দল হারলেও গুহার চিচিং বনধ হতে দেবে না ক্রিকেট বোর্ড

এঁদের সময় শেষ। সেকথা এঁদের ভক্তরা মানবেন না, তার চেয়েও বড় কথা ক্রিকেট বোর্ড মানবে না। কারণ এই তারকাদের পিছনে টাকার থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একগুচ্ছ স্পনসর।

রবিচন্দ্রন অশ্বিন খেললেই কি ভারত ওভালের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল জিতে যেত? যশপ্রীত বুমরা যদি ফিট থাকতেন এবং খেলতেন, তাহলে কি ভারত জিতে যেত? ঋষভ পন্থ যদি প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে অন্যের এবং নিজের জীবন বিপন্ন করে শয্যাশায়ী না হতেন, তাহলে কি শেষ ইনিংসে ৪৪৪ রান তাড়া করার বিশ্বরেকর্ড করে জিতিয়ে দিতেন? এগুলোর কোনো ঠিক বা ভুল উত্তর হয় না, কারণ কী হলে কী হত কেউ বলতে পারে না। তবে তথ্য বলছে, ২০২১ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে এই তিনজনই খেলেছিলেন। তবু ভারত হেরেছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে এই তিনজনের উল্লেখযোগ্য অবদান সত্ত্বেও ভারত সেই ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পরে আর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টেই খেতাব জেতেনি। শুধু টেস্ট ক্রিকেটের কথাই যদি বলি, গত দশ বছরে দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া ভারতের আর কোনো বলার মত সাফল্য নেই। দেশের মাঠে দাপটে যে কোনো দলকে হারিয়ে দেওয়ার রেকর্ড ভারতের টেস্ট ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। কিন্তু অতীতে একাধিক ভারতীয় দল ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ জিতেছে, নিউজিল্যান্ডে জিতেছে। এর একটাও রবি শাস্ত্রী-বিরাট কোহলি, রাহুল দ্রাবিড়-কোহলি বা দ্রাবিড়-রোহিত শর্মার দ্বারা হয়ে ওঠেনি। এমনকি গত দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভাঙাচোরা, নতুন মুখদের নিয়ে তৈরি দলটার কাছেও হেরে এসেছে এই দল। সুতরাং এই একটা ম্যাচে অমুক, অমুক আর অমুক থাকলেই ভারত জিতে যেত কিনা সে প্রশ্ন না তুলে বরং অন্য কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানা আছে কিনা দেখুন।

১) কোন টেস্ট খেলিয়ে দেশের নির্বাচন সমিতিতে যতজন নির্বাচক থাকার কথা ততজন নেই
২) কোন টেস্ট খেলিয়ে দেশের নির্বাচন সমিতিতে প্রধান নির্বাচক বলে কেউ নেই?
৩) কোন টেস্ট খেলিয়ে দেশের জাতীয় দল নির্বাচনের পর কোনো সাংবাদিক সম্মেলন হয় না?

জানেন কি, এই তিনটে প্রশ্নেরই উত্তর ভারত? যে কোনো খেলার আন্তর্জাতিক স্তরটাকে যাঁরা পেশাদার এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের ব্যাপার বলে মনে করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন যে দিনের পর দিন এই ফাজলামি চালিয়ে গিয়ে বিশ্ব খেতাব কেন, কোনো সিরিজই জেতার আশা করা উচিত নয়।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী পাঁচজন নির্বাচক থাকার কথা। কিন্তু আছেন চারজন – শিবসুন্দর দাস, সুব্রত ব্যানার্জি, সলিল আঙ্কোলা আর শ্রীধরণ শরথ। এ বছর জানুয়ারি মাসে পাঁচ সদস্যের নির্বাচক কমিটিই ঘোষণা করা হয়েছিল, তার একজন চেয়ারম্যানও ছিলেন – চেতন শর্মা। কিন্তু পরের মাসেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হয় একটা স্টিং অপারেশনে নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার ফলে। তারপর চার মাস কেটে গেছে। ভারত দেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট ও একদিনের সিরিজ খেলল। প্রথম দুটো টেস্টের দল নির্বাচনের সময়ে চেতন ছিলেন। তারপর থেকে দল নির্বাচন করেছেন ওই ভাঙাচোরা নির্বাচন সমিতি এবং তার অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান শিবসুন্দর। মনে রাখা ভাল, এ বছর অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ। ফলে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একদিনের সিরিজটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার দল নির্বাচনও করে ওই ভাঙা নির্বাচন কমিটি। বলা বাহুল্য, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের দল নির্বাচনের সময়েও পঞ্চম নির্বাচককে নিয়োগ করার কথা ভাবেনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড। এভাবে বোধহয় পয়সা বাঁচানো হচ্ছে। বোর্ড সভাপতি জয় শাহের ক্রিকেটবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, গত কয়েক বছরে তাঁর সম্পত্তি যেভাবে কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে তাতে তাঁর ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে তো আর প্রশ্ন তোলা চলে না।

মজার কথা, নির্বাচন সমিতি নিয়ে এই ধাষ্টামোর সূচনা কিন্তু চেতনের পদত্যাগ থেকে শুরু হয়নি। গত নভেম্বরে কুড়ি বিশের বিশ্বকাপ থেকে ভারত বিদায় নেওয়ার পর এর আগের নির্বাচন সমিতিকে ঘটা করে বরখাস্ত করে বোর্ড। সেই নির্বাচন সমিতিতেও চারজন সদস্যই ছিলেন, এবং কী আশ্চর্য! তখনো চেয়ারম্যান ছিলেন চেতনই। অর্থাৎ যে ব্যর্থতার দায় ঘাড়ে চাপিয়ে অন্য তিন নির্বাচক সুনীল যোশী, দেবাশিস মোহান্তি আর হরবিন্দর সিংকে বিদায় করে দেওয়া হল; সেই ব্যর্থতার কাণ্ডারী চেতনকে আবার নির্বাচন সমিতির চেয়ারম্যান করে নিয়ে আসা হয়েছিল।

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, ক্রিকেট বোর্ড দল নির্বাচনকে তেমন জরুরি ব্যাপার বলে মনে করে না। সেটা দল ঘোষণার ভঙ্গিতেও পরিষ্কার। ভারতীয় ক্রিকেটে দস্তুর ছিল প্রধান নির্বাচক সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে দল ঘোষণা করেন। ক্রিকেটজীবনে অতি সাধারণ এমএসকে প্রসাদ, প্রশাসক হিসাবে বিশালকায় রাজ সিং দুঙ্গারপুর বা ক্রিকেটার হিসাবেও যথেষ্ট সফল দিলীপ ভেংসরকার – কেউ প্রধান নির্বাচক হয়ে এর অন্যথা করেননি। কিন্তু সেসব বন্ধ হয়ে গেছে জয় বোর্ড সভাপতি হওয়ার পর থেকে। এখন দিনের কোনো একটা সময়ে বোর্ড প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে খেলোয়াড় তালিকা জানিয়ে দেয়। তারপর কে বাদ পড়লেন আর কাকে বিশ্রাম দেওয়া হল তা নিয়ে গুজব পল্লবিত হয়।

সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার হল, ঘরোয়া ক্রিকেটে দিনের পর দিন ভাল খেলেও যে তরুণ ক্রিকেটাররা দলে সুযোগ পান না, তাঁদের কেন নেওয়া হল না তার জন্য জবাবদিহি করা হয় না। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের টপ অর্ডার ফর্মে নেই কোভিড অতিমারীর আগে থেকে। কালে ভদ্রে এক-আধটা অর্ধশতরান বা শতরান করে উদ্ধার করেন। অধিকাংশ ইনিংসে শেষদিকে পন্থ, রবীন্দ্র জাদেজা বা শার্দূল ঠাকুর সম্মানজনক স্কোরে পৌঁছে দেন দলকে। সেই কারণেই বোলার হিসাবে বিদেশের মাঠে কল্কে না পেলেও ওঁদেরই খেলানো হয় সেরা বোলার অশ্বিনকে বসিয়ে রেখে। যেদিন জাদেজা, শার্দূলরাও পেরে ওঠেন না, সেদিন মধ্যাহ্নভোজনের আগেই খেলা শেষ হয়ে যায়, যেমন রবিবার ওভালে হল। অথবা দল খটখটে রোদের দিনেও ৩৬ অল আউট হয়ে যায়, যেমনটা ঘটেছিল ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর অ্যাডিলেডে।

এভাবে সিরিজ বা বড় ম্যাচ জেতা সম্ভব নয় বলেই ভারত অধিকাংশ ক্ষেত্রে জেতে না। অথচ ঘুরে ফিরে সেই রোহিত, সেই চেতেশ্বর পূজারা, সেই অজিঙ্ক রাহানে, সেই কোহলি খেলেই চলেছেন। এদিকে মুম্বাইয়ের ২৫ বছরের ছেলে সরফরাজ খান ৩৭ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে সাড়ে তিন হাজার রান করে বসে আছেন প্রায় ৮০ গড়ে। তিনি কেন সুযোগ পান না জবাব দেওয়ার কেউ নেই। বাংলা দলের অভিমন্যু ঈশ্বরন (৮৭ ম্যাচে ৬৫৫৬ রান, গড় প্রায় ৪৮) পরপর বেশ কয়েকটা রঞ্জি ট্রফিতে ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন। তাঁরও মেঘে মেঘেই বেলা বাড়ছে। এরকম আরও নাম আছে।

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

বাদ গিয়ে ফেরত আসা রাহানে ওভালে দুই ইনিংসেই ভারতের সেরা ব্যাটার ছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে রোহিত আর কোহলিও বেশ ভাল ব্যাট করলেন। কিন্তু দেখা গেল, তাঁদের যথেষ্ট ভাল ফর্মও আর দলের জন্য যথেষ্ট নয়। ভারত দুশোর বেশি রানে হারল। ক্রিকেট জগতে একথার একটাই মানে হয়। এঁদের সময় শেষ। সেকথা এঁদের ভক্তরা মানবেন না, তার চেয়েও বড় কথা ক্রিকেট বোর্ড মানবে না। কারণ এই তারকাদের পিছনে টাকার থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একগুচ্ছ স্পনসর। খেলা সরাসরি সম্প্রচারকারীদের প্রাণ তাদের হাতে, আর সম্প্রচারই হল বোর্ডের ধনরত্নে ভরা গুহা। হারজিতের কথা ভেবে কি আর ও গুহার চিচিং বনধ হতে দেওয়া যায়? যায় না বলেই বয়সের যুক্তিতে ঋদ্ধিমান সাহাকে রাহুল দ্রাবিড় বলে দিতে পেরেছিলেন, এবার তুমি এসো। কিন্তু কোহলিদের বয়স চোখে দেখতে পান না।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন?

এ দেশের ক্রিকেটমহল এখন ভীষণ ব্যস্ত। ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইপিএল চলছে। নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। লখনৌ সুপারজায়ান্টস অধিনায়ক কে এল রাহুল তো এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে গুরুতর চোট পাওয়ার পরে হার নিশ্চিত জেনেও দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। অতঃপর চোটের প্রভাবে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলতে পারবেন না, সামনের মাসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলতে পারবেন না। এমন বীরত্বের জন্যই তো জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান ক্রিকেটাররা। মুশকিল হল, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগত এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর দাবি, মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন আক্রমণের অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, ক্রিকেটারদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

গত ২৮ এপ্রিল ভিনেশ বলেন, ক্রিকেটারদের তো আমাদের দেশে পুজো করা হয়। তাঁরা আমাদের পক্ষ যদি না-ও নেন, অন্তত একটা নিরপেক্ষ বার্তা দিয়েও তো বলতে পারেন যে দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কেবল ক্রিকেটার নয় অবশ্য, সব খেলার তারকাদের কাছেই আবেদন ছিল ভিনেশের। তারপর থেকে অভিনব বিন্দ্রা আর নীরজ চোপড়া – ভারতের ইতিহাসে যে দুজন অলিম্পিকে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন, দুজনেই ওই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। সদ্যপ্রাক্তন টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাও দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বিশেষ হেলদোল নেই। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র মহিলাদের জাতীয় দলের শিখা পাণ্ডে মুখ খুলেছেন। সদ্য চালু হওয়া মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনার কোনো বক্তব্য নেই। জাতীয় দলের অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌরও চুপ। প্রাক্তনদের মধ্যে হরভজন সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ইরফান পাঠান সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। একমাত্র নভজ্যোৎ সিং সিধু সশরীরে ভিনেশ, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল কপিলদেব ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কবে ন্যায়বিচার পাবে?

স্পষ্ট বক্তা হওয়ার জন্য যাঁর বিপুল খ্যাতি, সেই বিরাট কোহলি স্পিকটি নট। যাবতীয় বাহাদুরি গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খরচ করছেন। নারীবাদীরা প্রায়শই বিরাটকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি জীবনে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার অবদান স্বীকার করেন বলে, তাঁর ব্যর্থতায় ট্রোলরা অনুষ্কাকে টার্গেট করলে বিরাট মুখ খোলেন বলে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে বিরাটই একমাত্র পুরুষ যিনি নিজের বউকে ভালবাসেন। তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন একমাত্র অস্কার মঞ্চে বউকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্রিস রককে ঘুঁষি মেরে দেওয়া উইল স্মিথ। দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি বিরাটের ভালবাসা আমাদের পাড়ার রানাদার পর্ণা বউদির প্রতি ভালবাসার চেয়ে মহত্তর কিছু মোটেই নয়। বরং হয়ত কিছুটা নিকৃষ্টতরই। কারণ রানাদা রাস্তাঘাটে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে কাউকে বিশ্রীভাবে কথা বলতে দেখলে অন্তত একটু ধমকা-ধমকি করেন। কিন্তু দেশের লাঞ্ছিত মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে বিরাটের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

মনে রাখা ভাল, অনুষ্কা নিজেও কম নারীবাদী নন। তিনি একদা সুনীল গাভস্করের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ গাভস্কর বলেছিলেন অনুষ্কার বোলিংয়ে অনুশীলন করে বিরাটের লাভ হবে না। সেই অনুষ্কাও আজ চুপ। চুপ মানে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। দুটিতে কেমন জীবন উপভোগ করছেন তার তত্ত্বতাল্লাশ দিব্যি দিয়ে যাচ্ছেন টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে। তবে গাভস্করের বিরুদ্ধে লম্বা বিবৃতি দিয়েছিলেন, অলিম্পিয়ান মহিলাদের প্রতিবাদ নিয়ে এক লাইনও লেখেননি। অবশ্য পরীক্ষায় আনকমন প্রশ্ন এসে গেলে আমরাও সে প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম।

গম্ভীর আবার দিল্লি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। সেই দিল্লির যন্তর মন্তরেই কুস্তিগীরদের অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। যদিও ওই এলাকা গম্ভীরের কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু তিনি একজন জনপ্রতিনিধি তো বটেন। অবশ্য উনি সাংসদের দায়িত্ব খুব মন দিয়ে কোনোদিন পালন করেছেন বলে অভিযোগ নেই। উনি সারাবছর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ান, আইপিএলের সময়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন। কদিন পরে হয়ত ওই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সারাবছরই বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াবেন। কারণ লখনৌ সুপারজায়ান্টসে তাঁর পদটির নাম গ্লোবাল মেন্টর, আর ওই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার টি টোয়েন্টি লিগে দল কিনে বসে আছেন। আর কোথায় কোথায় কিনবেন কে বলতে পারে? এমন বিশ্বনাগরিকের কি আর যন্তর মন্তরের অবস্থান বিক্ষোভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কূপমণ্ডূকতা মানায়?

পিভি সিন্ধু, সায়না নেহওয়ালদেরও মুখে কুলুপ। ছবারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কম তো পিটি ঊষা গোত্রের, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির অতি ঘনিষ্ঠ, তাই নীরব। গত কয়েকদিন অবশ্য তাঁর রাজ্য মণিপুরে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। বিজেপি তাঁকে এত গুরুত্ব দেয় যে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে বলতে হচ্ছে “মাই স্টেট ইজ বার্নিং, কাইন্ডলি হেল্প”। যে নিখাত জারীনকে একসময় স্রেফ জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে অবজ্ঞা করতেন মেরি, সেই দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিখাত কিন্তু সরব হয়েছেন।

প্রাক্তন সাংসদ ভারতরত্ন ‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ডাগআউটে নিদ্রা গিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন? তবু তো দয়া করে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মুখ খুলেছেন। লর্ডসের ব্যালকনির চিরস্মরণীয় ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ভারী বিনীতভাবে বলেছেন, ওদের লড়াই ওরা লড়ুক। আমি তো খবরের কাগজে পড়ছি, যা জানি না তা নিয়ে তো কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে শচীন, সৌরভ দুজনেই কন্যাসন্তানের পিতা।

সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় তারকা খেলোয়াড়দের যা ইতিহাস, তাতে এঁরা মহম্মদ আলি হয়ে উঠবেন বলে কেউ আশা করে না। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা কিন্তু সাতে পাঁচে না থাকার নীতি অনেকটাই ত্যাগ করেছেন। ওঁরা এখন শচীন বা ঊষার মত শাসক দলের প্রসাদ গ্রহণ করে রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন, এ পদ সে পদ গ্রহণ করছেন, গম্ভীরের মত ভোটে লড়ে সাংসদ বা বিধায়কও হচ্ছেন। যাঁদের অত এলেম নেই তাঁরাও কোহলির মত করে নোটবন্দি হওয়া মাত্রই তা কত বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন তার বিরোধিতা করে টুইট করেছিলেন। সেওয়াগের মত কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস। শহিদ হওয়া সৈনিকের মেয়েকে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার জন্য ট্রোল করতেও ছাড়েননি। কেবল সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দরকার পড়লেই এঁরা কেউ নীরব হয়ে যান, কেউ এক-দু লাইনে কাজ সারেন। সেওয়াগ, কপিলদেব, হরভজন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মানুষ। কুস্তিগীরদের আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন হরিয়ানার কুস্তিগীররাই। তা না হলে এতেও ওই তিন প্রাক্তন মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

যে পদকজয়ী অলিম্পিয়ানরা আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি-ঘনিষ্ঠই ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে বা জয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করতে এঁদেরও কামাই ছিল না। এখন চোখের জলে সেসবের দাম দিতে হচ্ছে। এখনো যে মহাতারকারা নীরব, তাঁদের দেখে একটাই ভয় হয়। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়মোলারের অনুসরণে এঁদের না কোনোদিন আওড়াতে হয়, প্রথমে ওরা এসেছিল কুস্তিগীরদের জন্যে। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কুস্তিগীর নই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ক্রিকেট জেনেশুনে বিশ করেছে পান

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে।

শোয়েব আখতার যখন বল করতেন, মনে হত গোলাবর্ষণ করছেন। এখন বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার সময়েও প্রায় একই মেজাজে থাকেন। আজকাল প্রাক্তন ক্রিকেটাররা ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে কথা বলার সময়ে অতি মাত্রায় সাবধানী। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চটে গেলে এ দেশে ধারাভাষ্যের মহার্ঘ সুযোগ পাওয়া যাবে না, কোনো একটা ভূমিকায় আইপিএলের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজে ঢুকে সারা বছরের রোজগার দু-আড়াই মাসে করার সুযোগও হাতছাড়া হবে। শোয়েব পাকিস্তানি হওয়ায় ও দুটো দরজাই তাঁর জন্যে বন্ধ। সম্ভবত সে কারণেই নিজের দেশের বাবর আজম সম্পর্কে যেরকম তীর্যক মন্তব্য করেন, বিরাট কোহলি সম্পর্কেও সেভাবেই কথা বলেন। কোহলিকে আক্রমণ করে কদিন আগে বলেছেন “আমি কোহলিকে অনুরোধ করব ও যেন ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত খেলে। তাহলে আরও ৮-৯ বছর সময় পাবে। ভারত ওকে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থাতেও খেলাবে এবং একশোটা শতরান করা পর্যন্ত খেলতে দেবে। আমার মনে হয় ও অবসর পর্যন্ত অন্তত ১১০ খানা শতরান করে ফেলবে।”

কোনো সন্দেহ নেই ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যক্তিপূজা এমন প্রবল, যে কপিলদেবকে রিচার্ড হেডলির টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড ভাঙার জন্য, আর শচীন তেন্ডুলকরকে শততম শতরান করতে দেওয়ার জন্য, খেলোয়াড় হিসাবে ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও খেলতে দেওয়া হয়েছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনি অবশ্য রেকর্ড ভাঙার জন্য খেলে যাননি। তাঁর ফিনিশ করার ক্ষমতা ফিনিশ হয়ে গিয়ে থাকলেও বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের কোম্পানির ডিরেক্টরকে বাদ দেয় কোন নির্বাচকের সাধ্যি? বরং সেই ২০১১ সালে নির্বাচক কমিটির বৈঠকে ধোনিকে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় নির্বাচক মহিন্দর অমরনাথের চাকরিই নট হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কোহলিও যদ্দিন ইচ্ছা খেলে যেতেই পারেন। কিন্তু শোয়েবের ভুল হয়েছে অন্য জায়গায়।

কোহলির এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতরানের সংখ্যা ৭৫ (টেস্ট ২৮, একদিনের ক্রিকেট ৪৬, আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ১)। যতদিন পর্যন্তই খেলুন, আরও ২৫ খানা শতরান কোথা থেকে আসতে পারে ভেবে দেখুন। পরপর দুটো ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে ব্যর্থ হওয়ার পর (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্মরণীয় ইনিংসটা বাদ দিলে) ৩৪ বছরের কোহলিকে আর ওই ফরম্যাটে খেলানো হবে কিনা দেবা ন জানন্তি। বয়স বাড়লে টেস্টে শতরান করা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে যায় তা তো কোহলির গত চার বছরের খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাহলে হাতে রইল পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট, যাতে কোহলিকে এখনো মাঝে মধ্যে স্বমহিমায় দেখা যায়। কিন্তু ওই ফরম্যাটটির নিজেরই যে বাঁচা দায়।

শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। মাত্র ছমাস পরেই পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ, তাও আবার ভারতে। যেখানে পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের প্লাস্টিক বল দিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হলেও খেলা দেখতে লোক জমে যায়। এই তো কদিন আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়া একদিনের সিরিজ হয়ে গেল, তার আগে বাংলাদেশে সিরিজ হল। সেখানে গুরুত্বহীন ম্যাচে হলেও ঈশান কিষণ দ্বিশতরান করলেন, কোহলি শতরানের খরা কাটালেন। এমন সময়ে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট নিয়ে এমন কথা কেন? ঘটনা হল, যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে। সারা পৃথিবীতে টি টোয়েন্টি লিগগুলোর, মানে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের যত রমরমা হচ্ছে, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের দর্শক তত কমছে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, যে কর্মকর্তারাও চান না ওটা বেঁচে বর্তে থাক। নইলে ১৩ নভেম্বর ২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ফাইনালের পর ১৭, ১৯ আর ২২ তারিখ কেন তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড? মাত্র চারদিন আগে দাপটে কুড়ি ওভারের বিশ্ব খেতাব জয় করা ইংল্যান্ড তিনটে ম্যাচেই গোহারা হারে। সেই ফলাফলকে গুরুত্ব না দিলেও হয়ত চলে, ইংল্যান্ডের পর্যুদস্ত হওয়ার দায় ক্লান্তির উপর চাপানো তো একেবারেই চলে না, কারণ ইংল্যান্ডের একদিনের দলের অনেকেই ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলে ছিলেন না। কিন্তু আসল কথা হল অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ইংল্যান্ড খেলছে আর গ্যালারিতে মাছি তাড়ানোরও লোক নেই – এ জিনিস দুদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। খেলাগুলোর টিভি রেটিংয়ের অবস্থাও ছিল শোচনীয়।

এটা একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। ভারতেও যে কোনো দলের সঙ্গে খেলা থাকলেই মাঠ ভরে যাওয়ার দিন চলে গেছে। আইপিএলে টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে, সাংবাদিকরা সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে বাধ্য হন “দয়া করে কেউ টিকিট চাইবেন না।” কিন্তু পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে অন্তত কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মত বড় শহরে সে সমস্যা হয় না। শুধু যে দর্শকদের আগ্রহ কমছে তা নয়, খেলোয়াড়দেরও আগ্রহ কমছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস ইতিমধ্যেই একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে বসে আছেন। মানে গত বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় এবার বিশ্বকাপে খেলবেন না। তাঁর বয়স কিন্তু মাত্র ৩১। গতবছর জুলাই মাসে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর ডিসেম্বরে অবশ্য স্টোকস বলেছিলেন তিনি শুধু বিশ্বকাপটা খেলার কথা ভেবে দেখতেও পারেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার যে কারণগুলো দেখিয়েছিলেন, সেগুলো লক্ষ করার মত। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, বড্ড বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। তিন ধরনের ক্রিকেটের ধকল তাঁর শরীর নিতে পারছে না।

এই সমস্যা একা স্টোকসের নয়। ইংল্যান্ডের জোরে বোলার জোফ্রা আর্চার চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বসেছিলেন বেশ কয়েক বছর, চলতি আইপিএলে মাঠে ফিরলেন। ভারতের যশপ্রীত বুমরা কবে ফিরবেন এখনো পরিষ্কার নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় সব দলের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররাই বারবার চোট পাচ্ছেন, বিরাম নিতে হচ্ছে। কারণ আইপিএল দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেই ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জয়যাত্রা এখন ম্যাগেলানের মত পৃথিবী পরিক্রমায় বেরিয়েছে। পাকিস্তান সুপার লিগ, লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশের সঙ্গে এ বছর থেকে যোগ হল দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টোয়েন্টি আর সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আইএল টি টোয়েন্টি। শেষের দুটো আবার ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে আইপিএলের ঠিক পরেই। দুটো লিগেই দল কিনেছেন চেন্নাই সুপার কিংস, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, কলকাতা নাইট রাইডার্স, দিল্লি ক্যাপিটালস, লখনৌ সুপার জায়ান্টস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রাজস্থান রয়ালসের মত দলের মালিকরা। ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলো খেলোয়াড়দের যা পারিশ্রমিক দিচ্ছে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কম্ম নয়। ফলে ছাড়তে হলে একজন ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে খেলাই যে ছাড়বেন, ফ্র্যাঞ্চাইজের খেলা নয়, তা বলাই বাহুল্য। টেস্টের প্রতি স্টোকসের ভালবাসা আছে বলে একদিনের ক্রিকেট ছেড়েছেন, কেউ টেস্ট খেলাও ছাড়তে পারেন।

ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বোর্ড মিলে বিশ্ব ক্রিকেটকে যে ছাঁচে ঢেলেছে ২০১৪ সাল থেকে, তাতে অনেক ক্রিকেট বোর্ডেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ফলে ক্রিকেটারদের ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডও বাধ্য হয়েছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ট্রেন্ট বোল্টকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে অব্যাহতি দিতে। অর্থাৎ তিনি হয়ত টেস্ট ক্রিকেট আর খেলবেনই না, একদিনের ক্রিকেট কতটা খেলবেন তাতেও সন্দেহ আছে। আইপিএলের পারিশ্রমিকের সঙ্গে অবশ্য ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডও এঁটে উঠতে পারবে না অদূর ভবিষ্যতে। ইংল্যান্ডের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজের প্রতিবেদক টিম উইগমোর গত সপ্তাহেই লিখেছেন, আইপিএলের ক্রিকেটাররা যে পারিশ্রমিক পান তা আরও তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। কারণ এত বড় ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া লিগ পৃথিবীর অন্য যেসব খেলায় আছে, সেখানে দলগুলো মোট রাজস্বের অর্ধেক বা তারও বেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ (বাস্কেটবল লিগ) এনএফএল (আমেরিকান ফুটবল লিগ) এবং এমএলএসে (বেসবল লিগ) অন্তত ৪৮% দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ফুটবলের প্রিমিয়ার লিগ ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে রাজস্বের ৭১% খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের পিছনে ব্যয় করেছিল। সেখানে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো ব্যয় করে ১৮% বা তারও কম।

আরও পড়ুন বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

অতএব বুঝতেই পারছেন, শুধু পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট কেন, সারা বছর ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলে বেড়িয়ে ভবিষ্যতে টেস্ট ক্রিকেট খেলার উৎসাহও কজন ক্রিকেটারের থাকবে সন্দেহ। স্বভাবতই খেলার গুণমানের তফাত হবে, দর্শকদের আগ্রহেও ভাঁটা পড়বে। যেমন এই মুহূর্তে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে হচ্ছে। টেস্টের দর্শক ভারতেও কমে গেছে বেশ কিছুদিন হল। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে সপ্তাহান্তে কোহলির শতরান পূর্ণ করার দিনেও গ্যালারিতে মানুষের চেয়ে চেয়ার বেশি দেখা যাচ্ছিল। তবু কৌলীন্য আছে বলে কোহলি, স্টোকস, জো রুটের মত খেলোয়াড়রা এখনো ওই ক্রিকেটটা খেলতে চান। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের কিন্তু অবস্থা সঙ্গীন। বাঁচিয়ে রাখতে কী করা যায়? স্টোকস বলেছিলেন, সম্প্রতি রবি শাস্ত্রীও বলেছেন খেলাটাকে চল্লিশ ওভারে নামিয়ে আনার কথা। রোহিত বলেছেন নয়ের দশকের মত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট ফিরিয়ে আনা যায় কিনা ভেবে দেখা উচিত। কিন্তু খেলোয়াড়দের ম্যাচ খেলার সংখ্যা যদি না কমে, ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের পরিমাণ কমানোর দিকে যদি কর্তারা নজর না দেন, তাহলে চল্লিশ ওভারের ম্যাচ খেলতেই বা সেরা খেলোয়াড়দের কী করে পাওয়া যাবে?

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে। ওখানেই তো যত মধু। আইপিএলে দল বাড়িয়ে ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, কারণ মিডিয়া স্বত্ব বেচে পাওয়া টাকার পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০১৮-২২ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকায়, আর ২০২৩-২৭ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকায়। আইপিএল নামক এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল নিজেদের সূচিতে প্রতি বছর আড়াই মাস খালি রেখেছে। কারণ আইপিএলে ম্যাচের সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। বাড়তে বাড়তে ২০২৭ সালে তা পৌঁছবে ৯৪-তে। সঙ্গে থাকবে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ। তারপর পঞ্চাশ (বা চল্লিশ ওভারের) খেলা খেলবেন কারা? সে বছর বিশ্বকাপেই বা কতজনকে ফিট অবস্থায় পাওয়া যাবে? তাই বলছিলাম, কোহলি যদি ২০৩১ অব্দি খেলেও ফেলেন, শতরানের সেঞ্চুরির জন্য সবচেয়ে লাগসই ফরম্যাটটার অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ।

এই সময় কাগজের অধুনালুপ্ত রাবিবারিক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত

বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

রবীশ কুমার মোদীর দোষ দেখতে পায় না এমন মিডিয়ার নাম দিয়েছেন গোদি মিডিয়া, অর্থাৎ মোদীর কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়া। জানি না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়ার কী নাম হওয়া উচিত।

‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কথাটা কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ভারতীয় অর্থনীতির আলোচনায় খুব ব্যবহার করা হত। কোনো বাঙালি অর্থনীতিবিদ এর বাংলা করেছেন কিনা জানি না। তবে এর মোটামুটি মানে হল, জনসংখ্যার এক বড় অংশ বয়সে নবীন হওয়ার সুবিধা। এখন আমাদের যতই ভাঁড়ে মা ভবানী হোক, নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সকলেই বলতেন ভারতীয়দের একটা বড় অংশ যেহেতু এখন কর্মক্ষম অবস্থায় আছেন সেহেতু এদের কর্মসংস্থান জুগিয়ে দিলেই দেশ ফুলে ফলে ভরে উঠবে। তা সে ডিভিডেন্ড গত ৮-১০ বছরে কতটা পাওয়া গেল তা নিয়ে এখন বিস্তর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নতুন চাকরি হওয়ার বদলে আমাদের দেশে বেকারত্ব ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে একথা ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমমন্ত্রকই বলেছিল। ছোট ব্যবসার অবস্থা কী তা পাড়ার দোকানে কথা বললেই টের পাওয়া যায়। ভারতীয় ক্রিকেট দলের অবস্থাও কেমন যেন আমাদের অর্থনীতির মতই হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তরুণ প্রতিভার অভাব নেই একথা আমরা সেই মহেন্দ্র সিং ধোনির আমল থেকে শুনে আসছি। যেটুকু সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাতে সেই প্রতিভারা যে নেহাত খারাপ ফল দিয়েছে তা-ও নয়, অথচ ঘুরে ফিরে একই মুখ খেলে চলেছে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে এবং একের পর এক বিশ্বকাপে ডোবানোর পর এখন দ্বিপাক্ষিক সিরিজেও ডোবাচ্ছে।

অর্থনীতির ফাঁক ঢাকতে জিডিপির মানদণ্ডই বদলে দেওয়া হয়েছিল প্রয়াত অরুণ জেটলি অর্থমন্ত্রী থাকার সময়ে। অনেক বিরোধী দল এবং অর্থনীতিবিদ সেই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এমন এক চমৎকার বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে সফল হয়েছে টাকার জোরে, যেখানে কোনো সমালোচক নেই। উল্টে যাদের সমালোচক হওয়ার কথা, সেই সংবাদমাধ্যম এবং প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বোর্ডকে সাফল্যের মানদণ্ডগুলো বদলে ফেলতে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে আর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট জেতেনি ভারত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেমিফাইনালও পেরোতে পারেনি (২০১৪ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০২১ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ব্যতিক্রম। শেষেরটায় অবশ্য সেমিফাইনাল বলে কিছু ছিল না)। ২০২১ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে তো সেমিফাইনালেরও আগে ঘরে ফেরার বিমান ধরতে হয়েছিল। অথচ কাগজে, টিভিতে, খেলা চলাকালীন ধারাভাষ্যে সারাক্ষণ প্রচার করা হয় আমাদের দল বিশ্বসেরা। সেখানেই থেমে না থেকে বলা হয় এই দল ভারতের সর্বকালের সেরা। কেন? না আমরা প্রচুর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতি। প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট থাকার কারণে গত এক দশকে দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোর গুরুত্ব যে প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, সেকথা কেউ লেখেন না বা বলেন না। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চালু হওয়ার পরে পাঁচদিনের ক্রিকেটেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজের গুরুত্ব তো আসলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠা গেল কিনা, খেতাব জেতা গেল কিনা – তাতে। এসব বলা হয় না।

এ-ও বলা হয় না, যে সাদা বলের ক্রিকেটে ভারত আসলে গত শতাব্দীর ক্রিকেট খেলে চলেছে ২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকেই। রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান, পরে রোহিত আর কে এল রাহুল যেভাবে ইনিংস শুরু করতেন সেভাবে একদিনের ক্রিকেট খেলা হত প্রাক-জয়সূর্য-কালুভিথর্না যুগে। ২০১১ বিশ্বকাপে শচীন তেন্ডুলকর আর বীরেন্দ্র সেওয়াগ যেভাবে ভারতের ইনিংস শুরু করতেন সেটা মনে থাকলেও কথাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাঁদের অবসরের পরে তো একদিনের ক্রিকেটটা আরও বদলেছে। দু প্রান্ত থেকে দুটো বল দিয়ে খেলা শুরু হয়েছে। ফলে স্পিনারদের প্রভাব কমেছে, রিভার্স সুইং প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বল পুরনো না হলে ও দুটো হওয়া শক্ত। সঙ্গে আছে পাওয়ার প্লে, অর্থাৎ সারাক্ষণ বোলাররা নানারকম বিধিনিষেধের মধ্যে বল করছেন। ফলে রান করার কাজটা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। সেই কারণে ইনিংসের শুরুতে আরও বেশি রান করার রাস্তা নিয়েছে ইংল্যান্ডের মত দল, যারা সব ধরনের ক্রিকেটে গত এক-দেড় দশকে আইসিসি টুর্নামেন্টগুলোতে সবচেয়ে বেশি সফল। অন্যদিকে মন্থরভাবে শুরু করব, উইকেট হাতে রেখে পরে মারব – এই নীতি অবলম্বন করে আমাদের বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মা ঝুড়ি ঝুড়ি শতরান আর দ্বিশতরান করেছেন দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে। গড় দেখলে চোখ কপালে উঠে যাবে, কিন্তু আসল জায়গায় চাপের ম্যাচে বারবার ব্যর্থ এবং দলও হেরেছে। রোহিত তবু ২০১৯ বিশ্বকাপে অসাধারণ ধারাবাহিকতা দেখিয়েছিলেন (৯ ম্যাচে ৬৪৮ রান, গড় ৮১; শতরান ৫), বিরাট তো বিশ্বকাপে অন্য মানুষ হয়ে যান। তিনটে বিশ্বকাপ খেলে এখন অবধি মোটে দুটো শতরান। তার কোনোটাই নক আউট ম্যাচে নয়, একটা আবার ২০১১ সালে দুর্বল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। কেরিয়ারে গড় ৫৭.৩২, অথচ বিশ্বকাপে গড় ৪৬.৮১।

রবীশ কুমার মোদীর দোষ দেখতে পায় না এমন মিডিয়ার নাম দিয়েছেন গোদি মিডিয়া, অর্থাৎ মোদীর কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়া। জানি না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়ার কী নাম হওয়া উচিত। গোদি মিডিয়ায় কর্মরত অনেক সাংবাদিক যেমন বিবেক দংশনে ভোগেন, ভারতীয় ক্রিকেট কভার করা অনেক সাংবাদিকেরও একই অবস্থা। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে শচীন তেন্ডুলকর চরম ব্যর্থ হওয়ার পরে এবং ভারত প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেওয়ার পরে অত বড় ক্রিকেটারেরও চরম সমালোচনা হয়েছিল। এক সর্বভারতীয় ইংরেজি কাগজে শিরোনাম হয়েছিল ENDULKAR। অথচ কোহলি বছর চারেক হয়ে গেল দলের হোমেও লাগেন না, যজ্ঞেও লাগেন না। কারোর সাধ্যি নেই সেকথা লেখে। বরং এতকাল পরে সাদা বলের ক্রিকেটে দুটো অর্থহীন ম্যাচে (১. এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে, ২. বাংলাদেশের সঙ্গে একদিনের সিরিজ হেরে যাওয়ার পর তৃতীয় একদিনের ম্যাচে) শতরান করার পর রাজার প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি লিখতে হয়েছে। আমেদাবাদ টেস্টে ঢ্যাবঢেবে পিচে শতরান করে তাঁর টেস্টের রান খরাও সবে কেটেছে। গত কয়েক বছরে গড় নামতে নামতে ৪৮.৯৩ হয়ে গেছে। অথচ কথায় কথায় তাঁকে সর্বকালের সেরাদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসিয়ে দেওয়া কিন্তু থামেনি। যাঁদের সঙ্গে তাঁর নামোচ্চারণ করা হচ্ছে তাঁদের সকলের গড় পঞ্চাশের বেশি।

বলতে পারেন, এসব কথা লিখতে চাইলেই লেখা যায়? কেউ কি বারণ করেছে? তা করেনি বটে, তবে লিখে ফেললে সাংবাদিকের চাকরিটি নট হয়ে যেতে পারে। বিশ্বাস না হলে হর্ষ ভোগলেকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। তিনি কারোর সমালোচনাও করেননি। মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়ক থাকার সময়ে টুইটারে অমিতাভ বচ্চনের একটি অন্যায় সমালোচনা, যা আবার ধোনি সমর্থন জানিয়ে রিটুইট করেছিলেন, তার প্রতিবাদে ভদ্র ভাষায় জানিয়েছিলেন, সারাক্ষণ ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রশংসা করা একজন ধারাভাষ্যকারের কাজ নয়। সেবার ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে চুক্তি পুনর্নবীকরণের সময় এলে দেখা যায় হর্ষ বাদ পড়েছেন। রবীন্দ্র জাদেজাকে “বিটস অ্যান্ড পিসেজ ক্রিকেটার” বলার অপরাধে একই অবস্থা হয়েছিল সঞ্জয় মঞ্জরেকরের। তা অত নামকরা লোকেদেরই যদি ওই অবস্থা হয় তাহলে খবরের কাগজ, নিউজ এজেন্সি বা ওয়েবসাইটের একজন নগণ্য সাংবাদিকের কী অবস্থা হতে পারে ভেবে দেখুন। হর্ষ আর সঞ্জয় তবু কিছুদিন পরে, কে জানে কোন শর্তে, আবার বোর্ডের তালিকায় ফিরতে পেরেছেন। সাংবাদিকের তো একটি ফোনে চাকরি চলে যাবে এবং তারকাদের চটিয়ে চাকরি গেলে আর কোথাও চাকরি হবে না।

যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখা যাক, ভারতের মাটিতে যত ক্রিকেট ম্যাচ হয় তার টিভি সম্প্রচারের প্রযোজক ভারতীয় বোর্ড। খেলা আপনি স্টার নেটওয়ার্কেই দেখুন আর সোনিতেই দেখুন। ফলে ধারাভাষ্যকাররা অধিকাংশই বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, সম্প্রচারকারীর সঙ্গে নয়। যাঁরা সম্প্রচারকারীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ তাঁরাও জানেন বোর্ডের অপছন্দের কথা বললে সম্প্রচারকারীও বিদায় করে দেবে, বোর্ডের সঙ্গে বিবাদ করে ব্যবসা গুবলেট করার ঝুঁকি নেবে না। এখানকার সম্প্রচার স্বত্ব পরম প্রার্থিত বস্তু। এই ব্যবস্থা ক্রিকেটবিশ্বের আর কোনো দেশে চালু নেই। সব দেশেই ক্রিকেট বোর্ড আলাদা, সম্প্রচারকারী এবং তার ধারাভাষ্যকাররা স্বাধীন। ফলে ইংল্যান্ডের খেলায় আপনি নাসের হুসেনকে জো রুট বা বেন স্টোকসের সমালোচনা করতে শুনবেন, কিন্তু ভারতীয় ব্যাটিং গোটা সিরিজে জঘন্যভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরেও বুধবার (২২ মার্চ ২০২৩) অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তৃতীয় একদিনের ম্যাচে দীনেশ কার্তিক বলেছেন এই সিরিজে ব্যাটারদের পারফরম্যান্স “প্রিটি অ্যাভারেজ”। প্রথম ম্যাচে ভারতের প্রথম চার উইকেট পড়ে গিয়েছিল ৩৯ রানে, মাত্র ১০.২ ওভারে। পঞ্চম উইকেট পড়ে যায় ৮৩ রানে, তখন মাত্র ১৯.২ ওভার খেলা হয়েছে। দ্বিতীয় ম্যাচে তো গোটা দল আউট হয়ে যায় ১১৭ রানে, ২৬ ওভারের মধ্যে। শেষ ম্যাচে যথেষ্ট ভাল শুরু করার পরেও শেষ সাত উইকেট পড়ে গেছে ১০২ রানে। এই ব্যাটিং যদি “প্রিটি অ্যাভারেজ” হয় তাহলে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, ওয়েবস্টার – সমস্ত প্রামাণ্য ইংরেজি অভিধানের সম্পাদকমণ্ডলীকে সত্বর জানানো দরকার যে ‘অ্যাভারেজ’ শব্দটার মানে বদলে গেছে। অবশ্য কার্তিক তো শিশু, প্রবাদপ্রতিম সুনীল গাভস্করকেও সারাক্ষণ অত্যুক্তি করে যেতে হয়। একবার আইপিএল চলাকালীন মুখ ফুটে বলেছিলেন, লকডাউনের সময়ে কোহলি যথেষ্ট অনুশীলন করতে পাননি। হালকা মেজাজে যোগ করেছিলেন, একটা ভিডিওতে দেখলাম অনুষ্কার সঙ্গে খেলছিল। ওই অনুশীলনে কোনো লাভ হবে না। অমনি এক রাগত ইন্সটাগ্রাম পোস্ট করে ট্রোলবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীমতি কোহলি

এসব কথা বলছি কারণ ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের মাত্র মাস ছয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ হারের যথার্থ মূল্যায়ন করতে গেলে ভারতীয় ক্রিকেটের এই গোটা বাস্তুতন্ত্রকে বোঝা দরকার। টাকা এবং ট্রোলবাহিনীর জোরে ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রিকেটাররা সমস্ত সমালোচকের মুখ বন্ধ করে দিতে পারেন, একগাদা হোম সিরিজের আয়োজন করতে পারেন যাতে আমাদের ক্রিকেটারদের রেকর্ডগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিন্তু রোহিত, কোহলি, রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজাদের বয়স তো কমাতে পারেন না। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁদের রিফ্লেক্স কমছে, লম্বা ইনিংস খেলার শারীরিক ক্ষমতা এবং মানসিক দক্ষতাও কমছে। ফলে আগে অন্তত দ্বিপাক্ষিক সিরিজে যে কৌশলে খেলে দলকে জয় এনে দিতে পারছিলেন, তা আর পেরে উঠছেন না। বুধবার যেমন ‘চেজমাস্টার’ বিরাট তাঁর চিরাচরিত রান তাড়া করার কায়দায় শুরু করেও শেষপর্যন্ত টানতে পারলেন না। রাহুল যে দ্রুত রান করতে পারেন না তা আর কতবার প্রমাণিত হলে কোচ রাহুল দ্রাবিড়, অধিনায়ক রোহিত এবং নির্বাচকরা তাঁকে অপরিহার্য ভাবা বন্ধ করবেন তাঁরাই জানেন। রাহুল এই সিরিজের প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৭৫ রান করে দলকে জিতিয়ে দেওয়ায় আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে শোনা গিয়েছিল তিনি নাকি সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল সে ম্যাচে জিততে হলে মাত্র ১৮৯ রান করতে হত, কোনো তাড়া ছিল না। ফলে রাহুল আপন মনে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বুধবারের খেলায় লক্ষ্য ছিল ২৭০, তবুও তিনি বিরাটের মত ১-২ রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখার তাগিদ দেখাননি। বত্রিশ রান করতে নিয়ে নিলেন ৫০ বল। এইভাবে নিজেই নিজের উপর চাপ বাড়াতে বাড়াতে একসময় হঠাৎ ‘পিটিয়ে ঠান্ডা করে দেব’ ভঙ্গিতে ব্যাট করতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন। এহেন রাহুলকে আবার টিম ম্যানেজমেন্ট ঋষভ পন্থের অনুপস্থিতিতে বিশ্বকাপের পাকাপাকি উইকেটরক্ষক হিসাবেও ভাবছে। এখন উপায়?

এখানেই এসে পড়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড জলে যাওয়ার প্রশ্ন। হাতের কাছেই আছেন ঈশান কিষণ। যিনি এই সিরিজে অধিনায়ক রোহিত খেলেননি বলে মোটে একটা ম্যাচে খেলার সুযোগ পেলেন। তিনি এখন অবধি ১৪ একদিনের ম্যাচে ৪২.৫০ গড়ে রান করেছেন, একমাত্র শতরানটা আবার ২১০। অথচ তাঁকে মিডল অর্ডারে ভাবা যাচ্ছে না। ঈশানের বয়স তবু ২৪, তাঁর থেকে ডিভিডেন্ড পাওয়ার এখনো সময় আছে। এই সিরিজে দলের বাইরে ছিলেন আরেকজন উইকেটরক্ষক ব্যাটার, যিনি এখন অবধি ১১ একদিনের ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ৬৬ গড়ে রান করেছেন, স্ট্রাইক রেটও একশোর বেশি। অথচ কিছুতেই তাঁকে টানা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সেই সঞ্জু স্যামসনের বয়সে দেখতে দেখতে ২৯ হতে চলল। হয়ত এই বিশ্বকাপের দলেও তাঁকে রাখা হবে না। কারণ সাত বছর এবং একটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলার পরেও যে ৩১ বছর বয়সীর ব্যাটিং অর্ডারই পাকা করা যাচ্ছে না, সেই রাহুল দলকে নতুন কিছু দিতে পারেন বলে বিশ্বাস করে টিম ম্যানেজমেন্ট।

পঁয়ত্রিশ হতে চলা বিরাট কোনোদিনই স্পিনের বিরুদ্ধে দারুণ ব্যাটার ছিলেন না। বছর তিনেক হল মাঝের ওভারগুলোতে কিছুতেই স্পিনারদের মেরে উঠতে পারেন না, মারতে গেলেই আউট হয়ে যান। ঠিক যেমন বুধবার হলেন। অথচ উপমহাদেশে বিশ্বকাপ, মাঝের ওভারগুলোতে স্পিনাররাই বেশি বল করবেন। বিশ্বকাপের আগেই ছত্রিশে পা দেবেন অধিনায়ক রোহিত। এই দলে একমাত্র তিনিই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে স্পিনারদের মারতে পারেন। কিন্তু তাঁর ধারাবাহিকতাও ক্রমশ কমছে। ইদানীং বল ঘুরলে বেশ অসুবিধায় পড়ছেন, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে প্রকট হয়েছে সমস্যাটা। এদিকে বল সুইং করলে তাঁকে চিরকালই কিঞ্চিৎ দিশাহারা দেখায়। সেই কারণেই টেস্ট ক্রিকেটে বিরাটের অর্ধেক সাফল্যও পাননি। এঁরা আমাদের ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ।

অবশ্য শুধু ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে দুশ্চিন্তার প্রতি অবিচার করা হবে। মনে রাখা ভাল, আমরা ডিসেম্বরে বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হেরেছি আর মার্চে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ হারলাম স্রেফ ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে নয়। মাঝে যে সিরিজে শ্রীলঙ্কাকে ৩-০ হারিয়েছি সেখানেও প্রথম ম্যাচে তারা ৩৭৩ রানের জবাবে ৩০৬ তুলে ফেলেছিল। অধিনায়ক দাসুন শানাকা ৮৮ বলে ১০৮ রান করে অপরাজিত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সুইং সহায়ক পরিবেশে ভারতের ব্যাটিং শুয়ে পড়লেও অস্ট্রেলিয়ার ১২১ রান তুলতে লেগেছে মাত্র ১১ ওভার, একটাও উইকেট খোয়াতে হয়নি। সবচেয়ে সিনিয়র বোলার মহম্মদ শামির মধ্যেও ধারাবাহিকতার অভাব স্পষ্ট। আমাদের বিরাট ভরসা যশপ্রীত বুমরা বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কিনা এখনো অনিশ্চিত, সাদা বলের ক্রিকেটে দীর্ঘদিন নির্ভরতা দেওয়া ভুবনেশ্বর কুমারও সাম্প্রতিক টি টোয়েন্টি ব্যর্থতার পর দলের বাইরে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের নির্বাচিত দলের দিকে তাকালে কতকগুলো আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করা যাবে।

এই দলে ছিলেন না ২৪ বছরের অর্শদীপ সিং, যিনি টি টোয়েন্টিতে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিণতির পরিচয় দিয়েছেন এবং মাত্র তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। অথচ ছিলেন ৩১ বছরের জয়দেব উনড়কত, যিনি দেশের জার্সিতে শেষ একদিনের ম্যাচ খেলেছেন ২০১৩ সালে। আমাদের সবেধন নীলমণি জোরে বোলার অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া সম্পূর্ণ ফিট এবং ব্যাটে, বলে চমৎকার খেললেন। তা সত্ত্বেও দলে ছিলেন মোটামুটি একই কাজের লোক শার্দূল ঠাকুর। তাঁর বয়স ৩১। প্রথম ম্যাচে দুজনেই একসঙ্গে খেলেও ফেললেন। শার্দূলকে মাত্র দু ওভার বল করতে দেওয়া হল আর ব্যাট করার কথা ছিল আট নম্বরে। তার দরকার পড়েনি। দ্বিতীয় ম্যাচে শার্দূলের জায়গায় এসে পড়লেন অক্ষর প্যাটেল, ভারত একসঙ্গে তিনজন বাঁহাতি স্পিনারকে খেলাল। এদিকে দেখা গেল পিচ জোরে বোলারদের উপযোগী। মিচেল স্টার্ক একাই পাঁচ উইকেট নিলেন, বাকিগুলো শন অ্যাবট আর নাথান এলিস। এসব দৃশ্য বেঞ্চে বসে দেখলেন ২৩ বছরের উমরান মালিক। তিনি আজকের ক্রিকেটে বিরল সেই প্রজাতির বোলার, যাঁর গড় গতি ঘন্টায় ১৪৫ কিলোমিটার বা ৯০ মাইলের বেশি। বিশাখাপত্তনমে তিন ওভারে ২৫ রান দেওয়া অক্ষরই চেন্নাইয়ের সিরিজ নির্ধারক ম্যাচেও খেললেন। দুটো উইকেট নিলেও আট ওভারে ৫৭ রান দিলেন আর বিশেষজ্ঞ ব্যাটার সূর্যকুমার যাদব তো বটেই, হার্দিকেরও আগে ব্যাট করতে এসে চার বলে দু রান করে রান আউট হয়ে গেলেন। তিন স্পিনারই খেলাতে হলে হাতে কিন্তু অফস্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দরও ছিলেন। তাঁর আর অক্ষরের মধ্যে কে বেশি ভাল ব্যাট করেন তা তর্কসাপেক্ষ। লেগস্পিনার যজুবেন্দ্র চহলও ছিলেন, যিনি কিছুদিন আগেও ছিলেন টিম ম্যানেজমেন্টের নয়নমণি। হঠাৎ ২০২১ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে অকর্মণ্য প্রমাণিত হয়েছেন। সেবার দলেই ছিলেন না, পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গিয়েও খেলানো হল না।

বুধবার চেন্নাইতে দেখা গেল ভারতের তিন স্পিনারের মধ্যে কুলদীপ যাদব ছাড়া বাকিরা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারলেন না। অক্ষর মার খেলেন, জাদেজা উইকেট নিতে পারলেন না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পা আর অ্যাশটন অ্যাগারই আসলে ম্যাচটা জিতে নিলেন। তাঁদের দুজনের কুড়ি ওভারে মাত্র ৮৬ রান উঠল, চলে গেল ছটা উইকেট। ভারতের মাটিতে এমন ভেলকি দেখাতে স্বয়ং শেন ওয়ার্নও পারেননি। মানে এই সিরিজ হার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ভারতীয় ব্যাটাররা বল সুইং করলেও হাবুডুবু খান, স্পিন করলেও হাবুডুবু খান। মানতেই হবে দ্বিতীয়টা নতুন লাগছে। বিশেষত ভারতের এই দলকে যেহেতু সেই রবি শাস্ত্রী-কোহলির আমল থেকে সর্বকালের সেরা দল বলে দাবি করা হচ্ছে। শাস্ত্রী টিম ডিরেক্টর থাকার সময়ে স্বয়ং এই দাবি করেছিলেন, তারপর যথারীতি ভারতের সংবাদমাধ্যম বারবার লিখে এবং বলে ব্যাপারটা সকলকে বিশ্বাস করাতে উদ্যোগী হয়েছে। অথচ দেশের মাঠে ভারতকে হারানো চিরকালই শক্ত। স্টিভ ওয়র বিশ্বরেকর্ডধারী দলও পারেনি। কোহলি, রোহিতরা ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ডে সিরিজ জেতেননি, যার একাধিক নজির ভারতীয় ক্রিকেটে আছে। এমনকি তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল দক্ষিণ আফ্রিকা দলের কাছেও হেরে এসেছে। বস্তুত দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া বর্তমান প্রজন্ম এমন কিছুই করেনি যা ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তাও টেস্ট ক্রিকেটে। সাদা বলের ক্রিকেটে বলার মত একটা সাফল্যও গত দশ বছরে আসেনি। বরং ভিতরে ভিতরে যেসব বিপ্লব ঘটে গিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছিল, সেগুলোর টিকি পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের নাকি অফুরন্ত জোরে বোলারের জোগান তৈরি হয়েছে। কোথায় তাঁরা? এক বুমরার অনুপস্থিতিতেই এত ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে কেন বোলিংকে? টেস্টে এখনো কেন খেলিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৩৬ বছর বয়সী অত্যন্ত মাঝারি মানের বোলার উমেশ যাদবকে? যা অবস্থা তাতে আইপিএলে ভাল বল করলে হয়ত ভুবনেশ্বরকেও বিশ্বকাপের জন্য ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁরও তো বয়স ৩৩। মাঝে মাঝে উদয় হন খলীল আহমেদ, নভদীপ সাইনি, দীপক চহর, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণর মত তরুণ বোলাররা। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষণ দেখেন তাঁদের মধ্যে এবং আমাদের দেখান। তারপর সেই বোলাররা বাদ পড়েন বা চোট পান, আর ফেরেন না। কোন কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যান?

এত চোটই বা হয় কেন? শুধু তো বোলার নয়, ব্যাটাররাও দেখা যাচ্ছে বসে বসেই চোট পেয়ে যান। যে শ্রেয়স আয়ার একদিনের ক্রিকেটে মিডল অর্ডারকে ভরসা দেবেন ভাবা হচ্ছিল, হঠাৎ আমেদাবাদ টেস্টে তিনি চোটের কারণে ব্যাট করতে নামলেন না। এখন জানা যাচ্ছে সে নাকি এমন চোট যে আইপিএল খেলাও অনিশ্চিত। এর আগে এমন অদ্ভুত চোট রাহুল পেয়েছেন, রোহিত পেয়েছেন। এর কারণ কি অতিরিক্ত ক্রিকেট? যদি তাই হয় তাহলে সুরাহা কী? বুধবারের হারের পর অধিনায়ক রোহিত সাঁইবাবাসুলভ দার্শনিকতায় বলে দিয়েছেন, খেলোয়াড়দের চোট সমস্যা তৈরি করছে ঠিকই, কিন্তু আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোই সব ক্রিকেটারের মালিক। তারাই ঠিক করবে কে কতগুলো ম্যাচ খেলবে না খেলবে।

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট: জাহান্নামের আগুনে পুষ্পের হাসি

তাহলে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের তরুণ প্রতিভারা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে ক্রমশ ডেমোগ্রাফিক লায়াবিলিটিতে পরিণত হচ্ছেন। যে সূর্যকুমার যাদব গত দুবছর টি টোয়েন্টিতে চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং করে একদিনের দলে জায়গা করে নিয়েছেন এবং যাঁকে দুটো ম্যাচে প্রথম বলে আউট হয়েছেন বলেই তৃতীয় ম্যাচে সাত নম্বরে ঠেলে দেওয়া হল, তিনিও কিন্তু দীর্ঘদিন ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করে যাওয়া সত্ত্বেও প্রথম সুযোগ পেয়েছেন ৩১ বছর বয়সে। কারণ তারকাদের বাদ দেওয়া বা ব্যাটিং অর্ডার বদলানো প্রায় অসম্ভব। অথচ অস্ট্রেলিয়াকে দেখুন। মিচেল মার্শ ওপেন করতে এসে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করছেন, তাই ডেভিড ওয়ার্নারের মত সিনিয়রকেও মিডল অর্ডারে খেলতে হল। বুমরা আর আয়ার ছিলেন না বলে অস্ট্রেলিয়ার এই জয়কে তুচ্ছ করাও বোকামি হবে। কারণ বুমরা অনেকদিন ধরেই নেই, আমরা তাঁর বিকল্প তৈরি করতে পারিনি। আর আয়ারের অনুপস্থিতিই যদি ঢাকতে না পারেন তাহলে আর রোহিত, বিরাটরা, রাহুলরা কিসের বড় ব্যাটার? বরং অস্ট্রেলিয়ার দলে ছিলেন না তাদের অন্যতম সেরা দুই পেসার – অধিনায়ক প্যাট কামিন্স (মায়ের মৃত্যুর ফলে) আর জশ হেজলউড (চোটের কারণে)। মিচেল স্টার্কের সঙ্গে মিডিয়াম পেসার মার্কাস স্তোইনিস আর অজিদের দ্বিতীয় সারির শন অ্যাবটকে সামলাতেই হিমসিম খেল তথাকথিত বিশ্বসেরা ভারতীয় ব্যাটিং। তাও তো অপরিণত ব্যাটিং করে প্রথম ম্যাচটা ভারতকে প্রায় উপহার দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটাররা, নইলে কী হত কে জানে?

আজকাল কোনো বিষয়েই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করার চল নেই। কিন্তু বিশ্বকাপের বছর বলেই হয়ত এসব নিয়ে অনেক ক্রিকেটভক্ত একটু চিন্তিত। তবে দেশের ক্রিকেটকর্তারা মোটেই চিন্তিত নন। একটা দেশের ক্রিকেট চালাতে গেলে ন্যূনতম যে কাঠামোগুলো দরকার হয় সেগুলোকে ঠিক রাখার প্রয়োজনও তাঁরা বোধ করেন না। নইলে নির্বাচন কমিটি নিয়ে এই ধাষ্টামো চলত নাকি?

২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির ব্যর্থতার জন্য চেতন শর্মার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিটিকে গত নভেম্বরে বরখাস্ত করা হল ঘটা করে। তারপর দুমাস কারা নির্বাচক ছিলেন কেউ জানে না। জানুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচন কমিটি হল, যার নেতৃত্বে সেই চেতনই। একমাস পরেই আরেক নাটক। এক টিভি চ্যানেলের স্টিং অপারেশনে চেতনকে বিরাটের নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া নিয়ে কিছু ভিতরের খবর ফাঁস করতে দেখা গেল। অতঃপর ঘোষণা করা হল তিনি নাকি বোর্ড সভাপতি জয় শাহের কাছে স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তা না হয় দিলেন, কিন্তু তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন কে? কেউ না। বহুকাল হল নির্বাচন কমিটির প্রধান সশরীরে দল ঘোষণা করেন না, কাকে নেওয়া হল, কাকে নেওয়া হল না তা নিয়ে কোনো প্রশ্নোত্তরের সুযোগ থাকে না। এরপর হয়ত নির্বাচন কমিটিই থাকবে না। দরকারই বা কী? ক্রিকেটারদের মালিক যখন ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো, জাতীয় দল নির্বাচনটাও তারাই করে দিতে পারে তো। দেশের ব্যাঙ্ক, বিমা, বন্দর, বিমানবন্দর – সবই যখন গুটি কয়েক লোকের মালিকানায় চলে যাচ্ছে, ক্রিকেট দলটাও তাই যাক না। এমনিতেও যে দল দেশ চালায় সেই দলই তো ক্রিকেট বোর্ড চালাচ্ছে। ক্রিকেটাররা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেই দলের নির্বাচনী পোস্টারে মুখও দেখাচ্ছেন। তাহলে এক যাত্রায় আর পৃথক ফল হবে কেন? বিশ্বকাপ ভুলে যান। আগামী শুক্রবার থেকে আইপিএল দেখুন মনের সুখে।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

ভারতীয় ক্রিকেট: জাহান্নামের আগুনে পুষ্পের হাসি

কেবল টি টোয়েন্টি নয়। রোহিত, শিখর ধাওয়ান, কোহলিরা একদিনের ক্রিকেটে যে ব্যাটিংটা করেন সেটাও প্রায় প্রাক-জয়সূর্য-কালু যুগের ব্যাটিং।

হে (ক্রিকেট) অতীত, তুমি হৃদয়ে আমার…

রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা সোশাল মিডিয়া প্রজন্মের ক্রিকেটার। তাঁরা খুব ইতিহাসের তোয়াক্কা করবেন এমন ভাবা অন্যায়। কিন্তু ভারতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের খেলোয়াড় জীবন থেকেই একটা ব্যাপারে দারুণ সুনাম। তিনি নাকি নিজের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে পড়ুয়া। যে কোনো সফরে তিনি কিছু না কিছু পড়েন। সেসব বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে ক্রিকেটের ইতিহাস। বিভিন্ন ক্রিকেট সাংবাদিক একাধিকবার এসব কথা লিখেছেন, তাই বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। উপরন্তু দ্রাবিড় যে সুবক্তা তা আমরা সকলেই জানি। শুধু ইংরেজিটা চমৎকার বলেন তা নয়, বক্তব্যও থাকে জোরালো। দ্রাবিড়ের ২০১১ সালের ‘স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান ওরেশন’ এত উৎকৃষ্ট ছিল যে তা নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছিল। যে লোক বই পড়ে না তার পক্ষে অত সুন্দর কথা বলা সম্ভব নয়।

এহেন পড়ুয়া এবং ক্রিকেট ইতিহাস সচেতন দ্রাবিড় কি জানেন না যে অস্ট্রেলিয়া যেমন গ্লেন ম্যাকগ্রা, ডেনিস লিলি, জেফ থমসন, ব্রেট লি-র দেশ তেমনই রিচি বেনো আর শেন ওয়ার্নেরও দেশ? বল ঘোরাতে জানেন এমন লেগস্পিনাররা বরাবরই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সফল হন, কারণ সে দেশের পিচের অতিরিক্ত বাউন্স তাঁদের ঘূর্ণিকে আরও বিষাক্ত করে তোলে। এই মুহূর্তে পায়ে গুলি খেয়ে হুইলচেয়ারে বন্দি ইমরান খান জানেন, ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ে কত বড় ভূমিকা ছিল লেগস্পিনার মুস্তাক আহমেদের। নটা ম্যাচে ১৬ খানা উইকেট নিয়েছিলেন ১৯.৪৩ গড়ে, ওভার পিছু রান দিয়েছিলেন চারেরও কম। সেরা বোলিং করেছিলেন একেবারে ফাইনালে। মেলবোর্নের বিশাল মাঠে ইংল্যান্ড অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ আর অলরাউন্ডার ডারমট রিভ মুস্তাককে মারতে গিয়ে আউটফিল্ডে ক্যাচ তুলে আউট হন। গ্রেম হিক ঠকে যান মুস্তাকের গুগলিতে।

লেগস্পিনারদের কথা বলে আলোচনা শুরু করলাম কেন? ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ফাইনালে ১৯৯২ সালের মতই আবার পাকিস্তান আর ইংল্যান্ড মুখোমুখি বলে? না। ভাগবত চন্দ্রশেখর আর অনিল কুম্বলের দেশ ভারত একজন পরীক্ষিত ও সফল লেগস্পিনারকে ডাগআউটেই বসিয়ে রেখে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিল বলে। যজুবেন্দ্র চহলের অস্ট্রেলিয়া সফর বেঞ্চে বসে শেষ হয়ে যাওয়াই ভারতের এবারের অভিযানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট যে আগাগোড়া ভুল পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ব খেতাব জিততে গিয়েছিল, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ নেই। মাঠে নেমে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে সেসবের আলোচনা তো হবেই। কিন্তু পরিকল্পনাতেই ভুল থাকলে মাঠে নেমে আর ঠিক কাজটা করা হবে কী করে?

ভারতের মত দেশে ক্রিকেট বোঝে না এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম। ফলে অগণিত ক্রিকেটবোদ্ধাদের মধ্যে কেউ বলে বসতেই পারেন, ১৯৯২ সালের বস্তাপচা ৫০ ওভারের ক্রিকেটের ধারণা দিয়ে আজকের টি টোয়েন্টি ক্রিকেটকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া বোকামি। আচ্ছা, ইতিহাস চুলোয় যাক। এবারে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে লেগস্পিনাররা কী করেছেন সেটাই না হয় দেখা যাক।

সুপার ১২ স্তর থেকে ফাইনালের আগে পর্যন্ত মোট নজন লেগস্পিনার খেলেছেন (ইংল্যান্ডের দুজন; আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবোয়ের একজন করে)। এঁরা মোট ১৩১ ওভার বল করে তুলে নিয়েছেন ৪১টা উইকেট। উইকেট পিছু খরচ করতে হয়েছে মাত্র ২২.২৯ রান, ওভার পিছু রান দিয়েছেন সাতেরও কম। একজনও লেগস্পিনারকে খেলায়নি ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস আর বাংলাদেশ – ঠিক যে চারটে দেশ সেমিফাইনালে পৌঁছতে পারেনি।

যা শত্রু পরে পরে

এই আলোচনা শুরুতেই সেরে নেওয়ার আরেকটা কারণ হল, ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা সেমিফাইনালে গোহারা হারার পর সটান দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন বোলারদের ঘাড়ে। স্বয়ং অধিনায়ক সমেত ব্যাটাররা কী করেছেন সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে তাই বলে নেওয়া দরকার যে ঠিকঠাক বোলারদের খেলানোই হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় খেলা হলেই সমস্ত আলোচনা জোরে বোলারদের নিয়ে হয়ে থাকে। কারণ সবাই জানে সে দেশের পিচ অন্য দেশের তুলনায় গতিময় হয়, বাউন্স বেশি থাকে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে অস্ট্রেলিয়ায় জিততে হলে দলে ভাল স্পিনার থাকা একইরকম জরুরি, বিশেষ করে সীমিত ওভারের খেলায়। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিকেটমাঠগুলো অস্ট্রেলিয়াতেই। যাঁরা নিয়মিত টি টোয়েন্টি ক্রিকেট দেখে অভ্যস্ত তাঁরা জানেন, এই ফরম্যাটে সর্বত্রই বাউন্ডারি ছোট করে ফেলা হয়। ফলে দৌড়ে তিন রান নেওয়ার ঘটনা প্রায় দেখাই যায় না ভারত বা সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর মাঠে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলো এতটাই বড় যে বাউন্ডারি কমিয়ে আনার পরেও এবারের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে প্রচুর তিন রান হতে দেখা গেছে। ভারতের সঙ্গে সেমিফাইনালে মহম্মদ শামির অবিমৃশ্যকারিতায় জস বাটলার একবার দৌড়ে চার রান পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছেন। তা এত বড় বড় মাঠে স্পিনারকে চার, ছয় মারতে গেলে আউট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই টি টোয়েন্টি যুগের আগেও যে দলে ভাল স্পিনার আছে তারা অস্ট্রেলিয়ায় ভাল ফল করেছে।

১৯৯২ সালে কেবল পাকিস্তানের মুস্তাক নয়, নিউজিল্যান্ডের অফস্পিনার দীপক প্যাটেলও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন এই কারণে। স্পিনার যে বোলিং ওপেন করতে পারে তার আগে কেউ কখনো ভাবেনি। প্রয়াত মার্টিন ক্রোয়ের ওই চাল প্রতিপক্ষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল। প্যাটেল বেশি উইকেট নিতে পারেননি, কিন্তু ওভার পিছু রান দিয়েছিলেন ৩.১০। আরও আগে ১৯৮৫ সালে ভারত যখন অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জেতে, সেই জয়েরও অন্যতম স্থপতি ছিলেন লেগস্পিনার লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ।

অথচ এবার চহলের বদলে খেলে গেলেন অক্ষর প্যাটেল। যিনি উচ্চতার কারণে পিচ থেকে বাউন্স আদায় করতে পারেন বটে, কিন্তু বল ঘোরাতে হলে তাঁর দরকার স্লো টার্নার। অস্ট্রেলিয়ায় অমন পিচ পাওয়া যায় না, বরং সমান বাউন্সের পিচ হওয়ায় অক্ষরের মত বোলারকে মনের সুখে প্রহারেণ ধনঞ্জয় করা যায়। হয়েছেও তাই। অক্ষর প্রায় ৪০ গড়ে পাঁচ ম্যাচে মোটে তিনটে উইকেট নিয়েছেন, ওভার পিছু সাড়ে আটের বেশি রান দিয়েছেন। কিন্তু বোলিং আক্রমণের একমাত্র সমস্যা তিনি নন। দীর্ঘদিন সাদা বলের ক্রিকেটে টিম ম্যানেজমেন্টের অপছন্দের বোলার হয়ে থাকার পর রোহিত-দ্রাবিড়ের আমলে অশ্বিন হঠাৎই প্রিয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি প্রায় কোনো ম্যাচেই কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি। অথচ পিচে স্পিনারদের জন্য যথেষ্ট সাহায্য ছিল। সেমিফাইনালের অ্যাডিলেডে তো ছিলই। চহলের চেয়ে অক্ষরের ব্যাটিং ক্ষমতা বেশি, তাই তাঁকে খেলানোই সমীচীন – এমন একটা যুক্তি টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ দেখা গেল প্রায়ই তাঁর আগে ব্যাট করতে নামছেন অশ্বিন। তাহলে আর চহল খেললে কী ক্ষতি ছিল?

পেস বোলিং বিভাগে আবার গোড়ায় গলদ। তড়িঘড়ি আহত যশপ্রীত বুমরাকে ফেরানোর চেষ্টা হয়েছিল, সে চেষ্টা সফল হয়নি। শামি অতীতে টি টোয়েন্টিতে ভাল করেননি, তা সত্ত্বেও তাঁকেই বুমরার জায়গায় নেওয়া হল। সুপার ১২-তে তবু ঠিকঠাক চলছিল, সেমিফাইনালে যখন তাঁরই বোলিং আক্রমণকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, তখনই শামি ব্যর্থ হলেন। তরুণ অর্শদীপ (১০ উইকেট, ওভার পিছু ৭.৮০ রান) আর অভিজ্ঞ ভুবনেশ্বর কুমার (মাত্র চার উইকেট, কিন্তু ওভার পিছু ৬.১৬) গোটা প্রতিযোগিতায় নেহাত খারাপ বল করেননি। কিন্তু সমস্যা হল তাঁরা একইরকম গতির সুইং বোলার। যেদিন বল তত সুইং করে না, সেদিন দু প্রান্ত থেকে দুজনকে খেলতে হলে ব্যাটারদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। শামির গতি এঁদের চেয়ে বেশি, কিন্তু সুইং না হলেও ব্যাটারকে ঘামিয়ে তোলার মত নয়; যা পাকিস্তানের হ্যারিস রউফ, ইংল্যান্ডের মার্ক উড বা দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যানরিখ নর্খ্যে পারেন। ফলে ভারতের বোলিং হয়ে গেল বৈচিত্র্যহীন। ভারতের দ্রুততম বোলার হয়ে গেলেন অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া, যিনি আবার বিশেষ ফর্মে ছিলেন না। আসলে বিশেষ করে বুমরা অনুপস্থিত বলেই দরকার ছিল একজন এক্সপ্রেস গতির পেসার। কিন্তু ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বল করতে পারা উমরান মালিক বা মহসীন খানকে তো স্কোয়াডেই রাখা হয়নি।

শশী তারকায় তপনে

নির্বাচক এবং টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনার অভাব বোলারদের ঘাড়ে চাপিয়ে রোহিত আসলে যাদের আড়াল করেছেন, এবার তাদের আলোচনায় আসা যাক। ক্রিকেটের যে ফরম্যাটে মাত্র ১২০টা বল খেলার জন্য হাতে দশখানা উইকেট থাকে, সেখানে বোলারদের ভূমিকা যে স্রেফ সহায়কের – একথা বোঝার জন্য ক্রিকেট বোদ্ধা হওয়ার দরকার পড়ে না। টি টোয়েন্টি জেতানোর দায়িত্ব সর্বদা মূলত ব্যাটারদের কাঁধে। যে দলের ব্যাটিং লাইন আপ বাংলাদেশ, জিম্বাবোয়ে, নেদারল্যান্ডসের মত দলের সঙ্গেও ২০০ রান করতে পারে না; পার্থের সবচেয়ে গতিময় পিচে ১৪০ পর্যন্তও পৌঁছতে পারে না – সেই দলের অধিনায়ক যখন স্রেফ সেমিফাইনাল ম্যাচটা দশ উইকেটে হারার জন্য বোলারদের দিকে আঙুল তোলেন তখন হেসে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না।

অধিনায়ক নিজে ছটা ম্যাচে মাত্র ১১৬ রান করেছেন, গড় ১৯.৩৩। তাঁর নির্ভরযোগ্য ওপেনিং পার্টনার কে এল রাহুলের গড় ২১.৩৩। দুটো অর্ধশতরান করেছেন জিম্বাবোয়ে আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাসকিন আহমেদকে খেলতে গিয়েই তাঁর গলদঘর্ম অবস্থা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, রোহিত আর রাহুলের স্ট্রাইক রেট যথাক্রমে ১০৬.৪২ আর ১২০.৭৫। এই দুই বীরপুঙ্গবের কল্যাণে ওপেনিং জুটির ওভার পিছু রান করার দিক থেকে ভারত সুপার ১২-তে খেলা দলগুলোর মধ্যে সবার নিচে, সবার পিছে (৪.৯৮, অর্থাৎ ১০৬ বল খেলে ৮৮ রান)।

যোগ্যতার্জন পর্ব পেরিয়ে সুপার ১২-তে উঠতে পারেনি যারা, তাদের মধ্যেও একমাত্র নামিবিয়া এক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে (৪.৪৪)।

এবার সবচেয়ে অপ্রিয় প্রসঙ্গে আসা যাক – বিরাট কোহলি। তিনি প্রতিযোগিতা শেষ করেছেন ব্র্যাডম্যানোচিত ৯৮.৬৬ গড়ে, স্ট্রাইক রেট ১৩৬.৪০। অতএব কোহলির ভক্তরা এবং তিনি যে শুধু ভারতের নয় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ব্যাটার তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞরা, বলে চলেছেন – আর কী করবে লোকটা? ঘটনা হল সূর্যকুমার যাদব গোটা প্রতিযোগিতায় অবিশ্বাস্য স্ট্রাইক রেটে (১৮৯.৬৮) ব্যাট না করলে এবং সেমিফাইনালে হার্দিক একই কাজ (১৯০.৯০) না করলে কোহলির ওই অর্ধশতরানগুলো সত্ত্বেও ভারত সম্ভবত আরও আগেই প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিত। কারণ মোট রান জেতার মত হত না। একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তান ম্যাচ। সত্যিই ওই হারা ম্যাচটা কোহলি একা হাতে জিতিয়েছেন। একথাও সত্যি যে শেষ দু ওভারে কোনোদিন ভুলতে না পারার মত দুটো ছক্কা মারার প্রতিভা এই মুহূর্তে বিশ্বের আর কোনো ব্যাটারের নেই। কিন্তু প্রথম ওভারে ব্যাট করতে নেমে ১৬০ রান তুলতে তাঁকে শেষ ওভার অবধি খেলতে হয়েছে এবং শেষ ওভারেও ম্যাচের লাগাম নিজের হাতে রাখতে পারেননি। শেষ বল খেলে উইনিং স্ট্রোক নিতে হয়েছে টেল এন্ডার অশ্বিনকে। সেদিন যা ঘটেছিল তা এককথায় কামাল। কিন্তু কামাল একবারই ঘটে। কামাল ভুল প্রণালীকে সঠিক বলে প্রমাণ করে না। শেষ দু ওভারে গোটা তিরিশেক রান বারবার তোলা যায় না। সুতরাং ‘আগে ধরে খেলব, পরে মেরে পুষিয়ে দেব’ নীতি অচল। ইংল্যান্ড ম্যাচই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। পঞ্চাশ করতে ৪০ বল খরচ করে ফেলার পর কোহলি ১৮তম ওভারে আউট হয়ে গেলেন, দলের রান তখন মাত্র ১৩৬।

কোহলির এই নীতির সপক্ষে যুক্তি হল – ওপেনাররা ডুবিয়েছে, তিনে নেমে খেলাটা ধরতে হবে না? নইলে তো ইনিংস আগেই শেষ হয়ে যেত। পাটীগণিত কিন্তু এই ধরাধরি সমর্থন করে না। হিসাবটা একেবারে সোজা। টি টোয়েন্টিতে একটা দলের জন্য বরাদ্দ ১২০টা বল, হাতে দশটা উইকেট। মানে উইকেট পিছু মাত্র ১২টা বল। একজন ব্যাটার ওর চেয়ে বেশি বল না খেললে কিচ্ছু এসে যায় না, বরং সেক্ষেত্রে পরের ব্যাটার বেশি সুযোগ পেয়ে যাবেন রান করতে। সুতরাং বারোটা বলে যত বেশি সম্ভব রান করার চেষ্টা করা উচিত, তার চেয়ে বেশি বল খেললে আরও বেশি রান করার চেষ্টা করা দরকার। তা না করে ১৩৬.৪০ স্ট্রাইক রেটে পুরো ইনিংস ব্যাট করা মানে পরের ব্যাটারদের কাজ কঠিন করে দেওয়া, হাতে থাকা উইকেটের অপচয়। মনে রাখা ভাল, এই প্রতিযোগিতায় পাওয়ার প্লে-তে ওভার পিছু রান করায় শেষ থেকে দ্বিতীয় হয়েছে ভারত (৫.৯৭; প্রথম স্থানে নেদারল্যান্ডস)।

পাওয়ার প্লে-তে অত কম রান করে টি টোয়েন্টি খেতাব জেতা যায় না। এতে কোহলির দায় কিন্তু কম নয়। কারণ তিনি প্রায়শই পাওয়ার প্লে চলাকালীনই ব্যাট করতে নেমেছেন। টি টোয়েন্টি একেবারেই স্ট্রাইক রেটের খেলা। কোহলির কেরিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৩৭.৯৬। মোট রান আর গড়ে যত উপরেই থাকুন, এতে তিনি পৃথিবীর প্রথম ৭০ জনের মধ্যেও নেই। নিজে অধিনায়ক থাকার সময়ে কোহলি টেস্ট ম্যাচের ব্যাটিং নিয়ে বলতে গিয়েও ‘ইনটেন্ট’ শব্দটা বারবার ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ পিচ যেমনই হোক, পরিস্থিতি যা-ই হোক, প্রতিপক্ষের বোলিং সবল না দুর্বল সেসব দেখা চলবে না। সারাক্ষণ রান করার চেষ্টা করে যেতে হবে, মন্থর গতিতে রান করা মানেই নাকি নিজের দলের উপর চাপ তৈরি করা। কথাটা অবশ্য চালু করেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এই ইনটেন্টের অভাবেই তো অজিঙ্ক রাহানের সাদা বলের কেরিয়ার বলে কিছু হল না। চেতেশ্বর পূজারাকে বহুবার শতরান করেও শুনতে হয়েছে তাঁর ইনটেন্টের অভাব আছে। আশ্চর্যের কথা, ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে কোহলির নিজের ইনটেন্টের দেখা পাওয়া যায় না। সুনীল গাভস্কর, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, শচীন তেন্ডুলকর, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, ভিভিএস লক্ষ্মণের দেশের কোহলি অ্যাডাম জাম্পা, লিয়াম লিভিংস্টোন, আদিল রশিদের মত স্পিনারকেও পিটিয়ে উঠতে পারেন না।

ঘটনা হল, এসব দোষ এবারের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে প্রথম জানা গেল এমন নয়। গত বছর সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে এইসব দোষেই ভারত সেমিফাইনালেও পৌঁছতে পারেনি। এ বছর এশিয়া কাপেও এইসব কারণেই আফগানিস্তান ছাড়া কারোর সঙ্গেই পরাক্রম দেখানো সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও কেন এই তারকাদের বাদ দেওয়া যায় না, কীভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে আইপিএল – সেসব নিয়ে এই ওয়েবসাইটেই আগে লিখেছি, পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। বরং অন্য কয়েকটা প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক।

কচি তারা, কথা ফোটে নাই

২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পরে ভারত আর কোনো খেতাব জেতেনি। আজ দ্রাবিড়-রোহিতের ব্যর্থতায় শাস্ত্রী-কোহলির যে ভক্তরা উল্লসিত, তাঁরাও নিশ্চয়ই এ তথ্য ভুলে যাননি। সর্বগ্রাসী মিডিয়া হাইপ আর মনভোলানো বিজ্ঞাপনী চাকচিক্য এতদিন সব ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল, ইংল্যান্ড একেবারে দশ উইকেটে জিতল বলেই সম্ভবত আর সামলাতে পারা যাচ্ছে না। বহু চাটুকারেরও মুখ খুলে গেছে। তবু এই চূড়ান্ত পণ্যায়নের যুগে যেহেতু ক্রিকেট তারকাদের একেকজনের উপর কোটি কোটি টাকা লগ্নি হয়ে আছে, সেহেতু এঁদের ঢাল হয়ে এখনো কিছু সংবাদমাধ্যম, ক্রিকেট লেখক এবং অতশত না বোঝা নিষ্পাপ ভক্ত দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। নরেন্দ্র মোদীর সরকারের একটা ব্যর্থতাও অস্বীকার করতে না পেরে যেমন এক শ্রেণির মানুষ বলেন “ইফ নট মোদী, দেন হু”, তেমনি এঁরাও বলতে শুরু করেছেন, এদের বাদ দিলে খেলবে কারা?

ঘটনা হল, এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটে এর চেয়ে অবান্তর প্রশ্ন নেই। মুম্বাইয়ের পৃথ্বী শ দেশের হয়ে এখন পর্যন্ত একটাই টি টোয়েন্টি খেলেছেন এবং কোনো রান করতে পারেননি। কিন্তু আইপিএল এবং ঘরোয়া টি টোয়েন্টিতে ৯২ ম্যাচে তিনি করে ফেলেছেন ২৪০১ রান; স্ট্রাইক রেট ১৫১.৬৭; সর্বোচ্চ ১৩৪। ওই ১৩৪ রান তিনি করেছেন মাত্র ৬১ বলে, গত মাসে আসামের বিরুদ্ধে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে। ওই প্রতিযোগিতাটি হল ভারতের ঘরোয়া টি টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা। তাহলে আইপিএল কী? এ প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া লজ্জা দিবেন না।

ভারতীয় দলের তারকারা ইদানীং যত খেলেন তার সমান বা হয়ত তার চেয়েও বেশি বিশ্রাম নেন। সেই সুবাদে ঝাড়খণ্ডের উইকেটকিপার ব্যাটার ঈশান কিষণকে তো অনেকেই চিনে গেছেন। ভারতের হয়ে যে কটা টি টোয়েন্টি আর একদিনের ম্যাচ তিনি এখন অব্দি খেলেছেন তাতে ধোনির মত অভাবনীয় কিছু না করলেও প্রমাণ হয়েছে তাঁর আরও সুযোগ প্রাপ্য। স্রেফ ওপেনিং ব্যাটার হিসাবেও তিনি খেলেছেন এবং খেলতে পারেন।

কিন্তু কাব্যে সবচেয়ে উপেক্ষিত কেরালার সঞ্জু স্যামসন। তিনি যে সিরিজে দলে সুযোগ পান সেখানে একটা-দুটো ম্যাচে খেলেন, সেখানে সফল বা ব্যর্থ যা-ই হোন, পরের সিরিজে বাদ পড়ে যান। আবার হয়ত তার পরের সিরিজে ফেরত আসেন। তারকাদের ট্র্যাফিক জ্যামে মাথা গলাতে পারেন না আর কি। এ পর্যন্ত ভারতের হয়ে ১৬টা টি টোয়েন্টিতে ১৩৫.১৫ স্ট্রাইক রেটে ২৯৬ রান করেছেন। উইকেটের পিছনে সাতটা ক্যাচ নিয়েছেন, দুটো স্টাম্পিং করেছেন। সঞ্জুর বয়স ইতিমধ্যেই ২৮, ঈশান ২৪, পৃথ্বী ২৩। এছাড়াও আছেন শ্রেয়স আয়ার, শুভমান গিলরা। আছেন আইপিএলে সাফল্য পাওয়া ঋতুরাজ গায়কোয়াড় (২৫), রাহুল ত্রিপাঠী (৩১), ফিনিশার হিসাবে একাধিকবার চমকে দেওয়া রাহুল টেওয়াটিয়া (২৯)। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মত বহু দেশ টি টোয়েন্টিতে এমন অনেককে খেলায় যাঁরা অন্য কোনো ফরম্যাটে সুযোগ পান না। ভারতও চাইলে তেমন করতেই পারে। টি টোয়েন্টি অন্যরকম, তার চাহিদাও অন্যরকম।

মাঝখানে নদী ওই

উপরের নামগুলো গত কয়েক মাসে তারকাদের অনুপস্থিতিতে যেটুকু সুযোগ পাওয়া গেছে তার সদ্ব্যবহার করা ক্রিকেটারদের। কিন্তু ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে শুকনো মুখে ফেরা দলের মধ্যেই এমন দুজন আছেন যাঁরা উপর্যুপরি ব্যর্থ হওয়া তারকাদের জায়গা নিতে পারেন। একজন ঋষভ পন্থ। টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৩১ ম্যাচের কেরিয়ারেই যেসব ইনিংস তিনি খেলে ফেলেছেন তাতে তাঁর প্রতিভাকে সন্দেহ করার আর উপায় নেই। কিন্তু তার সঙ্গে মানানসই সাফল্য সাদা বলের কেরিয়ারে এখনো দেখা যায়নি। তার অনেকখানি দায় শাস্ত্রী-কোহলি এবং দ্রাবিড়-রোহিতের। পাঁচ বছর হয়ে গেল, ব্যাটিং অর্ডারে ঋষভের জায়গা কোথায় তা এখনো স্থির হল না। অথচ সাদা চোখেই দেখা যায়, তাঁর মত আক্রমণাত্মক ব্যাটার যত বেশি বল খেলার সুযোগ পায় দলের পক্ষে তত ভাল। ইংল্যান্ডে একটা ম্যাচে ওপেনার হিসাবে খেলিয়েই সে পরীক্ষায় দাঁড়ি টেনে দিলেন দ্রাবিড়-রোহিত; আগের কোচ, অধিনায়ক তো সে চেষ্টাও করেননি। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, শচীন একদিনের ক্রিকেটে কত নম্বরে ব্যাট করবেন তা নিয়ে অজিত ওয়াড়েকর-আজহার ১৯৯৪ সালে অকল্যান্ডের সেই ইনিংসের পরেও এমন টালবাহানা করলে কী হত।

অন্যজন দীপক হুড়া। বরোদার এই ২৭ বছর বয়সী ব্যাটার ভারতের হয়ে ১৩টা টি টোয়েন্টিতে ১৫৩.৪০ স্ট্রাইক রেটে শ তিনেক রান করে ফেলেছেন। জুন মাসে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৫৭ বলে ১০৪ করেছেন। তবু তাঁর জায়গা পাকা নয়, কারণ ওই ট্র্যাফিক জ্যাম। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে মাত্র একটা ম্যাচ খেলতে পেলেন পার্থে সবচেয়ে কঠিন উইকেটে।

বলে রাখা ভাল, কেবল টি টোয়েন্টি নয়। রোহিত, শিখর ধাওয়ান, কোহলিরা একদিনের ক্রিকেটে যে ব্যাটিংটা করেন সেটাও প্রায় প্রাক-জয়সূর্য-কালু যুগের ব্যাটিং। বিশেষত ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে ও ব্যাটিং সব দল বাতিল করে দিয়েছে। সে কারণেই ভারত ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও ঝুড়ি ঝুড়ি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতেছে গত ন বছরে, কিন্তু বড় প্রতিযোগিতা এলেই ব্যর্থ। কারণ কোনো বড় দল, বিশেষ করে নক আউট স্তরের ম্যাচে, শেষের দিকের ওভারে এত লুজ বল ফেলে না বা ফিল্ডিংয়ে এত ভুলভ্রান্তি করে না যে পাওয়ার প্লে-তে কম রান করার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া যাবে। বরং সে সময় আসার আগেই আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যেমন নতুন বলেই রোহিত, রাহুল, কোহলি আউট হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে শুধু খেলোয়াড় পরিবর্তন নয়, পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন না আনলে সামনের বছর ঘরের মাঠে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপেও একইরকম বিপর্যয় ঘটবে।

আরও পড়ুন বিরাট, রোহিত, রাহুলদের সত্য রচনা চলছে চলবে

একই প্রণালী বারবার প্রয়োগ করে যদি ভারতীয় বোর্ড ভিন্ন ফলের আশা করে তাহলে বলতে হয় জেতা হারায় তাদের কিছু এসে যায় না। তেমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কারণ আইপিএল আর ভারতীয় ক্রিকেট দলের ম্যাচের সম্প্রচার সত্ত্ব থেকে এত বিপুল অর্থ আয় হয় যে দলের জয় পরাজয়ে কেবল ক্রিকেটপ্রেমীদেরই উত্তেজিত হওয়া সাজে। বোর্ডকর্তারা অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স দেখে নিয়ে সুখে নিদ্রা যেতে পারেন।

এতক্ষণে অরিন্দম…

কারা যেন ভারতের টি টোয়েন্টি ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিষম চিন্তিত হয়ে দ্রাবিড়কে প্রশ্ন করে ফেলেছিল, ভারতীয় ক্রিকেটারদের কি অন্য দেশের টি টোয়েন্টি লিগে খেলতে দেওয়া উচিত? ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা তো অনেকেই অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগে খেলেন। হয়ত তারই সুবিধা পেয়ে গেলেন। দ্রাবিড়, ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট ক্রিকেটারদের একজন, মহা উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছেন, সে তো ভারি মুশকিলের ব্যাপার হবে। অন্য দেশের লিগগুলোর সময়ে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট চলে যে! ভারতীয়রা ওখানে খেলতে গেলে আমাদের রঞ্জি ট্রফিটা উঠে যাবে যে! শুনে মাইকেল মধুসূদন মনে পড়ে: “এতক্ষণে” –অরিন্দম কহিলা বিষাদে / “জানিনা কেমনে আসি লক্ষণ পশিল/রক্ষঃপুরে!…”

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আর্থিক পেশির জোরে যখন আইপিএলের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ফিউচার টুরস প্রোগ্রামে জায়গা খালি করিয়েছে তখন আর পাঁচজন অনুগত প্রাক্তন ক্রিকেটারের মতই দ্রাবিড় চুপচাপ ছিলেন। ইতিমধ্যে বোর্ড আইপিএলে আরও দুটো দল যোগ করেছে, সম্প্রচার সত্ত্বের দাম যত বাড়ানো হচ্ছে তত টাকা পাওয়া যাচ্ছে দেখে আগামী কয়েক বছরে ম্যাচের সংখ্যাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এখন সারা পৃথিবীতে একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ গজাচ্ছে। সেসব দেশের ক্রিকেট বোর্ড নিজেদের খেলোয়াড়দের এতকাল আইপিএলের জন্য ছেড়ে এসেছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ রেখে আইপিএল চলবে – এ ব্যবস্থাও মেনে নিয়েছে। এখন যদি বিস্মিত দ্রাবিড় বলেন – হায়, তাত, উচিত কি তব/একাজ – তাতে তো চিড়ে ভিজবে না। উচিত-অনুচিতের সীমা তো ক্রিকেট কবেই পেরিয়ে এসেছে।

ইনস্ক্রিপ্ট-এ প্রকাশিত

বিরাট, রোহিত, রাহুলদের সত্য রচনা চলছে চলবে

টি টোয়েন্টিতে যে সেট হওয়ার সময় নেওয়া চলে না, সেকথা এঁদের বলবে কে? বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলি, সেক্রেটারি জয় শাহ, নির্বাচক কমিটির প্রধান চেতন শর্মা বা কোচ রাহুল দ্রাবিড় – কারোরই ঘাড়ে অতগুলো মাথা নেই।

এশিয়া কাপ থেকে ভারতের বিদায়

প্রতিক্রিয়া ১

কিচ্ছু ভাববেন না। আমাদের সেরা দল তো খেলেনি। সেরা বোলার যশপ্রীত বুমরা চোটের জন্য বিশ্রামে ছিল, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে তো খেলবে। সঙ্গে থাকছে টি টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট হর্ষল প্যাটেল। সে-ও চোটের কারণে এশিয়া কাপ খেলেনি। তার উপর টুর্নামেন্টের মাঝখানেই আমাদের ভরসা অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজা চোট পেয়ে বেরিয়ে গেল। এভাবে জেতা যায়?

প্রতিক্রিয়া ২

বিরাট কোহলি শেষমেশ ৭১ নম্বর সেঞ্চুরিটা করে ফেলেছে। আর চিন্তা নেই। এবার তো রানের বন্যা বইবে। বিরাট যেমন খেলছে খেলে যাক, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি আমরা ঠিক জিতে যাব। এশিয়া কাপ জিতিনি তো হয়েছে কী? বিরাট তো সেঞ্চুরি করেছে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাউন্সিলের র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্বের এক নম্বর টি টোয়েন্টি দল ভারত এশিয়ার ছটা দলের মধ্যে তিন বা চারে শেষ করায় মোটামুটি এই দুরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আজকাল এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞে আর ভক্তে বিশেষ তফাত হয় না। নগদ নারায়ণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও ভক্তি সঞ্চার করেছেন। যেসব বিশেষজ্ঞ এখনো ভক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, তাঁদেরও সোশাল মিডিয়ার ভক্তকুলকে ভয় করে চলতে হয়। ট্রোলরা খাঁটি সাম্যবাদী, কাউকে ছাড়ে না। এই লেখায় আমরা উপরের দুই প্রতিক্রিয়াকেই পাশ কাটিয়ে এশিয়া কাপে ভারতের ব্যর্থতার কারণ এবং ফলাফলকে তৃতীয় রকমে দেখার চেষ্টা করব।

প্রথমত, বুমরা যে এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা দু-তিনজন বোলারের মধ্যে পড়েন তা নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। ফলে এশিয়া কাপে তাঁর অনুপস্থিতি এবং আসন্ন ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে উপস্থিতিতে যে অনেকখানি তফাত ঘটবে সেকথা ঠিকই। কিন্তু মুশকিল হল, তিনি এত তাড়াতাড়ি নিজের সেরা ফর্ম ফিরে পাবেন কিনা তা বলা শক্ত। যে কোনো চোট সারিয়ে ফেরার পরেই প্রথম কিছুদিন বোলারদের মধ্যে একই জায়গায় আবার চোট পাওয়ার আশঙ্কা কাজ করে। সে আশঙ্কা কাটে বেশকিছু ওভার বল করা হলে। নেটে বল করে স্বচ্ছন্দ হয়ে গেলেও ম্যাচ খেলার চাপ অন্য। সেই চাপ অনেকসময় সদ্য সেরে ওঠা শরীর নিতে পারে না। ফলে ম্যাচ প্র্যাকটিস দরকার। কিন্তু ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির আগে আর মাত্র ছটা টি টোয়েন্টি খেলবে ভারত। সঙ্গে তিনটে একদিনের ম্যাচ। সবকটা ম্যাচেই কি খেলবেন বুমরা? সেটাও কি যথেষ্ট? কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। সুতরাং বুমরা এসে পড়েছেন বলেই সব জাদুর মত ঠিক হয়ে যাবে ভেবে নিলে তাঁর প্রতিই অবিচার করা হবে।

দ্বিতীয়ত, হর্ষল প্যাটেল। তাঁর উপর হঠাৎই দেখা যাচ্ছে অনেকের প্রবল ভরসা। সে ভরসার কারণ অবশ্যই গত দুই বছরের আইপিএলে তাঁর বোলিং। হর্ষল ভারত বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর পিচে নিঃসন্দেহে একজন গুরুত্বপূর্ণ বোলার তাঁর গতির হেরফের, নিখুঁত লাইন লেংথ এবং বৈচিত্র্যের জন্য। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পিচ নব্বইয়ের দশকের তুলনায় মন্থর হয়ে এলেও দু-আড়াই মাসব্যাপী আইপিএলে শেষের দিকে পিচগুলো যতটা ‘ক্লান্ত’ হয়ে পড়ে, সেরকম হবে না। অস্ট্রেলিয়ায় সাধারণত সমান বাউন্সের পিচ হয়, বল নির্বিঘ্নে ব্যাটে আসে। ঘন্টায় ১৩০-৩৫ কিলোমিটার গতিতে বল করা হর্ষল সেখানে প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের কতটা সমস্যায় ফেলতে পারবেন তা বলা মুশকিল। ওরকম পিচে ভুবনেশ্বর কুমার আর হর্ষল একই ধরনের বোলার হয়ে পড়তে পারেন। পরপর দুটো ম্যাচে ১৯তম ওভারে একগাদা রান দিয়ে ফেলায় এখন ভুবনেশ্বর অনেকেরই চক্ষুশূল, কিন্তু আসলে টি টোয়েন্টিতে তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ফর্ম্যাটে সারা পৃথিবীতে খুব বেশি বোলার নেই যাদের গোটা কেরিয়ারে ইকোনমি রেট, অর্থাৎ ওভার পিছু রান দেওয়ার হার, সাতের নিচে। সহজাত সুইং বোলার ভুবনেশ্বরের আরেকটা গুণ, তিনি নিয়মিত উইকেট নেন। সাতাত্তর ম্যাচে তাঁর ঝুলিতে ৮৪টা উইকেট, গড় মাত্র ২১.৭৩।

আসলে এশিয়া কাপ দেখিয়ে দিল, পেস ব্যাটারি নিয়ে গত কয়েক বছরে বিরাট আর রবি শাস্ত্রী যতই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকুন, আমাদের হাতে এখনো খুব বেশি বিকল্প নেই। আবেশ খানকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তিনি মোটেই সুবিধা করতে পারেননি। আশা জাগিয়েছেন বাঁ হাতি অর্শদীপ সিং, তাই ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলেও জায়গা পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরও মূল অস্ত্র স্লোয়ার এবং ইয়র্কার। বুমরা বাদে আমাদের সত্যিকারের গতিময় বোলার নেই। এবারের আইপিএলে দ্রুততম বোলারদের অন্যতম ছিলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের উমরান মালিক। অথচ তাঁর উপর নির্বাচকদের বা ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের বিশেষ ভরসা নেই। তাই জুন-জুলাই মাসে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুটো (প্রথম ম্যাচে মাত্র এক ওভার বল করার সুযোগ পেয়েছিলেন), ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচ খেলানোর পর আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। বেগতিক দেখে বিশেষজ্ঞরা হঠাৎ মহম্মদ শামির নাম জপতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শামির গতি আর সুইং দুটোই থাকলেও তিনি টি টোয়েন্টিতে মোটেই নির্ভরযোগ্য নন। সতেরোটা টি টোয়েন্টি ম্যাচে তাঁর উইকেট সংখ্যা মাত্র ১৮। উইকেট পিছু ৩১.৫৫ রান খরচ করেন আর ওভার পিছু প্রায় দশ (৯.৫৪) রান দিয়ে ফেলেন। সেই কারণেই বোধহয় শেষমেশ তাঁকে স্ট্যান্ডবাই হিসাবে রাখা হয়েছে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির জন্য। মূলত সুইং বোলার দীপক চহরের উপরেও তার চেয়ে বেশি ভরসা নির্বাচক বা টিম ম্যানেজমেন্টের নেই দেখা গেল।

স্পিন বোলিংয়ের অবস্থা তুলনায় ভাল। জাদেজা চোটের কারণে আপাতত হারিয়ে গেলেও আমাদের সাদা বলের সেরা স্পিনার যজুবেন্দ্র চহল আছেন, রবিচন্দ্রন অশ্বিনও মন্দ ফর্মে নেই দেখা গেল। আর আছেন অক্ষর প্যাটেল। ব্যাটের হাতটাও ভাল হওয়ার কারণে হয়ত শেষপর্যন্ত চহলের পাশে দ্বিতীয় স্পিনারের জায়গাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনিই নেবেন। কিন্তু ভুবনেশ্বরের উনিশ-বিশ আর ঋষভ পন্থের রান আউট করতে না পারার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে যে সত্য ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা হল এশিয়া কাপে ভারতের ব্যর্থতার আসল কারণ ব্যাটিং। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি নিয়ে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণও ব্যাটিংই।

আফগানিস্তান ম্যাচের বাহাদুরি দেখে না ভোলাই ভাল। আগের দিন টুর্নামেন্টে টিকে থাকার ম্যাচে প্রচণ্ড স্নায়ুর চাপ নিয়ে শেষ বল পর্যন্ত লড়েছিলেন আফগান ক্রিকেটাররা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড শারজায় আইপিএল ম্যাচের আয়োজন হলে আপত্তি করে না, কিন্তু জাতীয় দলকে সেখানে খেলতে দেবে না। তাই চালচুলোহীন আফগানদের পরপর দুদিন দুটো আলাদা জায়গায় খেলতে হল। আগের দিন শারজায়, পরের দিন দুবাইতে। স্বভাবতই তাঁরা শারীরিক বা মানসিকভাবে ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার অবস্থাতেই ছিলেন না। অন্যদিকে গুরুত্বহীন ম্যাচে ভারতীয়দের উপর প্রত্যাশা বা স্নায়ু – কারোর চাপই ছিল না। ফলে ওই ম্যাচের ২১২ রান দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না।

বাকি সব ম্যাচেই কিন্তু ব্যাটিং একগাদা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সুপার ফোরের পাকিস্তান ম্যাচে প্রথম ছ ওভারে ৬০ পেরিয়ে যাওয়ার পরে এবং প্রথম তিন ব্যাটারের একজন (বিরাট) শেষ ওভার পর্যন্ত খেলে যাওয়া সত্ত্বেও ভারত দুশো পেরোতে পারেনি। একবার শক্ত ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন বলেই হার্দিক পান্ডিয়া রোজ জেতাবেন তা হতে পারে না। সুপার ফোরের ম্যাচের দিন তিনি পাঁচ বলের বেশি টেকেননি। যিনি শেষ কয়েক ওভারে ব্যাটিংয়ের বিশেষজ্ঞ হিসাবে দলে জায়গা পেয়েছেন, সেই দীনেশ কার্তিক গ্রুপের পাকিস্তান ম্যাচে খেলতে পেয়েছিলেন একটা বল, হংকংয়ের বিরুদ্ধে ব্যাট করার সুযোগই পাননি। অথচ এই ম্যাচে তাঁকে খেলানো হল না। খেললেন ঋষভ পন্থ, যিনি টেস্টে অসাধারণ, একদিনের ক্রিকেটেও অসাধারণ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ৫৮টা টি টোয়েন্টি খেলা হয়ে গেল, এখনো পায়ের নিচে মাটি পাননি। দল তাঁকে দিয়ে ঠিক কী করাতে চায় তা-ও পরিষ্কার নয়। ইংল্যান্ড সফরে মাত্র একবার তাঁকে দিয়ে ইনিংস শুরু করানো হল, তারপর আবার মিডল অর্ডারে ঠেলে দেওয়া হল। তরুণ দীপক হুড়া আদ্যন্ত টপ অর্ডার ব্যাটার। এ পর্যন্ত মোটে বারোটা ম্যাচ খেলেছেন, তার মধ্যেই শতরান করে বসে আছেন। গড় ৪১.৮৫, স্ট্রাইক রেট – যা টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – দেড়শোরও বেশি। তাঁকে গোটা টুর্নামেন্টে খেলানো হল নিচের দিকে। ইদানীং যিনি মাঠে নামলেই প্রতিভার বিচ্ছুরণে হাঁ হয়ে যেতে হয়, সেই সূর্যকুমার যাদবও সুপার ফোরের পাকিস্তান ম্যাচে সফল হননি। সে অবস্থায় বিরাট করেছেন ৪৪ বলে ৬০ রান, স্ট্রাইক রেট ১৩৬.৩৬। সংখ্যাগুলো যে যথেষ্ট ভাল, তার প্রধান কারণ বিরাটের চোখধাঁধানো রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস। কিন্তু মনে রাখা ভাল, সপ্তম ওভারে ব্যাট করতে নেমে শেষ ওভারের চতুর্থ বল অবধি ব্যাট করেও বিরাট মেরেছেন মাত্র চারটে চার আর একটা ছয়।

শ্রীলঙ্কা ম্যাচের ব্যাটিং সম্পর্কে তো যত কম কথা বলা যায় তত ভাল। অধিনায়ক রোহিত আর কিছুটা সূর্যকুমার ছাড়া বাকি সবাই ব্যর্থ। রানটা যে যথেষ্ট হয়নি তা তো ফলেই প্রমাণিত। এমনকি হংকং ম্যাচেও সূর্যকুমার ২৬ বলে ৬৮ রান না করলে বিরাটের ৫৯ (মাত্র একটা চার, তিনটে ছয়) সত্ত্বেও ভারতের রান ১৫০-৬০ অবধি গিয়ে আটকে যেত। ম্যাচের স্কোরবোর্ড প্রমাণ করছে, ব্যাপারটা মোটেই স্বস্তিদায়ক হত না।

অর্থাৎ গত বছরের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে ঠিক যে যে রোগ ভারতীয় দলকে ভুগিয়েছিল, এখনো সেসবের ওষুধ পাওয়া যায়নি। এই এক বছরে ভারত বেশকিছু টি টোয়েন্টি খেলেছে। তাতে চোট, বিশ্রাম ইত্যাদি নানা কারণে এশিয়া কাপ এবং ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলে জায়গা না পাওয়া অনেক ক্রিকেটার খেলেছেন। ঈশান কিষণ, সঞ্জু স্যামসন, ঋতুরাজ সিংরা যে সেই সুযোগগুলোর একেবারেই সদ্ব্যবহার করতে পারেননি তা-ও নয়। তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হল না কেন? না হওয়ার কারণটা খুব সহজ। আপনার অসুখ করল, ডাক্তার এলেন, কী কী ওষুধ খেতে হবে লিখে দিয়ে গেলেন। তারপর দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনা হলে যদি আপনি শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের অভাগীর মত ওষুধগুলো মাথায় ঠেকিয়ে এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দেন, তাহলে রোগ সারবে? ভারতীয় দলেরও একই অবস্থা।

কে এল রাহুল ইনিংস শুরু করতে যাবেন রোহিতের সঙ্গে এবং টেস্ট ওপেনারদের মত লম্বা ইনিংস খেলার দিকে মনোযোগ দেবেন। রোহিত তো পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটেও পাওয়ার প্লের বিষম ঝড়ের বায়ে মারের সাগর পাড়ি দিতে নারাজ। বেশ কয়েক ওভার নেন সেট হয়ে নিতে, তারপর ভয়ভাঙা নায়ে ওঠেন। কুড়ি ওভারের খেলাতেও একই পথে চলেছেন এতদিন। ইংল্যান্ড সফরে টি টোয়েন্টি সিরিজে অন্যরকম পথ ধরেছিলেন, কিন্তু এশিয়া কাপের প্রথম দুই ম্যাচে পুনর্মূষিক ভব। তৃতীয় ম্যাচ থেকে অবশ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। আবার পুরনো গলিতে ফেরত যাবেন কিনা সেটা এ মাসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজেই টের পাওয়া যাবে। আর আছেন বিরাট। তিনি পঞ্চাশ ওভারের ব্যাটিংয়ের রাজা। সেখানে যে কায়দায় ইনিংস গড়েন, তা বদলাতে রাজি নন। এক-দুই রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখবেন, সেট হয়ে গেলে তবেই চার-ছয় মারার কথা ভাববেন।

টি টোয়েন্টিতে যে সেট হওয়ার সময় নেওয়া চলে না, সেকথা এঁদের বলবে কে? বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলি, সেক্রেটারি জয় শাহ, নির্বাচক কমিটির প্রধান চেতন শর্মা বা কোচ রাহুল দ্রাবিড় – কারোরই ঘাড়ে অতগুলো মাথা নেই। কেন নেই?

বিরাট তো কেবল বড় ক্রিকেটার নন, তিনি গোটা ক্রিকেট দুনিয়ার বৃহত্তম ব্র্যান্ড। তাঁর উপর বিপুল পরিমাণ টাকা লগ্নি হয়ে আছে। জিততে হবে বলে লগ্নিকারীদের হতাশ করা চলে না। বিরাট আর রোহিত যে বয়সে পৌঁছেছেন তাতে নিজেদের খেলার ধরন পাল্টে ফেলা হয়ত কঠিন। সেক্ষেত্রে ওষুধ হল তাঁদের জায়গায় অন্যদের সুযোগ দেওয়া। কিন্তু দুজনেই বড় ব্র্যান্ড। অতএব ওষুধ জানা থাকলেও সে ওষুধ প্রয়োগ করা চলবে না। আর রাহুল? তিনি নিজে অতবড় ব্র্যান্ড নন বটে, কিন্তু তিনি আইপিএলে লখনৌ সুপার জায়ান্টসের অধিনায়ক। অন্তত আইপিএল ব্র্যান্ডকে তো গুরুত্ব দিতে হবে। ব্র্যান্ডের যুক্তিতেই কার্তিককে খেলানোর চেয়ে পন্থকে খেলানো বেশি জরুরি। তিনিও এক আইপিএল দলের (দিল্লি ক্যাপিটালস) অধিনায়ক। হার্দিক আবার গুজরাট লায়ন্সের অধিনায়ক। এখন ফর্মে আছেন, যখন থাকবেন না তখন তিনিও ব্র্যান্ডের সুবিধা নিশ্চয়ই পাবেন।

নব্বইয়ের দশকে জাতীয় দলের নির্বাচকদের প্রায় সব সভার আগে-পরেই খবরের কাগজে লেখা হত আঞ্চলিক কোটার কথা। অমুকের ঘরোয়া ক্রিকেটে তেমন পারফরম্যান্স নেই, কিন্তু পূর্বাঞ্চলের কোটায় সুযোগ পেয়ে গেল। অথবা তমুকের বাদ পড়া অনিবার্য ছিল, শেষমেশ পশ্চিমাঞ্চলের কোটায় টিকে গেল। এখনকার সংবাদমাধ্যম তখনকার মত বোর্ডের প্রভাবমুক্ত হলে নির্ঘাত অমুক ব্র্যান্ডের কোটা, তমুক ফ্র্যাঞ্চাইজের কোটার কথা জানা যেত।

রোহিত-রাহুল-বিরাট-ঋষভদের গুণমুগ্ধরা বলতেই পারেন, এসব একেবারেই মনগড়া কথাবার্তা। ওঁরা নিজেদের যোগ্যতাতেই দলে আছেন। ব্র্যান্ড ভ্যালুর ভারে দলে ঢোকার কোনো প্রয়োজনই নেই। তাছাড়া ব্র্যান্ড ভ্যালু কি বোলারদের থাকে না? তাহলে বোলারদের সম্পর্কে এরকম মূল্যায়ন করছি না কেন?

আসলে ভারতে বোলাররা কোনোদিনই ব্যাটারদের মত জনপ্রিয় হন না। ফলে ব্র্যান্ড ভ্যালুতেও ব্যাটারদের ধারে কাছে পৌঁছতে পারেন না। শচীন তেন্ডুলকরের এক শতাংশ বিজ্ঞাপন চুক্তিও কোনোদিন অনিল কুম্বলে পাননি। যুবরাজ সিংয়ের চেয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে জাহির খানের অবদান খুব কম নয়। কটা বিজ্ঞাপনে দেখেছেন তাঁকে? গত কয়েক বছরে ভারত তিন ধরনের ক্রিকেটেই যত ম্যাচ জিতেছে তাতে বিরাট, রোহিতের চেয়ে বুমরার অবদান নেহাত কম নয়। তবু তিনি এনডর্সমেন্টের দিক থেকে এখনো বেশ কয়েক মাইল পিছিয়ে।

অতএব ব্যাটারদের আলোচনায় ফেরা যাক। ঋষভ এখন পর্যন্ত এমন কিছু করেননি টি টোয়েন্টিতে, যা দিয়ে তাঁকে যেনতেনপ্রকারেণ দলে রাখা যুক্তিযুক্ত বলে প্রমাণ করা যায়। তিনি যদি বাঁহাতি ব্যাটার বলে অপরিহার্য হন, তাহলে তো বিশেষজ্ঞ ব্যাটার হিসাবেই খেলানো উচিত। হয় কার্তিক খেলবেন, নয় ঋষভ খেলবেন – এমন ব্যবস্থা কেন? অবশ্য ঋষভের এখনো বয়স কম, তাই আরও সুযোগ প্রাপ্য – এই যুক্তি দেওয়া চলে। কিন্তু রোহিত-রাহুল-কোহলি সমস্যা বিশদে আলোচনা করা প্রয়োজন। তাঁরা কাঁচা বয়স পেরিয়ে এসেছেন।

রাহুল ৬১ বার ভারতের হয়ে টি টোয়েন্টি খেলতে নেমে ইতিমধ্যেই হাজার দুয়েক রান করে ফেলেছেন। কেরিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৪০-এর বেশি, অর্থাৎ পর্যাপ্ত। কিন্তু বছর দুয়েক হল তিনি ওই টেস্টসুলভ ব্যাটিং শুরু করেছেন। কেবল ভারতের হয়ে নয়, এ বছরের আইপিএলেও তিনি ওভাবেই ব্যাট করেছেন। ঝুঁকি কমিয়ে ফেলায় ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু যে স্ট্রাইক রেটে করছেন তা দলের কাজে আসে না প্রায়শই। ফলে নিজের যোগ্যতাতেই দলে থাকায় দলের কী লাভ হচ্ছে সে প্রশ্ন ওঠা উচিত।

রাহুল যে রোহিত আর বিরাটের স্তরের ব্যাটার নন তা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। শেষ দুজন বিস্তর রান করেছেন টি টোয়েন্টিতে। গড়ের দিক থেকে বিরাট বিশ্বের এক নম্বর (৫১.৯৪)। মোট রানে রোহিত এক (৩৬২০), বিরাট দুই (৩৫৮৪)। অথচ রোহিতের টি টোয়েন্টি অভিষেকের পর থেকে ভারত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি জিতেছে মাত্র একবার (২০০৭)। সেবার তিনি মিডল অর্ডারে ব্যাট করেছিলেন। বিরাটের অভিষেকের পর থেকে একবারও নয়। এমনকি সেমিফাইনালে পৌঁছতেও হিমসিম খেতে হয়েছে, ফাইনাল খেলা হয়েছে শুধু ২০১৪ সালে। কী করে হয় এমনটা? ফর্ম্যাটটা তো ব্যাটার নির্ভর। বিশ্বের সেরা দুজন ব্যাটার ভারতের, অথচ ভারত কেন সুবিধা করতে পারে না? এর খানিকটা উত্তর পাওয়া যাবে স্ট্রাইক রেটের তালিকার দিকে তাকালে।

শুনতে অবিশ্বাস্য লাগবে, প্রথম তিনটে জায়গা দখল করে আছেন যথাক্রমে রোমানিয়া, হাঙ্গেরি আর বেলজিয়ামের তিন ব্যাটার। টেস্ট খেলিয়ে দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে উপরে নাম আছে সূর্যকুমারের (১৭৩.২৯)। প্রথম পনেরো জনের মধ্যে টেস্ট খেলিয়ে দেশের প্রতিনিধি আর মাত্র তিনজন – নিউজিল্যান্ডের জেমস নিশাম (১৬৫.৮৪), তাঁর দেশেরই কলিন মানরো (১৫৬.৪৪) আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেল (১৫৬.০০)। তারপর বারবার নাম আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের। ২০০৭ সালের পরের ছটা ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির চারটেই এই তিন দেশের কেউ না কেউ জিতেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কয়েকজন ব্যাটারের নামও পাওয়া যায়। সূর্যকুমারের পর ভারতীয় নাম খুঁজতে খুঁজতে চলে যেতে হবে অনেক নিচে ৩৪ নম্বরে, যেখানে আছেন বীরেন্দ্র সেওয়াগ (১৪৫.৩৮)। আরও কয়েক ধাপ নামলে পাওয়া যাবে হার্দিকের নাম (১৪৪.৬৮)। রোহিত বা কোহলি – কেউই প্রথম পঞ্চাশেও নেই। এই তালিকাটা ব্যাটারদের ‘ক্লাস’ প্রমাণ করে না একেবারেই। যা প্রমাণ করে তা হল টি টোয়েন্টি ক্লাস ব্যাটিংয়ের জায়গা নয়, কম বলে যত বেশি সম্ভব রান করার জায়গা। সেটা করলে তবেই দল জেতার মত পরিস্থিতিতে পৌঁছয়, আর সেখানেই ভারতীয় ব্যাটাররা অনেক পিছিয়ে। রোহিত আর বিরাট তো বটেই।

এই দুজনের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে আরও একটা দিক ধরা পড়ে। এমনিতে কোহলির কেরিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৩৮.৩৭। কিন্তু পাঁচের বেশি দল খেলেছে এমন টুর্নামেন্টে (অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি এবং এশিয়া কাপ) তাঁর গড় প্রায় আশি হলেও স্ট্রাইক রেট নেমে আসে ১৩০.৩৯-এ। রোহিতের গড় ৩২ থেকে ৩৬-এ পৌঁছে যায়, কিন্তু স্ট্রাইক রেট ১৪০.৬৩ থেকে নেমে আসে ১৩৩.৭৩-এ। অর্থাৎ দুজনেরই নৈপুণ্য দ্বিপাক্ষিক সিরিজে বেশি। অথচ টি টোয়েন্টিতে দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোর আসলে কোনো গুরুত্ব নেই। সব দলই ওগুলোকে ব্যবহার করে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির প্রস্তুতি হিসাবে। প্রমাণ চান? টাটকা প্রমাণ আছে। গত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে একটা সিরিজ খেলেছিল। সেই সিরিজ অস্ট্রেলিয়া শোচনীয়ভাবে হারে (৪-১)। এমনকি শেষ ম্যাচে মাত্র ৬২ রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে কী এসে গেল? ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি খেতাব জেতে অস্ট্রেলিয়াই, বাংলাদেশ গ্রুপ স্তরই পেরোতে পারেনি। এই কারণেই র‍্যাঙ্কিংয়ে কোন দল এক নম্বর তাতেও কিছু এসে যায় না।

এখন কথা হল, ভারতীয় দলের দুই সেরা ব্যাটার, যাঁরা ব্যাট করেন একেবারে উপরের দিকে, তাঁদের স্ট্রাইক রেট যদি এত মাঝারি মানের হয়, তাহলে দল মোক্ষম ম্যাচে জেতে কী করে? জেতে না। ঠিক যে কারণে পাকিস্তানও বারবার এশিয়া কাপ ফাইনাল বা ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি সেমিফাইনালের মত বড় ম্যাচে বারবার ব্যর্থ হয়। রোহিত-রাহুল-কোহলি বা পাকিস্তানের বাবর-রিজওয়ান যে ব্যাটিং করেন, তাতে আসলে যা হয়, তা হল সূর্যকুমারের মত ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটিংয়ে সিদ্ধহস্ত খেলোয়াড়দের উপর বেশি চাপ পড়ে। কার্তিকের মত ফিনিশাররা এক-দু বলের বেশি খেলারই সুযোগ পান না। অথচ টি টোয়েন্টিতে ঝুঁকি বর্জন করে লম্বা ইনিংস খেলার কোনো প্রয়োজনই নেই। কারণ এখানে ব্যাটিং দলকে পঞ্চাশ ওভারের খেলার অর্ধেকের চেয়েও কম বল খেলতে হয়, অথচ হাতে থাকে একই সংখ্যক উইকেট। ঝুঁকি না নিলে রান করে ব্যক্তিগতভাবে ধারাবাহিক হওয়া খুব কঠিনও নয়। কারণ ফিল্ডিং দলের অধিনায়ককে সারাক্ষণই রক্ষ্মণাত্মক থাকতে হয়, ক্যাচ নেওয়ার মত জায়গায় বেশি ফিল্ডার রাখা যায় না। বোলারদেরও ব্যাটারকে আউট করার চেয়ে চার-ছয় মারতে না দেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়।

আফগানিস্তান ম্যাচে দুশো স্ট্রাইক রেটে বিরাটের শতরান দেখার পরে এসব কথা অনেকেরই অবান্তর মনে হতে পারে। কেউ আশা করতেই পারেন, এতদিন ফর্মে ছিলেন না (বিরাট নিজে অবশ্য বলেন তিনি কোনোদিনই ফর্ম হারাননি, নিন্দুকে নিন্দে রটিয়েছে) বলে বিরাটের দ্রুত রান করতে সমস্যা হচ্ছিল। এশিয়া কাপে ফর্মে এসে গেছেন, এবার আফগানিস্তান ম্যাচের মত স্ট্রাইক রেটেই তিনি খেলবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ে যেতে পারে ক্রিকেট বোর্ডের ওয়েবসাইটের জন্য বিরাট রোহিতকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তা দেখলে। সেখানে বিরাট বলেছেন তিনি কোচেদের বলেই দিয়েছেন, ১০-১৫ বল খেলে নেওয়ার পর বাউন্ডারি মারার দিকে যাবেন। নিজের স্বাভাবিক খেলাই তিনি খেলবেন। সেই ছকের বাইরে যেতে গিয়েই সমস্যা হচ্ছিল। কবে যে তিনি বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তা অবশ্য ম্যাচের পর ম্যাচ স্ট্রাইক রেট দেখলে টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যা-ই হোক, তিনি বলেছেন এশিয়া কাপে তিনি যেভাবে ব্যাট করতে চান টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁকে সেভাবেই ব্যাট করতে দিয়েছে এবং তিনি নিজের পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট। যোগ করেছেন, কেবল তিনি নয়, রাহুলকেও তিনি যেভাবে খেলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সেভাবে খেলতে দিলেই দলের পক্ষে ভাল হবে। রোহিতকেও বলেছেন, তুমি-আমি এতদিন খেলে ফেলেছি যে আমরা নিজেদের মত খেলতে পারলেই দলের পক্ষে ভাল। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতেও লম্বা ইনিংস খেলার দিকেই তাঁদের নজর থাকবে। শয়ে শয়ে ব্র্যান্ড এবং লক্ষ লক্ষ ভক্ত পকেটে আছে, অতএব “সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ঘটে যা তা সব সত্য নহে।”

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

মুশকিল হল, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে আফগানদের ক্লান্ত বোলিং পাওয়া যাবে না। ফলে লম্বা ইনিংস দুশো স্ট্রাইক রেটে খেলা একটু কঠিন হতে পারে। আরেকটি ঐতিহাসিক সত্য হল, অস্ট্রেলিয়া বড় শক্ত ঠাঁই। এশিয়ার উইকেটে দ্রুত রান করতে যে ব্যাটারের অসুবিধা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তার রান করা সহজ হয়ে গেছে – এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি পাওয়া যায় না। ফলে ব্যাটিং নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। দলের জেতা-হারার চেয়ে বিরাট, রোহিতদের ব্যক্তিগত গৌরব যদি আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

 

এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট; ওঁরা গ্ল্যাডিয়েটর নন, ক্রিকেটার

বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, এশিয়া কাপের সময়ে কি জওয়ানরা লড়েন না? তা যদি হয় তাহলে তো আরও বেশি করে ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া উচিত।

ম্যাচে তখন টানটান উত্তেজনা। টিভির পর্দায় দেখা গেল ওভারের মাঝখানে দীর্ঘদেহী হার্দিকের খর্বকায় রিজওয়ানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। চমকে যাওয়ার পর রিজওয়ানও ভালবেসে টেনে নিলেন হার্দিকের হাত। ম্যাচের আগের কদিন টুইটারে ভাইরাল হয়েছিল একটা ভিডিও। চোটের কারণে এশিয়া কাপ ক্রিকেট থেকে ছিটকে যাওয়া শাহীন আফ্রিদি মনমরা হয়ে প্র্যাকটিসের মাঠের ধারে বসেছিলেন। বিরাট কোহলিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বিরাট জিজ্ঞেস করলেন পা কেমন আছে। আফ্রিদি বললেন, আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছি, যেন আপনার ফর্ম ফিরে আসে।

এই আবহে খেলা হল রবিবারের ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ। এর আগের ম্যাচ হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ২০২১, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি উপলক্ষে। সে ম্যাচ দাপটে জিতেছিল পাকিস্তান। এবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল। শেষপর্যন্ত তফাত গড়ে দিলেন পান্ড্য, ভারত জিতল। কিন্তু কোনো ম্যাচেই কোনো অবাঞ্ছিত উত্তাপ তৈরি হয়নি। বরং সাম্প্রতিককালে ভারত বনাম ইংল্যান্ড খেলা হলে ম্যাচের আগে, পরে এবং মাঝে বেশ কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা গেছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশীর খেলা বরং ঠিক সেভাবেই হল যেভাবে হওয়া উচিত – ব্যাট বলের লড়াইতে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়ল না, কিন্তু মুখের হাসিটি বজায় রইল। শুধু তা-ই নয়, পাক ব্যাটার ফখর জমান আউটের আবেদন না হলেও বল ব্যাটে লেগেছে বুঝতে পেরে নিজেই হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। তবু কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে সিরিজ খেলা হবে না।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

শেষ ভারত-পাকিস্তান টেস্ট খেলা হয়েছিল ২০০৭ সালে আর শেষ একদিনের ম্যাচ ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে। দীর্ঘকাল হল ভারত বহুদলীয় প্রতিযোগিতার বাইরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে না। আবার আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বহুদলীয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে না। কেন খেলে না? কারণ স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরার ভাষায় “জওয়ান সীমা পে লড় রহে হ্যাঁয়”। তাহলে বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, এশিয়া কাপের সময়ে কি জওয়ানরা লড়েন না? শান্ত হয়ে বসে টিভিতে খেলা দেখেন? তা যদি হয় তাহলে তো আরও বেশি করে ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া উচিত। প্রক্সি ওয়ারে সীমান্তের এপারে ওপারে নিয়মিত যে জওয়ানদের প্রাণ যায়, সেগুলো বেঁচে যাবে। আসল কথা, নিয়মিত খেলা হলে প্রত্যেকটা ম্যাচ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করা আর সম্ভব হবে না। মাঠে ক্রিকেটারদের হাসিঠাট্টা, স্বাভাবিক ব্যবহার দেখতে দেখতে এপারের দেড়শো কোটি আর ওপারের কোটি পঁচিশেক মানুষ যদি বিশ্বাস করতে শুরু করে, প্রতিবেশী দেশের মানুষ মানেই ইবলিশের বাচ্চা বা রক্তপিপাসু জেহাদি সন্ত্রাসবাদী নয়, তাহলে সমূহ বিপদ দুই দেশের শাসকদেরই। তখন দেশের বেকারত্ব, দেশের মুদ্রাস্ফীতি, দেশের সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে। সে বিপদ এড়াতে কালেভদ্রে ম্যাচ হবে, পিচে পপিং ক্রিজ চিহ্নিত করতে টানা লাইনটাকে নিয়ন্ত্রণরেখার সাথে তুলনা করে সম্প্রচারকারী সংস্থা বিজ্ঞাপন দেবে আর প্রগলভ রবি শাস্ত্রীর কণ্ঠে শোনানো হবে – এটা স্টেডিয়াম নয়, কলিসিয়াম। ওরা ক্রিকেটার নয়, গ্ল্যাডিয়েটর। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই খেলার মাঠ লড়াইয়ের মাঠ হয়ে উঠবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ইংল্যান্ডের নতুন ক্রিকেট ভারতীয়দের যা শেখাল

১৯৯৬ বিশ্বকাপে একদিনের ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ে সনৎ জয়সূর্য আর রমেশ কালুভিথরনার জুটি বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পরের কথা। একটা ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে দুরমুশ হওয়ার পর ভারত অধিনায়ক শচীন তেন্ডুলকরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আগে ব্যাট করে কত রান করলে এই শ্রীলঙ্কাকে হারানো যাবে বলে মনে হয়? শচীন অসহায়ের মত উত্তর দিয়েছিলেন, বোধহয় এক হাজার। গত মঙ্গলবার এজবাস্টনে পুরস্কার বিতরণের সময়ে যশপ্রীত বুমরার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, মার্ক বুচার যদি জিজ্ঞেস করতেন চতুর্থ ইনিংসে কত রানের লক্ষ্যমাত্রা দিলে ইংল্যান্ডকে হারানো যাবে বলে মনে হয়, তাহলে বুমরা শচীনের উত্তরটাই দিতেন। টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে যদি কোনো দল ৩৭৮ রান মাত্র তিন উইকেট হারিয়ে তুলে পঞ্চম দিন মধ্যাহ্নভোজের বিরতির আগেই খেলা শেষ করে দেয়, তাহলে হেরে যাওয়া দলের অধিনায়ক এছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারেন? এজবাস্টনে যা ঘটেছে তা আরও বেশি চমকপ্রদ, আরও সুদূরপ্রসারী এই জন্যে যে টেস্টের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনো দল পরপর চারটে ম্যাচ চতুর্থ ইনিংসে আড়াইশোর বেশি রান তুলে জিতল। এই রানগুলো যে গতিতে তোলা হয়েছে সেটাও টেস্ট ক্রিকেটে চট করে হয় না। ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সাংবাদিক, সমর্থকরা আদর করে এই ধারার ব্যাটিংয়ের নাম দিয়েছেন ‘ব্যাজবল’ – দলের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ডাকনাম ব্যাজ, সেই কারণে। ঘটনাটা যেহেতু একবার মাত্র ঘটেনি, পরপর চারবার ঘটে গেল, সুতরাং মানতেই হবে ব্যাজবল একটা নতুন ধারা। ব্যাজবল টেস্ট ক্রিকেটের প্রচলিত ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। যতক্ষণ ইংল্যান্ডের বাইরে নানারকম পরিবেশে, নানারকম পিচে এ জিনিস করা হচ্ছে ততক্ষণ একে বিপ্লব বলা চলবে না ঠিকই। কিন্তু প্রয়াসটা যে বৈপ্লবিক তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

এই সহজ কথাটা মেনে নিতে কিন্তু ভারতীয়দের প্রচণ্ড অসুবিধা হচ্ছে। এজবাস্টন টেস্টের আগে থেকেই ইংল্যান্ড যা করছে তা যে নতুন কিছু নয়, তা ঠারেঠোরে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে সাধারণ দর্শক – সকলেই বলছিলেন। জোর গলায় ব্যাজবল নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু হয়ে যায় ঋষভ পন্থ ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ইনিংসে খেলে ফেলতেই। ইংল্যান্ড ব্যাটিং প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হওয়ায় তাচ্ছিল্যের মাত্রা বেড়ে যায়। জনি বেয়ারস্টোর একা কুম্ভের মত শতরানকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের দেখাদেখি ক্রিকেটভক্তদের মধ্যেও সিরিজ সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন মাফিক ইংল্যান্ডকে ধোলাই দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লাস চলছিল। চতুর্থ দিন দুপুরে ভারত যখন ৩৭৮ রানের লক্ষ্যমাত্রা খাড়া করে অল আউট হয়ে গেল, তখন আমরা কত অসাধারণ দল, আমাদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই ব্যাজবল কেমন অশ্বডিম্ব প্রসব করল – এসব উচ্চমার্গীয় আলোচনা চলছিল। কিন্তু বার্মিংহামে সন্ধে নামার আগেই গলা নামিয়ে ফেলতে হল সকলকে। বেয়ারস্টো আর ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকস ফর্মে থাকলে তবেই ব্যাজবল খেলা সম্ভব – এমনটা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে বিশেষজ্ঞরা, তাঁরা দেখলেন ইংল্যান্ডের দুই নড়বড়ে ওপেনারই দারুণ আত্মবিশ্বাসে আক্রমণাত্মক ব্যাট করলেন। জ্যাক ক্রলি কিছুটা সাবেকি ওপেনারদের ঢঙে খেললেও অ্যালেক্স লিজ শামি, বুমরা, সিরাজ – সকলকেই আক্রমণ করলেন। বাঁহাতি ব্যাটারের অফস্টাম্পের বাইরে তৈরি হওয়া পিচের ক্ষত কাজে লাগিয়ে রবীন্দ্র জাদেজা ভেলকি দেখাবেন বলে আশা ছিল। লিজ প্রথম ওভার থেকেই তাঁকে আক্রমণ করে সে আশায় জল ঢেলে দিলেন। সব মিলিয়ে ওভার পিছু পাঁচ রান করে নিয়ে ইংল্যান্ড একশো পেরিয়ে গেল। এরপর অস্থায়ী অধিনায়ক বুমরা দ্রুত দুটো উইকেট তুলে নিয়ে কিছুটা আশা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু অতঃপর যা ঘটল, তাকে ক্রিকেটের সাহেবি পরিভাষায় কী বলে সে কথা থাক, গোদা বাংলায় বলে দুরমুশ করা। ক্ষণেকের জন্য বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে জো রুট লিজের রান আউটের কারণ হয়ে না দাঁড়ালে হয়ত ভারতের হারের ব্যবধানটা আরও হতভম্ব করার মত হত। যা-ই হোক, শেষপর্যন্ত রুট আর বেয়ারস্টো যথাক্রমে ৮২.০৮ আর ৭৮.৬২ স্ট্রাইক রেটে ৩৪টা চার আর দুটো ছয় মেরে কার্য সমাধা করেছেন।

ভারতীয় পণ্ডিতরা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। ম্যাচের পর স্টুডিওতে বসে সঞ্জয় মঞ্জরেকর মাথা নেড়ে বললেন এই ব্যাটিংটা ব্যাজবল নয়, এটা হল “সেন্সিবল ব্যাটিং”। মানে মোগলসরাইয়ের নাম দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর, টালিগঞ্জের নাম উত্তমকুমার। সঞ্জয় একা নন। ম্যাচটা শেষ হয়েছে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল; অজিত আগরকর, বীরেন্দর সেওয়াগ, ওয়াসিম জাফররা এখনো অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এটা প্রমাণ করতে যে ইংল্যান্ড নতুন কিছু আবিষ্কার করেনি। আপাতত যে তত্ত্বটি খাড়া করা হয়েছে, তা হল এমন ব্যাটিং তো ঋষভ পন্থই করে। এ আর নতুন কী? অনেকে ভিভ রিচার্ডস, সেওয়াগ, জয়সূর্য, অ্যাডাম গিলক্রিস্টেরও নাম করেছেন। পণ্ডিতদের (এবং ভারতীয় ক্রিকেট দলের ভক্তদের) বোঝানো দুঃসাধ্য যে কোনো একজন ব্যাটারের টেস্টে একদিনের ক্রিকেটের মেজাজে ব্যাটিং ব্যাজবল নয়, নতুন কিছুও নয়। স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যানই তো একবার একদিনে ৩০০ রান করেছিলেন (১১ জুলাই ১৯৩০)। কিন্তু একটা আস্ত টেস্ট দলের ব্যাটিং কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য কিছু না ভেবে রান তাড়া করে যাওয়া, এক থেকে এগারো নম্বর, সবাই সেই নীতি মেনে ব্যাট করছে – এমনটা টেস্টের ইতিহাসে হয়নি। জো রুটের মত কপিবুক ব্যাটার নিয়মিত স্পিনারদের সুইচ হিট মারছেন, জোরে বোলারদের ব্যাট উল্টে স্লিপের মাথার উপর দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাচ্ছেন। অর্থাৎ দলের পরিচালকরা এটাই চাইছেন। স্টোকস এজবাস্টনে টস জিতে বলেছিলেন, তাঁর দল রান তাড়া করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। টেস্ট ম্যাচে টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়া হবে না প্রথমে ব্যাট করা হবে, তা ঠিক হচ্ছে পিচ বা আবহাওয়ার চরিত্র দেখে নয়, রান তাড়া করার পারদর্শিতা মাথায় রেখে – এ জিনিস অভূতপূর্ব। শুধু টেস্ট খেলা নয়, খেলাটাকে নিয়ে আলোচনা করার মানদণ্ডটাই তো বদলে দিল ইংল্যান্ড। ব্যাজবল বলুন বা অন্য কিছু বলুন, নামে কী আসে যায়? ব্যাজবলকে যে নামেই ডাকা হোক, তার সুগন্ধ কমে না। মুশকিল হল, আমরা ভারতীয়রা আর খেলার সুগন্ধ পাই না, সেটা সামরিক লড়াইসুলভ প্রতিহিংসার পূতিগন্ধে চাপা পড়ে যায়। আমাদের দলকে প্রত্যেক খেলায় জিততে হবে, আম্পায়ারের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে যেতে হবে। অন্যথা হলে আমাদের খেলোয়াড়রা দাঁত নখ বের করে ফেলেন, আমরাও গ্যালারিতে বা টিভির/মোবাইলের সামনে বসে ব্যাপারটা জাতীয় সংকট হিসাবে ধরে নিয়ে ফুঁসতে থাকি। প্রতিপক্ষের ভাল বোলিং বা ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতাই যখন হারিয়ে গেছে, তাদের দলগত উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে তারিফ করার ক্ষমতা আর থাকবে কী করে?

তবে প্রাক্তন ক্রিকেটাররা কী বললেন; বিশ্লেষক, সাংবাদিকরা কী টুইট করলেন আর তার প্রভাবে সাধারণ ক্রিকেটভক্তদের কী প্রতিক্রিয়া হল তা নিয়ে আলোচনার দরকার হত না, যদি না প্রতিপক্ষের অভিনবত্বকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা খোদ ভারতীয় ক্রিকেট দলের মধ্যেই দেখা যেত। এজবাস্টনে ভারত যেভাবে খেলেছে, তাতে মনে করা অমূলক নয় যে বুমরা আর কোচ রাহুল দ্রাবিড়ও ব্যাজবল ব্যাপারটাকে স্রেফ ইংরেজ মিডিয়ার অতিকথন বলেই ধরে নিয়েছিলেন। তাই তার জন্যে আলাদা করে কোনো পরিকল্পনা করেননি। নইলে হু হু করে রান হয়ে যাচ্ছে দেখেও রানের গতি কমানোর জন্যে চতুর্থ দিন রক্ষ্মণাত্মক ফিল্ডিং সাজানো, রক্ষণাত্মক বোলিং করা হল না কেন? তাহলে কি ধরে নেওয়া হয়েছিল, কোনোভাবে কয়েকটা উইকেট ফেলতে পারলেই ইংল্যান্ড ম্যাচ বাঁচানোর কথা ভাববে, যেমনটা টেস্ট ক্রিকেটে চিরকাল হয়ে এসেছে? দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের ব্যাটিং দেখেও মনে হয়নি, তারা এমন একটা দলের জন্য লক্ষ্য স্থির করছে যারা পরপর তিনটে টেস্টে ঝড়ের গতিতে আড়াইশোর বেশি রান তাড়া করে জিতেছে। চেতেশ্বর পুজারা ছাড়া আর কেউ যত বেশি সময় সম্ভব ব্যাট করে ইংল্যান্ডের রান তোলার সময় কমিয়ে ফেলার কথা ভেবেছেন, এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। ঋষভ যে সময়ে যে শট খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে আউট হলেন, তাতেও মনে হয় তাঁর ধারণা হয়েছিল যথেষ্ট রান উঠে গেছে। এরপর দ্রুত যা পাওয়া তা-ই বোনাস। এমনিতে ৩৭৮ রান যথেষ্ট বলে মনে হওয়া দোষের নয়। কিন্তু ভিডিও অ্যানালিস্ট, পরিসংখ্যানবিদ ইত্যাদি বাহিনী সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট দল নিউজিল্যান্ড সিরিজের কথা জেনেও এত নিশ্চিন্ত থাকতে পারল?

অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনটে টেস্টে (দক্ষিণ আফ্রিকায় শেষ দুটো টেস্ট আর এজবাস্টন) চতুর্থ ইনিংসে বোলাররা চরম ব্যর্থ হওয়ার পর যে ভারতীয় বোলিংকে এতদিন পাইকারি হারে সর্বকালের সেরা তকমা দেওয়া হচ্ছিল, তাকে নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। আসলে অন্ধ হলে যে প্রলয় বন্ধ থাকে না, সে কথাটা অন্য সব ক্ষেত্রের মত ক্রিকেটেও আমরা অনেকদিন হল ভুলে থাকা অভ্যাস করেছি। তার ফল দেখে এখন মাথা চুলকোতে হচ্ছে। বোলারদের আর দোষ কী? ইংল্যান্ডের মত ফর্মে থাকা, জয়ের ছন্দে থাকা ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে যদি আপনি তিনজন বোলার আর দুজন আধা অলরাউন্ডার নিয়ে খেলতে নামেন, তাহলে এমন ফল হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে যখন পিচ ম্যাচের শেষ দুদিনে বোলারদের যতটা সাহায্য করার কথা ততটা করল না।

তিনজন খাঁটি পেসারের সঙ্গে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মত একজন খাঁটি স্পিনারকে খেলানো হয়নি, খেলেছেন শার্দূল ঠাকুর আর রবীন্দ্র জাদেজা। এই একই কৌশল বিরাট কোহলি আর রবি শাস্ত্রীও নিয়েছিলেন ম্যাচের পর ম্যাচ। তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে রোহিত শর্মা (এ ম্যাচে বুমরা)-দ্রাবিড় জুটিও একই কৌশল নিচ্ছে। জাদেজাকে আধা অলরাউন্ডার বললে অনেকে যারপরনাই রাগ করেন, কিন্তু সত্যিটা হল দেশের মাঠে তিনি একজন ম্যাচ জেতানো স্পিনার। কিন্তু বিদেশে ক্রিকেট খেলার সময়ে তিনি একজন শক্তিশালী ব্যাটার, যিনি সামান্য হাত ঘোরাতে পারেন। গত ৪-৫ বছরে বিদেশের মাঠে ভারতের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটার হলেন ঋষভ আর জাদেজা। ভারতের তিন, চার আর পাঁচ নম্বর সেই ২০১৮-১৯ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের পর থেকেই নড়বড়ে। পুজারা, বিরাট আর অজিঙ্ক রাহানে যতগুলো ইনিংসে একসাথে সফল হয়েছেন তার চেয়ে বেশি ইনিংসে ব্যর্থ হয়েছেন। উদ্ধার করেছেন নীচের সারির ব্যাটাররা। কখনো ঋষভ, কখনো বোলারদের সঙ্গে নিয়ে জাদেজা। অতএব উপরের তিনজনের ব্যর্থতা ঢাকতে তাঁর ব্যাটটা দরকার, তাতে বোলিং শক্তিতে যতই ঘাটতি হোক। একই কারণে বল হাতে তেমন সাফল্য না পেলেও হার্দিক পাণ্ড্যাকে এগারোটা টেস্ট খেলানো হয়েছিল। চোটের কারণে হার্দিক সরে যাওয়ার পর আনা হয়েছে শার্দূলকে। হার্দিকের তবু কিছুটা গতি ছিল, শার্দূলের তা-ও নেই। পিচ থেকে একেবারে সাহায্য না পেলে, প্রধান বোলাররা প্রথম দিককার উইকেটগুলো না নিতে পারলে শার্দূলের পক্ষে সফল হওয়া কঠিন। মূলত বুমরা আর শামি দীর্ঘকাল দারুণ ফর্মে থাকায় এইসব ফাঁকফোকর ধরা পড়েনি। তাঁরা এখন প্রাকৃতিক নিয়মেই ফর্ম হারাচ্ছেন, আর ফাঁকগুলো বিরাট হাঁ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

রাহানেকে অনেক ব্যর্থতার পরে বাদ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পুজারা আর বিরাট এখনো খেলে যাচ্ছেন। পুজারার কোনো ব্র্যান্ড ভ্যালু নেই, তিনি সাদা বলের ক্রিকেটে জায়গা করে নিতে পারেননি, আইপিএলও খেলেন না। তাই তাঁর যোগ্যতা নিয়ে তবু প্রশ্ন তোলা চলে। তিনি প্রথম একাদশ থেকে বেশ কয়েকবার বাদ গেছেন। উপর্যুপরি ব্যর্থতার পর ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কা সিরিজেও বাদ পড়েছিলেন, কাউন্টি ক্রিকেটে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করে ফেরত আসতে হয়েছে। কিন্তু বিরাট হলেন অনির্বচনীয় গুণের আধার। ২০১৮-১৯ মরসুমের অস্ট্রেলিয়া সফরের পর থেকে বিরাট বা পুজারা কেউই ধারাবাহিকভাবে রান করেননি। নভেম্বর ২০১৯ থেকে দুজনের পারফরম্যান্স পাল্লা দিয়ে খারাপ হয়েছে। প্রথম জনের গড় ২৯.৬৪, দ্বিতীয় জনের ২৮.৩১। কিন্তু দলে বিরাটের জায়গা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না। সকলেই জানে, তিনি যে কোনো দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর ৭১তম শতরানটি করে রানে ফিরবেন। ততদিন জাদেজা, শার্দূলরা তাঁর রানগুলো করে দেবেন না কেন?

আরও পড়ুন বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত জনগণমন

শাস্ত্রী-কোহলির দেখানো এই পথেই রাহুল-রোহিত হাঁটছেন যখন, তখন এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই ভারতীয় ক্রিকেটের ক্রমমুক্তি হবে নিশ্চয়ই। বছরের গোড়ায় যখন নতুন লোকেদের হাতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল, তারপর সাঁইত্রিশ পেরনো ঋদ্ধিমান সাহাকে দ্রাবিড় জানিয়ে দিলেন তাঁর কথা আর ভাবা হবে না, তখন মনে হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট সত্যিই বদলাচ্ছে। কিন্তু এখন আবার সবাই চলতি হাওয়ার পন্থী। অফ ফর্মে থাকা বিরাট, সদ্য কোভিডের জন্য টেস্ট না খেলা অধিনায়ক রোহিত প্রমুখ বিশ্রাম নেবেন। তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজে একদিনের ম্যাচে ভারতের অধিনায়কত্ব পাচ্ছেন সাঁইত্রিশের দিকে এগোনো শিখর ধাওয়ান।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

অ্যালাস্টেয়ার কুককে নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আছে। টেস্ট ক্রিকেটে বারো হাজারের বেশি রান করা ব্যাটারকে এমনিতেই কোনো ক্রিকেটপ্রেমী ভোলেন না। তার উপর কুক জীবনের প্রথম এবং শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধেই, আর দুটোতেই তিন অঙ্কের রান করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ২০১১ সালে ভারতের অভিশপ্ত ইংল্যান্ড সফরের সময়ে এজবাস্টন টেস্টে ক্রিকেটজীবনের সর্বোচ্চ স্কোরেও (২৯৪) পৌঁছন। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলা কুক এখনো দাপটে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছেন। এ মরসুমে এসেক্সের এই ওপেনারের গড় এখন ৬০। পাঁচটা ম্যাচেই তিনটে শতরান করে ফেলেছেন এবং দুই দশকব্যাপী প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কেরিয়ারে আগে কখনো যা পারেননি, তা ঘটিয়ে ফেলেছেন গত ম্যাচে। দুই ইনিংসেই শতরান করেছেন।

এদিকে কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে। জো রুটের কাছে ইংল্যান্ডের কর্মকর্তা, ক্রিকেটপ্রেমী – সকলেরই বিরাট আশা ছিল। কিন্তু ব্যাটার হিসাবে যথেষ্ট সফল হলেও অধিনায়ক হিসাবে রুট একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। গত আঠারোটা টেস্টের মধ্যে মাত্র একটা জিতেছে ইংল্যান্ড। ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যে যে কারণে ইংল্যান্ডের এমন হাঁড়ির হাল, তার অন্যতম হল ওপেনারদের ব্যর্থতা। কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে অনেককে নির্বাচকরা সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু কেউই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। কুক ইতিমধ্যে স্যার অ্যালাস্টেয়ার কুক হয়ে গেছেন। মানে ক্রিকেট মাঠে তাঁর কীর্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং রানী এলিজাবেথ। জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড সম্প্রতি খোলনলচে বদলে ফেলেছে। নতুন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার রব কী, নতুন টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস আর টেস্ট দলের কোচের দায়িত্বে এসেছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। দেশটার নাম ভারত হলে এতদিনে হাউস অফ কমন্সে সব দলের সাংসদরা মিলে রেজলিউশন পাস করাতেন, নতুন অধিনায়ক আর কোচকে কুককে অবসর ভেঙে ফিরে আসতে বলতেই হবে। কুক নিজেও শতমুখে সংবাদমাধ্যমকে বলে বেড়াতেন, তিনি এখনো দারুণ ফিট এবং জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন।

কিন্তু দেশটার নাম ইংল্যান্ড। কয়েকদিন আগে কুককে এক সাক্ষাৎকারে রব কীর নিয়োগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ভালই তো। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের এখন একেবারে নতুন করে শুরু করা উচিত। নিজের সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। বরং বলেই দিলেন যে পুরনো সবকিছু ভুলে এগোনো উচিত।

স্নেহময় জ্যাঠামশাইরা পরীক্ষায় ফেল করা ভাইপোদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যে এরকম বলতেন। তা কুকজেঠুর বয়স কত? সাঁইত্রিশ বছর চার মাস। চলতি আইপিএলে গত ম্যাচটা (তা-ও বিপক্ষের দ্রুততম বোলার লকি ফার্গুসন কোনো অজ্ঞাত কারণে বল করতে এলেন বিরাট আর ফ্যাফ দু প্লেসি সেট হয়ে যাওয়ার পর এবং মাত্র দু ওভার বল করলেন) বাদ দিলে চূড়ান্ত ব্যর্থ (তিনটে ম্যাচে প্রথম বলে আউট; ১৪ ম্যাচে ৩০৯ রান, গড় ২৩.৭৬) বিরাট কোহলির বয়স কত? সাড়ে তেত্রিশ। অর্থাৎ কুক বিরাটের বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাঁর এখনকার ফর্ম দেখে মনে করা অমূলক নয় যে অবসর না নিলে তিনি এতদিনে শচীন তেন্ডুলকরের টেস্ট ক্রিকেটে মোট রানের রেকর্ড (১৫,৯২১) আর সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড (২০০) – দুটোরই কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন। অথচ এখন কনিষ্ঠরা পারছে না দেখেও ফিরে আসার নাম করছেন না। বোর্ডও এখন পর্যন্ত তাঁর নাম করেনি। ভক্তরা কেউ কেউ সোশাল মিডিয়ায় কুকের নাম ভাসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও তা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করছেন না। এদিকে বিরাটকে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক – অনেকেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি নাকি একটানা অনেকদিন খেলে ফেলেছেন, কদিন বিশ্রাম নিলেই হইহই করে রানে ফিরবেন। বিরাটও গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচের আগে আইপিএলের সরাসরি সম্প্রচারকারী সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বললেন তাঁর উপর দিয়ে সত্যিই অনেক ধকল গেছে, তাই বিশ্রাম নিলে ভালই হয়। মজার কথা, বিশ্রাম নেওয়া যে প্রয়োজন সেটা তাঁর আইপিএলের শেষ লগ্নে এসে খেয়াল হল। বিরাট মনে করেন আমাদের প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট রবি শাস্ত্রীর চেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর নেই। তিনি শুধু বিরাটকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেননি, বলেছেন বিশ্রামের পর বিরাট আরও ছ বছর খেলতে পারে। অর্থাৎ কুক যে বয়সে ফর্মে থেকেও জ্যাঠামশাইয়ের ভূমিকা উপভোগ করছেন, বিরাট সেই বয়সেও খেলে যাবেন। অথচ বিরাটের ফর্ম কিন্তু এবারের আইপিএলে হঠাৎ উধাও হয়েছে এমন নয়। এই সাইটেই আগে লিখেছি, কোনো ধরনের ক্রিকেটেই তিনি তেমন প্রভাব ফেলতে পারছেন না অনেকগুলো বছর হয়ে গেল।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নতুন করে শুরু করার কাজটা আগেই করেছে, কারণ আইসিসি টুর্নামেন্টে বারবার ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা দরকার। শাস্ত্রীর জায়গায় এসেছেন রাহুল দ্রাবিড় আর সাদা বলের অধিনায়ক করা হয়েছিল রোহিত শর্মাকে। বিরাট টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ছাড়া অন্যগুলোর লাগাম নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন, বোর্ড সে গুড়ে বালি দিয়ে পরে টেস্ট ক্রিকেটেও রোহিতকেই নেতা করে দিয়েছে। তা রোহিতের বয়স কত? পঁয়ত্রিশ। টেস্ট ক্রিকেট কোনোদিনই রোহিতের সেরা মঞ্চ ছিল না। ন বছর আগে টেস্ট অভিষেক হলেও এতদিনে মোটে পঁয়তাল্লিশটা টেস্ট খেলেছেন, শতরান মাত্র আটটা। বিদেশে প্রথম শতরান পেলেন গত ইংল্যান্ড সফরে। তিনি আসলে সাদা বলের যম। অথচ গত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে বিরাটের পাশাপাশি তিনিও ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবার আইপিএলেও মোটেই রানের মধ্যে নেই (১৩ ম্যাচে ২৪৮ রান; গড় ২০.৪৬)। একাধিকবার আইপিএল খেতাব জয়ী মুম্বাই ইন্ডিয়ানস যে এবার পয়েন্ট টেবিলের একেবারে তলায় পড়ে আছে, তার অন্যতম কারণ রোহিতের খারাপ ফর্ম।

এ বছর ফের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি। স্বয়ং অধিনায়ক এরকম ফর্মে থাকলে দলের অবস্থা কী হবে? উপরন্তু দলের সবচেয়ে বড় তারকা বিরাটকে দীর্ঘদিন ধরে টি টোয়েন্টির উপযোগী দেখাচ্ছে না। তিনি ইদানীং এত সাবধানে ব্যাট করছেন (বৃহস্পতিবার গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে ৫৪ বলে ৭৩ রান করার আগে অব্দি স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৩.৪৬), যে তিনি বড় রান করলে দলের মোট রান ভাল জায়গায় পৌঁছনো শক্ত। অথচ এই দুই তারকা থাকতে ঋতুরাজ গায়কোয়াড়, রাহুল ত্রিপাঠী, রাহুল টেওটিয়াদের মত বড় শট নিতে পারা ব্যাটারদের দলে জায়গা হবে না।

তবে ভারতীয় ক্রিকেট যে ভারত দেশটার মতই পিছন দিকে এগোতে চাইছে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই দুজন নন। সাঁইত্রিশ বছরের কুক যদি জেঠু হন, আগামী ৭ জুলাই একচল্লিশে পা দিতে চলা মহেন্দ্র সিং ধোনি নিঃসন্দেহে পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর যে ইচ্ছামৃত্যু, তা সেই ২০১১ সালেই প্রমাণ হয়ে গেছে। দল পরপর আটটা টেস্ট হারার পরেও ধোনির অধিনায়কত্ব যায়নি, বরং সে প্রস্তাব নির্বাচন কমিটির মিটিংয়ে তোলার পরে মোহিন্দর অমরনাথের নির্বাচকের চাকরি গিয়েছিল। ভারতের একদিনের ক্রিকেটের দলও ধোনিকে বয়ে বেড়িয়েছে বছর চারেক। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল আর বড় শট নিতে পারেন না, অন্য প্রান্ত থেকে কেউ সে কাজটা করলে তিনি বড়জোর এক-দুই রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখতে পারেন, যা অনেকসময় জেতার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবু তাঁকে অবসর নিয়ে প্রশ্ন করলে বেজায় রেগে যেতেন। ২০১৬ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে ভারতের বিদায়ের পর তো নির্লজ্জতার শিখরে উঠেছিলেন। এক অস্ট্রেলিয় সাংবাদিক এই প্রশ্ন করায় তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনের ডায়াসে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি ধোনির অবসর দেখতে চান কিনা। তিনি তো আর ভারতীয় নন, যে কোনো আত্মীয় পরিজন থাকবে যে ধোনির জায়গায় খেলতে পারে।

এন শ্রীনিবাসনের থেকে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন বলেই ধোনি একদিনের ক্রিকেট খেলতে পেরেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপ অব্দি। অথচ ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে চার, ছয় মারার ক্ষমতা তো বটেই, গড়ও কমে গিয়েছিল। কেরিয়ারের ব্যাটিং গড় যেখানে পঞ্চাশ, সেখানে এই চার বছরের গড় নেমে এসেছিল চুয়াল্লিশে। চারে নেমে খেলতে না পারলে টিভি স্টুডিওতে বসে বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বলতেন ধোনিকে পাঁচে খেলানো উচিত। পাঁচে না পারলে বলতেন ছয়ে। অর্থাৎ দল তাঁকে বয়ে বেড়াত। কালে ভদ্রে একটা ম্যাচে উইনিং স্ট্রোক নিলেই ফের সবাই মনে করিয়ে দিত, ধোনি সর্বকালের সেরা ফিনিশার। আর ধোনিকে এসব জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বারবার বলতেন, আগের মত অত ছয় মারেন না তো কী হয়েছে? তিনি তো ফিট আছেন। যেন খেলাটা ক্রিকেট নয়, জিমন্যাস্টিক্স।

আসলে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে অনেক সমস্যা মিটে যায়। তাই ধোনি নির্বিঘ্নেই খেলে ফেলেন আরও একটা বিশ্বকাপ। কিছু বিশেষজ্ঞ আর অন্ধ ভক্ত আজও বলেন “যদি গাপ্টিলের থ্রোটা উইকেটে না লাগত…”। ভুলে যান যে ধোনি সেদিন পঞ্চাশে পৌঁছতে লাগিয়েছিলেন বাহাত্তরটা বল, মাত্র একটা চার আর একটা ছয় মেরেছিলেন। রবীন্দ্র জাদেজা ৫৯ বলে ৭৭ রান করেছিলেন বলে নিউজিল্যান্ডের জয়ের ব্যবধান আরও বড় হয়নি – এটুকুই সান্ত্বনা। নইলে শেষ ওভারে ধোনির ভেলকি দেখানোর সম্ভাবনা আরও আগেই শেষ হয়ে যেত। রাজনীতিতে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু খেলার মাঠে পরিণাম বদলানো যায় না।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

এতদিন পরে হৃদয় খুঁড়ে আবার এসব বেদনা জাগাতে হচ্ছে, কারণ এবারের আইপিএলে ধোনি ওই জাদেজাকেই হাসির পাত্র বানিয়ে ছেড়েছেন। এমনিতে চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক শ্রীনিবাসনের কোম্পানি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের অন্যতম ডিরেক্টর ধোনি। সুপার কিংস দলটা সে অর্থে তাঁর নিজের সম্পত্তি। যার ব্যাট, যার উইকেট তাকেই খেলতে নেব না – এ জিনিস পাড়া ক্রিকেটেই চলে না, আইপিএলে কী করে চলবে? ফলে ধোনির উইকেটরক্ষায় যতই শিথিলতা আসুক, ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতা যতই কমে যাক, এ দলে তিনি যতদিন খেলতে চাইবেন ততদিনই খেলবেন। সমস্যা হল, তিনি কেবল খেলছেন না, খেলতে গিয়ে অন্যদের কোণঠাসা করছেন। আইপিএল শুরু হওয়ার মুখে ঘটা করে ঘোষণা করা হয়েছিল, পিতামহ অধিনায়কের সিংহাসনটি স্নেহভাজন জাদেজার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরু হতেই দেখা গেল ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তন – সবকিছুতেই ধোনির কথাই শেষ কথা। জাদেজা নেহাতই রাবার স্ট্যাম্প। অবশ্য তাতেও সুপার কিংস দলের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হওয়া আটকায়নি। কিন্তু ব্যাটে, বলে ব্যর্থ জাদেজা নটা খেলার মধ্যে ছটা হারার পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে চাইলেন। ধোনি মুকুট ফিরিয়েও নিলেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঋতুরাজ সিংয়ের মত তরুণতর কাউকে দায়িত্ব দিলেন না। তাহলে মরসুমের শুরুতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন ছিল? জাদেজাও তো তেত্রিশ পেরিয়েছেন, কচি খোকাটি নন। তাঁর হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে কোন মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের আশা ছিল? জাদেজা এই মুহূর্তে চোট-আঘাতের কারণে মাঠের বাইরে। এই টানাপোড়েনে তাঁর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল কিনা তিনি মাঠে না ফেরা পর্যন্ত জানা যাবে না। যদি ধরে থাকে, তাহলে সুপার কিংসের চেয়ে বেশি ক্ষতি কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট দলের।

আসলে বাকি পৃথিবী সামনের দিকে তাকাতে চায়, আর আমরা চাই অতীতের গৌরবে বুঁদ হয়ে থাকতে। এ আমাদের জাতীয় চরিত্র। তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে অতি বড় ক্রিকেটারেরও ক্ষমতা কমে আসে, আজ না কমে থাকলেও পরের বড় টুর্নামেন্টটা আসতে আসতে যে কমে যেতে পারে – এসব কথা না তাঁরা নিজেরা মানেন, না তাঁদের ভক্তকুল মানে। তারকারা আয়নায় মুখ দেখতে পান না, কারণ মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। ফলে ব্যাটে বলে হচ্ছে না, পা বলের লাইনে যাচ্ছে না, রিফ্লেক্স কমে গেছে, বহু বছর ধরে অতিমাত্রায় জিম করার ফলে টানা দু ঘন্টা ব্যাট করলেই পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে – এসব যখন ক্রিকেটার নিজে বুঝতে শুরু করেন, তখনো সবাই মিলে কানের কাছে বলতে থাকে “ও কিছু নয়। কদিন ব্রেক নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” এমনটাই এনডর্সমেন্টের যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে হয়ে আসছে। যেনতেনপ্রকারেণ চল্লিশ অব্দি খেলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন শচীন। ধোনি ভাবলেন তিনিই বা কম কিসে? হয়ত পঁয়তাল্লিশকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছেন। বিরাট ভাবছেন তিনি তো কোনো অংশে ধোনির চেয়ে কম যান না। রোহিত সবে অধিনায়ক হলেন, পঞ্চাশ ওভার আর কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে তাঁরও ঝুড়ি ঝুড়ি রান আছে। তিনিই বা চল্লিশ অব্দি খেলার কথা ভাববেন না কেন? “ক্রিকেটের ঈশ্বর” তো শচীন, কুক তো নন। ফলে টেওয়াটিয়া, ত্রিপাঠীদের বেলা মেঘে মেঘেই বাড়বে।

ঋদ্ধিমান সাহার বেলায় দ্রাবিড় ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই ছেলেখেলা তিনি চলতে দেবেন না। এই ২০২২ সালেও উনবিংশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের গন্ধে মাতাল বাঙালি তা নিয়ে বিস্তর গোল করেছিল। এবারের আইপিএলে গুজরাট টাইটান্সের ওপেনার হিসাবে ঋদ্ধিমানের সাফল্যে আবার গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দল নির্বাচনের সময়ে যদি তরুণদের সুযোগ দেওয়ার নীতি ভুলে গিয়ে তারকাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু মানতেই হবে, পোর্টফোলিওতে যথেষ্ট পরিমাণ এনডর্সমেন্ট থাকলে ঋদ্ধিমানের বয়সও ঢেকে যেত।

*সব পরিসংখ্যান ১৯ মে, বৃহস্পতিবারের গুজরাট টাইটান্স বনাম রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ম্যাচ পর্যন্ত

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত জনগণমন

ব্র্যান্ড বুদ্ধ। কথাটা এই শতকের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এতটাই জনপ্রিয় যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিজের দলের সদস্যরা, যাঁদের তাত্ত্বিক ভাবে ব্র্যান্ডিং ব্যাপারটা নিয়েই প্রবল আপত্তি থাকার কথা, তাঁরাও বেশ সন্তোষ প্রকাশ করতেন। যদি ধরে নেওয়া যায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সত্যিই একটি ব্র্যান্ড, তাহলে মানতেই হবে সে ব্র্যান্ড রীতিমত জনপ্রিয় হয়েছিল। শতকের প্রথম দশকের দুটো নির্বাচনেই বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন দল তথা জোট হই হই করে জিতেছিল। ব্র্যান্ড বুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত এবং সফল ব্র্যান্ড মোদি। মানতেই হবে ব্র্যান্ড নির্মাণের মুন্সিয়ানাও সেখানে অনেক বেশি। কারণ একজন লেখাপড়া জানা ভদ্রলোককে নির্ভরযোগ্য প্রশাসক হিসাবে তুলে ধরার চেয়ে গোটা রাজ্যে গণহত্যা চলার সময়ে ক্ষমতাসীন নেতাকে গোটা দেশ চালানোর পক্ষে বিকল্পহীন প্রশাসক হিসাবে তুলে ধরা বহুগুণ কঠিন। ব্র্যান্ড নির্মাণ মানেই হল যা না থাকলেও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না তাকেই অপরিহার্য বলে প্রতিষ্ঠা করা, যার বিকল্প আছে তাকে নির্বিকল্প হিসাবে ঘোষণা করা। তাই কেবল ভালো বললে চলে না, তুলনায় যেতে হয়। আর সকলের চেয়ে ভালো, এ পর্যন্ত যা যা দেখেছেন, সবার চেয়ে ভাল — এইসব বলতে হয়। তাই নরেন্দ্র মোদি কোনো শিশুর দিকে তাকিয়ে হাসলেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি কোনো শিশুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন — এই জাতীয় প্রচারের প্রয়োজন পড়ে।

রাজনীতিবিদের ব্র্যান্ড নির্মাণ করার চেয়ে খেলোয়াড়দের ব্র্যান্ড নির্মাণ করা সহজ। কারণ তাঁরা কাজের অঙ্গ হিসাবেই সাধারণ মানুষের নিরিখে অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা করে থাকেন। অভিনেতারাও করেন বটে, কিন্তু তা অবশ্যই পূর্বনির্ধারিত; চিত্রনাট্য এবং প্রযুক্তির সহায়তায় করা। আজকের দিনের দর্শকরা জানেন কোনটা ক্যামেরার কারসাজি, কোথায় আসল নায়ক হল ভিএফএক্স। কিন্তু বিরাট কোহলির দিকে যখন বাউন্সার ধেয়ে আসে, তখন তিনি পুল করতে পারলে তবেই বল মাঠের বাইরে যাবে। ওখানে ফাঁকি চলে না। তাই তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা এমনিতেই বেশি। কিন্তু ওতে সন্তুষ্ট হলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ড নির্মাণ সম্ভব নয়।

গাড়ির টায়ার থেকে টিএমটি বার, পেশাগত শিক্ষার সাইট থেকে পটেটো চিপসের বিকল্প স্ন্যাকস যাঁকে দিয়ে বিক্রি করাতে হবে — তিনি যে কেবল দারুণ খেলোয়াড় নন, অন্য সকলের চেয়ে, এমনকি আগে যাঁরা ক্রিকেট খেলেছেন তাঁদের সকলের চেয়ে ভাল; নিদেনপক্ষে সর্বকালের সেরাদের মতই ভাল, তা প্রতিষ্ঠা না করলে চলে না। এই কারণেই সারা পৃথিবীর খেলাধুলোয় বর্তমানের তারকাদের সর্বকালের সেরার আসনে বসানোর হুড়োহুড়ি।

অতীতে কোনো খেলোয়াড় সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়েন কিনা সে আলোচনা শুরু হতো তাঁর কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে বা কেরিয়ার শেষ হলে। কিন্তু শচীন তেন্ডুলকর যখন মধ্যগগনে, তখনই এই মর্মে বিপুল প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারণ তখন বিপুল টাকার চুক্তি নিয়ে ওয়ার্ল্ড টেল এসে পড়েছে ভারতীয় ক্রিকেটে, শচীনকে ধনী করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মার্ক মাসকারেনহাস। অশীতিপর ডন ব্র্যাডম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছেন, ‘এই ছেলেটাকে দেখে আমার নিজের কথা মনে পড়ে।’ ব্যাস! আর যায় কোথায়? সর্বকালের সেরা হিসাবে শচীনের এমন জোরদার ব্র্যান্ডিং হল, কাগজে এমন লেখালিখি, টিভিতে এমন বিজ্ঞাপন যে আমরা যারা সুনীল গাভস্করের খেলা দেখিনি; কপিলদেব, ইয়ান বোথাম, ভিভ রিচার্ডসদের তাঁদের সেরা সময়ে দেখিনি; তারা নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলাম — সবার উপরে শচীন সত্য, তাহার উপরে নাই। সর্বকালের সেরার মুকুটের জন্য শচীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আমরা বড়জোর ব্রায়ান লারাকে মানতে রাজি ছিলাম, কোনো প্রাক্তনকে মোটেই নয়।

ব্র্যান্ডিংয়ের সেই ট্র্যাডিশন আজও সমান তালে চলছে। শচীন অবসর নিয়েছেন বলে তো আর ব্যবসা থেমে থাকতে পারে না, অতএব পরবর্তী GOAT (গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম — এই অভিধাটি সোশাল মিডিয়ার যুগে নতুন আমদানি, শচীনের সময়ে চালু হয়নি) হয়ে গেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তাঁর কেরিয়ার শেষের দিকে যেতেই বিরাট। প্রত্যেক প্রজন্মেই আগের গোটের নৈপুণ্যকে অতিক্রম করে এসে যাচ্ছেন নতুন গোট। মানবিক দক্ষতার এত দ্রুত বিবর্তন হয় জানলে হয়ত চার্লস ডারউইন ওরিজিন অফ স্পিসিজ নিজে হাতে পুড়িয়ে দিতেন।

গোট প্রচার ভোট প্রচারের মতই শক্তিশালী। শচীনের আমলে কেবল সাংবাদিককুল আর বিজ্ঞাপন ছিল প্রচারযন্ত্র। এখন যুক্ত হয়েছে সোশাল মিডিয়া। কেবল প্রচার নয়, ভিন্নমতের প্রতিকারও সেখানে হয়ে থাকে। ট্যুইটারে একবার বলে দেখুন, বিরাট নিঃসন্দেহে বড় ব্যাটার। কিন্তু সর্বকালের সেরা বলার সময় হয়েছে কি? পঙ্গপালের মত ধেয়ে আসবেন বিরাটভক্তরা। আক্রমণ শুরু হবে আপনি যে ক্রিকেটের ‘ক’ বোঝেন না সেই ঘোষণা দিয়ে। ক্রমশ আপনি যে মোগ্যাম্বোসুলভ খলনায়ক তা বলা হবে। তারপর প্রমাণ করা হবে আপনি দেশদ্রোহী; নামটা মুসলমান হলে সোজা পাকিস্তানি। গালিগালাজ ইত্যাদি তো আছেই। বলা যেতেই পারত যে এসবের সাথে খেলার বা খেলোয়াড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। ক্রীড়ানুরাগীরা কালে কালে এরকম জঙ্গিপনা করে আসছেন, সোশাল মিডিয়া আসায় পাড়ার রকের জঙ্গিপনা জনপরিসর পেয়ে গেছে মাত্র। দুঃখের বিষয়, তা বলা যাবে না। কারণ দু’টি।

প্রথমত, এমন আক্রমণ কেবল রাম শ্যাম যদু মধুরা করে না। সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার, ভেরিফায়েড হ্যান্ডেলওলা উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, ডাক্তার, উকিল — কেউই বাদ যান না। দ্বিতীয়ত, বিরাট নিজেও একাধিকবার ট্রোলদের মত আচরণ করেছেন।

ভারতের শাসক দলের মত ভারতের ক্রিকেট দলও সমালোচনা মোটেই বরদাস্ত করে না সেই ধোনির আমল থেকেই। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই মাইনে দিয়ে ধারাভাষ্যকার রাখে। দল হারুক আর জিতুক, ভারতীয় ক্রিকেটারদের সমালোচনা করেছ কি মরেছ। ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন হর্ষ ভোগলে। অমিতাভ বচ্চনের টুইট রিটুইট করে ভোগলের ধারাভাষ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন ভারত অধিনায়ক ধোনি। তারপরই ভোগলের কন্ট্র্যাক্ট চলে যায়। বিরাট ক্রিকেটের মেধাবী এবং মনোযোগী ছাত্র; তিনি বড়দের দেখে যা শিখেছেন তা তাঁদের চেয়ে ঢের বেশি জোর দিয়ে করেন। ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালীন অনুশীলনের সময়ে তিনি এক ভারতীয় সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল ওই সাংবাদিক বিরাট আর অনুষ্কা শর্মার সম্পর্ক নিয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা লিখেছেন। পরে যখন জানা যায় সেই নিবন্ধ অন্য এক সাংবাদিকের লেখা, তখন বিরাট ক্ষমা চান। অর্থাৎ ভুল লোককে গালিগালাজ করা হয়েছে বলে ক্ষমা চান। এই ঘটনায় টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বিরাটকে বুঝিয়েছেন যে ভবিষ্যৎ ভারত অধিনায়কের এরকম ব্যবহার সাজে না। যদিও বিরাট তখন ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হয়ে গিয়েছেন।

২০১৮ সালে বিরাটের কোপে পড়েন এক ক্রিকেটপ্রেমীও। দোষের মধ্যে, তিনি বলেছিলেন ভারতের চেয়ে অন্য দেশের ব্যাটারদের খেলা দেখতে তাঁর বেশি ভালো লাগে। বিরাট তাঁকে সটান বলে দেন, তাহলে অন্য দেশে গিয়েই থাকা উচিত। দেশের শাসক দল বিজেপি ও তার ট্রোলরা তখন অনলাইন এবং অফলাইন — সর্বত্র সরকারবিরোধী কথা বললেই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। অবশ্য এরকম প্রতিধ্বনিতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আচমকা নোটবন্দির ঘোষণা করার সাতদিন পরে সাংবাদিক সম্মেলনে বিরাট বলেছিলেন, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওটা তাঁর দেখা সেরা সিদ্ধান্ত।  বিরাট ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস কতখানি জানেন সে প্রশ্ন তোলা নিষ্প্রয়োজন, কারণ যিনি গোট তিনি তো কেবল খেলার গোট নন, তিনি সর্বজ্ঞ।

ব্র্যান্ডিংয়ের এমনই মহিমা, যে সাংবাদিক সম্মেলনে অপছন্দের প্রশ্ন শুনলেই রেগে যাওয়ার ধারাবাহিক ইতিহাস, কাগজে কী বেরোল তা নিয়ে সাংবাদিককে আক্রমণ করা এবং বিতর্কিত সরকারি সিদ্ধান্তকে সাত তাড়াতাড়ি সমর্থন করার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বিরাটের অধিনায়কত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে বড় অংশের বিজেপিবিরোধী মানুষ নিঃসন্দেহ, যে বিরাটকে সরিয়ে দেওয়া আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মহম্মদ শামির পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলেন বলে অমিত শাহের নির্দেশে তাঁর পুত্র জয় শাহ ও বশংবদ সৌরভ গাঙ্গুলি মিলে বিরাটকে একদিনের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, আর টেস্টের নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছেন।

আরও পড়ুন সকলেই চুপ করে থাকবে, শামিকে মানিয়ে নিতে হবে

বিরাটের কথা উঠলেই যে দেশের বেশিরভাগ মানুষের যুক্তিবোধ ঘুমিয়ে পড়ে, সবটাই আবেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় — এখানেই ব্র্যান্ড নির্মাতাদের সাফল্য। নানা মহল থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এখন আর আগের জায়গায় নেই। কিন্তু সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তার সময়েও তিনি এভাবে ডান, বাম, মধ্যপন্থীদের এক করে ফেলতে পারেননি। রাজনীতিতে এবং সমাজে যেসব প্রবণতার চরম নিন্দা করে থাকেন মোদিবিরোধীরা, সেগুলোই বিরাটের মধ্যে দেখা গেলে সকলে জাতীয়তাবাদী হয়ে পড়েন। প্রযুক্তির সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি বলে অধিনায়ক সদলবলে হাস্যকর অসভ্যতা করলেও কেউ বলেন না, বিদেশের মাঠে অধিনায়ক প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাষ্ট্রদূত। তিনি এই আচরণ করতে পারেন না, এর জন্যে শাস্তি হওয়া উচিত। উল্টে উঠে আসে বনলতা সেনগিরির যুক্তি (যাকে ইংরেজিতে বলা হয় হোয়াট্যাবাউটারি) — এরকম যখন সাহেবরা করত তখন কোথায় ছিলেন? এখন আমাদের জোর হয়েছে, তাই বিরাট করছে। বেশ করছে। রাজনীতিবিদদের গুন্ডাসুলভ কথাবার্তার যাঁরা অহরহ নিন্দা করেন, তাঁরাও বিরাটের নেতৃত্বাধীন দলের খেলার মাঠে অকারণ চিৎকার, খেলার পরেও সাংবাদিক সম্মেলনে এসে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলাকে আগ্রাসনের যুক্তিতে সমর্থন করেন। বিজেপি কথিত যে ‘নিউ ইন্ডিয়া’ অনেকের প্রবল অপছন্দ, সেই ভারতের বৈশিষ্ট্যগুলোই বিরাটের শরীরী ভাষায় দেখে একই লোকেদের যে উল্লাস– সেটাই ব্র্যান্ডিংয়ের জয়পতাকা।

সরকারি দল, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ এবং সহায়ক সংবাদমাধ্যম যখন বলে তারা ক্ষমতায় আসার আগে ভারতে কোনো উন্নয়ন হয়নি, বিদেশে ভারতের কোনো সম্মান ছিল না, ভারতীয়রা ভীতু বলে পরিচিত ছিল; তখন প্রতিবাদ করার লোক পাওয়া যায়। অথচ শাস্ত্রী, বিরাট এবং তাঁদের ভগবান বানিয়ে তোলা সংবাদমাধ্যম গত কয়েক বছর ধরে প্রচার করে যাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেট দল আগে আক্রমণাত্মক ছিল না, লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না, ক্রিকেটাররা মুখের মত জবাব দিতে পারতেন না ইত্যাদি। এই প্রোপাগান্ডা হাঁ করে গিলছেন প্রায় সবাই। ইতিহাস বিকৃত করা অথবা অস্বীকার করার যে ধারা এ দেশে চালু হয়েছে, সেই ধারারই অংশ এসব। যেন ১৯৭৬ সালে পোর্ট অফ স্পেনে নেহাত মিনমিন করে মোহিন্দর অমরনাথ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সুনীল গাভস্কররা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চতুর্থ ইনিংসে ৪০৬ রান তুলে জয় ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন। যেন স্টিভ ওয়র বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০০৩-০৪ মরসুমে সমানে সমানে লড়েনি ভারতীয় দল। যেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর কপিলদেব অপরাজিত ১৭৫ করতে পেরেছিলেন লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছাড়াই। ১৯৮১ সালে আগের টেস্টেই বাউন্সারে আহত হয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়া সন্দীপ পাতিলের অ্যাডিলেড টেস্টে ডেনিস লিলি, রডনি হগ, প্যাসকোকে বাইশটা চার আর একটা ছয় মেরে ১৭৪ রান করাও বোধহয় সম্ভব হয়েছিল আক্রমণাত্মক না হয়েই।

একটা প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত বিপক্ষে যাওয়ায় বিরাট নেশাগ্রস্তের মত স্টাম্প মাইক্রোফোনে টিভি সম্প্রচারকারীকে ধমকেছেন, সহ অধিনায়ক কে এল রাহুল গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটাকেই অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু ম্যাচের পর বিরাট ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কয়েকটা অর্থহীন কথা বলেছেন। “মাঠের ভিতরে ঠিক কী ঘটছিল বাইরের লোকেরা তো জানে না, আমরা জানি। আমি এখন বলব না যে আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কারণ তখন যদি আমরা চার্জড আপ হয়ে গোটা তিনেক উইকেট নিয়ে নিতাম তাহলেই খেলাটা ঘুরে যেত।” মনে করুন ২০০৭-০৮ মরসুমে সিডনি টেস্টের কথা। অস্ট্রেলিয় তৃতীয় আম্পায়ারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে ভারত কোণঠাসা হয়, তারপর শেষ দিনে স্রেফ রিকি পন্টিংয়ের মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে আম্পায়াররা সৌরভকে ড্রপ পড়া বলে আউট দেন, দল হেরে যায়। ভারত অধিনায়ক অনিল কুম্বলে মাঠের ভিতরে ছেলেমানুষের মত হাত-পা ছোঁড়েননি, চিৎকার করেননি। কিন্তু খেলার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন “এখানে একটা দলই ক্রিকেটের স্পিরিট অনুযায়ী খেলছিল।” এসব লড়াকু মনোভাব নয়, আগ্রাসন নয়, সাহসিকতা নয় — এমনটাই শিখে গেছি আমরা।

বিরাটের নেতৃত্বে নতুন কী ঘটেছে আসলে? ভারতীয় দল অনেক বেশি জয়ের মুখ দেখেছে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবার, দ্বিতীয়বার টেস্ট সিরিজ জিতেছে। কিন্তু সেই জয় আকাশ থেকে পড়েনি। বিরাটের দলের এই স্মরণীয় জয়গুলো এসেছে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়। সৌরভের আমলে শুরু হয়েছিল বিদেশে নিয়মিত টেস্ট ম্যাচ জেতা। জয়ের সংখ্যা বাড়ে ধোনির আমলে, বিরাটের আমলে আরম্ভ হয়েছে সিরিজ জয়। তার কৃতিত্ব অনেকটাই জোরে বোলারদের, নেতা হিসাবে অবশ্যই বিরাটেরও। উপরন্তু জয়ের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বিরাটের আমলে ভারত ইংল্যান্ডে সিরিজ জেতেনি, নিউজিল্যান্ডেও নয়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা হয়নি, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও দু’বারের চেষ্টায় প্রথমবার সিরিজ জিতে নতুন ইতিহাস তৈরি করা যায়নি। কিন্তু বিরাট বন্দনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এসব কথা বলতে গিয়েও ঠারেঠোরে জওহরলাল নেহরুকে ছোট করার ঢঙে আগের অধিনায়কদের এক হাত নেওয়া হয়। বলা হয় বিরাটের আগে কোনো অধিনায়ক নাকি জোরে বোলারদের এত গুরুত্ব দেননি। ঘটনা হল, আগে কোনো অধিনায়ক একসাথে এতজন ভাল জোরে বোলার পাননি। ভারতীয় ক্রিকেটে একসময় বিষাণ সিং বেদিকে বোলিং ওপেন করতে হয়েছে, এমনকী দু-একবার গাভস্করকেও। কারণ বিশ্বমানের জোরে বোলার কেউ ছিলেন না। সে পরিবর্তনও এসেছে ধারাবাহিকভাবেই।

প্রথমে এসেছেন কপিলদেব। তাঁর কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে জাভাগাল শ্রীনাথ, পিছু পিছু ভেঙ্কটেশ প্রসাদ। পরবর্তীকালে জাহির খান, আশিস নেহরারা। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছনো হত না পেস ত্রয়ীকে ছাড়া। সে ত্রয়ী তৈরিই হত না অধিনায়ক সৌরভ প্রায় অবসর নিয়ে ফেলা শ্রীনাথকে খেলতে রাজি না করালে। সৌরভের সময়েই সাড়া জাগিয়ে এসেছিলেন ইরফান পাঠান, যাঁর অলরাউন্ডার হতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। রাহুল দ্রাবিড় অধিনায়ক থাকার সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারতের হয়ে অল্প কিছুদিন রীতিমত গতিময় বোলিং করেছিলেন মুনাফ প্যাটেল আর বিক্রম রাজবীর সিং। প্রথম জন ক্রমশ গতি কমিয়ে ফেলেন, দ্বিতীয় জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে পারেননি। রাহুলের আমলেই উঠে এসেছিলেন শান্তাকুমারণ শ্রীশান্ত, রুদ্রপ্রতাপ সিংরা। ইতিমধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে, জোরে বোলারদের প্রতি যত্ন বেড়েছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে জোরে বোলিং সহায়ক পিচ তৈরিও শুরু হয়েছে। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামিদের রাত্রির বৃন্ত থেকে ফুটন্ত সকাল ছিঁড়ে আনার মত করে বিরাট নিয়ে আসেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সুযোগ না পাওয়া একজন অধিনায়কের পক্ষে তা সম্ভবও নয়।

এসব গোপনীয় তথ্য নয়, কিন্তু এখন কারো মনেই পড়ে না। কারণ আমাদের মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে, আর বিজ্ঞাপন ঢেকেছে বিরাটের মুখে। তাই একদিনের ক্রিকেটের দল একের পর এক বিশ্ব স্তরের টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হোক, বিরাটকে সরানো চলবে না। তিনি বিবৃতি দেবেন “টেস্ট আর একদিনের দলের নেতৃত্ব দিতে তৈরি থাকার জন্য টি টোয়েন্টির নেতৃত্ব ছেড়ে দিচ্ছি।” তবু আমাদের মনে হবে না, ভদ্রলোক অধিনায়কত্বকে জমিদারি মনে করছেন। তিনি গোট, তাঁর সাত খুন মাফ।

বস্তুত, ব্র্যান্ডিংয়ের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারলে দেখতে পেতাম, বিরাট (৯৯ টেস্টে ৭৯৬২ রান, গড় ৫০.৩৯, শতরান ২৭) টেস্ট ক্রিকেটে দারুণ এবং নিজের সময়ের সেরা ব্যাটারদের অন্যতম। কিন্তু গোট তো নয়ই, তাঁকে সর্বকালের সেরাদের একজন বলার সময়ও আসেনি। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে স্টিভ স্মিথ (৮২ টেস্টে ৭৭৮৪ রান, গড় ৫৯.৮৪, শতরান ২৭), কেন উইলিয়ামসন (৮৬ টেস্টে ৭২৭২ রান, গড় ৫৩.৪৭, শতরান ২৪) বরং তাঁর চেয়ে বেশি ধারাবাহিক। কেবল রানের দিক থেকে টেস্টের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দশে ঢুকতে হলেও বিরাটকে এখনো জনা কুড়ি খেলোয়াড়কে টপকাতে হবে। শুধু ভারতীয়দের মধ্যেও তিনি আপাতত ছয় নম্বরে। দলের জন্য যা আরও চিন্তার, তা হল গত কয়েক বছরে তাঁর পারফরম্যান্স গ্রাফ ক্রমশ নামছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে শেষ শতরানের পর থেকে হিসাব করলে তাঁর গড় ২৮.১৪।

আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি এই মুহূর্তে রানের দিক থেকে দু’নম্বরে, গড়ে এক নম্বর (৯৫ ম্যাচে ৩২২৭ রান, গড় ৫২.০৪), অধিনায়কত্বের রেকর্ডও ভাল। একদিনের ক্রিকেটের অধিনায়কত্বের রেকর্ডও নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় সাদা বলের ক্রিকেটে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জয়ের বিশেষ মূল্য নেই আজকের ক্রিকেটে। কারণ টি টোয়েন্টি যুগে দলগুলোর দ্বিপাক্ষিক ওয়ান ডে ম্যাচ খেলার আগ্রহ ক্রমশ কমছে। চার বছর অন্তর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে এক বছর অন্তর টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অর্থাৎ একটি দল পাঁচ বছরে চারটি বিশ্বকাপ খেলছে। সুতরাং দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলো বিশ্বকাপের প্রস্তুতি মাত্র। লক্ষ করে দেখুন, অস্ট্রেলিয়ার যে দল সদ্য ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি জিতল, সেই দলের সঙ্গে কিছুদিনে আগেই যে দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরেছিল তার বিস্তর তফাত। সুতরাং বিশ্বকাপে বা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রান করতে না পারলে বা ট্রফি জিততে না পারলে অন্য সময়ের ফলাফলের বিশেষ গুরুত্ব থাকে না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে আইপিএলের মত ফ্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট। সেখানে ব্যাটে প্রচুর রান থাকলেও নেতা বিরাট কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থ। রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের নেতা হিসাবে তাঁর প্রাপ্তি শূন্য।

যে ক্রিকেটে বিরাট সত্যিই সর্বকালের সেরাদের আসনের দাবিদার, তা হল একদিনের ক্রিকেট (২৫৫ ম্যাচে ১২২২০ রান, গড় ৫৯.০৩, শতরান ৪৩)। এখানে তাঁর সমসাময়িকরা কেউ ধারে কাছে নেই। শচীনের ৪৯ শতরানের রেকর্ডের থেকে মাত্র ছয় ধাপ দূরে আছেন বিরাট। গড়ের দিক থেকে তিনি আপাতত তিন নম্বরে, কিন্তু সামনের দু’জন খেলেছেন মাত্র গোটা তিরিশেক ম্যাচ। দুশোর বেশি ম্যাচ খেলেছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে তাঁর ব্যাটিং গড়ই সর্বোচ্চ। কিন্তু মুশকিল হল, ৫০ ওভারের খেলায় যাঁরা সর্বকালের সেরা হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত, অর্থাৎ ভিভ রিচার্ডস, শচীন, রিকি পন্টিং, সনৎ জয়সূর্য, কুমার সঙ্গকারা বা ধোনি — তাঁদের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের পাশে বিরাট ফ্যাকাশে (২৬ ম্যাচে ১০৩০ রান, গড় ৪৬.৮১, শতরান ২)। অথচ খেলে ফেলেছেন তিনটে বিশ্বকাপ। বিশেষত নক আউট স্তরে তাঁকে একবারও স্বমহিমায় দেখা যায়নি। বিশ্বকাপে রান এবং শতরানের দিক থেকে সবার উপরে থাকা শচীন তো বটেই, তিলকরত্নে দিলশান (২৭ ম্যাচে ১১১২ রান, গড় ৫২.৯৫, শতরান ৪), হার্শেল গিবসের (২৫ ম্যাচে ১০৬৭ রান, গড় ৫৬.১৫, শতরান ২) মত ক্রিকেটারদেরও বিরাটের চেয়ে বেশি স্মরণীয় পারফরম্যান্স রয়েছে। ফর্ম থাকলে আগামী বছর ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে হয়ত তিনি এই অভাব পুষিয়ে দেবেন।

একথা ঠিক যে পরিসংখ্যান দিয়ে সব কিছু প্রমাণ হয় না। কারণ পরিসংখ্যানে ধরা থাকে না পিচের অবস্থা, ম্যাচের পরিস্থিতি বা খেলোয়াড়ের শারীরিক অসুবিধা। ধুম জ্বর গায়ে বা বাউন্সারে মাথা ফেটে যাওয়ার পর করা ৩০ রানের মূল্য পরিস্থিতির বিচারে শতরানের চেয়েও বেশি হয় অনেকসময়। ব্যাটিংয়ের ল্যাজকে সঙ্গে নিয়ে আহত ভিভিএস লক্ষ্মণের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট জেতানো ইনিংসের মূল্য সংখ্যায় মাপা যায় কখনো? গত বছর রবিচন্দ্রন অশ্বিন আর হনুমা বিহারীর অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট বাঁচানো জুটির ওজনও ওই ম্যাচের স্কোরকার্ড দেখে উপলব্ধি করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাটিং কতটা ভাল তা প্রতিপক্ষের বোলিংয়ের মান না জেনে বিচার করা মূর্খামি। কারণ ক্রিকেট খেলায় একমাত্র বোলিংটাই ক্রিয়া; ব্যাটিং আর ফিল্ডিং হল প্রতিক্রিয়া।

কিন্তু পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে আলোচনা করলে বিরাটকে আর তত বিরাট মনে হবে না হয়তো। কারণ তখন বলতেই হবে, তাঁর কেরিয়ারের বড় অংশে সারা পৃথিবীতে এমন জোরে বোলার বিরল, যিনি যে কোনো পিচে যে কোনো আবহাওয়ায় দিনের যে কোনো সময়ে ঘন্টায় নব্বই মাইল বা তার বেশি গতিতে বল করতে পারেন। বড়জোর অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসন আর দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইন, মর্নি মর্কেলের কথা ভাবা যেতে পারে। নব্বই আর শূন্য দশকে কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, প্যাট্রিক প্যাটারসন, অ্যালান ডোনাল্ড, শোয়েব আখতার, ব্রেট লি, শেন বন্ডরা ছিলেন। সত্তর ও আশির দশকে ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয় ধরানো পেস চতুর্ভুজ, অস্ট্রেলিয়ার লিলি-থমসন, নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হেডলি, ইংল্যান্ডের বব উইলিস, পাকিস্তানের আক্রাম-ইউনিস। আরও বলতে হবে, তত গতিময় না হলেও এখন মিচেল স্টার্ক, জশ হেজলউড, জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, টিম সাউদিদের মত সুইং ও সিম করাতে পারা বোলাররা আছেন। কিন্তু বিশ্বমানের স্পিনার বলতে শুধু নাথান লায়ন। আজাজ প্যাটেল যতই এক ইনিংসে দশ উইকেট নিন, নিউজিল্যান্ড স্পিন সহায়ক উইকেট নয় বলে পরের ম্যাচেই তাঁকে খেলায়নি। আর ছিলেন ইয়াসির শাহ, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বিরাটের তাঁর বিরুদ্ধে খেলা হয়নি। অত্যন্ত মাঝারি মানের অ্যাডাম জাম্পা বা আদিল রশিদের বিরুদ্ধে কিন্তু বিরাটকে স্বচ্ছন্দ দেখায় না।

২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি ৫০ ওভারের খেলা দু প্রান্ত থেকে দুটি আলাদা বলে খেলা হবে — এই নিয়ম চালু করে। আগে একটি বলেই গোটা ইনিংস খেলার নিয়ম ছিল। সাধারণত ৩৫-৪০ ওভার নাগাদ সেই বলের সাদা রং নষ্ট হয়ে গিয়ে ব্যাটারদের দেখতে অসুবিধা হত, বল নরম হয়ে যাওয়ায় মারতে অসুবিধায় পড়তে হত, অনেকসময় বলের আকৃতিও যেত বিগড়ে। তেমন হলে আম্পায়াররা বল বদলাতে পারবেন, কিন্তু সেই বল আনকোরা নতুন হবে না, হবে একটু পুরনো বল। আগে হয়ে যাওয়া খেলাগুলোর মাঠ থেকে সংগ্রহ করে আনা অনেকগুলো বলের মধ্যে থেকে আম্পায়াররা বল বেছে নেবেন — এই ছিল নিয়ম। দুটো বলে খেলা শুরু হওয়ায় রিভার্স সুইং প্রায় বন্ধ, কারণ বল তেমন পুরনো হচ্ছে না। একই কারণে স্পিনারদের পক্ষে বল ঘোরানোও বেশি শক্ত হয়ে গেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রভাবে বাউন্ডারিও যে ছোট করে ফেলা হয়েছে, সচেতন টিভি দর্শকও তা বুঝতে পারেন। স্বভাবতই ব্যাটিং আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। শতরানের সংখ্যা বেড়েছে, আগে ব্যাট করলে তিনশো রান করে নিশ্চিন্ত থাকার দিন শেষ।

১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি খেলা হয়েছিল প্রথম একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ, আর প্রথম দ্বিশতরান এসেছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেটার বেলিন্দা ক্লার্কের ব্যাট থেকে। পুরুষদের ক্রিকেটে দ্বিশতরান এসেছে আরও ১৩ বছর পরে শচীনের ব্যাট থেকে। অথচ ২০১১ থেকে গত ১১ বছরে বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ক্রিস গেল, মার্টিন গাপ্টিল, ফখর জমান — সকলেই দ্বিশতরান করেছেন। একা রোহিত শর্মাই তিনটে দ্বিশতরানের মালিক। একদিনের ক্রিকেটে যাঁদের গড় পঞ্চাশের বেশি, তাঁদের মধ্যে মাইকেল বিভান আর নেদারল্যান্ডসের রায়ান টেন দুশখাতাকে বাদ দিলে সকলেরই কেরিয়ারের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ২০১১ সালের অক্টোবরের পরে।

বলা বাহুল্য, এসব পরিবর্তন বিরাটের সুবিধা হবে বলে কেউ করে দেয়নি। তিনি যে নিয়মে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তার মধ্যে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দিয়েছেন। কিন্তু সর্বকালের সেরাদের পাশে বসাতে হলে বা একেবারে গোট বলতে হলে এমন তুল্যমূল্য আলোচনা যে করতেই হয়। আসলে ওসব ব্র্যান্ডিংয়ের কারসাজি। আশা করা যায় ভক্তরা না বুঝলেও বিরাট নিজে সে কথা বোঝেন, ফলে মেসিসুলভ মূঢ়তায় কোনো লম্বকর্ণের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না। এখনো যে অনেক কিছু অর্জন করা বাকি আছে, তা বুঝলে তিনি আরও বড় ক্রিকেটার হতে পারবেন। ভারতীয় দলও আরও অনেক বেশি জয়ের মুখ দেখবে। ইতিহাস পারফরম্যান্স বোঝে। মন কি বাত বোঝে না, স্টাম্প মাইক কি বাতও বোঝে না।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

%d bloggers like this: