শীতলকুচির প্রতি ঈষদুষ্ণ ব্যবহার: সঙ্কোচের বিহ্বলতায় বাম রাজনীতি ম্রিয়মান

বামপন্থীরা কি কেবল বুলিতেই আটকে থাকবেন? বরাবর তো তাঁদের শক্তি ছিল দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় পথে নেমে আন্দোলন।

“এই নির্বাচন গুলি দিয়ে নয়, বুলি দিয়ে হওয়া উচিৎ”, বললেন সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম। মনে পড়ে গেল সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে রাম বিভীষণকে খোঁড়াতে দেখে বলছেন “যত তেজ বুঝি তোমার মুখেই।” জাম্বুবান পাশ থেকে টোন কাটছে “আজ্ঞে হ্যাঁ, মুখেন মারিতং জগৎ”। আসলে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এবং সিপিএম দলের ইতিহাস সম্বন্ধে ন্যূনতম, লোকের মুখে শোনা ধারণা থাকলেও বিশ্বাস করা শক্ত হবে যে গণতন্ত্রের চরম সঙ্কটের মুহূর্তে একজন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা লড়াই আন্দোলনের কথা বলছেন না, রাজ্য অচল করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন না। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এক কবি একদা লিখেছিলেন “রাস্তাই একমাত্র রাস্তা”, আর সেলিম বললেন বাকযুদ্ধই একমাত্র রাস্তা!

রাষ্ট্রের বন্দুকের গুলিতে চারজন মানুষের প্রাণ চলে যাওয়ার পর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। দোষীদের শাস্তি হয়নি, হবেও না। কারণ নির্বাচনকালীন প্রশাসন অজস্র অস্বস্তিকর প্রশ্ন না শোনার ভান করে আত্মরক্ষার স্বার্থে জওয়ানরা গুলি চালিয়েছিল বলে রায় দিয়ে ফেলেছে। ব্যবস্থা নেওয়া বলতে নির্বাচন কমিশন ৭২ ঘন্টা রাজনৈতিক নেতাদের ঐ এলাকায় ঢুকতে বারণ করেছে আর বাকি চার দফা নির্বাচনের প্রচার এক দিন করে কমিয়ে দিয়েছে। স্পষ্টতই, যে চারজনের প্রাণ গিয়েছে, সেই মনিরুজ্জামান, ছামিউল, হামিদুল আর নুর সম্বন্ধে নির্বাচন কমিশনের মনোভাব — পরের ছেলে পরমানন্দ। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির নেতা দিলীপ ঘোষ বলেই দিয়েছেন দরকার পড়লে আরো শীতলকুচি হতে পারে। ফলত নির্বাচন কমিশন স্বয়ংশাসিত সংস্থা — এ কথা এখন কলেজের ছাত্রদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষার উত্তর মাত্র। এমতাবস্থায় লক্ষ্মী ছেলের সংসদীয় রাজনীতি যে ভোটারদের সমর্থন আদায় করা আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্কটের মোকাবিলা করা — দুটোর কোনটার জন্যেই যথেষ্ট নয়, তা বিজেপি বিরোধী যে কোন রাজনৈতিক নেতার বুঝতে পারা উচিৎ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিলক্ষণ বুঝেছেন। তাই ঘটনার দিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করেছেন, শীতলকুচিতে তাঁর যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মৃতদের পরিবার পরিজনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছেন। আর বামপন্থীরা ইতিমধ্যে কী করলেন?

তাঁরাও প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। জেলায় জেলায় প্রতিবাদ হবে। যেমন প্রতিবাদ দলীয় বৃত্তের বাইরে থাকা কোন কোন সংগঠনও করছে। শীতলকুচির ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, সেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর আচরণের নিন্দা ছিল। বলেছিলেন যে দলের লোকই মারা গিয়ে থাক, নিন্দার ভাষা নেই। সঙ্গে ছিল এই বক্তব্য, যে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার প্রস্তাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী কেন ঘেরাও করার কথা বলেছিলেন, তার আগের ঘটনাবলী কী, সেসব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সময় সম্ভবত সিপিএম নেতৃত্ব পাননি।

কোন সন্দেহ নেই তৃতীয় দফা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যে মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ভোটদান হয়েছে, বহু জায়গায় মানুষ দশ বছর পর নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছেন, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের আতঙ্ক কেটেছে, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বড় ভূমিকা রয়েছে। যাঁরা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বাদ দিয়ে ভোট করানো হোক দাবি তুলছেন এখন, তাঁদের চোখে হঠাৎ রাজ্য পুলিস ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেছে। রাজ্যের বহু মানুষ তাঁদের সাথে একমত হবেন না। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীও চুপচাপ ভোটারদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে তা নয়। রাজ্যের একাধিক জায়গা থেকে তাদের আচার আচরণ নিয়ে মানুষ প্রথম দফা থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন। কেউ বলছিলেন তারা বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, কেউ বলছিলেন তারাই উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আরো গুরুতর কিছু অভিযোগ উঠেছে, ভোটের ডিউটি করে এসে প্রিসাইডিং অফিসাররা সেসব সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল হুগলী জেলা থেকে। সেখানে ৫ই এপ্রিল রাতে একটি দশম শ্রেণির ছাত্রীকে স্কুলবাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। সেই জওয়ানকে পুলিস গ্রেপ্তার করেনি। [১]

এই বাহিনীকে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘেরাও করার কথা বলে থাকেন, তার নিন্দা করা যেতে পারে বড় জোর এই মর্মে, যে এতে উত্তেজনা ছাড়বে, ভোটের মরসুমে তা কাম্য নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মানুষের মৃত্যুর পর মমতার ঐ উক্তিকেও উস্কানিমূলক আখ্যা দিয়ে সমানভাবে দায়ী করলে মনে হয়, মৃতেরা বা স্থানীয় মানুষ সত্যি সত্যিই জওয়ানদের আক্রমণ করেছিলেন, তাই তারা গুলি চালিয়েছে। অথচ তেমন কোন ভিডিও ফুটেজ বা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দুদিন পেরিয়ে গেলেও পাওয়া যায়নি। সাত তাড়াতাড়ি পুলিসের বক্তব্য বিশ্বাস করে ঐ বিবৃতি সুজনবাবু দিলেন কেন? ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজের আজকের সংস্করণ পড়লে সুজনবাবু আরো ধন্দে পড়বেন। কারণ মঈনুদ্দিন চিস্তির প্রতিবেদন বলছে, যে মৃণাল হক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে নাকি জওয়ানরা তাকে সাহায্য করতে যায় এবং গুজব রটে তাকে মারধর করা হয়েছে, তা থেকে অশান্তি শুরু হয়, সেই মৃণাল হকের বাবা-মা বলছেন সে বাজারে গিয়েছিল, তাকে জওয়ানরা অকারণে মারধর করে। সত্য যা-ই হোক, নির্বাচন কমিশনে জমা পড়া রিপোর্টের সাথে এই বয়ান যে মিলছে না। [২] সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দের চোখেও এইসব অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। আজ কলকাতায় নির্বাচন আধিকারিকের সাথে দেখা করে বেরিয়ে তাঁরা যে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন তাতে তা-ই বোঝা গেল। তাহলে অন্য নেতার মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করার অত তাড়া ছিল কেন, সে প্রশ্ন রয়ে গেল। [৩]

তবু তো সুজনবাবুর বিবৃতিতে ঘটনার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিন্দার ভাগ বেশি ছিল। যত সময় গড়িয়েছে, বাম নেতা কর্মীদের ভাষ্যে নিক্তিতে মেপে বিজেপি আর তৃণমূলকে সমান দায়ী করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে সেলিমবাবুর সাংবাদিক সম্মেলন। শেষকালে তিনি অমিত শাহ আর মমতা — দুজনেরই পদত্যাগ দাবি করে বসলেন। অমিত শাহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে এই ঘটনা ঘটেছে — এমন অভিযোগ অনেকেই করছেন। ফলে সেলিম তাঁর পদত্যাগ দাবি করতেই পারেন। কিন্তু কেবল কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করতে বলেছেন বলে মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে, এ যুক্তি হাস্যকর। অবশ্য সেলিমের পক্ষ সমর্থনে বলা যেতে পারে যে তিনি ঐ দুজনের পদত্যাগ করা উচিৎ বলেই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে দেন, ফলে মমতার কেন পদত্যাগ করা উচিৎ তার যুক্তি ব্যাখ্যা করার সময় পাওয়া যায়নি। মনে কী দ্বিধা রেখে তিনি চলে গেলেন!

কোন যুক্তি যদি থেকেও থাকে, তা দুর্বোধ্য। কেউ বুঝেছেন বলে মনে হয় না। সাধারণ ভোটারের কাছে বরং এ কথাই প্রতিভাত হল, যে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্যই যে এই গুলি চালনা, বিজেপি-বিরোধী ভোটারদের বার্তা দেওয়ার জন্যই যে এই নৃশংসতা — বামপন্থীরা তা বুঝলেন না বা বুঝতে চাইলেন না। আমরা তৃতীয় পক্ষ, আমাদের অন্য দুই পক্ষকেই আক্রমণ করতে হবে — এই রাজনৈতিক হীনমন্যতা তাঁদের বিজেপি-বিরোধী ভোটারদের নিজেদের দিকে টেনে আনার প্রয়োজন ভুলিয়ে দিল। বরং এই ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা কেবল সংখ্যালঘু নয়, সবরকম বিজেপি-বিরোধী মানুষ, যাঁরা তৃণমূলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মোর্চাকে ভোট দেবেন ভাবছিলেন, তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিল। অন্য দিকে এই নির্বাচন পর্বে সম্ভবত প্রথমবার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শক্তিশালী মনে হল। কারণটা আর কিছুই নয়। বিরোধিতাই তাঁর শক্তি, প্রশাসন চালানো নয়। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী হিসাবে তাঁকে আগাগোড়াই রক্ষণ সামলাতে হচ্ছিল। শীতলকুচির ঘটনা তাঁকে আবার বিরোধী নেত্রীর মত আক্রমণে যাওয়ার সুযোগ এনে দিল।

এ তো গেল বুলি নিয়ে কথাবার্তা। কিন্তু বামপন্থীরা কি কেবল বুলিতেই আটকে থাকবেন? বরাবর তো তাঁদের শক্তি ছিল দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় পথে নেমে আন্দোলন। এ বারের নির্বাচনে যে তাঁরা প্রবলভাবে আলোচনার মধ্যে চলে এলেন, তা-ও তো ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযানের পর। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা দ্বিতীয় তো হলেনই, উপরন্তু সকালবেলায় শীতলকুচিতে গুলি চলার পরে সারাদিনে কোথাও নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষকদের বা বিজেপি নেতাদের ঘেরাও করার মত কোন ঘটনা ঘটল না। শুধু বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করা হল, ঘটনার দুদিন পরে নির্বাচন আধিকারিকের সাথে দেখা করে মোর্চার আপত্তিগুলো জানানো হল কেবল। এই ঈষদুষ্ণ ব্যবহার কি মৃতেরা তৃণমূলের লোক বলে? তাহলে এ-ও তো হীনমন্যতা।

প্রথম দুটো বেঞ্চের মধ্যে মারামারি হচ্ছে, আমি শেষ বেঞ্চের ছেলে, আমার কী আসে যায়? এই মানসিকতা নিয়ে কি বিরোধী রাজনীতি হয়? সমর্থন বাড়ানো যায়? সময় বলবে। তবে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সিপিএম বলে একটা পার্টি ছিল, যারা কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী খুন হওয়ার পর তাঁর নিজের পার্টি বনধ ডাকার আগেই বনধ ডেকে দিয়েছিল। যুক্তি ছিল, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন হত্যা করা আসলে ভারতের গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা। তারই প্রতিবাদে বনধ। জানি না ভোট দানের সময় অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আসা বাহিনীর গুলিতে সাধারণ ভোটারের হত্যা গণতন্ত্রকে হত্যা করার চেষ্টা কিনা, সে দিনের নেতারা থাকলে তৎক্ষণাৎ পরদিন বাংলা বনধ ডাকতেন কিনা। কোন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিরোধী আসনে থাকা দল, যদি প্রমাণ করতে চায় তার কাছে মানুষের জীবনের দাম আছে, তাহলে শুধু বুলিতে কি কাজ হয়? জাম্বুবানের ভাষায় “ঢাল নেই তলোয়ার নেই খামচা মারেঙ্গা”?

সূত্র :
১. NDTV
২. Telegraph India
৩. CPIM West Bengal Facebook Page

https://nagorik.net এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

%d bloggers like this: