ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল: পুরনো কাহিনি, নতুন দিগন্ত

ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ভুজঙ্গের ভেদ এতটাই কম যে অজিত তার মধ্যে অপরাধীসুলভ ধূর্ততা আছে বলে সন্দেহ করায় ব্যোমকেশ বলে ফেলে “পরিচয় না থাকলে বোধহয় আমাকেও সেরকমই ভাবতে।”

“পৃথিবী বদলে গেছে/তাতে কি নতুন লাগে?/তুমি আমি একই আছি/দুজনে যা ছিলাম আগে”। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দর্শক আর গোয়েন্দা গল্প নিয়ে ছবি বা ওয়েব সিরিজের সম্পর্কটা অনেকটা উত্তমকুমার অভিনীত আনন্দ আশ্রম ছবির এই গানটার মত। দুনিয়া জুড়ে এই ধরনের ছবিতে (এবং সাহিত্যে) আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। অথচ এখানে আজও ধুতি পাঞ্জাবি পরা কলঙ্কহীন ব্যোমকেশ, নিখুঁত দক্ষিণ কলকাতার ভদ্রলোক ফেলুদা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মহাজনদের পথে গমন করেই এখানে ওখানে একটু-আধটু রং বদলে সোনাদা, মিতিন মাসি, একেনবাবুরা চালিয়ে যাচ্ছেন। দর্শককুলের কারোর যে একেবারেই ক্লান্তি আসে না তা নয়, কিন্তু বহুবার দেখা জিনিসই ফের দেখে ‘আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না’ বলার লোকও নেহাত কম পড়ে না। ফলে প্রযোজক, পরিচালকরাও চালিয়ে যাচ্ছেন একই মাল প্যাকেট বদলে। হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ব্যোমকেশ সিরিজও প্রথম সাতটা সিজনে এই ছকের বাইরে বেরোতে পারেনি। নতুনত্ব হিসাবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেক্সটে যা যা আমদানি করা হয়েছে, তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রস ঘনীভূত হওয়ার বদলে পিরিয়ড পিসের দফারফা হয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে – period in pieces। সেই কারণে অষ্টম সিজন নিয়ে প্রত্যাশার পারদ খুব উঁচুতে রাখিনি। আগ্রহ ছিল শুধু দুটো কারণে – ১) এই নিয়ে চতুর্থবার চিড়িয়াখানা উপন্যাসটাকে পর্দায় নিয়ে আসা হচ্ছে। গল্পটা যারপরনাই রহস্যময় এবং গল্পে নানা পরত আছে। তা সত্ত্বেও, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের হাতেও তেমন উৎকৃষ্ট ছবি হয়ে উঠতে পারেনি। এবার কী হবে? ২) মন্দার ওয়েব সিরিজের নির্দেশক অনির্বাণ ভট্টাচার্য এই সিজনে কেবল ব্যোমকেশের ভূমিকায় ক্যামেরার সামনে নেই, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসাবে ক্যামেরার পিছনেও তাঁর বড় ভূমিকা থাকছে। পারবেন কি নতুন কিছু দেখাতে?

নূতনের কেতন দিব্যি উড়েছে, তাতে কালবোশেখীর ঝড় উঠল কিনা দর্শককুলের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাবে। কিন্তু যাবতীয় একঘেয়েমি এবং স্টিরিওটাইপকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবল চেষ্টা যে করা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

শরদিন্দুর গল্পের নাম চিড়িয়াখানা, সত্যজিতের ছবির নামও চিড়িয়াখানা, অঞ্জন দত্তের ছবির নাম ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা। কিন্তু পরিচালক সুদীপ্ত রায় ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অনির্বাণ একই গল্প অবলম্বনে ছবি করলেও নামে নিয়ে এসেছেন পিঁজরাপোল শব্দটা। শরদিন্দু স্বয়ং গল্পে এই শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু শব্দটাকে স্বতন্ত্র গুরুত্ব দান করেছে এই সিরিজের অকুস্থল নির্মাণ। শরদিন্দু লিখেছেন খোলামেলা গোলাপ কলোনীর কথা, যার আয়ের উৎস ফুলের ব্যবসা। সত্যজিৎ, অঞ্জনও তেমনই দেখিয়েছিলেন। সুদীপ্ত-অনির্বাণ ঘটনাবলীকে এনে স্থাপন করেছেন এক চকমেলানো ইংরেজ আমলের বাড়িতে, যার নাম রোজি ম্যানশন। এখানকার ব্যবসা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের। রোজি মেমসাহেবের প্রতি প্রেম অক্ষয় করে রাখতে থমাস সাহেবের তৈরি এই প্রাসাদোপম বাড়ির ঘরে বারান্দায় লিফটে চার পর্বের এই সিজনের অধিকাংশ দৃশ্যের অবতারণা। ফলে সমাজের মূলধারায় মিশতে না পারা এ বাড়ির বাসিন্দারা সকলেই পিঞ্জরাবদ্ধ, হয়ত দর্শক নিজেও – এই ধারণা ক্রমশ চেপে ধরে। অবশ্য এহ বাহ্য। পরিবর্তন এই একটা নয়, সব পরিবর্তনের কথা লিখবও না। কারণ তাতে সাহেবদের ভাষায় ‘স্পয়লার’ দেওয়া হয়ে যাবে।

অজিত চরিত্রের অভিনেতা বদলেছে এই সিজনে, এসেছেন ভাস্বর চ্যাটার্জি। তিনি একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা অজিত – মিতভাষী, মিষ্টভাষী। তিনি শুধু ব্যোমকেশ নয়, সত্যবতীরও (ঋদ্ধিমা ঘোষ) ভরসাস্থল। টিনে মুড়ি ভরে রাখা, বাজার থেকে কাঁচকলা নিয়ে আসা, আটা মেখে দেওয়া – সবেতেই অজিত পারদর্শী। সাইডকিক কথাটার নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভবত লেজুড়। শার্লক হোমসের ওয়াটসন বা আর্কুল পয়রোর হেস্টিংসকে সাইডকিক বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলা ভাষায় সাইডকিকের একেবারে সমার্থক শব্দ যে পাওয়া যায় না, তার কারণ সম্ভবত বিখ্যাত বাঙালিরাও বন্ধুদের নিজের চেয়ে ছোট করে ভাবতেন না একসময়। শরদিন্দু তাই অজিতকে সাইডকিক হিসাবে আঁকেননি, সত্যজিৎও লালমোহন গাঙ্গুলিকে সাইডকিক হিসাবে নির্মাণ করেননি। আজকের পরিচালক এবং অভিনেতারা বোধহয় অন্য ধারণার মানুষ। তাই তাঁদের অজিত, লালমোহনরা ভাঁড় হয়ে ওঠেন। এই কুৎসিত প্রবণতা পরিহার করার জন্য সুদীপ্ত-অনির্বাণের প্রশংসা প্রাপ্য। ভাস্বরের মাধ্যমে তাঁরা এমন এক অজিতকে তৈরি করেছেন যে শরদিন্দুর অজিতের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। সে নেপাল গুপ্তের চ্যালেঞ্জ কবুল করে দাবা খেলতে বসে যায় এবং তাকে হারিয়েও দেয়।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে অবশ্য ব্যোমকেশ চরিত্রে। গত সাতটা সিজনের মত এই সিজনেও অভিনেতা সেই অনির্বাণই, কিন্তু এই সত্যান্বেষী একেবারে নতুন। শরদিন্দু যে লিখেছেন ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা বলতে পছন্দ করত না, তা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা গল্পগুলোর প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা, নাকি গোয়েন্দা চরিত্রের যে বহুমাত্রিকতা বিশ্বসাহিত্যে এবং সিনেমা/ওয়েব সিরিজে আজকাল দেখা যায় সেদিকে যাওয়ার নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা প্রচেষ্টা – তা বলা দুষ্কর। কিন্তু সন্দেহ নেই, শরদিন্দু সে লক্ষ্যে খুব বেশিদূর এগোননি। ‘কী হইতে কী হইয়া গেল’ কাহিনির সর্বশক্তিমান গোয়েন্দা না করে শরদিন্দু ব্যোমকেশকে আটপৌরে করেছেন ঠিকই, কিন্তু ব্যোমকেশ নিঃসন্দেহে সর্বগুণান্বিত। সে পাঁচজনের একজন নয়, একেবারে পঞ্চম। সে তার প্রতিপক্ষদের চেয়ে তীক্ষ্ণ তো বটেই, বেশি শক্তিশালী এবং বেশি সৎও বটে। এ ধরনের সত্যান্বেষী এই ২০২৩ সালে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারণ অমন মানুষ আজ দুনিয়ায় বিরল, যাত্রার বিবেকের মতই অলীক। এই ওয়েব সিরিজে অনির্বাণ যে ব্যোমকেশের ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে কিন্তু অন্য লোক।

সত্যজিতের উত্তমকুমার, বাসু চ্যাটার্জির রজিত কাপুর, অঞ্জনের আবীর চ্যাটার্জি বা যীশু সেনগুপ্ত, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুশান্ত সিং রাজপুত – সকলেই ব্যোমকেশের মূল পোশাক হিসাবে ধুতি পাঞ্জাবিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনির্বাণকেও এর আগের সিজনগুলোতে মূলত সেই পোশাকেই দেখা গেছে। এখানে অজিত ধুতি পাঞ্জাবিতে থাকলেও ব্যোমকেশ বাড়িতে পাঞ্জাবি পাজামায়, বাইরে আগাগোড়া শার্ট প্যান্টে। এই বহিরঙ্গের আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের মত এই ব্যোমকেশ নিশানাথ সেন ৫০ টাকার জায়গায় ভুল করে ৬০ টাকা দিয়ে গেছেন দেখে ফেরত দেওয়ার কথা চিন্তাও করে না। দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে অজিতকে বলে, ভেবে নেওয়া যাক পরিশ্রমের দাম হিসাব করতে জজসাহেব ভুল করেছেন। উপরন্তু আগাগোড়া ব্যোমকেশ একজন পেটরোগা লোক। বারবার শৌচালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন তার তদন্তেও ব্যাঘাত ঘটায়। বরং অজিত শক্তপোক্ত। পানুগোপালের মৃত্যুর খবরে দেখা যায় রেগে গেলে ব্যোমকেশের মাথার ঠিক থাকে না। জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে দেয়, চিৎকার করে, অজিতকে ওই মৃত্যুর জন্য দায়ী করে। এই নিজের উপর শারীরিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণহীন গোয়েন্দা (আচ্ছা, সত্যান্বেষীই হল) বাংলা ছবি, সিনেমায় প্রায় অপরিচিত। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি শবর সিরিজের শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে তবু কিছুটা মানবিক দোষ, মানসিক অসুখ – এসব দেখা যায়। কিন্তু সে পেশায় পুলিস অফিসার। পদমর্যাদা তার রক্ষাকবচের কাজ করে, এই ব্যোমকেশের তেমন কোনো রক্ষাকবচ নেই। উল্টে রহস্যের শেষ জটটা ছাড়াতে তাকে হাফপ্যান্ট পরা হাবিলদারের ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়।

অভিনয়ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এই নতুন ব্যোমকেশকে জীবন্ত করে তুলেছেন অনির্বাণ। প্রতীক দত্তের চিত্রনাট্য এবং সংলাপের গুণে আরও যা হয়েছে তা হল স্বাধীনতার সামান্য পরের যুগের এমন এক চিন্তাশীল যুবকের নির্মাণ, যার চিন্তাভাবনা এই ২০২৩ সালেও অনুরণন তোলে। হইচইয়ের এই সিরিজে অতীতে ব্যোমকেশকে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন আওড়াতে দেখা গেছে। কিন্তু তা নেহাতই প্রক্ষিপ্ত মনে হয়েছে। একে তো যে সময়কাল তুলে ধরা হয়েছে তখন জীবনানন্দ মোটেই যুবকদের মুখে মুখে ফিরতেন না, উপরন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে লাগসই না হলে কোনো দৃশ্যে অমন শক্তিশালী কবির পংক্তি স্রেফ জ্ঞান ফলানোর প্রচেষ্টা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এই সিজনে ব্যোমকেশ জীবনানন্দ আওড়ায় না, অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে পড়ে থাকা গাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে তার প্রতিক্রিয়ায় সংবেদনশীল দর্শকের কেবল জীবনানন্দ নয়, টি এস এলিয়টও মনে পড়তে পারে। তবে এমন ব্যোমকেশ নিজের ডায়রিতে ‘বনলক্ষ্মী’ না লিখে ‘বনলক্ষী’ লিখলে মর্মাহত হতে হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পূর্ব দাঙ্গা দেখে মনুষ্যত্ব সম্পর্কে আশাহীনতা ও বিষাদ এখানে কেবল ব্যোমকেশ নয়, নিশানাথেরও অভিজ্ঞান। তা অবশ্য শরদিন্দুর কলমেও এসেছিল, কিন্তু এই নিশানাথ (বাবু দত্তরায়) আরও বেশি কটু। তাঁর বয়স যত বাড়ছে তত জীবের চেয়ে জড়ের উপরেই নাকি টান বেড়ে চলেছে। এমনকি অজিতও তার গল্পে বড় বেশি নৃশংসতা এনে ফেলছে বলে সত্যবতী অভিযোগ করে। পিরিয়ড পিস মানে যে কেবল জামাকাপড়ের সাবেকিয়ানা আর সেপিয়া টোনের ছবি নয়, ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এখানে চরিত্রগুলো, দৃশ্যাবলী এবং শব্দ – সব মিলেই সময়কে ধারণ করেছে। রেডিওতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ পর্যন্ত এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর নিয়ে। এসেছেন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। এ জন্যে সঙ্গীত ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত শুভদীপ গুহ প্রশংসার্হ। আবহে স্রেফ লাইন দুয়েক রবীন্দ্রনাথের গান দৃশ্যকে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে, হিন্দি ছবির গান বাজানো বাংলা মেগাসিরিয়ালের যুগে দাঁড়িয়ে এই ওয়েব সিরিজ তাও দেখিয়ে দিল। সেতারের কথা আর না-ই বা বললাম।

শরদিন্দুর ডায়রি অনুযায়ী, চিড়িয়াখানা লেখা শেষ হয় ২০ জুলাই ১৯৫৩। এই সিজন শেষ হয়েছে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে (তথ্যটা বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকার বাহুল্য না দেখালেই ভাল হত) ব্যোমকেশ, অজিত ও সত্যবতীর ভোটদান করে বেরিয়ে আসার দৃশ্য দিয়ে। যে নিশানাথ জাঁক করে বলেছিলেন “I deserve democracy, they don’t”, অর্থাৎ পিঁজরাপোলের অন্যরা গণতন্ত্রের যোগ্য নয়, সেই নিশানাথের ভোট দেওয়া হয়নি। ব্যোমকেশ তাঁর কথাকে ব্যঙ্গ করে স্ত্রী এবং বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, ও কথার মানে কী? গণতন্ত্র সকলের জন্য না হলে যে কারোর জন্যই টেকে না, তা তিনি জীবন দিয়ে বুঝেছেন, এখন আমরা বুঝছি। নিশানাথকে শরদিন্দুর অজিত ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেনি, দময়ন্তীকেও নয়। তার মতে “… এ জগতে কর্মফলের হাত এড়ানো যায় না, বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না। নিশানাথ কঠিন মূল্য দিয়াছেন, দময়ন্তীও লজ্জা ভয় ও শোকের মাশুল দিয়া জীবনের ঋণ পরিশোধ করিতেছেন।” শরদিন্দুর এই সামাজিক রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করে গেছেন চিত্রনাট্যকার প্রতীক। এখানে ব্যোমকেশ নিশানাথের প্রতি সহানুভূতিহীন কারণ তিনি বিচারক হয়ে, অন্যের অসহায়তার সুযোগ নিয়েও নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু ভাবতেন, অগণতান্ত্রিক ছিলেন। কিন্তু দময়ন্তীকে সমান দোষী ভাবা হয়নি, লাল সিংয়ের মৃত্যু সংবাদ জানার পর তাকে (মৈত্রী ব্যানার্জি) বৈধব্য পালন করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ তার অন্তরের পবিত্রতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। এতসব করা গেছে অতিনাটকীয় সংলাপ বা কান্নাকাটি ছাড়াই, স্রেফ কয়েকটা শটে। চিত্রনাট্যকারের এ প্রশংসনীয় সাফল্য।

আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

তবে চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক আর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের সবচেয়ে বড় সাফল্য বোধহয় শরদিন্দুর থেকে এতখানি সরে এসেও তাঁর সমস্ত ব্যোমকেশ কাহিনিতে উপস্থিত সেই উপাদানকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা – যা এই চিড়িয়াখানা গল্পে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও এর আগেকার চলচ্চিত্রকাররা হয় ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, অথবা সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে গেছেন। উপাদানটা হল যৌনতা। ব্যোমকেশের প্রায় সব গল্পেই আদিম রিপু কোনো না কোনো ভূমিকায় থাকে। প্রচ্ছন্ন অথচ তীব্র – এই হল শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনির যৌনতার বিশেষত্ব। এখানে পানুগোপাল চরিত্রে বুদ্ধদেব দাস, নজর বিবির চরিত্রে দীপান্বিতা সরকার, সর্বোপরি বনলক্ষ্মীর চরিত্রে অনুষ্কা চক্রবর্তী সে জিনিস জীবন্ত করে তুলেছেন। প্রথম দুজন তো প্রায় বিনা সংলাপে। তিনজনকেই যোগ্য সঙ্গত করেছে অয়ন শীলের ক্যামেরা। এমনকি সত্যবতীর চরিত্রে ক্রমশ উন্নতি করতে থাকা ঋদ্ধিমাও নীরবে যৌন ব্যাকুলতা ফুটিয়ে তোলেন আলো নেভানোর মন্থরতায়, পাশের খালি বালিশে হাত রাখায়। অকৃতদার অজিতের স্বপ্নে বনলক্ষ্মীর মুখ বদলে সত্যবতী হয়ে যাওয়াও অতুলনীয়।

তবে এতকিছুর সবই মাটি হতে পারত ভুজঙ্গ ডাক্তারের চরিত্রে দুর্বার শর্মা অমন দুর্দান্ত অভিনয় করতে না পারলে। ব্যোমকেশের প্রতিস্পর্ধী খলনায়ক রচনা করতে শরদিন্দু ভালবাসতেন। ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের অনুকূল ডাক্তার থেকেই ম্যাড়মেড়ে খলনায়ক তাঁর অপছন্দ, ব্যোমকেশকে তার স্রষ্টা বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী জয় করতে দেননি। এখানেও শেষ সকালের আগে পর্যন্ত ভুজঙ্গ ব্যোমকেশের চেয়ে বেশি তৎপর, বেশি স্থিতধী, বেশি আত্মবিশ্বাসী। দুর্বার প্রত্যেকটা সংলাপ বলেন ভেবেচিন্তে, একটা তিরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আবার ডাক্তারি করার সময়ে তাঁর মধ্যে সংবেদনশীলতার কোনো অভাব দেখা যায় না। ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ভুজঙ্গের ভেদ এতটাই কম যে অজিত তার মধ্যে অপরাধীসুলভ ধূর্ততা আছে বলে সন্দেহ করায় ব্যোমকেশ বলে ফেলে “পরিচয় না থাকলে বোধহয় আমাকেও সেরকমই ভাবতে।” দুর্বার যে দৃশ্যে ব্যোমকেশকে তার পেশা নিয়ে দুকথা শোনান, সেখানে তাঁর অভিনয় তলোয়ারের মত ঝলসে ওঠে। এই না হলে খলনায়ক! তাই বোধহয় শেষমেশ ব্যোমকেশেরও ভুজঙ্গকে একটা সুযোগ দিতে ইচ্ছা হয়। গল্পের ব্যোমকেশ কিন্তু ইচ্ছা করে সুযোগ দেয়নি। সে টেরই পায়নি ভুজঙ্গর মতলব।

এখানে ব্যোমকেশ সুযোগ তো দিল, তারপর কী হল? সেটা দেখে নেবেন। আমার দেখার আগ্রহ রইল, রহস্য গল্প নিয়ে তৈরি ছবি দেখার অভ্যাস বদলে দেওয়ার এত চেষ্টা সফল হয় কিনা।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত