সদ্য দ্বিতীয়বার বাবা হওয়া বিরাট কোহলি মাঠে নামার জন্যে মুখিয়ে আছেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির নাকি ব্র্যাড পিট অভিনীত বেঞ্জামিন বাটনের মত বয়স বাড়ার বদলে কমছে। হার্দিক পান্ডিয়ার কাছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়কত্ব হারানোয় রোহিত শর্মা কি রেগে আছেন, নাকি হালকা বোধ করছেন?
খবরের কাগজের খেলার পাতা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া– সর্বত্র ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন এসব নিয়েই আলোচনা করছেন। কারণ শীত চলে যেতেই এসে পড়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের বৃহত্তম রিয়েলিটি শো। পেশাগত বাধ্যবাধকতা সরে যাওয়ার পর থেকে আইপিএল দেখি টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে কখনও চোখে পড়ে গেলে দু-এক ওভার। উপরন্তু কাগজে, টিভিতে বা হাতের মোবাইলে শিরোনাম পেরিয়ে আইপিএলের খবরেও ঢুকি না। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রিকেটপ্রেমিক হয়েও আইপিএল দেখতে যাই না কেন? যুক্তিগুলো সাজানো যাক।
ক্রিকেটের কাঠিন্য নেই, আছে আমোদ
২০০৮ সালের প্রথম আইপিএলের সময়ে যে কাগজের ক্রীড়া সাংবাদিক ছিলাম, সেই কাগজের মালিক আইপিএলের একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিরও মালিক ছিলেন। প্রথম খেলার দিনই মাঠে গিয়ে দেখি– অবাক কাণ্ড! বাউন্ডারির দড়ির বাইরে যতটা জায়গা পড়ে, তা একত্র করলে আরেকটা ছোটখাটো মাঠ হয়ে যায়। খেলা শুরু হতেই দেখা গেল, রোহিত শর্মা স্পিনারের বল চামচের মত করে পিছন দিকে তুলে দিলেও মাত্র একবার ড্রপ খেয়ে মাঠের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের উপর কিন্তু কাগজের কর্তাদের কড়া নির্দেশ ছিল, বাউন্ডারি যে ছোট করে দেওয়া হয়েছে সেকথা কোনও কারণেই লেখা যাবে না।
গত দেড় দশকে অবশ্য এসব লুকোচুরি আর নেই। এখন সবাই জানে, ৫০ ওভারের খেলাতেও বাউন্ডারি ছোট করে ফেলা হয় চার-ছয়ের সংখ্যা বাড়াতে। স্বীকার্য যে, আজকাল এমন বড় বড় ছয় মারা হয় যে বল গিয়ে পড়ে গ্যালারিতে। তার কারণ ব্যাটগুলোর গঠন এবং ওজন, বাউন্ডারির দৈর্ঘ্য নয়। কিন্তু একইসঙ্গে লক্ষ করে দেখবেন, সীমানার ধারে রোমাঞ্চকর ক্যাচের সংখ্যা কত বেড়ে গিয়েছে। পৃথিবীর যে কোনও দেশে কুড়ি ওভারের লিগ চললেই প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে একজন ফিল্ডার অপূর্ব কায়দায় শূন্যে শরীর ছুড়ে দিয়ে বা অন্য একজন ফিল্ডারের সাহায্যে সীমানার বাইরে থেকে ফিরে ক্যাচ নিচ্ছেন। এমনটা সম্ভব হয় সীমানার বাইরে অনেকখানি জায়গা থাকে বলেই।
ইউটিউবে প্রাক-আইপিএল যুগের সাদা বলের ক্রিকেটই দেখুন– সীমানার পরে মাঠ শেষ। সেখানে এসব করতে গেলে ভারতীয় স্টেডিয়ামগুলোর গ্রিলে ধাক্কা খেতে হত। আরও লক্ষ করুন, বাউন্ডারি ছোট করে দেওয়ায় রানিং বিটুইন দ্য উইকেটসে কত কম শক্তি খরচ হচ্ছে ব্যাটারের। তিন রান প্রায় হয়ই না, কারণ ফিল্ডারের বল তাড়া করে চার আটকে বল ফেরত পাঠানোর অবকাশ কম। তার আগেই বল সীমানা পেরিয়ে যাবে।
সাধারণভাবে পরিশ্রমের দিক থেকে দেখলেও যে আইপিএল বা টি২০ ক্রিকেট একজন ক্রিকেটারের পক্ষে তুলনায় আরামদায়ক তা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। বোলারকে চার ওভারের বেশি বল করতে হয় না, একজন ব্যাটার প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত খেলে শতরান করলেও বড়জোর ৬০-৭০ বল খেলবেন। টেস্ট ক্রিকেটের কথা বাদ দিন, ৪২ বছর বয়সে পঞ্চাশ ওভারের খেলা খেলতে হলেও টের পাওয়া যেত ধোনির বয়স কমছে না বাড়ছে। জেমস অ্যান্ডারসন একজনই হয়, তিনিও বেছে বেছে ম্যাচ খেলেন।
বড়লোকের বেড়ালের বিয়ে
সদ্য প্রকাশিত এক সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে, ভারতের উপরতলার ১% লোকের হাতে দেশের ২২.৬% আয় আর ৪০% সম্পদ রয়েছে। তা এমন এক দেশে বাবুরা বেড়ালের বিয়ে দেবেন না মোচ্ছব করে? প্রতিবছর ঘটা করে নিলাম হয়, বাবুরা দাসী বাঁদি কেনার মত পছন্দের ক্রিকেটার কেনেন। খেলার সময়েও কেবল খেলা হয় না। গ্যালারিতে এবং আফটার পার্টিতে বলিউড সুন্দরীরা আসেন, মাঠের ধারে চিয়ারলিডার নাম দিয়ে স্বল্পবাস মেম নাচানো হয়। কোন কোন বছর কোন ক্রিকেটার কোন চিয়ারলিডারের সঙ্গে কী ধরনের যৌনতায় লিপ্ত হয়েছিলেন তা নিয়ে রসালো কাহিনীও প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে।
একবার যেমন প্রাক্তন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক গ্রেম স্মিথের কীর্তিকলাপ মুখরোচক হয়েছিল, আরেকবার ক্রিস গেল আর শেরলিন চোপড়ার নাচানাচি কলকাতার কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল। আজ থেকে ঠিক এক যুগ আগে পুনে ওয়ারিয়র্স দলের ক্রিকেটাররা রেভ পার্টিতে গিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ে ক্যাচ কট কটও হয়েছিলেন। নেহাত তাঁরা শাহরুখ খানের ছেলে নন, তাই বেশি হয়রানি হয়নি।
কবি বলেছেন, শীত এসে পড়লে বসন্ত খুব পিছিয়ে থাকতে পারে না। তেমনই ফুর্তির উপাদান হিসাবে মদ, মেয়েমানুষ এসে পড়লে জুয়াও পিছিয়ে থাকে না। তবে ভারতের সরকার, সাংবাদিক, ভাষ্যকার, সর্বোপরি ক্রিকেটপ্রেমী জনতা অত্যন্ত ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন। তাই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঘটনা ধরা পড়ে গেলে শান্তাকুমারণ শ্রীসান্ত, অজিত চান্ডিলার মত কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে মিটিয়ে ফেলা হয়। চেন্নাই সুপার কিংস দল সাসপেন্ড হয়ে যায় তাদের মালিকদের অন্যতম গুরুনাথ মেইয়াপ্পন অবৈধ বাজি ধরায় যুক্ত ছিলেন বলে, অথচ তৎকালীন অধিনায়ক ধোনি নাকি কিছুই জানতেন না। এক ফ্রেমে একাধিক ছবি থাকলেও তিনি নাকি এন শ্রীনিবাসনের জামাইকে আদৌ চিনতেন না। অথচ ধোনি নিজে শ্রীনিবাসনের স্নেহভাজন, তাঁর কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্টও নিযুক্ত হয়েছিলেন।
আইপিএলের উদ্গাতা ললিত মোদি বিস্তর আর্থিক কেলেঙ্কারি করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে ২০১০ সালে। নিজের লোকদের কম পয়সায় ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা পাইয়ে দেওয়া, আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রির টাকা থেকে কাটমানি নেওয়া, বিদেশে গোপন অ্যাকাউন্টে টাকা সরানো– কী ছিল না তার মধ্যে? প্যান্ডোরার বাক্স খুলেছিলেন ললিত নিজেই। যখন তিনি অভিযোগ করেন যে, তৎকালীন মন্ত্রী শশী থারুর নিজের প্রভাব খাটিয়ে সুনন্দা পুষ্করকে কোচি টাস্কার্স ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনিয়ে দিয়েছেন। তা থেকে আরও নানা অভিযোগ উঠেছিল– আইপিএলের সব ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই নাকি বেনামে অনেকের টাকা খাটে। অন্য কোনও দেশে হয়তো এত কাণ্ডের পর এই লিগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু যারা দেশ চালায়, তাদের মোচ্ছব থামায় কার সাধ্যি? ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ? সত্যি?
কবি বলেছেন নামে কী আসে যায়? আইপিএলের বেলায় সেকথা মনে রাখা খুব জরুরি। এ এমনই ভারতীয় লিগ যে, ২০০৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময়ে ম্যাচের আয়োজন করা যাবে না বলে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলা হয়েছিল। পরেও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে খেলা হয়েছে। অতএব দরকার পড়লে উত্তর মেরুতে বা চাঁদেও খেলা যেতে পারে। কিন্তু খেলা হওয়া চাই, কারণ সম্প্রচার স্বত্ব বেচে পকেট ভারী হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের। সেটাই লক্ষ্য, ক্রিকেট উপলক্ষ্য।
বোর্ড ধনী হলে তা কি ভারতীয় ক্রিকেটের লাভ নয়? এর উত্তর দেওয়া বেজায় শক্ত। ভারতীয় ক্রিকেটারদের, এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটারদেরও যে আইপিএল যুগে পারিশ্রমিক অনেক বেড়েছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু মুশকিল হল, কর্তা এবং ক্রিকেটারদের লক্ষ্য, মোক্ষ সবই হয়ে গিয়েছে আইপিএল। অতিমারির সময়ে আইপিএলটা যেন হতে পারে তার সযত্ন ব্যবস্থা করেছিল সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন বোর্ড। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চালু ছিল যে রনজি ট্রফি, তা চালু রাখার উদ্যোগ নেয়নি। ঘরোয়া ক্রিকেটারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থাও হয় অনেক পরে।
আরো পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট মানে ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসা
দেওধর ট্রফি, চ্যালেঞ্জার ট্রফির মত গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া প্রতিযোগিতা প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু টি২০ নয়, পঞ্চাশ ওভারের জাতীয় দল বা টেস্ট দল বাছার সময়েও যে আইপিএলের পারফরমেন্সকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তা এখন সুনীল গাভাসকারের মত শান্তশিষ্ট লোকও বলতে শুরু করেছেন। কেএল রাহুলের মত প্রতিষ্ঠিত তারকা তো বটেই, ঈশান কিষান বা শ্রেয়স আয়ারের মত তরুণ তুর্কিরাও এখন আইপিএল ছাড়া অন্য কিছুকে পাত্তা দিচ্ছেন না। কেউ মানসিক সমস্যার দোহাই দিয়ে আইপিএলের আগের টেস্ট সিরিজ থেকেও পালাচ্ছেন, কেউ চোট আছে বলে রনজি না খেলে বসে থাকছেন।
তাহলে আইপিএল থেকে ভারতীয় ক্রিকেট টাকা ছাড়া পেল কী? মনে রাখা ভাল, পৃথিবীর সেরা টি ২০ লিগের আয়োজক হওয়া নিয়ে গুমর থাকলেও ভারত সেই ২০০৭ সালের পরে আর ওয়ার্ল্ড টি২০ও জেতেনি। এই লিগ কেন দেখব? হাতে নষ্ট করার মত সময় থাকলে না হয় কোনও ওয়েব সিরিজ দেখা যাবে।
উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত