এমন সব অবিস্মরণীয় ফ্রেম তৈরি করছেন যে কেবল তার জন্যেই ছবিটা দেখা যায় – তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে যে কয়েকটা হাতে গোনা ছবি ‘হিট’ হয়েছে সেগুলোর সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্যের কথা বলতে বললেও একাধিকবার ছবিটা দেখা দর্শক মাথা চুলকোবেন। অথচ ক্যামেরা, আলো, সম্পাদনা – সবেরই তো মান বেড়েছে প্রযুক্তির উন্নতির কারণে। নীহারিকা কিন্তু এদিক থেকেও ব্যতিক্রমী। এর গল্প (সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ইন্দ্রাশিসের রচনা) যেমন বাঁধা গতের নয়, তেমনই একাধিক নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করেছেন পরিচালক।

শান্ত জনপদ শিমুলতলায় সন্ধেবেলা লোডশেডিং হয়ে যাওয়ার পর দীপার ঘুরঘুট্টি অন্ধকার মামাবাড়ি জেগে থাকে পর্দা জুড়ে। তারপর একতলায় জ্বলে ওঠে দুটো আলোর বিন্দু – সম্ভবত হ্যারিকেন। একটা আলোর বিন্দু কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চলে যায় চোখের আড়ালে, শেষে আবির্ভূত হয় দোতলায়। এ দৃশ্য মনে রাখার মত। আবার অনেক দর্শক নিশ্চয়ই বাড়ি যাবেন সিলুয়েটে দীপার (অনুরাধা মুখার্জি) নাচের রেশ নিয়ে। সংলাপ নয়, স্রেফ ছবি দিয়ে গল্প বলা যে শক্ত কাজ তা গত কয়েক বছরের বাংলা ছবি দেখলে বেশ টের পাওয়া যায়। পরিচালকের পরিমিতিবোধ না থাকলে এ জিনিস অসম্ভব। ইন্দ্রাশিসের সেই পরিমিতিবোধে চমৎকার সঙ্গত করেছেন সম্পাদক লুব্ধক চ্যাটার্জি। বিশেষত কোনো কান্নাকাটি, হইচই ছাড়াই দীপার মায়ের মৃত্যু নিঃশব্দে স্রেফ দুটো শটে দেখিয়ে ফেলার মুনশিয়ানা ভোলার নয়।

আরও পড়ুন মায়ার জঞ্জাল: যে কলকাতা দেখতে পাই না, দেখতে চাই না

যে ছবিতে চাকচিক্য বর্জন করা হয় সে ছবি দাঁড়িয়ে থাকে অভিনয় ক্ষমতার উপর ভর দিয়ে। নীহারিকা ছবিতে সেই গুরুদায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন অভিনেতারা। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অনুরাধা ব্যক্তিগত জীবনের অশান্তি এবং শান্তিময়তা দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন, যদিও স্বামী রঙ্গনের (অনিন্দ্য সেনগুপ্ত) উপর ফোনে চেঁচানোর সময়ে তাঁকে কিঞ্চিৎ বেশি কোমল মনে হয়েছে। ছবির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দীপার ছোটমামা। অভিনেতা শিলাজিৎ সিনেমায় অভিনয় করছেন কম দিন হল না। কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে সন্দীপ রায় – কেউই তাঁকে এত বড় অথচ আপাত বিশেষত্বহীন চরিত্রে ভাবেননি। স্বনামধন্য শিলাজিৎ কিন্তু অনায়াসে ঘুমন্ত মফস্বলের ব্যস্ত ডাক্তার হয়ে গেছেন, যাঁর চরিত্রের তলদেশে আবার ঘুমিয়ে আছে এমন একটা জিনিস যাকে অন্তত তিনি নিজে বলেন বিকৃতি। পরিচালক নিথর দাম্পত্যের একাকিত্ব বোঝাতে শিলাজিৎকে দিয়ে অন্ধকার বারান্দায় ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব’ গাইয়ে নিয়েছেন। ওই অমূল্য মুহূর্ত সৃষ্টি করার কৃতিত্ব যতখানি পরিচালকের, ঠিক ততটাই শিলাজিতের।

চমকে উঠতে হয় অবশ্য ছোটমামীর চরিত্রে মল্লিকা মজুমদারকে দেখে। গোটা ছবিতে তিনি টানা টানা চোখ ব্যবহার করে যে অভিনয় করে যান (যা তুঙ্গে ওঠে ‘মলয় বাতাসে’ গানে) তাতে স্রেফ চরিত্রটা নয়, মানুষটার জন্যেও কষ্ট হয়। কারণ উপলব্ধি করা যায়, নিম্নমেধার সিরিয়াল/মেগা সিরিয়াল একজন শিল্পীর ক্ষমতার প্রতি কতটা অবিচার করে।

এতকিছু সত্ত্বেও দু-একটা খটকা থেকে যায়। যেমন ছবিতে কোন সময় দেখানো হচ্ছে তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়। কারণ শিমুলতলার জীবনে এমনকি ব্যস্ত ডাক্তারবাবুকেও মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায় না, কিন্তু বিয়ের পর দীপা আর রঙ্গন কলকাতায় চলে আসতেই মোবাইল ফোন তো বটেই, ল্যাপটপেরও ব্যবহার দেখা যায়। এ যদি বর্তমানের গল্প হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, শিমুলতলা কি এখনো এতটা প্রযুক্তিবর্জিত? নাকি বেশ আগে লেখা বইয়ের গল্পকে পর্দায় নিয়ে আসতে গিয়ে এই বিভ্রাট হয়েছে? দেওঘরের প্যাথোলজিস্ট পরিচিত ডাক্তারকে “মিস্টার চ্যাটার্জি” বলে সম্বোধন করেন – এই ব্যাপারটাও একটু অদ্ভুত লাগে। সাধারণত তো ডাক্তারবাবুদের “ডক্টর” বলেই সম্বোধন করা হয়। আরেকটি প্রশ্নও না করে থাকা যায় না। দীপা পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পেল – নিজের সঙ্গে থাকার স্বাধীনতা। কিন্তু তা করতে গেলে তো অর্থনৈতিক স্বাধীনতারও প্রয়োজন হয়। সে সম্পর্কে কোনো সংবাদ কিন্তু পেলাম না। দীপা এম এ করেছে, তারপর গবেষণা করবে – এই পর্যন্ত জানা গিয়েছিল রঙ্গনের সঙ্গে বিয়ের আগে। তারপর সোজা বিয়ে, মা হওয়া দেখলাম। ওরই মধ্যে বা পরে কি সে কোনো কাজে যোগ দিয়েছিল? তার হদিশ পেলাম না।

কেউ বলতেই পারেন এ নেহাত ছিদ্রান্বেষণ। কিন্তু ছবিটা এত বেশি প্রত্যাশা জাগায় এবং পূরণ করে বলেই কথাগুলো মনে আসে। বাজার চলতি বাংলা ছবির মত একখানা পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যেখানে পারা যায় গুঁজে না দিয়ে যে পরিচালক নায়িকাকে দিয়ে দ্বিজেন্দ্রগীতি গাওয়ান, তাঁর কোথাও ভুলচুক হয়ে গেল কিনা তা নিয়ে তো উদ্বেগ তৈরি হবেই। রবীন্দ্রসঙ্গীতও আছে অবশ্য। কিন্তু সে গানের এর চেয়ে উপযুক্ত ব্যবহার অসম্ভব ছিল।

পপকর্ন খেতে খেতে দেখে ভুলে যেতে চাইলে নীহারিকা আপনার জন্যে নয়। যদি প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার বহুক্ষণ পরেও দেখা ছবির রোমন্থন করতে ভাল লাগে, তাহলে এই ছবি আপনার।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

দেব দেবী মহাদেব আছেন, সত্যান্বেষী নিরুদ্দেশ

শো শুরু হওয়ার আগে লবিতে বসে দেওয়ালে লাগানো এলইডি স্ক্রিনে ওই ছবির প্রোমোশনালে দেখেছিলাম শিবের বেশে অক্ষয়কে। ফলে ছবি শুরুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পর্দায় ত্রিশূল হাতে শিব এবং তাঁর মারামারি করার দৃশ্য দেখে ভাবলাম, এই রে! হল কর্তৃপক্ষ ভুল করে এই ছবি চলতে চলতে ওই ছবি চালিয়ে দিল না তো!

মমতা ব্যানার্জি বাংলা ছবির জন্য এত বছর ধরে এত করলেন, এতজনকে এত পুরস্কার দিলেন, আর কাজের সময়ে টলিউডকে কাজে লাগিয়ে ফেলল বিজেপি!

নিশ্চয়ই ভাবছেন সিনেমার আলোচনার সূচনা এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা দিয়ে কেন? কী করা যাবে বলুন? যে মাল্টিপ্লেক্সে ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে ঠিক পাশের স্ক্রিনেই চলছিল অক্ষয় কুমারের ওএমজি ২। শো শুরু হওয়ার আগে লবিতে বসে দেওয়ালে লাগানো এলইডি স্ক্রিনে ওই ছবির প্রোমোশনালে দেখেছিলাম শিবের বেশে অক্ষয়কে। ফলে ছবি শুরুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পর্দায় ত্রিশূল হাতে শিব এবং তাঁর মারামারি করার দৃশ্য দেখে ভাবলাম, এই রে! হল কর্তৃপক্ষ ভুল করে এই ছবি চলতে চলতে ওই ছবি চালিয়ে দিল না তো! শুধু কি দৃশ্য? সাউন্ড ট্র্যাকে তখন ঝাঁ ঝাঁ করে বাজছে আজকালকার ডিজে বাজানো ভক্তিগীতির কায়দায় রচিত “বম বম সত্যান্বেষী” (পরেও যতবার ব্যোমকেশ অপরাধীকে ধাওয়া করে ততবার বাজে)। শ্রাবণ মাস চলছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সিনেমা হলের চেয়ে ওই গান অনেক বেশি মানানসই তারকেশ্বরে যারা বাবার মাথায় জল ঢালতে যাচ্ছে তাদের জমায়েতে। গোয়েন্দা গল্প নিয়ে তৈরি ছবিতে ওই দৃশ্য আর এই গান ঢুকে পড়ার যুক্তি হিন্দুত্ববাদের প্রচার ছাড়া আর কী হতে পারে?

এমনিতে কোনো টেক্সটের পুনর্কথনে দোষ নেই, যদি তার পিছনে নিবিড় পাঠ থাকে। মুশকিল হল, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গরহস্য উপন্যাস তো বটেই, গোটা ব্যোমকেশ সমগ্র ঘেঁটেও এমন একটা বাক্য দেখানো শক্ত যেখানে লেখক ব্যোমকেশ বক্সীর নামটার দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কোনোরকম ঈশ্বরত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বরং উল্টোটাই সত্যি। বিশ্বসাহিত্যের বহু প্রথিতযশা গোয়েন্দার চেয়ে ব্যোমকেশ বেশি আটপৌরে। আর্থার কোনান ডয়েল প্রায় প্রতি গল্পে শার্লক হোমস যে আর পাঁচজন মানুষের চেয়ে আলাদা তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। শরদিন্দু কিন্তু বারবার ব্যোমকেশের সাধারণত্বই যে তার বিশেষত্ব সেকথা প্রমাণ করেছেন। তাই সে তার বয়সী যে কোনো ছেলের মতই তদন্ত করতে গিয়েও প্রেমে পড়ে যায় এবং সত্যবতীকে বিয়ে করে। এমনকি গোটা ব্যোমকেশ সাহিত্যে ব্যোমকেশ-সত্যবতীর সন্তানকে শরদিন্দু স্রেফ ‘খোকা’ বলে গেছেন। সে যুগে গড়পড়তা বাঙালি ছেলেদের ডাকনাম হিসাবে খোকা বা খোকন বহুলপ্রচলিত ছিল। এখানে ব্যোমকেশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী করে তুলতেই যে শিব সাজানো হয়েছে, তার প্রমাণ সে শিব সেজে দাঁড়িয়ে থেকে দেশের সম্পদ বিদেশে চালানকারী সাহেবকে ধরে ফেলেই বলে, কোহ-ঈ-নূর নিয়ে গেছ বলে সবই নিয়ে যাবে? সাহেব অবশ্য নেহাতই ক্রেতা। বিক্রেতা যে ভারতীয় তাকে বিস্তর ঝাড়পিটের পর ধরে ফেলে জটাধারী ব্যোমকেশ বলতে ছাড়ে না যে এইসব লোককে শাস্তি দিতেই ব্যোমকেশকে বারবার ফিরে আসতে হবে। টুক করে অবতারবাদও ঢুকিয়ে দেওয়া গেল।

বস্তুত এই ছবির ব্যোমকেশ চরিত্র একটি ধারাবাহিকতা তৈরি করল। কিছুদিন আগে অরিন্দম শীল নির্দেশিত ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ওয়েব সিরিজে প্রথমবার ফেলুদা এনকাউন্টার করে অপরাধী মেরেছে। এবার বিরসা-দেব জুটি ব্যোমকেশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসাবে দেখালেন। তৃণমূল কংগ্রেস দলের সাংসদ দেব আবার এই ছবির অন্যতম প্রযোজকও বটে। অর্থাৎ টলিউডের মাধ্যমে বাংলার দুই জনপ্রিয় গোয়েন্দা যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ মডেল আর গুজরাট মডেল আপন করে নিলেন।

হিন্দু জাতীয়তাবাদ ভাল হোক আর মন্দই হোক, সত্যান্বেষীকে শিব বানিয়ে ফেলা নির্দেশক বিরসা দাশগুপ্ত ও চিত্রনাট্যকার শুভেন্দু দাশমুন্সীর শৈল্পিক মুনশিয়ানা বলে মেনে নেওয়া যেত, যদি এই প্রবল জাতীয়তাবাদী গোয়েন্দাটি বাকি ছবিতে চিরাচরিত ধুতি-শার্ট বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকতেন। কিন্তু তিনি অধিকাংশ দৃশ্যেই রীতিমত সুটেড বুটেড। শরদিন্দুর ব্যোমকেশও এতখানি সায়েব ছিল না। অবশ্য সেই ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ব্যোমকেশকে মিলিয়ে দেখতে গেলে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে। কারণ সিরিজের একেবারে প্রথম গল্পেই লেখক জানিয়ে দিয়েছিলেন, ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা বলতে ঘোর অপছন্দ করে। ব্যোমকেশ অজিতকে বলেছে “ডিটেকটিভ কথাটা শুনতে ভাল নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ।” এখানে দেখা যাচ্ছে তাকে টিকটিকি বলে উল্লেখ করলেও ব্যোমকেশের আপত্তি নেই।

সবচেয়ে বড় যে বদলটি ঘটানো হয়েছে এই ছবিতে, তা হল সত্যবতীকে (রুক্মিণী মৈত্র) গর্ভাবস্থায় দাদা সুকুমারের কাছে না পাঠিয়ে ব্যোমকেশ, অজিতের সঙ্গে অকুস্থলে পাঠানো হয়েছে। সত্যবতীর সহচরীর প্রয়োজনে পুরন্দর পাণ্ডের সুগৃহিণী স্ত্রীকেও হাজির করা হয়েছে। এই পরিবর্তনটি নিঃসন্দেহে জরুরি ছিল। কারণ দেব অভিনীত ব্যোমকেশ যত ভাল দৌড়তে পারে, মারামারি করতে পারে, সত্যান্বেষণে তত দড় নয়। দুর্গে না গিয়েও স্রেফ শুনে শুনে রামকিশোরের পরিবারের সদস্যদের চরিত্র বিশ্লেষণ সত্যবতীই অনেকটা করে দেয়। এমনকি নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ থেকে কয়েক লাইন আউড়ে গুপ্তধনের সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার কাজটাও সে-ই করে দেয়। অর্থাৎ সত্যবতী একাই ব্যোমকেশ এবং অজিতের কাজ করে দিতে পারে। তাও আবার ঘরে বসে, মিস মার্পলের মত। কেন যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের দীর্ঘ তালিকায় মমতা, শিবরাজ সিং চৌহান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আগাথা ক্রিস্টির নামটাও রাখা হল না? অবশ্য ব্যোমকেশ শিব হয়ে উঠলে সত্যবতীকে তো পার্বতী হতেই হয়। এর জন্যে কোনো বিদেশিনীর কাছে কেনই বা কৃতজ্ঞ থাকতে হবে?

আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

সত্যান্বেষণে গিন্নী অনেকখানি সাহায্য করে দিলেও ব্যোমকেশকে বিস্তর কায়িক পরিশ্রম করতে হয়েছে। গল্পে ছিল ব্যোমকেশ-অজিতকে দুর্গ থেকে তাড়াতে নির্বিষ ঢ্যামনা সাপ ছেড়ে দেওয়ার কথা। সে সাপকে ধরেছিল পুলিস কনস্টেবল সীতারাম। এই ছবির সাপটি রীতিমত বিষধর এবং সাপ সম্পর্কে গবেষণায় আজ পর্যন্ত যা যা জানা গেছে, সেসবকে কাঁচকলা দেখিয়ে সে রীনা রায় অভিনীত নাগিন (১৯৭৬) ছবির মত মানুষ মারার উদ্দেশ্য নিয়েই ঘরে ঢোকে। আরেকটু হলেই ঘুমন্ত অজিতের (অম্বরীশ ভট্টাচার্য) ভবলীলা সে সাঙ্গ করে দিয়েছিল। ব্যোমকেশ খালি হাতে সেই সাপকে ধরে ঝুড়িতে পুরে ফেলে। এতদ্বারা বোধহয় দেব তাঁর পরের ছবি বাঘাযতীন-এ খালি হাতে বাঘ মারার রিহার্সালও করে নিলেন। হলই বা কম্পিউটার জেনারেটেড। তবে সম্ভবত দেবকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে বেঢপ চশমাখানা সামলাতে। বাংলা ছবির বাজেটের কি এতই করুণ অবস্থা যে তাঁর মুখের গড়নের সঙ্গে মানানসই একখানা চশমা পাওয়া যায়নি? সারাক্ষণই বাঁকা মনে হয়। যেন ঠিক চেপে বসেনি, এখুনি খুলে পড়ে যাবে। প্রযোজক দেব কি অভিনেতা দেবের এই অসুবিধা খেয়াল করেননি?

সত্যবতীর চরিত্রে রুক্মিণীর একমাত্র গুণ হল তাঁর রূপ।

অম্বরীশ ছাড়া ছবির বাকি অভিনেতাদের প্রায় সকলকেই দেখে মনে হয়েছে তাঁরা থতমত খেয়ে আছেন, ঠিক কী করতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। সে জন্যে তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। সাবেকি বাঙালি ভদ্রলোক রামকিশোরের চরিত্রে রজতাভ দত্তকে যদি খামোকা স, শ সবই s-এর মত উচ্চারণ করতে হয় তাহলে নিজের ভূমিকা গুলিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আরও গুলিয়ে যাওয়ার মত চরিত্র রামকিশোরের নায়েব চাঁদমোহন দত্তের (শঙ্কর দেবনাথ)। তিনি রীতিমত বাঙাল ভাষায় কথা বলেন, অথচ বেশভূষা খাঁটি হিন্দি বলয়ের মুনশিদের মত। বল্লভপুরের রূপকথা ছবিতে প্রধান চরিত্রে মন ভরিয়ে দেওয়া সত্যম ভট্টাচার্য এখানে কিছুতেই খলনায়ক হয়ে উঠতে পারলে না। মণিলালের চরিত্রে তিনি যেন সেই বল্লভপুরের ভালমানুষ রাজাই রয়ে গেলেন। শরদিন্দু তাঁর খলনায়কদের ব্যোমকেশের প্রতিস্পর্ধী হিসাবে গড়ে তুলেছেন বহু গল্পেই। পথের কাঁটা, চিড়িয়াখানা-র মত দুর্গরহস্য উপন্যাসেও তাকে শেষ পর্যন্ত ধরা যায় না। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেবকে অপরাধী ফাঁকি দিল – এ জিনিস কোথায় কার ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করবে কেউ বলতে পারে না। তাই পরিচালক সে ঝুঁকি নেননি। ক্লাইম্যাক্সটা হয়েছে একেবারে হিন্দি সিনেমার মত। দেব মরার ভান করে, হারার ভান করে শেষমেশ জিতে গেছেন। ছবিতে যে পরিমাণ হিন্দি, বাংলা সংলাপ মেশানো হয়েছে তাতে বলে দিতেই পারতেন “শুনুন মণিলালবাবু, হার কর জিতনেওয়ালে কো বাজিগর কহতে হ্যাঁয়।” দোষ হত না।

একমাত্র অম্বরীশই এই ছবিতে সাবলীল। কিন্তু মুশকিল হল, কোনো অজ্ঞাত কারণে বাংলা ছবির নির্দেশকরা সকলেই একমত হয়েছেন যে লালমোহনবাবু আর অজিত গোয়েন্দার বন্ধু কম, ভাঁড় বেশি। তাই তাঁকে দিয়ে বিস্তর ভাঁড়ামি করানো হয়েছে। এমনকি সিদ্ধি খাইয়ে মাতাল পর্যন্ত করা হয়েছে (শরদিন্দু সিদ্ধি খাওয়ার কথা লিখেছেন, টলমল করার কথা লেখেননি)। বাঙালি সাহিত্যিকের এমন চরিত্রচিত্রণ দেখলে শরদিন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন নির্ঘাত।

সবই বোঝা গেল, কিন্তু শেষে লগ্নজিতা চক্রবর্তীর গলায় ‘ও যে মানে না মানা’ কেন বেজে উঠল তা ঠিক বোধগম্য হল না। সবাই তো সবকিছু মেনে নিল। শরদিন্দু যেমন লিখেছেন তেমনভাবেই তুলসী আর রমাপতির বিয়ে হল, সত্যবতী মা হল, এমনকি রামকিশোরের দুই দুর্দান্ত ছেলের বাঁদরামিও প্রশমিত হল। তাহলে? রবীন্দ্রনাথের গান কি তুলসীপাতা, যে বাংলার সংস্কৃতির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সবকটি নৈবেদ্যের উপর একখানা করে দিতেই হবে?

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

সাহিত্য ও সাংবাদিকতা অপ্রিয় সত্য ছাড়া বৃথা

সাংবাদিকতা করা মানেই হল, সজাগ দৃষ্টিতে যে ক্ষমতাশালী – সে সরকার হতে পারে, ব্যবসায়ী হতে পারে, মাস্টার হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, উকিল হতে পারে – তার দোষত্রুটি খেয়াল করা এবং সকলের চোখের সামনে সত্য উদ্ঘাটিত করা।

দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর মহাবিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের আমন্ত্রণে গত ১৫ মার্চ ২০২৩ (বুধবার) ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘সাহিত্য ও সাংবাদিকতা’ বিষয়ে এই ভাষণ দেওয়া হয়েছিল।

শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আমার প্রণাম, প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসা। আমাকে আজ বলতে ডাকার জন্যে কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং সংস্কৃত বিভাগকে ধন্যবাদ। তোমাদের যে মাস্টারমশাইরা আমার আগে বললেন, তাঁরা আমার উপরে একটা গুরুভার চাপিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা আশা করেছেন যে আমার বক্তৃতা থেকে তোমরা একটা পেশাগত দিশা পাবে। এখন আমি নিশ্চিত নই সেটা পাবে কিনা। তোমরা শুনে দ্যাখো।

জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না, আমাকে দিয়েছে। ইংরেজি অনার্সের ছাত্র হিসাবে যখন বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তখন একটা পেপারে আমাদের ৪০ নম্বরের প্রবন্ধ লিখতে হত। সেবার সবাই বলেছিল একটা প্রবন্ধ আসবেই। টেস্ট পরীক্ষায় এসেছিলও বটে। আমি অনেক বই-টই ঘেঁটে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, টেস্ট পরীক্ষার খাতা দেখানোর সময়ে মাস্টারমশাই “চমৎকার হয়েছে” বলে পিঠও চাপড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দিতে বসে দেখি, সে প্রবন্ধ আসেনি। এসেছে আজকের বিষয়টা – সাহিত্য ও সাংবাদিকতা। যেহেতু প্রস্তুতি ছিল না, সেহেতু সেদিন কীরকম লিখেছিলাম শুনেই বুঝতে পারছ। নম্বরও পেয়েছিলাম তেমনই। আমার সেই সময়কার সহপাঠী এবং তোমাদের মাস্টারমশাই ডঃ শান্তিগোপাল দাসের কল্যাণে আমি আজ দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছি। আজকের পরীক্ষকরা, মানে তোমরা, নিশ্চয়ই অত কড়া পরীক্ষক নও। দ্যাখো আজ পাস করতে পারি কিনা।

এই বক্তৃতার আয়োজক যেহেতু এই কলেজের সংস্কৃত বিভাগ, বিশেষ করে সেই কারণেই ধরে নিচ্ছি, রাজা বিক্রমাদিত্য আর কালিদাস – এই নাম দুটো কারোর অজানা নয়। বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা গল্প শুধু সংস্কৃত কেন, প্রায় যে কোনো বিভাগের লোকেরই জানা। সেই গল্পটা দিয়েই আজকের আলোচনা শুরু করব। নবরত্নসভায় কালিদাস ছাড়াও আরেকজন কবি ছিলেন, তাঁর নাম বররুচি। তাঁর একটু অভিমান বা ক্ষোভ ছিল, যে রাজা তাঁর চেয়ে কালিদাসকে বেশি গুরুত্ব দেন, যদিও কবি হিসাবে তিনি কালিদাসের চেয়ে কোনো অংশে কম যান না। এই ক্ষোভের কথা রাজা জানতেন। তা তিনি ঠিক করলেন একদিন প্রমাণ করে দেবেন কালিদাস মহত্তর কবি। কীভাবে করলেন? একদিন সভাসদদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন, সামনে একটা মরা গাছ পড়ে আছে। রাজা ওই গাছটা দেখিয়ে বররুচিকে বললেন “কবিবর, এ নিয়ে এক লাইন হয়ে যাক?” কবি বললেন “শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে।” তারপর রাজা কালিদাসকে বলতে বললেন। তিনি বললেন “নীরসতরুবরঃ পুরতো ভাতি।” আর কোনো সংশয় রইল না। যিনি শুকিয়ে যাওয়া গাছেও রসসঞ্চার করতে পারেন তাঁর চেয়ে বড় কবি আর কে আছে?

বাংলা ভাষার সম্ভবত সর্বকালের সেরা সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু অবশ্য মেঘদূতম অনুবাদ করে তার ভূমিকায় লিখেছেন, প্রচলিত ধারণাটা ভুল। আসলে বররুচির শ্লোকটাই সাহিত্য হিসাবে উন্নততর। কিন্তু সে বিতর্কে যাব না, কারণ আমার এই গল্পটা বলার উদ্দেশ্য আলাদা। কথা হল, সাহিত্য হিসাবে কালিদাস যা বলেছেন তা হয়ত মহত্তর, কিন্তু সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বররুচি যা বলেছেন সেটাকেই এগিয়ে রাখতে হবে। কোনোরকম অলঙ্করণ বাদ দিয়ে সত্যকে তুলে ধরা – এই যদি সাংবাদিকতার কাজ হয়, তাহলে মানতেই হবে বররুচি বেশি সফল।

কিন্তু সাংবাদিকতার কাজ কি এটাই? অলঙ্করণ বাদ দিয়ে সত্যকে তুলে ধরা? অলঙ্করণ করলে কি সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতা থাকে না? আরও প্রশ্ন আছে। সত্য বলা কি শুধু সাংবাদিকতারই কাজ, সাহিত্যের কাজ নয়? সাহিত্য মানে কি স্রেফ কতকগুলো বানানো কথা? সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি বা অন্য যে কোনো ভাষার সাহিত্য নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা সকলেই বোধহয় মানবেন যে কবিতাই হল সাহিত্যের সবচেয়ে বিমূর্ত ধারা। কারণ কবিতার প্রকরণ এবং বিষয়বস্তু – দুটোতেই কল্পনার আধিপত্য। তা বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন, শঙ্খ ঘোষ, আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগেই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় লিখে দিয়েছেন “সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার। কিন্তু জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে আছি দিনরাত যে একটি কবিতার জন্যেও কখনো-কখনো অনেকদিন থেমে থাকতে হয়।” এরপর তো আর সত্য বলা সাহিত্যের কাজ নয়, এ কথা বলার অবকাশ নেই। তাহলে?

আমরা বরং আগে ভেবে দেখি যে সাংবাদিকতা আসলে কী? ইংরেজি সাহিত্যের মাস্টারমশাই, দিদিমণি এবং ছাত্রছাত্রীরা জর্জ অরওয়েলের কথা জানেন। অরওয়েল বলেছিলেন সাংবাদিকতা হল তাই, যা কেউ না কেউ প্রকাশিত হতে দিতে চায় না। বাকি সবই হল জনসংযোগ, মানে পাবলিক রিলেশন বা সংক্ষেপে পি আর। যা অরওয়েলের সময়ে না হলেও, আমাদের সময়ে একটা আস্ত পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমাদের মধ্যে যারা ভবিষ্যতে কোথাও কোনো গণমাধ্যমের পাঠক্রমে ভর্তি হবে, তারা দেখতে পাবে একইসঙ্গে সাংবাদিকতা এবং পাবলিক রিলেশন পড়ানো হয়। কিন্তু অরওয়েলের কথাটা শুনলেই বোঝা যাচ্ছে, দুটো আসলে পরস্পরবিরোধী বিষয়।

ব্যাপারটা কীরকম? ধরা যাক, তোমাদের কলেজে সাংবাদিকতা বিভাগ চালু করা হচ্ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ খবরটা স্থানীয় কাগজের সম্পাদকদের কাছে পাঠালেন, তারাও ছেপে দিল। এটা প্রয়োজনীয় কাজ হল, কারণ এলাকার সাংবাদিকতা পড়তে আগ্রহী ছেলেমেয়েরা জানতে পারল এবং তাদের অভিভাবকরা জানতে পারলেন। কিন্তু এটা জনসংযোগ হল, সাংবাদিকতা হল না। এবার ধরা যাক, কোনো কলেজে সাংবাদিকতা বিভাগ আছে, সেখানে ছেলেমেয়েরা ভর্তিও হয়েছে। অথচ সেখানে অধিকাংশ ক্লাস হয় না, সময়ে পরীক্ষা হয় না। কারণ বেশিরভাগ অধ্যাপক বহুদিন হল কলেজেই আসেন না। এই খবরটা কোনো কাগজে কি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল বা কোনো খবরের চ্যানেলে দেখানো হল। এইটা সাংবাদিকতা হল। কারণ এ খবর বাইরে যাক তা কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইবেন না। আবার এমনও হতে পারে যে তাঁরা চাইছিলেন খবরটা প্রকাশিত হোক, হইচই হোক। কারণ এই অচলাবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, কর্তৃপক্ষ প্রতিকার করতে চেয়েও পারেননি উপরতলার চাপে বা অবজ্ঞায়। সেক্ষেত্রে আবার এ খবর প্রকাশিত হোক সেটা উপরতলা চাইবে না।

তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারা যাচ্ছে, সাংবাদিকতা বলে রোজ যা চলছে আমাদের চারপাশে, তার অধিকাংশই আসলে পি আর। মোটেই সাংবাদিকতা নয়। রাত্রিবেলা স্টুডিওতে বসে গলা ফাটিয়ে “দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো” বলা সাংবাদিকতা নয়। কিন্তু এরকম হচ্ছে তো। কেন হচ্ছে? সে আবার একটা আলাদা আলোচনার বিষয়। এই বক্তৃতাতেও শেষদিকে খানিকটা সে আলোচনায় আসব, কারণ তোমাদের শান্তিগোপাল স্যার আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছেন, কী করে সাংবাদিক হতে হয় সেটা যেন বলি। সেকথা বলতে গেলে ওই আলোচনায় ঢুকতেই হবে। কিন্তু আপাতত আমরা দেখব, যে সাহিত্য আর সাংবাদিকতা নিয়ে একত্রে আলোচনা কেন দরকার? সাংবাদিকতা আর সাহিত্যে কোথায় মিল, কোথায় অমিল? দুটোর মধ্যে কি আদৌ কোনো সীমারেখা আছে? সে রেখা কি সবসময় বজায় থাকে? না থাকলে কোথায় মুছে যায়?

এ পর্যন্ত আমাদের আলোচনা থেকে যা উঠে এসেছে, তার মধ্যে দুটো জিনিস আলাদা করে চিহ্নিত করা দরকার। ১) সাংবাদিকতা আর সাহিত্য – দুয়ের কাজই সত্য বলা, ২) সাংবাদিকতার কাজ অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করা। এই দ্বিতীয় কাজটার উল্লেখে সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের একটা তফাতের আভাস পাওয়া যায়। কারণ প্রাথমিকভাবে আমরা সাহিত্যের কাছে কেন যাই? আরও সহজ করে যদি বলি – গল্পের বই, কবিতার বই, নাটক বা প্রবন্ধের বই পড়তে চাই কেন? আনন্দ পাব বলে। তাহলে সাহিত্য পড়ার মূল উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আনন্দ পাওয়া? এমনটা শুধু যে আমাদের মত সাধারণ মানুষেরই মত তা নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের পথে বইয়ের তথ্য ও সত্য প্রবন্ধে লিখেছেন “যে প্রকাশচেষ্টার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপন প্রয়োজনের রূপকে নয়, বিশুদ্ধ আনন্দরূপকে ব্যক্ত করা, সেই চেষ্টারই সাহিত্যগত ফলকে আমি রসসাহিত্য নাম দিয়েছি।” প্রবন্ধের নামটা খেয়াল করো। আজকের বিষয়ের সঙ্গে মিল আছে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছি; প্রবন্ধের নাম ‘তথ্য ও সত্য’। রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তা যদি ঠিক হয়, তাহলে মানতে হবে যে সত্য প্রকাশ করা সাংবাদিকতার মত সাহিত্যেরও কাজ বটে, কিন্তু অপ্রিয় সত্য নয়। তোমাদের শান্তিগোপাল স্যারের পাশে বসে যখন সংস্কৃত ক্লাস করতাম, তখন শিখেছিলাম প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রেও উপদেশ দেওয়া হয়েছে “সত্যম অপ্রিয়ম মা বদ”। মানে অপ্রিয় সত্য বোলো না। এটাই তাহলে সাহিত্যে পালনীয়, তাই না?

কিন্তু এই যুক্তি মানলে বিশ্বসাহিত্যের সেরা সৃষ্টির অনেকগুলোকেই যে আর সাহিত্য বলে মানা যাবে না! ইংরেজ কবি পিবি শেলি ‘টু আ স্কাইলার্ক’ কবিতায় লিখেই দিয়েছেন “Our sincerest laughter/With some pain is fraught/Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.” মানে আমরা যখন সবচেয়ে জোরে হাসি, তার মধ্যেও কিছুটা বেদনা মিশে থাকে। আমাদের সবচেয়ে মিষ্টি গান সেগুলোই, যেগুলোতে সবচেয়ে কষ্টের কথা বলা আছে। কথাগুলো গানের ক্ষেত্রে যতটা সত্যি, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ততটাই সত্যি। ধরো বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যে স্থান, ইংরেজি সাহিত্যে তো সে স্থান উইলিয়াম শেক্সপিয়রের। তিনি ১৬১৬ সালে মারা গেছেন, আজ ৪০০ বছর পরেও তাঁর কোন নাটকগুলো বারবার পড়া হয়, মঞ্চে অভিনীত হয়, বারবার নানা রূপে সিনেমার পর্দায় নিয়ে যাওয়া হয়? কমেডিগুলো নয়, ট্র্যাজেডিগুলো। ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, ওথেলো, জুলিয়াস সিজার, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। সারা পৃথিবীর সাহিত্য সমালোচকরা মানেন, এগুলোই শেক্সপিয়রের সেরা কাজ। অথচ এগুলো যে শুধু বিয়োগান্ত তা নয়, প্রথম চারটে নাটকের কেন্দ্রে আছে চারটে খুন। পঞ্চমটায় দুই নিরপরাধ যুবক-যুবতীর মৃত্যু ঘটে। উপরন্তু শত্রুতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অন্তর্ঘাত, অবৈধ প্রেম এসবে ভর্তি এই নাটকগুলো। ওগুলোর বিজ্ঞাপনে অনায়াসে লেখা যেত “লাশ কা মাউন্টেন, খুন কা ফাউন্টেন। ডেঞ্জার! ডেঞ্জার! ডেঞ্জার!” কথাটা ম্যাকবেথ, ওথেলো আর হ্যামলেট অবলম্বনে বিশাল ভরদ্বাজের মকবুলওমকারা আর হায়দার  ছবিগুলো যারা দেখেছে তারা পরিষ্কার বুঝতে পারবে।

শেক্সপিয়র তবু অনেক আধুনিক দৃষ্টান্ত। একেবারে রামায়ণ, মহাভারতে চলে যাই। রাম-সীতা আর লক্ষ্মণকে বনবাসে যেতে হল কেন? রামের সৎ মা কৈকেয়ী আর দাসী মন্থরার ষড়যন্ত্রে। রাম-রাবণের যুদ্ধই বা লাগল কেন? রাবণ অন্যের বউকে অপহরণ করলেন বলে। পাশ্চাত্য জগতের পুরাণ হোমারের ইলিয়াড, তারও কেন্দ্রে একজন নারীর উপর কর্তৃত্ব কায়েম করা নিয়ে যুদ্ধ – সেই নারী হলেন হেলেন অফ ট্রয়। আর মহাভারতে কতগুলো অপ্রিয় সত্য আছে সেকথা তো গুনতে শুরু করলে শেষ হবে না। আজকের ভারতের আইনকানুন, নীতি নৈতিকতা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে এখন মহাভারত লিখলে প্রথমে বইটা নিষিদ্ধ হয়ে যেত, তারপর ব্যাসদেবের বাড়িতে ঢিল পড়ত, শেষমেশ পুলিস এসে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিত। সবচেয়ে বড় কথা, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড – সবই শেষপর্যন্ত যুদ্ধের গল্প। রামায়ণে তবু উত্তরকাণ্ড বলে একটা ব্যাপার আছে। মহাভারত তো যুদ্ধের পর কার কী হল সে গল্প দিয়েই শেষ। যুদ্ধে যে আসলে কেউ জেতে না – একথা শান্তিপর্বে ব্যাসদেব যেভাবে দেখিয়েছেন তাতে মহাভারতকে যদি পৃথিবীর প্রাচীনতম যুদ্ধবিরোধী সাহিত্যকর্ম বলে চিহ্নিত করি তাহলে ভুল হবে না।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সাংবাদিকতার মত সাহিত্যেরও একটা বড় কাজ অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করা। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের “বিশুদ্ধ আনন্দরূপ” কথাটার বিস্তার আমরা আনন্দ বলতে যা বুঝি তার চেয়ে অনেক বেশি এবং তার মধ্যে এইসব মহান সাহিত্য অনায়াসে এঁটে যায়। কারণ আমাদের দেশের প্রাচীন নন্দনতত্ত্বে নবরসের কথা বলা হয়েছে। যে কোনো মহান সাহিত্য ওই নটার এক বা একাধিক রসের সন্ধান দেয়। যে কোনো রসেই রয়েছে বিশুদ্ধ আনন্দরূপ। যাকে ট্র্যাজেডি বলা হয়, তাতে শেষে পাওয়া যায় করুণরস। সে রসে যে বিশুদ্ধ আনন্দরূপ রয়েছে সে ব্যাপারে এমনকি পাশ্চাত্যের প্রাচীন নন্দনতত্ত্বের গুরু অ্যারিস্টটলও একমত। ওই আনন্দরূপ আবিষ্কার করে যে অনুভূতি হয় তিনি তার নাম দিয়েছেন catharsis

এখন ঘটনা হল, যত দিন গেছে, সাহিত্যে অপ্রিয় সত্যের ভাগ কিন্তু তত বেড়েছে। ফলে সাহিত্যের আজ যে চেহারা দাঁড়িয়েছে তার সবটা আমরা নবরসের ধারণা দিয়ে বা অ্যারিস্টটল, রবীন্দ্রনাথের ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব না। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সারা পৃথিবীর মানুষের উপর এবং স্বভাবতই সাহিত্যের উপর পড়েছে। আমাদের দেশে, বিশেষ করে বাংলায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, পরবর্তীকালে নকশাল আন্দোলন, তারপর ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রভাবও পড়েছে সাহিত্যে। ফলে অপ্রিয় সত্যের পরিমাণ বেড়েই চলেছে, এখনো বাড়ছে। পাশাপাশি সাংবাদিকতার পরিমাণ ও বিস্তার বেড়েছে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের সীমারেখাও অস্পষ্ট হয়েছে। এটা কাকতালীয় নয়, যে বিংশ শতাব্দীর বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক জীবনের কোনো পর্বে বা সারাজীবন পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ থেকে শুরু করে বাংলার প্রমথনাথ বিশী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় বা আজকের প্রচেত গুপ্ত – তালিকা তৈরি করলে কয়েক মাইল লম্বা হবে। পৃথিবীর যেসব জায়গায় মানুষ বেশি কষ্টে আছে, জীবনযুদ্ধ যেখানে বেশি প্রবল, সেখানে সাহিত্য আর সাংবাদিকতার তফাত আরও কমে এসেছে। এর সবচেয়ে দগদগে উদাহরণ প্যালেস্তাইনের কবি, পেশায় সাংবাদিক রাফীফ জিয়াদার একখানা কবিতা। তোমরা ইউটিউবে গিয়েই সার্চ করলে স্বচক্ষে দেখতে পাবে রাফীফ কীভাবে সমস্ত শরীর, মন দিয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করেছেন।

কয়েক বছর আগে সেই ভিডিও দেখে ইংরিজিতে লিখিত এই কবিতার বাংলা ভাষান্তর করেছিলাম। তোমরা শুনে দ্যাখো, ইজরায়েলি হানাদারির মুখে বেঁচে থাকা প্যালেস্তিনীয়দের কথা কীভাবে রাফীফের কলমে উঠে এসেছে। এটা কি সাহিত্য, নাকি সাংবাদিকতা? নাকি দুটোই। তোমরাই বিচার করো।

আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন
সাউন্ড বাইট আর শব্দসংখ্যায় বাঁধা,
পরিসংখ্যানে ভারি,
সব প্রশ্নের মাপা উত্তর দিতে তৈরি।
আমার ইংরিজিটা ঘষেমেজে,
জাতিপুঞ্জের সনদগুলো ঝালিয়ে নিয়ে এসেছি
তবু সে আমায় জিজ্ঞেস করল:
“মিস জিয়াদা, তোমার মনে হয়না সব মিটে যাবে
যদি তোমরা শিশুদের হিংসার পথ দেখানো বন্ধ করো?”
আমি শান্ত হওয়ার শক্তি খুঁজলামকিন্তু শান্তি তো আমার জিভের ডগায় নেই
গাজায় বোমাবৃষ্টি দেখতে দেখতে
শান্তি এইমাত্র কেটে পড়ল
আমরা বাঁচতে শেখাই, ভাই
(রাফীফ, হাসতে থাকো),
আমরা বাঁচতে শেখাই
আমরা প্যালেস্তিনীয়রা বাঁচতে শেখাই
ওরা শেষ আকাশের টুকরোটা দখল করে নেওয়ার পরেও,
শেষ আকাশপারে পাঁচিল তোলার পরেও,
আমরা বাঁচতে শেখাই

কিন্তু আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন
সাউন্ড বাইট আর শব্দসংখ্যায় বাঁধা

“আরে আমাদের একটা গল্প চাই, একটা মানবিক গল্প,
রাজনৈতিক খবর-টবর নয়
আমরা লোককে তোমার, তোমার দেশের লোকের ব্যাপারে
জানাতে চাই
“বৈষম্য”, “দখলদারী” এইসব শব্দ চলবে না,
এটা রাজনৈতিক ব্যাপার নয়
সাংবাদিক হিসাবে আমাদের বল তোমার কথা,
মানে যা রাজনৈতিক নয়, এমন কিছু।”

আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন

“ধরো গাজার একজন মহিলার গল্প যার চিকিৎসা দরকার,
বা তোমার কথাই বল নাআচ্ছা তোমার কটা হাড় ভাঙা?
এতগুলো কি যে সূর্য ঢেকে যাবে?
আমাকে তোমাদের মৃতদেহগুলো দাও না,
আর নামের তালিকা,
বারোশো শব্দের মধ্যে

আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন
সাউন্ড বাইট আর শব্দসংখ্যায় বাঁধা,
এমনভাবে যাতে সন্ত্রাসবাদীদের রক্ত দেখে যাদের মন গলে না
তাদেরও নাড়িয়ে দেওয়া যায়

কিন্তু ওরা ব্যথা পেয়েছে,
গাজার গরু-ছাগলগুলোর জন্য ওরা সত্যিই খুব ব্যথিত
তাই আমি ওদের জাতিপুঞ্জের সনদগুলো দিলাম,
আর বললাম আমরা নিন্দা করি,
ঘেন্না করি, প্রত্যাখ্যান করি ওগুলো।
এটা সমানে-সমানে লড়াই নয়:
দখলদার আর ভিটেমাটি চাটি হওয়া লোকজন,
আর একশো, দুশো, এক হাজার মৃতদেহের কথা বলছি।
তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধ আর গণহত্যার কথা বলছি
বলতে বলতে হাসি,
হেসে বলি “সন্ত্রাসবাদীদের কথা বলছি না কিন্তু”
আমি আবার গুনি, বারবার গুনি –
একশো, দুশো, এক হাজার মৃতদেহ।
কেউ আছেন? কেউ শুনছেন?
আহা, ঐ মড়াগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে
যদি হাউ হাউ করে কাঁদতে পারতাম,
যদি সব উদ্বাস্তু শিবিরে খালি পায়ে দৌড়ে যেতে পারতাম,
আর সব শিশুর কান চেপে রাখতে পারতাম,
যাতে ওদের বোমার আওয়াজ শুনতে না হয় বাকি জীবন
আমার মত!

আজ আমার শরীর মুখরোচক বুলেটিন
আর শোনো ভাই, তোমার জাতিপুঞ্জের সনদ
কস্মিনকালেও এ ব্যাপারে কিস্যু করেনি
আর কোনো সাউন্ড বাইট, কোনো সাউন্ড বাইট,
সে যতই নিখুঁত হোক না কেন,
আমার ইংরিজি যতই ঝরঝরে হোক না কেন,
কোনো সাউন্ড বাইট সে জীবনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
কোনো সাউন্ড বাইট পারবে না এসব মেটাতে।

আমরা বাঁচতে শেখাই ভাই,
আমরা বাঁচতে শেখাই

আমরা প্যালেস্তিনীয়রা রোজ সকালে জেগে উঠি
বাকি দুনিয়াকে বাঁচতে শেখাব বলে

সভ্যতার ইতিহাস যত লম্বা তার সাপেক্ষে বিচার করলে সাংবাদিকতা অত্যন্ত আধুনিক ব্যাপার, কিন্তু সাহিত্য অতি প্রাচীন। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে আধুনিক যুগ বলতে বিভিন্ন সময়কে বোঝানো হয়, আধুনিকতার সংজ্ঞাও সেই অনুযায়ী বদলে যায়। এখানে আধুনিক শব্দটা আমি সাহিত্যের ইতিহাসে যে অর্থে ব্যবহার হয় একেবারেই সে অর্থে ব্যবহার করছি না। শব্দটার সবচেয়ে সংকীর্ণ যে অর্থ, মানে সাম্প্রতিককালের ব্যাপার – সে অর্থেই ব্যবহার করলাম। তাহলে এতক্ষণ ধরে সাহিত্য আর সাংবাদিকতার অমিলগুলোকে বাতিল করতে করতে এসে এতক্ষণে একটা অমিল স্বীকার করলাম। তার মানে নিশ্চয়ই সাহিত্য আর সাংবাদিকতার সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে বললেও কোনো একটা সীমারেখা আমি মানি?

মানি তো বটেই। কী সেটা? উদ্দেশ্যের সীমারেখা। আবার রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞায় ফিরে যাই। “যে প্রকাশচেষ্টার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপন প্রয়োজনের রূপকে নয়, বিশুদ্ধ আনন্দরূপকে ব্যক্ত করা, সেই চেষ্টারই সাহিত্যগত ফলকে আমি রসসাহিত্য নাম দিয়েছি।” সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আবহমানকাল ধরে চলছে। রবীন্দ্রনাথের আমলেও জোরদার বিতর্ক চলছিল। সেইসময় অনেকের মত ছিল সাহিত্যের উদ্দেশ্য লোককে শিক্ষিত করা। রবীন্দ্রনাথ তাতে ঘোর আপত্তি করেছিলেন। ওই সাহিত্যের পথে বইতেই ‘বাস্তব’ নামে প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন “লোক যদি সাহিত্য হইতে শিক্ষা পাইতে চেষ্টা করে তবে পাইতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য লোককে শিক্ষা দিবার জন্য কোনো চিন্তাই করে না। কোনো দেশেই সাহিত্য ইস্কুল-মাস্টারির ভার লয় নাই। রামায়ণ মহাভারত দেশের সকল লোকে পড়ে তাহার কারণ এ নয় যে, তাহা কৃষাণের ভাষায় লেখা বা তাহাতে দুঃখী-কাঙালের ঘরকরনার কথা বর্ণিত। তাহাতে বড়ো বড়ো রাজা, বড়ো বড়ো রাক্ষস, বড়ো বড়ো বীর এবং বড়ো বড়ো বানরের বড়ো বড়ো লেজের কথাই আছে। আগাগোড়া সমস্তই অসাধারণ। সাধারণ লোক আপনার গরজে এই সাহিত্যকে পড়িতে শিখিয়াছে।” সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে এতরকম পরস্পরবিরোধী মতামত আছে, যে তা থেকে কোনো মোদ্দাকথা বের করা অসম্ভব। এই হলে যতজন বসে আছেন তাঁদের প্রত্যেককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন সাহিত্য পড়েন? আলাদা আলাদা উত্তর পাওয়া যাবে। আবার সাহিত্যিকদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন লেখেন? তাহলেও কোনো একটা উত্তর পাওয়া যাবে না। কিন্তু একথা ঠিক, যে বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান আছে এমন কোনো সাহিত্যিক বলবেন না “লিখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু লেখা আমার চাকরি, তাই লিখি।”

সাংবাদিকদের অনেককে জিজ্ঞেস করলে কিন্তু এই উত্তরটা পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ সাহিত্যের মূলে আছে মানসিক প্রয়োজন বা আরেকটু তরল করে বললে, সাহিত্য হৃদয় সংক্রান্ত ব্যাপার। সাংবাদিকতার মূলে আছে ব্যবহারিক প্রয়োজন। কথাটা শুধু সাংবাদিকের দিক থেকেই সত্যি তা নয়। একজন পাঠকও যে জন্যে পয়সা দিয়ে গল্পের বই কেনেন, সেই কারণেই খবরের কাগজ কেনেন কি? যে কারণে হলে গিয়ে বা মোবাইলে সিনেমা দ্যাখো তোমরা, ঠিক সেই কারণেই টিভিতে বা মোবাইলে খবর শোনো কি? তা তো নয়। সাহিত্য পড়ো বা সিনেমা দ্যাখো উপভোগ করার জন্যে। কিছু ক্ষেত্রে হয়ত নতুন কিছু জানার জন্যে। কাগজ পড়ো বা টিভিতে কি মোবাইলে খবর পড়ো চারপাশে কী হচ্ছে জানতে চাও বলে। যা হচ্ছে তার সঙ্গে নিজের রোজকার ভালমন্দ জড়িয়ে আছে বলে। কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়রের লেখা যদি কেউ না-ই পড়ে তার কী ক্ষতি হবে? ভারতের মত দেশে বেশিরভাগ লোকই তো সাহিত্য পড়ে না। কারণ সাহিত্য পড়তে গেলে যে প্রাথমিক পড়াশোনা করা দরকার তার সুযোগই পায় না। যারা পায় তাদের অনেকের হাতেও খাওয়া, পরা, থাকার ব্যবস্থা করে এবং পাঠ্য বইয়ের ব্যবস্থা করে এতটা অতিরিক্ত পয়সা থাকে না যে সাহিত্য পাঠ করার জন্যে শখ করে বই কিনবে। কিনে পড়ার ক্ষমতা না থাকলেও মানুষ যাতে বই পড়তে পারে তার জন্যে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলে একটা চমৎকার জিনিস মানুষ আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু সে জিনিস তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। সে যা-ই হোক, আর্থিক ক্ষমতা না থাকলেও কিন্তু মানুষ খবর সংগ্রহ করতে চেষ্টা করে। নিজে কাগজ কিনতে না পারলে দোকানে গিয়ে পড়ে, প্রতিবেশীর কাগজ চেয়ে নিয়ে পড়ে। ইদানীং অবশ্য কাগজের জনপ্রিয়তা কমছে। কিন্তু মোটামুটি সকলেই টিভিতে খবর শোনে। নিদেনপক্ষে হাতের মোবাইলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুলে খবর দেখে। ফেসবুকে দেখে, হোয়াটস্যাপে দেখে। অনেকসময় ভুয়ো খবরও দেখে ফ্যালে, কিন্তু দ্যাখে। মানুষের খবরের খিদে কিছুতেই মেটে না।

সাহিত্য আর সাংবাদিকতা যাদের জন্যে, অর্থাৎ পাঠক বা দর্শক – তাঁদের উদ্দেশ্যে যখন এরকম তফাত আছে, তখন সাহিত্য আর সংবাদ উৎপাদনের উদ্দেশ্যেও তফাত থাকতে বাধ্য। সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য মানুষকে অবগত করা। কী বিষয়ে? তা ঠিক করে সংবাদ পরিবেশকরা, চলতি কথায় সংবাদমাধ্যম। যেখানে সাংবাদিকরা চাকরি করেন। অর্থাৎ খবরের কাগজ বা চ্যানেল বা ওয়েবসাইট বা নিউজ এজেন্সি। পৃথিবীর যে কোনো দেশের খবরের কাগজ হাতে নিলে বা খবরের সাইট খুললে বা খবরের চ্যানেল দেখলে দেখা যাবে বিভাগগুলো মোটামুটি একই। রাজনীতির খবর, অর্থনীতির খবর, খেলার খবর, বিনোদন জগতের খবর। আমাদের দেশে এখনো খুব বেশি চল নেই যে দু ধরনের খবরের, সেগুলো হল পরিবেশ সম্পর্কিত খবর আর বিজ্ঞানের খবর। কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে একেকটা সংবাদমাধ্যমে একেকটা বিভাগের গুরুত্ব একেকরকম। কেউ রাজনীতির খবর বেশি পরিবেশন করে, কেউ সিনেমা-টিনেমা নিয়ে বেশি মেতে থাকে, কেউ আবার খেলা নিয়ে। যারা রাজনীতির খবর বেশি দেয় তাদের মধ্যেও কেউ এ দলের খবর বেশি দেয়, কেউ ও দলের খবর বেশি দেয়। এই তফাতগুলো কেন হয়? সে প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আগে অন্য একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার। এই যে বললাম, মানুষকে অবগত করা। আচ্ছা, অবগত হওয়ার দরকারটা কী? এই বুনিয়াদপুরে বসে যদি না-ই জানা যায় কলকাতায় কী হচ্ছে, দিল্লিতে কী হচ্ছে, ইউক্রেনের রাজধানী কিভে কী হচ্ছে বা নিউইয়র্কে কী হচ্ছে; তাতে ক্ষতিটা কী?

ক্ষতি ছিল না, যদি আমরা একটা রাজতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক দেশে বাস করতাম। আমাদের অধিকার বলে কিছু থাকত না, আইনকানুন বলেও কিছু থাকত না। রাজা বা একনায়কের মুখের কথাই হত আইন, আমাদের সবাইকে মুখ বুজে সেই আইন মেনেই চলতে হত। প্রতিবাদ করলেই পুলিস মিলিটারি ইত্যাদি দিয়ে মারধোর করা হত, জেলে পুরে দেওয়া হত, গুমখুন করা হত। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ইংল্যান্ডের রানির শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার তিন বছরের মাথায়, ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি, আমরা, মানে ভারতের সাধারণ নাগরিকরা, একটা কাণ্ড করে বসেছি। আমরা একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু করেছি। পৃথিবীর অন্য অনেক গণতান্ত্রিক দেশের মত এই সংবিধান অনুযায়ী আমাদের কিসে ভাল, কিসে মন্দ; কোন আইনটা করা হবে আর কোন আইনটা বাতিল করা হবে, আমাদের প্রতিনিধি হয়ে কারা দেশ চালাবে – এসব ঠিক করার দায়িত্ব আমরা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছি। তা এইসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আমরা নেব কী করে যদি কোথায় কী হচ্ছে সে সম্পর্কে অবগতই না থাকি? আর অবগত থাকা মানে মূলত খারাপ কী কী হচ্ছে সে সম্পর্কে অবগত থাকা। মানে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কোথায় কোথায় তাঁদের যে দায়িত্ব আমরা দিয়েছি ভোটের মাধ্যমে, তা থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন সে সম্পর্কে অবগত থাকা। মানে ঘুষ নিচ্ছেন কি? আমাদের ভুল বুঝিয়ে বা অন্ধকারে রেখে এমন কোনো আইন তৈরি করছেন কি যাতে আমাদের ক্ষতি হতে পারে? তাঁদের হাতে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে – মানে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, পুলিসবাহিনী, সেনাবাহিনী – সেগুলো ব্যবহার করে এমন কিছু করছেন কি, যাতে তাঁরাই যে আমাদের ভৃত্য সেই ব্যাপারটা উল্টে গিয়ে আমরা তাঁদের ভৃত্য হয়ে যাই? যেসব সরকারি পরিষেবা আমাদের পাওয়ার কথা, তা আমরা সবাই পাচ্ছি কি? এমন নয় তো, যে কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বুনিয়াদপুরে পাওয়া যাচ্ছে না? বা বুনিয়াদপুরে সরকারি স্কুলে লেখাপড়া হচ্ছে, মেদিনীপুরে হচ্ছে না? বর্ধমানে মসৃণ রাস্তা হচ্ছে, কিন্তু ঔরঙ্গাবাদে হচ্ছে না? সরকার আমাদের মত সাধারণ লোকেদের মধ্যে মারদাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে না তো? অন্য কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে এমন কোনো চুক্তি করছে না তো, যাতে সরকারের আমাদের উপর নজরদারি করতে সুবিধা হয় এবং আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়? আমাদের টাকায় তৈরি সরকারি সংস্থা জলের দরে একজন, দুজন ধনী লোককে বেচে দিচ্ছে না তো?

এই সমস্ত বিষয়ে অবগত হওয়ার জন্যে একটা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমন হতেই পারে, আমার যে সিদ্ধান্তটা মনে হয় ঠিক তোমার মনে হল সেটা ঠিক নয়। কিন্তু আমার কেন মনে হয় ঠিক, আর তোমার কেন মনে হয় ঠিক নয় তা নিয়ে তর্ক হওয়া উচিত। তর্কে আমি ভুল প্রমাণিত হলে আমাকে তোমার সিদ্ধান্ত মানতে হবে, তুমি ভুল প্রমাণিত হলে তোমাকে আমার সিদ্ধান্ত মানতে হবে। এই প্রক্রিয়াতেই আমাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিতর্ক চলবে পৌরসভায়, পঞ্চায়েতে, বিধানসভায়, লোকসভায়, রাজ্যসভায়। তারপর সংখ্যাগরিষ্ঠ যাতে মত দেবে তাই হবে। একেই বলে গণতন্ত্র। কিন্তু আমাদের হাতে যদি তথ্যই না থাকে, তাহলে মত দেব কিসের ভিত্তিতে? দিলে কিছুদিন পরে বোঝা যাবে এমন মত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যা অধিকাংশ মানুষের মত হলেও আসলে তাদের পক্ষেই ক্ষতিকর হয়েছে। এমনটা ঘটেও, কারণ মানুষ মাত্রেই ভুল করে। একা করে বলেই অনেকে মিলেও ভুল করতে পারে। ভুল শোধরাতে হলেও আগে তো বুঝতে হবে ভুল করেছি। কী করে বুঝব, যদি আমার কাছে তথ্যই না থাকে?

এই ব্যাপারগুলো শুধু সরকারের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের বেলায় নয়, যে কোনোরকম ক্ষমতায় যে আছে তার সঙ্গে যে ক্ষমতায় নেই তার সম্পর্কের বেলাতেই সত্যি। সুতরাং এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, অরওয়েল কেন বলেছিলেন, সাংবাদিকতা হচ্ছে তাই, যা কেউ না কেউ প্রকাশিত হতে দিতে চায় না? কোনো ক্ষমতাশালী তো চাইবে না তার কুকীর্তির খবর প্রকাশ পাক। যে সৎ ক্ষমতাশালী সে-ও হয়ত চাইবে না তার ভুলচুক লোকে জেনে যাক, কারণ সে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। সুতরাং সাংবাদিকতা করা মানেই হল, সজাগ দৃষ্টিতে যে ক্ষমতাশালী – সে সরকার হতে পারে, ব্যবসায়ী হতে পারে, মাস্টার হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, উকিল হতে পারে – তার দোষত্রুটি খেয়াল করা এবং সকলের চোখের সামনে সত্য উদ্ঘাটিত করা। আমি যখন সাংবাদিকতার ছাত্র ছিলাম, আমাদের এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন “একশোটা শকুন মরলে একটা সাংবাদিক জন্মায়।” কথাটা কিন্তু নিন্দাসূচকভাবে বা ব্যঙ্গার্থে বলা নয়। বলার অর্থ হল, শকুনকে যেমন সারাক্ষণ ভাগাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, সাংবাদিকেরও কাজ হল সারাক্ষণ কোথায় কী অন্যায় হচ্ছে খুঁজে যাওয়া। আমাদের চারপাশ পরিষ্কার রাখার জন্যে শকুন কতটা প্রয়োজনীয় প্রাণী সে সম্পর্কে পুরনো দিনের লোকেদের ধারণা ছিল, আমাদের নেই। ফলে শকুন এখন একটা লুপ্তপ্রায় প্রাণী। সাংবাদিকও লুপ্তপ্রায় প্রাণী। কারণ যুগের হাওয়ায় সংবাদ হয়ে গেছে তেল, সাবান, শ্যাম্পু, এয়ার কন্ডিশনারের মত একটা পণ্য। ফলে সাংবাদিকরা চাকরি করেন যেসব সংবাদমাধ্যমে তারা আর সাংবাদিকদের দিয়ে শকুনের কাজটা করাতে চায় না, সেলসম্যান বা সেলসগার্লের কাজ করায়। কে না জানে, ব্যবসা করতে গেলে ক্ষমতাশালীর সঙ্গে বিবাদ করা চলে না? কিছু নাছোড়বান্দা সাংবাদিক এখনো আছেন, যাঁরা কিছুতেই বিক্রেতা হয়ে যেতে রাজি নন। তাঁরা কেউ ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে ইউটিউব চ্যানেল খুলছেন, ফেসবুক পেজ খুলছেন। আমরা কয়েকজন যেমন একটা ওয়েবসাইট খুলেছি। কিন্তু এইভাবে সাংবাদিকতা করার অসুবিধা হল বড় বড় সংবাদমাধ্যমের মত আমাদের বিরাট পুঁজি নেই, বিজ্ঞাপন নেওয়ার উপায় নেই। কারণ বিজ্ঞাপন নিলেই বিজ্ঞাপনদাতারা হয়ে যাবেন ক্ষমতাশালী, তখন আর তাঁরা আমাদের শকুনের কাজটা করতে দেবেন না।

এই কারণেই আজকাল বেশকিছু ক্রাউড-ফান্ডেড মিডিয়া তৈরি হয়েছে। মানে তুমি সেই সাইটে গিয়ে কোনো লেখা পড়লে বা ভিডিও দেখলে, দেখে তার জন্যে টাকা দিলে। সেই টাকাতেই যারা কাজ করছে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হবে, সাইটের কাজকর্ম চলবে। তোমরা নিশ্চয়ই জানো এরকম অনেক সংবাদমাধ্যমের কথা। আমি যে সাইটের সঙ্গে যুক্ত সেটাও এরকমই একটা সাইট। কিন্তু বাংলায় এভাবে কাজ চালানো দ্বিগুণ শক্ত। কারণ সারা ভারতের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের উপরেও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো চলছেই, সেইসঙ্গে বাংলা যে একটা ফালতু ভাষা, সেটা বাঙালিরা নিজেরা সবচেয়ে বেশি করে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এই যে আমি বক্তৃতা দিচ্ছি বাংলায়, আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সংস্কৃত বিভাগ। অথচ এই ফ্লেক্সটা লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। এমতাবস্থায় তোমাদের বাংলায় সাংবাদিকতা করতে বলি কী করে? আদৌ সাংবাদিক হতেই বা বলি কী করে, যা তোমাদের মাস্টারমশাইরা আমাকে বলতে বলছেন? বলার সমস্যা আছে।

পৃথিবীর কোন দেশে সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন তা নিয়ে প্রতি বছর একটা সমীক্ষা হয়। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ বলে এক আন্তর্জাতিক সংগঠন এই সমীক্ষা করে। ২০২২ সালের সর্বশেষ সমীক্ষায় ভারতের স্থান ছিল ১৮২টা দেশের মধ্যে ১৫০ নম্বরে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক – যাঁদের মধ্যে তোমাদের সবচেয়ে জানা নাম হয়ত গৌরী লঙ্কেশ – খুন হয়ে গেছেন। খুন হয়ে যাওয়া সাংবাদিকদের একটা লম্বা তালিকা দেওয়া সম্ভব। বক্তৃতা অতি দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে সে তালিকা দিচ্ছি না। শুধু এইটুকু তোমাদের বলে দিই, যে খুন হয়ে যাওয়াই একমাত্র সম্ভাব্য বিপদ নয়। তোমরা হয়ত সিদ্দিক কাপ্পান বলে একজনের নাম শুনেছ। তিনি কেরালার সাংবাদিক। উত্তরপ্রদেশে একটি দলিত মেয়ে ধর্ষিত হয়, খুন হয়, তারপর অভিযোগ ওঠে যে রাজ্যের পুলিসই নাকি দেহটা তার বাবা-মাকে অন্ধকারে রেখে রাতের অন্ধকারে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর লোক টিভির পর্দায় দেখে ফেলেছে ঘটনাটা। তারপর সে ঘটনা নিয়ে আরও গভীরে লিখবেন বলে কেরালা থেকে সিদ্দিক যাচ্ছিলেন হাথরাসে। তিনি পৌঁছবার আগেই, কোনো প্রতিবেদন লেখার আগেই, স্রেফ লিখতে পারেন বলেই পুলিস তাঁকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পুরে দেয়। তারপর দুবছরের বেশি সময় কারাবাস করে সিদ্দিক এই কিছুদিন আগে জামিন পেয়েছেন। জামিন, খালাস নয় কিন্তু। মানে মামলাটা এখনো চালু আছে। অথচ পুলিস তাঁর বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ করেছে তার পক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

এইরকম বিপদের মুখে আমাদের দেশের সাংবাদিকরা এখন সাংবাদিকতা করেন। তোমরা ঠিক আমার ছেলেমেয়ের বয়সী নও, কিন্তু আমার ভাইবোনের মত তো বটেই। তা আমি এগুলো জেনেশুনে কী করে তোমাদের বলি, যে সাংবাদিকতা করো? ভারত সরকার অবশ্য বলেছে যে ওই সমীক্ষাটা ভুল। মেথডোলজি ভুল, অনেক কম নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু আমি যদি কোনো মেয়ের বাবা না হতাম, তাহলে হয়ত কায়মনোবাক্যে সরকারের কথা বিশ্বাস করে নিয়ে তোমাদের বলতে পারতাম, ঠিক আছে। সরকার একটা কথা বলেছে আর একটা সংগঠন উল্টো কথা বলেছে। তোমরা নিজেরা ময়দানে নামো, নেমে পরখ করে দ্যাখো সত্যিটা কী। কিন্তু আমি বাপু তোমাদের সে ঝুঁকি নিতে বলতে পারছি না।

এ প্রসঙ্গে বলে দিই, ইতিহাস বলছে কোনো দেশ যখন সাংবাদিকদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তখন সাহিত্যিকরাও শান্তিতে থাকতে পারেন না। তোমরা তেলুগু ভাষার কবি ভারভারা রাওয়ের কথা হয়ত জানো। এই অশীতিপর কবিও দীর্ঘকাল কারান্তরালে কাটিয়েছেন ওইরকমই আরেকটা অভিযোগে, যা পুলিস আজ অব্দি প্রমাণ করতে পারেনি। আপাতত জামিনে বাইরে আছেন অসুস্থ বলে। পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে অভিজিৎ রায়ের মত ব্লগারদের হত্যার কথাও তোমরা নিশ্চয়ই জানো। ব্লগাররা ঠিক সাহিত্যিক না হলেও সাংবাদিকতা আর সাহিত্যের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বিচরণ করেন বলা যায়। আবার বিশ্ববিখ্যাত সলমন রুশদির উপর প্রাণঘাতী আক্রমণের কথাও নিশ্চয়ই জানো। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন, একটা চোখ প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদাহরণ অসংখ্য, যা থেকে বোঝা যায় সারা পৃথিবীর সাংবাদিক এবং সাহিত্যিকদের জন্যে এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়।

আরও পড়ুন সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের স্তম্ভ নয়, গণতন্ত্রই সংবাদমাধ্যমের স্তম্ভ

কী করে সাংবাদিক হতে হয় আসলে সেটাই আমি এতক্ষণ ধরে বলেছি, যদি তোমরা বুঝে থাকো। কিন্তু কী করে সাংবাদিকতার চাকরি পেতে হয় তা বলা আমার সাধ্যের বাইরে। কারণ সমস্ত সংবাদমাধ্যম ব্যাপকভাবে সাংবাদিক ছাঁটাই করেছে গত ৫-৬ বছরে। কোভিড-১৯ আসার আগে থেকেই বহু কাগজ, টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। অতিমারীর সময়ে ওটাকে অজুহাত করে আরও বেশি কর্মী সংকোচন করা হয়েছে, বহু বড় বড় কাগজ তাদের অনেক জায়গার সংস্করণ তুলে দিয়েছে, যেগুলো রেখেছে সেখানেও প্রচুর সাংবাদিক এবং অন্যান্য বিভাগের কর্মীদের চাকরি গেছে। যে সাংবাদিকদের চাকরি যায়নি, তাঁরা অরওয়েলের ভাষায় পাবলিক রিলেশন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আজকাল পাবলিক রিলেশন যেহেতু নিজেই একটা আলাদা পেশা, সেহেতু ও কাজটা করতে হলে সরাসরি তাতে যাওয়াই ভাল। কারণ তাতে সাংবাদিকদের চেয়ে বেশি মাইনে পাওয়া যায়। কোথায় শিখবে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় – তিনটে জায়গাতেই সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের পাঠক্রমের অঙ্গ হিসাবেই ওটা পড়ানো হয়। যারা আরেকটু দূরে যেতে পারবে, তারা ওড়িশার ঢেঙ্কানল বা দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস কমিউনিকেশনসে পড়তে পারো। এছাড়া আছে চেন্নাইয়ের এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজম। এগুলো অনেকদিনের প্রতিষ্ঠান। এছাড়া একগুচ্ছ নতুন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে যারা সাংবাদিকতা এবং পি আর পড়ায়। তাদের তত্ত্বতালাশ তোমরা গুগল করলেই পাবে।

যে কথাটা বলে শেষ করব সেটা হল সাহিত্য যেমন সাংবাদিকতার মত অপ্রিয় সত্য উদ্ঘাটন করে তেমন সাংবাদিকতাও দেখার গভীরতায় এবং ভাষার সৌন্দর্যে সাহিত্যে বা শিল্পে উত্তীর্ণ হতে পারে। যে কারণে শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলাম, অলঙ্করণ করলে কি সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতা থাকে না? উত্তর হল আলবাত থাকে। বস্তুত, সঠিক অলঙ্করণ ছাড়া সাংবাদিকতা যে বার্তা দিতে চাইছে তা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। পাঠকের কাছে আদৌ না পৌঁছতে পারে। সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমরা এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত নই, কারণ সাংবাদিক বলতেই আমরা রিপোর্টার বুঝি। কথাটার মানে আসলে সাংবাদিক নয়। রিপোর্টার মানে প্রতিবেদক, যিনি যা ঘটেছে তার প্রতিবেদনটা এনে দেন। সেটা অবশ্যই সাংবাদিকতা, কিন্তু ওই প্রতিবেদনকে যথাযথভাবে সাজিয়ে পাঠক বা দর্শকের সামনে হাজির করা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। সেই কাজ যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে অনেকরকম লোক আছেন। এক দলের নাম সম্পাদক। কোন খবরটা নেব, কোনটা নেব না তা সম্পাদকরা ঠিক করেন। কোন খবরটাকে কীভাবে নেব তাও সম্পাদকরা ঠিক করেন। কোন খবরটা কাগজের প্রথম পাতায় যাবে, কোনটা ভিতরে যাবে; কোনটা প্রথম পাতায় ছবিসহ বড় করে যাবে, কোনটা ছোট করে এক কলমে যাবে – এই সমস্ত সিদ্ধান্ত, যা বাদ দিয়ে সাংবাদিকতা হয় না, সেগুলো সম্পাদকরা নেন। উপরন্তু সংবাদের অলঙ্করণ মানে শুধু সম্পাদনাও নয়। চিত্রসাংবাদিক বা ফটোগ্রাফারদের আমরা সাংবাদিক ভাবতে অভ্যস্ত নই, কিন্তু তাঁদের কাজ আসলে সাংবাদিকতার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এমন সব ছবি তোলা সম্ভব যে ছবি নিজেই গোটা ঘটনাটা বলে দেবে, আলাদা করে প্রতিবেদন লেখার দরকারই হবে না। তার উপর কাগজ, টিভি, ওয়েবসাইট – সর্বত্রই আছেন গ্রাফিক ডিজাইনাররা। তাঁরা কোনো প্রতিবেদনের নির্যাস বা প্রতিবেদনের অতিরিক্ত কিছুও আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে পারেন। এতরকম অলঙ্করণ ঠিকঠাক হলে, তবে কাজটা সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে। মানে প্রকৃত অলঙ্করণ ছাড়া সাংবাদিকতা হয় না।

এছাড়াও সাংবাদিকতার মধ্যেই প্রতিবেদন বা রিপোর্টের চেয়েও গভীরে গিয়ে লেখা হয় এবং সাহিত্যে উত্তীর্ণ হতে পারে এরকম এক স্বতন্ত্র ধারা আছে। তার নাম রিপোর্টাজ। বাংলা ভাষায় যাঁরা ভাল রিপোর্টাজ লিখেছেন তাঁদের একজন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি আমাদের ভাষার একজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকও বটে। তাঁর একটা ছোট্ট রিপোর্টাজের নাম ‘মাটিতে এক ঋতু’। তার শেষদিকটা পড়ে এই বক্তৃতা শেষ করব। এখানে দীপেন্দ্রনাথ লখনৌয়ের উপকণ্ঠে একটা বস্তির কথা লিখছেন।

… পেছনে ভাঙা লোহার বেড়ার ওপর দিয়ে রেললাইন চলে গেছে কানপুরের দিকে। সামনেও কালো পিচের চওড়া রাস্তা। বাঁ দিকে পচা নালা, দক্ষিণে মজা নর্দমা। ধার ঘেঁষে মানুষ তার প্রতিদিনের কাজটুকু সেরে রেখেছে। জমাট দুর্গন্ধ। আর এরই মধ্যে ওদের সেই এক টুকরো পৃথিবী। যার ওপর দিয়ে অন্তত খ্রিস্ট জন্মের পরও এক হাজার ন’শো চুয়ান্নটি বসন্ত চলে গেছে।

মাথা হেঁট করে ফিরে আসছিলাম। কিন্তু, হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল।

অবাক বিস্ময়ে দেখলাম একটা খুপরির দোরগোড়ায় আধহাতটাক জমি কুপিয়ে কে যেন দুটো ঝাউ আর কী একটা বুনো ফুলগাছের ডাল সযত্নে পুঁতে দিয়েছে। এত ছোট যে চোখে পড়ে কি পড়ে না। জমিটার চারপাশ সুন্দর করে নিকোনো। এত তুচ্ছ যে সহজেই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।

জিজ্ঞেস করলাম : কে পুঁতেছে রে?

আধডজন ছেলে কাছেই খেলা ছেড়ে অবাক হয়ে আমাদের দেখছিল। ছুটে গিয়ে সামনের অন্ধকার কুঠরিটা থেকে কানহাইয়ালালকে ধরে আনল। নাম জানতে চাইলাম। রুগ্ন বাছুরের মতো নির্বোধ আর অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে সে উত্তর দিল।

বললাম : এই ডাল তুমি পুঁতেছ এখানে?

অপরাধীর ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ল সে।

জিজ্ঞেস করলাম : কেন?

মিষ্টি সুরে দেহাতি ঢঙে সে উত্তর দিল : কাহে, গাছ হোবে।

গাছ হলে কী হবে?

আবার সে বিমূঢ় দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ফিক করে হেসে ফেলল হঠাৎ। হলদে রঙের ছোট্ট দাঁতগুলো বার করে কেমন এক সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল : কাহে, ফুল হোবে।

বললাম : ফুল হোনেসে কেয়া হোগা কানহাইয়ালাল?

কিছু না ভেবেই ঝটপট উত্তর দিল সে : কাহে, সুন্দর হোবে।

আর প্রশ্ন করতে পারলাম না। দেখলাম ওখানকার শ্রমিকনেতা, আমাদের সঙ্গী সরফজি এক দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁরও চোখে শিল্পীর দৃষ্টি। তাঁর ঠোঁটেও কী এক সার্থকতার হাসি।

তারপর কলকাতায় ফিরে এসেছি।

এখানে দৈনিক স্টেটসম্যান পড়ি, সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এর পাতা ওলটাই। অ্যালবার্ট হলে বসে বিবর্ণ কফির স্বাদে মশগুল থেকে বন্ধু আর পরিচিতের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে তর্ক করি। আবার, ইতিহাসের নতুন মূল্যবোধকে যাচাই করার জন্য ডাক এলে ছুটে যাই ময়দানের সভায়। জীবন এখানে দ্রুত, বৈচিত্র্য আর পরস্পর-বিরোধিতার আবর্তে প্রাণ এখানে অবিরাম দোলায় দুলছে।

কিন্তু এরই মধ্যে থেকে থেকে মনে পড়ে যায় সেই দিনটা। মন্ত্রের মতো কতকগুলো কথা আর স্বপ্নের মতো গোটা দুই মুখ।

আর মনে হয়, আবার ফাল্গুন আসছে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

অপমানে হতে হবে মহম্মদ শামির সমান

যথার্থ স্ট্রিট ফাইট করার সময়ে কোহলি কোথায় গেলেন, সে প্রশ্ন ধর্মনিরপেক্ষরা করবেন না? শামির হয়ে নিদেনপক্ষে একখানা টুইটও তো করতে পারতেন প্রাক্তন অধিনায়ক।

এমনকি অ্যাডলফ হিটলারের জন্যেও করুণা হয়। সে যাবতীয় কুকীর্তিকে ক্রীড়াধৌত করার জন্য পেয়েছিল মাত্র একটা অলিম্পিক, নরেন্দ্র মোদী পেয়েছেন আস্ত একটা ক্রিকেট বোর্ড। নিজের নামাঙ্কিত ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাশে অন্য এক রাষ্ট্রনেতাকে নিয়ে গেরুয়া রঙের গ্যালারির দিকে হাত নাড়তে নাড়তে গোটা মাঠ ঘুরছেন সর্বাধিনায়ক। এ দৃশ্য অমর করে রাখার জন্যে কোনো লেনি রিফেনশ্টল নেই – এই যা। কত বড় ইতিহাস তৈরি হল তা বোঝার মেধা বিবেক অগ্নিহোত্রীদের নেই, থাকলে ক্যামেরা নিয়ে ঠিক পৌঁছে যেতেন আমেদাবাদে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্টের প্রথম দিনে।

অবশ্য এ কথাও ঠিক, আজকাল দৃশ্যের জন্ম দিতে জিনিয়াসের দরকার হয় না। অসংখ্য ক্যামেরা সারাক্ষণ হাতে হাতে ঘুরছে আর কোটি কোটি দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। তাছাড়া স্টার স্পোর্টসের ক্যামেরা তো ছিলই। তার উপর ছিলেন অমিত শাহের সুপুত্রের অধীন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ধারাভাষ্যকাররা, যাঁদের চাটুকারিতার একমাত্র তুলনীয় উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার বাবুর মোসাহেবরা – “রাজা যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।” মুশকিল হল মোসাহেবি একটি প্রতিযোগিতামূলক পেশা, আলাপ আলোচনা করে এ কাজ করা যায় না। ফলে ধারাভাষ্যকাররা দর্শকসংখ্যা এদিক-ওদিক করে ফেলেছেন। বর্ষীয়ান সাংবাদিক শারদা উগ্রা লিখেছেন, খেলা শুরু হওয়ার আগেই সাতসকালে ম্যাথু হেডেন, সঞ্জয় মঞ্জরেকর আর স্টার স্পোর্টসের উপস্থাপক সুরেশ সুন্দরম বলে দিয়েছিলেন, মাঠে তিলধারণের জায়গা থাকবে না। কারণ শুধু ক্রিকেট নয়, লোকে আসবে তাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে। এক লক্ষ লোক নাকি এসে পড়বে। খেলা শুরুর মিনিট পঞ্চাশেক আগেই নাকি মাঠ প্রায় ভরে গিয়েছে। অথচ পরে রবি শাস্ত্রী, যাঁর পরম শত্রুও তাঁকে পৃথিবীর কোনো বিষয়ে কমিয়ে বলার অপবাদ দেবে না, ধারাভাষ্য দিতে দিতে প্রবল উৎসাহে বলেন ৫০ হাজারের বেশি লোক হয়েছে। কে জানে, হয়ত অর্ধেক লোক আসলে ক্রিকেট নয়, মোদীকে দেখতেই এসেছিল! পরে তিনি চলে যাওয়ায় তারাও চলে গেছে। উসমান খাজার শতরান দেখতে কি আর দেশপ্রেমিক দর্শকরা বসে থাকতে পারেন? পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তাঁকে তো ভিসাই দেওয়া হয়েছে বাকি অস্ট্রেলিয়দের একদিন পরে

আসলে ক্রিকেট যে উপলক্ষ, মোদীর মহানতা প্রমাণই লক্ষ্য – তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। নইলে দেশের এত ক্রিকেটপাগল এবং ঐতিহ্যময় শহর থাকতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম আমেদাবাদেই বানানো হবে কেন? পতৌদি ট্রফি (ভারত-ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে জয়ী দলকে প্রদেয়) আর বর্ডার-গাভস্কর ট্রফি (ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে জয়ী দলকে প্রদেয়) – এই দুটো আজকের ক্রিকেটে সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজের মধ্যে পড়ে এবং কারো কারো দাবি অনুযায়ী খেলার উৎকর্ষে অ্যাশেজের চেয়েও এগিয়ে। সেক্ষেত্রে পরপর দুবার ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামই বা খেলা পায় কেন? ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে তো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টানা দুটো টেস্ট খেলা হয়েছিল ওই স্টেডিয়ামে। তখন অবশ্য যুক্তি হিসাবে কোভিড অতিমারী ছিল, এ বারে যুক্তি কী?

দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা প্রাণপণ চেষ্টাতেও চেপে রাখা যাচ্ছে না, যেখানেই ভোট হচ্ছে বিজেপির ভোট কমে যাচ্ছে, বিরোধী ভোট কাটাকাটিতে মানরক্ষা হচ্ছে। ওদিকে ব্রিটিশ চ্যানেল তথ্যচিত্র বানিয়ে বিশ্বগুরু বেলুনে পিন ফুটিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় মোদী অস্ট্রেলিয় প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করবেন, তার জন্য একটা মোচ্ছব করা দরকার, সেই দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ছবির মোচ্ছবটার মত। তাই বুঝি আমেদাবাদে এই আয়োজন। ওই শহরের গুজরাটি ভাষার কাগজ দিব্য ভাস্কর তো লিখেছে প্রথম দিনের খেলার ৮০,০০০ টিকিট নাকি বিজেপি দলই কিনে নিয়েছে। দ্য ওয়্যারের সাংবাদিকের কাছে কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক স্বীকারও করেছেন যে দল থেকে তাঁদের প্রথম দিনের খেলার বিপুল পরিমাণ টিকিট কিনতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ তো টি টোয়েন্টি নয়, খেলাটা যে পাঁচ দিনের। পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম যে শহরে, সেখানকার মানুষের ক্রিকেটপ্রেম এত প্রবল যে কাল চতুর্থ দিন দুপুরে বিরাট কোহলি যখন কোভিডোত্তর দুনিয়ায় প্রথম টেস্ট শতরান করলেন তখনো টিভির পর্দায় দেখা গেল মাঠের অর্ধেক ভরেনি। তিনি প্রায় দ্বিশতরান করে ফেললেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। অথচ কাল ছিল রবিবার। এদিকে ২০০১ সালের সেই বিখ্যাত টেস্টের পর গত ২২ বছরে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার একটাও টেস্ট ম্যাচ হয়নি কলকাতায় ক্রিকেটের নন্দনকাননে।

অবশ্য কবি বলেছেন “ঘটে যা তা সব সত্য নয়”। আমেদাবাদে কেন তেমন দর্শক হয়নি, এ প্রশ্ন চারিদিক থেকে উঠতে শুরু করলেই হয়ত ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড রীতিমত পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেবে, মাঠ একেবারে উপচে পড়ছিল। ঠিক যেমনটা কদিন আগে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ সম্পর্কে লিগ কর্তৃপক্ষ বলেছে। ইদানীং ভারতে সমস্ত গোনাগুনিই হযবরল নিয়মে চলে। ইচ্ছামত বাড়ানো, কমানো যায়। একেবারেই এদিক-ওদিক করা না গেলেও বলে দিলেই চলবে “দর্শক কম হয়নি, স্টেডিয়াম বড় হয়ে গেছে।” নির্মলা সীতারামণ তো পথ দেখিয়েই রেখেছেন। ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই বোধহয় ঠিক কত দর্শক ধরে এই স্টেডিয়ামে তা নিয়ে দুরকম বয়ান সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন নিজেই স্টেডিয়ামের এক জায়গায় লিখে রেখেছে “১৩০,০০০”, আরেক জায়গায় “১১০,০০০”। এ যেন সেই ২০০২ নিয়ে কথা উঠলেই এক দলের “সব বাজে কথা, সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনচিট দিয়েছে” আর আরেক দলের “যা হয়েছিল বেশ হয়েছিল” বলার মত। হাজার হোক, জায়গাটা আমেদাবাদ, রাজ্যটা গুজরাট।

গুজরাট মডেলের চেয়ে ভাল মডেল ভূভারতে নেই। ওখানে ভারতের সবচেয়ে সিনিয়র বোলারকেও গ্যালারি থেকে ক্রিকেটপ্রেমীরা বুঝিয়ে দেন, বাপু, তুমি মুসলমান হও আর যা-ই হও, এখানে এলে “জয় শ্রীরাম” শুনতে হবে। ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক সিএলআর জেমস বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি নামে একটা বই লিখেছিলেন, আর সেখানে লিখেছিলেন, সে কী জানে যে শুধু ক্রিকেট জানে? ক্রিকেট যে সত্যিই সীমানার ওপারেও খেলা হয়, তার এমন চমৎকার উদাহরণ রোজ পাওয়া যায় না। স্রেফ কয়েকটা বাজে লোক এই কাণ্ড করেছে বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। ভারতীয় ক্রিকেট দলের গৈরিকীকরণ বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। তারই প্রতিফলন আমেদাবাদ টেস্টের প্রথম দিনের এই ঘটনা। যারা কাণ্ডটা ঘটিয়েছে তারা কেমন লোক তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু ওই ভিডিওতে মহম্মদ শামির সতীর্থদের আচরণ লক্ষ করার মত।

SHAMI KO JAI SHREE RAM 🚩 PIC.TWITTER.COM/RWVG1YMEAZ— Gems of Shorts (@Warlock_Shabby) March 9, 2023

প্রথমে সূর্যকুমার যাদবকে দেখে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীসুলভ উল্লাসে তাঁর নাম ধরে ডাকা হয়, তিনি সাড়া দিয়ে ডান হাত তোলেন। তারপর দুহাত জোড় করে দর্শকদের নমস্কার জানান। এরপর তাঁর পাশে মহম্মদ সিরাজকে দেখা যেতেই শুরু হয় “জয় শ্রীরাম” ধ্বনি। তারপর শামিকে দেখে উৎসাহ চরমে ওঠে। তাঁর নাম ধরে ডেকে ওই স্লোগান দেওয়া হয়, যাতে তিনি বোঝেন তাঁকেই শোনানো হচ্ছে। সেইসময় ওখানে উপস্থিত গুজরাটেরই বাসিন্দা এবং দলের অত্যন্ত সিনিয়র সদস্য চেতেশ্বর পূজারা, সৌরাষ্ট্র রঞ্জি দলের অধিনায়ক জয়দেব উনড়কত, আরেক সিনিয়র জোরে বোলার উমেশ যাদব এবং ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর। সকলেরই হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা শুনতেই পাননি। একই দূরত্ব থেকে দুজনের নাম ধরে ডাকা হল, একজন শুনতে পেয়ে সাড়া দিলেন আর বাকিরা শুনতেই পাননি এমন তো হতে পারে না। তাহলে বুঝতে হবে হয় তাঁদের অবস্থা তপন সিংহের আতঙ্ক ছবির মাস্টারমশাইয়ের মত, নয় তো শামির প্রতি ধর্মীয় টিটকিরি তাঁরা দিব্যি উপভোগ করছিলেন। এই দল যদি চলতি সিরিজ জেতে, এমনকি যদি আসন্ন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে খেতাবও জেতে। তা কি ভারতের জয়?

সাংবাদিক মানস চক্রবর্তী বহুকাল আগে ব্রায়ান লারাকে নিয়ে একখানা কিশোরপাঠ্য বই লিখেছিলেন। সেখানে আছে, মানস লারার কথা প্রথম শোনেন অরুণলালের মুখে এবং সেটা লারার ব্যাটিং প্রতিভার কথা নয়। ১৯৮৯ সালে ভারত যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায়, অরুণ অন্যতম ব্যাটার হিসাবে সেই দলে ছিলেন। অরুণ বলেছিলেন, একটা টেস্টে দ্বাদশ ব্যক্তি ছিল ব্রায়ান লারা বলে একটা বাচ্চা ছেলে। প্রথম দিনের খেলার পর খবর এল ওর বাবা মারা গেছেন। অধিনায়ক ভিভিয়ান রিচার্ডস সমেত গোটা দল ওর বাড়ি চলে গেল। কথাটা বলে অরুণের মন্তব্য ছিল, বোঝা যায় কেন ওরা বছরের পর বছর টেস্ট হারে না। ২০০২ সালের ৫ ডিসেম্বরের ঘটনাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। সেদিন তৎকালীন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভ ওয়র সিডনির বাড়ির দিকে ধেয়ে এসেছিল এক দাবানল। স্টিভ তখন মেলবোর্নে, স্ত্রী লিনেট তিন সন্তান আর বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে বাড়িতে। লিনেটের ফোন পেয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা পৌঁছে যান এবং আপ্রাণ লড়ে বাড়িটাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচান। স্টিভ খবর পেয়ে বিমানে চেপে শেষপর্যন্ত বাড়ি পৌঁছন রাত এগারোটায়। ততক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণে। স্টিভ গিয়ে জানতে পারেন ম্যাকগ্রা ছ-সাত ঘন্টা ধরে আগুনের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন।

সহখেলোয়াড় মাঠের বাইরেও প্রাণাধিক প্রিয় – এই মূল্যবোধই খেলার মাঠের চিরকালীন শিক্ষা। সেই শিক্ষার পরিচয় কোথায় শামির সহখেলোয়াড়দের ব্যবহারে? ভারতে অবশ্য এখন অমৃত কাল। চিরকালীন সবকিছুই এখন বাতিল। কেউ কেউ বলবেন, কী করা উচিত ছিল পূজারাদের? শামির হয়ে লোকগুলোকে পাল্টা গালাগালি দিত, না হাতাহাতি করতে যেত? যে কোনো সভ্য দেশে এই প্রশ্নটাই অবান্তর। ভারতের গত অস্ট্রেলিয়া সফরে সিরাজকে বর্ণবিদ্বেষী গালাগালি দেওয়ার অভিযোগ উঠতেই কয়েকজন দর্শককে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। যা অন্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড করতে পারে, তা যে এ দেশের বোর্ড করবে না — এমনটা তাহলে সূর্য, পূজারা, উনড়কত, উমেশ, বিক্রমরা জানেন? তাই তাঁরা প্রতিবাদ করেননি, বোর্ডের কাছে কোনো অভিযোগও জানাননি? এই ভিডিও যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, বেশকিছু সংবাদমাধ্যম যেভাবে খবর প্রকাশ করেছে, তাতে অধিনায়ক রোহিত শর্মা বা কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের চোখে পড়েনি — এমনটা হওয়া অসম্ভব। তাঁরাই বা চুপ কেন? এর নাম নেতৃত্ব, নাকি হিন্দুত্ব?

ভারতীয় দলে আবার ভয়ানক লড়াকু কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন। তাঁদের সারা দেশের ক্রিকেট সাংবাদিকরা ‘স্ট্রিট ফাইটার’ বলে বিস্তর প্রশংসা করে থাকেন। এঁরা বিপক্ষ দলের ১১ নম্বর ব্যাটারকে বাউন্সারের পর বাউন্সার দিয়ে, স্লেজ করে বাহাদুরি দেখান। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বড় মুখ করে বলেন, আমাদের একজনকে আক্রমণ করলে আমরা ১১ জন মিলে প্রতিআক্রমণ করব।

এঁদের মধ্যে সবচেয়ে ওজনদার অবশ্যই ২৪ টেস্টে ৪২ খানা ইনিংস খেলার পরে ২৭ নম্বর থেকে ২৮ নম্বর শতরানে পৌঁছনো বিরাট। তিনি ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির সময়ে শামির ধর্ম তুলে যারা টুইট করেছিল তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীদের হৃদয়সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন। অধিনায়কত্ব যখন চলে গেল, তখন আপন মনের মাধুরী মিশায়ে ধর্মনিরপেক্ষরা গর্জন করেছিলেন, শামির পক্ষ নেওয়ার অপরাধেই নাকি বেচারা বিরাটকে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ক্রিকেট বোর্ড বরখাস্ত করেছে। এবার যথার্থ স্ট্রিট ফাইট করার সময়ে কোহলি কোথায় গেলেন, সে প্রশ্ন ধর্মনিরপেক্ষরা করবেন না? শামির হয়ে নিদেনপক্ষে একখানা টুইটও তো করতে পারতেন প্রাক্তন অধিনায়ক। তিনি যে এখনো ভারতীয় ক্রিকেটের এক নম্বর তারকা তাতে তো সন্দেহ নেই। তাঁকে তো যথেষ্ট মান্যিগণ্যি করেন ক্রিকেটভক্তরা, আর তাঁর ভক্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। টুইটারে বিরাটের সমালোচনা করলেই যেভাবে ট্রোলবাহিনী ধেয়ে আসে তাতেই তা টের পাওয়া যায়। এহেন বিরাটের জাভেদ মিয়াঁদাদসুলভ আগ্রাসন আমেদাবাদে শামির অপমান দেখেও মিইয়ে রইল? তাহলে বুঝতে হবে, বিরাট এবং তাঁর মত ডানপিটেদের যত হম্বিতম্বি সব ক্রিকেট বোর্ডের ছত্রছায়ায়, ক্রিকেট মাঠের ভিতরে। সিনেমার অ্যাকশন হিরোদের যেমন যত বীরত্ব সিনেমার সেটে, স্টান্টম্যানদের উপস্থিতিতে।

আরও পড়ুন সকলেই চুপ করে থাকবে, শামিকে মানিয়ে নিতে হবে

এমন নয় যে হিন্দুগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমান ক্রিকেটাররা ব্যর্থ হলে অতীতে কখনো কেউ তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে পাঁচটা কথা বলেনি। মহম্মদ আজহারউদ্দিন তো তেমন লোকেদের পোয়া বারো করে দিয়ে গেছেন ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে। কিন্তু সেসব মন্তব্য চলতে ঠারেঠোরে এবং ক্রিকেটারের কানে পৌঁছতে না দিয়ে। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগে টিটকিরি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। ফলে শুধু মুসলমান শামি কেন, শিখ অর্শদীপ সিংকেও পাকিস্তান ম্যাচে ক্যাচ ফেলার জন্য অনলাইন গালাগালি হজম করতে হয়েছে। কিন্তু আমেদাবাদে যা হল তা অভূতপূর্ব। শামির হাত থেকে ক্যাচ পড়েনি, তিনি অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের হাতে বেদম মারও খাননি। ম্যাচটাও পাকিস্তান ম্যাচ নয়। স্রেফ উত্যক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁকে সরাসরি আক্রমণ করেছে কিছু তথাকথিত ক্রিকেটপ্রেমী। অথচ গোটা দল চুপ, বোর্ডও চুপ। এ থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না দলটা আসলে কাদের। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? এই দলেই তো খেলছেন রবীন্দ্র জাদেজা, যিনি গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রচারে জাতীয় দলের জার্সিকে ব্যবহার করেছেন। বোর্ড কোনো আপত্তি করেনি। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট দল এখন দেশের নয়, সরকারের দল। তাদের প্রধান কর্তব্য মোদীর যাবতীয় কীর্তিকে ক্রীড়াধৌত করা। তাই তাদের সমস্ত আচরণই এখন হিন্দুত্বানুসারী।

রবীন্দ্রনাথের কল্পনার ‘ভারততীর্থ’ কোথাও না থাকলেও, অন্তত আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল সেদিকে যাত্রা করছিল। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, যে যাত্রা থেমে গেছে। অবশ্য ওই কবিতার ভাবনায় বেশকিছু আপত্তিকর দিক আছে বলে লিখেছিলেন অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য। তা সবিস্তারে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না। প্রাসঙ্গিক অংশটা হল

রবীন্দ্রনাথও ভক্তি-গদগদ হতেন। তাতে স্বদেশচেতনার উদ্দীপন ঘটত, সেটা আমাদের লাভ। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথ বেশিক্ষণ ওরকম ভক্তিগদগদ অভিভূত হয়ে থাকতে পারতেন না। গদগদচিত্তকে তিনিই আবার আঘাত করতেন…

‘ভারততীর্থ’ লেখার পর একটিমাত্র দিন গেল। তার পরেই রবীন্দ্রনাথ যা লিখলেন তা হল স্বদেশের প্রতি নিদারুণ ধিক্কার, অভিশাপ – “হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান/…বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে/ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।”

ভারততীর্থের পথে নয়, ভারতীয় ক্রিকেট এবং দেশটা এ পথেই চলেছে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

শাহীনবাগ: কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে…

ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। দুটিই একই গোত্রের বাক্য – এমন ধারণা নিয়েই আমরা বুড়োধাড়ি হয়ে উঠেছিলাম। আমরা, মানে যাদের জন্ম স্বাধীনতার অনেক পরে। সূর্যের পূর্ব দিকে ওঠা নিয়ে যেমন আলোচনা করার কিছু নেই, তেমন ধর্মনিরপেক্ষতাও কোনো আলোচ্য বিষয় নয় – এমনটাই আমরা শিখেছিলাম। ধর্মনিরপেক্ষতা যে চর্চা করার জিনিস, তা ভাবিনি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ হওয়ার পরেও সমাজ, রাষ্ট্র বা বিদ্যায়তন এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেনি। অমুক অমুক রাজ্যে দাঙ্গা হয়, আমাদের রাজ্যে হয় না – এই তথ্যটুকুতেই আমাদের প্রয়োজন মিটে গিয়েছিল। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায় যারা, তারা যে একদিনের জন্যও নিজেদের মতাদর্শের চর্চা বন্ধ করেনি বাবরি ধ্বংস তার প্রথম প্রমাণ। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেই ভারতের নাগরিকত্ব আইন বদলে ফেলা সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার অভাবকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মত করে ভরা বাজারে উলঙ্গ করে দিতে পারেনি আর কিছুই। ২০১৯ সালে যখন ওই আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হল, তখন প্রথমবার ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা, তার ভালমন্দ নিয়ে খোলাখুলি বিতর্ক শুরু হল। সরকারের উদ্দেশ্য তা ছিল না। কিন্তু এত বড় দেশের সব মানুষকে নিজের মর্জি মত চালাতে মহম্মদ বিন তুঘলক বা ঔরঙ্গজেবই পারেননি, মোদী কোন ছার। দিল্লির শাহীনবাগে পথে বসে পড়লেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, দেশের আরও নানা জায়গায় তৈরি হল অনুরূপ শাহীনবাগ। সে আন্দোলনের দুটি সবচেয়ে ইতিবাচক দিক – মহিলা, বিশেষ করে রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের মহিলারা আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতে তুলে নিলেন; আর তরুণ-তরুণীরা পথে নেমে এল। আমরা যারা জরুরি অবস্থা দেখিনি, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিনি, তারা তো অল্পবয়সীদের রাজনৈতিক উদাসীনতাতেই অভ্যস্ত। নিজেরাও উদাসীন ছিলাম।

কোভিড-১৯ এসে না পড়লে দেশের অযুত শাহীনবাগ থেকে কী প্রাপ্তি হতে পারত সে আলোচনায় আজ আর লাভ নেই। কিন্তু মানতেই হবে, নাগরিকত্ব আইনবিরোধী আন্দোলনে আর কিছু না হোক, সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সংখ্যার জোরে আইন পাস করিয়েও আজ পর্যন্ত নাগরিকত্ব দেওয়ার নিয়মকানুন ধার্য করে দেশব্যাপী কাজটা শুরু করতে পারেনি। এনপিআর-এনআরসির জুজু এখনো দেখানো চলছে, কিন্তু আসামের বিভীষিকাময় কর্মসূচির জাতীয়করণ আজও সম্ভব হয়নি।

আরো পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়

নিঃসন্দেহে অপ্রাপ্তি অনেক। শাহীনবাগ ও তদ্রূপ আন্দোলনগুলোর পাশে মৌখিকভাবে দাঁড়ালেও বিজেপি বাদে দেশের অন্য দলগুলো সক্রিয় অবস্থান নিতে পারেনি। ফলে আন্দোলন অলিগলিতে ছড়াল না। ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা না থাকার ফলস্বরূপ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ ভাবলেন, ওটা মুসলমানদের আন্দোলন। নাগরিকত্ব গেলে ওদের যাবে, আমাদের কী? ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল তা হাত গলে ম্যানহোলে তলিয়ে গেল।

তবে থেকে যাবে কিছু দৃশ্য, যাদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মিছিলে পাশাপাশি আম্বেদকর আর গান্ধীর ছবি হাতে হাঁটছে যুবক-যুবতী। ‘কলকাতার শাহীনবাগ’ পার্ক সার্কাসে ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে, সমবেত জনতা গাইছে ‘জনগণমন’। তাছাড়া শাহীনবাগের নামে মিথ্যে দোষারোপ করে লাগিয়ে দেওয়া দিল্লি দাঙ্গায় নিষ্ক্রিয়তা থেকে, এমনকি নিজের দলের মুসলমান নেতাকেও বিসর্জন দেওয়া থেকে চেনা গেল আসল অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। আমীর আজীজের ভাষায় ‘সব ইয়াদ রখখা যায়েগা’

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

জাতীয় সঙ্গীত এবং নেশন: ইরান যা ভাবায়

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ।

জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার কী কী ফল হতে পারে? ইসলামিক আইনে চালিত, এই মুহূর্তে গনগনে বিদ্রোহের আগুনে ঝলসাতে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে কী হতে পারে জানি না, তবে সাংবিধানিকভাবে এখনো ধর্মনিরপেক্ষ এবং তথাকথিত আধুনিক আইনকানুন মেনে চলা দেশ ভারতে কী হতে পারে তার বেশকিছু দৃষ্টান্ত আছে।

২০১৮ সালের দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন নিজেদের দেশের সবচেয়ে সংস্কৃতিবান এবং প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী বলে দাবি করা কলকাতার বাসিন্দারা স্টার থিয়েটারে ন জন দর্শকের দিকে তেড়ে যান সিনেমা শুরু হওয়ার আগে ‘জনগণমন’ চলার সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে গান না করার অপরাধে। অথচ সে বছরের জানুয়ারিতেই সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টেরই জারি করা সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক করার আদেশ বাতিল করে দিয়ে বলেছিল, “The interim order passed on November 30, 2016 is modified that playing of national anthem prior to screening of a film is not mandatory or directory”। কিন্তু দেশের অবস্থা তখনই এমন, যে ওই আদেশ পুরোপুরি বাতিল করার সাহস সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরও হয়নি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় সে সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বটে “should we wear our patriotism on our sleeves”? কিন্তু আদালত এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্কোয়্যার পাস দিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে।

সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর ৯ জানুয়ারি দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া কলকাতার বিভিন্ন সিনেমা হলের মালিকদের মতামত প্রকাশ করেছিল এক প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাতিরাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যে মনোভাবই থেকে থাকুক, কলকাতার হলমালিকরা ব্যবসার মত জাতীয়তাবাদের প্রতিযোগিতাতেও হারতে রাজি নন।

প্রিয়া সিনেমার মালিক অরিজিৎ দত্ত বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে আমার এখানে কোনো তফাত হবে না। আমি জাতীয় সঙ্গীতের বদলে বন্দে মাতরম বাজাব। আশা করব দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন। তবে আমি কাউকে জোর করব না।” মিনার, বিজলী, ছবিঘরের মালিক সুরঞ্জন পাল বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের নতুন অর্ডার জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক নয় বললেও আমি বাজাতেই থাকব। আমি এ-ও আশা করব যে গান চলার সময়ে দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন।” নবীনার মালিক নবীন চৌখানি আবার একটা নতুন কথা বলেছিলেন। “আগের অর্ডারটা বৈষম্যমূলক ছিল। কেবল সিনেমা হলগুলোকে জাতীয় স্তোত্র বাজানোর জন্যে বেছে নেওয়া হল কেন? রেস্তোরাঁ, খেলার মাঠ – এসব জায়গায় তো বাজাতে বলা হয়নি।”

অর্থাৎ দিনের যে কোনো সময়ে যে কোনো উদ্দেশ্যে আপনি যেখানেই যান না কেন, রাষ্ট্রের ইচ্ছা হলেই আপনাকে সাবধান পজিশনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় স্তোত্র বাজিয়ে দেওয়া হবে আর আপনাকেও সুবোধ বালক/বালিকা হয়ে গাইতে হবে। এই ব্যবস্থায় বিশেষ কারোর আপত্তি নেই। শুধু তাই নয়, কেউ ভিন্নমত হলে তাকেও মেরে ধরে দাঁড় করিয়ে গাওয়ানোর উদ্যোগ নেবে লোকে।

চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতেও সেসময় সিনেমা হলে এ নিয়ে বিস্তর গোলমাল, হাতাহাতি হয়েছিল, গৌহাটিতে হুইলচেয়ারে বসা এক শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকেও জাতীয়তাবাদী দর্শকরা উঠে না দাঁড়ানোর জন্য গালাগালি করেছিলেন। উল্লেখ্য, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার অবমাননা আইনত অপরাধ বলে গণ্য হলেও আইনে কোথাও বলা নেই উঠে না দাঁড়ানো মানে অবমাননা করা। যা-ই হোক, আজও রমরমিয়ে সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বেজে চলেছে, অধিকাংশ নাগরিক উঠে দাঁড়িয়ে গান গেয়েও থাকেন। ইদানীং অবশ্য যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের দিকে তেড়ে যাওয়ার ঘটনা তত শোনা যায় না। অনেকে ওসব ঝামেলা এড়াতে গান বেজে যাওয়ার পরে হলে ঢোকেন। তার মানে ঝামেলা যে হতে পারে সে আতঙ্ক সফলভাবে সকলের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে। সিনেমা হলে জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন কর্তব্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। সে কর্তব্য পালন না করলে গারদে পুরে দেওয়ার আইন এখনো পাস হয়নি বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কদিন আগে বলে দিয়েছেন, শুধু বন্দুকধারী নয়, কলমধারী নকশালদেরও সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। তেমন কিছুদিন পরে বলতেই পারেন, শুধু রাজনীতি করা অ্যান্টি-ন্যাশনাল নয়, জাতীয় স্তোত্র না গাওয়া অ্যান্টি-ন্যাশনালদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। কে না জানে, প্রধানমন্ত্রী যে সে লোক নন? তিনি বিষ্ণুর একাদশ অবতার। অতএব তাঁর কথাই আইন। তিনি বললেই জাতীয় স্তোত্র গাইতে যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের হাজতবাস করানোর জন্য সিনেমা হলে কাতারে কাতারে পুলিস মোতায়েন হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

তবু না মেনে উপায় নেই, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আয়াতোল্লা খোমেইনি হয়ে উঠতে বাকি আছে। অনুসিদ্ধান্ত – ভারতের ইরান হয়ে উঠতে বাকি আছে। তাই ভাবছিলাম, ভারতেই যদি সাধারণ নাগরিক সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র না গাইলে এত কাণ্ড হতে পারে, তাহলে কাতারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে ইরানের যে ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, তাঁদের কী অবস্থা হবে। ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনে ইরান অধিনায়ক এহসান হজসফি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন কেন তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত গাননি। জানিয়েছেন দেশে যা চলছে তা যে ভাল হচ্ছে না তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর দল দেশের মানুষের পাশেই আছে। তাদের জন্যেই ভাল খেলার চেষ্টা, গোল করার চেষ্টা।

⚡️ BREAKING: #IRAN FOOTBALL TEAM CAPTAIN DEFIES REGIME, BACKS PROTESTS: “WE HAVE TO ACCEPT THAT CONDITIONS IN OUR COUNTRY ARE NOT RIGHT & OUR PEOPLE ARE NOT HAPPY. THEY SHOULD KNOW THAT WE ARE WITH THEM. AND WE SUPPORT THEM. AND WE SYMPATHIZE WITH THEM REGARDING THE CONDITIONS.” PIC.TWITTER.COM/SX4KENXITZ— Hillel Neuer (@HillelNeuer) November 21, 2022

কী চলছে তাঁর দেশে? কারোর জানতে বাকি নেই। ১৬ সেপ্টেম্বর মাহসা আমীনী রাষ্ট্রের হাতে খুন হওয়ার পর থেকে ইরানের মহিলাদের হিজাববিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তাঁরা প্রকাশ্যে আসছেন ইসলামিক রাষ্ট্রের হিজাব, বোরখা পরার আইন অমান্য করে। পুড়িয়ে দিচ্ছেন সেসব, চুল কেটে ফেলছেন। মিছিলে মিছিলে ছয়লাপ গোটা দেশ। পাল্লা দিয়ে চলছে সরকারি দমননীতি – মারধোর, হত্যা, পুলিসি হেফাজতে যৌন নির্যাতন। ইরানের পুরুষদের একটা বড় অংশ যে এই আন্দোলনের পাশে এসে গেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল বিশ্বকাপের মঞ্চে ফুটবল দলের প্রতিবাদে।

পৃথিবীর কোথাও কোনো নারী আন্দোলনের পাশে এভাবে পুরুষদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা দাঁড়িয়েছেন কিনা জানি না, নারীবাদ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বলতে পারবেন। কিন্তু হজসফি ও তাঁর দল একইসঙ্গে অন্য একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন যা আজকের পৃথিবীতে, ভারতে তো বটেই, প্রাসঙ্গিক। ভারতের জাতীয় স্তোত্রের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ নেশন (বাংলাতেও এই শব্দই লিখেছেন) ব্যাপারটাকেই ভাল চোখে দেখতেন না। স্বাধীন দেশে কী করলে নেশনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় তার কিছু মানদণ্ড আমরা ঠিক করেছি, সব দেশই করে থাকে। তার অন্যতম জাতীয় সঙ্গীত। ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, বললেন দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ দেশ মানে মানুষ, কতকগুলো প্রতীক নয়। তাহলে কি প্রতীকের প্রয়োজন শুধু দেশের উপর নেশনের আধিপত্য বজায় রাখতে?

১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথ ইরানে যান শাসক রেজা শাহ পহলভির আমন্ত্রণে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক হজসফিদের জানার কথা নয়। তবু তাঁদের আচরণে যেন উঠে এসেছে নেশন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরই অনাস্থা।

আরও পড়ুন ‘ন্যাশনাল আর্কাইভের অবলুপ্তি দেশটাকে শপিং মল বানানোর চক্রান্ত’

১৯১৬ সালের মে মাস থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল – এই সময়ের মধ্যে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দেন। যেসব কথাবার্তা তিনি বলেন তা জাতীয়তাবাদীদের (বা নেশনবাদীদের) সেদিনও পছন্দ হয়নি, আজও হয় না। যেমন জাপান সম্পর্কে তিনি বলেন “জাপানে দেখেছি গোটা দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের মস্তিষ্ক এবং স্বাধীনতা সরকারের হাতে খর্ব হতে দিয়েছে। আর সরকার নানারকম শিক্ষার ব্যবস্থার দ্বারা মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের অনুভূতি নির্মাণ করছে, মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিলে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে নজরদারি চালাচ্ছে। এক সংকীর্ণ পথ দিয়ে সত্যের দিকে নয়, মানুষকে সেই দিকে চালিত করছে যেদিকে নিয়ে গেলে মানুষকে একেবারে ভেঙে গড়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী এক সমসত্ত্ব জড়পিণ্ডে পরিণত করা যাবে। মানুষ এই সর্বগ্রাসী মানসিক দাসত্ব সানন্দে এবং সগর্বে মেনে নেয় কারণ তাদের মধ্যে নেশন নামক ক্ষমতার যন্ত্রে পরিণত হওয়ার উত্তেজক অভিলাষ কাজ করে…”। [ভাষান্তর আমার]

(I have seen in Japan the voluntary submission of the whole people to the trimming of their minds and clipping of their freedom by their government, which through various educational agencies regulates their thoughts, manufactures their feelings, becomes suspiciously watchful when they show signs of inclining toward the spiritual, leading them through a narrow path not toward what is true but what is necessary for the complete welding of them into one unform mass according to its own recipe. The people accept this all-pervading mental slavery with cheerfulness and pride because of their nervous desire to turn themselves into a machine of power, called the Nation…)

পড়লে মনে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়েই রবীন্দ্রনাথ ইসলামিক বিপ্লব পরবর্তী ইরানের মত নেশন বা একবিংশ শতাব্দীর বিরাট ডিসটোপিয়াসুলভ নেশনগুলোর চেহারা দেখতে পাচ্ছিলেন, যা তাঁর অন্তত দেড় দশক পরে ইউরোপের টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে দেখে কল্পনা করবেন অলডাস হাক্সলি (Brave New World; প্রকাশকাল ১৯৩২), তিন দশক পরে জর্জ অরওয়েল (1984; প্রকাশকাল ১৯৪৯)।

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে এ জিনিস দেখতে হয়নি। ১৯১৬-১৭ সালের সেই বক্তৃতামালায় ভারত সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “যদিও শৈশবকাল থেকে আমাকে শেখানো হয়েছিল যে নেশনকে পুজো করা প্রায় ঈশ্বরকে এবং মানবতাকে শ্রদ্ধা করার চেয়েও ভাল, আমার মনে হয় আমি সেই শিক্ষার প্রভাব কাটিয়ে উঠেছি। আমার বিশ্বাস আমার দেশের মানুষ তাঁদের সত্যিকারের ভারত লাভ করতে পারবেন সেই শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করলে, যা শেখায় একটা দেশ মানবতার আদর্শের চেয়ে বড়।”

(Even though from childhood I had been taught that idolatry of the Nation is almost better than reverence for God and humanity, I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will truly gain their India by fighting against the education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity.) [ভাষান্তর আমার]

রবীন্দ্রনাথ যে লড়াই করতে বলেছিলেন আমরা তাতে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই দেশভাগ হয়, উপরন্তু খণ্ডিত ভারতবর্ষ আজও ভাগ হয়ে চলেছে। ইরানের ফুটবল দল নেশন নির্ধারিত প্রতীককে অস্বীকার করে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যত দিন যাচ্ছে তত নেশনের বশংবদ হয়ে পড়ছেন। আগে সাতে পাঁচে থাকতেন না, ইদানীং সবার আগে রাষ্ট্রের পক্ষ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোশাল মিডিয়ায়। এসব বললেই একটা কথা বলা হয় – আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের থেকে ওসব আশা করা উচিত নয়, কারণ আমাদের সমাজ ইউরোপ বা আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক নয়। আমাদের খেলোয়াড়রা রাজনৈতিক প্রতিবাদ করলে নাকি নানাবিধ চাপের মুখে পড়বেন। ইরানের ফুটবলারদের দেখার পর এ কথায় আর কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই বোধহয়। কারণ আমরা তো ইরানের চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক দেশ বলেই নিজেদের দাবি করে থাকি। তাহলে তাদের ফুটবলাররা এবং তাঁদের পরিজন যে সংকটের কল্পনায় ম্রিয়মান না হয়ে এমন প্রতিবাদ করেছেন তার চেয়ে বড় কোন বিপদে আমাদের খেলোয়াড়রা পড়তে পারেন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে?

পুনশ্চ: বিশ্বকাপ জ্বরে আমাদের অনেকেরই হয়ত চোখ এড়িয়ে গেছে একটা খবর। বিজেপির আইনজীবী নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে দাবি করেছেন ‘জনগণমন’ আর ‘বন্দে মাতরম’-কে সমান মর্যাদা দিতে হবে। তার উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, দুটো গান একই স্তরের এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দুটোকেই সমান শ্রদ্ধা জানানো উচিত। উপাধ্যায় নিজের পিটিশনে দাবি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলোকে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুটো গানই প্রত্যেক কাজের দিনে বাজানো নিশ্চিত করতে হবে।

দেশ যত দুর্বল হয় নেশনকে তত শক্তিশালী করার দরকার হয়। যে গানে নেশন কম জনগণমন বেশি, সে গান ঠেকায় পড়ে সহ্য করে নিতে হয়। কিন্তু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে অবশ্যই সেই গান বেশি শ্রেয়, যেখানে মাতৃমূর্তির সাহায্যে জনমনে অভিন্ন নেশন প্রতিভাত হয়। 

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

তালিবান শাসন: ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

এ দেশের শাসকরা তালিবান নন। কারণ তাঁরা অনেকেই গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতে পারেন। উচ্চশিক্ষিত বলেই পাঠ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি।

খুব আতঙ্কে কাটছে আমাদের। পাশেই আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। ভীষণদর্শন বন্দুকধারীদের ছবি, মানুষের প্রাণপণ পালানোর ছবি আমরা টিভি, খবরের কাগজ অথবা সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখছি। আফগান মানেই বর্বর, অথবা মুসলমানরা ওরকমই হয় — এরকম ভাবনার লোকেরা একরকম শান্তি পাচ্ছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ মনে পড়লে অশান্তি দ্বিগুণ। আফগানিস্তানের মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের কথা ভেবে ঘুম উড়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল ‘কাবুলিওয়ালা’ লেখেননি। লিখেছিলেন “বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/ দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।” এই লাইনগুলো স্মরণ থাকলে আতঙ্কিত হওয়ার জন্য আফগানিস্তান দেখার প্রয়োজন নেই। তালিবান যা যা করে থাকে তার প্রায় কোনোটাই এ দেশে ঘটতে বাকি নেই।

তারা যখন নব্বইয়ের দশকে প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন থেকেই এ কথা বলে অনেকে প্রবল নিন্দার মুখে পড়েছেন। বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে ফেলা গর্হিত কাজ, কিন্তু বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার — এমন ব্যাখ্যাই চিৎকৃত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কারণ তালিবান কাজটা করেছিল ক্ষমতায় এসে, বাবরি ভেঙেছিল ‘স্বতঃস্ফূর্ত জনতা’। এখন সেই স্বতঃস্ফূর্ত জনতাই দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা। নেশন কী চায় তারাই জানে। সেই চাহিদা অনুযায়ী এডিট করা ভিডিও ক্লিপ জুগিয়ে দেয় ক্ষমতাসীন দলের আই টি সেল, পুলিস তার ভিত্তিতেই সত্য মিথ্যা যাচাই না করে মানুষকে হাজতে পুরে দেয়, সে পচতে থাকে ইউএপিএ আইনে। শরিয়তি আইনের অবিচার এর চেয়ে আর কত বেশি?

তবু এ দেশের শাসকরা তালিবান নন। কারণ তাঁরা অনেকেই গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতে পারেন। উচ্চশিক্ষিত বলেই পাঠ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি। তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর গল্প বাতিল করেন, দলিত লেখক বামা এবং সুখরথারিনিও বাতিল হন। এঁরা গান নিষিদ্ধ করে লোকসঙ্গীত গায়ককে হত্যা করেন না, অপছন্দের লেখা সরিয়ে দেন। সে কালের জার্মানির মত বই পোড়ানোও শুরু হয়ে গেছে। আমেদাবাদের বইয়ের দোকানে ঢুকে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ পুড়িয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে, আবার এসব বই পাওয়া গেলে দোকানই জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। আফগানিস্তানে তালিবরা যেটাকে ইসলাম বলে সেটাই ইসলাম। ভারতেও এখন সঙ্ঘ যাকে হিন্দুধর্ম বলে সেটাই হিন্দুধর্ম। তাই বাৎস্যায়নও হিন্দু সংস্কৃতি বিরুদ্ধ।

আরও পড়ুন সাহিত্য ও সাংবাদিকতা অপ্রিয় সত্য ছাড়া বৃথা

তালিবান নেতারা সগর্বে বলে, মেয়েদের কাজকর্ম, লেখাপড়া করতে হলে ইসলামের নির্দেশ মেনে বোরখা পরে বাইরে বেরোতে হবে। ইসলামে ঠিক কী বলা আছে তা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু তালিবানি শাসনে তাদের মুখের কথাই আইন। এ দেশে এখনো ১৯৫০ সালের সংবিধান চালু আছে বটে, কিন্তু মহিলাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচন, জামাকাপড়ের মাপ, মোবাইল ফোন ব্যবহার, এমনকি চাউমিন খাওয়ার অভ্যাসেও যে সংস্কৃতির বারোটা বাজছে — তা বহুবার পরিষ্কার করে দিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। স্বয়ং মোহন ভাগবত প্রকাশ্যেই বলে থাকেন, মেয়েদের কাজ ঘর সামলানো। উত্তরপ্রদেশের দাসনার মন্দিরের মহন্ত যতি নরসিংহানন্দের ছাপার অযোগ্য ভাইরাল বিষোদ্গারে মহিলাদের সম্পর্কে ভাবনায় তালিবান-সঙ্ঘ ঐকমত্য পরিষ্কার। এখন বিজেপি এই ঘোর মুসলমান বিদ্বেষী লোকটিকে জিহাদি আখ্যা দিচ্ছে, কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ধরে কপিল মিশ্রর মত গুরুত্বপূর্ণ নেতার ঘনিষ্ঠ।

আর হত্যা? গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশদের কথা আমাদের মনে নেই। আরও অদরকারি আখলাক আহমেদ, পেহলু খানের মত অসংখ্য গণপিটুনির শিকারদের স্মৃতি। কারণ তাঁরা গরুর অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত। গত পরশু এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক বিচারপতি তো বলেই দিয়েছেন, গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করে তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইন দরকার। গরুর কল্যাণ হলেই দেশের কল্যাণ হবে।

আশা করা যায় তালিবান সরকার শুয়োরের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার আগেই ভারত সরকার বিচারপতির স্বপ্ন সত্যি করবেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: