ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল: পুরনো কাহিনি, নতুন দিগন্ত

ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ভুজঙ্গের ভেদ এতটাই কম যে অজিত তার মধ্যে অপরাধীসুলভ ধূর্ততা আছে বলে সন্দেহ করায় ব্যোমকেশ বলে ফেলে “পরিচয় না থাকলে বোধহয় আমাকেও সেরকমই ভাবতে।”

“পৃথিবী বদলে গেছে/তাতে কি নতুন লাগে?/তুমি আমি একই আছি/দুজনে যা ছিলাম আগে”। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দর্শক আর গোয়েন্দা গল্প নিয়ে ছবি বা ওয়েব সিরিজের সম্পর্কটা অনেকটা উত্তমকুমার অভিনীত আনন্দ আশ্রম ছবির এই গানটার মত। দুনিয়া জুড়ে এই ধরনের ছবিতে (এবং সাহিত্যে) আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। অথচ এখানে আজও ধুতি পাঞ্জাবি পরা কলঙ্কহীন ব্যোমকেশ, নিখুঁত দক্ষিণ কলকাতার ভদ্রলোক ফেলুদা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মহাজনদের পথে গমন করেই এখানে ওখানে একটু-আধটু রং বদলে সোনাদা, মিতিন মাসি, একেনবাবুরা চালিয়ে যাচ্ছেন। দর্শককুলের কারোর যে একেবারেই ক্লান্তি আসে না তা নয়, কিন্তু বহুবার দেখা জিনিসই ফের দেখে ‘আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না’ বলার লোকও নেহাত কম পড়ে না। ফলে প্রযোজক, পরিচালকরাও চালিয়ে যাচ্ছেন একই মাল প্যাকেট বদলে। হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ব্যোমকেশ সিরিজও প্রথম সাতটা সিজনে এই ছকের বাইরে বেরোতে পারেনি। নতুনত্ব হিসাবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেক্সটে যা যা আমদানি করা হয়েছে, তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রস ঘনীভূত হওয়ার বদলে পিরিয়ড পিসের দফারফা হয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে – period in pieces। সেই কারণে অষ্টম সিজন নিয়ে প্রত্যাশার পারদ খুব উঁচুতে রাখিনি। আগ্রহ ছিল শুধু দুটো কারণে – ১) এই নিয়ে চতুর্থবার চিড়িয়াখানা উপন্যাসটাকে পর্দায় নিয়ে আসা হচ্ছে। গল্পটা যারপরনাই রহস্যময় এবং গল্পে নানা পরত আছে। তা সত্ত্বেও, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের হাতেও তেমন উৎকৃষ্ট ছবি হয়ে উঠতে পারেনি। এবার কী হবে? ২) মন্দার ওয়েব সিরিজের নির্দেশক অনির্বাণ ভট্টাচার্য এই সিজনে কেবল ব্যোমকেশের ভূমিকায় ক্যামেরার সামনে নেই, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসাবে ক্যামেরার পিছনেও তাঁর বড় ভূমিকা থাকছে। পারবেন কি নতুন কিছু দেখাতে?

নূতনের কেতন দিব্যি উড়েছে, তাতে কালবোশেখীর ঝড় উঠল কিনা দর্শককুলের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাবে। কিন্তু যাবতীয় একঘেয়েমি এবং স্টিরিওটাইপকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবল চেষ্টা যে করা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

শরদিন্দুর গল্পের নাম চিড়িয়াখানা, সত্যজিতের ছবির নামও চিড়িয়াখানা, অঞ্জন দত্তের ছবির নাম ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা। কিন্তু পরিচালক সুদীপ্ত রায় ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অনির্বাণ একই গল্প অবলম্বনে ছবি করলেও নামে নিয়ে এসেছেন পিঁজরাপোল শব্দটা। শরদিন্দু স্বয়ং গল্পে এই শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু শব্দটাকে স্বতন্ত্র গুরুত্ব দান করেছে এই সিরিজের অকুস্থল নির্মাণ। শরদিন্দু লিখেছেন খোলামেলা গোলাপ কলোনীর কথা, যার আয়ের উৎস ফুলের ব্যবসা। সত্যজিৎ, অঞ্জনও তেমনই দেখিয়েছিলেন। সুদীপ্ত-অনির্বাণ ঘটনাবলীকে এনে স্থাপন করেছেন এক চকমেলানো ইংরেজ আমলের বাড়িতে, যার নাম রোজি ম্যানশন। এখানকার ব্যবসা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের। রোজি মেমসাহেবের প্রতি প্রেম অক্ষয় করে রাখতে থমাস সাহেবের তৈরি এই প্রাসাদোপম বাড়ির ঘরে বারান্দায় লিফটে চার পর্বের এই সিজনের অধিকাংশ দৃশ্যের অবতারণা। ফলে সমাজের মূলধারায় মিশতে না পারা এ বাড়ির বাসিন্দারা সকলেই পিঞ্জরাবদ্ধ, হয়ত দর্শক নিজেও – এই ধারণা ক্রমশ চেপে ধরে। অবশ্য এহ বাহ্য। পরিবর্তন এই একটা নয়, সব পরিবর্তনের কথা লিখবও না। কারণ তাতে সাহেবদের ভাষায় ‘স্পয়লার’ দেওয়া হয়ে যাবে।

অজিত চরিত্রের অভিনেতা বদলেছে এই সিজনে, এসেছেন ভাস্বর চ্যাটার্জি। তিনি একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা অজিত – মিতভাষী, মিষ্টভাষী। তিনি শুধু ব্যোমকেশ নয়, সত্যবতীরও (ঋদ্ধিমা ঘোষ) ভরসাস্থল। টিনে মুড়ি ভরে রাখা, বাজার থেকে কাঁচকলা নিয়ে আসা, আটা মেখে দেওয়া – সবেতেই অজিত পারদর্শী। সাইডকিক কথাটার নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভবত লেজুড়। শার্লক হোমসের ওয়াটসন বা আর্কুল পয়রোর হেস্টিংসকে সাইডকিক বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলা ভাষায় সাইডকিকের একেবারে সমার্থক শব্দ যে পাওয়া যায় না, তার কারণ সম্ভবত বিখ্যাত বাঙালিরাও বন্ধুদের নিজের চেয়ে ছোট করে ভাবতেন না একসময়। শরদিন্দু তাই অজিতকে সাইডকিক হিসাবে আঁকেননি, সত্যজিৎও লালমোহন গাঙ্গুলিকে সাইডকিক হিসাবে নির্মাণ করেননি। আজকের পরিচালক এবং অভিনেতারা বোধহয় অন্য ধারণার মানুষ। তাই তাঁদের অজিত, লালমোহনরা ভাঁড় হয়ে ওঠেন। এই কুৎসিত প্রবণতা পরিহার করার জন্য সুদীপ্ত-অনির্বাণের প্রশংসা প্রাপ্য। ভাস্বরের মাধ্যমে তাঁরা এমন এক অজিতকে তৈরি করেছেন যে শরদিন্দুর অজিতের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। সে নেপাল গুপ্তের চ্যালেঞ্জ কবুল করে দাবা খেলতে বসে যায় এবং তাকে হারিয়েও দেয়।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে অবশ্য ব্যোমকেশ চরিত্রে। গত সাতটা সিজনের মত এই সিজনেও অভিনেতা সেই অনির্বাণই, কিন্তু এই সত্যান্বেষী একেবারে নতুন। শরদিন্দু যে লিখেছেন ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা বলতে পছন্দ করত না, তা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা গল্পগুলোর প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা, নাকি গোয়েন্দা চরিত্রের যে বহুমাত্রিকতা বিশ্বসাহিত্যে এবং সিনেমা/ওয়েব সিরিজে আজকাল দেখা যায় সেদিকে যাওয়ার নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা প্রচেষ্টা – তা বলা দুষ্কর। কিন্তু সন্দেহ নেই, শরদিন্দু সে লক্ষ্যে খুব বেশিদূর এগোননি। ‘কী হইতে কী হইয়া গেল’ কাহিনির সর্বশক্তিমান গোয়েন্দা না করে শরদিন্দু ব্যোমকেশকে আটপৌরে করেছেন ঠিকই, কিন্তু ব্যোমকেশ নিঃসন্দেহে সর্বগুণান্বিত। সে পাঁচজনের একজন নয়, একেবারে পঞ্চম। সে তার প্রতিপক্ষদের চেয়ে তীক্ষ্ণ তো বটেই, বেশি শক্তিশালী এবং বেশি সৎও বটে। এ ধরনের সত্যান্বেষী এই ২০২৩ সালে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারণ অমন মানুষ আজ দুনিয়ায় বিরল, যাত্রার বিবেকের মতই অলীক। এই ওয়েব সিরিজে অনির্বাণ যে ব্যোমকেশের ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে কিন্তু অন্য লোক।

সত্যজিতের উত্তমকুমার, বাসু চ্যাটার্জির রজিত কাপুর, অঞ্জনের আবীর চ্যাটার্জি বা যীশু সেনগুপ্ত, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুশান্ত সিং রাজপুত – সকলেই ব্যোমকেশের মূল পোশাক হিসাবে ধুতি পাঞ্জাবিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনির্বাণকেও এর আগের সিজনগুলোতে মূলত সেই পোশাকেই দেখা গেছে। এখানে অজিত ধুতি পাঞ্জাবিতে থাকলেও ব্যোমকেশ বাড়িতে পাঞ্জাবি পাজামায়, বাইরে আগাগোড়া শার্ট প্যান্টে। এই বহিরঙ্গের আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের মত এই ব্যোমকেশ নিশানাথ সেন ৫০ টাকার জায়গায় ভুল করে ৬০ টাকা দিয়ে গেছেন দেখে ফেরত দেওয়ার কথা চিন্তাও করে না। দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে অজিতকে বলে, ভেবে নেওয়া যাক পরিশ্রমের দাম হিসাব করতে জজসাহেব ভুল করেছেন। উপরন্তু আগাগোড়া ব্যোমকেশ একজন পেটরোগা লোক। বারবার শৌচালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন তার তদন্তেও ব্যাঘাত ঘটায়। বরং অজিত শক্তপোক্ত। পানুগোপালের মৃত্যুর খবরে দেখা যায় রেগে গেলে ব্যোমকেশের মাথার ঠিক থাকে না। জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে দেয়, চিৎকার করে, অজিতকে ওই মৃত্যুর জন্য দায়ী করে। এই নিজের উপর শারীরিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণহীন গোয়েন্দা (আচ্ছা, সত্যান্বেষীই হল) বাংলা ছবি, সিনেমায় প্রায় অপরিচিত। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি শবর সিরিজের শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে তবু কিছুটা মানবিক দোষ, মানসিক অসুখ – এসব দেখা যায়। কিন্তু সে পেশায় পুলিস অফিসার। পদমর্যাদা তার রক্ষাকবচের কাজ করে, এই ব্যোমকেশের তেমন কোনো রক্ষাকবচ নেই। উল্টে রহস্যের শেষ জটটা ছাড়াতে তাকে হাফপ্যান্ট পরা হাবিলদারের ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়।

অভিনয়ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এই নতুন ব্যোমকেশকে জীবন্ত করে তুলেছেন অনির্বাণ। প্রতীক দত্তের চিত্রনাট্য এবং সংলাপের গুণে আরও যা হয়েছে তা হল স্বাধীনতার সামান্য পরের যুগের এমন এক চিন্তাশীল যুবকের নির্মাণ, যার চিন্তাভাবনা এই ২০২৩ সালেও অনুরণন তোলে। হইচইয়ের এই সিরিজে অতীতে ব্যোমকেশকে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন আওড়াতে দেখা গেছে। কিন্তু তা নেহাতই প্রক্ষিপ্ত মনে হয়েছে। একে তো যে সময়কাল তুলে ধরা হয়েছে তখন জীবনানন্দ মোটেই যুবকদের মুখে মুখে ফিরতেন না, উপরন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে লাগসই না হলে কোনো দৃশ্যে অমন শক্তিশালী কবির পংক্তি স্রেফ জ্ঞান ফলানোর প্রচেষ্টা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এই সিজনে ব্যোমকেশ জীবনানন্দ আওড়ায় না, অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে পড়ে থাকা গাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে তার প্রতিক্রিয়ায় সংবেদনশীল দর্শকের কেবল জীবনানন্দ নয়, টি এস এলিয়টও মনে পড়তে পারে। তবে এমন ব্যোমকেশ নিজের ডায়রিতে ‘বনলক্ষ্মী’ না লিখে ‘বনলক্ষী’ লিখলে মর্মাহত হতে হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পূর্ব দাঙ্গা দেখে মনুষ্যত্ব সম্পর্কে আশাহীনতা ও বিষাদ এখানে কেবল ব্যোমকেশ নয়, নিশানাথেরও অভিজ্ঞান। তা অবশ্য শরদিন্দুর কলমেও এসেছিল, কিন্তু এই নিশানাথ (বাবু দত্তরায়) আরও বেশি কটু। তাঁর বয়স যত বাড়ছে তত জীবের চেয়ে জড়ের উপরেই নাকি টান বেড়ে চলেছে। এমনকি অজিতও তার গল্পে বড় বেশি নৃশংসতা এনে ফেলছে বলে সত্যবতী অভিযোগ করে। পিরিয়ড পিস মানে যে কেবল জামাকাপড়ের সাবেকিয়ানা আর সেপিয়া টোনের ছবি নয়, ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এখানে চরিত্রগুলো, দৃশ্যাবলী এবং শব্দ – সব মিলেই সময়কে ধারণ করেছে। রেডিওতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ পর্যন্ত এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর নিয়ে। এসেছেন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। এ জন্যে সঙ্গীত ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত শুভদীপ গুহ প্রশংসার্হ। আবহে স্রেফ লাইন দুয়েক রবীন্দ্রনাথের গান দৃশ্যকে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে, হিন্দি ছবির গান বাজানো বাংলা মেগাসিরিয়ালের যুগে দাঁড়িয়ে এই ওয়েব সিরিজ তাও দেখিয়ে দিল। সেতারের কথা আর না-ই বা বললাম।

শরদিন্দুর ডায়রি অনুযায়ী, চিড়িয়াখানা লেখা শেষ হয় ২০ জুলাই ১৯৫৩। এই সিজন শেষ হয়েছে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে (তথ্যটা বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকার বাহুল্য না দেখালেই ভাল হত) ব্যোমকেশ, অজিত ও সত্যবতীর ভোটদান করে বেরিয়ে আসার দৃশ্য দিয়ে। যে নিশানাথ জাঁক করে বলেছিলেন “I deserve democracy, they don’t”, অর্থাৎ পিঁজরাপোলের অন্যরা গণতন্ত্রের যোগ্য নয়, সেই নিশানাথের ভোট দেওয়া হয়নি। ব্যোমকেশ তাঁর কথাকে ব্যঙ্গ করে স্ত্রী এবং বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, ও কথার মানে কী? গণতন্ত্র সকলের জন্য না হলে যে কারোর জন্যই টেকে না, তা তিনি জীবন দিয়ে বুঝেছেন, এখন আমরা বুঝছি। নিশানাথকে শরদিন্দুর অজিত ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেনি, দময়ন্তীকেও নয়। তার মতে “… এ জগতে কর্মফলের হাত এড়ানো যায় না, বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না। নিশানাথ কঠিন মূল্য দিয়াছেন, দময়ন্তীও লজ্জা ভয় ও শোকের মাশুল দিয়া জীবনের ঋণ পরিশোধ করিতেছেন।” শরদিন্দুর এই সামাজিক রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করে গেছেন চিত্রনাট্যকার প্রতীক। এখানে ব্যোমকেশ নিশানাথের প্রতি সহানুভূতিহীন কারণ তিনি বিচারক হয়ে, অন্যের অসহায়তার সুযোগ নিয়েও নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু ভাবতেন, অগণতান্ত্রিক ছিলেন। কিন্তু দময়ন্তীকে সমান দোষী ভাবা হয়নি, লাল সিংয়ের মৃত্যু সংবাদ জানার পর তাকে (মৈত্রী ব্যানার্জি) বৈধব্য পালন করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ তার অন্তরের পবিত্রতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। এতসব করা গেছে অতিনাটকীয় সংলাপ বা কান্নাকাটি ছাড়াই, স্রেফ কয়েকটা শটে। চিত্রনাট্যকারের এ প্রশংসনীয় সাফল্য।

আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

তবে চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক আর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের সবচেয়ে বড় সাফল্য বোধহয় শরদিন্দুর থেকে এতখানি সরে এসেও তাঁর সমস্ত ব্যোমকেশ কাহিনিতে উপস্থিত সেই উপাদানকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা – যা এই চিড়িয়াখানা গল্পে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও এর আগেকার চলচ্চিত্রকাররা হয় ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, অথবা সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে গেছেন। উপাদানটা হল যৌনতা। ব্যোমকেশের প্রায় সব গল্পেই আদিম রিপু কোনো না কোনো ভূমিকায় থাকে। প্রচ্ছন্ন অথচ তীব্র – এই হল শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনির যৌনতার বিশেষত্ব। এখানে পানুগোপাল চরিত্রে বুদ্ধদেব দাস, নজর বিবির চরিত্রে দীপান্বিতা সরকার, সর্বোপরি বনলক্ষ্মীর চরিত্রে অনুষ্কা চক্রবর্তী সে জিনিস জীবন্ত করে তুলেছেন। প্রথম দুজন তো প্রায় বিনা সংলাপে। তিনজনকেই যোগ্য সঙ্গত করেছে অয়ন শীলের ক্যামেরা। এমনকি সত্যবতীর চরিত্রে ক্রমশ উন্নতি করতে থাকা ঋদ্ধিমাও নীরবে যৌন ব্যাকুলতা ফুটিয়ে তোলেন আলো নেভানোর মন্থরতায়, পাশের খালি বালিশে হাত রাখায়। অকৃতদার অজিতের স্বপ্নে বনলক্ষ্মীর মুখ বদলে সত্যবতী হয়ে যাওয়াও অতুলনীয়।

তবে এতকিছুর সবই মাটি হতে পারত ভুজঙ্গ ডাক্তারের চরিত্রে দুর্বার শর্মা অমন দুর্দান্ত অভিনয় করতে না পারলে। ব্যোমকেশের প্রতিস্পর্ধী খলনায়ক রচনা করতে শরদিন্দু ভালবাসতেন। ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের অনুকূল ডাক্তার থেকেই ম্যাড়মেড়ে খলনায়ক তাঁর অপছন্দ, ব্যোমকেশকে তার স্রষ্টা বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী জয় করতে দেননি। এখানেও শেষ সকালের আগে পর্যন্ত ভুজঙ্গ ব্যোমকেশের চেয়ে বেশি তৎপর, বেশি স্থিতধী, বেশি আত্মবিশ্বাসী। দুর্বার প্রত্যেকটা সংলাপ বলেন ভেবেচিন্তে, একটা তিরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আবার ডাক্তারি করার সময়ে তাঁর মধ্যে সংবেদনশীলতার কোনো অভাব দেখা যায় না। ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ভুজঙ্গের ভেদ এতটাই কম যে অজিত তার মধ্যে অপরাধীসুলভ ধূর্ততা আছে বলে সন্দেহ করায় ব্যোমকেশ বলে ফেলে “পরিচয় না থাকলে বোধহয় আমাকেও সেরকমই ভাবতে।” দুর্বার যে দৃশ্যে ব্যোমকেশকে তার পেশা নিয়ে দুকথা শোনান, সেখানে তাঁর অভিনয় তলোয়ারের মত ঝলসে ওঠে। এই না হলে খলনায়ক! তাই বোধহয় শেষমেশ ব্যোমকেশেরও ভুজঙ্গকে একটা সুযোগ দিতে ইচ্ছা হয়। গল্পের ব্যোমকেশ কিন্তু ইচ্ছা করে সুযোগ দেয়নি। সে টেরই পায়নি ভুজঙ্গর মতলব।

এখানে ব্যোমকেশ সুযোগ তো দিল, তারপর কী হল? সেটা দেখে নেবেন। আমার দেখার আগ্রহ রইল, রহস্য গল্প নিয়ে তৈরি ছবি দেখার অভ্যাস বদলে দেওয়ার এত চেষ্টা সফল হয় কিনা।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

মায়ার জঞ্জাল: যে কলকাতা দেখতে পাই না, দেখতে চাই না

মায়ার জঞ্জাল দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, এ যেন অবচেতনে সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ছবির সিকুয়েল।

ধরুন, আপনি কলকাতা ময়দানের আশপাশ দিয়ে বাসে, ট্যাক্সিতে বা বাইকে চেপে যাচ্ছেন। একটি ইমারত আপনার চোখে পড়বেই। ও জিনিস না দেখে আপনি ওখান দিয়ে যেতেই পারবেন না। কারণ আশপাশের যাবতীয় ইমারতকে ছাড়িয়ে আকাশে উঠেছে ওই বিয়াল্লিশ তলা বাড়িটি। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো চরতে আসেননি, এলে হয়ত ওই ইমারত দেখে তাঁর “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে” মনে পড়ে যেত। আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষার অপকর্ষের যুগের কিবোর্ডচি (কলমচি বলার মানে হয় না), ফলে আমার কবিতার লাইন-টাইন মনে পড়ে না। আমার লেখাপড়া যেটুকু, বুদ্ধিসুদ্ধির যে হাঁটুজল গভীরতা, তাতে কেবল উত্থিত লিঙ্গের কথা মনে পড়ে। আবার যদি ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ধরে সায়েন্স সিটি ছাড়িয়ে যাদবপুর-সন্তোষপুর অভিমুখে যান, তাহলে দেখবেন ডান হাতে পাশাপাশি অমন দু-দুখানি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলির নাম ট্রাম্প টাওয়ার। উত্থিত লিঙ্গ রাস্তাঘাটে প্রদর্শন করা পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশে কেবল অসভ্যতা বলে গণ্য হয় তা নয়, আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। অমন করলে আপনাকে সহনাগরিকদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা যেতেই পারে। কিন্তু কোনো সভ্য দেশেই ধনের প্রদর্শনী অসভ্যতা বলে গণ্য হয় না, আইনত অপরাধও নয়। বরং ইদানীং ওটিই সভ্যতার লক্ষণ। কলকাতা সেদিক থেকে ভারতের অন্য শহরগুলির তুলনায় অনেক পরে সভ্য হতে শুরু করেছে, ফলে এখন একের পর এক অমন ইমারত তৈরি হয়েই চলেছে। ফর্টি টু, ট্রাম্প টাওয়ার, আরবানা, আরও বানা। নইলে পশ্চাদপর হয়ে পড়ব আমরা। উল্লিখিত ইমারতগুলির মত বিরাট না হলেও, কলকাতা শহরে এখন উঁচু পাঁচিল আর ইয়াব্বড় সিংহদ্বারযুক্ত, প্রবেশ-প্রস্থানে কড়াকড়িসম্পন্ন লম্বা লম্বা ইমারতের অভাব নেই। সাম্প্রতিককালের বাংলা ছবিতে এই ধরনের ইমারতের বাসিন্দাদের জীবন ঘনঘন ধরা পড়ে। কলকাতা মানেই তারা – দেখলে এমন ধারণাই তৈরি হয়। আগামীকাল (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) অবশ্য এমন একটি ছবি মুক্তি পাচ্ছে, যেখানে ওই ইমারতগুলি যে জঞ্জাল উৎপাদন করছে, যে জঞ্জালে চাপা পড়ে যাচ্ছে বাকি শহরের বহু মানুষ, গোটা শহর হয়ে যাচ্ছে ধাপার মাঠ, সেই জঞ্জাল দেখানো হয়েছে – মায়ার জঞ্জাল।

গত বছরের শেষদিকে ঝিল্লি বলে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল সামান্য কিছু প্রেক্ষাগৃহে, যা আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মুখে শুনেছি এবং পত্রপত্রিকাতেও পড়েছি, সেই ছবিতে ক্যামেরা সত্যিকারের জঞ্জালের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। একটি কাগজে এ কথাও পড়েছি যে একটি শোতে ছবি শুরু হওয়ার খানিকক্ষণের মধ্যে একজন দর্শক দৃশ্যের অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যান। মায়ার জঞ্জাল সে তুলনায় অনেক নরম ছবি। এখানে এমন কোনো দৃশ্যের জন্ম দেননি পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, যা দেখে বমি পাবে বা মাথা ঘুরবে। নামেই প্রকাশ, তিনি মূর্ত জঞ্জাল নয়, বিমূর্ত জঞ্জাল দেখাতে চেয়েছেন। সে কাজে কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছেন তার বিচার সিনেমাবেত্তারা করবেন, কিন্তু আমার ভাল লাগছে এই দেখে যে বাংলা ছবির পরিচালকরা শেষমেশ ক্লেদজ কুসুম পর্দায় তুলে আনতে বেরিয়ে পড়েছেন।

কোভিড অতিমারীর আগেই তৈরি হয়ে যাওয়া, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির সুযোগ না পাওয়া এই ছবির আখ্যানাংশের অবলম্বন হিসাবে কাজ করেছে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি গল্প – ‘বিষাক্ত প্রেম’ এবং ‘সুবালা’। কিন্তু যেভাবে আজকের কলকাতা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে পর্দায় – তার অপরাধ জগৎ, দলীয় ও বৃহত্তর রাজনীতি, ধ্বস্ত অর্থনীতি, তার চাপে আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলি সমেত – তাতে পুরনো হিট ছবির রিমেকের রমরমার যুগে দাঁড়িয়ে এই পুনর্নির্মাণের মুনশিয়ানার চেয়েও সাহসটি বেশি প্রশংসনীয় বোধহয়।

ছবি দেখতে দেখতে সাংবাদিকসুলভ বদভ্যাসে মনে হচ্ছিল, গত এক-দেড় বছরে বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করা মানুষগুলির সবরকম দুর্দশার জন্য অতিমারীকে নন্দ ঘোষ বানানোর যে চল হয়েছে, এ ছবিকে তার জবাব হিসাবে খাড়া করা যায়। অতিমারীর আগেও যে মানুষ ভাল ছিল না, মধ্যবিত্ত দ্রুত গরিব হয়ে যাচ্ছিল আর বেঁচে থাকার জন্য সৎ-অসৎ, এক নম্বরি-দু নম্বরির ভেদ রাখা একদা লাল পতাকা নিয়ে মিটিং মিছিল করা আদর্শবাদী মধ্যবিত্তের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছিল না – তা এ ছবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

মার্কস সাহেব কী বলেছেন জানি না, গত বিশ বছরে নিজের চোখে যা দেখেছি তা হল, গরিব দুরকমের। এক, যে আজন্ম গরিব এবং কালো পথে না হাঁটলে সেভাবেও বাঁচতে পারবে না। দুই, যে মধ্যবিত্ত ছিল, যার টনটনে আত্মসম্মানবোধ এবং নীতিজ্ঞান ছিল। এখন সেসব বিসর্জন না দিলে জাতও যায়, পেটও ভরে না। এই দু ধরনের গরীবকে একইসঙ্গে দেখতে পাব আমার সময়ের কোনো বাংলা ছবির পরিচালকের ছবিতে – সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ইন্দ্রনীল মায়ার জঞ্জালে আশা ফিরিয়ে দিলেন। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় এই দুই ধরনের গরিবকে পর্দায় একেবারে রক্তমাংসের করে তুলেছেন সোহেল মন্ডল, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অপি করিম, চান্দ্রেয়ী ঘোষরা।

ঋত্বিক একেবারে সাধারণ, চলতি কথায় যাদের এলেবেলে বলা হয়, তেমন লোকের চরিত্রে এতবার অভিনয় করেছেন এবং এত জীবন্ত করে তুলেছেন যে মনে হয় তাঁকে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে আনলেও ওরকম একটি চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করে ফেলবেন। কিন্তু নিজের জীবনের রাশ, এমনকি বউয়ের রাশও হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় যুগপৎ নিষ্ফল আক্রোশ এবং অসহায় হতাশার যে অভিনয় তিনি এই ছবিতে করেছেন, তা দগদগে ঘা হয়ে থাকে। সোহেলও দক্ষ বাজিকরের হাতের পুতুল খুচরো সমাজবিরোধী হিসাবে, যৌনকর্মীর প্রেমে পড়ে যাওয়া কিন্তু লোভের দাস একজন মানুষ হিসাবে দারুণ পরিমিত। 

তবে সোহেলের চরিত্রের একটি দিক কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা তৈরি করে। তা হল তাঁর সংলাপের ভাষা। তিনি খিস্তি দিচ্ছেন যথার্থ গুন্ডাদের মতই, কিন্তু তা বাদে তাঁর মুখের বাংলা অনেকটাই কলকাতার ভদ্রলোকদের মত শোনায়। খিস্তি বাদ দিলে ঋত্বিকের মুখের ভাষার সঙ্গে সোহেলের মুখের ভাষা প্রায় এক। তাঁর অপরাধ জগতের সঙ্গীসাথীদের ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা মনে হয়। এমনকি নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের মধ্যেও চান্দ্রেয়ী ঘোষ বাদে অন্য অভিনেত্রীদের মুখের ভাষা যেন বড় বেশি ‘মান্য’ বাংলা, অবশ্যই খিস্তি বাদে। যেখানে সমরেশ বসুর প্রজাপতি উপন্যাসের সুখেনের ভাষা আশা করেছিলাম, সেখানে যেন বিবর উপন্যাসের বীরেশের ভাষা উঁকি মারছে। বাংলাদেশ থেকে স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় বেড়াতে এসে বিক্রি হয়ে যাওয়া চান্দ্রেয়ীর চরিত্রের মুখের ভাষাতেও কি পূর্ববঙ্গীয় টান খানিক থাকা উচিত ছিল? নাকি কলকাতার খদ্দেরদের চাহিদায় সে ভাষা পালটে নিতে হয়? খটকা রইল। কারণ কদিন আগেই প্রতিভা সরকারের লেখা একটি গল্পে উত্তরবঙ্গ থেকে এসে সোনাগাছির বাসিন্দা হয়ে যাওয়া দুই যৌনকর্মীর কথা পড়েছি। তাদের একজন উত্তরবঙ্গীয় ভাষা কিছুতেই ছাড়তে চায় না।

অভিনয়ের দিক থেকে অবশ্য চমকে দেন চান্দ্রেয়ী। যদিও তাঁর অনেককিছু বলার, অনেককিছু করার আছে। যিনি প্রধানত মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে যান এবং সেভাবেই নিজের সীমিত ক্ষমতায় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়ে যান, সেই গৃহবধূর চরিত্রে মনে রাখার মত অভিনয় করেছেন অপি করিম। তাঁর চমকে দেওয়া কাজ ছিল না, তাঁকে দেখলেই মনে হয় – আরে! একে তো চিনি! ভাত আছে, ভাতের সঙ্গে মুখরোচক ব্যঞ্জন নেই। রোজ রোজ একই জিনিস দিয়ে ভাত খেতে খেতে গলা দিয়ে আর নামে না। কোনো কারণে আত্মসম্মানে আঘাত লাগায় ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গেলেন বাবা, নীরব হয়ে রইলেন মা – এ দৃশ্য গত শতকে মধ্যবিত্ত জীবন পেরিয়ে আসা আমাদের অনেকের কাছেই চিরচেনা। সেইসব মায়েদের মুখ অপি প্রস্থেটিক মেক-আপের চেয়েও নিখুঁতভাবে ধারণ করেছেন নিজের মুখে।

আরও পড়ুন ‘অলৌকিক মেগা সিরিয়াল দেখা সমাজের সত্যজিতের ছবি দেখার কোন কারণ নেই, তিনি উপলক্ষ মাত্র’

এক সময়কার ক্রীড়া সাংবাদিক অশোক দাশগুপ্ত একবার ক্রিকেট নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলেন, নাম ছিল ‘বেণুদা কী বলবে’। সেখানে বেণুদা গল্পের কথককে বলেছিলেন, ক্রিকেট খেলায় উইকেটরক্ষকের কাজ হল চোখে না পড়ে নিজের কাজ করে যাওয়া। যদি কোনো উইকেটরক্ষক খুব বেশি চোখে পড়ে, বুঝতে হবে সে ভাল কিপিং করছে না। মায়ার জঞ্জালে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র উইকেটরক্ষকের। তিনি প্রবাদপ্রতিম সৈয়দ কিরমানির মতই প্রশান্ত কিপিং করেছেন। অন্যদিকে ব্রাত্য বসু যেন হাতে জমে যাওয়া ক্যাচ নিতে গিয়েও বিস্তর লম্ফঝম্প করলেন।

সিনেমাশাস্ত্রে দীক্ষিতরা নিশ্চয়ই মায়ার জঞ্জাল দেখে বেশকিছু অপূর্ণতা চিহ্নিত করতে পারবেন। আমার মত ছাপোষা দর্শকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। দেয়াল জোড়া এলইডি টিভিতে বিদেশি সুনীল সাগরের শ্যামল কিনার দেখে অপির শূন্য দৃষ্টির শট আর তারপরেই তাজপুরের সমুদ্র সৈকতে স্বামী-স্ত্রীর শুয়ে থাকার শট আমাকে দ্রব করে ফেলে। এ আমার জীবনযাপনের মধ্যবিত্ততা তো বটেই, হয়ত রুচিরও। তবে মনে হয় আমার মত দর্শকদের কল্পনাশক্তির উপর পরিচালকের ভরসা বেশ কম। নইলে জঞ্জাল কুড়ানি মহিলাকে অতবার না দেখালেও চলত।

সিনেমার ভাষায় যাকে সিকুয়েল বলে, তার বাংলা প্রতিশব্দ কী জানি না। মায়ার জঞ্জাল দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, এ যেন অবচেতনে সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ছবির সিকুয়েল। মনে হওয়ার পিছনে ছবির আখ্যানাংশ কতখানি দায়ী আর হিন্ডেনবার্গ, ফোর্বসের প্রতিবেদনের পর গৌতম আদানির শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় আমার এলআইসি পলিসি আর স্টেট ব্যাঙ্কে জমা টাকাগুলির জন্য উদ্বেগ কতখানি দায়ী – তা অবশ্য বলতে পারব না। তবে ১৯৬৩ সালের মহানগর যে আজ ষাট বছর পরে মায়ার জঞ্জালেই পরিণত হয়েছে তাতে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। সিনেমার পর্দায় নিজের চারপাশ, নিজের জীবন এবং যাদের আমরা দেখতে চাই না বলেই দেখতে পাই না – তাদের দেখার আগ্রহ থাকলে এ ছবি দেখার মত। এটুকু বলতেই পারি।

পুনশ্চ: অপ্রাসঙ্গিক, তবু ছবিটি ভাবাল বলেই আরও কিছু কথা বলি। মুক্তি পাওয়ার আগেই যে এই ছবি দেখে ফেললাম সে আমার পেশাগত তথা সামাজিক অবস্থানের বিশেষ সুবিধা। এ ছবি আসলে যাদের কথা বলে, তাদের প্রায় কারোরই সে সুবিধা নেই। উপরন্তু, শহর গ্রাম মফস্বলের এক পর্দার সিনেমা হলগুলিকে গিলে নিয়েছে যে মাল্টিপ্লেক্স শিল্প, তার দাপটে এ ছবি মুক্তি পাওয়ার পরেও ওই মানুষগুলি দেখে উঠতে পারবে কিনা জানি না। আমার ধারণা বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না দেখতে যারা একসময় হল ভরাত, উবের ওলা চড়া শহুরে দর্শকের চেয়ে মায়ার জঞ্জাল তাদের স্পর্শ করতে পারত অনেক বেশি। কিন্তু এ ছবি নিয়ে প্রযোজক, পরিচালক তাদের কাছে পৌঁছবেন কী করে? সেই দর্শকদের সিনেমা দেখতে আসার পথ তো বহুকাল আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর অনেক আবেদন আজকাল বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অথচ যখন প্রয়োজন ছিল, তখন বাংলা ছবি ওই বিরাট অংশের দর্শকের পাশে দাঁড়ায়নি।

সে দোষ কি শুধুই একুশ শতকের নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতির? তার আগেও কি কখনো ভেবে দেখেছি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী আমরা, দেশভাগের কেবল গল্প শোনা আমরা মেঘে ঢাকা তারা দেখে যেভাবে মথিত হই, আট বা নয়ের দশকে বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে এ দেশে চলে আসা আমার বাড়ির কাজের লোকটি তার চেয়েও বেশি মথিত হতে পারে। তাকে একদিন দেখানো যাক? আমরা কি জাঁক করে ভাবিনি, পথের পাঁচালী দেখে ওরা কিছুই বুঝবে না? এই আমরাই আবার মহৎ শিল্পের সর্বজনীন আবেদন নিয়ে বক্তৃতা দিই, প্রবন্ধ লিখি। আজ বাঙালি সংস্কৃতির যে সংকট তা হয়ত অনেকখানি এইজন্য, যে ভাল ভাল জিনিস সব নন্দন চত্বরে ‘আমাদের কালচার’ হয়ে রয়ে গেছে। সব বাঙালির সংস্কৃতি হয়ে ওঠেনি।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

খাড়া বড়ি থোড় বললেই উড়ে যাবে না নতুন ফেলুদা ছবি

সন্তোষ দত্তের জন্মশতবর্ষে যে ফেলুদা ছবি মুক্তি পাবে তাতে যদি জটায়ুর অভিনয়টা ভাল হয় তাহলে তাঁকে যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে।

বুঝে দেখ জটায়ুর কলমের জোর
ঘুরে গেছে রহস্য কাহিনীর মোড়
থোড় বড়ি খাড়া
লিখে তাড়াতাড়া
এইবারে লিখেছেন খাড়া বড়ি থোড়।

ফেলু মিত্তিরের ভক্তরা জানেন, এই পাঁচ লাইনের রচয়িতা প্রদোষচন্দ্র মিত্র স্বয়ং। হত্যাপুরী গল্পের শুরুতেই ফেলুদা রচিত এই লিমেরিক তোপসে পাঠকের কাছে হাজির করেছে। সন্দীপ রায়ের হত্যাপুরী ছবির বর্ণনাতেও এই ছড়া দিব্যি খেটে যায়। তবে ফেলুদাকে নিয়ে নতুন কিছু করা হয়েছে এমন প্রত্যাশা নিয়ে কে-ই বা সিনেমা হলে যাচ্ছে? শীতের ছুটির মধ্যে কোনো একটা দিন সপরিবারে খানিকটা স্মৃতিমেদুর সময় কাটানো – ফেলুদার ছবি দেখতে যাওয়ার এই তো আসল উদ্দেশ্য। সুতরাং সে ছবি অভিনব না হয়ে যত পরিচিত হয় ততই ভাল। তাছাড়া ফেলুদার ছবির সব দর্শকই গল্পগুলো পড়ে ফেলেছে – একথা বুকে হাত দিয়ে বলা ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখনকার স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের অনেকেরই ফেলুদার কথা বাবা-মায়ের মুখে শোনা। তারা বই পড়ে কম, বাংলা পড়ে আরও কম। ফলে ছবিগুলো এমনিতেই তাদের কাছে অভিনব। আমরা চল্লিশোর্ধ্বরা কনুইটা সিটের হাতলে ঠেকিয়ে হাতটা থুতনিতে রেখে যতই ভুরু কুঁচকে বিচার করি সন্দীপ সত্যজিতের ফেলুদাকে পর্দায় আনতে গিয়ে কোথায় কতটুকু সরলেন বা সরলেন না, সরলে সেটা রসোত্তীর্ণ হল কিনা; তরুণতর দর্শকদের অনেকের কাছেই কেবল গল্পটা নয়, ফেলু-তোপসে-জটায়ুর গোটা জগৎটাই নতুন। যতবার ফেলুদা চলচ্চিত্রায়িত হচ্ছে, ততবার তাদের নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। বাঙালির সাংস্কৃতিক শিকড় যতখানি আলগা হয়ে গেছে, তাতে স্রেফ আর্কাইভ করে রাখার কথা ভেবে যদি সত্তর ছুঁই ছুঁই সন্দীপ এখনো পুরনো ফর্মুলাতেই ফেলুদা ছবি বানিয়ে যান তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া চলে না।

ছবির বিচার করতে গিয়ে এসব কথাও ভাবতে হচ্ছে – এটা নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু বাংলা ছবি, শুধু ছবিই বা কেন, বাংলার সংস্কৃতিই যে কপাল চাপড়ানোর মত অবস্থায় পৌঁছেছে তা নিয়ে তো আর ঢাকঢাক গুড়গুড় করার কিছু নেই। বাংলা ছবির দুরবস্থা যে নেহাত নিন্দুকের কল্পনা নয় তার ব্যবসায়িক ও শৈল্পিক – দু ধরনের প্রমাণই উপস্থিত। ২০২২ সালে গোটা চারেক ছবি প্রেক্ষাগৃহে লোক টানতে পেরেছে, যার মধ্যে একটা আবার বাংলাদেশের ছবি। এতেই প্রযোজক থেকে শুরু করে দর্শক অব্দি সকলেই আহ্লাদে আটখানা – এই হল ব্যবসায়িক প্রমাণ। আর শৈল্পিক প্রমাণ তো প্রায় এক দশক ধরে গোয়েন্দা ছবির প্রাবল্যেই পাওয়া যাচ্ছে।

এমন নয় যে পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় জনপ্রিয় গোয়েন্দা গল্প নিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ছবি বা সিরিজ হয় না। বাঙালিরা যে ভাষার সিনেমা, সিরিজের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিচিত সেই ইংরেজি ভাষাতেই শার্লক হোমস, আর্কুল পয়রো, মিস মার্পল প্রমুখ গোয়েন্দাকে নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ বড় পর্দার ছবি, টিভি সিরিজ হয়েছে; ওটিটির যুগে ওয়েব সিরিজও হয়ে চলেছে। কিন্তু প্রায় সমস্ত প্রযোজনাতেই নতুন কিছু করার প্রয়াস দেখা যায়, কখনো কখনো তার ফলে বিবিসির শার্লক সিরিজের মত চমকপ্রদ কিছুও তৈরি হয়।

সন্দীপ সত্যজিতের ছেলে হওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজে ফেলুদার হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়ে গল্পগুলোকে আজকের দিনে নিয়ে আসা ছাড়া কোনোরকম সৃজনশীলতা দেখাচ্ছেন না, ওদিকে কপিরাইট ধরে রেখে অন্য কাউকে আরও সৃজনশীল হওয়ার সুযোগও দিচ্ছেন না বলে আমরা – ফেলুদা পড়ে বড় হওয়া প্রজন্ম – অনুযোগ করতাম গত দশকে। সন্দীপ সে গুড়ে বালি দিয়েছেন অনেকদিন হল। তাঁর হাঁটুর বয়সী পরিচালকরা ফেলুদাকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ করছেন। কিন্তু তাতেই বা ফেলুদা নব নব রূপে প্রাণে আসতে পারছে কই? তরুণ পরিচালকদের উদ্ভাবনী শক্তির নমুনা দেখে তো উল্লসিত হওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য শেয়াল দেবতা রহস্য আর ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা নিয়ে ওয়েব সিরিজ করেছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। শেষমেশ সেখানে কলকাতার ঢাকা হয়ে যাওয়া আর তোপসের লেখা বইয়ের বদলে ব্লগে প্রকাশিত হওয়া ছাড়া কোনো যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখা যায়নি। ও জিনিসটিও স্টিভেন মফাট আর মার্ক গ্যাটিস শার্লক সিরিজে আগেই করে ফেলেছেন এবং সেখানে আর্থার কোনান ডয়েলের আখ্যানকে তাঁরা যতদূর নিয়ে গেছেন ততখানি পরীক্ষামূলক হওয়ার সাহস পরমব্রত দেখিয়ে উঠতে পারেননি। উপরন্তু স্বয়ং ফেলুদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসে ঘুরঘুটিয়ার ঘটনার ক্লাইম্যাক্সে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে পরিচিত দুটো লাইন আওড়াতে গিয়ে গুবলেট করেছেন। শেয়াল দেবতা রহস্যে ফেলুদার একটি সাংবাদিক প্রেমিকা প্রায় জুটিয়ে ফেলেছিলেন (শারলিন ফারজানা), শেষ অব্দি বোধহয় সন্দেশ পড়া প্রাচীন পাঠক-পাঠিকারা রেগে যাবেন ভেবে পিছিয়ে যান।

পরমব্রত তবু নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন, বাংলা ছবির রিমেক সম্রাট সৃজিত মুখোপাধ্যায় তো ফেলুদাকে নিয়ে পিরিয়ড পিস বানাতে গিয়ে ১৯৮০-র দশকের দমদম বিমানবন্দরে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া ক্যাম্পেনের পোস্টার সেঁটে ফেলেছেন। মুক্তি পেতে চলেছে অরিন্দম শীল নির্দেশিত আরও একটা ফেলুদা ওয়েব সিরিজ। সেখানে আবার গ্যাংটকে এ জাতীয় গন্ডগোল দেখা না গেলেই হয়। পরিচালক অবশ্য এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এখানে ফেলুদা আধুনিক – স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করেন। তবে সেটাই প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকলে খাড়া বড়ি থোড়ই ভবিতব্য।

সন্দীপের হত্যাপুরীকে এই পরিস্থিতি মনে রেখে বিচার করা ভাল।

তিনি প্রথম যখন বড় পর্দার জন্যে ফেলুদার ছবি তৈরি করতে শুরু করেন তখন যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি হতাশ করত তা হল কে অপরাধী তা গোড়াতেই দেখিয়ে দেওয়া। সত্যজিৎ নিজে সোনার কেল্লা আর জয়বাবা ফেলুনাথ – দুটো ক্ষেত্রেই তা করেছিলেন। কিন্তু গল্পের তুলনায় সে দুটো প্রায় আমূল পরিবর্তিত চিত্রনাট্য। ফলে বইয়ের ‘হু ডান ইট’ পর্দায় থ্রিলারে পরিণত হয়ে অন্যরকম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সন্দীপ আবার আমূল পরিবর্তন করতে চান না কখনোই, ফলে ছবির অবস্থা হত ন যযৌ ন তস্থৌ। হত্যাপুরীতে সে দ্বিধা নেই। চিত্রনাট্য মোটের উপর গল্পকেই অনুসরণ করেছে, ‘হু ডান ইট’ উৎকণ্ঠা বজায় রাখা হয়েছে। শুরুতে যে ফেলুদা আবিষ্কারক দর্শক প্রজন্মের কথা বলছিলাম, তাদের এই চিত্রনাট্য আকর্ষণ করবে। গল্প থেকে চোখে পড়ার মত পরিবর্তন বলতে জটায়ুর ড্রাইভার হরিপদবাবুকে বাদ দেওয়া। তাতে অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি।

এ ছবির সেরা অভিনেতা দুজন – সাহেব চ্যাটার্জী আর শুভাশিষ মুখোপাধ্যায়। সুপুরুষ সাহেবের শিশুর মত সরল হাসি বিলাস মজুমদারকে দারুণ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। হারবার্টের চরিত্রে অভিনয় করা শুভাশিস যে লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের চরিত্র ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও করে ফেলতে পারেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (দুর্গাগতি সেন) সম্ভবত অভিনয় জীবনের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন যেখানে খেলার মাঠে যাকে ‘প্লেয়িং ফ্রম মেমরি’ বলে, তা করলেও দেখার মত হবে। ঠিক ফ্রাঙ্কো বারেসি যেভাবে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে ওটুকু করেই সেরা সময়ের রোমারিও, বেবেতোকে আটকে দিয়েছিলেন।

কিন্তু যে কোনো ফেলুদা ছবির আসল আকর্ষণ তো ওই তিনজন – গোয়েন্দা, তাঁর খুড়তুতো ভাই আর রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী। তাঁদের অভিনয়ে গোলমাল হলে দারুণ চিত্রনাট্য, অসামান্য সিনেমাটোগ্রাফি – কোনোকিছুই ছবিকে বাঁচাতে পারে না। যে কোনো গোয়েন্দা গল্পের চলচ্চিত্রায়ণেই অবশ্য তাই। বেনেডিক্ট কামবারবাচ আর মার্টিন ফ্রিম্যান যথাক্রমে শার্লক হোমস আর ডাক্তার ওয়াটসনের চরিত্রে মারকাটারি অভিনয় না করলে বিবিসির শার্লক সিরিজ তাক লাগানো ভাবনা, চিত্রনাট্য, প্রযুক্তির ব্যবহার সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়তই। হত্যাপুরী ছবিতে তিন কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতাদের সন্দীপ এই প্রথম ব্যবহার করলেন। বস্তুত, ছবিটা যেমনই হয়ে থাক, সন্দীপের প্রশংসা প্রাপ্য এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতাপশালী প্রযোজকের সঙ্গে কাস্টিং নিয়ে আপোস করেননি বলে। একই প্রযোজকের ব্যানারে অন্য পরিচালক যে কাস্ট নিয়ে কাজ করেছেন তাঁকেও সেই কাস্ট নিয়েই কাজ করতে হবে – এই অন্যায় আবদার মানবেন না বলে সন্দীপ প্রযোজকই বদলে ফেলেছেন। ছবিটা হতে পারত অনেক আগেই, কিন্তু পিছিয়ে গেছে। এখন কথা হল, তাঁর এই লড়াইকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারলেন কি তাঁর পছন্দের অভিনেতারা?

ফেলুদার কথায় শেষে আসব, কারণ ওটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তোপসেকে দিয়ে শুরু করা যাক। সন্দেহ নেই, সেই সোনার কেল্লার সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জির পরে এই প্রথম একজন তোপসেকে দেখে কচি ছেলে বলে মনে হয়েছে। সন্দীপ রায়ের টেলিফিল্মগুলোতে এবং সিনেমায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় আর পরমব্রত যখন ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তাঁদের মোটেই বছর পনেরোর ছেলে মনে হয়নি। বরং পরমব্রত নির্দেশিত ওয়েব সিরিজে ঋদ্ধি সেনকে কিছুটা বইয়ের তোপসে মনে হয়েছিল। হয়ত আগের ছবিগুলোতে সন্দীপ তোপসেকে একটু বড় ছেলে হিসাবেই দেখাতে চেয়েছিলেন। হত্যাপুরীতে আয়ুশ দাসকে কিন্তু সদ্য দাড়িগোঁফ ওঠা তোপসেই মনে হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। সংলাপ বলায় তাঁর নিজেকে কচিতর করে তোলার চেষ্টা ভীষণ চোখে লাগে। উপরন্তু মেগাসিরিয়ালের অভিনেতাদের মত উত্তেজনা প্রকাশ করতে গেলে তিনি চোখ বড় বড় করে কথা বলেন। বড় পর্দায় স্বভাবতই সে চোখ আরও বড় বড় লাগে।

আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

সন্দীপ রায় নিজে বলেছেন শিগগির আরও ফেলুদা ছবি করবেন, অন্য পরিচালকরাও ময়দানে নেমে পড়েছেন। ফলে আশা করা যায় ২০২৫ সালেও কোনো না কোনো ফেলুদা ছবি মুক্তি পাবে। বছরটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেবার সন্তোষ দত্ত একশোয় পড়বেন। বাষট্টি বছরের জীবনে যতগুলো ছবিতে কাজ করেছেন কোনোটাতেই একেবারে ফেলে দেওয়ার মত অভিনয় করেননি। তবু বেশিরভাগ দর্শক তাঁকে মনে রেখেছেন জটায়ু হিসাবে। তাঁর জন্মশতবর্ষে যে ফেলুদা ছবি মুক্তি পাবে তাতে যদি জটায়ুর অভিনয়টা ভাল হয় তাহলে তাঁকে যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে। কিন্তু লক্ষণ ভাল নয়। ওই চরিত্রের অভিনয় সন্তোষ দত্তের মৃত্যুর পর থেকে যেন ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। রবি ঘোষ আর অনুপকুমার তবু একরকম ছিলেন, অকালমৃত্যু না হলে হয়ত আরও ভাল করতেন। বিভু ভট্টাচার্যের আমল থেকে শুরু হয়েছে লালমোহনবাবুকে কমিক রিলিফে পরিণত করা। সন্দীপ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জটায়ু ভাঁড় নন, বন্ধু। এই কথাটা যে কোনো ফেলুদারসিকই বোঝেন, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে ওই চরিত্রের অভিনেতারা সন্তোষ দত্তের প্রয়াণের পর সাড়ে তিন দশকেও বুঝে উঠতে পারলেন না। সৃজিতের দার্জিলিং জমজমাট সিরিজে অনির্বাণ চক্রবর্তী তো প্রায় গোপাল ভাঁড় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সে না হয় অন্য পরিচালকের ছবি, কিন্তু সন্দীপের নিজের ছবির জটায়ুরা কেন নিজেদের ভাঁড় মনে করছেন? হত্যাপুরীর জটায়ু অভিজিৎ গুহ নিজেও একজন পরিচালক, অথচ তিনিও এ দোষ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সারাক্ষণই অতি-অভিনয় করে গেছেন। হোটেলের ঘরের একটা দৃশ্যে তো মনে হয়েছে তিনি ফেলুদাকেও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

যে অভিনেতার কাস্টিং নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ ছিল, সেই ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তই কিন্তু সবচেয়ে জমাট অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সব্যসাচী চক্রবর্তীর বাচনভঙ্গি আর উচ্চারণ ফেলুদাকে এমন খাঁটি বাঙালি চেহারা দিয়েছে যে প্রবাসী ইন্দ্রনীলের ঈষৎ টানওলা বাংলা অভ্যস্ত কানে কোথাও কোথাও একটু অস্বস্তি তৈরি করে, কিন্তু তাঁর অতীতের অভিনয় দেখা থাকলে বোঝা যায় সেখানেও অনেকটা উন্নতি করেছেন। তাছাড়া কেবল বাচনভঙ্গীই তো অভিনয় নয়। হাঁটাচলায়, স্থৈর্যে, সাহসে ইন্দ্রনীল ফেলুদা হয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি আবীর চ্যাটার্জির মত সংলাপসর্বস্ব ফেলুদা নন, টোটা রায়চৌধুরীর মত বচ্চনপ্রতিম ফেলুদাও নন। ইন্দ্রনীলকে সত্যিই মগজাস্ত্র-নির্ভর গোয়েন্দা বলে মনে হয়েছে। জটায়ুকে হ্যাটা করার প্রবণতা, যা সব্যসাচী পরবর্তী ফেলুদাদের অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছিল, তাও ইন্দ্রনীলের মধ্যে নেই।

সম্প্রতি বাংলা ছবি, ওয়েব সিরিজে গোয়েন্দার ছড়াছড়ি। রোগা ভূত, মোটা ভূত, বাবা ভূত, ছানা ভূতের মত নানারকমের গোয়েন্দায় ভরে গেছে দ্বিগ্বিদিক। অথচ রহস্যের তেমন বৈচিত্র্য নেই। সোনাদা একের পর এক ছবিতে গুপ্তধনই উদ্ধার করে চলেছেন, একেনবাবুর জটায়ুসুলভ হিন্দি বলা আর বাংলা প্রবাদ ব্যবহারে ভুল করায় বৈচিত্র্য থাকলেও ঘুরে ফিরে সেই খুনের রহস্যের কিনারা করছেন। তার মধ্যে সন্দীপ ফেলুদার এমন একটা গল্প বেছে নিয়ে ছবি করেছেন যেখানে সোনাদানা নয়, অপরাধের লক্ষ্য প্রাচীন পুঁথি। খুনোখুনি যা হয়েছে সেগুলোও পুঁথির কারণেই। এ জন্যেও বোধ করি তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। পুঁথিকে ধন মনে করার বাঙালি সংস্কৃতি লুপ্তপ্রায়। দুর্গাগতি আর সিধুজ্যাঠার মত মানুষ, পাহাড়প্রমাণ টাকা যাঁদের কিনতে পারে না – তাঁরাও মিসিং লিঙ্কে পরিণত হয়েছেন। হত্যাপুরী নিদেনপক্ষে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রমাণ রেখে দিল যে এমন মানুষও একদা এই পশ্চিমবঙ্গে ছেল।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

বল্লভপুরের রূপকথা: খাঁটি বাংলা ছবি

হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল, এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

এক গল্প হাজারবার বললে সে আর এক গল্প থাকে না, পালটে পালটে যায়। মানুষের জীবনের মত। এক চরিত্রের মুখ দিয়ে এই কথাটি পরিচালক ছবির শুরুতেই বলে দিয়েছেন। তাই বাদল সরকারের নাটক দেখা না থাকলেও বল্লভপুরের রূপকথা দেখতে অসুবিধা হয় না। আমরা দুর্ভাগা প্রজন্ম। বাদল সরকারের নামটুকুই শুনেছি, কেউ কেউ তা-ও শুনিনি। আমরা কেবল সত্যজিৎ রায়কে চিনি। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য যথার্থই অনুমান করেছিলেন, হলে ঢুকে আমরা কেউ সঙ্গের দর্শককে জিজ্ঞেস করে ফেলতেই পারি “বাদল সরকারটা আবার কে?” তাই গোড়াতেই সেসব দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রফেসর শঙ্কুর মত দেখতে লোকটি যে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যশিল্পী তা সিনেমা দেখতে গিয়ে জানা হয়ে গেল।

পরিচালকের বুকের পাটা দেখে অবাক হতে হয়। মেগাসিরিয়ালে অভ্যস্ত দর্শককে তিনি একে তো বাদল সরকার চেনাচ্ছেন, তার উপর আবার আখ্যান সম্বন্ধে সচেতন করছেন! মিশকালো অন্ধকারে নৌকো বাইতে বাইতে যে মাঝি আখ্যান সম্পর্কে ওই চিরসত্য উচ্চারণ করছে তার নাম রসিক। অরসিকের কাছে রস নিবেদন করার দুর্ভাগ্য যেন আমার না হয় – বিধাতার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন প্রাচীন কবি। অনির্বাণ সে ঝুঁকি নিয়েছেন। তাঁর এত আয়োজন বৃথা যেত যদি বিদেশি ছবি থেকে বাদল সরকারের হাত ঘুরে তাঁর কাছে আসা আখ্যানটিকে রসোত্তীর্ণ করতে না পারতেন। সে পরীক্ষায় তিনি সফল। তাঁর আখ্যান রসে টইটম্বুর। হলভর্তি দর্শক প্রায়ই হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এ ছবি একটিমাত্র রস পরিবেশন করেনি। এমনকি হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল (pun), এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট অধিনায়কদের একজন, সৌরভ গাঙ্গুলি, একটা কথা খুব বলে থাকেন – একজন অধিনায়ক ততটাই ভাল, যতটা ভাল তাঁর দল। কথাটা চলচ্চিত্র পরিচালকের বেলাতেও বোধহয় খানিকটা খাটে। যে পরিচালকের হাতে বাদল সরকারের লেখা সংলাপ, সত্যম ভট্টাচার্য (ভূপতি), শ্যামল চক্রবর্তী (মনোহর), দেবরাজ ভট্টাচার্যের (সঞ্জীব) মত উৎকৃষ্ট অভিনেতা থাকেন, তাঁকে হাস্যরসের জন্য ইদানীংকালের বাংলা ছবিতে ব্যবহৃত উপরে উল্লিখিত মধ্যমেধার কৌশলগুলোর কাছে হাত পাততে হবেই বা কেন? তবে ক্রিকেট দলের অধিনায়কের একটা সুবিধা থাকে যা পরিচালকের নেই। দলের ব্যর্থতায় নেহাত প্যাঁচে পড়লে অধিনায়ক নির্বাচকদের ঘাড়েও কিছুটা দায় চাপিয়ে দিতে পারেন, পরিচালকের সে উপায় নেই। অনির্বাণ থিয়েটারের অভিনেতাদের নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। ফেল করলে কারোর দিকে আঙুল তোলার উপায় থাকত না। কিন্তু তাঁর নির্বাচিত অভিনেতারা প্রত্যেকেই চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ের মত খেলেছেন।

অনিবার্যভাবে মনে পড়ে সদ্যপ্রয়াত তরুণ মজুমদারের কথা। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগে অনুপকুমারকে নায়কের চরিত্রে রেখে তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলা ছবির ইতিহাসে সর্বকালের সেরা হিট ছবিগুলোর অন্যতম – পলাতক (১৯৬৩)। স্রেফ শক্তিশালী চিত্রনাট্য আর অভিনয় দক্ষতা হিট ছবির রসায়ন হতে পারে তার অকাট্য প্রমাণ। অনির্বাণও তারকাবিহীন, এমনকি রুপোলি পর্দার অভিনেতাবিহীন ছবি করেছেন। তরুণের সময়ে তবু টলিউড সংকটাপন্ন ছিল না। এখন কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছবি যদি শেষপর্যন্ত বিপুল সংখ্যক দর্শকের আশীর্বাদধন্য হয়, তাহলে কী করলে ছবি হিট হয়, সে প্রশ্ন নতুন করে ভাবতে হবে সকলকেই। শীর্ষ মন্তাজেই ইঙ্গিত রয়েছে – গোয়েন্দা, ভূত, নস্ট্যালজিয়া সবই কপচানো হয়ে গেছে। কোনোটাই বিশেষ কাজ দেয়নি। তরুণ পারতেন রুচিসম্মত অথচ জনপ্রিয় ছবি তৈরি করতে। সে ছবি সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনের উচ্চতার শিল্প হত না হয়ত। কিন্তু স্রেফ শহুরে ও অনাবাসী বাঙালি দর্শকের জন্য তৈরি চলচ্চিত্রোৎসবমুখী ভানও তাতে থাকত না। একইসঙ্গে গ্রাম ও শহরের দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারে, এমন বাংলা ছবি বিশ-তিরিশ বছর হল তৈরিই হয় না। অভিজ্ঞরা বলেন অমন ছবি নাকি সম্ভবই নয়, কারণ গ্রাম আর শহরের দর্শকের রুচির তফাত বিস্তর। অথচ বিশ্বায়নের যুগে গোটা দুনিয়াটাই গ্লোবাল ভিলেজ – এমনটাই তো জেনে আসছি। বাস্তবিক দার্জিলিং থেকে মেদিনীপুর – সর্বত্রই তো পৌঁছে গেছে ওটিটি। তবু? বল্লভপুরের রূপকথা আখ্যানে এবং উপস্থাপনে গ্রাম, শহরের সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছে। দেখা যাক তা সফল হয় কিনা।

অভিনয়ের কথা হচ্ছিল। ছবি দাঁড়িয়ে আছে ভূপতি, ছন্দা (সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়), মনোহর আর সঞ্জীবের চরিত্রের উপর ভর দিয়ে। তাঁদের অভিনয় তো নিখুঁত বটেই, ছোটখাটো চরিত্রগুলোতেও এত নির্মেদ অভিনয় আজকাল বাংলা ছবিতে সুলভ নয়। ভূপতির তিন পাওনাদার সাহা (কৃপাবিন্দু চৌধুরী), শ্রীনাথ (সুরজিৎ সরকার) আর পবনের (সুমন্ত রায়) সংলাপ বলার ঢং, হাঁটাচলা, তাকানো – সবকিছুই হাসির উদ্রেক করেছে। অথচ যথেষ্ট অবকাশ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অতি-অভিনয় করেননি। ইংরেজিতে যাকে কমিক টাইমিং বলে তাতে অবশ্য সবার উপরে মনোহর চরিত্রে শ্যামল। গোটা ছবিতে তিনি ভাবলেশহীন মুখে আর সকলকে হাসিয়ে গেলেন।

সত্যম চারশো বছর আগেকার রোম্যান্টিক, কালিদাস আওড়ানো, জমকালো পোশাক পরা রাজপুত্রের চরিত্রে যতটা সাবলীল, ততটাই দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা রায়বাড়ির প্রথম গামছা পরে ঘুমনো রাজা হিসাবে। এমনকি শুধু ভূপতির চরিত্রেও তিনি প্রয়োজনমাফিক সপ্রতিভ এবং অপ্রতিভ। কাজটা মোটেই সহজ নয়। বিশেষ করে ব্যোমকেশ আর ফেলুদার চরিত্রের একইরকম অভিনয় দেখে অভ্যস্ত চোখে সত্যমকে দেখে বলতে ইচ্ছে করে “বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে”।

দেবরাজ ভূতের ভয়ে কাবু, মিসেস হালদারের বকুনিতে ক্যাবলা অথচ বন্ধুর প্রতি আনুগত্যে অবিচল চরিত্রে দারুণ বিশ্বাসযোগ্য। অমন অভিনয় করতে পারেন আবার চমৎকার গাইতেও পারেন – এমন শিল্পী কজন পাওয়া যায়?

ওপেন টি বায়োস্কোপ ছবির নেহাত বালিকা সুরঙ্গনা এ ছবিতে গত শতকের ছয়ের দশকের লাবণ্যময়ী বাঙালি মেয়ে ছন্দার চরিত্রে দারুণ মানিয়ে গেছেন। সে শুধু তাঁর সৌন্দর্য, শাড়ি পরার ধরন বা চুল বাঁধার কায়দার জন্যে নয়। যে চোখের ভাষা সেরা সময়ের রোম্যান্টিক বাংলা ছবির নায়িকাদের অব্যর্থ অস্ত্র ছিল, সেই ভাষায় সুরঙ্গনার চোখ বারবার কথা বলেছে। পাশে দাঁড়ানো পুরুষটিকে নিজের ভাললাগা জানানোর জন্য বেশি কিছু নয়, স্রেফ তার মত দেখতে পূর্বপুরুষের পোর্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে “সুপুরুষ” বলে আড়চোখে তাকিয়ে নেওয়ার নৈপুণ্য সুরঙ্গনা চমৎকার রপ্ত করেছেন। বাঙালির প্রেমের অভিজ্ঞান, অন্তত সিনেমার পর্দায়, একসময় ছিল তার সূক্ষ্মতা। নায়িকারা সরাসরি নায়কের দিকে তাকাতেন না বা আগ বাড়িয়ে চুমু খেতেন না বলে যে ন্যাকা ছিলেন তা নয়। পাঁচের দশকেই শাপমোচন ছবিতে অবিবাহিতা সুচিত্রা সেন সটান বাবার সামনে দাদাকে জানিয়ে দিচ্ছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করতে যান কারণ “তিনি আমার স্বামী”। আবার পথে হল দেরী ছবিতে তাঁর চেয়ে নায়কের দৃষ্টিই লজ্জায় বেশি থরোথরো। সত্যমকে ধমকে দেওয়ার দৃশ্যে সুরঙ্গনাকেও তেমনই দৃঢ়চেতা দেখিয়েছে।

আরও পড়ুন অহৈতুকী পার্টিজানপ্রীতি

বল্লভপুরের রূপকথা ছবিটির এই এক মজা। আপাতদৃষ্টিতে নতুন কিছুই নেই। যা আছে তা হল বাংলা ছবির, বাংলার সংস্কৃতির চিরনতুন কিছু উপাদান যা মানুষের সর্বদা ভাল লাগে। নায়ক, নায়কের অভিভাবকসুলভ বৃদ্ধ চাকর, প্রাণের বন্ধু, নায়িকার শৌখিন এবং আধক্ষ্যাপা বাবা, জাঁদরেল মা, বাবার সঙ্গে রেষারেষি থাকা এক বুড়ো ধনী – এর কোনোটাই কি বাংলা ছবির দর্শকের কাছে নতুন? পরিচালক অনির্বাণ বা অন্যরা প্রচার পর্বে কোথাও বলেননি, অথচ দেখা গেল ছবিটি পিরিয়ড পিসও বটে। মূল নাটকের মত গত শতকের ছয়ের দশকই দেখানো হয়েছে। সেই সময়কার পোশাক-আশাক, কথা বলার ধরন, গাড়ির মডেল সবই নিখুঁত। এমনকি ছবির সঙ্গীত পর্যন্ত বাংলা গানের হারিয়ে যাওয়া মেলডির সন্ধান দেয়। অনির্বাণ, দেবরাজ, শুভদীপের সৃষ্টি ‘সাজো সাজাও এমন করে’ সাহানা বাজপেয়ীর গলায় এমন মধু ঝরায় যে সুরটি ছবি শেষ হওয়ার বহুক্ষণ পরেও কোথা থেকে যেন কানে ভেসে আসে। যন্ত্রসঙ্গীতের ঝমঝম আওয়াজে পূর্ণ খোনা গলার আধুনিক বাংলা সিনেমার গান তো শুনি আর ভুলে যাই প্রায় সহজেই। ছবির আবহসঙ্গীত পর্যন্ত আজকের বলে মনে হয় না, ভয়ের ছবির পরিবেশ সৃষ্টিকারী চেনা শব্দসম্ভারই ফিরে ফিরে আসে। যদিও তাতে ভয়ের পরিবেশ কতটা তৈরি করা গেছে তাতে সন্দেহ আছে। এই এক সমালোচনার জায়গা।

তবে চলচ্চিত্র তো শেষপর্যন্ত চিত্র। মনে রাখার মত কিছু শট না থাকলে চলে না। সেখানে সোনা ফলিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার। তাঁর তৈরি অন্ধকার ঘুরঘুট্টি বটে, কিন্তু তার মধ্যেও জঙ্গলের প্রত্যেকটি গাছ আলাদা করে দেখা যায়। দিনের বেলার শটগুলোতেও আউটডোর লোকেশনের সৌন্দর্য তাঁর ক্যামেরা চেটেপুটে নিয়েছে। তবে ভোলা যায় না বল্লভপুরের রাজবাড়িতে প্রথম পদক্ষেপের সময়ে সিনেমার পর্দা জুড়ে থাকা অন্ধকারের মধ্যে উদ্ভাসিত ছন্দার মুখের ক্লোজ আপ।

বল্লভপুরের রূপকথা শস্তা নয়, সহজ। চটকদার নয়, রংদার। নতুন নয়, চিরচেনা। পরিচালক অনির্বাণের সবচেয়ে বড় গুণ – তিনি একটি খাঁটি বাংলা ছবি বানিয়েছেন। এখানে বাঙালিকে বাঙালি বলে চেনা যায়। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল হাইরাইজ, হাইওয়ে, স্কচ আর পরকীয়ায় হারিয়ে যায়নি। হৃদয় ঘেঁটে দেখা গেছে কোথায় পাতা শীতলপাটি। ছবির শুরুতে আখ্যান সম্পর্কে যে চিরসত্য মাঝি রসিক তার পীর ঠাকুর্দার উক্তি বলে উল্লেখ করেছে, সেই সত্যই আবার শেষে দোকানদার পবন তার সন্ন্যাসীপ্রতিম ঠাকুর্দার উক্তি বলে ঘোষণা করেছে। অতি সহজে, প্রায় অলক্ষ্যে পরিচালক বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক সমন্বয় দেখিয়ে দিলেন। পুরনো কথাও বারবার বলতে হয়, বলতে বলতে নতুন হয়ে ওঠে। সেই নতুনত্বের খোঁজে বেরিয়েছেন অনির্বাণ। একেবারে শেষে দেখা গেছে তিনি নিজেকে নিয়েও রসিকতা করতে পারেন। এই ক্ষমতা যদি ধরে রাখতে পারেন তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভাল কিছু আশা করা যায়।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

আমাদের যখন সবে গোঁফ দাড়ি গজাচ্ছে, তখন ট্রেনের কামরা বা পাবলিক টয়লেটের দেয়ালে সাঁটা কিছু বিজ্ঞাপন নজর কাড়ত। সেখানে লেখা থাকত একটা কথা, যার অর্থ বুঝতে না পেরে আমরা আকাশ-পাতাল ভাবতাম এবং বন্ধু মহলে বিস্তর আলোচনা করতাম। কথাটা হল, কৈশোরের কিছু “কুঅভ্যাস” ছাড়তে না পারলে নাকি বিবাহিত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজেরা কিশোর বলেই ওখানে কোন অভ্যাসের কথা বলা হত তা জানতে আমরা যারপরনাই উদগ্রীব ছিলাম। কথাটা মনে পড়ল সদ্য ওটিটিতে মুক্তি পাওয়া ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দেখে। এই ওয়েব সিরিজের মূলধন হল ফেলুদা আর সত্যজিৎ সম্পর্কে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতা। ও জিনিসটা মানুষ মাত্রেরই থাকে, কিন্তু ওটা এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় কুঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা চিরকিশোর হয়ে পড়েছি। ফলে পুনরাবৃত্তিই আমাদের শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনুকরণই আমাদের আপ্লুত করছে। গালভরা নাম হয়েছে ‘ট্রিবিউট’। অনীক দত্ত সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁকে ট্রিবিউট দিতে ছবি তৈরি করেছেন। সে ছবির বৈশিষ্ট্য (বিজ্ঞাপন জগতের ভাষায় – ইউনিক সেলিং পয়েন্ট) হল, নামভূমিকায় যিনি আছেন তাঁকে হুবহু সত্যজিতের মত দেখাচ্ছে (অথচ চরিত্রটির নাম সত্যজিৎ নয়), আর পথের পাঁচালীর দৃশ্যগুলোর দারুণ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এতেই আমাদের আবেগে গলা বুজে আসছে। আসল পথের পাঁচালী দেখার উপায় থাকতে অনুকরণ কেন দেখতে যাব, সে প্রশ্ন করলে লোকে তেড়ে আসছে।

ব্যাপারটা শৈল্পিক হোক বা না হোক, স্মৃতিমেদুরতা (বাঙালিরা যাকে বলে নস্ট্যালজিয়া) যে লালমোহন গাঙ্গুলির ভাষায় “সেলিং লাইক হট কচুরিজ”, তাতে সন্দেহ নেই। ফলে সৃজিত মুখার্জিও নস্ট্যালজিয়া বেচতেই নেমেছেন। সিরিজের প্রথম পর্বের শুরুটাই হুবহু অনুকরণ, থুড়ি ট্রিবিউট। সোনার কেল্লা ছবিতে ফেলুদাকে পর্দায় প্রথমবার দেখানোর সময়ে শীর্ষাসনরত পদযুগল দেখানো হয়েছিল, তোপসে দৌড়ে এসে খবর দিয়েছিল মক্কেল এসেছে। এখানে পদযুগল এসেছে কয়েক সেকেন্ড পরে, প্রথমবার দেখানো হয়েছে শীর্ষাসনরত ফেলুদার মুখের ক্লোজ আপ। মুশকিল হল, অনুকরণেরও সক্ষমতা অক্ষমতা আছে। মক্কেল আসার খবর ফেলুদাকে তখুনি জানানোর দরকার পড়ে। জটায়ুর আগমন তো কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় যে তৎক্ষণাৎ জানাতে হবে। কিন্তু নির্দেশক ওসব ভাবতে যাবেন কেন? দর্শককে নস্ট্যালজিয়ায় জবজবে করে ফেলতে পারাই আসল। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

নস্ট্যালজিয়া নিশ্ছিদ্র করতে সিরিজটিকে পিরিয়ড পিসে পরিণত করা হয়েছে। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই বোধহয় এমন সিনেমা বোদ্ধা দর্শক পাওয়া যায়, যাঁরা বিশ্বাস করেন ছবি সেপিয়া টোনে রাখলেই পিরিয়ড পিস হয়ে যায়। কারণ ফেলুদারা দার্জিলিংয়ে যে হোটেলে ওঠে, তার বাইরের দেয়াল আধুনিক কায়দার। আশির দশকের ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ট্রিবিউট দিতেই বোধহয় দার্জিলিংয়ের ঠান্ডাতেও এই সিরিজের ফেলুদা টোটা রায়চৌধুরীকে ফিনফিনে পাজামা আর পাঞ্জাবির উপরে স্রেফ একটা চাদর জড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বাইরে বেরোবার সময়ে তিনি দিব্যি টি-শার্ট পরে ফেলেন। মর্নিং ওয়াকেও চলে যান আধুনিক জামাকাপড় পরে। সেইসব সময়ে আশির দশক বজায় থাকে ফেলুদা আর তোপসের পেতে আঁচড়ানো চুলে। বিরূপাক্ষ মজুমদারের পুত্র সমীরণের সঙ্গে ফেলুদার বাকযুদ্ধ অবশ্য পুরোদস্তুর রেট্রো। ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া প্রভাত রায়ের প্রতিকার ছবির কথা মনে পড়ে যায়। ভয় হয়, চোখা চোখা সংলাপ বলতে বলতে এখুনি চিরঞ্জিত আর ভিক্টর ব্যানার্জির মত টোটা আর সমীরণরূপী সুপ্রভাত দাস মারামারি শুরু করে দেবেন। ট্রিবিউট অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এই সিরিজে ফেলুদার সংলাপ সম্ভবত এমএলএ ফাটাকেষ্ট চরিত্রের অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে ট্রিবিউট। নইলে নিজের গায়ের জোর কতটা তা বোঝাতে ফেলুদা বলতে পারেন না “ঘোড়া যেমন চাঁট মেরে মানুষের মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনই বহু দেশে ঘোড়াকে কেটে তার মাংস রান্না করে খাওয়া হয়।” (তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে “সুস্বাদু। জানেন?”)

দার্জিলিংয়ে ফেলুদার কার্যকলাপ অবশ্য সৌমিত্র বা চিরঞ্জিতের চেয়েও যাঁকে বেশি মনে পড়ায় তিনি অমিতাভ বচ্চন। কারণ এই ফেলুদা চিতাবাঘের চোখে চোখ রাখতে পারেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেই গুনগুন করে গান গাইতে পারেন। সে আবার ইংরেজি গান, যেহেতু তাতে ল্যাভেন্ডার শব্দটা আছে এবং যে ধাক্কা মেরেছিল তার শরীর থেকে ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার পারফিউমের গন্ধ পেয়ে ফেলুদা তাকে চিনতে পেরেছেন। এখানেই শেষ নয়, ফেলুদা আহত, ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের উপর গোটা শরীরের ভার নিতে পারেন। তিনি আরও একটি জিনিস পারেন যা এমনকি আশির দশকের বচ্চনও পারতেন না। তা হল দু হাতে বন্দুক চালানো। সমীরণ মজুমদারের গাড়ির টায়ারে ফেলুদা গুলি করেন বাঁ হাতে, গাড়ি থেকে নেমে আবার বন্দুক তাক করেন ডান হাতে।

ভক্তরা নিশ্চয়ই বলবেন এসব পরিচালকের স্বাধীনতা। ফিল্মের সাহিত্যকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করার দায় নেই। সত্যজিৎ নিজেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প নিয়ে ছবি করার সময়ে চিত্রনাট্যে অনেককিছু বদলে দিয়েছেন। কথাটা ঠিকই। এই স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার সৃজিতবাবু এই সিরিজে করেছেন। যেমন সত্যজিতের গল্পের টফ্রানিল বড়ি হয়ে গেছে ট্রফানিল। কিন্তু সমস্যা হল, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ছদিনে লিখিত এই গল্পে (সূত্র: ফেলুদা সমগ্র ১, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯; আনন্দ) সত্যজিৎ যে টফ্রানিলের কথা লিখেছেন, সামান্য গুগল সার্চই বলে দিচ্ছে ওই ওষুধটি (Tofranil) অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, যার প্রয়োজনীয়তা বিরূপাক্ষবাবু নিজে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু Trofanil বলে কোনো ওষুধের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এ যুগের সিধুজ্যাঠা গুগল Tromanil Plus বলে একটি ট্যাবলেটের কথা বলছে বটে, কিন্তু সেটিও রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ব্যবহার হয়। তাহলে কি পরিচালক সত্যজিতের উপর কলম চালিয়ে কোনো অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত ওষুধের সন্ধান দিলেন? পিরিয়ড পিসে কি তা করা চলে? প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অবশ্য হতাশ হতে হবে। যেমন বিরূপাক্ষবাবুর বেয়ারা লোকনাথকে খুন করা হয়েছিল গলা কেটে। মৃতদেহের তলপেটের কাছেও কী করে রক্ত লাগল – এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।

গল্পের যে পরিবর্তনটিকে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ বৈপ্লবিক আখ্যা দিচ্ছেন, সেটি চিত্রনাট্যকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে তা-ও যেমন বোঝা গেল না। দার্জিলিং জমজমাট গল্পে বলিউডের নায়িকা সুচন্দ্রার উল্লেখমাত্র আছে। এই সিরিজে কিন্তু তাঁর উপস্থিতি বেশ কয়েকটি দৃশ্যে। শুধু তা-ই নয়, ফিল্মের নায়ক রাজেন রায়না ওরফে বিষ্ণুদাশ বালাপোরিয়ার সঙ্গে তাঁর উদ্দাম প্রেম আছে – একথা একেবারে শুরু থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত দর্শককে (এবং ফেলুদাকে) একটি চুম্বন দৃশ্য উপহার দেওয়া ছাড়া চরিত্রটির আর কোনও ভূমিকা নেই। নায়ক-নায়িকার সম্পর্ক বিরূপাক্ষ মজুমদার হত্যা রহস্যকে নতুন কী দিতে পারল তা বোধহয় জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না। কিন্তু সুলভ পর্নোগ্রাফির যুগেও বাঙালি দর্শকের একটি লং শটের চুম্বন দৃশ্যকে বৈপ্লবিক মনে হচ্ছে দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।

একইরকম অবাক করে গল্পের সাধারণ ভদ্রলোক হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে ‘অ্যাংগ্রি ওল্ড ম্যান’ গোছের চরিত্রে পরিণত করা। তিনি নাকি বিরূপাক্ষবাবুর উপর নজর রাখার জন্য লোক লাগিয়েছিলেন। কী উদ্দেশ্যে তার ব্যাখ্যা অবশ্য চিত্রনাট্যে নেই। উপরন্তু তিনি বলেন, “ব্লাড প্রেশার আর গেঁটে বাতের সমস্যা না থাকলে” তিনি হয়ত বিরূপাক্ষবাবুকে খুন করার চেষ্টা করতেন। এটাও কি আশির দশকের বচ্চনকে ট্রিবিউট? মানে পিরিয়ড পিস হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হঠাৎ একটিমাত্র দৃশ্যে একটিমাত্র দেয়ালে আখরি রাস্তা-র পোস্টার সাঁটা হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করছি।

আরও পড়ুন ‘অলৌকিক মেগা সিরিয়াল দেখা সমাজের সত্যজিতের ছবি দেখার কোন কারণ নেই, তিনি উপলক্ষ মাত্র’

ট্রিবিউটাভ্যাস চরমে উঠেছে ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে। কদিন পরে কলকাতা মেট্রোর উত্তমকুমার স্টেশনের আশপাশে হাঁটতে গেলে নির্ঘাত কোনো ব্যোমকেশ বা ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে। দেখা যাচ্ছে তাতেও যথেষ্ট ট্রিবিউট হয়নি। তাই সৃজিতবাবুর সিরিজে পুলক ঘোষাল জটায়ুর নারীচরিত্রহীন উপন্যাসের চিত্রনাট্যে নায়িকা আমদানি করার যুক্তি হিসাবে খাড়া করছেন শরদিন্দুর সত্যান্বেষীর বিবাহিত জীবনকে। আবার রহস্যোদ্ঘাটনের দৃশ্যে স্বয়ং ফেলুদা বলছেন চিত্রচোর গল্পের সঙ্গে নাকি বিরূপাক্ষ হত্যার ঘটনার মিল আছে। মিলটি যে কী তা আমার খাটো বুদ্ধিতে ধরা পড়ল না। শরদিন্দুর গল্পের অপরাধী তার পুরনো চেহারাটা গায়েব করার জন্য ছবি চুরি করেছিল। এ গল্পের অপরাধী তো বুঝতেই পারেনি তার একখানা পুরনো চেহারার ছবি রয়েছে নয়নপুর ভিলায়। অবশ্য আমাদের মত দর্শকের বুদ্ধির দৌড় কতটুকু তা নির্দেশক ভালই জানেন। তাই ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যগুলি বার তিনেক করে না দেখিয়ে ক্ষান্ত দেননি। বিরূপাক্ষবাবুর বুকে ছুরি মারার শটটি যে কতবার কতভাবে দেখিয়েছেন তা গুনতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।

নস্ট্যালজিয়া ছাড়া আর যে জিনিসটি এখন সেলিং লাইক হট কচুরিজ, সেটি হল গোয়েন্দা গল্প। এই দুয়ের চাপে এই সিরিজের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছেন। তাঁর নাম অনির্বাণ চক্রবর্তী। সবে গত মাসে মুক্তি পেয়েছে আরেক গোয়েন্দার কীর্তিকলাপ নিয়ে ছবি দ্য একেন। সেই ছবিতে অনির্বাণ নিজেই গোয়েন্দা। এমন একজন গোয়েন্দা যিনি বিলক্ষণ ভাঁড়ামি করেন। বাংলা প্রবাদ বলতে ভুল করেন, হাস্যকর হিন্দি বলেন। দুটি ছবিরই প্রেক্ষাপট দার্জিলিং, লোকেশনেও মিল। অনেক ফ্রেমে মনে হয় একই ছবি দেখছি। কে জানে, হয়ত শুটিংও কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। এই ডামাডোলে অনির্বাণ একেনবাবুই থেকে গেছেন, লালমোহনবাবু হয়ে উঠতে পারেননি। জটায়ু যে ভাঁড় নন তা অভিনেতা বা নির্দেশক কেউই বুঝে উঠতে পারেননি মনে হয়। বিশেষ করে অঘোরচাঁদ বাটলিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করার সময়ে অনির্বাণ যা করেছেন তা সিনেমা কেন, যাত্রার মঞ্চেও বিসদৃশ লাগে। অবশ্য বিরূপাক্ষ মজুমদারের চরিত্রে বরুণ চন্দ, মহাদেব ভার্মার চরিত্রে সুব্রত দত্ত ইন্সপেক্টর যতীশ সাহার চরিত্রে লোকনাথ দে আর সুচন্দ্রার চরিত্রে মুনমুন রায় ছাড়া এই সিরিজে প্রায় সকলেই বাড়াবাড়ি করেছেন।

ফেলুদার চরিত্রে টোটাকে দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিড়িয়াখানায় চিতাবাঘকে প্রায় কামড়াতে যাওয়া ফেলুদাকে তো মানায় না বটেই, কোনো শিক্ষিত মানুষকেই মানায় না। সোনার কেল্লায় মুকুল ভবানন্দকে দুষ্টু লোক বলে চিনতে পেরেছিল তখন, যখন সে ময়ূরের দিকে গুলি চালায়। জীবজগতের প্রতি এই সংবেদনশীলতা গোটা রায় পরিবারের অভিজ্ঞান। লীলা মজুমদারের ‘কুঁকড়ো’ গল্পেও যার প্রমাণ রয়েছে। ফেলুদাকে হি-ম্যান বানাতে গিয়ে সেই সংবেদনশীলতার জায়গায় আলিপুর চিড়িয়াখানায় যারা বাঘের খাঁচায় ঢুকে তাকে মালা পরাতে গিয়েছিল, তাদের মানসিকতা এনে ফেলা হয়েছে। সন্দীপ রায়ের ফেলুদাও অনেকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন না, কিন্তু নিদেনপক্ষে তাঁর ফেলুদা সলমন খান বা টাইগার শ্রফ মার্কা মোটা দাগের অ্যাকশন হিরো হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন না। সৃজিতের ফেলুদা যদি পেশিবহুল চেহারার, বাঘ সিংহের সাথে লড়াই করা পুরোদস্তুর একটি নতুন চরিত্র হয়ে উঠতেন, তাহলেও কথা ছিল। ভাবা যেত বিবিসির শার্লক সিরিজের মত নতুন কিছু হল। কিন্তু এক পা নস্ট্যালজিয়ার সেপিয়া নৌকায় রেখে অন্য পা হাস্যকর মাচোইজমে রাখা এই টলমলে ট্রিবিউট আপন মনে গাওয়ার মত শীর্ষ সঙ্গীতটি ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র জগৎকে কী দিল?

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

%d bloggers like this: