অ্যাঙ্কর বয়কট আবশ্যিক কিন্তু পর্যাপ্ত নয়

বিজেপিবিরোধী সাংবাদিকরা বহুকাল ধরেই বিরাট মূল্য দিচ্ছেন, বিজেপির ধ্বজাধারীরাই বা দেবেন না কেন? যুক্তি দিয়ে বিচার করলে তো এই ১৪ জনকে সাংবাদিক বলে ধরাই যায় না।

আমাদের দেশের অলিখিত প্রাচীন নিয়ম – দূত অবধ্য। সাহেবরাও একই মেজাজে বলে থাকে – দূতকে গুলি করবেন না (Don’t shoot the messenger)। দুটো কথার পিছনে যুক্তিটা একই – দূত কোনো পক্ষের লোক নয়, অতএব তাকে প্রতিপক্ষ হিসাবে আক্রমণ করা অন্যায়। সে এক পক্ষের কাছে অন্য পক্ষের বার্তাবাহকমাত্র। ফলে সে নিরস্ত্রও বটে। কিন্তু ধরুন, একজন দূত প্রতিপক্ষের শিবিরে বার্তা দিতে ঢুকল ছত্রপতি শিবাজীর মত বাঘনখ পরে। বার্তা দেওয়ার নাম করে শিবিরে ঢুকে যিনি বার্তা নেবেন তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে চলে গেল। এরপর কি তার আর দূত হিসাবে ছাড় প্রাপ্য? একেবারেই নয়। সে যে ক্ষতি করল তা কিন্তু স্রেফ একজনকে খুন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার এই আচরণের ফলে অন্য দূতেরাও বিপদে পড়বে, কারণ তাদের আর কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। ফলে দূতীয়ালি ব্যাপারটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১৪ সালের পর থেকে (আসলে তার কিছু আগে থেকেই) ভারতের সাংবাদিকতা যেদিকে মোড় নিয়েছে তাকে এইভাবে দেখাই শ্রেয়। বেশিরভাগ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা হয়ে গেছে বাঘনখ পরা দূতের মত। ইদানীং অবশ্য দূত সেজে থাকার নাটকটুকুও ত্যাগ করেছে অনেক সংবাদমাধ্যমই, অথচ দূত হওয়ার সুবিধাগুলো নিয়েই চলেছে। এমতাবস্থায় ইন্ডিয়া জোট ১৪ জন অ্যাঙ্করের তালিকা প্রকাশ করেছে, যাদের শোতে এই দলগুলোর প্রতিনিধিরা যাবেন না। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের স্থান যতই নেমে যাক, যত সাংবাদিকই গ্রেফতার হয়ে যান না কেন, এই অ্যাঙ্কররা কিন্তু দিনরাত দর্শকদের বলে থাকে ভারতের সব ক্ষেত্রেই দারুণ অগ্রগতি হচ্ছে। এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকারের দিক থেকেও। সেই অ্যাঙ্কররাই এই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর একে গণতন্ত্রের উপর আঘাত, বাকস্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি আখ্যা দিচ্ছে। এরা অবশ্য রবীশ কুমার কথিত গোদি মিডিয়ার লোক। কিন্তু যাঁদের কেউ গোদি মিডিয়ার লোক মনে করে না, তেমন কয়েকজনও এই বয়কটের বিরোধিতা করেছেন। যেমন করণ থাপার, রাজদীপ সরদেশাই, সাগরিকা ঘোষ। সুতরাং ব্যাপারটাকে নানা দিক থেকে দেখা প্রয়োজন।

প্রথমেই নিরপেক্ষতার ধারণাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আসলে কেউ নিরপেক্ষ নয়। সাংবাদিক দূরে থাক, ক্রিকেট খেলার আম্পায়ার পর্যন্ত নিরপেক্ষ নন। বোল্ড আর দিনের আলোর মত পরিষ্কার ক্যাচ আউট ছাড়া আর সব আউটের ক্ষেত্রেই ফিল্ডিং দল আম্পায়ারের কাছে আবেদন করে। তিনি আইন মেনে নিজের বিবেচনা মত আউট দেন, প্রয়োজনে অন্য আম্পায়ারের পরামর্শ নেন, কখনো বা প্রযুক্তির সাহায্য নেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত এক দলের পক্ষে যায়, অন্য দলের বিপক্ষে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তাঁকে একটা পক্ষ বাছতেই হয়। বিশেষ করে লেগ বিফোর উইকেটের মত আউটের ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে আম্পায়ারের ব্যক্তিগত মত। আগে এই মতের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল, এখন বিপুল পরিমাণ প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেকখানি কমেছে। তবু দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিও শেষ কথা বলতে পারছে না। তখন টিভি আম্পায়ারের বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে ছাড়ে না, অনেকসময় পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার অভিযোগও ওঠে। ক্রিকেট খেলার দৃষ্টান্ত এই কারণেই দেওয়া, যে জীবনের মত ক্রিকেট খেলাতেও বহু জিনিস মানবিক বিবেচনার উপরেই শেষপর্যন্ত নির্ভরশীল। যেমন বৃষ্টি হওয়ার পরে মাঠ খেলার উপযুক্ত হয়েছে কিনা সেই সিদ্ধান্ত অন্তত এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র দুই আম্পায়ারের বিবেচনার ভিত্তিতেই ঠিক হয়। যেখানেই এই অবকাশ আছে সেখানেই নিরপেক্ষতা বজায় থাকল কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে। এ তো গেল খেলার বিচারকদের কথা। একই কথা আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একই আইনে একই মামলার বিচারে বিচারক বদলালে রায়ও বদলে যায় অনেক সময়। এমনটাই যে স্বাভাবিকতা আইনও তা বিশ্বাস করে। সেই কারণেই নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন জানানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিচারকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হয়, কিন্তু রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইনসম্মত। বিচারকের রায়ের যে ভালমন্দ আছে তাও সর্বজনস্বীকৃত। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “…দণ্ডিতের সাথে/দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে/সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।” এই বিচারে বিচারকের ব্যক্তিগত আদর্শ, মতামত – সবই প্রভাব ফেলে। ফেলতে বাধ্য। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে নিরপেক্ষতা সোনার পাথরবাটি।

এ তো গেল বিচারকদের কথা। সাংবাদিকরা বিচারক নন, হওয়া অন্যায়ও বটে। খোদ সুপ্রিম কোর্ট সংবাদমাধ্যমের বিচারক হয়ে বসা নিয়ে অসন্তুষ্ট। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের বেঞ্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছে, পুলিস ব্রিফিং যেন মিডিয়া ট্রায়ালের সুযোগ না করে দেয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের বরং দূত হওয়ারই কথা। কার দূত? এই প্রশ্নের উত্তরটাই সম্পূর্ণ উলটে দেওয়া হয়েছে আজকের ভারতে।

ইন্ডিয়া জোটের তালিকায় যে ১৪ জন অ্যাঙ্করের নাম রয়েছে তাদের একজন রুবিকা লিয়াকত। তাকে পাশে দাঁড় করিয়ে ‘হিন্দি নিউজ’ চ্যানেলের সিইও জগদীশ চন্দ্র প্রকাশ্যে বলেছে, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেই। কিন্তু আমরা দেশের জনপ্রিয় সরকারের পক্ষে আছি। কেন থাকব না? আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি গ্লোবাল লিডার হয়ে থাকেন, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা বলে গণ্য হয়ে থাকেন, যদি অমিত শাহ ৩৭০ তুলে দিয়ে কাশ্মীরের পরিবেশ বদলে দিয়ে থাকেন… তাহলে তাঁকে অগ্রাহ্য করব কী করে? তাঁকে তাঁর জনপ্রিয়তা অনুযায়ী গুরুত্ব দিতেই হবে। দেশের উপর রাজত্ব করলে আমাদের নেটওয়ার্কের পর্দাতেও রাজত্ব করবেন। এ নিয়ে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই। যাঁরা আমাদের গোদি মিডিয়া বলেন আমি তাঁদের খুব বিনীতভাবে বলছি, আমরা গোদি মিডিয়া নই। কিন্তু যা বাস্তব তাকে কী করে অস্বীকার করি? এই তো ২০২৪ নির্বাচন এসে গেল। কাল আপনারা সরকারে আসুন; প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে যান। কথা দিচ্ছি যতখানি কভারেজ আর লাইভ টেলিকাস্ট মোদী আর অমিত শাহের করেছি ততটাই আপনাদেরও করব।

অন্য এক অ্যাঙ্কর ‘আজ তক’ চ্যানেলের চিত্রা ত্রিপাঠী। সে এক টক শোতে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে ইদানীং সোশাল মিডিয়ার সূত্রে বিপুল জনপ্রিয় ব্যঙ্গাত্মক গানের শিল্পী নেহা সিং রাঠোরকে ডেকে কেন তিনি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীদের ব্যঙ্গ করে গান করেন তা জিজ্ঞেস করেছিল। নেহা পালটা পক্ষপাতের প্রশ্ন তোলায় চিত্রা বলে, আপনি যাঁদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা কিন্তু ৫-৭ লাখ ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন। জনগণ ভোট দিয়েছে, নিজের পকেট থেকে তো আর ভোট বার করেননি।

দুজনেরই বক্তব্য আসলে এক। যে জিতেছে তার পক্ষে আছি, তার পক্ষে থাকাই আমাদের কাজ। আসলে দুজনেই জানে, গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের হওয়ার কথা দর্শকের, অর্থাৎ নাগরিকদের, দূত। সেই ভানটা বজায় রাখার জন্যেই একজন যোগী আদিত্যনাথ আর শিবরাজ সিং চৌহান কত বড় ব্যবধানে জিতে এসেছেন তা উল্লেখ করেছে। অন্যজন বলেছে যারা জনপ্রিয় হবে তাদেরই কভারেজ দেব। এই ভানের সরটুকু আলাদা করে নিলে যা পড়ে থাকে তা হল, যে ক্ষমতায় থাকবে তার পক্ষেই থাকব। আমি তার দূত।

এই ভাবনাই ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোদি মিডিয়া বলা যায় না যাদের, সেইসব সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও প্রতিবেদকরাও অনেকে এরকমই মনে করেন। ক্ষমতার সমর্থনে দাঁড়ানো নয়, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই যে সংবাদমাধ্যমের কাজ — তা বিস্মৃত। ভারতে একসময় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস কমিউনিকেশন, এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজমের মত দু-একটা জায়গা ছাড়া কোথাও সাংবাদিকতা ও গণসংযোগ আলাদা করে পড়ানো হত না। গত কুড়ি বছরে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বছর বছর পাস করে বেরিয়ে অনেকে সাংবাদিকও হচ্ছেন। অথচ দেখা যাচ্ছে প্রথাগতভাবে লেখাপড়া না করা সাংবাদিকদের আমলেই সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা ঠিক ছিল। এর পিছনে আসলে ক্লাসরুমের দায় তত নয়, যতটা পাস করে সকলে যেখানে কাজ করতে যায় তার। ডাক্তারির মত সাংবাদিকতাও সবটা শেখা হয় না ‘প্র্যাকটিস’ না করলে। সেখানেই গলদ। ডাক্তাররা তবু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারেন। সাংবাদিকতায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস বলে কিছু এখনো সেভাবে নেই। এতকাল উপায়ও ছিল না। আগে রবীশ কুমারের মত সাংবাদিককে চাকরি ছাড়তে হলে একেবারে চুপ হয়ে যেতে হত। কারণ অন্য কোনো সংবাদমাধ্যম জায়গা না দিলে নিজের সাংবাদিকতা লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উপায় ছিল না। এখন ইউটিউব চ্যানেল, টেলিগ্রাম চ্যানেল, ফেসবুক পেজ ইত্যাদি নানা ব্যবস্থা হয়েছে। ফ্রিলান্স সাংবাদিকতা আগেও ছিল, এখনো আছে বটে। কিন্তু সেই সাংবাদিকের কাজ প্রকাশ করতে রাজি এমন সংবাদমাধ্যম তো দরকার। সরকারবিরোধী কাজ করতে উৎসাহী ফ্রিলান্স সাংবাদিকদের ভরসা কিন্তু এখন বিকল্প সংবাদমাধ্যম। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তাঁদের জায়গা ক্রমশ কমে আসছে। আর কেউ যদি মূলধারার চাকুরে সাংবাদিক হন, তাহলে তিনি সত্যিকারের সাংবাদিকতা করতে চাইলেও পারবেন না। মালিকরা জগদীশ চন্দ্রের মত সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বসে আছে। যেহেতু টিভি দেখেন অনেক বেশি মানুষ, সেহেতু ইন্ডিয়া জোট আপাতত অ্যাঙ্করদের বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এমন নয় যে খবরের কাগজের চিত্রটা একেবারে আলাদা।

এখানেই এসে পড়ে ইন্ডিয়া জোটের সিদ্ধান্তের সার্থকতার প্রশ্ন। সাংবাদিকের স্বাধীনতা আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কিন্তু এক নয়। সাংবাদিক নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারেন না। আজকের ভারতে তো আরওই পারেন না। বহু সম্পাদক, প্রতিবেদকের চাকরি গেছে বিজেপির ঢাক বাজাতে রাজি না হওয়ায়। মাত্র কয়েকদিন আগে জানা গেছে এনডিটিভির ব্যুরো চিফ সোহিত মিশ্রের পদত্যাগের খবর। তাঁকে নাকি বলা হয়েছিল গৌতম আদানির সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে রাহুল গান্ধীর সাংবাদিক সম্মেলন ভেস্তে দিতে। তিনি রাজি হননি, তাই পদত্যাগ করতে হয়।

এই পরিস্থিতিতে আস্ত চ্যানেল বয়কট না করে শুধুমাত্র কয়েকজন অ্যাঙ্করকে বয়কট করে কী লাভ, সে প্রশ্ন তোলা সঙ্গত। কিন্তু বয়কটের সিদ্ধান্তটাই ভুল — এ কথা আদৌ বলা চলে না। কারণ একাধিক, যদিও ইন্ডিয়া জোট প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কোনো কারণ নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। জোটের বিভিন্ন নেতা ব্যক্তিগতভাবে নানা কারণ দর্শিয়েছেন।

প্রথমত, এই চ্যানেলগুলোর প্রধান আকর্ষণ ওই অ্যাঙ্করদের ঘৃণা বর্ষণকারী তথাকথিত বিতর্ক সভা। সেখানে বিতর্ক হয় না, হয় অ্যাঙ্করের মদতে ভারতের সংখ্যালঘু এবং সমস্তরকম বিজেপিবিরোধী মানুষের প্রতি অবিরাম ঘৃণার চাষ। সে কাজে প্রয়োজন মত ভুয়ো খবর, নির্জলা মিথ্যাভাষণ – সবই ব্যবহার করা হয়। অ্যাঙ্করের যে বক্তব্য পছন্দ তার বিপরীতে যে মুখপাত্ররা বলতে আসেন তাঁদের প্রায় কিছুই বলতে দেওয়া হয় না। হয় ধমকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, নয়ত তাঁর মত যে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘জেহাদি’ তা চিৎকার করে বারবার বলা হয়। ফলে এই শোগুলোতে যাওয়ার যে যুক্তি রাজনৈতিক দলগুলো দেখিয়ে থাকে – নিজেদের মত জনপরিসরে জানানো – বিজেপিবিরোধীদের ক্ষেত্রে তা ভোঁতা হয়ে গেছে। এইসব শোতে যাওয়া মানে বরং বিজেপির সুবিধা করে দেওয়া। তার চেয়েও বড় কথা, ১৯৯০-এর দশকে আফ্রিকার দেশ রোয়ান্ডার গৃহযুদ্ধে রেডিও রোয়ান্ডা সংখ্যালঘু হুটুদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ঘৃণাভাষণ চালিয়ে তাদের যেভাবে অবমানবে পরিণত করেছিল টুটসিদের চোখে, ঠিক সেই কাজ এই অ্যাঙ্কররা করে চলেছে। সুতরাং এদের শোতে গিয়ে বসা মানে সেই কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া, পরোক্ষে মদত জোগানো।

দ্বিতীয়ত, এই অ্যাঙ্করদের সঙ্গে অন্য সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের তো বটেই, ওই চ্যানেলগুলোরই আর পাঁচজন সাংবাদিকেরও তফাত আছে। এরা প্রত্যেকে মহার্ঘ মাইনে পায় এবং অনেকেই কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে বসেছে। অর্ণব গোস্বামী তো ‘টাইমস নাও’ চ্যানেলে এই অসভ্যতা চালিয়ে এত জনপ্রিয় হল যে নিজস্ব চ্যানেলই খুলে ফেলল। সুতরাং এরা নেহাত ঠেকায় পড়ে একপেশে সরকারি প্রচার চালায় না, ঘৃণাভাষণ দেয় না। বরং এরাই চ্যানেলের এজেন্ডা তৈরি করে। ফলে এদের ঘৃণা ছড়াতে বাধা দেওয়া যথেষ্ট না হলেও আবশ্যিক। বহু ভাসমান ভোটার এবং বিজেপিবিরোধী ভোটারও হাঁ করে এইসব চ্যানেল দেখে থাকেন। এই বয়কট তাঁদেরও এক প্রচ্ছন্ন বার্তা দেবে যে এই অ্যাঙ্কররা যা করে তা যথার্থ নয়, কারোর জন্যে ভাল নয়। এতে ভাসমান ভোটারদের কেউ কেউ হয়ত বিজেপির দিকে ঢলে পড়বেন, কিন্তু উলটোটাও ঘটবে। ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোর সমর্থক যে ভোটাররা, তাঁদের উপর তো এই সিদ্ধান্তের স্পষ্ট প্রভাব পড়া উচিত।

তৃতীয়ত, এই বয়কট কোনোভাবেই সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের স্বাধীনতা হরণ নয়। এখানে কোনো সাংবাদিককে তার মতামতের জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে না, তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, খুন করা হচ্ছে না। এর প্রত্যেকটাই ভারতে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিজেপি আমলে (ইন্ডিয়া জোটের কোনো কোনো দলের শাসনে থাকা রাজ্যেও ঘটছে। খড়্গপুরের সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচীর কথা স্মর্তব্য), অথচ তার বিরুদ্ধে কোনোদিন টুঁ শব্দ করেনি এই অ্যাঙ্কররা। সে না হয় তাদের স্বাধীনতা। কথা হল এই বয়কট সত্ত্বেও তারা শো চালিয়ে যেতে পারে, শুধু কয়েকটা রাজনৈতিক দল সেই শোয়ে অংশগ্রহণ করবে না। আপনার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মাতাল চিৎকার করে আপনাকে, আপনার পরিবারকে অকথ্য গালিগালাজ করছে। আপনি যদি বাড়ির জানলা বন্ধ করে দেন, তাহলে মাতালরা কি বলতে পারে, বাকস্বাধীনতা হরণ করা হল? এ প্রসঙ্গে বাকস্বাধীনতার প্রশ্ন তোলা একইরকম হাস্যকর।

চতুর্থত, সরকার তথা বিজেপির বিজ্ঞাপনের লোভে এবং/অথবা সরকারি চাপে যেসব সংবাদমাধ্যম বিজেপির মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা আর সাংবাদিকতার বিশেষ ছাড়গুলো দাবি করতে পারে না। কারণ সরকারবিরোধীদের সেই ছাড় এরা নিজেরাই দেয়নি। যে কোনো দেশে সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ হল একতা। পাঠক/দর্শকদের অবাক লাগতে পারে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে বর্তমানের সাংবাদিককে প্রশাসনের কেউ কিছু বললে গণশক্তির সাংবাদিকও বর্তমানের সাংবাদিকের পাশে দাঁড়াবেন – এটাই ছিল নিয়ম। সারা পৃথিবীতেই তাই হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে অপছন্দের প্রশ্ন করার জন্যে একজন সাংবাদিককে আক্রমণ করলে অন্য সব সাংবাদিক একজোট হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াতেন। প্রায় সব পেশাতেই এটাই নিয়ম। কারণ পেশাদারি প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই তীব্র হোক, নিজেদের মধ্যে একতা না থাকলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় না। আর সাংবাদিকতা করা মানেই রাষ্ট্রের ত্রুটিবিচ্যুতির দিকে আঙুল তোলা। ভারতে এই একতা কিন্তু যত্ন করে নষ্ট করেছে গোদি মিডিয়া। অর্ণবই প্রথম টাইমস নাওয়ের স্টুডিও থেকে সরকারবিরোধী খবর করে এমন চ্যানেলের অ্যাঙ্কররা পাকিস্তানের মদতপুষ্ট, শহুরে নকশাল – এমন সব অভিযোগ করতে শুরু করে। দর্শকরা মুসলমান, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, রাহুল গান্ধী-সোনিয়া গান্ধী, কমিউনিস্ট ইত্যাদির মত ওইসব সাংবাদিকদেরও যেন ঘৃণা করে – এই কামনা অর্ণব সরাসরিই করত। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্যান্য চ্যানেলের অ্যাঙ্কররাও। এখন ঝাঁকের কই হতে চাইলে চলবে কেন?

এবার একটু নিরপেক্ষতার বিচারে ফেরত আসা যাক। গোদি মিডিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই অনেকে বলেন, অন্য মিডিয়াগুলো নিরপেক্ষ নাকি? চাকরিজীবনে সিনিয়র সহকর্মীদের সঙ্গে বিজেপির সংবাদমাধ্যমকে করতলগত করা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা এর সপক্ষে যুক্তি খাড়া করেই রেখেছেন – “এসব চিরকালই হয়”। বস্তুত পৃথিবীর সমস্ত অন্যায়ই চিরকাল হয়। রামায়ণ-মহাভারত খুললেই তা টের পাওয়া যায়, কোনো প্রবীণ সাংবাদিকের প্রজ্ঞার প্রয়োজন নেই। ইদানীং অন্যায়ের কোন দিকটা নতুন তা চিহ্নিত করতে হয় এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। নইলে ঝাড়ে বংশে বিনষ্ট হতে হয়।

গত কয়েক বছরে যা নতুন তা হল বিজেপির বিপুল আর্থিক ক্ষমতা। ইলেক্টোরাল বন্ডের সুবাদে বিজেপি যে টাকার পাহাড়ে বসে আছে তা ভারতের কোনো দল কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। এর প্রমাণ বিজেপির পার্টি অফিসের কলেবর থেকে শুরু করে তাদের নির্বাচনী প্রচারের জাঁকজমক – সবেতেই টের পাওয়া যায়। সেই টাকার ভাগ পাওয়ার জন্য, সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য, বিজেপির সঙ্গে খাতিরের সুবাদে নিজের অন্য ব্যবসাগুলোর শ্রীবৃদ্ধি করার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকরা দিনকে রাত, রাতকে দিন করছেন। অর্থাৎ সাংবাদিকতায় দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে কিছু সাংবাদিক দুর্নীতিগ্রস্ত হতেন বা বিশেষ কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হতেন। মালিকেরও বিলক্ষণ পক্ষপাত থাকত। কিন্তু অন্তত বাজারের স্বার্থে, দর্শক/পাঠক ধরে রাখতে তাঁকে কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হত। একই সংবাদমাধ্যমে নানা দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট সাংবাদিক থাকতেন। তাঁদের মধ্যে আলাপ আলোচনা, ঝগড়াঝাঁটি, লেঙ্গি মারা, হাসিঠাট্টা সবই চলত। এই দ্বন্দ্বের ফলে দর্শক/পাঠক যা পেতেন তাতে শেষমেশ এক ধরনের সাম্যবিধান হত। তিনটে চ্যানেল দেখলে হয়ত একটা ঘটনাকে তিনরকম দেখাত। কিন্তু তা থেকে দর্শক সত্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছতে পারতেন। এখনকার মত সর্বত্র একই মিথ্যা বয়ান চলত না। কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেই আগে নিউজরুমগুলোকে মনে হত মাছের বাজার, এখন মনে হয় কল সেন্টার। দারুণ নিয়মানুবর্তী, দারুণ শান্তিপূর্ণ। শ্মশানের শান্তি। এই শান্তি যে সাংবাদিক ভাঙেন তাঁর চাকরি যায় বা তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়। যেমন রবীশ ছেড়েছেন, সোভিত ছেড়েছেন।

আগেই বলেছি কেউ নিরপেক্ষ নয়। আক্ষরিক অর্থে নিরপেক্ষ হওয়া প্রার্থনীয়ও নয়। কয়েকজন মানুষ মিলে একজনকে সাংবাদিকের চোখের সামনে পিটিয়ে মারল। সাংবাদিক যদি প্রতিবেদনে বলেন ‘এরা মেরে অন্যায় করেছে, তবে লোকটাও প্ররোচনা দিয়েছিল’, তাহলে তিনি তো আসলে খুনীদের পক্ষে দাঁড়ালেন। তাঁকে বলতেই হবে খুনীরা অন্যায় করেছে, কোনো প্ররোচনা থাকুক আর না-ই থাকুক। অর্থাৎ তাঁকে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, এক্ষেত্রে যার অর্থ হবে যে খুন হয়েছে তার পক্ষে দাঁড়ানো। এলবিডব্লিউ আবেদন নাকচ করে দেওয়ার সময়ে যেমন আম্পায়ার ব্যাটারের পক্ষের লোক হয়ে যান ক্ষণিকের জন্য। সুতরাং সংবাদমাধ্যম সত্যের পক্ষে দাঁড়াক – এটুকুই ন্যায্য দাবি। সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ হোক – এ দাবি অর্থহীন। বিশেষত আজকের ভারতে সংবাদমাধ্যমকে পক্ষ নিতেই হবে এবং তার মূল্যও চোকাতে হবে। বিজেপিবিরোধী সাংবাদিকরা বহুকাল ধরেই বিরাট মূল্য দিচ্ছেন, বিজেপির ধ্বজাধারীরাই বা দেবেন না কেন? যুক্তি দিয়ে বিচার করলে তো এই ১৪ জনকে সাংবাদিক বলে ধরাই যায় না। তাদের নরেন্দ্র মোদীর গুণমুগ্ধ বলা যেতে পারে, সরকারের মুখপাত্রও বলা যেতে পারে। এগুলো তো গালাগালি নয়। এরা নিজেরা বা এদের চ্যানেলের মালিকরা নিজমুখেই তো অন্য সময় এগুলো বলে। এখন হঠাৎ রেগে যাওয়ার যুক্তি নেই। কিন্তু রেগে যাচ্ছে, এই বয়কটে জরুরি অবস্থার মানসিকতার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে বলছে

আরও পড়ুন কর্ণাটক নির্বাচনের ফল: মিডিয়া, জিভ কাটো লজ্জায়

অর্ণবভক্তরা শুধু নয়, অর্ণবের শো দেখেন না এবং পছন্দ করেন না এমন অনেকেরও ধারণা এই বয়কটে অর্ণবের কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু তেমন হলে এ নিয়ে সে এত উত্তেজিত হত না। অর্ণব এবং তার দর্শকদের যে ধর্ষকাম মানসিকতা বিপক্ষের লোকেদের ডেকে এনে ধমকে তৃপ্তিলাভ করে, এই বয়কটের ফলে তাতে অসুবিধা হবে। ধর্ষকাম মানুষ কামনা চরিতার্থ না হলে কতটা রিপাবলিক টিভি দেখবেন তা নিশ্চিত নয়। টিআরপি পড়ে যেতে পারে। তা যদি না-ও হয়, কানাঘুষো যা শোনা যাচ্ছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে ১৪ জন অ্যাঙ্করের চ্যানেলেরই সমূহ বিপদ। শোনা যাচ্ছে ইন্ডিয়া জোটের দলগুলো যেসব রাজ্যে আছে সেখানকার সরকারগুলো নাকি এই চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। আগেও লিখেছি যে এখন সকালে যে কাগজটা হাতে পান সেটা আসলে আপনার কথা ভেবে তৈরি নয়, ওটা বিজ্ঞাপনদাতার রসিদ। কারণ কাগজ ছাপার খরচটুকুও আপনার দেওয়া কাগজের দামে ওঠে না। তেমনই টিভি চ্যানেলও চলে বিজ্ঞাপনদাতার টাকায়। সেখানে অতগুলো রাজ্যের সরকারি বিজ্ঞাপন আসা বন্ধ হয়ে গেলে টানাটানির সংসার হয়ে যাবে। অতএব অর্ণবের উত্তেজনার মধ্যে চাপা ভয়ও লুকিয়ে আছে।

তবে ইন্ডিয়া জোটের এই ব্যবস্থা সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

১) এই কজন অ্যাঙ্করের বাইরে কি আর কেউ নেই যে একই দোষে দুষ্ট?
২) হিন্দি বাদে অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার চ্যানেল এবং তাদের অতি উদ্ধত, অপছন্দের মুখপাত্রকে “কে তুমি” বলে ধমকানো, অ্যাঙ্করদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই?
৩) ভোটের আর ৭-৮ মাস বাকি। এখন এই ব্যবস্থায় কতটা আটকানো যাবে গণমাধ্যমে ঘৃণাভাষণ আর মিথ্যার বেসাতি?
৪) এই অ্যাঙ্করদের বাদ দিয়ে বিকল্প সংবাদমাধ্যমগুলোকে বেশি কভারেজের সুযোগ দেবে কি ইন্ডিয়া জোট? যেমন ধরা যাক, রবীশ কুমারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাহুল গান্ধী।

বিকল্প পথের সন্ধান করতে না পারলে কিন্তু এই সদুদ্দেশ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত সফল হবে না। দেশের সংবাদমাধ্যমের ভোল পালটানোর কাজ শুরু হবে না।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

ব্যাকফুটে গোদি মিডিয়া

পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না।

প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা আর বুথফেরত সমীক্ষার দৌলতে লোকনীতি-সিএসডিএস নামটা এখন ওয়াকিবহাল পাঠকদের কারোর অজানা নয়। কিন্তু এই সংস্থাটি আরও কিছু সমীক্ষা করে থাকে যেগুলো নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে শুধু যে হইচই হয় না তা নয়, আদৌ কোনো খবরই প্রকাশ করা হয় না। কারণ করলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে। তেমনই এক সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত সপ্তাহে। এই সমীক্ষার মজা হল, এখানে উত্তরদাতা সাংবাদিকরাই। যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের সমীক্ষাটির ফল দেখে আতঙ্কিত হওয়ার মত নানা বিষয় আছে, তবে এই লেখার পক্ষে যা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য তা হল, ৮২% সাংবাদিক বলেছেন তাঁরা মনে করেন তাঁদের নিয়োগকর্তা বিজেপিকে সমর্থন করেন।

এমনিতে স্বাধীন, সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যে কোনো ব্যক্তিরই যে কোনো দলকে সমর্থন করার অধিকার আছে। উপরন্তু উদারনৈতিক গণতন্ত্রের গালভরা বাণীগুলোর গলদ বুঝে ফেলা যে কোনো মানুষই জানেন কোনো দেশেই কোনো সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে পারে না। বস্তুত, হওয়া উচিতও নয়। কারণ রাজনীতিহীন সাংবাদিকতা হল অর্থহীন তথ্যের সমাহার। ও জিনিস হোমেও লাগে না, যজ্ঞেও লাগে না। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া স্কুপ নামক ওয়েব সিরিজে একজন আদর্শবাদী সম্পাদকের একটি সংলাপ আছে। তিনি চাকরি ছাড়ার আগে মালিককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যখন কেউ বলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর অন্য একজন বলে হচ্ছে না, তখন সাংবাদিকের কাজ দুজনকেই উদ্ধৃত করা নয়। জানলা খুলে দেখা কোনটা ঠিক এবং সেটাই লেখা। সাংবাদিকের কাজ কোনটা তা ঠিক করা কিন্তু শতকরা একশো ভাগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সুতরাং সাংবাদিকের এবং সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক প্রবণতা থাকতে বাধ্য। সেই প্রবণতা কোনদিকে থাকবে তা অনেককিছুর ভিত্তিতে ঠিক হয়, যার একটা অবশ্যই মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ। ফলে কোনো তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমই যে কোনোদিন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল না একথা বলাই বাহুল্য। যেমন কেউ বলে না দিলেও পশ্চিমবঙ্গে নেহাত বালক-বালিকারাও চিরকাল জানত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ওই সংস্থারই ইংরিজি কাগজ দ্য টেলিগ্রাফ কংগ্রেসপন্থী; বর্তমান, দ্য স্টেটসম্যান বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধী; আবার আজকাল বাম ঘেঁষা। তাহলে লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষার ফল আলাদা করে আলোচনা করার মত কেন? কারণ ভারতের মত এত বড় একটা দেশ, যেখানে এতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেখানে চালানো সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক মনে করছেন তাঁদের সংস্থা একটা দলকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ বিভিন্ন নাগরিক বিভিন্ন দলকে সমর্থন করার মত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন দলের দিকে ঢলে থাকলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ভারসাম্য বজায় থাকে তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এই সমীক্ষা থেকে।

২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন খবরের চ্যানেল দেখার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা সমীক্ষার এই ফলাফলে অবিশ্বাস করবেন না। কেউ কেউ বলবেন বেশ হয়েছে, এমনটাই হওয়া উচিত কারণ বিজেপিই একমাত্র জাতীয়তাবাদী পার্টি। আর বিজেপিবিরোধী শঙ্কিত হবেন। এই যা তফাত। কিন্তু কে নিজের রাজনৈতিক পছন্দ অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের এই একপেশে হয়ে যাওয়াকে কীভাবে দেখবেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের সংবাদমাধ্যমের এতখানি একচোখামির ফল কী হচ্ছে? অর্ণব গোস্বামী, রাহুল শিবশঙ্কর, রাহুল কাঁওয়াল, শিব অরুর, সুধীর চৌধুরী, রুবিকা লিয়াকত, দীপক চৌরাসিয়া, অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, সুরেশ চওনঙ্কে বা অমন চোপড়ারা যে পরিমাণ ঘৃণা ছড়িয়েছেন গত এক দশকে – তার ফল আর শুধু উত্তেজনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা ছড়ানোয় সীমাবদ্ধ নেই। ও কাজ তো হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকও করে। ধর্মান্ধ টিভি অ্যাঙ্করদের অবদানে উঠে এসেছে চেতন সিংয়ের মত ভয়ঙ্কর অপরাধী, যে সরকারি উর্দি পরে সরকারি বন্দুক দিয়ে ট্রেনের কামরায় প্রথমে নিজের ঊর্ধ্বতন অফিসারকে খুন করে। তারপর এক কামরা থেকে আরেক কামরায় গিয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী যাত্রী খুঁজে বার করে খুন করে। অবশেষে সেখানে দাঁড়িয়ে বাকি যাত্রীদের হুমকি দেয়, ভারতের দুজনই আছে – মোদীজি আর যোগীজি। এখানে থাকতে হলে এদেরই ভোট দিতে হবে।

এতদ্বারা ২০২৪ লোকসভার নির্বাচনের জন্য বিজেপির প্রচার শুরু হয়ে গেল কি? রবীশ কুমার যাদের গোদি মিডিয়া বলেন, তারা যখন অমিত শাহকে বিধায়ক কেনাবেচা করার গুণে ‘মডার্ন চাণক্য’ আখ্যা দিতে পারে তখন এই প্রণালীকেও ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলে যে বিজেপির ‘অ্যাগ্রেসিভ ক্যাম্পেনিং’ নাম দেবে না তার নিশ্চয়তা কী? আপাতত খাঁটি আমেরিকান কায়দায় চেতন সিংকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা চলছে। যদিও রেলমন্ত্রীকে কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করবে না, একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে বন্দুক হাতে ট্রেনযাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছি কেন? কারণ বিজেপি সরকারকে প্রশ্ন করা বারণ, করলে চাকরি যায়। লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষা যে সঠিক, এই তার হাতে গরম প্রমাণ।

নিজের বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আশপাশের লোকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাওয়া যায় মূলধারার মিডিয়ার ছড়ানো ভুয়ো খবর এবং একচোখা খবর ইতিমধ্যেই কতখানি ক্ষতি করে ফেলেছে। দিন দুয়েক আগে একজন প্রাইভেট গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেদিন কাগজে বেরিয়েছে বিজেপি মণিপুরের এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই এনআরসি করার কথা ঘোষণা করেছে। চালকের পাশে বসে কাগজ পড়তে গিয়ে সক্ষোভে আমার স্ত্রীকে বলতেই চালক বলে উঠলেন “ঠিক হয়েছে। এনআরসি তো করাই উচিত।” কেন করা উচিত জিজ্ঞাসা করায় তাঁর উত্তর “বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানগুলো এসেই তো মণিপুরে অশান্তিটা করছে।” তাঁকে বলা গেল যে মণিপুরে মুসলমান প্রায় নেই বললেই চলে এবং ওই রাজ্যের সীমান্ত মায়ানমারের সঙ্গে, বাংলাদেশের সঙ্গে নয়। তাঁর নাছোড়বান্দা উত্তর “মুসলমান সব জায়গাতেই আছে।” অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হল, মণিপুর সম্পর্কে তাঁর তথ্যের উৎস কী? উত্তর “খবরেই তো দেখাচ্ছে।” কোন চ্যানেলের খবরে দেখাচ্ছে সে প্রশ্ন করে আর সময় নষ্ট করিনি, কারণ কোন খবর মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ায় না সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বরং সহজ। তাই তাঁকে মণিপুরের ভূগোল, ইতিহাস এবং বর্তমান অশান্তি যে মেইতেই আর কুকিদের মধ্যে তা জানাতে খানিকটা সময় ব্যয় করলাম। এনআরসি যে এর প্রতিকার নয় তাও বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সফল হলাম কিনা জানি না, ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ মানুষ বহুবছর ধরে সারাদিন যা দেখে চলেছে তার প্রভাব কয়েক মিনিটের কথায় দূর হওয়া অসম্ভব।

ভারতীয় সমাজকে এই খাদের কিনারে নিয়ে আসার দোষ সবটাই টিআরপিখোর টিভি চ্যানেলগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে অবশ্য অন্যায় হবে। খবরের কাগজগুলোও কোনো অংশে কম যায়নি। ‘পেইড নিউজ’ নিয়ে সাংবাদিক পি সাইনাথের যে কাজ আছে তা প্রমাণ করে টাকার জন্যে ভারতের বড় বড় কাগজগুলো সবকিছু করতে রাজি। ২০১৮ সালে কোবরাপোস্টের স্টিং অপারেশনেও তেমনই দেখা গিয়েছিল। কোবরাপোস্টের প্রতিনিধিরা একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধি সেজে ভারতের অনেকগুলো বড় বড় সংবাদমাধ্যমের কর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন। প্রস্তাব ছিল, আমরা টাকা দেব, সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর করতে হবে এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হয় এমন খবর করতে হবে, নানারকম ইভেন্টের আয়োজন করতে হবে। দুটো মাত্র সংবাদমাধ্যম রাজি হয়নি – পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ।

সংবাদমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থলোলুপতা এবং বিজেপি সরকারের ভয় দেখানো, সরকারবিরোধী খবর করলে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি নানা কৃৎকৌশলের ফল হল দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বিজেপি-আরএসএসের বয়ানের একাধিপত্য। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কখনো যা হয়নি ২০১৪ সালের পর থেকে ঠিক তাই হয়ে চলেছে। সংবাদমাধ্যম কেবলই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। যাদের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব তাদের প্রশ্ন করে না। অর্থাৎ কয়েকশো বছর ধরে সারা পৃথিবীতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার মূল কর্তব্য বলে যা স্থির হয়েছে – ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা – সেই কাজটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা অপরাধ, যে সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে না তারাই সঠিক কাজ করে – একথাই সারা দেশে সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সাংবাদিকরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে গদগদ সেলফি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। কে কত বড় সাংবাদিক তার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রশাসনিক বৈঠকে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন “পজিটিভ (ইতিবাচক) খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন।” এত বড় খবর সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা দৈনিকের এক কোণে ১৭৮ শব্দে প্রকাশিত হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের একজনও এর প্রতিবাদে একটি শব্দও লেখেননি বা বলেননি।

এভাবে চলছিল ভালই, কিছুদিন হল এই ধামাধরা মিডিয়া কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েছে। এমনিতে পৃথিবীর যে কোনো ব্যবসায় নিয়ম হল কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু ভারতের সাংবাদিকতায় সেই নিয়ম বারবার ভেঙেছে গোদি মিডিয়া। অর্ণব গোস্বামী টাইমস নাওতে থাকার সময়েই বিজেপির পক্ষে বলে না এনডিটিভির মত যেসব চ্যানেল তার সাংবাদিকদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা আরম্ভ করেছিলেন। একেবারে আরএসএসের তত্ত্ব অনুসরণ করে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, মুসলমান তো বটেই, যে কোনো ইস্যুতে সরকারের সামান্যতম বিরোধিতা করা ব্যক্তিদেরও দেশদ্রোহী বলা শুরু হয়ে গিয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে। টিভি বিতর্কে বিরোধী দলের একজন মুখপাত্রকে ডেকে চিৎকার করে তাঁকে কথা বলতে না দেওয়া, অন্যদিকে নানা পরিচয়ে বিজেপি-আরএসএসপন্থী একাধিক লোককে প্যানেলে বসিয়ে একতরফা প্রচার চালিয়ে যাওয়া দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে ভারতের সংবাদমাধ্যম এমন কখনো করেনি বলেই সম্ভবত বিরোধী দলগুলোর নেতারা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজিতে যাকে ‘ওয়াল টু ওয়াল কভারেজ’ বলে, সমস্ত নির্বাচনী প্রচারে এবং সারাবছরই বিজেপি তাই পেয়ে চলছিল আর বিরোধীদের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবার রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। এর পাল্টা কৌশল কারোর মাথায় আসেনি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য, সমর্থকরা ভেবে বসেছিলেন সোশাল মিডিয়া দিয়ে মাত করে দেবেন। কিন্তু বিপুল অর্থবলের কারণে সেখানেও বিজেপির সঙ্গে এঁটে ওঠা শক্ত। উপরন্তু আমাদের মত শহুরে মধ্যবিত্তদের নিজের চারপাশ দেখে যা-ই মনে হোক, ভারতের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এখনো স্মার্টফোন নেই, থাকলেও শস্তা ডেটা নেই, কানেক্টিভিটি নেই। ফলে ফেসবুক বা টুইটার দিয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছনো যায় না।

নেপথ্যে কে আছেন জানি না, কিন্তু বিজেপির এই সর্বগ্রাসী প্রচারের বিকল্প পথ প্রথম দেখালেন রাহুল গান্ধী – ভারত জোড়ো যাত্রা। শুধু যে সাবেকি ভারতীয় কায়দায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজের ভাবমূর্তি খানিকটা পুনরুদ্ধার করলেন এবং কংগ্রেসকে জাতীয় স্তরে ফের প্রাসঙ্গিক করে তুললেন তাই নয়, রাহুল ওই যাত্রায় এমন একটা জিনিস করলেন যা এমনকি বিজেপিও ভেবে উঠতে পারেনি। ভারত জোড়ো যাত্রাকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কোনো কভারেজ দেবে না বুঝে রাহুল ছোট বড় বিচার না করে বিকল্প সংবাদমাধ্যম, এমনকি ইউটিউবারদেরও সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, বড় বড় কাগজে রাহুল নেই। টিভিতে রাহুল নেই। অথচ কর্ণাটকে চলা ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও আলোচনা করছেন। আসলে রাহুল (বা কংগ্রেস) যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা বড় অংশের মানুষ খবরের জন্য আর কাগজ বা টিভির উপর ভরসা করেন না। বিশেষত যাঁদের মস্তিষ্কের সবটাই এখনো হিন্দুত্ব গ্রাস করতে পারেনি, তাঁরা অনেকেই এখন ধ্রুব রাঠি বা আকাশ ব্যানার্জির মত ইউটিউবারের দিকে তাকিয়ে থাকেন খবর সংগ্রহের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বিকল্প সংবাদমাধ্যম এখনো সঠিক অর্থে বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি বলেই হয়ত এই ধারা এখনো শীর্ণকায়। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মত বুলডোজারশাসিত রাজ্যেও হিন্দি ভাষার ইউটিউবাররা প্রবল জনপ্রিয়। যোগী সরকারকে বেগ দেওয়ার মত খবর, হাস্যকৌতুক, গান সবই তাঁরাই তৈরি করছেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বহু রাজ্যেই ঘটনা তাই। এই প্রবণতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হল ভারত জোড়ো যাত্রায়।

এর সঙ্গে কংগ্রেস আরও একটি কৌশল নিল, যা প্রথম চোটে যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আপত্তিকর মনে হবে। শাস্ত্রে বলা আছে, দূত অবধ্য। সাহেবরাও বলে থাকে “Don’t shoot the messenger”। কিন্তু রাহুল ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিককে সরাসরি বলে দিলেন, বিজেপির হয়ে কাজ করতে হলে বুকে বিজেপির লোগো লাগিয়ে আসুন। তাহলে ওদের যেভাবে উত্তর দিই আপনাদেরও সেভাবেই উত্তর দেব। সাংবাদিক হওয়ার ভান করবেন না। সাংবাদিক দমে যেতে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাওয়া বেরিয়ে গেল?

এরপর থেকে একই ঢঙে কথা বলা শুরু করলেন তাঁর দলের অন্য মুখপাত্ররাও। পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না। কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন ইন্ডিয়া টুডের শোতে সুপ্রিয়া সটান রাহুল কাঁওয়াল এবং রাজদীপ সরদেশাইকে বলে দিলেন, আপনাদের স্টুডিওতে তো সকাল থেকে শোকপালন চলছে বলে মনে হচ্ছে। এই আক্রমণাত্মক মেজাজ কংগ্রেসের মুখপাত্ররা বজায় রেখে চলেছেন। সম্প্রতি টাইমস নাওয়ের সাক্ষাৎকারে কপিল সিবাল নাভিকা কুমারকে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়েছেন। ভারি মোলায়েম গলায় বলেছেন, আশা করি এখন পর্যন্ত নাভিকা প্রধানমন্ত্রীর মাউথপিস নয়?

ক্রমশ এই রণনীতি অন্য বিরোধী দলের নেতাদেরও নিতে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সবকিছুই বাকি দেশের চেয়ে একটু দেরিতে হয় আজকাল। তাই হয়ত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অতি সম্প্রতি একেবারে পার্টিজান হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমকে কড়া ভাষায় প্রত্যুত্তর দেওয়া শুরু করেছেন। লাইভ অনুষ্ঠানে জি ২৪ ঘন্টার অ্যাঙ্কর মৌপিয়া নন্দীকে সটান বলে দিয়েছেন, দালালি করা চলবে না। ওই চ্যানেলের মালিক সুভাষ চন্দ্র যে রাজ্যসভার বিজেপি সমর্থিত সাংসদ, টেনে এনেছেন সেকথাও।

আত্মপক্ষ সমর্থনে মৌপিয়া প্রথমে ওই তথ্যটাই অস্বীকার করেছেন, তারপর সেটা সফল হবে না বুঝে জাঁক করে বলেছেন, সেলিম চাইলেও ২৪ ঘন্টা গণশক্তির মত রিপোর্টিং করবে না। তারপর, যেন হঠাৎ খেয়াল হওয়ায়, যোগ করেছেন, জাগো বাংলার মত রিপোর্টিংও করবে না।

স্বাভাবিক অবস্থায় রাজনৈতিক নেতাদের এইভাবে সাংবাদিকদের তথা সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ভারত যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং এই অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। বস্তুত অধিকাংশ তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম এখন এতটাই একচোখো হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তাদের খবর না দেখে বা না পড়ে কেউ যদি গণশক্তি আর জাগো বাংলা পড়ে নিজের মত করে ঠিক কী ঘটেছে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে হয়ত সত্যের বেশি কাছাকাছি পৌঁছবেন।

একথা পাঠক/দর্শক মাত্রেই আজকাল উপলব্ধি করেন। সেই কারণেই রবীশ কুমারের ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহক সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এমনকি কুণাল কামরার মত ঋজু বিদূষক, যাঁর মূল কাজ লোক হাসানো, তাঁর পডকাস্টও মানুষ আগ্রহ নিয়ে দ্যাখেন। সেদিক থেকে যে বাঙালি হিন্দি বা ইংরিজিতে স্বচ্ছন্দ নন তাঁদের দুর্ভাগা বলতে হবে। বাংলা ভাষায় ওই মানের কাজ এখনো হচ্ছে না।

যা-ই হোক, ধামাধরা মিডিয়ার সংকটের কথা ফেরত আসি। সম্প্রতি রিপাবলিক চ্যানেলের কর্ণধার অর্ণব মণিপুর নিয়ে মোদী সরকারের সমালোচনা করেছেন, রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিও তুলেছেন। তা নিয়ে বিজেপিবিরোধী মানুষ যুগপৎ হাসাহাসি করছেন এবং বিস্মিত হচ্ছেন। আসলে এতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই। বিজেপিকে তো বটেই, এমনকি বিজেপিবিরোধীদেরও বিস্মিত করে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও ২৬টি দলের ইন্ডিয়া জোট গড়ে উঠেছে। শেষপর্যন্ত সে জোট টিকবে কিনা সেটা পরের কথা, কিন্তু গোদি মিডিয়ার কাছে আশু সমস্যা হল এই দলগুলির অধীনে থাকা রাজ্য সরকারগুলো। গোটা দক্ষিণ ভারতে কোথাও বিজেপি সরকার নেই, অথচ ওই রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল, প্রচুর বিজ্ঞাপন পাওয়া যেতে পারে। বাড়াবাড়ি করলে বিজেপির দেখানো পথে ওই সরকারগুলো বিজ্ঞাপন দেবে না। গোবলয়ের রাজ্যগুলোর মধ্যেও বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থানের সরকার ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোর হাতে। দিল্লি, পাঞ্জাবের সরকারও তাই। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের মত বড় রাজ্য, ছত্তিসগড়ের মত উন্নতি করতে থাকা রাজ্যও ইন্ডিয়ার হাতে। তাহলে গোদি মিডিয়ার হাতের পাঁচ বলতে রইল মডেলের হাড়গোড় বেরিয়ে পড়া গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ছোট্ট রাজ্য হরিয়ানা আর মধ্যপ্রদেশ। শেষেরটি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির হাতে থাকবে কিনা তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে তেমন ব্যবসা হয় না নয়ডাকেন্দ্রিক তথাকথিত সর্বভারতীয় মিডিয়ার। কারণ তারা ওই অঞ্চল এবং তার মানুষজনকে চেনেই না। স্বভাবতই তাঁরাও এদের পাত্তা দেন না। এমতাবস্থায় স্রেফ দাঙ্গাবাজি করে চলে কী করে অর্ণব, রুবিকাদের?

লাইভ টিভিতে বিরোধী দলের নেতাদের প্রতিআক্রমণের ফলে হিন্দুত্বে একান্ত দীক্ষিত দর্শক ছাড়া আর সকলের কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা যে তলানিতে ঠেকেছে একথা বুঝতে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর পাকা মাথাদের কারোর বুঝতে বাকি নেই। বিকল্প সংবাদমাধ্যম বিপুল সরকারি বাধা সত্ত্বেও যে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে তাতেও সন্দেহ নেই। অতএব মাঝেমধ্যে বিজেপিবিরোধী ভান করতে হবে বইকি। মুশকিল হল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সম্ভবত বিজেপিও ভাবতে শুরু করেছে, এদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা করালে তা আর আগের মত প্রভাবশালী হবে না। তাই তারাও এখন ‘সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার’ ধরার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বিজেপিপন্থী লেখক, সাংবাদিক, এমনকি মন্ত্রীরাও বেশকিছু ইউটিউবারকে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেছেন। এমনটা বিজেপি আগে কখনো করেনি। এই ইউটিউবারদের অন্যতম beerbiceps বলে একজন। ইউটিউবে তার প্রায় ছয় মিলিয়ন ফলোয়ার। অতীতে সে ক্রিকেটার যজুবেন্দ্র চহল, সানি লিওন, সারা আলি খান জাতীয় মানুষের সাক্ষাৎকার নিত। এমনকি ডিমনেটাইজেশনকে ব্যঙ্গ করেও ভিডিওও বানিয়েছে একসময়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে সে পরম সাত্ত্বিক হয়ে উঠেছে। বারবার ভুয়ো খবর ছড়িয়ে ভ্রম সংশোধন করা এজেন্সি এএনআইয়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশ থেকে শুরু করে অমুক প্রভু, তমুক দক্ষিণপন্থী স্ট্র্যাটেজিস্ট – সকলেই বিয়ারবাইসেপসের শোতে উপস্থিত হচ্ছেন। বিজেপি যদি ২০২৪ নির্বাচন জিতেও যায়, রাহুল, সেলিমরা মূলধারার সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে তাঁদের তিরিক্ষে মেজাজ বজায় রাখলে হয়ত বিয়ারবাইসেপসদেরই পোয়া বারো হবে, কপাল পুড়বে অর্ণব, মৌপিয়াদের।

তবে আক্রমণের ধারাবাহিকতা থাকা চাই। সেলিম জি নেটওয়ার্কের অ্যাঙ্করকে হাঁকড়াবেন আর তাঁর দলের মুখপাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা রিপাবলিক টিভির মত আরও উগ্র দক্ষিণপন্থী চ্যানেলের বিতর্কে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করবেন, অনুষ্ঠানের আগে পরে দিলদরিয়া হয়ে ছবিও তুলবেন – তা কী করে হয়?

পিপলস রিপোর্টার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

এনডিটিভি বিসর্জন: শোক নিষ্প্রয়োজন, উল্লাস অন্যায়

এনডিটিভি প্রথম নেটওয়ার্ক নয় যা সরকারের মুখপত্র হতে চলেছে, শেষ নেটওয়ার্ক। বিপদটা সেইখানে।

এনডিটিভির দখল এশিয়ার সবচেয়ে বড় ধনী গৌতম আদানির হাতে চলে যাওয়া নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রণয়-রাধিকার হাত থেকে লাগাম ছুটে যাওয়া মাত্রই পদত্যাগ করেছেন ম্যাগসাসে পুরস্কার জয়ী সাংবাদিক রবীশ কুমার। এই খবরটা আরও বেশি পীড়া দিচ্ছে অনেককে। কারণটা শুধুমাত্র কিছু মানুষের প্রিয় টিভি নেটওয়ার্ক অপ্রিয় লোকের হাতে চলে যাওয়া বা সেখান থেকে প্রিয় অ্যাঙ্করের প্রস্থান নয়। এনডিটিভির আদানিকরণ নিয়ে সারা পৃথিবীতে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় থাকা লোকেদের হাতে কোনো সংবাদমাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ার মালিকানা চলে যাওয়া যে গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর, বাকস্বাধীনতার বারোটা বাজানোর পক্ষে যথেষ্ট, তা সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ বুঝে ফেলেছেন। উপরন্তু আদানি এনডিটিভিকে নিয়ে কী করবেন তা নিয়েও কোনো সংশয় রাখেননি। তিনি ফাইন্যানশিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন “স্বাধীনতা মানে হল সরকার ভুল কিছু করলে তা বলার স্বাধীনতা। কিন্তু একইসঙ্গে সরকার যখন রোজ ঠিক কাজ করে তখন সেটা বলার সাহসও থাকা উচিত। সেটাও আপনাকে বলতে হবে।” পৃথিবীর সবচেয়ে জনদরদী সরকারও যে রোজ ঠিক কাজ করে না তা বোঝার জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের মত বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার নেই আর আদানির মত সফল ব্যবসায়ী নির্বোধও নন। ফলে তিনি যে আসলে বলতে চাইছেন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা সংবাদমাধ্যমের কাজ নয় – তা স্পষ্ট। একটা সাড়ে তিন দশকের পুরনো মিডিয়া নেটওয়ার্কের মালিকানা এমন লোকের হাতে চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।

কিন্তু এনডিটিভি কি প্রথম চ্যানেল যা শাসকের মুখপাত্র হতে বসেছে? নাকি এনডিটিভি ছিল বলে ভারতের গণতন্ত্র জীবন্ত ছিল, আর আদানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেই নিমেষে তার মৃত্যু হবে? যদি দুটো প্রশ্নের উত্তরই ‘না’ হয়, তাহলে এত কান্নাকাটির কী আছে? নাগরিক ডট নেটের মত একটা বিকল্প সংবাদমাধ্যমে আমারই বা এ নিয়ে প্রবন্ধ ফেঁদে বসার কী আছে? রবীশ কিছুদিন আগেই, সম্ভবত কী হতে চলেছে জেনে, নিজের ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন। সাবস্ক্রাইবারের যথারীতি অভাব হয়নি, তাঁর পদত্যাগের কথা চাউর হওয়ার পর সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে। সুতরাং সেই চ্যানেল থেকে যে বিস্তর আয় হবে তাতে সন্দেহ নেই। রবীশের সে আয়ের ভাগ তো আমি পাব না, নাগরিক ডট নেটও পাবে না। তাহলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মত “কিসের শোক করিস ভাই/আবার তোরা মানুষ হ” বলে অন্য কাজে লেগে পড়লেই তো হয়। কী দরকার এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তার?

এসব কথা অনেকেই বলাবলি করছেন। আরও বলাবলি হচ্ছে, এনডিটিভির ভারতীয় সাংবাদিকতায় এমন কিছু অবদান নেই যে তাদের জন্য চোখের জল ফেলতে হবে। তারাও আর পাঁচটা সংবাদমাধ্যমের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। যাঁরা মনে করছেন এনডিটিভি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা শেষ চ্যানেল ছিল, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এনডিটিভি কেন্দ্রের শাসককে প্রশ্ন করলেও বহু রাজ্যের শাসককে ছাড় দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারই সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সুতরাং শোকার্ত হয়ে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আবার কংগ্রেসের অনেক সদস্য, সমর্থক এনডিটিভির উপর চটে আছেন অন্য কারণে। তাঁদের বক্তব্য এরা বিজেপিকে যত প্রশ্ন করেছে, বিরোধী আসনে থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসকে তার চেয়ে বেশি প্রশ্ন করেছে। নরেন্দ্র মোদীর চেয়ে বেশি আক্রমণ করেছে রাহুল গান্ধীকে। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে দিনরাত আলোচনা করেছে, বিজেপির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই।

উপরের সবকটা অভিযোগেরই কিছু না কিছু সারবত্তা আছে। ঠিক সেজন্যেই এনডিটিভির আদানিকরণ নিয়ে আলোচনা অপরিহার্য।

প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, অনেকেই একটা কথা ভুল বুঝেছেন। এনডিটিভির নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রণয় রায় ও তাঁর স্ত্রী রাধিকা রায়ের হাত থেকে বেরিয়ে যায়নি। তাঁরা এখনো এনডিটিভির বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সে আছেন, থাকতে বাধাও নেই। কারণ দুজনের হাতেই এনডিটিভির বেশকিছু শেয়ার রয়েছে।

কিন্তু এনডিটিভির প্রোমোটার হল আরআরপিআর হোল্ডিং নামক সংস্থা। তাঁরা পদত্যাগ করেছেন সেই সংস্থার ডিরেক্টরের পদ থেকে, কারণ আরআরপিআরের দখল অগাস্ট মাসেই আদানি গ্রুপের হাতে চলে গেছে, ফলে এনডিটিভির ২৯.১৮% শেয়ারও এখন আদানি গ্রুপেরই হাতে। এনডিটিভির আরও ২৬% শেয়ার দখল করার জন্য গৌতম আদানি ২২ নভেম্বর এক ওপেন অফার লঞ্চ করেছেন, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ। আদানির লক্ষ্যপূরণ হলে এনডিটিভির বেশিরভাগ শেয়ার চলে যাবে আদানি গ্রুপের হাতে। পূরণ না হলেও অন্য যারা শেয়ার কিনে নেবে তাদের শেয়ারগুলো আরও বেশি দামে কিনে নেওয়ার রেস্ত আদানির আছে, রায় দম্পতির নেই। ফলে আদানির এনডিটিভির ম্যানেজমেন্টের সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নেওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা। ইতিমধ্যেই আদানি গ্রুপের চিফ টেকনোলজি অফিসার সুদীপ্ত ভট্টাচার্য, সাংবাদিক সঞ্জয় পুগলিয়া ও সেন্থিল চেঙ্গলবরায়ন আরআরপিআরের ডিরেক্টর নিযুক্ত হয়েছেন। প্রণয়-রাধিকার এনডিটিভি থেকে বিদায় অনিবার্য – একথাও বলাই যায়। কারণ আদানির চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে ওপেন অফারে যারা শেয়ার কিনেছে তাদের শেয়ারগুলো ফের কিনে নেওয়ার অবস্থা রায় দম্পতির থাকলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টিই হত না। তাঁরা ২০০৯-১০ সালে বিশ্বপ্রধান কমার্শিয়াল প্রাইভেট লিমিটেড নামে এক সংস্থা থেকে ৪০৩ কোটি টাকা ধার নিয়েছিলেন। সে ঋণের শর্তই ছিল, ঋণ শোধ করতে না পারলে আরআরপিআরের ৯৯.৯% শেয়ার বিশ্বপ্রধান দখল করে নিতে পারবে। আদানি প্রথমে ওই বিশ্বপ্রধানেরই প্রধান হয়ে বসেন টাকার জোরে, তারপর অনাদায়ী ঋণের দায়ে এনডিটিভির দখল নেওয়ার কাজ শুরু করেন।

শোধ দিতে পারবেন না এমন ঋণ নিলেন কেন, তা-ও আবার ২০০৮ সালে তৈরি হওয়া বিশ্বপ্রধানের মত এক গোলমেলে ‘হোলসেল ট্রেডিং ফার্ম’ থেকে, যার মালিকানা হাত বদলাতেই থাকে, যার মালিকানা একসময় ছিল রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের হাতে, পরে মুকেশ আম্বানিরই ঘনিষ্ঠ মহেন্দ্র নাহাতার হাতে চলে যায়? এসব প্রশ্ন তুলে এনডিটিভির আজকের অবস্থার জন্য রায় দম্পতিকে দায়ী করাই যায়। এমনকি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি)-ও এ নিয়ে প্রণয়-রাধিকাকে শোকজ করেছিল। এনডিটিভিতে কাজ করেই বিখ্যাত হওয়া বরখা দত্তের মত কেউ কেউ এখন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তির্যক ভাষায় টুইট করতে লেগেছেন, এনডিটিভি আগে আম্বানির হাতে ছিল। তখন যদি স্বাধীন থেকে থাকে, এখন আদানির হাতে গেলেই পরাধীন হবে কেন? আসলে ইস্যুটা হল টিভির রেভিনিউ মডেলটাই ভেঙে পড়েছে।

AM CONFUSED. WHEN MUKESH AMBANI OWNED 30% OF NDTV IT WAS FREE AND WHEN GAUTAM ADANI PURCHASES THAT 30% ITS OBITUARY TIME? PRAY, HOW? SO MUCH POLITICKING & HUMBUG IN THE DISCOURSE BOTH FOR OR AGAINST, BOTH NARRATIVES IGNORE THE ELEPHANT IN THE ROOM- REVENUE MODEL OF TV IS BROKEN.— barkha dutt (@BDUTT) December 1, 2022

এতদ্বারা বরখা আম্বানিকে গণতান্ত্রিক বললেন, নাকি আদানিকে গণতান্ত্রিক বললেন? নাকি দুজনের কেউই বাকস্বাধীনতার পক্ষে বিপজ্জনক নন বললেন? বোঝা কঠিন। কিন্তু ঘটনা হল কর্পোরেট মিডিয়ার রেভিনিউ মডেল যে গোলমেলে তা কোনো নতুন কথা নয়। আয়ের জন্যে বিজ্ঞাপন নির্ভরতা এবং বিজ্ঞাপনের জন্য টিআরপি নির্ভরতা বহুকালের সত্য। বরখা যখন স্বয়ং কর্পোরেট মিডিয়ার হর্তাকর্তা ছিলেন তখনো তাই ছিল। ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর সংবাদমাধ্যমে, বিশেষত ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে, দুটো জিনিস ক্রমান্বয়ে ঘটেছিল। এক, সংবাদমাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক চাকরি চালু হওয়া আর সাংবাদিকদের পারিশ্রমিক অনেকখানি বেড়ে যাওয়া। এককথায় অন্যদের ঘাড়ে পা দিয়ে সাংবাদিকদের স্বর্গারোহণ আরম্ভ হয়। যে সাংবাদিক যত উপরে আছেন তাঁর মাইনে তত বাড়ে। রাজস্ব বেড়েছে কিনা, এত মাইনের টাকা আসবে কোথা থেকে – এসব প্রশ্ন তখন বরখার মত শীর্ষস্থানীয়রা করেননি। ২০০৮-০৯ বা ২০১০, অর্থাৎ যে সময়ে প্রণয়-রাধিকা ওই বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছিলেন, ঠিক সেই সময়টাতে এই মাইনে বাড়ার হার চরমে পৌঁছয় সারা দেশের সংবাদমাধ্যমে। কেবল টিভি চ্যানেলগুলোতে নয়, খবরের কাগজেও।

আমার নিজের অভিজ্ঞতাই বলি। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার ধুঁকতে থাকা দ্য স্টেটসম্যান কাগজের চাকরি ছেড়ে পাড়ি দিই হায়দরাবাদে, ২৮,০০০ টাকা মাস মাইনেয়। সেখানে যে কাগজে যোগ দিই, সেখানে কয়েক মাসের মধ্যেই কোনো অজ্ঞাত কারণে বেতন কাঠামোর পুনর্বিন্যাস হয়। নিউজরুমের বড়, মেজ, সেজ, ছোট সকলেরই বেতনের বিপুল বৃদ্ধি হয়। যাদের পদোন্নতি হয়নি তাদেরও বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়। আমার মত যাদের পদোন্নতি হয়েছিল তাদের বৃদ্ধি হয় চোখ কপালে তোলার মত। আমার বেতন গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মাসিক ৭০,০০০ টাকায়। আমি তখন নেহাতই মাঝের স্তরের সাংবাদিক, সবে সিনিয়র সাব-এডিটর থেকে চিফ সাব হয়েছি। অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, এক্সিকিউটিভ এডিটর বা এডিটরদের মাইনে কোথায় পৌঁছেছিল তা কেবল কল্পনাই করতে পারি। আমরা কেউ কি খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম কাগজের আয় বেড়েছে কিনা? অথচ সকলেই জানতাম কাগজের বিক্রি কিন্তু রাতারাতি বাড়েনি।

সেটা ২০০৮ সালের কথা। তখন সারা ভারতের ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে প্রতিযোগিতা চলছে সাংবাদিকদের মাইনে বাড়ানোর। আবার ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সারদা গ্রুপের বাংলা কাগজ চালু হওয়ার সময়ে একইরকম জিনিস দেখা গিয়েছিল। সে কাগজ বছর দুয়েকের বেশি না চললেও বাংলা ভাষার সাংবাদিকদের সঙ্গে ইংরেজির সাংবাদিকদের পারিশ্রমিকের যে লজ্জাজনক ব্যবধান ছিল, তা কমাতে ঘটনাটা কিছুটা সাহায্য করেছিল।

এখন কথা হল, টিআরপির খোঁজে বহুকাল ধরেই ভূত পেত্নী দত্যি দানো তাবিজ কবচ দেখায় বহু হিন্দি চ্যানেল। সে কাজ রবীশরা কখনো করেননি। ২০১২-১৩ সাল থেকে ওসবের সঙ্গে হিন্দি, ইংরেজি সব চ্যানেলেই যুক্ত হয়েছে প্রায় আঁচড়ে কামড়ে দেওয়ার মত সান্ধ্য মজলিশ, মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো, উদারনৈতিক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে লোক ক্ষ্যাপানো, সব ধরনের বামপন্থীদের দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া, ভুয়ো খবর প্রচার, বিজেপির অলিখিত মুখপত্রের কাজ করা। এনডিটিভি এগুলোর কোনোটাই করেনি। অথচ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে বাজারের চলতি হারের কমে মাইনে দেওয়া চলে না। উপরন্তু সাংবাদিকদের মাইনে একটা সংবাদমাধ্যমের খরচের একটা অংশ মাত্র। তথ্যপ্রমাণ বলছে খুব বড় অংশও নয়। তার চেয়ে খবর সংগ্রহ করা এবং টিভির ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নয়নের খরচ অনেক বেশি। সেখানেও প্রতিযোগীদের সঙ্গে তাল মেলাতে টাকার প্রয়োজন হয়। আমরা যারা স্বাধীন সংবাদমাধ্যম চাই, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে এমন সংবাদমাধ্যম চাই, তারা কি টিআরপি বাড়িয়ে বেশি বিজ্ঞাপন পাওয়ার দিকে মন না দিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ ঋণ নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টাকে বেশি অপরাধ বলে গণ্য করব? বরখার টুইটসূত্রে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এনডিটিভির শেয়ার হোল্ডাররা মন্তব্য করছেন, ওটা বাজে কোম্পানি। আমাদের কী করে ডিভিডেন্ড দেওয়া যায় তার দিকে কোনোদিন নজর দেয়নি। একটা সংবাদমাধ্যমকে স্রেফ কোম্পানি হিসাবে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গিই কি আমাদের মূল্যায়নের মাপকাঠি হওয়া উচিত? ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমরা তো কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার নই। আমরা বরং, পুঁজিবাদী লবজে, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের স্টেক হোল্ডার।

এনডিটিভি প্রথম নেটওয়ার্ক নয় যা সরকারের মুখপত্র হতে চলেছে, শেষ নেটওয়ার্ক। বিপদটা সেইখানে। ভারতে যতগুলো বড় বড় টিভি নেটওয়ার্ক আছে তার প্রায় সবকটাই ইতিমধ্যেই শাসক দলের গর্ভে চলে গেছে। বাকি ছিল এনডিটিভি। বলতে দ্বিধা নেই, এনডিটিভিও একটি পুঁজিবাদী সংস্থা। সে পুঁজিবাদের নিয়মেই চলেছে। এমন নয় যে সারা ভারতের সংবাদমাধ্যমে যখন ছাঁটাই চলেছে, এনডিটিভি তখন সমস্ত কর্মচারীর স্বার্থরক্ষা করেছে। কিন্তু রায় দম্পতি কখনো কারাত দম্পতির মত নিজেদের বিপ্লবী বলে দাবি করেছেন বলে তো মনে পড়ে না। তাঁরাও ব্যবসাই করছিলেন। ব্যবসা প্রায় তিন দশক ক্রমশ বড় হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের যা কাজ তা করতে নিতান্ত ব্যর্থ হয়নি, দায়িত্ব অস্বীকারও করেনি। কোনো সন্দেহ নেই, সব ইস্যুতেই এনডিটিভির অবস্থান ন্যায়ের পক্ষে বা দুর্বলের পক্ষে ছিল না। থাকার কথাও নয়। অন্তত বামপন্থীদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে সংবাদমাধ্যম শেষপর্যন্ত মালিকের শ্রেণিস্বার্থেরই প্রতিভূ। এনডিটিভি তার চেয়ে আলাদা হবে এরকম প্রত্যাশা ছিল কি? থাকলে কেন ছিল? তবে এই একটি নেটওয়ার্কে কিন্তু বুলডোজার দিয়ে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ বা আসামে প্রতিবাদীদের ঘর ভেঙে দেওয়ার জন্যে বিজেপি নেতাদের দিকে আঙুল তোলা চলত। উমর খালিদ, ভারভারা রাও, স্ট্যান স্বামী, জি এন সাইবাবা, গৌতম নওলাখারা যে খলনায়ক নন সেটা বলা চলত। বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে পরে লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য নিয়ে কথা হত। আজ দেশের যা অবস্থা, তাতে এমন একটা মঞ্চের গুরুত্ব কম নয়। এই মঞ্চের অবলুপ্তিতে শোকাহত না হলেও উল্লসিত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

ভারতীয় সাংবাদিকতায় এনডিটিভির অবদান কী, সে সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছেন অনিন্দ্য চক্রবর্তী। এনডিটিভি নেটওয়ার্কের দু-দুটো চ্যানেলের একদা ম্যানেজিং এডিটর এই সাংবাদিক রায় দম্পতির আরও অনেক অবদানের কথা লেখার সঙ্গে সঙ্গে লিখেছেন, ভারতের আর সব প্রতিষ্ঠানের মতই এনডিটিভিতেও বিলক্ষণ লুটিয়েন্স এলিটসুলভ ব্যাপার-স্যাপার আছে। কিন্তু অন্য কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান একজন রবীশ তৈরি করতে পারেনি। কারণ একজন হিন্দি ভাষার সাংবাদিককে অতখানি জায়গা এবং কাজের স্বাধীনতাই কেউ দেয়নি।

এ কথার মাহাত্ম্য বোঝানো শক্ত। কারণ আমরা বাঙালি অ্যাংলোফাইলরা বুঝে উঠতে পারি না আঞ্চলিক ভাষার সাংবাদিকতার গুরুত্ব কতখানি। স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কেটে গেল, অথচ আজও ভারতে প্রগতিশীলতার ভাষা ইংরেজি। আমরা দ্য ওয়্যার, নিউজলন্ড্রি, ক্যারাভ্যান, অল্টনিউজ, বুম লাইভ ইত্যাদি ইংরেজি ভাষার বিকল্প সংবাদমাধ্যম পড়ি/দেখি বলে হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির বাইরের সত্য জানতে পারি। কিন্তু এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইংরেজি পড়তে পারেন না, বলতে পারেন না, শুনে বুঝতেও পারেন না। তাঁদের কাছে উদারনৈতিক মতবাদ, ভুয়ো খবর পেরিয়ে সত্য পৌঁছে দেওয়ার দায় আমরা নিই না। আমরা কেবল তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেই খালাস। যে কারণে বাংলায় বিকল্প সংবাদমাধ্যম তৈরি করার তেমন প্রয়াস নেই। বাংলার টিভি চ্যানেলগুলোও দুর্গাপুজোয় অ্যাঙ্করদের শাড়ি পরিয়ে, তৃণমূল-বিজেপি তরজা দেখিয়ে, শোভন-বৈশাখী কেচ্ছা দেখিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। যে দক্ষিণপন্থীদের আমরা ঘোর অপছন্দ করি, তারা কিন্তু আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব বোঝে। তাই রিপাবলিক হিন্দি খুলে গেছে, রিপাবলিক বাংলাও চলে এসেছে। এই আবহে রবীশকে রায় দম্পতি যে স্থান দিয়েছিলেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সময়ের কোনো বাঙালি সম্পাদক বাংলায় সাংবাদিকতা করে বিশ্বমানের পুরস্কার পেতে পারবেন? পুরস্কার পাওয়া অবশ্য সবচেয়ে বড় কথা নয়। কিন্তু কলকাতার যে সম্পাদকদের ইদানীং আমরা প্রবাদপ্রতিম বলে মনে করি, রবীশের মত জনগণের দুঃখ দুর্দশা সাংবাদিকতায় নিয়ে আসার ব্যাপারেও তো তাঁদের অবদান শূন্য। ফলে রবীশের মত বিস্তীর্ণ এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের উপর ইতিবাচক তো নয়ই, নেতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। এঁদের প্রভাব হাওড়া ব্রিজ পেরোলেই শেষ বললে ভুল হয় না।

তার উপর আছে ম্যানেজারি করে সম্পাদক হওয়ার ভান। যে কারণে দেবেশ রায় অশোক দাশগুপ্তের কলামের সংকলনের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন “এক সময় বাংলা খবরের কাগজে সম্পাদকের সক্রিয় সাংবাদিক হওয়ার বাধ্যতা ছিল। তাঁদের লিখতে হত – চাকরির কারণে নয়, নিজেদের মত দশজনকে জানানোর দরকারে ও দশজনের মত তৈরি করে তোলার দায় স্বীকার করে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় থেকে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার বাংলা সাংবাদিকতার সেই ইতিহাস তৈরি করেছেন। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় শেষ সম্পাদক যিনি নিজে লিখতেন। যদিও তাঁর লেখা তাঁর নামে বেরোত না, তবু পাঠক এমনই চিনত তাঁর লেখা যে সম্পাদকীয়র নৈর্ব্যক্তিকে তিনি হারিয়ে যেতেন না। তারপর বাংলা কাগজে সম্পাদকের লেখালেখি উঠে গেছে।” বাংলার টিভি চ্যানেলের সম্পাদকরা আরও কম সাংবাদিক। তাঁরা সুটেড বুটেড হয়ে সান্ধ্য বিতর্ক পরিচালনা করা আর বিশিষ্টদের সাক্ষাৎকার নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেন না। রবীশের মত আবর্জনার মধ্যে দাঁড়িয়ে “প্লিজ টেল মনমোহন সিং টু ওয়াচ রবীশ কি রিপোর্ট। ইংলিশ মে ওয়সে ভি ইন্ডিয়া ডেভেলপড লগতা হ্যায়” বলা এঁদের কল্পনাতীত। এই রবীশ টিভি মিডিয়ার বাইরে চলে গেলেন। এতে সত্যিই হয়ত তাঁর ক্ষতি নেই, কিন্তু টিভির দর্শকদের ক্ষতি। টিভির মাধ্যমে তিনি যত হিন্দিভাষী দর্শকের কাছে পৌঁছতে পারতেন, যত ইংরেজি না জানা মানুষকে বিষাক্ত দক্ষিণপন্থার উল্টো ছবি দেখাতে পারতেন, ইউটিউব চ্যানেল দিয়ে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ ভারতে মোবাইল ডেটার দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে।

শেষ প্রশ্নে আসব, অর্থাৎ এসব নিয়ে নাগরিক ডট নেট কেন ভাবছে? তার আগে সংক্ষেপে কংগ্রেসি বন্ধুদের এনডিটিভির প্রতি রাগ নিয়ে দু-চার কথা বলে নিই। এনডিটিভি যে উদারনীতির অনুশীলন করেছে সেই ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’-এর সময় থেকে, তা কিন্তু আসলে নেহরুসুলভ উদারনীতি। জওহরলাল নেহরু যে গণতান্ত্রিক উদারতার ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে বিদ্যায়তনিক ইতিহাস চর্চায় বামপন্থীদের জায়গা দিয়েছিলেন, ললিতকলা আকাদেমি বা সাহিত্য আকাদেমি নির্মাণ করেছিলেন – সেই উদারতা। ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ঋত্বিক ঘটকের মত ঘোর বামপন্থী, যাঁকে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেই হজম করতে পারেনি, তিনি পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন যে উদারনৈতিক ধারাবাহিকতায়, এনডিটিভি বস্তুত তারই অনুশীলন করেছে। ফলে তা মনমোহনী অর্থনীতির পক্ষ নেয়, আবার গান্ধী পরিবারের সমালোচনাও করে। এই জাতীয় উদারবাদীদের সঙ্ঘ পরিবারের কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই, যত প্রত্যাশা কংগ্রেসের কাছে। স্বভাবতই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন যখন দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে কোনো আগ্রহের বিষয়ই নয়, তখন এনডিটিভি ঘন্টার পর ঘন্টা শশী থারুর আর মল্লিকার্জুন খড়গের সাক্ষাৎকার দেখিয়ে গেছে। মোদী সারাক্ষণের রাজনীতিবিদ, রাহুলের কেন মাঝে মাঝেই ছুটির দরকার হয় – এ কথাও এনডিটিভির মঞ্চ থেকে বহুবার উঠেছে সম্ভবত এই কারণেই। কংগ্রেস এইসব সমালোচনা খোলা মনে নিতে পারলে তাদেরই লাভ হত। সমর্থকরা না নিলেও, রাহুল স্বয়ং বোধহয় নিয়েছেন। ভারত জোড়ো যাত্রা দেখে অন্তত সেরকমই মনে হয়।

দীর্ঘ লেখা এবার শেষ করব কেন এত দীর্ঘ লেখা, কেন আদৌ এ লেখা – সে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে।

এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সবকটাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা চলছে। শুধু ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী এজেন্ডা তার কারণ নয়। একুশ শতকের পুঁজিবাদ কোনো প্রতিষ্ঠান পছন্দ করে না। সবকিছুকেই কোম্পানি করে তোলাই তার উদ্দেশ্য। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হবে কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল কোম্পানি – লেখাপড়া হোক আর না-ই হোক। সেটা লাভজনক থাকলে চালানো হবে, নয়ত বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ শিক্ষা পণ্য। খবর এবং/অথবা তথ্য তো পণ্য বটেই। ফলে সংবাদমাধ্যমকেও প্রতিষ্ঠান থাকতে দেওয়া চলে না, তাকেও হতে হবে কোম্পানি। লাভজনক হলে চলবে, নইলে বন্ধ করে দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া ভাল, যদি প্রতিস্পর্ধী প্রতিষ্ঠান তৈরি করার দম থাকে। সেসব যখন আমাদের নেই, তখন আজকের পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়া উদযাপন করা মূর্খামি। এতে গণতন্ত্রের পরিসরই যে সংকুচিত হচ্ছে সেকথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

অনেকেই দেখছি বিকল্প সংবাদমাধ্যমের উপর যাবতীয় দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হচ্ছেন। নাগরিক ডট নেটের সদস্য হিসাবে তা দেখে মন্দ লাগে না। কিন্তু মনে রাখা ভাল, ‘বিকল্প’ কথাটা অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিকল্পের ক্ষমতা সীমিত। যাঁরা পড়বেন তাঁরাই টাকা দেবেন, বিজ্ঞাপনের পরোয়া করতে হবে না – এই বিকল্প তৈরি হয়েছে বরখা কথিত অচল রেভিনিউ মডেলের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে। ইংরেজিতে এই মডেল (পোশাকি নাম ক্রাউড-ফান্ডেড মিডিয়া) অনেক ক্ষেত্রেই বেশ সফল, বাংলাতেও এই মডেল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে নির্ঘাত। নাগরিক ডট নেট তো করবেই, আরও অনেকে করলে ভাল। কিন্তু এই মডেলের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। বিজ্ঞাপন মডেলের মতই এই ব্যবস্থাতেও যিনি টাকা দেবেন নির্ঘাত তাঁর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কনটেন্টের উপর। এক্ষেত্রে যেহেতু টাকা দিচ্ছেন অনেকে, সেহেতু একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চলবে না বলে কনটেন্টে ভারসাম্য বজায় থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি অবশ্য। কিন্তু যিনি একেবারেই টাকা দিতে পারবেন না, তাঁর কথা কতটা উঠে আসবে? বাজারের যে সবজি বিক্রেতা পাঁচ টাকা দিয়ে দোকানে একটা কাগজ রাখেন বা যে রিকশাচালক বাড়ির টিভিতে দিনে অন্তত একবার খবর দেখেন, তিনি কি মোবাইলে নাগরিক ডট নেট পড়বেন টাকা দিয়ে? যদি না পড়েন, নাগরিক ডট নেট কি তাঁর সুখ দুঃখ তুলে আনার পরিশ্রম করতে পারবে? শ্রমের তো মূল্য আছে। অন্তত থাকা উচিত।

এছাড়াও আছে ঝুঁকির প্রশ্ন। ভারতের সব রাজ্যেই সাংবাদিক ও তাঁর পরিবার পরিজনদের উপর আক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে, যে কোনো সমীক্ষায় উঠে আসছে সেই তথ্য। এনডিটিভির মত মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক তবু বিপদে পড়লে সংগঠনের আইনি ও সাংগঠনিক সাহায্য পান। নাগরিক ডট নেটের কেউ বিপদে পড়লে কার সাহায্য পাবে?

বিকল্প সংবাদমাধ্যম বা স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যেই বেশ প্রতিষ্ঠিত যারা, সেই নিউজক্লিকের দপ্তরেও কারণে অকারণে সরকারি সংস্থার রেড হয়ে থাকে। মামলা ঠুকে হয়রানি চলে নিয়মিত। এই ধরনের মিডিয়ার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় দ্য ওয়্যার। তারা কিছুদিন আগে এক কেলেঙ্কারি করে বসেছিল। বিরাট খবর করছে মনে করে বিজেপির আই টি সেলের কর্তা অমিত মালব্য এবং ফেসবুককে জড়িয়ে সম্পূর্ণ ভুল খবর পরিবেশন করেছিল। সেই খবর পরে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ন্যক্কারজনক ঘটনা, কিন্তু সাংবাদিকতার ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। যে কোনো কাজ করতে গেলেই ভুল হয়, খবর করতে গেলেও। কিন্তু সরকারবিরোধী সংবাদমাধ্যম হওয়া এখন এ দেশে বিরাট অপরাধ। তাদের ভুল অমার্জনীয়। তাই কেবল দপ্তরে নয়, দ্য ওয়্যারের প্রধান সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বাড়িতেও পুলিস হানা দিয়ে তাঁর ল্যাপটপ, ফোন ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই। এনডিটিভি গেল তো কী হল, বিকল্প সংবাদমাধ্যম দিয়েই কাজ চলে যাবে এই স্বপ্নে যাঁরা বুঁদ হয়ে আছেন তাঁরা এগুলো খেয়াল রাখবেন দয়া করে। এখানেই শেষ নয়। তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে অনলাইন কনটেন্টের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের রাস্তাও পরিষ্কার করা হয়েছে।

ফলে নাগরিক ডট নেটের মত ওয়েবসাইটও খুব নিরাপদ নয়। অতএব স্বাধীন তথা বিকল্প সংবাদমাধ্যমের উপর ভরসা রাখুন, পাশে থাকুন। পকেটের পয়সা দিয়ে এবং আরও যে যে উপায়ে পারেন। কিন্তু পা মাটিতে রাখুন। কোনো মূলধারার সংবাদ প্রতিষ্ঠানের পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজনের হাতে চলে যাওয়ার ঘটনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়, উল্লাস করার তো নয়ই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: