তারুণ্যের হাড়িকাঠে বলি দেওয়া হয়নি শৈলজাকে

সংবাদমাধ্যম এবং এল ডি এফ-বিরোধী দল ও ব্যক্তিবর্গ রেগে আগুন। রাগ আবর্তিত হচ্ছে কে কে শৈলজাকে কেন্দ্র করে।

সিপিএম

ভারতে প্রবীণ মানে প্রাজ্ঞ ভাবাই রীতি, কিন্তু সম্প্রতি তরুণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজনীতিতে যৌবনই অধিক প্রার্থিত। সেই ধারা মেনে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব থেকে জীর্ণ, পুরাতন যাক ভেসে যাক — এই দাবি উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম প্রার্থী তালিকায় নতুন মুখের ভিড় প্রশংসিত হয়েছে, কোন আসনে না জিতলেও তরুণ প্রার্থীরা নিজ নিজ কেন্দ্রে পার্টির ভোট বাড়াতে পেরেছেন। কিন্তু কেরালার ৭৫ বছর বয়সী সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন তরুণ মন্ত্রিসভা তৈরি করে সমালোচিত হচ্ছেন।

বিজয়নের ২১ জনের মন্ত্রিসভায় দশজন প্রথমবারের বিধায়ক, বেশিরভাগ আগে কখনো মন্ত্রী হননি। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম এবং এল ডি এফ-বিরোধী দল ও ব্যক্তিবর্গ রেগে আগুন। রাগ আবর্তিত হচ্ছে কে কে শৈলজাকে কেন্দ্র করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে অতিমারীর সময় তাঁর কাজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। কেন তাঁকে বাদ দেওয়া হল? সিপিএমের ব্যাখ্যা — শৈলজার ব্যাপারে আলাদা কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তারুণ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার সামগ্রিক সিদ্ধান্তের অঙ্গ হিসাবেই তিনি বাদ। কিন্তু বাতাসে নানাবিধ অভিযোগ ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রথমত, কেরালার কমিউনিস্টরা নারীবিদ্বেষী। দ্বিতীয়ত, বিজয়ন শৈলজাকে মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার মনে করছিলেন। তাই পথের কাঁটা সরিয়ে দিলেন। তৃতীয়ত, তারুণ্যের অজুহাতে তিনি স্বজনপোষণ করছেন। তাঁর জামাই মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন অথচ শৈলজার জায়গা হল না?

প্রথম অভিযোগটা নিয়ে কদিন বহু নারীবাদী সোশাল মিডিয়ায় বিস্তর লড়েছেন। কিন্তু মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর দেখা গেল সেখানে তিনজন মহিলা রয়েছেন, যা কেরালায় সচরাচর হয় না। উপরন্তু শৈলজার দপ্তরের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে একজন মহিলাকে। সেই বীণা জর্জ অনভিজ্ঞ, কিন্তু পাঁচ বছর আগে শৈলজাও অনভিজ্ঞ ছিলেন।

দ্বিতীয় অভিযোগের মুশকিল হল, জয়ী দলের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদলানোর কোন দাবি উঠেছিল — এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। শৈলজাকে মন্ত্রিসভায় রেখে দেওয়া হোক — রাজ্য কমিটির অন্তত সাতজন এমনটা চেয়েছিলেন বলে এক সংবাদপত্র জানিয়েছে। কিন্তু নেতৃত্ব বদলের দাবির খবর নেই। তাহলে বিজয়ন চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা করলেন কখন এবং কেন? কেরালা সিপিএম পরপর দুবার কাউকে মন্ত্রী না করার নীতি ঘোষণা করেছে। সেই অনুযায়ী ২০২৬-এ এল ডি এফ ফের জিতলেও বিজয়ন মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না। তাহলে কার পথ, কে-ই বা কাঁটা? পরবর্তীকালে দলের নিয়ম স্রেফ বিজয়নের জন্য ভাঙা হলে তা নিশ্চয়ই নিন্দাযোগ্য। কিন্তু তার জন্য পাঁচটা বছর অপেক্ষা করতে হবে। ইতিমধ্যে শৈলজাকে বিধানসভায় পার্টির হুইপ করা হয়েছে। মন্ত্রিত্ব যাদের মোক্ষ, তাদের কাছে এটা অবশ্যই পদাবনতি। শৈলজার মনোভাব অদূর ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে।

বিজয়নের জামাই মহম্মদ রিয়াজ কি স্রেফ জামাই বলেই মন্ত্রী হয়েছেন? তাহলে বিজয়ন অবশ্যই ‘ডাইনেস্টি’ প্রতিষ্ঠা করছেন। রিয়াজ স্কুলে পড়ার সময় থেকে সিপিএমের ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত, ইউনিট কমিটি থেকে রাজনীতি করা শুরু করেছেন, পার্টি সদস্য ১৯৯৩ থেকে। বিজয়ন কন্যার সাথে বিয়ে হয়েছে ২০২০-তে। এ যদি ডাইনেস্টি হয়, তাহলে ডাইনেস্টির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা দরকার।

আরও পড়ুন কংগ্রেস-সিপিএম জোট নিয়ে সীতারামায়ণ

পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসনের ৩৪ বছরে এই আলোচনার দরকার পড়েনি। সংসদীয় রাজনীতিতে কোন কমিউনিস্ট দলের এত দীর্ঘ শাসনকাল যেমন বিরল, তেমনি নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর পর বারবার ফিরে আসাও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। জার্মানি, ইতালি বা স্পেনে একদা কমিউনিস্ট দলগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থাকতে থাকতে ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় (অনেকটা বঙ্গ সিপিএমের মত)। পরবর্তীকালে অন্য চেহারায় অন্য নামে, সমাজবাদী বা কোন মধ্যপন্থী দলের সাথে মিলে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় ফিরেছে। কমিউনিস্ট পরিচয়ে নয়। সুতরাং কেরালাও বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। এহেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কেরালার কমিউনিস্টরা যে মন্ত্রিসভা বানালেন, তার ফল ক্রমশ বোঝা যাবে। তবে যে দেশে কোন রাজ্যে দাগী আসামী মুখ্যমন্ত্রী হয়, কোথাও বা মন্ত্রীদের গ্রেপ্তারি আটকাতে মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের গ্রেপ্তারি চাইতে হয় — সে দেশে এক রাজ্যের মন্ত্রিসভায় কেন একজন কর্মঠ মন্ত্রীর পুনর্বার জায়গা হল না, তা নিয়ে বিতর্ক ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য নিয়ে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখায়।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading