কংগ্রেস-সিপিএম জোট নিয়ে সীতারামায়ণ

“মিত্রোঁ, আপনারা দেখুন, আমি দলিত বাবা-মার চা ওয়ালা ছেলে, আপনাদের আশীর্বাদে ক্ষমতায় এসেছি। আমাকে সরানোর জন্যে সবাই একজোট হয়েছে। এদের কোন নীতি নেই, কোন আদর্শ নেই, শুধু একটাই উদ্দেশ্য — মোদীকে হারানো। কারণ মোদী গরীব মানুষের জন্যে কাজ করে, কারণ মোদীর আমলে হিন্দুদের জাগরণ হয়েছে” ইত্যাদি

সিপিএম

মার্কসবাদ মানে কী, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি যা বলছেন সেটাই কিনা, প্রকাশ কারাত ঠিক না ভুল — এসব তত্ত্বকথা না হয় থাক। তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করার বৈদগ্ধ্য আমার নেই, যতদূর জানি বেশিরভাগ লোকেরই আমার মতই অবস্থা। অতএব ওসব ভুলে গিয়ে একটা কান্ডজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্ন করি। কান্ডজ্ঞান ব্যাপারটা সংসদীয় রাজনীতিতে প্রায়শই গাণিতিক। অতএব প্রশ্নটাকে অঙ্কের প্রশ্নও বলা যায়। প্রশ্নটা এই — যে অঙ্কটা একবার ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে সেটাই আবার করতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ কিনা।

পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের জোট নিদারুণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। আসন সংখ্যাটা যেসব সিপিএম কর্মীর মনে আছে তাঁরা নিশ্চয় মানেন একা লড়লে ৩৪ বছরের শাসন বা অপশাসন সত্ত্বেও এত খারাপ অবস্থা হত না। অর্থাৎ ইয়েচুরি, কারাত, বেঙ্গল লাইন, কেরালা লাইন যা-ই হোক না কেন হাতে কাস্তে হাতুড়ি উঠে আসা ভোটাররা মোটেই পছন্দ করেননি। সীতারামের একমাথা চুল বলেই তিনি আবার বেলতলায় যাবেন এটা কী ধরণের কান্ডজ্ঞান ভগবান কিম্বা মার্কস কেউই জানেন না বোধহয়।

আজকের টাইমস অফ ইন্ডিয়া পড়ে বুঝলাম ভদ্রলোকের আবার পার্টির উপর অভিমান হয়েছে। “আমায় প্রো-কংগ্রেস বললে আমিও প্রো-বিজেপি বলতে পারি” জাতীয় ছেলেমানুষি কথাবার্তা বলেছেন ধেড়ে সাধারণ সম্পাদক। সে বলুন গে। উনি বুঝবেন আর ওঁর পার্টি বুঝবে। কিন্তু উনি মার্কসবাদের মানে যা বলেছেন সেটা মেনে নিলেও যে কংগ্রেসের সাথে জোট সমর্থনযোগ্য হচ্ছে না! উনি বলেছেন যে বদলাতে পারে না সে কমিউনিস্ট নয়। মেনে নেওয়া গেল। তাহলে উনি নিজে কংগ্রেসের সাথে জোটের চূড়ান্ত ব্যর্থতা দেখার পরেও বদলাচ্ছেন না কেন?

ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে তাড়ানো যে আশু কর্তব্য তা নিয়ে শুধু সিপিএম বা বামপন্থী কেন, বিরোধী রাজনৈতিক দল বা দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা নাগরিকদের কারোরই দ্বিধা আছে বলে মনে হয় না। সীতারাম নিজেও বলেছেন মতপার্থক্য শুধু কিভাবে সেটা নিয়ে। তাহলে কেন মনে হচ্ছে যে বিরোধী ঐক্যটা নির্বাচনী জোট করেই হতে হবে? ভোটের পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী তো সিদ্ধান্ত নেওয়াই যায়। সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই তো নির্বাচন দিয়েই শেষ হবে না।

তেলে আর জলে মিশ খাওয়াতে গেলে যে যাকে হারাতে চাইছি তারই সুবিধা হয় সেই শিক্ষাটা ২০১৬ সালের ফল থেকে নেওয়া কি এতই শক্ত? আমরা কেউ কি ভুলে গেছি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে মমতা কী বলে গেলেন সমানে? কংগ্রেস সমর্থকদের বললেন “দেখুন, বরাবর বলেছি কংগ্রেস সিপিএমের বি টিম। দেখলেন তো? ওরা সাঁইবাড়ির শহীদদের কেমন ভুলে গেল দেখুন।” আর সিপিএম সমর্থকদের ছুঁয়ে গেল তাঁর টিটকিরি “বাহাত্তরের সন্ত্রাস ভুলে গেলেন কমরেড?” এর ফলে যেটা হল সেটা হচ্ছে গোটা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঁচ বছর কী কাজ করলেন তার কোন হিসাবই দিতে হল না। বিরোধীরা নিজেদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ সামাল দিতেই ব্যস্ত থাকলেন, সরকারকে প্রশ্নটা করবেন কখন?

আরও পড়ুন ঢেউ উঠছে…

এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়, রামধনু জোট হলে নরেন্দ্র মোদীর কাজটাও একইরকম সহজ হয়ে যাবে। অর্থনীতির বেহাল অবস্থার জন্যে জবাবদিহি করতে হবে না, সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার পুঁজিবাদের জন্যে কৈফিয়ত দিতে হবে না, কর্নিসেনাদের তোল্লাই দেওয়া, মুসলমান, দলিতদের উপর অত্যাচারের প্রশ্ন উঠবেই না। তিনি শুধু কেঁদেকেটে মিটিঙে মিটিঙে সেই ফাটা রেকর্ড বাজাবেন “মিত্রোঁ, আপনারা দেখুন, আমি দলিত বাবা-মার চা ওয়ালা ছেলে, আপনাদের আশীর্বাদে ক্ষমতায় এসেছি। আমাকে সরানোর জন্যে সবাই একজোট হয়েছে। এদের কোন নীতি নেই, কোন আদর্শ নেই, শুধু একটাই উদ্দেশ্য — মোদীকে হারানো। কারণ মোদী গরীব মানুষের জন্যে কাজ করে, কারণ মোদীর আমলে হিন্দুদের জাগরণ হয়েছে” ইত্যাদি। এর সাথে মোদীর ইশারায় সাঙ্গোপাঙ্গদের তৈরি কিছু বাইনারি তো থাকবেই, সেগুলো তো জোট হলেও হবে, না হলেও হবে। অর্থাৎ বিরোধীরা যথারীতি নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকবেন। বরং মোদীর পক্ষে তুলনায় শক্ত হবে যে রাজ্যে যে শক্তিশালী সেখানে তার মোকাবিলা করা। কারণ ২০১৪ র হাওয়া আর নেই। সব প্রশ্নপত্রের একই উত্তর দিয়ে তখন ড্যাংড্যাং করে পাশ করা গেছিল, এবারে অত সোজা হবে না। অতএব আমি যদি মোদী হতাম, আমি চাইতাম শুধু কংগ্রেস-বাম নয়, যত বিরোধী দল আছে সব্বাই মিলে একটা জোট হোক। তাহলে বলতে পারব সারদা, নারদা, ভাদরা, কাস্তে হাতুড়ি সবাই এক। এরা এক হয়ে দেশের মানুষকে লুটতে চায়। এটা অ্যান্টি-ন্যাশনালদের জোট। অর্ণব গোস্বামীকে লেলিয়ে দেব, সে জিওর্জিও আরমানির স্যুট আর জিমি চুর জুতো পরে বলবে “এটা দেশের গরীব মানুষের ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় ফিরতে হাত নিশপিশ করা লুটিয়েন্স এলিট আর জেএনইউ এর অ্যান্টি-ন্যাশনাল বামেদের জোট। এতদিন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ছিল, এবার ভোটে হয়েছে।” আহা! ভারী মজা হবে।

অনেক বাজে বকলাম। একটা মজার স্মৃতি দিয়ে শেষ করি।

জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে যখন সিপিএম পার্টিতে বিতর্ক হয় তখন সীতারাম ইয়েচুরি ছিলেন সরকারে না যাওয়ার পক্ষে। সেবারে তাঁরাই জয়যুক্ত হয়েছিলেন। তারপর আজকালে একটা ছবি বেরিয়েছিল। ছবি মানে এখন যাকে মিম (meme) বলা হয়। ছবিতে কার্ল মার্কসের মূর্তির সামনে বসে সীতারাম বোঝাচ্ছেন “মার্কসবাদ মানে হল…”। আর মার্কসের মূর্তিটা বলছে “এটা আবার কে?”

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন।

One thought on “কংগ্রেস-সিপিএম জোট নিয়ে সীতারামায়ণ”

Leave a Reply

%d bloggers like this: