বাঙালি কাহারে কয়, সে কি কেবলি সৌরভময়?

ভারতীয়

ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
সেই ভুলটুকু বেঁচে থাক
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।

অন্নদাশঙ্কর রায় এসব লিখেছেন বহুকাল হয়ে গেল। কিন্তু আজও কলকাতা ও তার শহরতলির ভদ্রজন বলে থাকেন “বাঙালি আর মুসলমান”। বোঝা শক্ত নয় যে বাঙালি বলতে তাঁরা বোঝেন হিন্দু বাংলাভাষীদের। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গের কাগজ, টিভি, এমনকি সরকারও চালান মূলত কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের ভদ্রজনই। কোনটা বাঙালি ভাবাবেগকে আহত করে (ইদানীং আবার ভাবাবেগ না লিখে অস্মিতা লেখা চালু হয়েছে), কোনটা করে না তাও ঠিক করে দেন ওঁরাই। ফলে শেষমেশ দেখা যায় বাঙালি বলতে সব বাঙালি হিন্দুও নয়, কেবল তাঁদেরই বোঝাচ্ছে। সুতরাং দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের সময়ে মাল নদীতে হড়পা বান এসে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হলে বাঙালির ভাবাবেগ আহত হয় না, কলকাতায় ড্যাং ড্যাং করে কার্নিভাল চলে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নামক এক লাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদ বেহালার গাঙ্গুলিবাড়ির ছোট ছেলেটির হাতছাড়া হলে বাঙালির ভাবাবেগ এতদূর আহত হয়, যে মুখ্যমন্ত্রীকে ময়দানে নামতে হয়। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে বলতে হয়, মহারাজকে সম্মান দিতে চাইলে শাহরুখ খানকে সরিয়ে তাঁকেই রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করুন না। বামপন্থীরাও বলেন, এসব হল দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিজেপির কুক্ষিগত করার চক্রান্ত। কেন সব রাজনৈতিক দলকেই কিছু না কিছু বলতেই হয়? কারণ নজরুল-টজরুল আজকাল আর কে পড়ে? এখন বাঙালি বলতে একজন আছে – সৌরভ গাঙ্গুলি।

অর্থাৎ বাঙালি মানে দাঁড়াল কলকাতা ঘেঁষা ভদ্রজন। তাঁদের আবেগ জড়িত বলেই তো ইস্টবেঙ্গল আইএসএলে দল নামাতে পারল কিনা তা মুখ্যমন্ত্রীকে তদারক করতে হয়, কিন্তু মহমেডান স্পোর্টিং থাকল কি উঠে গেল তা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা থাকে না। দু-একদিন হইচইয়ের পরেই সংবাদমাধ্যম এবং ক্রীড়াপ্রেমীদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যান জাতীয় গেমসে ফুটবলে সোনা জয়ী বাংলা দলের ফুটবলাররা। দুদিন দুরাত ট্রেনে করে ফিরতে না হলে আদৌ তাঁদের নিয়ে কেউ আলোচনা করত কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। একই কারণে জাতীয় গেমসে বাংলা কোথায় শেষ করল, কেন করল – সেসব নিয়ে রাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত খবরের কাগজগুলোতে কয়েক সেন্টিমিটার জায়গাও খরচ করা হয় না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অমিত শাহের প্রসাদে ক্রিকেট বোর্ডের সর্বোচ্চ পদে বসে থাকা সৌরভ কত বড় বঞ্চনার শিকার হলেন তা নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয় একেবারে প্রথম পাতায়।

ঘটনাচক্রে সৌরভ যে বছর ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হলেন সে বছরই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বাঙালি বলে দাবি করতে উৎসাহের খামতি হয়নি জনমত গঠনকারী বাবুদের। সে তবু একরকম, কিন্তু বাঙালি ভাবাবেগ এত সহজপাচ্য যে কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে অভিজিৎ আর সৌরভকে বাঙালির গর্ব হিসাবে পাশাপাশি রেখে হোর্ডিং টাঙিয়েছিল কে বা কারা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সমাজবিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদত্ত পৃথিবীর সেরা পুরস্কার অর্জনের কৃতিত্ব কী করে এক ব্যবসায়িক সংস্থার আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ছক্কা পাঞ্জায় সফল হয়ে পাওয়া চেয়ারের সমান হয়, তা বাঙালিই জানে। কিন্তু কী আর করা যাবে? মহাজনেরা দেগে দিয়েছেন, বাঙালি বলতে একজনই আছে।

দাগানোর কাজটা আজ হয়নি, হয়েছে সৌরভের খেলোয়াড় জীবনেই। লর্ডসে টেস্ট অভিষেকের পর থেকে কোনো ম্যাচে প্রথম একাদশ থেকে সৌরভ বাদ গেলেই বাংলায় বসে মনে হত নেতাজি সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হওয়ার পরে এত বড় অন্যায় আর কোনো বাঙালির সঙ্গে করা হয়নি। আজকের মুখ্যমন্ত্রী সৌরভকে পদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান, আগের সরকারও কিছু কম যেত না। ১৯৯৭ সালে ঢাকায় ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ফাইনালে সৌরভ একটি অবিস্মরণীয় ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর প্রকাশ্য সংবর্ধনার আয়োজন করে। অবাক কাণ্ড! জিতিয়েছেন একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল, বিশ্বকাপ ফাইনাল নয়। তার জন্যে সরকারি সংবর্ধনা পাওয়ার সৌভাগ্য পৃথিবীর কজন ক্রিকেটারের হয়েছে বলা মুশকিল। অন্তত শচীন তেন্ডুলকরের যে হয়নি তা হলফ করে বলা যায়। তিনি পরের বছরেই শারজায় প্রায় একক কৃতিত্বে একই সপ্তাহে দুবার স্টিভ ওয়র অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ভারতকে খেতাব জেতান। এমন ব্যাট করেছিলেন যে ওয় বলেন ডন ব্র্যাডম্যানের পরে শচীনই সেরা। তবু কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার তাঁর বর্ণাঢ্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেনি।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

বাঙালি ক্রীড়াবিদকে বাংলার সরকার সম্মান জানিয়েছে – এর নিন্দা করলে আবার অনেকে রেগে যেতে পারেন। পক্ষ সমর্থনে এমনও বলা যেতে পারে, যে বাঙালিদের মধ্যে থেকে তো আর মুম্বাইয়ের মত কাঁড়ি কাঁড়ি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার বেরোয় না, আমাদের সবেধন নীলমণি সৌরভই আছেন। তাই আমরা, আমাদের সরকার একটু বাড়াবাড়ি করলে ক্ষতি কী? কথা হল, ক্ষতি কিছু হত না, যদি সব বাঙালি ক্রীড়াবিদ সম্পর্কেই এমন মহৎ চিন্তা গোটা বাংলার মানুষের এবং মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকারগুলোর থাকত। বাংলার রঞ্জি ট্রফি দলের সুলুকসন্ধান কজন বাঙালি রাখেন তার ঠিক নেই, কিন্তু কলকাতা নাইট রাইডার্স আইপিএল জিতলে ঘটা করে ইডেন উদ্যানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংবর্ধনার ব্যবস্থা হয়। সৌরভকে দল থেকে বাদ দিলে গেল গেল রব উঠত, এখন প্রশাসনিক পদে থাকতে না দিলেও বাঙালির জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ কলকাতার বৃত্তের বাইরের লোক, শিলিগুড়ির ছেলে ঋদ্ধিমান সাহা ফর্ম না হারিয়েও স্রেফ আহত হয়ে দলের বাইরে যাওয়ার জন্যেই যখন ভারতীয় দলে তাঁর জায়গা খোয়ালেন, তখন তেমন আলোড়ন উঠল না। উঠল তখন যখন ঋদ্ধিমানের স্থলাভিষিক্ত তরুণ ঋষভ পন্থ দুরন্ত ব্যাটিংয়ে তাঁর জায়গা পাকা করে ফেলেছেন, স্বভাবতই কোচ রাহুল দ্রাবিড় ঋদ্ধিমানের দীর্ঘ কেরিয়ারকে সম্মান করে আলাদা করে ডেকে বলে দিয়েছেন তাঁকে আর টেস্ট দলের জন্য ভাবা হবে না। হপ্তাখানেক কলকাতার সংবাদমাধ্যম ঋদ্ধিমানের প্রতি অবিচারের জন্য দ্রাবিড়কে খলনায়ক বানিয়ে অশ্রুপাত করল। আগে উচ্চবাচ্য করা হয়নি। সম্ভবত তার কারণ তখন খলনায়ক খুঁজতে হলে প্রথমেই স্বয়ং সৌরভের দিকে আঙুল তুলতে হত। কারণ তিনি তখন বোর্ড সভাপতি তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা ঋষভ আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালসের ক্রিকেটার আর সৌরভ সেই দলেরই পরামর্শদাতা ছিলেন বোর্ডকর্তা হওয়ার আগে পর্যন্ত।

ক্রিকেটিয় কারণে ঋদ্ধিমানের ভারতীয় দলের জন্য আর বিবেচিত না হওয়া তবু মেনে নেওয়া যায়, বোর্ড সভাপতি সৌরভ যে দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না সে কথাও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ঋদ্ধিমানের মত বর্ষীয়ান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড় তো বাংলার তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে অমূল্য সম্পদ হতে পারতেন। তাঁকে কেন ত্রিপুরায় চলে যেতে হল বাংলার ক্রিকেটকর্তাদের অপমানজনক ব্যবহারে? এ নিয়ে সরাসরি আঙুল ওঠা উচিত ছিল সৌরভের দিকে। তিনি বোর্ড সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের প্রতিনিধি হিসাবেই। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁর হস্তক্ষেপ করা বেআইনিও হত না। কিন্তু এসব পশ্চিমবঙ্গে কোনো আলোচনার বিষয়ই নয়। কারণ সম্ভবত সৌরভ যতটা বাঙালি, ঋদ্ধিমান ততটা বাঙালি নন।

এশিয়ান গেমসে হেপ্টাথলনে সোনা জয়ী স্বপ্না বর্মনও সৌরভের মত বাঙালি নন নিশ্চয়ই। নইলে স্বপ্নার মধ্যপ্রদেশে চলে যাওয়া আটকাতে মুখ্যমন্ত্রী নিজে আসরে নামলেন না কেন? কোথায় গেল বাঙালির ভাবাবেগ?

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading