সিপিএম পথে ফিরেছে, কিন্তু ব্যালটে ফিরবে কি?

আইএসএফের সঙ্গে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের এখন ঠিক কী সম্পর্ক? কংগ্রেসের সঙ্গে কি আবার জোট করা হবে?

খবরে প্রকাশ, সিপিএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি শিলিগুড়িতে এক সভায় বলেছেন, শিলিগুড়ি পৌর নিগম বামেদের হাতছাড়া হয়েছে সবে কয়েক মাস। কিন্তু এর মধ্যেই তা দুর্বৃত্তদের হাতে চলে গেছে। সিপিএম তথা বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত প্রশাসনিক কার্যকলাপ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ধুতি পাঞ্জাবির মত শ্বেতশুভ্র ছিল, কোথাও দুর্নীতির লেশমাত্র ছিল না – এমনটা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, দুর্নীতির যে পরিমাণ এবং দুর্নীতি করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর যে নির্লজ্জা এ রাজ্যে দেখা যাচ্ছে তা একান্তই তৃণমূল কংগ্রেসের দান। তার মধ্যে কংগ্রেসের উত্তরাধিকার খুঁজতে যাওয়াও বৃথা। আবু বরকত আলি গনিখান চৌধুরীরা সেকালের জমিদারদের কায়দায় রাজনীতি করতেন, অধীর চৌধুরীর মত লোকেরা তার সঙ্গে মিশিয়েছিলেন পেশিশক্তির ব্যবহার। কিন্তু সেখানেও পরিমাণ মত দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে রবিন হুড মার্কা ভাবমূর্তি তৈরি করার প্রয়াস থাকত। বাম আমলেও রাজনৈতিক মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীরা অন্তত নিজের এলাকায় গরীবের মেয়ের বিয়ে দেওয়া, অমুক বড়লোককে ‘চমকে’ দিয়ে তমুক গরীবকে একটু স্বস্তি দেওয়া – এসব করত।

কিন্তু মাত্র এগারো বছরের শাসনেই দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের ফ্ল্যাট থেকে নগদ কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে, তদন্ত এগোলে অগাধ গোপন সম্পত্তির হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। অনুব্রত মন্ডলের মত বাহুবলীরা নিজেরাই নেতা হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তো বটেই, এমনকি দেশের বাইরেও নেতাদের সম্পত্তি রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এতৎসত্ত্বেও স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে অনুব্রতর মত নেতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, ববি হাকিম বাঘ বেরিয়ে এলেই শেয়ালরা পালাবে ইত্যাদি আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছেন। সাধারণ মানুষ টিভির পর্দায় পাহাড়প্রমাণ টাকা দেখে ফেলায় কদিন নিচু হয়ে থাকা শাসকের গলা আবার সপ্তমে চড়েছে। সুতরাং সাধারণ মানুষ যদি ভেবে নেন, শীর্ষ নেতৃত্বের আশীর্বাদেই এত দুর্নীতি চলছে রাজ্যে, তাহলে দোষ দেওয়া যাবে না। উপরন্তু মহারাষ্ট্র বা তামিলনাড়ুর মত পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী অর্থনীতির রাজ্যে দুর্নীতি সাধারণ মানুষের যতটা চোখে লাগে, কর্মসংস্থানের হাহাকার পড়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের নেতাদের বিপুল সম্পত্তি এবং তা নিয়ে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধের অভাব অনেক বেশি গায়ে লাগাই স্বাভাবিক।

ফলে মীনাক্ষীর কথা বেশকিছু শ্রোতাকে স্পর্শ করতে পারলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সম্ভবত পারছেও। সেই কারণেই ইদানীং সিপিএমের মিছিল, মিটিংয়ে আবার ভিড় হতে দেখা যাচ্ছে। স্রেফ কৌতূহলী জনতার ভিড় নয়, মধ্যবয়স্ক বা পাকা চুলের মানুষের ভিড় নয় – তরুণ তরুণীদের ভিড়। স্কুল নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে বছর দশেক হতে চলল, কিন্তু গত এক বছরে যে তীব্রতা এসেছে আন্দোলনে – তাও আগে দেখা যায়নি। এর পিছনেও যে সিপিএমের সক্রিয়তা বৃদ্ধি অন্যতম কারণ, তা এই আন্দোলনকে নিয়মিত নজরে রাখা সাংবাদিকরা সকলেই জানেন। মীনাক্ষী, ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, কলতান দাশগুপ্তের মত সিপিএমের ছাত্র, যুব সংগঠনের নেতারা যে এই আন্দোলন নিয়ে পথে নেমে পড়েছেন, কম্পাস ঠিক করতে সাহায্য করছেন তা তো কারোর কাছেই অবিদিত নেই। যে রাত্রে করুণাময়ী থেকে আন্দোলনকারীদের বলপূর্বক তুলে দেওয়া হল কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে সাক্ষী গোপাল করে, সে রাত্রেও এঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন উচ্ছেদ আটকাতে। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সম্পর্কে সিপিএমের হাবভাব বদল চোখে পড়ার মত। পূর্বতন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের আমলে এই আন্দোলন চলছিল নিজের মত করে। কলকাতার মাঝখানে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে চাকরিপ্রার্থীরা যখন অনশন করছিলেন, তখন পথচারীরা পর্যন্ত উঁকি মেরে দেখতেন না এরা কারা, কেন এখানে বসে আছে। সিপিএম বলত তারা আন্দোলনটাকে হাইজ্যাক করতে চায় না বলে ওর মধ্যে প্রবেশ করছে না, কিন্তু আন্দোলনকারীদের পাশে আছে। পাশে থাকা মানে কোনোদিন বিমান বসু, কোনোদিন অন্য কোনো নেতার মেয়ো রোড গমনের ফেসবুক লাইভ। মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর থেকে স্বয়ং বেশ কয়েকবার আন্দোলনকারীদের কাছে গেছেন, এই ইস্যু নিয়ে পার্টির পতাকা নিয়ে অথবা নাগরিক মিছিলের নাম দিয়ে একাধিক কর্মসূচি পালন হয়েছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কড়া রায় তৃণমূল সরকারকে বিপদে ফেলেছে আদালতের ভিতরে। কিন্তু আদালতের লড়াইকে রাস্তায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব অবশ্যই সিপিএমের।

কিন্তু রাজ্যের পরিস্থিতির সাপেক্ষে যে প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ, তা হল পথে ঘাটে সিপিএমের প্রতি সমর্থন ফেরত এলেও, ব্যালট বাক্সে আসবে কি? কোনো সন্দেহ নেই, কলকাতার ধর্মতলায় সারা রাজ্যের ছাত্র, যুবদের একত্র করে শক্তি প্রদর্শন আর ভোট আদায় এক জিনিস নয়। ২০২৪ এখনো ঢের দেরি, সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। সে নির্বাচনে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন কতটা প্রভাব ফেলবে বলা মুশকিল। হয়ত বেশি প্রভাবশালী হবে সিপিএমের হেল্পলাইন, যেখানে মানুষ ফোন করে স্থানীয় দুর্নীতির কথা বলতে পারেন। সিপিএম নেতাদের দাবি দারুণ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া রাজ্যের প্রত্যেক পঞ্চায়েত এলাকায় গোটা নভেম্বর মাস জুড়ে পদযাত্রা এবং ডেপুটেশনের কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে, যা শুভেন্দু-অভিষেক কাদা ছোড়াছুড়ি এবং রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব পেরিয়ে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে এখনো জায়গা করে নিতে পারেনি।

রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে, তৃণমূলের স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজ্য নেতাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ক্ষোভ জমেছে। কিন্তু তেমন ক্ষোভ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগেও ছিল। সে নির্বাচন অনেকটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পর্কে গণভোটে পরিণত হওয়ায় এবং দুয়ারে সরকার আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কল্যাণে তৃণমূল শেষপর্যন্ত হইহই করে জিতেছিল। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট অন্য ব্যাপার। ইতিমধ্যে দুয়ারে সরকার নিয়েও দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। তৃণমূলেরই একাধিক গোষ্ঠীকে কারা কী পেল, কারা পেল না তা নিয়ে প্রকাশ্যে ঝগড়া করতে দেখা যাচ্ছে। বিজেপি এখন পর্যন্ত নিষ্প্রভ। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে কি পারবে সিপিএম?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে উঠে আসবে আরেকটি জরুরি প্রশ্ন। বামফ্রন্ট, তুমি আজিও আছ কি? কারণ সিপিএম যখন মধ্যগগনে, তখনো বহু জায়গায় তাদের চেয়ে ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপির মত ফ্রন্টের অন্য দলগুলোরই আধিপত্য বেশি ছিল। তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি যেমন হয়েছে, তেমনি নির্বাচনের সময়ে এই সমীকরণ বামফ্রন্টের হাত শক্তও করেছে। মুর্শিদাবাদে কী অবস্থা আরএসপির? কোচবিহারে উদয়ন গুহর প্রস্থানের পর কেমন আছে ফরোয়ার্ড ব্লক? প্রবাদপ্রতিম চিত্ত বসুর পার্টির উত্তর ২৪ পরগণাতেই বা কী হাল? বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে যে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি হয়েছিল তাতে ছিল কংগ্রেস আর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টও। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মুসলমান এবং হিন্দু নিম্নবর্গীয় মানুষের হাত ধরার জন্যই নাকি শেষোক্ত দলটিকে নেওয়া হয়েছিল। তাদের সঙ্গেই বা সিপিএম তথা বামফ্রন্টের এখন ঠিক কী সম্পর্ক? কংগ্রেসের সঙ্গে কি আবার জোট করা হবে?

আরও পড়ুন সেলিব্রিটি কাল্ট দরদী সিপিএমকে খোলা চিঠি

এইসব প্রশ্নেই লুকিয়ে আছে বামেরা এ রাজ্যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা তার উত্তর। কারণ এ রাজ্যে যেভাবে ভোট হয়, তাতে সবকিছু ঠিকঠাক করেও নির্বাচনের দিন খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নের মোকাবিলা করতে না পারলে ভোটে জেতা যায় না। গোটা রাজ্যে একা তার মোকাবিলা করার মত সংগঠন সিপিএমের এখন নেই, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে হবেও না।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

অলক্ষ্মী না হলে বাঁচবে না আমাদের লক্ষ্মী মেয়েরা

পুলিস যেখানে মিটিং করার অনুমতি দেয়নি ঠিক সেখানটাই পার্টিকর্মী, সমর্থকদের দিয়ে ভরিয়ে ফেলে ম্যাটাডোরের উপর দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, মিটিং কোথায় হবে মানুষ ঠিক করবে। পুলিস ঠিক করবে না। এমন দস্যি মেয়েদেরই আমরা লক্ষ্মীছাড়া বলতে অভ্যস্ত।

লক্ষ্মীপুজো কবে? দুর্গাপুজোর পরেই তো? নাকি দিওয়ালি নাগাদ? প্রশ্নটা এই পুজোর মরসুমে রীতিমত ভাবিয়েছে। দিনকাল যেভাবে বদলাচ্ছে। হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকে দেখে আসছি বাঙালি গণেশপুজো করে অক্ষয় তৃতীয়ায়। কিছু দোকান হালখাতা পয়লা বৈশাখে করে না, করে সেইদিন। এখন চুল পাকতে শুরু করার পর দেখছি বাঙালির ঘরে ঘরে, ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে গণেশ চতুর্থীর হিড়িক। দুর্গাপুজোর ঢাকের বাদ্যিও শুরু হয়ে যাচ্ছে অকালবোধনের একমাস আগে। পঞ্চমী তো বটেই, আমাদের আমলে জাঁদরেল বাবা-মায়েরা ষষ্ঠীর দিনও সকালে পড়তে বসাতেন, বিকেল থেকে ছুটি। এখনকার বাবা-মা মহালয়ার দিনই ছেলেমেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়ে বাতানুকূল গাড়িতে চাপিয়ে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাচ্ছেন। এতকিছু যখন বদলাচ্ছে, তখন মেঝেতে সারি সারি লক্ষ্মীর পায়ের আলপনা দেওয়ার পুজো ধনতেরাসে বিলীন হতেই পারে। তাই চোখকান খোলা রাখতে হয়। আগে অবশ্য আমাদের বছরে একদিন লক্ষ্মীপুজো করে আশ মিটত না, বাড়িতে লক্ষ্মী মেয়ে তৈরি করার প্রকল্প চলত সারাবছর। শ্বশুরবাড়িতে লক্ষ্মী মেয়েদের চাহিদা এখনো কম নয়, তবে বাবা-মায়েদের কাছে আজকাল অলক্ষ্মী মেয়েদের যথেষ্ট আদর হয়েছে। ছেলের মত বা ছেলের চেয়েও বেশি করে বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে যে অলক্ষ্মীরাই পারে, তার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুতরাং কাল পর্যন্ত যাদের অলক্ষ্মী বলা আমাদের অভ্যাস ছিল, এখন তাদেরই লক্ষ্মী মেয়ে বলে মেনে নেওয়ার দিন। যেমন

মীরাবাঈ চানু, পিভি সিন্ধু, লভলীনা বরগোহাঁই: পিটি ঊষা বা অঞ্জু ববি জর্জ মান্ধাতার আমলের মহিলা নন, কিন্তু কেরিয়ারের সেরা সময়েও তাঁদের যদি বলা হত, আর মাত্র দুই দশকের মধ্যেই কোনো অলিম্পিকে ভারতের জেতা পদকের অর্ধেক জিতবে মেয়েরা, ঊষা আর অঞ্জু নিশ্চয়ই হেসে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু ভারোত্তোলক চানু, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় সিন্ধু আর মুষ্টিযোদ্ধা লভলীনা ঠিক সেটাই করে দেখিয়ে দিয়েছেন গত বছরের টোকিও অলিম্পিকে। একজন পেশি ফুলিয়ে লোহা তোলেন, একজন জনসমক্ষে ছোট ছোট জামাকাপড় পরে লম্ফঝম্প করে ঠাঁই ঠাঁই করে শাটল পেটান। তৃতীয় জন আরও এক কাঠি সরেস – ঘুঁষোঘুঁষি করেন। কী ভীষণ অলক্ষ্মী! আরেকটু হলে মেয়েদের হকি দলও পদক জিতে ফেলছিল। ভারতীয় মেয়েরা এখনো অলিম্পিকে সোনা জেতেননি। অলক্ষ্মীরা এভাবে দলে ভারি হতে থাকলে ২০২৪ সালে প্যারিসে সে অভাবও মিটে যেতে পারে।

দীপ্তি শর্মা, হরমনপ্রীত কৌর: ক্রিকেট খেলার জন্ম বিলেতে আর বিলেতে খেলার দেবভূমি হল লর্ডসের মাঠ। সেই মাঠে সাহেবদের জব্দ করে দিতে পারা কত বড় কাণ্ড তা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে জামা খুলে মাথার উপর বনবন করে ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের পুরুষদের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। কদিন আগে সেই লর্ডসেই ইতিহাসে প্রথমবার মেমদের তিনটে একদিনের ম্যাচের তিনটেতেই হারিয়ে দিল ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল। উপরন্তু ইংরেজদের কাটা ঘায়ে ঠান্ডা মাথায় নুন ঘষে দিলেন অফস্পিনার দীপ্তি আর অধিনায়িকা হরমনপ্রীত। ইংল্যান্ড ব্যাটার চার্লি ডিন বারবার আগেভাগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। দীপ্তি বল করতে গিয়ে বেল ফেলে দিলেন। তৃতীয় আম্পায়ার খতিয়ে দেখে জানালেন এখন যে নিয়ম বলবৎ হয়েছে সে নিয়ম অনুযায়ী চার্লি আউট, ম্যাচ খতম। কিন্তু ব্যাপারটা কেবল ইংরেজ নয়, আরও অনেকেরই হজম হয়নি। সাহেবদের তৈরি খেলা, ফলে তারা দাবি করে আইনটাই শেষ কথা নয়, কেতাও বজায় রাখতে হবে (কেতার গালভরা নাম ‘স্পিরিট অফ ক্রিকেট’)। দীপ্তি যদি কাণ্ডটা করেও থাকেন, হরমনপ্রীতের উচিত ছিল আউটের আবেদন ফিরিয়ে নেওয়া। ক্যাপ্টেন বলে কথা। ম্যাচের শেষে টিভির প্রতিনিধি হরমনপ্রীতকে এ নিয়ে প্রশ্নও করলেন। দেখা গেল হরমনপ্রীত, ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির অপর্ণা সেনের মতই, ‘অত্যন্ত ইমপোলাইট’। বললেন যা করা হয়েছে আইন মেনেই হয়েছে। এরকম হলে আমি আমার বোলারকেই সমর্থন করব। ২৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় ইংরেজরা মনে এত ব্যথা পেয়েছে যে পুরুষদের একদিনের দলের অধিনায়ক জস বাটলার হপ্তাখানেক পরেও বলেছেন, আমি হলে কখনো এমন হতে দিতাম না। বিশ্বকাপ ফাইনালে আমার দলের কোনো বোলার এমন করলেও আমি আউট হওয়া ব্যাটারকে ফিরিয়ে আনব।

মীনাক্ষী মুখার্জি: ইনি যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী নন, বিদেশ থেকে ডিগ্রি বা ব্র্যান্ডেড হাতব্যাগ – কোনোটাই নিয়ে আসেননি। রবীন্দ্রসঙ্গীত বা ‘বেলা চাও’ গাইতে পারেন না, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গানে নাচতেও পারেন না। কলকাতার ভদ্রলোকেদের বাংলায় কথা বলতে পারেন না, চোস্ত ইংরেজি বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। কী পারেন তাহলে? পুলিস লক আপে মার খেয়েও সোজা থাকতে পারেন, যেখানে তাঁর পার্টির তেমন সংগঠন নেই সেখানে দাঁড়িয়েও পুলিসকে ধমকাতে পারেন, জনতাকে উদ্বেল করতে পারেন। পুলিস যেখানে মিটিং করার অনুমতি দেয়নি ঠিক সেখানটাই পার্টিকর্মী, সমর্থকদের দিয়ে ভরিয়ে ফেলে ম্যাটাডোরের উপর দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, মিটিং কোথায় হবে মানুষ ঠিক করবে। পুলিস ঠিক করবে না। এমন দস্যি মেয়েদেরই আমরা লক্ষ্মীছাড়া বলতে অভ্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গের দশ বছর ধরে মিইয়ে থাকা শান্ত বিরোধী রাজনীতিতে অশান্তি হানতে পেরেছেন মীনাক্ষী। মধ্যবিত্তপ্রধান সিপিএমে গরীব ঘর থেকে উঠে আসা এই মেয়ে নূতন যৌবনের দূত। যে পথে এ রাজ্যের বামপন্থীরা আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না বলে মনে হচ্ছিল, সে পথের হদিশ যে পাওয়া গেছে বলে মনে হচ্ছে তাতে রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের অবদান অনেকখানি, কিন্তু মীনাক্ষীর অবদানও কম নয়।

আরও পড়ুন ঝুলন সেরা বাঙালি ক্রিকেটার? মোটেই না

রিয়া কুমারী: প্রচলিত অর্থে লক্ষ্মী মেয়ে বোধহয় বিহারের মহিলা উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারপার্সন হরজোৎ কৌর ভামরা। বহুদূর লেখাপড়া করে আইএএস পরীক্ষায় পাস করে চাকরি পায় যে মেয়ে তাকেই তো লক্ষ্মী মেয়ে বলে। কিন্তু সম্প্রতি বিহার সরকারের উদ্যোগে মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিয়ে এক কর্মশালায় ধরা পড়ে গেছে, যে হরজোৎ মানসিকতায় একজন প্রবল পিতৃতান্ত্রিক পুরুষমানুষ। তাঁকে ধরে ফেলেছেন ১৯ বছর বয়সী ঠোঁটকাটা রিয়া কুমারী, যাঁকে কেউ লক্ষ্মী মেয়ে বলবে না হয়ত। রিয়া জানতে চেয়েছিল সরকার ২০-৩০ টাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। হরজোৎ বলেছেন, এরপর তোমরা সরকারের কাছে জিনস চাইবে। তারপর সুন্দর জুতো চাইবে। তারপর কি কন্ডোমও চাইবে? রিয়া তাতে দমে যায়নি। আমলাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, সরকার নির্বাচিত হয় নাগরিকদের ভোটে। নাগরিকদের দাবিদাওয়া থাকতেই পারে।

ভারত রাষ্ট্র যে পথে চলেছে তাতে রিয়া নয়, রাষ্ট্র্বের কাছে হরজোৎই লক্ষ্মী মেয়ে। কিন্তু ভারতীয় মেয়েদের বাঁচতে হলে রিয়ার মত অবাধ্য, অলক্ষ্মী হতে হবে। লক্ষ্মীঠাকুরে যাঁদের বিশ্বাস আছে তাঁরা বরং প্রার্থনা করতে পারেন, এ দেশের মেয়েদের যেন ইরানের মেয়েদের মত লক্ষ্মীছাড়া হয়ে উঠে প্রাণ দিতে না হয়।

বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

মিঠুদা (নাম পরিবর্তিত) পেশাদার ড্রাইভার। বাসচালক ছিলেন, এখন প্রাইভেট গাড়ি চালান। সম্প্রতি যে শতাধিক পৌরসভায় নির্বাচন হল, উনি তারই একটার বাসিন্দা। পার্টি সদস্য না হলেও, সক্রিয় সিপিএম সমর্থক। নির্বাচনের ফল বেরোবার আগের দিন দেখা হল, বললেন “দাদা, মনে হচ্ছে অন্তত আমাদের ওয়ার্ডটায় জিতে যাব। ওরা অনেক চেষ্টা করেছিল, ভয় দেখিয়েছিল, কিন্তু আমরা বুক দিয়ে বুথ আগলেছি।” মিঠুদার আশা পূর্ণ হয়নি। রাজ্যের অন্য অনেক পৌরসভার মত ওঁদের পৌরসভাও বিরোধীশূন্য হয়েছে। দিন সাতেক পরে আবার দেখা। দুঃখ করে বললেন “কাজকর্ম ফেলে, টিএমসির গালাগাল খেয়ে ভোটের আগে কদিন রাত জেগে পোস্টারিং করলাম। এখন ভোটের পরে পার্টি অফিসে গেলে নেতারা ভাব করছে যেন চেনেই না। আর ওদের কাছে যাবই না ভাবছি। আগেও দেখেছি, মিছিলে লোক দরকার হলে আমাকে ডাকে। আর এসডিও অফিসে ডেপুটেশন দিতে যাওয়ার সময়ে ফরসা দেখতে লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোকে ডাকে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, একবার বলেও না ‘মিঠু, তুইও যাস।’ কেন বলবে? আমার কালোকোলো চেহারা, লেখাপড়া জানি না অত, আমার আর কী দাম?”

পশ্চিমবঙ্গে বিধায়ক, সাংসদ নেই; ভোটও দু-আড়াই শতাংশে নেমে এসেছে সিপিএমের। তবু যে তারা এখনো কয়েক হাজার মানুষের মিছিল করতে পারে, আনিস খান হত্যার যথাযথ বিচার চেয়ে যে মাঝে কয়েকদিন রাজ্য তোলপাড় করে দিতে পেরেছিল, তা এই মিঠুদাদের জন্যই। মিঠুদার পেশায় মাস মাইনে নেই, ডি এ নেই, টি এ নেই, অবসরের পর পেনশন নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। গাড়ি চালালে রোজগার, না চালালে হাত খালি। সেই মানুষ ভোটের আগে গাড়ি না চালিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বেড়িয়েছেন। একথা জানতে পারলে যে কোনো মানুষের মনে হতে বাধ্য, বর্তমান যেমনই হোক, সিপিএমের এখনো ভবিষ্যৎ আছে। কোনো পার্টির যদি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সমর্থক থাকে, তাহলে তার কিসের অভাব?

অভাব আছে। মিঠুদাদের উপযুক্ত মর্যাদার অভাব। সিপিএমে বৃদ্ধতন্ত্র চলছে বলে প্রায়ই হইচই হয়। রাজ্য সম্মেলন চলাকালীন কয়েকজন বয়স্ক নেতা ঝিমোচ্ছেন — এই ছবি প্রকাশ হওয়ার পর আরও বেশি করে হচ্ছে। চাপা পড়ে যাচ্ছে যে কথা, তা হল বিমান বসু এখনো যে কোনো ২৫-৩০ বছরের ছেলের চেয়ে বেশি হাঁটতে পারেন মিছিলে, হান্নান মোল্লা দিল্লির রাস্তায় বসে এক বছরের বেশি কৃষক আন্দোলন করলেন সদ্য, তপন সেন এখনো গোটা ভারত চষে শ্রমিক সংগঠনের কাজ করেন। যা সত্যিই সিপিএমের সমস্যা, তাকে বলা চলে মধ্যবিত্ততন্ত্র। মিঠুদার অভিজ্ঞতা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। মূলত শ্রমিক-কৃষকের পার্টি হওয়ার কথা যে দলের, সেই দলের রাজ্য নেতৃত্বে দীর্ঘকাল ছাত্র, যুব নেতারা প্রাধান্য পাচ্ছেন। চক্রান্ত করে শ্রমিক নেতা, কৃষক নেতাদের সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে না এমন হয়ত নয়। আসলে পার্টিতে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। যাঁরা আসতে চাইছেন তাঁরা মিঠুদার মত ব্যবহার পাচ্ছেন। গুরুত্ব পাচ্ছেন লেখাপড়া জানা চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ীরা। মিঠুদার মত লোকেদের আদর দল ভারী করার সময়ে, অন্য সময়ে তারা অপ্রয়োজনীয়।

মিঠুদা মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন বা মায়াকভস্কি পড়েননি। তিনজনের সংসারের খাওয়া, পরা আর ছেলের লেখাপড়ার সংস্থান করতে উদয়াস্ত খেটে ওসব পড়াও যায় না। কিন্তু না পড়েই মার্কসবাদ যাকে শ্রেণিচরিত্র বলে, তার ধারণা ওঁর কাছে পরিষ্কার। বলেই দিলেন “চাকরি করা ফ্যামিলির ছেলেকে যতই তোল্লাই দিক, সে ভাল কেরিয়ার পেলেই চলে যাবে। পার্টির জন্যে আমরাই থাকব।” কিন্তু পার্টি এঁদের জন্য থাকবে কিনা এঁরা বুঝতে পারছেন না।  আশা করা যায় সিপিএমের নবনির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম জানেন, এই মুহূর্তে তাঁর পার্টির এ এক বড় সংকট। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ছিল মুসলমান, নিম্নবর্গীয় মানুষের হাতে। মুজফফর আহমেদ, আব্দুল হালিম, মহম্মদ ইসমাইলের মত নেতারা প্রবাদপ্রতিম। স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষত পার্টি ভাগ হওয়ার পর থেকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সব কমিউনিস্ট পার্টিই ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের দল। ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে যার অর্থ গরীব, প্রান্তিক মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়া। এখন কি মাটির টানে ফিরতে পারবে সিপিএম?

তারুণ্য নেই এমন কথা আর বলা যাবে না। বিধানসভা নির্বাচনে এক ঝাঁক অল্পবয়সীকে প্রার্থী করা হয়েছিল, সদ্যগঠিত নতুন রাজ্য কমিটিতেও অনেক নতুন মুখ। আনিসের জন্য বিচার চেয়ে আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি বহুকাল পরে মনে করিয়ে দিলেন সেই স্লোগান “পুলিসের লাঠি ঝাঁটার কাঠি/ভয় করে না কমিউনিস্ট পার্টি”। কিন্তু আশ্চর্য! তাঁকে এবং আরও একগুচ্ছ পার্টিকর্মীকে হাস্যকর অভিযোগে হপ্তা দুয়েক আটকে রাখা হল, উপরন্তু শারীরিক নির্যাতন চলল; সিপিএম আইনের উপর আস্থা রেখে নিরামিষ প্রতিবাদ ছাড়া কিছুই করল না!

আরও পড়ুন সেলিব্রিটি কাল্ট দরদী সিপিএমকে খোলা চিঠি

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির জন্যে ইস্যুর কিন্তু অভাব নেই। দেউচা পাঁচামিতে খনি করতে দেবেন না – এই দাবিতে স্থানীয় মানুষ আন্দোলনে, স্কুলের নিয়োগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, পুলিস আনিসের পর ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলরের হত্যাতেও প্রশ্নের মুখে, শাসক দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে যে নির্বাচিত কাউন্সিলর খুন হয়ে যাচ্ছেন, নেতৃত্ব মনোনীত চেয়ারম্যানকে বিজেপির সমর্থনে হারিয়ে দিয়ে পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়ে যাচ্ছেন অন্য একজন, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে সরকারে ফিরে মার্কামারা সাম্প্রদায়িক প্রাক্তন বিজেপিদের নির্বাচনে প্রার্থী করছে তৃণমূল। অথচ সিপিএম কিছুতেই মমতার কপালে ভাঁজ ফেলার মত বিরোধিতা করে উঠতে পারছে না। অন্য সবকিছু ভুলে সম্মেলন নিয়ে মেতে থাকা দেখে সন্দেহ হয়, পার্টির জন্য সম্মেলন নয়, সম্মেলনের জন্য পার্টি। বিপ্লবকেও ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখা যেতে পারে, সম্মেলনটা লগ্ন মেনে ষোড়শোপচারে করতে হয়।

বোধ করি কমিউনিস্ট পার্টিতে মধ্যবিত্ততন্ত্র চালু হয়ে গেলে এমনটাই ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন হয় না, এ অভিযোগ স্বয়ং হান্নান মোল্লা মাসখানেক আগে করেছেন। আসলে আন্দোলন হবে কি হবে না — তা ঠিক করছেন মাথায় ছোট বহরে বড় ভদ্রসন্তানরা, এবং অধিকাংশ সময়েই সিদ্ধান্ত হচ্ছে, হবে না। লড়াকু, গরীব কর্মী সমর্থকরা আছেন কেবল হুকুম তামিল করতে। অথচ মাস দশেক আগে নির্বাচনের প্রচারে টুম্পাসোনা গানের প্যারডি প্রকাশ করে বলা হয়েছিল সাধারণ মানুষের ভাষায় তাঁদের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা চলছে। সিপিএমের ভোটের ফলাফলে বোঝা গিয়েছিল, সাধারণ মানুষের ভাষা সিপিএম আদৌ বোঝেনি। লাভের লাভ এই, পার্টির শিল্পবোধও এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে শুভেন্দু মাইতির মত প্রবীণ গণশিল্পী তথা পার্টিকর্মীকে নেতৃত্ব মনে করছেন হুকুমের চাকর।

সিপিএমের ভবিষ্যৎ যদি এঁদের হাতেই থাকে, সে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

তরুণ কৃষক নেতা, শ্রমিক নেতারা কোথায়?

সিপিএমের মত দল যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ২ থেকে বামফ্রন্টের অন্য দল সমেত শত মুখে বলার মত ২৩৫-এ পৌঁছেছিল, তার পিছনে কিন্তু ছিলেন জ্যোতি বসুর মত শ্রমিক নেতা এবং হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরীদের মত কৃষক নেতারা।

যৌবন রাজনীতির কাছে কী চায়? ক্ষমতা? নাম? যশ? অর্থ?

প্রশ্নগুলোর উত্তর বেশ কঠিন। সাধারণ বুদ্ধি বলে নিতান্ত সাধু সন্ন্যাসী না হলে এই জিনিসগুলো পাওয়ার ইচ্ছা সকলেরই থাকে। যত বেশি থাকলে তাকে লোভ বলা যায়, তত বেশি না থাকলেও, থাকে। অথচ যৌবন এসবের জন্যই রাজনীতিতে আসে, এ কথা যদি সত্যি হত, তাহলে পৃথিবী জুড়ে ইতিহাসের সমস্ত যুগেই সরকারবিরোধী, বা ব্যাপকার্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাজনীতিতে, যুবক-যুবতীদের বিরাট সংখ্যায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত না। কারণ ও রাজনীতিতে পাওয়ার চেয়ে খোওয়ানোর সম্ভাবনা বেশি। ক্ষুদিরাম বসু, ভগৎ সিং-এর নাম তবু ইতিহাসে থেকে গেছে; বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে কত যুবক-যুবতী প্রাণ হারিয়েছে, পঙ্গু হয়ে গেছে, কারাবাস করেছে তার কোন হিসাব কোনদিন করা সম্ভব হবে না। তবুও যে কোন আন্দোলনে তাদের ঝাঁপিয়ে পড়া থামে না। এবং ব্যতিক্রমহীনভাবে যে কোন দেশেই বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে আকর্ষণ করে বামপন্থী রাজনীতি। এ দেশে এ রাজ্যেও তাই। ষাট-সত্তরের দশকে অসংখ্য মার্কসবাদে আকৃষ্ট যুবক-যুবতী নকশাল আন্দোলনের প্রভাবে বা প্রকোপে খুন হয়েছে, বন্দী হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। তারপরেও বিভিন্ন মতের বামপন্থী দলগুলোর প্রতি ঐ বয়সের ছেলেমেয়েদের আকর্ষণ রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে এই দলগুলোর নেতৃত্বে তারুণ্যের অভাব দেখা দিল। সে অভাব সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ত দেশের বৃহত্তম বাম দল সিপিএমের দিকে তাকালে। ইদানীং প্রবাহ বদলের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য অধিকাংশ বামপন্থী প্রার্থীর নাম ঘোষিত হয়েছে। তরুণ মুখের ভিড়, ছাত্র যুব ফ্রন্টের প্রাধান্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং দোর্দণ্ডপ্রতাপ শুভেন্দু অধিকারীর মত ওজনদার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম আসনে দাঁড়াচ্ছেন ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের নেত্রী মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়। সিঙ্গুরের মত প্রতীকি আসনে ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য। এ ছাড়াও জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির জন্য প্রসিদ্ধ ঐশী ঘোষ আর দীপ্সিতা ধরও প্রার্থী তালিকায়। বৃদ্ধতন্ত্র বলে ব্যঙ্গ করা হয় যে দলগুলোকে, সেই দলের প্রার্থীদের মধ্যে এত নতুন এবং তরুণ মুখের ভিড় প্রমাণ করে ব্যঙ্গের অন্তর্নিহিত ইতিবাচক সমালোচনা বামেরা গ্রহণ করেছেন। পার্টির মস্তিষ্কে নতুন রক্ত সঞ্চালন করা যে দরকারি এবং সেই প্রক্রিয়া শুরু করা যে আশু প্রয়োজন, তা শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। গোটা ২০২০ জুড়ে বাম দলগুলো রাজ্য রাজনীতির আলোচনায় যতটা জায়গা অধিকার করে ছিল, এ বছরের প্রথম দু মাসেই যে তার চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, তার পিছনেও অল্পবয়সীরাই। ১১ই ফেব্রুয়ারি ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযান দিয়েই বামেরা নতুন করে সবার কাছে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিল। অনেকদিন পরে বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে তৃণমূল-বিজেপি তরজার বাইরে কোন রাজনৈতিক খবর দেখা গেল। মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যু নিয়ে সরকারকে আক্রমণ করার কাজেও এসএফআই, ডিওয়াইএফআইয়ের ছেলেমেয়েদেরই পুরোভাগে দেখা গেছে। তারপর ২৮শে ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডের জনসভাতেও তরুণদের অভূতপূর্ব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

তরুণ নেতৃত্ব তৈরি করার এই চেষ্টা কতটা দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত আর কতটা ভোটারদের মন পাওয়ার চেষ্টা তা সময় বলবে, কিন্তু এই প্রচেষ্টার অন্য একটা দিক আছে যা নিয়ে বামপন্থী সদস্য সমর্থকদের বড় একটা কথাবার্তা বলতে শোনা যায় না। ছাত্র, যুব ফ্রন্টের নেতাদের প্রবীণ নেতৃত্ব গুরুত্ব দিচ্ছেন, বিভিন্ন আন্দোলনে সামনের সারিতে তারা থাকছে দেখে একেবারে পাড়া স্তরের কর্মী, সমর্থক, সাধারণ ভোটার যে বেশ খুশি তা স্পষ্ট দেখা যায়। যিনি কোনদিন বামেদের ভোট দেননি, হয়ত ভবিষ্যতেও দেবেন না, তিনিও বলেন “যাক, নতুনদের জায়গা দিয়েছে। এক মুখ দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত।” হয়ত ঠিকই বলেন, কিন্তু যে প্রশ্নটা কেউ করে না, তা হল তরুণ নেতা মানে কী?

অন্যান্য দলে তরুণ নেতা বলতে বোঝানো হয় অল্পবয়সী, উচ্চশিক্ষিত, প্রায়শই সুদর্শন, সুবক্তা নেতাদের। কংগ্রেসের মত প্রাচীন এবং অভিজাতবংশীয় নেতায় পরিপূর্ণ দলে যেমন শচীন পাইলট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, মিলিন্দ দেওরাদের বোঝানো হত কিছুদিন আগেও। বিজেপিতে এখন তরুণ নেতা বলতে বোঝায় চমৎকার ইংরেজিতে বিষাক্ত বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বছর তিরিশেকের সাংসদ তেজস্বী সূর্যকে। বিহারে এখন তরুণ নেতা তেজস্বী যাদব। বছর দশেক আগে উত্তরপ্রদেশে ছিলেন অখিলেশ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোতেও যেন ক্রমশ তরুণ নেতার মধ্যে ঐ গুণগুলোই খোঁজা হচ্ছে — বয়সে তরুণ কিনা, উচ্চশিক্ষিত কিনা, ছবিতে ভাল দেখায় কিনা আর ভাল কথা বলতে পারে কিনা। বলা বাহুল্য, এসব গুণ দোষের নয়। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির এর সঙ্গে আরো একটা জিনিসের খোঁজ করার কথা, তা হল শ্রেণী। তিনি কোন শ্রেণী থেকে আসছেন তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কোন শ্রেণীর মধ্যে কাজ করেন। যৌবন কোন শ্রেণী নয়, ছাত্র কোন শ্রেণী নয়।

তরুণ বামপন্থী মুখ বললেই কোন নামগুলো আমাদের মনে আসে? কানহাইয়া, ঐশী, দীপ্সিতা, সৃজন, শতরূপ; কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ঋতব্রত। মানে ঘুরে ফিরে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ কলেজের মত নামকরা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রনেতারা। এমন ছেলেমেয়েদের রাজনীতিতে আসা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য ভাল খবর, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব জুড়েও কেবল এরাই থাকলে সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী কোথায় প্রতিনিধিত্ব পাবে? তরুণ কৃষক নেতা হতে পারেন না? একশো দিন পেরিয়ে যাওয়া দিল্লী সীমান্তের কৃষক আন্দোলনে এত যে তরুণ মুখ দেখছি? এ রাজ্যেরই লোক হান্নান মোল্লার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা সারা দেশ জানতে পারল তিনি প্রবীণ বয়সে সারা ভারত কিষাণ সভার সাধারণ সম্পাদক হয়ে তিনি অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার পর। অথচ এ রাজ্যে কৃষক সভার আন্দোলন টের পাওয়া যায় না দীর্ঘকাল। তরুণ কৃষক নেতা পাওয়া যাবে কোথা থেকে?

আরও পড়ুন বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

এক সিপিএম কর্মী বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল কয়েক মাস আগে। সে বলছিল “উত্তরবঙ্গের চা বাগানে আমাদের শক্তি বেশ কিছুটা বেড়েছে গত পাঁচ বছরে। কৃতিত্ব যার, সেই ছেলেটা বছরে অন্তত ৩০০ দিন চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যেই পড়ে থাকে। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, নেপালি — সব ভাষায় গড়গড় করে কথা বলতে পারে। শ্রমিকদের ঘরের লোক হয়ে গেছে। তাকে কেউ চেনে না, কারণ তার ফেসবুক লাইভ করার সময় নেই।” শুনে সন্দেহ জাগল, তবে কি তরুণ শ্রমিক নেতাও আছে, আমরা অভ্যাসের দাস বলে তাদের চিনি না? সে বিলাসিতা আমাদের মানায়, কমিউনিস্ট পার্টিকে মানায় কিনা সন্দেহ। শ্রমিক, কৃষকের প্রতিনিধি ছাড়া কী করে সংযোগ সম্ভব গরীব মানুষের সাথে? সেই সংযোগ ছিন্ন হয়েই তো ক্ষমতা হারানোর দশ বছরের মধ্যে ভোট শতাংশ এক অঙ্কে নেমে আসার বিপত্তি আর নির্বাচনের মুখে অনন্যোপায় জোটসঙ্গীর খোঁজ।

সিপিএমের মত দল যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ২ থেকে বামফ্রন্টের অন্য দল সমেত শত মুখে বলার মত ২৩৫-এ পৌঁছেছিল, তার পিছনে কিন্তু ছিলেন জ্যোতি বসুর মত শ্রমিক নেতা এবং হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরীদের মত কৃষক নেতারা।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: