বামপন্থী, বা বৃত্তটা আরেকটু ছোট করে বললে মার্কসবাদী আন্দোলনে, মাঝেমাঝেই অনেক মতপার্থক্য ঘটে। এ সেই মার্কস, এঙ্গেলসের আমল থেকেই চলে আসছে। আন্দোলনের পথ নিয়ে তো বটেই, এমনকি লক্ষ্য নিয়েও মতান্তর হয়েছে। তার সুগ্রন্থিত ইতিহাস আছে। এদেশেও তো একসাথে যাত্রা শুরু করেও কমিউনিস্টরা পরে নানাভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন।
শুধু আন্দোলনেই নয়, আমার মত বামমনস্ক কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করা লোক যারা আছে তাদের মধ্যেও মতপার্থক্য হয়। কয়েকদিন আগেই যেমন লেনিনের মূর্তি ভাঙার পালটা শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি ভাঙা ঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়ে হল।
এরকম মতান্তর এবং তা নিয়ে তর্ক আমরা বামপন্থী বন্ধুরা সামনাসামনি করি, দেখা না হলে ফোনে করি, ফেসবুকে করি, সর্বত্র করি। এবং ঝগড়া করে একে অপরের উপর রাগ করি, অভিমান করি। কোন ব্যাপারে মৃণাল হয়ত ভাবল “প্রতীকটা এরকম স্বল্পমেয়াদী চিন্তা করছে! চটজলদি সমাধান ভাবছে! ছিঃ!” আর প্রতীক ভাবল “সিদ্ধার্থকে এতদিন চিনি, আমার চেয়েও বেশি মার্কসবাদ পড়েছে। আর ও কিনা প্রত্যাঘাতের গুরুত্ব বুঝল না!” মণিশঙ্কর হয়ত এদের চেয়ে ঠান্ডা মাথার ছেলে। তাই সে ভাবছে “নাঃ! প্রতীককে সামনে পেলে বোঝাতে হবে। এটা হতে দেয়া যায় না।”
এই যে মতান্তর, আন্দোলনেই হোক বা সমর্থকদের মধ্যে, এটা কিন্তু নেহাত খারাপ নয়। এটা হওয়ার কারণ সমস্যাগুলো নিয়ে এই সব পক্ষই মনপ্রাণ দিয়ে ভাবছে এবং নিজের মত করে ভাবছে। কারোর কাছেই এটা নিছক আড্ডা দিয়ে বা বিতর্কসভা করে ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। আর ইংরিজিতে কথা আছে না “fools seldom differ”? বিজেপি সমর্থকরা যেমন লক্ষ্য করি সব ব্যাপারেই একমত। দুজন সামনাসামনি বসলে এত একরকম কথা বলে যে যে তাড়াতাড়ি বলতে পারে সে-ই বলে যায়, অন্যজনের মাথা নাড়তে নাড়তে ঘাড় ব্যথা হওয়ার যোগাড়।
কিন্তু বামপন্থীদের মধ্যে যত মতপার্থক্যই থাক, দেশের আজকের অবস্থায় যে একত্র হওয়া দরকার সেটা নিয়ে বিরাট কোন মতান্তর নেই। মতান্তর যা আছে, তা বামেরা ছাড়াও আর কাউকে দলে টানা দরকার কিনা তাই নিয়ে। সেই বিতর্কের সমাধান করে দেওয়ার দায়িত্ব বোধহয় সাধারণ মানুষই নিয়ে নিয়েছেন। প্রথমে ত্রিপুরার নির্বাচনে তাঁরা সিপিএম সরকারকে হারিয়ে দিলেন, কংগ্রেসকে একটা আসনও দিলেন না। তারপর মহারাষ্ট্রে, যেখানে বামেরা বিধানসভায় উপস্থিতির বিচারে কোন শক্তিই নয়, সেখানকার হাজার হাজার কৃষক কিনা লাল পতাকা হাতে ছদিন মিছিল করে পৌঁছে গেলেন ভারতীয় পুঁজিবাদের সদর দপ্তর মুম্বাইয়ে! কে জানে, কলকাতার লেনিন সরণির স্ট্যাচুটা হয়ত স্মিত হেসে বলেছে “একটু পা চালিয়ে ভাই।” শুধু মহারাষ্ট্রের কৃষক নয়, আমাদের মিডিয়া পাত্তা দিক আর না-ই দিক, মাত্র কয়েকমাস আগে রাজস্থানের কৃষকরাও লাল ঝান্ডা হাতে বিজেপি সরকারের শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন।
আইনসভায় উপস্থিতির দিক থেকে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে বামেদের ক্ষমতায় আসার কোন সম্ভাবনা নেই, কিন্তু খুব কম সময়ের ব্যবধানে দুটো আন্দোলন ক্ষমতার মেদ জমে যাওয়া বামপন্থীদেরও দেখিয়ে দিল “রাস্তাই একমাত্র রাস্তা।” এম পি, এম এল এ না-ই থাক, বামপন্থীরা মানুষের পাশে থাকলে, রাস্তায় থাকলে এখনো কী করতে পারে টের পেয়ে গেল সবাই।
আজকের মুম্বাইতে লাল ঝান্ডা যেটা করতে পারল সেটা সম্ভবত আজকের কলকাতায় পারত না। গ্রাম থেকে শহর হয়ে ওঠা মফঃস্বলের ছেলে হয়েও তো কৃষক সভার অস্তিত্ব টের পাই না বহুবছর হল। হয়ত পশ্চিমবঙ্গের কৃষকও ঝান্ডাটাকে নিজের মনে করতে পারেন না আর। তার পেছনে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের শেষের দিককার ভূমিকা থাকা স্বাভাবিক। যতটুকু বুঝেছি, সাধারণ মানুষের কাছে লাল পতাকাটারই আলাদা পরিচিতি আছে, ভিন্নমত বাম দলগুলোর সেভাবে নেই। সেজন্যেই এত বছর পরেও বিদ্যাসাগরের মাথা কাটার দায় সিপিএমের ঘাড়ে চেপে যায়। একইভাবে সিপিএমের কুকর্মের দোষ এস ইউ সির ঘাড়ে কেউ চাপিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
শত্রুরাও কিন্তু লাল পতাকাধারী সব দলকেই এক ও অভিন্ন শত্রু বলে মনে করে। এবং বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে যতই তর্ক করুন কে প্রধান শত্রু তা নিয়ে, ফ্যাসিবাদীরা নিঃসংশয় যে বামপন্থীরাই প্রধান শত্রু। তা নাহলে ২০১৪ থেকেই মূর্তি ভাঙা শুরু হত নেহরু, গান্ধী বা ইন্দিরাকে দিয়ে। একটা বুড়ো আঙুলের সমান রাজ্যে লেনিনের মূর্তি ভেঙে এর সূচনা হত না।
সুতরাং হোক না, যেখানে কোনদিন ক্ষমতায় আসেনি কোন বামপন্থী দল, লড়াইটা সেখান থেকেই নতুন করে শুরু হোক না। আর এই আন্দোলন তো বেশকিছু নতুন জিনিস শেখাচ্ছে, বাকি দেশের বামপন্থীরা, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা রাজ্যের বামপন্থীরা সেগুলো শিখুন না। যেমন পরীক্ষার্থীদের যাতে অসুবিধা না হয়, তাই মিছিলটা আজাদ ময়দান পৌঁছল রাতেই, সকালে নয়। এটা নিশ্চয়ই শেখার মত। ভরসার কথা তো এটাই যে মহারাষ্ট্রের মত অতবড় রাজ্যের কৃষক লাল ঝান্ডাধারীদের এখনো বিশ্বাস করেন, তাই গলায় দেওয়ার দড়ি ছেড়ে রক্তপতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন।
অনাবশ্যক আশাবাদ মনে হচ্ছে? হতেই পারে, কারণ কিছুদিন আগেই একটি বামপন্থী দলের সর্বক্ষণের কর্মী এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। সে বলছিল হিন্দি বলয়ের অনেক রাজ্যেই শ্রমিক, কৃষক লাল পতাকাকে বিশ্বাস করেন, কিন্তু বলেন “দাবী আদায় করতে লাল পার্টি, ভোট দেয়ার জন্যে অন্য পার্টি।” কেন হয় এমনটা? ভীষণ কঠিন পরিস্থিতিতে, মার খেয়ে, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, সবচেয়ে বড় কথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবহেলা উপেক্ষা করে, যে পার্টিকর্মীরা ঐসব রাজ্যে সংগঠন চালান তাঁরা কি পারছেন না আশু দাবী আদায় করার চেয়ে বেশি কিছু শ্রমিক, কৃষককে ভাবাতে? সোশাল ডেমোক্রেসির স্বপ্ন দেখাতে না পেরে কি ট্রেড ইউনিয়নবাদে পর্যবসিত হচ্ছে ঐসব রাজ্যের বামপন্থী রাজনীতি (যার বিরুদ্ধে লেনিন বারবার সতর্ক করেছেন)? সক্রিয় বামপন্থীরা ভেবে দেখতে পারেন।
আমরা যারা রাস্তায় নেই, ময়দানে নেই তারা শুধু স্বপ্নই দেখতে পারি। অবশ্য লেনিন রুশ সাহিত্যিক দিমিত্রি পিসারেভকে উদ্ধৃত করে বলেছেন “স্বপ্ন আর বাস্তবের পার্থক্যে কোনই ক্ষতি হয় না, যদি স্বপ্ন যে দেখে সে গভীরভাবে বিশ্বাস করে তার স্বপ্নে, নিবিড়ভাবে অনুধ্যান করে জীবনকে, জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তার স্বপ্নসৌধকে আর সাধারণভাবে বলতে গেলে, তার আকাশকুসুমগুলিকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য যদি সে নিষ্ঠাসহকারে কাজ করে।”
ঢেউ উঠছে…
সাধারণ মানুষের কাছে লাল পতাকাটারই আলাদা পরিচিতি আছে, ভিন্নমত বাম দলগুলোর সেভাবে নেই। সেজন্যেই এত বছর পরেও বিদ্যাসাগরের মাথা কাটার দায় সিপিএমের ঘাড়ে চেপে যায়। একইভাবে সিপিএমের কুকর্মের দোষ এস ইউ সির ঘাড়ে কেউ চাপিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই
One thought on “ঢেউ উঠছে…”