সরকারবিরোধী মানুষ এত অসহায় যে এই সময়কালে অনেকের মনে বিরোধী নেতাদের শূন্য আসনে শুধু বিজেপি নেতারাই নয়, বিচারকরাও বসে পড়েছেন।
সালটা ১৯৯৬। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে উদগ্রীব দেশের অকংগ্রেস, অবিজেপি দলগুলো। এই প্রস্তাবে সায় দেওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলছে সিপিএমের মধ্যে। সেইসময় আমাদের এলাকার সিপিএমের একেবারে নিচুতলার এক তরুণ কর্মী বলেছিলেন, ছোট থেকে শুনে আসছি আমাদের দলের নামে একটা ‘আই’ আছে। সেটার গুরুত্ব কী তা তো কোনোদিন টের পেলাম না। জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হলে গোটা দেশ টের পাবে। সেদিনের আড্ডায় অন্য এক কর্মী কংগ্রেসের সমর্থনে সরকারে যাওয়ার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, আজ কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ব, তারপর বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে কোন মুখে ভোট চাইতে যাব লোকের কাছে? শেষপর্যন্ত যিনি ‘আই’-এর প্রভাব দেখার আশা করেছিলেন তাঁকে আশাহত হতে হয়েছিল। জ্যোতিবাবু স্বয়ং সেই নিচুতলার কমরেডের চেয়ে কিছু কম নিরাশ হননি। সরকারে না যাওয়ার পার্টিগত সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও বলেছিলেন, ঐতিহাসিক ভুল হল। জ্যোতিবাবুর জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির শরিক সেই কমরেড অতি সম্প্রতি প্রয়াত হলেন আর যিনি বিরোধিতা করেছিলেন তিনিও এখন বয়সের কারণে খানিকটা নিষ্প্রভ। ইতিমধ্যে সাতাশটা বছর কেটে গেছে, কিন্তু সিপিএমের ‘আই’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে পার্টির নিজেরই দ্বিধা এখনো কাটল না। ইন্ডিয়া জোটের ‘আই’-তে ‘আই’ মেলানো নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপোড়েন তারই প্রমাণ।
সেইসময় সরকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পিছনে ঘোষিত যুক্তি ছিল, এমন কোনো সরকারে যাব না যে সরকার মার্কসবাদী কর্মসূচি লাগু করে উঠতে পারবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের বহু নেতা সরকারে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন এবং তাঁরা মনে করেন ‘কেরালা লবি’ জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। কথাটা সত্যি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের সব নেতাও যে সরকারে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না তা সর্বজনবিদিত। এবারেও দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার পক্ষপাতী নয়। ইন্ডিয়া জোটে সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস – দুই দলই থাকলেও, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং অন্যতম নেতা সুজন চক্রবর্তী বারবারই বলছেন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আর তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও একই কথা বলছেন, কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে এক জোটে থাকা ঠিক হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সিপিএম নেতৃত্বের দ্বিধা স্পষ্ট হয়ে গেছে কো-অর্ডিনেশন কমিটিতে সদস্য না রাখার সিদ্ধান্তে। যদি গোড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হত তাহলে তবু বোঝা যেত। ইন্ডিয়া জোটের সব দল ওই কমিটিতে নেই। কিন্তু যখন কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা হয়, তখন সিপিএমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তাদের প্রতিনিধির নাম পরে জানানো হবে। পরবর্তীকালে হঠাৎ কমিটিতে না থাকার সিদ্ধান্ত হল কেন?
সিপিএম নেতৃত্বের এই দ্বিধার সমালোচনায় অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু অনস্বীকার্য যে বিজেপিবিরোধিতা আর তৃণমূলবিরোধিতার মধ্যে একটি বেছে নেওয়া আজকের সিপিএমের পক্ষে কঠিন। তাদের বিজেপিবিরোধিতার ইতিহাসে কোনো ছেদ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের মত তারা কখনো বিজেপির সঙ্গে জোট সরকার গড়েনি, বিজেপির মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হননি কোনো সিপিএম নেতা। ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকারকে বিজেপি, সিপিএম দুই দলই সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সেবার নির্বাচনে ভোটাররা কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। উপরন্তু স্বল্প সময়ে ভিপি সিংয়ের সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু করা, একজন মুসলমানকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করার মত অভূতপূর্ব কাজ করেছিল। সেই সরকারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি বাবরি মসজিদ ভেঙে উঠতে পারেনি, বাধা পেয়েই সমর্থন প্রত্যাহার করে। অর্থাৎ বিজেপির কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে দেওয়া হয়নি, উল্টে হিন্দুত্ববাদের অতি অপছন্দের গোটা দুয়েক কাজ সেই সরকার করে ফেলেছিল। স্বভাবতই সিপিএম বিজেপিবিরোধী জোটের স্বাভাবিক সদস্য।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু মানুষ যে এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন তা বুঝতে বড় নেতা হতে হয় না। ট্রেনে বাসে বাজারে দোকানে খুচরো কথাবার্তায় গরিব, বড়লোক নির্বিশেষে মানুষের সরকারকে গাল দেওয়ার এরকম উৎসাহ শেষ দেখা গিয়েছিল বামফ্রন্ট আমলের শেষ পর্বে। এই অসন্তোষের কারণ যেমন ফ্ল্যাট থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়া অর্থাৎ যাবতীয় নিয়োগ দুর্নীতি, তেমনই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা নিয়ে দুর্নীতি, একশো দিনের কাজ না পাওয়ার মত বিষয়ও। পরের দুটি বিষয় সরাসরি গ্রামের গরিব মানুষের গায়ে লাগে। তা না হলে মনোনয়ন পর্ব থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত পুকুর চুরির পরেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীরা এতগুলো আসনে জিততে পারত না, বাম-কংগ্রেসের ভোটও বাড়ত না। সংসদীয় রাজনীতিতে জনমতের এই স্রোতকে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের বিরোধী দল অগ্রাহ্য করতে পারে না।
এমতাবস্থায় সিপিএম কী করতে পারত? ইন্ডিয়া জোটে না গিয়ে বলতে পারত আমরা নিজেদের মত করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ব। সেক্ষেত্রে তৃণমূল তো বটেই, সব রঙের সমালোচক সিপিএমকে বিজেপির দালাল বলে দেগে দিত। ইন্ডিয়া জোটে থাকায় যেমন বিজেপি তৃণমূলের দালাল বলছে এবং নিজেদের সদস্য, সমর্থকরাও সন্দেহের চোখে দেখছে। কথা হল, সমালোচকরা কী বলবে তা ভেবে রাজনীতি করা দিশাহীনতার লক্ষণ। এতদিনের দিশাহীনতাই আজকের গাড্ডায় ফেলেছে সিপিএমকে। ইন্ডিয়া জোটে না গেলেই সিপিএমকে বিজেপির দালাল বলার সুযোগ পাওয়া যাবে কারণ ২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যে সিপিএমের সক্রিয়তার অভাবে বিরোধী পরিসর দখল করতে শুরু করে বিজেপি। তৃণমূল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে গায়ের জোরে প্রহসনে পরিণত করার পর নিচের তলার হতাশ সদস্য, সমর্থকরা বিজেপির দিকে ভিড় জমান এবং ২০১৯ সালের লোকসভা আর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি তার ফায়দা তোলে। সিপিএম শূন্যে পৌঁছয়। ফলে ‘পার্টি লাইন’ যা-ই হোক, সিপিএমই বিজেপিকে পুষ্ট করছে – একথা পাটিগাণিতিক সত্য হয়ে যায়। সেই বদনামের ভারে সিপিএম এখন ন্যুব্জ।
এই পরিস্থিতি তৈরিই হত না, যদি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে নেতৃত্ব বাম রাজনীতির লড়াকু বিরোধিতার ঐতিহ্য বজায় রাখতেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর অনতিবিলম্বে সারদা কেলেঙ্কারির পর্দাফাঁস হয়। অথচ সিপিএম একদিনের জন্যও তা নিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়ার মত আন্দোলন করেনি। নারদের ক্যামেরায় শাসক দলের নেতাদের নগদ টাকা ঘুষ নিতে দেখা যায়। সেইসময় বিরোধী নেত্রীর নাম মমতা ব্যানার্জি হলে কলকাতা অচল হয়ে যেত, সূর্যকান্ত মিশ্ররা কেবল বিবৃতি দিয়ে গেছেন। গতবছর মার্চে সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে এবং মীনাক্ষী মুখার্জির উদ্যোগে সিপিএমের আন্দোলনে ঝাঁজ আসে। তার আগে পর্যন্ত রাস্তার চেয়ে টিভির পর্দায় এবং ফেসবুক লাইভেই বেশি দেখা যেত সিপিএম নেতাদের। সরকারবিরোধী মানুষ এত অসহায় যে এই সময়কালে অনেকের মনে বিরোধী নেতাদের শূন্য আসনে শুধু বিজেপি নেতারাই নয়, বিচারকরাও বসে পড়েছেন।
এই দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তার মূল্য হিসাবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও শূন্য পাওয়া তেমন বড় কিছু নয়, যদি বিরোধী হিসাবে বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা হলেও ফেরত আনা যায়। সিপিএম নেতৃত্বের এবং বিজেপিবিরোধী সিপিএম সমালোচকদেরও ভেবে দেখা উচিত, সিপিএম ইন্ডিয়া জোট থেকে আলাদা হয়ে লড়লেই ভাল হয় কিনা। কারণ সিপিএম তৃণমূলবিরোধিতা না করলে আখেরে বিজেপিরই লাভ, তারা আরও বেশি করে তৃণমূলবিরোধী ভোট পাবে। মনে রাখা ভাল, ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি হেরেছে মাত্র হাজার চারেক ভোটে। ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থীর (কংগ্রেস সমর্থিত) জামানত জব্দ হলেও তিনি পেয়েছেন তেরো হাজারের বেশি ভোট। এতগুলো তৃণমূলবিরোধী ভোট কিন্তু বিজেপির ঝুলিতে যেত তৃতীয় পক্ষ না থাকলে। এভাবে ভাবতে হলে অবশ্য সিপিএম নেতৃত্বকে ঠিক করতে হবে লোকসভা নির্বাচনে মূল লক্ষ্য কোনটা। জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিং সুরজিৎদের অন্তত সেই দ্বিধা ছিল না। তাঁরা বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকাতে ১৯৯৬ পর্যন্ত নরসিমা রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকারকে চলতে দিয়েছিলেন।
বিজেপিবিরোধী সাংবাদিকরা বহুকাল ধরেই বিরাট মূল্য দিচ্ছেন, বিজেপির ধ্বজাধারীরাই বা দেবেন না কেন? যুক্তি দিয়ে বিচার করলে তো এই ১৪ জনকে সাংবাদিক বলে ধরাই যায় না।
আমাদের দেশের অলিখিত প্রাচীন নিয়ম – দূত অবধ্য। সাহেবরাও একই মেজাজে বলে থাকে – দূতকে গুলি করবেন না (Don’t shoot the messenger)। দুটো কথার পিছনে যুক্তিটা একই – দূত কোনো পক্ষের লোক নয়, অতএব তাকে প্রতিপক্ষ হিসাবে আক্রমণ করা অন্যায়। সে এক পক্ষের কাছে অন্য পক্ষের বার্তাবাহকমাত্র। ফলে সে নিরস্ত্রও বটে। কিন্তু ধরুন, একজন দূত প্রতিপক্ষের শিবিরে বার্তা দিতে ঢুকল ছত্রপতি শিবাজীর মত বাঘনখ পরে। বার্তা দেওয়ার নাম করে শিবিরে ঢুকে যিনি বার্তা নেবেন তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে চলে গেল। এরপর কি তার আর দূত হিসাবে ছাড় প্রাপ্য? একেবারেই নয়। সে যে ক্ষতি করল তা কিন্তু স্রেফ একজনকে খুন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার এই আচরণের ফলে অন্য দূতেরাও বিপদে পড়বে, কারণ তাদের আর কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। ফলে দূতীয়ালি ব্যাপারটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১৪ সালের পর থেকে (আসলে তার কিছু আগে থেকেই) ভারতের সাংবাদিকতা যেদিকে মোড় নিয়েছে তাকে এইভাবে দেখাই শ্রেয়। বেশিরভাগ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা হয়ে গেছে বাঘনখ পরা দূতের মত। ইদানীং অবশ্য দূত সেজে থাকার নাটকটুকুও ত্যাগ করেছে অনেক সংবাদমাধ্যমই, অথচ দূত হওয়ার সুবিধাগুলো নিয়েই চলেছে। এমতাবস্থায় ইন্ডিয়া জোট ১৪ জন অ্যাঙ্করের তালিকা প্রকাশ করেছে, যাদের শোতে এই দলগুলোর প্রতিনিধিরা যাবেন না। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের স্থান যতই নেমে যাক, যত সাংবাদিকই গ্রেফতার হয়ে যান না কেন, এই অ্যাঙ্কররা কিন্তু দিনরাত দর্শকদের বলে থাকে ভারতের সব ক্ষেত্রেই দারুণ অগ্রগতি হচ্ছে। এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকারের দিক থেকেও। সেই অ্যাঙ্কররাই এই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর একে গণতন্ত্রের উপর আঘাত, বাকস্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি আখ্যা দিচ্ছে। এরা অবশ্য রবীশ কুমার কথিত গোদি মিডিয়ার লোক। কিন্তু যাঁদের কেউ গোদি মিডিয়ার লোক মনে করে না, তেমন কয়েকজনও এই বয়কটের বিরোধিতা করেছেন। যেমন করণ থাপার, রাজদীপ সরদেশাই, সাগরিকা ঘোষ। সুতরাং ব্যাপারটাকে নানা দিক থেকে দেখা প্রয়োজন।
প্রথমেই নিরপেক্ষতার ধারণাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আসলে কেউ নিরপেক্ষ নয়। সাংবাদিক দূরে থাক, ক্রিকেট খেলার আম্পায়ার পর্যন্ত নিরপেক্ষ নন। বোল্ড আর দিনের আলোর মত পরিষ্কার ক্যাচ আউট ছাড়া আর সব আউটের ক্ষেত্রেই ফিল্ডিং দল আম্পায়ারের কাছে আবেদন করে। তিনি আইন মেনে নিজের বিবেচনা মত আউট দেন, প্রয়োজনে অন্য আম্পায়ারের পরামর্শ নেন, কখনো বা প্রযুক্তির সাহায্য নেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত এক দলের পক্ষে যায়, অন্য দলের বিপক্ষে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তাঁকে একটা পক্ষ বাছতেই হয়। বিশেষ করে লেগ বিফোর উইকেটের মত আউটের ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে আম্পায়ারের ব্যক্তিগত মত। আগে এই মতের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল, এখন বিপুল পরিমাণ প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেকখানি কমেছে। তবু দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিও শেষ কথা বলতে পারছে না। তখন টিভি আম্পায়ারের বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে ছাড়ে না, অনেকসময় পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার অভিযোগও ওঠে। ক্রিকেট খেলার দৃষ্টান্ত এই কারণেই দেওয়া, যে জীবনের মত ক্রিকেট খেলাতেও বহু জিনিস মানবিক বিবেচনার উপরেই শেষপর্যন্ত নির্ভরশীল। যেমন বৃষ্টি হওয়ার পরে মাঠ খেলার উপযুক্ত হয়েছে কিনা সেই সিদ্ধান্ত অন্তত এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র দুই আম্পায়ারের বিবেচনার ভিত্তিতেই ঠিক হয়। যেখানেই এই অবকাশ আছে সেখানেই নিরপেক্ষতা বজায় থাকল কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে। এ তো গেল খেলার বিচারকদের কথা। একই কথা আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একই আইনে একই মামলার বিচারে বিচারক বদলালে রায়ও বদলে যায় অনেক সময়। এমনটাই যে স্বাভাবিকতা আইনও তা বিশ্বাস করে। সেই কারণেই নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন জানানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিচারকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হয়, কিন্তু রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইনসম্মত। বিচারকের রায়ের যে ভালমন্দ আছে তাও সর্বজনস্বীকৃত। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “…দণ্ডিতের সাথে/দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে/সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।” এই বিচারে বিচারকের ব্যক্তিগত আদর্শ, মতামত – সবই প্রভাব ফেলে। ফেলতে বাধ্য। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে নিরপেক্ষতা সোনার পাথরবাটি।
এ তো গেল বিচারকদের কথা। সাংবাদিকরা বিচারক নন, হওয়া অন্যায়ও বটে। খোদ সুপ্রিম কোর্ট সংবাদমাধ্যমের বিচারক হয়ে বসা নিয়ে অসন্তুষ্ট। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের বেঞ্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছে, পুলিস ব্রিফিং যেন মিডিয়া ট্রায়ালের সুযোগ না করে দেয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের বরং দূত হওয়ারই কথা। কার দূত? এই প্রশ্নের উত্তরটাই সম্পূর্ণ উলটে দেওয়া হয়েছে আজকের ভারতে।
ইন্ডিয়া জোটের তালিকায় যে ১৪ জন অ্যাঙ্করের নাম রয়েছে তাদের একজন রুবিকা লিয়াকত। তাকে পাশে দাঁড় করিয়ে ‘হিন্দি নিউজ’ চ্যানেলের সিইও জগদীশ চন্দ্র প্রকাশ্যে বলেছে, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেই। কিন্তু আমরা দেশের জনপ্রিয় সরকারের পক্ষে আছি। কেন থাকব না? আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি গ্লোবাল লিডার হয়ে থাকেন, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা বলে গণ্য হয়ে থাকেন, যদি অমিত শাহ ৩৭০ তুলে দিয়ে কাশ্মীরের পরিবেশ বদলে দিয়ে থাকেন… তাহলে তাঁকে অগ্রাহ্য করব কী করে? তাঁকে তাঁর জনপ্রিয়তা অনুযায়ী গুরুত্ব দিতেই হবে। দেশের উপর রাজত্ব করলে আমাদের নেটওয়ার্কের পর্দাতেও রাজত্ব করবেন। এ নিয়ে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই। যাঁরা আমাদের গোদি মিডিয়া বলেন আমি তাঁদের খুব বিনীতভাবে বলছি, আমরা গোদি মিডিয়া নই। কিন্তু যা বাস্তব তাকে কী করে অস্বীকার করি? এই তো ২০২৪ নির্বাচন এসে গেল। কাল আপনারা সরকারে আসুন; প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে যান। কথা দিচ্ছি যতখানি কভারেজ আর লাইভ টেলিকাস্ট মোদী আর অমিত শাহের করেছি ততটাই আপনাদেরও করব।
অন্য এক অ্যাঙ্কর ‘আজ তক’ চ্যানেলের চিত্রা ত্রিপাঠী। সে এক টক শোতে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে ইদানীং সোশাল মিডিয়ার সূত্রে বিপুল জনপ্রিয় ব্যঙ্গাত্মক গানের শিল্পী নেহা সিং রাঠোরকে ডেকে কেন তিনি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীদের ব্যঙ্গ করে গান করেন তা জিজ্ঞেস করেছিল। নেহা পালটা পক্ষপাতের প্রশ্ন তোলায় চিত্রা বলে, আপনি যাঁদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা কিন্তু ৫-৭ লাখ ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন। জনগণ ভোট দিয়েছে, নিজের পকেট থেকে তো আর ভোট বার করেননি।
দুজনেরই বক্তব্য আসলে এক। যে জিতেছে তার পক্ষে আছি, তার পক্ষে থাকাই আমাদের কাজ। আসলে দুজনেই জানে, গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের হওয়ার কথা দর্শকের, অর্থাৎ নাগরিকদের, দূত। সেই ভানটা বজায় রাখার জন্যেই একজন যোগী আদিত্যনাথ আর শিবরাজ সিং চৌহান কত বড় ব্যবধানে জিতে এসেছেন তা উল্লেখ করেছে। অন্যজন বলেছে যারা জনপ্রিয় হবে তাদেরই কভারেজ দেব। এই ভানের সরটুকু আলাদা করে নিলে যা পড়ে থাকে তা হল, যে ক্ষমতায় থাকবে তার পক্ষেই থাকব। আমি তার দূত।
এই ভাবনাই ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোদি মিডিয়া বলা যায় না যাদের, সেইসব সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও প্রতিবেদকরাও অনেকে এরকমই মনে করেন। ক্ষমতার সমর্থনে দাঁড়ানো নয়, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই যে সংবাদমাধ্যমের কাজ — তা বিস্মৃত। ভারতে একসময় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস কমিউনিকেশন, এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজমের মত দু-একটা জায়গা ছাড়া কোথাও সাংবাদিকতা ও গণসংযোগ আলাদা করে পড়ানো হত না। গত কুড়ি বছরে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বছর বছর পাস করে বেরিয়ে অনেকে সাংবাদিকও হচ্ছেন। অথচ দেখা যাচ্ছে প্রথাগতভাবে লেখাপড়া না করা সাংবাদিকদের আমলেই সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা ঠিক ছিল। এর পিছনে আসলে ক্লাসরুমের দায় তত নয়, যতটা পাস করে সকলে যেখানে কাজ করতে যায় তার। ডাক্তারির মত সাংবাদিকতাও সবটা শেখা হয় না ‘প্র্যাকটিস’ না করলে। সেখানেই গলদ। ডাক্তাররা তবু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারেন। সাংবাদিকতায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস বলে কিছু এখনো সেভাবে নেই। এতকাল উপায়ও ছিল না। আগে রবীশ কুমারের মত সাংবাদিককে চাকরি ছাড়তে হলে একেবারে চুপ হয়ে যেতে হত। কারণ অন্য কোনো সংবাদমাধ্যম জায়গা না দিলে নিজের সাংবাদিকতা লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উপায় ছিল না। এখন ইউটিউব চ্যানেল, টেলিগ্রাম চ্যানেল, ফেসবুক পেজ ইত্যাদি নানা ব্যবস্থা হয়েছে। ফ্রিলান্স সাংবাদিকতা আগেও ছিল, এখনো আছে বটে। কিন্তু সেই সাংবাদিকের কাজ প্রকাশ করতে রাজি এমন সংবাদমাধ্যম তো দরকার। সরকারবিরোধী কাজ করতে উৎসাহী ফ্রিলান্স সাংবাদিকদের ভরসা কিন্তু এখন বিকল্প সংবাদমাধ্যম। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তাঁদের জায়গা ক্রমশ কমে আসছে। আর কেউ যদি মূলধারার চাকুরে সাংবাদিক হন, তাহলে তিনি সত্যিকারের সাংবাদিকতা করতে চাইলেও পারবেন না। মালিকরা জগদীশ চন্দ্রের মত সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বসে আছে। যেহেতু টিভি দেখেন অনেক বেশি মানুষ, সেহেতু ইন্ডিয়া জোট আপাতত অ্যাঙ্করদের বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এমন নয় যে খবরের কাগজের চিত্রটা একেবারে আলাদা।
এখানেই এসে পড়ে ইন্ডিয়া জোটের সিদ্ধান্তের সার্থকতার প্রশ্ন। সাংবাদিকের স্বাধীনতা আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কিন্তু এক নয়। সাংবাদিক নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারেন না। আজকের ভারতে তো আরওই পারেন না। বহু সম্পাদক, প্রতিবেদকের চাকরি গেছে বিজেপির ঢাক বাজাতে রাজি না হওয়ায়। মাত্র কয়েকদিন আগে জানা গেছে এনডিটিভির ব্যুরো চিফ সোহিত মিশ্রের পদত্যাগের খবর। তাঁকে নাকি বলা হয়েছিল গৌতম আদানির সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে রাহুল গান্ধীর সাংবাদিক সম্মেলন ভেস্তে দিতে। তিনি রাজি হননি, তাই পদত্যাগ করতে হয়।
এই পরিস্থিতিতে আস্ত চ্যানেল বয়কট না করে শুধুমাত্র কয়েকজন অ্যাঙ্করকে বয়কট করে কী লাভ, সে প্রশ্ন তোলা সঙ্গত। কিন্তু বয়কটের সিদ্ধান্তটাই ভুল — এ কথা আদৌ বলা চলে না। কারণ একাধিক, যদিও ইন্ডিয়া জোট প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কোনো কারণ নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। জোটের বিভিন্ন নেতা ব্যক্তিগতভাবে নানা কারণ দর্শিয়েছেন।
প্রথমত, এই চ্যানেলগুলোর প্রধান আকর্ষণ ওই অ্যাঙ্করদের ঘৃণা বর্ষণকারী তথাকথিত বিতর্ক সভা। সেখানে বিতর্ক হয় না, হয় অ্যাঙ্করের মদতে ভারতের সংখ্যালঘু এবং সমস্তরকম বিজেপিবিরোধী মানুষের প্রতি অবিরাম ঘৃণার চাষ। সে কাজে প্রয়োজন মত ভুয়ো খবর, নির্জলা মিথ্যাভাষণ – সবই ব্যবহার করা হয়। অ্যাঙ্করের যে বক্তব্য পছন্দ তার বিপরীতে যে মুখপাত্ররা বলতে আসেন তাঁদের প্রায় কিছুই বলতে দেওয়া হয় না। হয় ধমকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, নয়ত তাঁর মত যে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘জেহাদি’ তা চিৎকার করে বারবার বলা হয়। ফলে এই শোগুলোতে যাওয়ার যে যুক্তি রাজনৈতিক দলগুলো দেখিয়ে থাকে – নিজেদের মত জনপরিসরে জানানো – বিজেপিবিরোধীদের ক্ষেত্রে তা ভোঁতা হয়ে গেছে। এইসব শোতে যাওয়া মানে বরং বিজেপির সুবিধা করে দেওয়া। তার চেয়েও বড় কথা, ১৯৯০-এর দশকে আফ্রিকার দেশ রোয়ান্ডার গৃহযুদ্ধে রেডিও রোয়ান্ডা সংখ্যালঘু হুটুদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ঘৃণাভাষণ চালিয়ে তাদের যেভাবে অবমানবে পরিণত করেছিল টুটসিদের চোখে, ঠিক সেই কাজ এই অ্যাঙ্কররা করে চলেছে। সুতরাং এদের শোতে গিয়ে বসা মানে সেই কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া, পরোক্ষে মদত জোগানো।
দ্বিতীয়ত, এই অ্যাঙ্করদের সঙ্গে অন্য সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের তো বটেই, ওই চ্যানেলগুলোরই আর পাঁচজন সাংবাদিকেরও তফাত আছে। এরা প্রত্যেকে মহার্ঘ মাইনে পায় এবং অনেকেই কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে বসেছে। অর্ণব গোস্বামী তো ‘টাইমস নাও’ চ্যানেলে এই অসভ্যতা চালিয়ে এত জনপ্রিয় হল যে নিজস্ব চ্যানেলই খুলে ফেলল। সুতরাং এরা নেহাত ঠেকায় পড়ে একপেশে সরকারি প্রচার চালায় না, ঘৃণাভাষণ দেয় না। বরং এরাই চ্যানেলের এজেন্ডা তৈরি করে। ফলে এদের ঘৃণা ছড়াতে বাধা দেওয়া যথেষ্ট না হলেও আবশ্যিক। বহু ভাসমান ভোটার এবং বিজেপিবিরোধী ভোটারও হাঁ করে এইসব চ্যানেল দেখে থাকেন। এই বয়কট তাঁদেরও এক প্রচ্ছন্ন বার্তা দেবে যে এই অ্যাঙ্কররা যা করে তা যথার্থ নয়, কারোর জন্যে ভাল নয়। এতে ভাসমান ভোটারদের কেউ কেউ হয়ত বিজেপির দিকে ঢলে পড়বেন, কিন্তু উলটোটাও ঘটবে। ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোর সমর্থক যে ভোটাররা, তাঁদের উপর তো এই সিদ্ধান্তের স্পষ্ট প্রভাব পড়া উচিত।
তৃতীয়ত, এই বয়কট কোনোভাবেই সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের স্বাধীনতা হরণ নয়। এখানে কোনো সাংবাদিককে তার মতামতের জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে না, তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, খুন করা হচ্ছে না। এর প্রত্যেকটাই ভারতে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিজেপি আমলে (ইন্ডিয়া জোটের কোনো কোনো দলের শাসনে থাকা রাজ্যেও ঘটছে। খড়্গপুরের সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচীর কথা স্মর্তব্য), অথচ তার বিরুদ্ধে কোনোদিন টুঁ শব্দ করেনি এই অ্যাঙ্কররা। সে না হয় তাদের স্বাধীনতা। কথা হল এই বয়কট সত্ত্বেও তারা শো চালিয়ে যেতে পারে, শুধু কয়েকটা রাজনৈতিক দল সেই শোয়ে অংশগ্রহণ করবে না। আপনার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মাতাল চিৎকার করে আপনাকে, আপনার পরিবারকে অকথ্য গালিগালাজ করছে। আপনি যদি বাড়ির জানলা বন্ধ করে দেন, তাহলে মাতালরা কি বলতে পারে, বাকস্বাধীনতা হরণ করা হল? এ প্রসঙ্গে বাকস্বাধীনতার প্রশ্ন তোলা একইরকম হাস্যকর।
চতুর্থত, সরকার তথা বিজেপির বিজ্ঞাপনের লোভে এবং/অথবা সরকারি চাপে যেসব সংবাদমাধ্যম বিজেপির মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা আর সাংবাদিকতার বিশেষ ছাড়গুলো দাবি করতে পারে না। কারণ সরকারবিরোধীদের সেই ছাড় এরা নিজেরাই দেয়নি। যে কোনো দেশে সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ হল একতা। পাঠক/দর্শকদের অবাক লাগতে পারে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে বর্তমানের সাংবাদিককে প্রশাসনের কেউ কিছু বললে গণশক্তির সাংবাদিকও বর্তমানের সাংবাদিকের পাশে দাঁড়াবেন – এটাই ছিল নিয়ম। সারা পৃথিবীতেই তাই হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে অপছন্দের প্রশ্ন করার জন্যে একজন সাংবাদিককে আক্রমণ করলে অন্য সব সাংবাদিক একজোট হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াতেন। প্রায় সব পেশাতেই এটাই নিয়ম। কারণ পেশাদারি প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই তীব্র হোক, নিজেদের মধ্যে একতা না থাকলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় না। আর সাংবাদিকতা করা মানেই রাষ্ট্রের ত্রুটিবিচ্যুতির দিকে আঙুল তোলা। ভারতে এই একতা কিন্তু যত্ন করে নষ্ট করেছে গোদি মিডিয়া। অর্ণবই প্রথম টাইমস নাওয়ের স্টুডিও থেকে সরকারবিরোধী খবর করে এমন চ্যানেলের অ্যাঙ্কররা পাকিস্তানের মদতপুষ্ট, শহুরে নকশাল – এমন সব অভিযোগ করতে শুরু করে। দর্শকরা মুসলমান, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, রাহুল গান্ধী-সোনিয়া গান্ধী, কমিউনিস্ট ইত্যাদির মত ওইসব সাংবাদিকদেরও যেন ঘৃণা করে – এই কামনা অর্ণব সরাসরিই করত। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্যান্য চ্যানেলের অ্যাঙ্কররাও। এখন ঝাঁকের কই হতে চাইলে চলবে কেন?
এবার একটু নিরপেক্ষতার বিচারে ফেরত আসা যাক। গোদি মিডিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই অনেকে বলেন, অন্য মিডিয়াগুলো নিরপেক্ষ নাকি? চাকরিজীবনে সিনিয়র সহকর্মীদের সঙ্গে বিজেপির সংবাদমাধ্যমকে করতলগত করা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা এর সপক্ষে যুক্তি খাড়া করেই রেখেছেন – “এসব চিরকালই হয়”। বস্তুত পৃথিবীর সমস্ত অন্যায়ই চিরকাল হয়। রামায়ণ-মহাভারত খুললেই তা টের পাওয়া যায়, কোনো প্রবীণ সাংবাদিকের প্রজ্ঞার প্রয়োজন নেই। ইদানীং অন্যায়ের কোন দিকটা নতুন তা চিহ্নিত করতে হয় এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। নইলে ঝাড়ে বংশে বিনষ্ট হতে হয়।
গত কয়েক বছরে যা নতুন তা হল বিজেপির বিপুল আর্থিক ক্ষমতা। ইলেক্টোরাল বন্ডের সুবাদে বিজেপি যে টাকার পাহাড়ে বসে আছে তা ভারতের কোনো দল কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। এর প্রমাণ বিজেপির পার্টি অফিসের কলেবর থেকে শুরু করে তাদের নির্বাচনী প্রচারের জাঁকজমক – সবেতেই টের পাওয়া যায়। সেই টাকার ভাগ পাওয়ার জন্য, সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য, বিজেপির সঙ্গে খাতিরের সুবাদে নিজের অন্য ব্যবসাগুলোর শ্রীবৃদ্ধি করার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকরা দিনকে রাত, রাতকে দিন করছেন। অর্থাৎ সাংবাদিকতায় দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে কিছু সাংবাদিক দুর্নীতিগ্রস্ত হতেন বা বিশেষ কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হতেন। মালিকেরও বিলক্ষণ পক্ষপাত থাকত। কিন্তু অন্তত বাজারের স্বার্থে, দর্শক/পাঠক ধরে রাখতে তাঁকে কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হত। একই সংবাদমাধ্যমে নানা দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট সাংবাদিক থাকতেন। তাঁদের মধ্যে আলাপ আলোচনা, ঝগড়াঝাঁটি, লেঙ্গি মারা, হাসিঠাট্টা সবই চলত। এই দ্বন্দ্বের ফলে দর্শক/পাঠক যা পেতেন তাতে শেষমেশ এক ধরনের সাম্যবিধান হত। তিনটে চ্যানেল দেখলে হয়ত একটা ঘটনাকে তিনরকম দেখাত। কিন্তু তা থেকে দর্শক সত্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছতে পারতেন। এখনকার মত সর্বত্র একই মিথ্যা বয়ান চলত না। কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেই আগে নিউজরুমগুলোকে মনে হত মাছের বাজার, এখন মনে হয় কল সেন্টার। দারুণ নিয়মানুবর্তী, দারুণ শান্তিপূর্ণ। শ্মশানের শান্তি। এই শান্তি যে সাংবাদিক ভাঙেন তাঁর চাকরি যায় বা তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়। যেমন রবীশ ছেড়েছেন, সোভিত ছেড়েছেন।
আগেই বলেছি কেউ নিরপেক্ষ নয়। আক্ষরিক অর্থে নিরপেক্ষ হওয়া প্রার্থনীয়ও নয়। কয়েকজন মানুষ মিলে একজনকে সাংবাদিকের চোখের সামনে পিটিয়ে মারল। সাংবাদিক যদি প্রতিবেদনে বলেন ‘এরা মেরে অন্যায় করেছে, তবে লোকটাও প্ররোচনা দিয়েছিল’, তাহলে তিনি তো আসলে খুনীদের পক্ষে দাঁড়ালেন। তাঁকে বলতেই হবে খুনীরা অন্যায় করেছে, কোনো প্ররোচনা থাকুক আর না-ই থাকুক। অর্থাৎ তাঁকে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, এক্ষেত্রে যার অর্থ হবে যে খুন হয়েছে তার পক্ষে দাঁড়ানো। এলবিডব্লিউ আবেদন নাকচ করে দেওয়ার সময়ে যেমন আম্পায়ার ব্যাটারের পক্ষের লোক হয়ে যান ক্ষণিকের জন্য। সুতরাং সংবাদমাধ্যম সত্যের পক্ষে দাঁড়াক – এটুকুই ন্যায্য দাবি। সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ হোক – এ দাবি অর্থহীন। বিশেষত আজকের ভারতে সংবাদমাধ্যমকে পক্ষ নিতেই হবে এবং তার মূল্যও চোকাতে হবে। বিজেপিবিরোধী সাংবাদিকরা বহুকাল ধরেই বিরাট মূল্য দিচ্ছেন, বিজেপির ধ্বজাধারীরাই বা দেবেন না কেন? যুক্তি দিয়ে বিচার করলে তো এই ১৪ জনকে সাংবাদিক বলে ধরাই যায় না। তাদের নরেন্দ্র মোদীর গুণমুগ্ধ বলা যেতে পারে, সরকারের মুখপাত্রও বলা যেতে পারে। এগুলো তো গালাগালি নয়। এরা নিজেরা বা এদের চ্যানেলের মালিকরা নিজমুখেই তো অন্য সময় এগুলো বলে। এখন হঠাৎ রেগে যাওয়ার যুক্তি নেই। কিন্তু রেগে যাচ্ছে, এই বয়কটে জরুরি অবস্থার মানসিকতার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে বলছে।
অর্ণবভক্তরা শুধু নয়, অর্ণবের শো দেখেন না এবং পছন্দ করেন না এমন অনেকেরও ধারণা এই বয়কটে অর্ণবের কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু তেমন হলে এ নিয়ে সে এত উত্তেজিত হত না। অর্ণব এবং তার দর্শকদের যে ধর্ষকাম মানসিকতা বিপক্ষের লোকেদের ডেকে এনে ধমকে তৃপ্তিলাভ করে, এই বয়কটের ফলে তাতে অসুবিধা হবে। ধর্ষকাম মানুষ কামনা চরিতার্থ না হলে কতটা রিপাবলিক টিভি দেখবেন তা নিশ্চিত নয়। টিআরপি পড়ে যেতে পারে। তা যদি না-ও হয়, কানাঘুষো যা শোনা যাচ্ছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে ১৪ জন অ্যাঙ্করের চ্যানেলেরই সমূহ বিপদ। শোনা যাচ্ছে ইন্ডিয়া জোটের দলগুলো যেসব রাজ্যে আছে সেখানকার সরকারগুলো নাকি এই চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। আগেও লিখেছি যে এখন সকালে যে কাগজটা হাতে পান সেটা আসলে আপনার কথা ভেবে তৈরি নয়, ওটা বিজ্ঞাপনদাতার রসিদ। কারণ কাগজ ছাপার খরচটুকুও আপনার দেওয়া কাগজের দামে ওঠে না। তেমনই টিভি চ্যানেলও চলে বিজ্ঞাপনদাতার টাকায়। সেখানে অতগুলো রাজ্যের সরকারি বিজ্ঞাপন আসা বন্ধ হয়ে গেলে টানাটানির সংসার হয়ে যাবে। অতএব অর্ণবের উত্তেজনার মধ্যে চাপা ভয়ও লুকিয়ে আছে।
তবে ইন্ডিয়া জোটের এই ব্যবস্থা সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
১) এই কজন অ্যাঙ্করের বাইরে কি আর কেউ নেই যে একই দোষে দুষ্ট? ২) হিন্দি বাদে অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার চ্যানেল এবং তাদের অতি উদ্ধত, অপছন্দের মুখপাত্রকে “কে তুমি” বলে ধমকানো, অ্যাঙ্করদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই? ৩) ভোটের আর ৭-৮ মাস বাকি। এখন এই ব্যবস্থায় কতটা আটকানো যাবে গণমাধ্যমে ঘৃণাভাষণ আর মিথ্যার বেসাতি? ৪) এই অ্যাঙ্করদের বাদ দিয়ে বিকল্প সংবাদমাধ্যমগুলোকে বেশি কভারেজের সুযোগ দেবে কি ইন্ডিয়া জোট? যেমন ধরা যাক, রবীশ কুমারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাহুল গান্ধী।
বিকল্প পথের সন্ধান করতে না পারলে কিন্তু এই সদুদ্দেশ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত সফল হবে না। দেশের সংবাদমাধ্যমের ভোল পালটানোর কাজ শুরু হবে না।
মোহন ভাগবত বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে।
যা রটে তার কিছু
যেদিন বিজেপিবিরোধী জোটের নামকরণ হল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স, সংক্ষেপে ইন্ডিয়া, সেদিন সঙ্ঘ পরিবারের প্রবল বিরোধী এক অগ্রজ বন্ধু বলেছিলেন “সবই ভাল, কিন্তু সেই অ্যাংলোফাইল নামটাই ধরে থাকতে হল? ইন্ডিয়া না করে কোনোভাবে ভারত করা গেল না নামটা?” তিনিও অবশ্য স্বীকার করেছিলেন, গত এক দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে যেভাবে বিজেপিই ঠিক করে দিয়েছে ইস্যু কোনটা আর বিরোধীরা কেবল তার বিরোধিতা করে গেছে, সেই ধারা উলটে দিয়েছে ওই নাম। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, সরকারি দলের মুখপাত্র এবং তাদের কুখ্যাত আই টি সেল হিমশিম খাচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক আলোচনার যে মানদণ্ড তারাই তৈরি করেছে, তাতে ইন্ডিয়া নামধারী কাউকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা চলে না। বললেই পালটা আক্রমণ হবে “তার মানে আপনি অ্যান্টি-ইন্ডিয়া?” নাম যে সবকিছু নয়, চরম দেশদ্রোহী কোনো দলও নিজের নামের সঙ্গে দেশের নাম জুড়তেই পারে – এই যুক্তির বাজার বিজেপি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে বহুকাল হল। বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের নাম বদলে প্রয়াগরাজ রাখা হয়েছে, মোগলসরাই হয়ে গেছে দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। এগুলো তো প্রাচীন জায়গা, সাম্প্রতিককালে ঝাঁ চকচকে শহর হয়ে ওঠা গুরগাঁওয়ের নাম পর্যন্ত বদলে গুরুগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির ঔরঙ্গজেব রোডেরও নাম বদলে গেছে। কারণ বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার মনে করে নাম ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্যাঁচে পড়ে শেক্সপিয়র সাহেবের মত নামে কী আসে যায় বললে নিজেদের সমর্থকরাই শুনবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখনিঃসৃত বাণী সমর্থকদের কাছে অমৃতসমান। তাই তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নামেও ইন্ডিয়া থাকে বলে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হল না দেখে শেষ চেষ্টা ছিল ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে ‘ঘমন্ডিয়া’ বলা। কিন্তু দেখা গেল, ওটা ‘মিত্রোঁ’ বা ‘ভাইয়োঁ ঔর বহনোঁ’-র অর্ধেক জনপ্রিয়তাও অর্জন করতে পারল না। ফলে নামের লড়াইটা তখনকার মত ইন্ডিয়া জোট জিতেই গিয়েছিল।
কিন্তু হার স্বীকার করে নেওয়া বিজেপির স্বভাব নয়। হলে একাধিক রাজ্যে ভোটে না জিতেও তারা সরকার গঠন করতে পারত না। তাছাড়া সত্যোত্তর পৃথিবীর বাস্তবতা বিজেপির মত করে কেউ বোঝে না। তারা জানে, আজকের দুনিয়ায় বাস্তবে কী ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে বড় কাজ হল মানুষ কী জানছে এবং জেনে কী ভাবছে তা নিয়ন্ত্রণ করা। অতএব যা ভাবলে আমার সুবিধা লোককে সেটাই ভাবাতে হবে, অন্য কথা ভাবার ফুরসত দেওয়া চলবে না। সুতরাং অবিলম্বে চলে এল জল্পনা কল্পনা চালানোর মত বিষয় – এক দেশ, এক নির্বাচন। আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসবে ঘোষণা করা হল এবং কী নিয়ে আলোচনা হবে তা সংসদীয় প্রথায় প্রকাশ না করে গোদি মিডিয়াকে দিয়ে সম্ভাবনা হিসাবে ভাসিয়ে দেওয়া হল এক দেশ, এক নির্বাচনের কথা। এতে বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল এই পরিকল্পনার বিরোধিতায়, নিজেদের সরকারবিরোধী বক্তব্যগুলো আর মানুষের সামনে তুলে ধরার সময় রইল না। জনপরিসর থেকে হারিয়ে গেল মণিপুর, হরিয়ানার দাঙ্গা, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, বিদেশের সংবাদমাধ্যমে আদানি গ্রুপের আর্থিক দুর্নীতির নতুন প্রমাণ সামনে আসায় তাদের বিরুদ্ধে ফের ওঠা যৌথ সংসদীয় তদন্তের দাবি। এক দেশ, এক নির্বাচন নিয়ে হইচই না কাটতেই সরকারপক্ষ নিয়ে এসেছে আরেক অনন্ত জল্পনার বিষয় – দেশের নাম ইংরেজিতেও ইন্ডিয়া থেকে বদলে ভারত করে দেওয়া হবে কি?
এমনিতে বিজেপির ভোটসর্বস্বতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্রেফ ভোটে জেতার জন্যে তারা করতে পারে না এমন কাজ নেই। ফলে এক দেশ, এক নির্বাচন চালু করা অথবা দেশের নাম বদলানোর দিকেও এগোতেই পারে। বিজেপির পুরনো বন্ধু এবং উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ইদানীং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া মায়াবতী যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন রাজনৈতিক সংগঠন বা জোটের নামে ইন্ডিয়া ও ভারত শব্দ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করার আবেদন নিয়ে, হাস্যকরভাবে ইন্ডিয়া জোটকে দায়ী করেছেন বিজেপিকে দেশের নাম বদলে দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য, তাতে এই সন্দেহ জোরদার হয়। কিন্তু এহ বাহ্য। আলোচনাটা আরেকটু গভীরে গিয়ে করা দরকার।
যেখানে বাঘের ভয়
লক্ষণীয় যে এক দেশ, এক নির্বাচন এখনো স্রেফ জল্পনার বিষয় হলেও (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটা কমিটি তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করা হয়নি) দেশের নাম সরকারিভাবে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত সরকারের তরফ থেকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতিকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ লিখে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা স্রেফ কারোর স্বপ্নার্দ্র বিছানার জিনিস হয়ে নেই, সরকারি কাগজপত্রে লিখিত আকারে এসে পড়েছে। সুতরাং সাধারণ মানুষের এ নিয়ে আলোচনা না করে উপায় নেই। কারণ এতে আমার-আপনার – জনপ্রিয় লব্জে বললে করদাতার – টাকা জড়িয়ে আছে। মানে সমস্ত সরকারি কাগজপত্রে যদি কাল থেকে ‘গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ হয়ে দাঁড়ায় ‘গভমেন্ট অফ ভারত’, তাহলে স্রেফ লেটারহেড ছাপাতে কত কোটি টাকা খরচ হবে ভাবুন।
ইদানীং সরকার এবং তার ন্যাওটা সংবাদমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিখ্যাত ক্রিকেটার, চিত্রতারকা ইত্যাদি বিশেষ অজ্ঞরা সরকারের যে কোনো কার্যকলাপের উপকারিতা প্রমাণ করতে প্রথমেই বোঝায় কাজটা করলে করদাতাদের কত টাকা বাঁচবে। ১৯৯১ সালের পর থেকে যেমন সরকার এবং তার ন্যাওটারা অহোরাত্র বোঝাত ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’, এ খানিকটা সেইরকম। যেমন ‘এক দেশ এক নির্বাচন ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচবে’, ‘ভর্তুকি তুলে দেওয়া ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচে’। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় ওটাই সরকারের কাজের ভালমন্দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড, তাহলে কিন্তু সর্বত্র ‘ইন্ডিয়া’ বদলে ‘ভারত’ করার পরিকল্পনাকে কোনোভাবেই ভাল বলা যাবে না। কারণ এতে করদাতাদের টাকা তো বাঁচবেই না, উলটে একগাদা টাকা খরচ হবে। টাকার কথা যখন উঠলই, তখন খেয়াল করিয়ে দেওয়া যাক – শুধু গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া নেই, আছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াও। সেটাও কি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ভারত হবে? হলে টাকা কি নতুন করে ছাপা হবে? সেক্ষেত্রে পুরনো নোটগুলোকে কি চলতে দেবে সরকার? নাকি আরও একচোট নোটবন্দির খাঁড়া ঝুলছে আমাদের মাথার উপরে?
কথাটাকে সোশাল মিডিয়া জোক মনে হচ্ছে? মনে রাখবেন, দেশের বর্তমান সরকার জোকারের মত সব এলোমেলো করে দিতেই ভালবাসে। তাতে মানুষের প্রাণ গেলেও কুছ পরোয়া নেই। রাজ কাপুর অভিনীত জোকার নয়, হিথ লেজার বা জোয়াকিন ফিনিক্স অভিনীত জোকার। তার অন্তত দুটো প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে – নোটবন্দি আর চার ঘন্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন।
ভারত এক খোঁজ
অবশ্যই শুধু করদাতাদের টাকা খরচ হবে বলে ভারত নাম ব্যবহারে বিরোধিতা করা চলে না। ও রাস্তায় হাঁটলে শেষমেশ অনেক ভাল কাজেরই বিরোধিতায় গিয়ে পৌঁছতে হবে। ঠিক যে রাস্তায় মোদী সরকার হাঁটছে। দেশে এত ঘন ঘন নির্বাচন হয়, তাতে করদাতাদের বিপুল টাকা খরচ হয়। অতএব গোটা দেশে একসঙ্গে লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচন হোক – টাকা বাঁচবে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিয়ে টাকা বাঁচানো যদি ঠিক হয়, তাহলে কিছুদিন পরে বলা যেতেই পারে, নির্বাচন ব্যাপারটারই দরকার নেই। একশো শতাংশ টাকা বেঁচে যাবে। পঞ্চায়েত, পৌরসভা, কর্পোরেশনগুলোর ব্যাপারে নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতেই তাই বলা হবে। সুতরাং অন্য যুক্তিতে আসি।
এতদিন যাঁরা জানতেন না, তাঁরাও গত কয়েকদিনের আলোচনায় নিশ্চয়ই জেনে গেছেন যে আমাদের দেশটার নাম সাংবিধানিকভাবেই ইন্ডিয়া এবং ভারত – দুটোই। সংবিধানের একেবারে প্রথম অনুচ্ছেদেই পরিষ্কার লেখা আছে “India, that is Bharat, shall be a Union of States.”
বস্তুত সংবিধান সভার বিতর্কে নাম নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল এবং সবাই যে ইন্ডিয়া শব্দটা ব্যবহার করা নিয়ে একমত ছিলেন তা নয়। শেষমেশ দুটো নামই থেকে যায়। এমন নয় যে ভারত নামটাকে ব্রাত্য করে দিয়ে স্রেফ বিদেশি লব্জের ইন্ডিয়াকেই দেশের সরকারি নাম করে দেওয়া হয়েছিল, যা এখন দক্ষিণপন্থীরা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আদৌ ইন্ডিয়া কেন? সব ভাষাতেই ভারত নয় কেন? আমার বন্ধু যা বলেছেন সেটা কি সত্যি? ইন্ডিয়া শব্দটা কেবল ভারতের অ্যাংলোফাইলরা, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষাসর্বস্ব উচ্চকোটির লোকেরা ব্যবহার করেন? ও নাম আপামর ভারতবাসীর পছন্দের নাম নয়?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে মনে রাখা ভাল, বহু ভাষাভাষী এবং ভাষার ভিত্তিতে তৈরি প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত দেশ ভারতে এক রাজ্যের মানুষের সঙ্গে অন্য রাজ্যের মানুষের সংযোগের ভাষা কী হওয়া উচিত, সরকারি কাজের ভাষা কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে স্বাধীনতার আগে থেকেই বিতর্ক চলছে। এমনকি সংবিধানের ৩৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় লেখা আছে দেশের সরকারি ভাষা হবে দেবনাগরী লিপিতে লেখা হিন্দি।
তারপর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ১ নম্বরে যা-ই লেখা থাক, এই সংবিধান চালু হওয়ার পরে ১৫ বছর দেশের সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরিজির ব্যবহার চলতে থাকবে। আবার ৩ নম্বর ধারাতেই বলা হয়েছে, বর্তমান অনুচ্ছেদে (অর্থাৎ ৩৪৩ নম্বরে) যা-ই বলা থাক, ওই ১৫ বছর কেটে গেলে ইংরিজি ভাষার ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে। ৩৪৩-৩৫১ অনুচ্ছেদগুলো পড়লে হিন্দি ভাষার প্রতি সংবিধানের পক্ষপাত দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়। ৩৫১ নম্বরে তো হিন্দি ভাষার প্রসারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই অনুচ্ছেদের শেষাংশে একেবারে হেডমাস্টারি কায়দায় বলা হচ্ছে শব্দভাণ্ডার প্রসারিত করার প্রয়োজনে প্রধানত সংস্কৃতের কাছে হাত পাততে হবে (“…for its vocabulary, primarily on Sanskrit and secondarily on other languages”)। ঘটনা হল, ভারত শব্দটা এসেছে সংস্কৃত থেকে এবং ব্যবহার হয় মূলত হিন্দি ও উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলোতে। ফলে বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের মানুষের সঙ্গত কারণেই এই শব্দটাকে দেশের নাম বলে মেনে নিতে আপত্তি আছে। প্রাচীন শাস্ত্র ও পৌরাণিক সাহিত্যে যে ভারতের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কিন্তু দাক্ষিণাত্য পড়ে না। মহাভারতে কটা কথা আছে দক্ষিণ ভারত নিয়ে? বাঙালিদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, তামিল, মালয়ালমের সঙ্গে সংস্কৃতের অনেক মিল। অতএব ওগুলো সংস্কৃত থেকেই এসেছে। কিন্তু তামিলরা অনেকেই মনে করেন তাঁদের ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি। বরং দাক্ষিণাত্যের সমস্ত ভাষার জন্ম তামিল থেকে। আর্য সভ্যতার থেকে দ্রাবিড় সভ্যতা একেবারেই পৃথক। সাম্প্রতিক অতীতে তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলায় ২৬০০ বছরের পুরনো এক সভ্যতার খোঁজ মেলার পর তাকে ‘ভারতম’ সভ্যতা বলা হবে, নাকি ‘দ্রাবিড়ম’ – এই নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছিল ওই রাজ্যের রাজনীতি।
অর্থাৎ আমরা বিন্ধ্য পর্বতের এপারে আছি বলেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতিতে ভারত শব্দটার প্রাঞ্জল উপস্থিতি। কিন্তু কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সমস্ত ভারতবাসী ভারত বলেই দেশটাকে চেনেন বা চিনতে পছন্দ করেন – এরকম ভাবনায় গলদ আছে। এমনকি বাঙালিরা সকলে ভারত শব্দটাই ভাবে – এমন ধারণাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে সাপ্তাহিক কালান্তর-এ প্রকাশিত দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিপোর্টাজ ‘আমি ইন্ডিয়া’ পড়লে
এই বয়েসে আবার উদ্বাস্তু। বন্যার তিনমাস পরেও একটা তাঁবু জোটাতে পারেন নি। সমর্থ মেয়ে-জামাই আর বছর দশেকের ছেলেটাকে নিয়ে চারদিক খোলা একটা ছাউনির তলায় খড় বিছিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। অথচ এখনও ওঁর মাথা ছুঁয়ে পূর্ণিমার চাঁদ।
‘পাকিস্তান ছেড়ে কবে এসেছিলেন?’ আশ্চর্য উত্তর দিলেন বুধেশ্বরী। ছাউনি থেকে হাত নামিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন ‘আমি ইন্ডিয়া। আমি পাকিস্তান না থাকিস।’
অমোঘ সেই অভিজ্ঞতা। পাটকাঠির চাল ছাড়িয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে যে রমণী দাঁড়িয়ে, সে বলছে সে উদ্বাস্তু নয় – ভারতবাসী। সে বলছে সে ‘ইন্ডিয়া’।
আরও বড় কথা, ভারতের কেন্দ্রস্থলের যে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো সবচেয়ে জনবহুল, সেখানকার গরিব-গুরবো মানুষের মধ্যেও দেশের নাম হিসাবে ভারতের চেয়ে বেশি প্রচলিত এমন একটা শব্দ যা ভারত বনাম ইন্ডিয়া বিতর্কে বিজেপিবিরোধীদেরও উল্লেখ করতে দেখছি না – হিন্দুস্তান। স্বাধীনোত্তর দেশে আসমুদ্রহিমাচল সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে (দক্ষিণ ভারতে কিছুটা কম, কিন্তু একেবারে পারেনি তা নয়) যে জিনিসটা তা যে মুম্বাইয়ে তৈরি হিন্দি ছবি – সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বাংলায় সে ছবির জনপ্রিয়তাও কোনোদিন কম ছিল না। ভেবে দেখুন তো, হিন্দি সিনেমার সংলাপে বা গানে কতবার শুনেছেন ভারত বা ভারতীয় শব্দটা? বরং বারবার শোনা যায় হিন্দুস্তান এবং হিন্দুস্তানি শব্দ দুটো। হম হিন্দুস্তানী ছবির ‘ছোড়ো কল কি বাতেঁ, কল কি বাত পুরানি/নয়ে দওর মে লিখেঙ্গে/দিল পর নয়ী কহানী/হম হিন্দুস্তানী’ গানটা একসময় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। সে গানে আবার আরএসএস-বিজেপির প্রবল অপছন্দের লোক জওহরলাল নেহরুকে দেখানো হয়েছিল।
বলিউডের সর্বকালের জনপ্রিয়তম শিল্পীদের একজন অমিতাভ বচ্চন। তাঁর প্রথম ছবির নাম সাত হিন্দুস্তানী (১৯৬৯)। তিনি বুড়ো বয়সে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে তৈরি বেশকিছু খাজা জাতীয়তাবাদী ছবির একটায় অভিনয় করেছিলেন। সেই ছবির নাম হিন্দুস্তান কি কসম (১৯৯৯)। ওই একই নামে ১৯৭৩ সালেও একটা ছবি হয়েছিল। চেতন আনন্দ সেই ছবি বানিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে। বর্তমানে যাঁকে বলিউডের বাদশা বলা হয়, সেই শাহরুখ খানের একটা ফ্লপ কিন্তু অন্যরকম ছবির নাম ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানী (২০০০)। আরও অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। হিন্দিভাষী সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বলিউড হিন্দুস্তান শব্দটাকে এই প্রাধান্য দিত না। আরএসএস-বিজেপির প্রভাবে ইদানীং হয়ত বদল এসেছে, কিন্তু গত শতকের আট-নয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের যেসব শ্রমজীবী মানুষ বসবাস করতেন তাঁদের কদাচিৎ ভারত শব্দটা ব্যবহার করতে দেখা যেত। তাঁরা হিন্দুস্তানই বলতেন। যদিও হিন্দুস্তান শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হিন্দুদের ভূমি – হিন্দু, মুসলমান সকলেই কিন্তু দেশের নাম হিসাবে এই শব্দটাই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে এসেছেন। আজকাল কথাগুলো লেখার প্রয়োজন পড়ছে, পড়ে সন্দেহও হচ্ছে হয়ত, কিন্তু আমাদের শৈশবে স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস বা নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে যে গানটা পাড়ায় পাড়ায় মাইকে বাজতই, সেটা হল ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা/হিন্দুস্তান হমারা’। সেই গানের রচয়িতা মীর ইকবাল একসময় পাকিস্তানপন্থী হয়ে যান। সম্ভবত সেই অপরাধেই, আমাদের অখেয়ালে, ওই গানটাকে বিজেপি আমলে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছে। ইকবালের লেখাপত্র পাঠ্য থেকে বাদ দেওয়াও শুরু হয়েছে, কিন্তু সে অন্য আলোচনা। এই আলোচনায় এটুকুই বলার যে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের বিরাট অংশের মানুষ দেশকে হিন্দুস্তান নামে চিনে এসেছেন অন্তত কয়েক হাজার বছর ধরে, ভারত নামে নয়, ইন্ডিয়া নামেও নয়। ফলে ইন্ডিয়া যদি অভিজাত ভারতের লব্জ হয়, ভারতও অভিজাত ভারতেরই অন্য এক অংশের লব্জ।
‘ভারত’ আর ‘ইন্ডিয়া’ বলে অনেক আরএসএসবিরোধীও আসলে যা বোঝাতে চান তা হল দুস্তর আর্থসামাজিক ব্যবধান। ওটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। তাঁরা বলতে চান এ দেশের মধ্যে আসলে দুটো দেশ আছে। ইন্ডিয়া অংশটা লেখাপড়া শেখা, শহুরে, পেট ভরে খাওয়া দেশ। ভারত মূলত গ্রামে বাস করে, লেখাপড়া শিখবে কী, অনশনে অর্ধাশনেই তার দিন কাটে। কথাটা ঠিক, আবার ভুলও। কারণ দুটো কেন? একটু ঘোরাফেরা করলেই স্পষ্ট দেখা যায় এ দেশের মধ্যে আসলে অনেকগুলো দেশ আছে। পেশাগত কারণে এক সময় বারবার ঝাড়খণ্ড যেতাম। রাঁচি আর কলকাতা যে একই দেশের দুটো রাজ্যের রাজধানী একথা বিশ্বাস হত না কিছুতেই। কারণ প্রচণ্ড অব্যবস্থা, প্রবল অনুন্নয়ন দেখেছি। আবার সিকিম আর কেরালা বেড়াতে গিয়ে অবাক হয়ে ভেবেছি, পশ্চিমবঙ্গ এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে একই দেশে আছে কেমন করে? এ তো গেল ভিনরাজ্যের কথা। সম্প্রতি জঙ্গলমহল ঘুরে এলাম। বুঝতে বাকি রইল না যে আমি আর কাঁকড়াঝোর বা আমলাশোলের বাসিন্দারা একই দেশে বাস করি না। কিন্তু তার সঙ্গে ইন্ডিয়া আর ভারত শব্দ দুটোর কী সম্পর্ক?
আরএসএস-বিজেপি কিন্তু ওই ফারাক বোঝাতে ইন্ডিয়া আর ভারত বলে না। তারা ওই দুটো শব্দ দিয়ে কী বোঝাতে চায় তা ২০১৩ সালে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত আসামের শিলচরে যা বলেছিলেন তা খেয়াল করলেই পরিষ্কার হবে। তিনি বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে। নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা জানেন ভাগবতের ওই মন্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। আসল কথা হল গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বিরুদ্ধে ঘটানো অধিকাংশ অপরাধের অভিযোগই দায়ের হয় না। সুতরাং ইন্ডিয়াকে ভারত বানাতে চাওয়া মানে, হয় গোটা দেশটাকেই এমন করে ফেলা যেখানে পরম্পরাগত চিন্তায় ধর্ষিতারা আদৌ অভিযোগ দায়ের করবেন না, অথবা আরও সরল সমাধান – রাষ্ট্র বলবে ভারত প্রাচীন সংস্কার মেনে চলা দেশ। এখানে ধর্ষণ হয় না। এটা একটা উদাহরণ। আরও কী কী হওয়া সম্ভব ভারতে তার মাত্র একটা উদাহরণ।
আসল কথা
দেশকে মা বলে শুধু দক্ষিণপন্থীরাই কল্পনা করে তা তো নয়, ঋত্বিক ঘটকও করতেন। এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ করে থাকেন। কারণ দেশ আসলে একটা আবেগ, অর্থাৎ বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্র হল সেই বিমূর্ত ভিতের উপর গেঁথে তোলা মূর্ত ইমারত। নিজের মাকে যার যা ইচ্ছা সে তাই বলে ডাকে। ওটা বেঁধে দেওয়া অসম্ভব। বাঙালিরা মা বলে, তামিলরা আম্মা বলে, গুজরাটিরা আবার বা বলে। এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও অনেকে মামণি বলে। এক পরিবারের কথা জানি, সেখানে দুই ছেলে তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকত। কারণ কথা বলতে শেখার বয়সে ঠাকুমাকে শুনত তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকছেন, সেই অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তামিল বা গুজরাটি পরিবারগুলোর মধ্যেও খুঁজে দেখলে নির্ঘাত এরকম বিকল্প ডাকের সন্ধান পাওয়া যাবে। ও নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, কারণ ওটা আবেগের বিষয়। সন্তানের যা বলে ডাকতে ভাল লাগে, সে তাই বলবে। কেউ ভারত বলবে, কেউ হিন্দুস্তান বলবে, কেউ ইন্ডিয়া বললেও তেড়ে যাওয়ার কিছু নেই। সংবিধানপ্রণেতারা ইন্ডিয়া আর ভারত লিখেছিলেন, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন নাম হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুস্তান শব্দটা রাখেননি। হয়ত ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য ভাগ হওয়া এবং নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা দেশের সরকারি নাম হিন্দুস্তান হওয়া ভাল বার্তা দেবে না মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সে নামের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ করার জন্যেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। ভারত রাষ্ট্র পরবর্তীকালেও সরকার ছাড়া অন্য কে কোন নাম ব্যবহার করছে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন ঘামাতে চায় বলেই এত কাণ্ড করছে।
এমনিতে নাম বদলালে কী-ই বা এসে যায়? উপরে যে ব্যবহারিক অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছি সেটা ছাড়া? লক্ষ করে দেখছি, শেখানো বুলির মত কিছু কথা আওড়াচ্ছেন বিখ্যাতরা। সুনীল গাভস্কর প্রমুখ বলছেন, বর্মার নামও তো বদলে মায়ানমার হয়েছে। তাতে ক্ষতি কী? এর উত্তর খুঁজলেই আসল ক্ষতে চোখ পড়বে। বর্মার নাম বদলে মায়ানমার করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে এবং তা কোনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাজ ছিল না। কাজটা করেছিল জুন্টা সরকার। আসল আপত্তির জায়গাটা এইখানে। ভারত সরকার যদি সত্যিই মনে করে থাকে দেশের সরকারি নাম ইংরিজিতেও ভারত করার কোনো বিশেষ প্রয়োজন আছে, তাহলে সংসদে আলোচনা করে নিয়মকানুন মেনে সংবিধান সংশোধন করে বদলাতে পারত। কিন্তু সরকারি কাগজে চুপিসাড়ে বদল করে দেওয়া অগণতান্ত্রিক। কাজটা অবশ্য বিলক্ষণ চতুরতার। কারণ এখন সংসদের বাইরে বিজেপি মুখপাত্ররা যা-ই বলুন, সংসদে আলোচনা হলে হয়ত অমিত শাহ বলবেন, বদলাইনি তো! ভারত নামটা তো সংবিধানেই আছে।
আসলে সংগঠনের শতবর্ষে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে গেল অথচ দুনিয়াসুদ্ধ লোক ইন্ডিয়া বলে ডাকছে – এ জিনিস আরএসএসের হজম হবে না। কারণ ‘ইন্ডিয়া’ নামটা এসেছে পারস্যের লোকেদের মুখের ‘হিন্দুস্তান’ ইউরোপিয় জবানে বদলে গিয়ে। ইংরেজদের এ দেশে আসতে তখনো কয়েক হাজার বছর দেরি, যীশুখ্রিস্টেরই জন্ম হয়নি। এ নাম কি সঙ্ঘ মেনে নিতে পারে? বস্তুত ‘হিন্দু’ শব্দটাও বেদ, বেদান্ত, রামায়ণ, মহাভারত – কোথাও নেই। বরং জরাথ্রুষ্টের ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ আবেস্তা-য় আছে। সঙ্ঘ তাই পারলেই তাদের বয়ানে ‘সনাতন ধর্ম’ কথাটা গুঁজে দেয়। এমনি তো আর দয়ানিধি স্ট্যালিন সনাতন ধর্মের বিনাশের ডাক দেওয়ায় বিজেপি নেতারা রণচণ্ডী হয়ে ওঠেননি। বস্তুত যে ভাষাটার প্রতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ পক্ষপাত, যা গত শতকের ছয়ের দশকে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং এখন বিজেপি ফের চাপিয়ে দেওয়ার তালে আছে, সেই ‘হিন্দি’ ভাষাও আদতে ছিল হিন্দুস্তানি (আমির খুসরো বলতেন হিন্দভি) ভাষা। সুলতানি আমল থেকে দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্য এশিয়া এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ভাষা মিশে তা গড়ে উঠেছিল। এই ভাষা দেবনাগরী আর ফারসি – দুরকম লিপিতেই লেখা চলত। হিন্দি আর উর্দু – এই বিভাজন হয়েছে মাত্র শ দুয়েক বছর আগে এবং তার পিছনে ইংরেজদের ভূমিকা কম নয়।
অর্থাৎ সঙ্ঘ পরিবারের এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্রের স্লোগান – হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান – গোটাটাই বিদেশি লব্জ ধার করা। অবশ্য জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র ধারণাগুলোই ইউরোপিয়। কস্মিনকালে ভারতে ছিল না। আগাগোড়া ধার করা জিনিস নিয়ে চললে হীনমন্যতা আসাই স্বাভাবিক, ধারের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টাও প্রত্যাশিত।
শেষ নাহি যে
বুধেশ্বরী দীপেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘হামারলা মরিলে কি দ্যাশ বাঁচিবে?’ দেশের মানুষ না বাঁচলে দেশ বাঁচে না। এখন আশু লড়াইটা দেশ বাঁচানোর, নাম বাঁচানোর নয়। যেহেতু দেশের মানুষের জন্য বিজেপি সরকার কিছুই করেনি, তাই দেশের মানুষকে ঝুটো গর্ব দিয়ে এবং বিরোধীদের সে গর্ব সামলানোর কাজে ব্যস্ত রেখেই তারা উতরোবার চেষ্টা করছে। যুগপৎ নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত করছে। অর্থাৎ রথ দেখা এবং কলা বেচা। ২০২৪ নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীরা পুনর্নির্বাচিত হলে দেশের নাম কেন, দেশের লোকেদের নামও বদলে দিতে পারে। কেউ আটকাতে পারবে না। ফলে এখন বিরোধীদের দায়িত্ব এক দেশ এক নির্বাচন বা নাম পরিবর্তনের মত কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থেকেও সরকারের অকর্মণ্যতা এবং বিপজ্জনক কাজগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো, বিকল্প হাজির করা। নইলে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির ঘূর্ণিতে ডুবে মরতে হবে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী অবশ্য নির্বাচন এবং নাম নিয়ে ডামাডোলের ঊর্ধ্বে উঠে আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে সংসদে আলোচনার জন্য নটা বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু বিজেপি যে বিনা আলোচনায় সংসদ চালাতে এবং নিজেদের পছন্দের বিল পাস করাতে সিদ্ধহস্ত তা আমরা জেনে গেছি। ইন্ডিয়া জোট তাদের একতা বাইরের মত সংসদের ভিতরেও দেখাতে পারে কিনা, দেখিয়ে বিজেপির যা ইচ্ছা তাই করা আটকাতে পারে কিনা, তার উপরে নির্ভর করছে আমরা আগামী বছর কীরকম নির্বাচন দেখব। তার চেয়েও বড় কথা, দেশের ভিতটা থাকবে কিনা। ভিত না থাকলে ইমারত টেকে না।
পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না।
প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা আর বুথফেরত সমীক্ষার দৌলতে লোকনীতি-সিএসডিএস নামটা এখন ওয়াকিবহাল পাঠকদের কারোর অজানা নয়। কিন্তু এই সংস্থাটি আরও কিছু সমীক্ষা করে থাকে যেগুলো নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে শুধু যে হইচই হয় না তা নয়, আদৌ কোনো খবরই প্রকাশ করা হয় না। কারণ করলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে। তেমনই এক সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত সপ্তাহে। এই সমীক্ষার মজা হল, এখানে উত্তরদাতা সাংবাদিকরাই। যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের সমীক্ষাটির ফল দেখে আতঙ্কিত হওয়ার মত নানা বিষয় আছে, তবে এই লেখার পক্ষে যা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য তা হল, ৮২% সাংবাদিক বলেছেন তাঁরা মনে করেন তাঁদের নিয়োগকর্তা বিজেপিকে সমর্থন করেন।
এমনিতে স্বাধীন, সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যে কোনো ব্যক্তিরই যে কোনো দলকে সমর্থন করার অধিকার আছে। উপরন্তু উদারনৈতিক গণতন্ত্রের গালভরা বাণীগুলোর গলদ বুঝে ফেলা যে কোনো মানুষই জানেন কোনো দেশেই কোনো সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে পারে না। বস্তুত, হওয়া উচিতও নয়। কারণ রাজনীতিহীন সাংবাদিকতা হল অর্থহীন তথ্যের সমাহার। ও জিনিস হোমেও লাগে না, যজ্ঞেও লাগে না। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া স্কুপ নামক ওয়েব সিরিজে একজন আদর্শবাদী সম্পাদকের একটি সংলাপ আছে। তিনি চাকরি ছাড়ার আগে মালিককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যখন কেউ বলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর অন্য একজন বলে হচ্ছে না, তখন সাংবাদিকের কাজ দুজনকেই উদ্ধৃত করা নয়। জানলা খুলে দেখা কোনটা ঠিক এবং সেটাই লেখা। সাংবাদিকের কাজ কোনটা তা ঠিক করা কিন্তু শতকরা একশো ভাগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সুতরাং সাংবাদিকের এবং সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক প্রবণতা থাকতে বাধ্য। সেই প্রবণতা কোনদিকে থাকবে তা অনেককিছুর ভিত্তিতে ঠিক হয়, যার একটা অবশ্যই মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ। ফলে কোনো তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমই যে কোনোদিন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল না একথা বলাই বাহুল্য। যেমন কেউ বলে না দিলেও পশ্চিমবঙ্গে নেহাত বালক-বালিকারাও চিরকাল জানত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ওই সংস্থারই ইংরিজি কাগজ দ্য টেলিগ্রাফ কংগ্রেসপন্থী; বর্তমান, দ্য স্টেটসম্যান বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধী; আবার আজকাল বাম ঘেঁষা। তাহলে লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষার ফল আলাদা করে আলোচনা করার মত কেন? কারণ ভারতের মত এত বড় একটা দেশ, যেখানে এতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেখানে চালানো সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক মনে করছেন তাঁদের সংস্থা একটা দলকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ বিভিন্ন নাগরিক বিভিন্ন দলকে সমর্থন করার মত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন দলের দিকে ঢলে থাকলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ভারসাম্য বজায় থাকে তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এই সমীক্ষা থেকে।
২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন খবরের চ্যানেল দেখার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা সমীক্ষার এই ফলাফলে অবিশ্বাস করবেন না। কেউ কেউ বলবেন বেশ হয়েছে, এমনটাই হওয়া উচিত কারণ বিজেপিই একমাত্র জাতীয়তাবাদী পার্টি। আর বিজেপিবিরোধী শঙ্কিত হবেন। এই যা তফাত। কিন্তু কে নিজের রাজনৈতিক পছন্দ অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের এই একপেশে হয়ে যাওয়াকে কীভাবে দেখবেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের সংবাদমাধ্যমের এতখানি একচোখামির ফল কী হচ্ছে? অর্ণব গোস্বামী, রাহুল শিবশঙ্কর, রাহুল কাঁওয়াল, শিব অরুর, সুধীর চৌধুরী, রুবিকা লিয়াকত, দীপক চৌরাসিয়া, অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, সুরেশ চওনঙ্কে বা অমন চোপড়ারা যে পরিমাণ ঘৃণা ছড়িয়েছেন গত এক দশকে – তার ফল আর শুধু উত্তেজনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা ছড়ানোয় সীমাবদ্ধ নেই। ও কাজ তো হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকও করে। ধর্মান্ধ টিভি অ্যাঙ্করদের অবদানে উঠে এসেছে চেতন সিংয়ের মত ভয়ঙ্কর অপরাধী, যে সরকারি উর্দি পরে সরকারি বন্দুক দিয়ে ট্রেনের কামরায় প্রথমে নিজের ঊর্ধ্বতন অফিসারকে খুন করে। তারপর এক কামরা থেকে আরেক কামরায় গিয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী যাত্রী খুঁজে বার করে খুন করে। অবশেষে সেখানে দাঁড়িয়ে বাকি যাত্রীদের হুমকি দেয়, ভারতের দুজনই আছে – মোদীজি আর যোগীজি। এখানে থাকতে হলে এদেরই ভোট দিতে হবে।
এতদ্বারা ২০২৪ লোকসভার নির্বাচনের জন্য বিজেপির প্রচার শুরু হয়ে গেল কি? রবীশ কুমার যাদের গোদি মিডিয়া বলেন, তারা যখন অমিত শাহকে বিধায়ক কেনাবেচা করার গুণে ‘মডার্ন চাণক্য’ আখ্যা দিতে পারে তখন এই প্রণালীকেও ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলে যে বিজেপির ‘অ্যাগ্রেসিভ ক্যাম্পেনিং’ নাম দেবে না তার নিশ্চয়তা কী? আপাতত খাঁটি আমেরিকান কায়দায় চেতন সিংকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা চলছে। যদিও রেলমন্ত্রীকে কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করবে না, একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে বন্দুক হাতে ট্রেনযাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছি কেন? কারণ বিজেপি সরকারকে প্রশ্ন করা বারণ, করলে চাকরি যায়। লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষা যে সঠিক, এই তার হাতে গরম প্রমাণ।
নিজের বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আশপাশের লোকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাওয়া যায় মূলধারার মিডিয়ার ছড়ানো ভুয়ো খবর এবং একচোখা খবর ইতিমধ্যেই কতখানি ক্ষতি করে ফেলেছে। দিন দুয়েক আগে একজন প্রাইভেট গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেদিন কাগজে বেরিয়েছে বিজেপি মণিপুরের এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই এনআরসি করার কথা ঘোষণা করেছে। চালকের পাশে বসে কাগজ পড়তে গিয়ে সক্ষোভে আমার স্ত্রীকে বলতেই চালক বলে উঠলেন “ঠিক হয়েছে। এনআরসি তো করাই উচিত।” কেন করা উচিত জিজ্ঞাসা করায় তাঁর উত্তর “বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানগুলো এসেই তো মণিপুরে অশান্তিটা করছে।” তাঁকে বলা গেল যে মণিপুরে মুসলমান প্রায় নেই বললেই চলে এবং ওই রাজ্যের সীমান্ত মায়ানমারের সঙ্গে, বাংলাদেশের সঙ্গে নয়। তাঁর নাছোড়বান্দা উত্তর “মুসলমান সব জায়গাতেই আছে।” অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হল, মণিপুর সম্পর্কে তাঁর তথ্যের উৎস কী? উত্তর “খবরেই তো দেখাচ্ছে।” কোন চ্যানেলের খবরে দেখাচ্ছে সে প্রশ্ন করে আর সময় নষ্ট করিনি, কারণ কোন খবর মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ায় না সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বরং সহজ। তাই তাঁকে মণিপুরের ভূগোল, ইতিহাস এবং বর্তমান অশান্তি যে মেইতেই আর কুকিদের মধ্যে তা জানাতে খানিকটা সময় ব্যয় করলাম। এনআরসি যে এর প্রতিকার নয় তাও বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সফল হলাম কিনা জানি না, ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ মানুষ বহুবছর ধরে সারাদিন যা দেখে চলেছে তার প্রভাব কয়েক মিনিটের কথায় দূর হওয়া অসম্ভব।
ভারতীয় সমাজকে এই খাদের কিনারে নিয়ে আসার দোষ সবটাই টিআরপিখোর টিভি চ্যানেলগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে অবশ্য অন্যায় হবে। খবরের কাগজগুলোও কোনো অংশে কম যায়নি। ‘পেইড নিউজ’ নিয়ে সাংবাদিক পি সাইনাথের যে কাজ আছে তা প্রমাণ করে টাকার জন্যে ভারতের বড় বড় কাগজগুলো সবকিছু করতে রাজি। ২০১৮ সালে কোবরাপোস্টের স্টিং অপারেশনেও তেমনই দেখা গিয়েছিল। কোবরাপোস্টের প্রতিনিধিরা একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধি সেজে ভারতের অনেকগুলো বড় বড় সংবাদমাধ্যমের কর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন। প্রস্তাব ছিল, আমরা টাকা দেব, সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর করতে হবে এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হয় এমন খবর করতে হবে, নানারকম ইভেন্টের আয়োজন করতে হবে। দুটো মাত্র সংবাদমাধ্যম রাজি হয়নি – পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ।
সংবাদমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থলোলুপতা এবং বিজেপি সরকারের ভয় দেখানো, সরকারবিরোধী খবর করলে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি নানা কৃৎকৌশলের ফল হল দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বিজেপি-আরএসএসের বয়ানের একাধিপত্য। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কখনো যা হয়নি ২০১৪ সালের পর থেকে ঠিক তাই হয়ে চলেছে। সংবাদমাধ্যম কেবলই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। যাদের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব তাদের প্রশ্ন করে না। অর্থাৎ কয়েকশো বছর ধরে সারা পৃথিবীতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার মূল কর্তব্য বলে যা স্থির হয়েছে – ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা – সেই কাজটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা অপরাধ, যে সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে না তারাই সঠিক কাজ করে – একথাই সারা দেশে সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সাংবাদিকরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে গদগদ সেলফি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। কে কত বড় সাংবাদিক তার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রশাসনিক বৈঠকে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন “পজিটিভ (ইতিবাচক) খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন।” এত বড় খবর সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা দৈনিকের এক কোণে ১৭৮ শব্দে প্রকাশিত হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের একজনও এর প্রতিবাদে একটি শব্দও লেখেননি বা বলেননি।
এভাবে চলছিল ভালই, কিছুদিন হল এই ধামাধরা মিডিয়া কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েছে। এমনিতে পৃথিবীর যে কোনো ব্যবসায় নিয়ম হল কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু ভারতের সাংবাদিকতায় সেই নিয়ম বারবার ভেঙেছে গোদি মিডিয়া। অর্ণব গোস্বামী টাইমস নাওতে থাকার সময়েই বিজেপির পক্ষে বলে না এনডিটিভির মত যেসব চ্যানেল তার সাংবাদিকদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা আরম্ভ করেছিলেন। একেবারে আরএসএসের তত্ত্ব অনুসরণ করে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, মুসলমান তো বটেই, যে কোনো ইস্যুতে সরকারের সামান্যতম বিরোধিতা করা ব্যক্তিদেরও দেশদ্রোহী বলা শুরু হয়ে গিয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে। টিভি বিতর্কে বিরোধী দলের একজন মুখপাত্রকে ডেকে চিৎকার করে তাঁকে কথা বলতে না দেওয়া, অন্যদিকে নানা পরিচয়ে বিজেপি-আরএসএসপন্থী একাধিক লোককে প্যানেলে বসিয়ে একতরফা প্রচার চালিয়ে যাওয়া দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে ভারতের সংবাদমাধ্যম এমন কখনো করেনি বলেই সম্ভবত বিরোধী দলগুলোর নেতারা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজিতে যাকে ‘ওয়াল টু ওয়াল কভারেজ’ বলে, সমস্ত নির্বাচনী প্রচারে এবং সারাবছরই বিজেপি তাই পেয়ে চলছিল আর বিরোধীদের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবার রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। এর পাল্টা কৌশল কারোর মাথায় আসেনি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য, সমর্থকরা ভেবে বসেছিলেন সোশাল মিডিয়া দিয়ে মাত করে দেবেন। কিন্তু বিপুল অর্থবলের কারণে সেখানেও বিজেপির সঙ্গে এঁটে ওঠা শক্ত। উপরন্তু আমাদের মত শহুরে মধ্যবিত্তদের নিজের চারপাশ দেখে যা-ই মনে হোক, ভারতের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এখনো স্মার্টফোন নেই, থাকলেও শস্তা ডেটা নেই, কানেক্টিভিটি নেই। ফলে ফেসবুক বা টুইটার দিয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছনো যায় না।
নেপথ্যে কে আছেন জানি না, কিন্তু বিজেপির এই সর্বগ্রাসী প্রচারের বিকল্প পথ প্রথম দেখালেন রাহুল গান্ধী – ভারত জোড়ো যাত্রা। শুধু যে সাবেকি ভারতীয় কায়দায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজের ভাবমূর্তি খানিকটা পুনরুদ্ধার করলেন এবং কংগ্রেসকে জাতীয় স্তরে ফের প্রাসঙ্গিক করে তুললেন তাই নয়, রাহুল ওই যাত্রায় এমন একটা জিনিস করলেন যা এমনকি বিজেপিও ভেবে উঠতে পারেনি। ভারত জোড়ো যাত্রাকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কোনো কভারেজ দেবে না বুঝে রাহুল ছোট বড় বিচার না করে বিকল্প সংবাদমাধ্যম, এমনকি ইউটিউবারদেরও সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, বড় বড় কাগজে রাহুল নেই। টিভিতে রাহুল নেই। অথচ কর্ণাটকে চলা ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও আলোচনা করছেন। আসলে রাহুল (বা কংগ্রেস) যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা বড় অংশের মানুষ খবরের জন্য আর কাগজ বা টিভির উপর ভরসা করেন না। বিশেষত যাঁদের মস্তিষ্কের সবটাই এখনো হিন্দুত্ব গ্রাস করতে পারেনি, তাঁরা অনেকেই এখন ধ্রুব রাঠি বা আকাশ ব্যানার্জির মত ইউটিউবারের দিকে তাকিয়ে থাকেন খবর সংগ্রহের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বিকল্প সংবাদমাধ্যম এখনো সঠিক অর্থে বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি বলেই হয়ত এই ধারা এখনো শীর্ণকায়। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মত বুলডোজারশাসিত রাজ্যেও হিন্দি ভাষার ইউটিউবাররা প্রবল জনপ্রিয়। যোগী সরকারকে বেগ দেওয়ার মত খবর, হাস্যকৌতুক, গান সবই তাঁরাই তৈরি করছেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বহু রাজ্যেই ঘটনা তাই। এই প্রবণতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হল ভারত জোড়ো যাত্রায়।
এর সঙ্গে কংগ্রেস আরও একটি কৌশল নিল, যা প্রথম চোটে যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আপত্তিকর মনে হবে। শাস্ত্রে বলা আছে, দূত অবধ্য। সাহেবরাও বলে থাকে “Don’t shoot the messenger”। কিন্তু রাহুল ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিককে সরাসরি বলে দিলেন, বিজেপির হয়ে কাজ করতে হলে বুকে বিজেপির লোগো লাগিয়ে আসুন। তাহলে ওদের যেভাবে উত্তর দিই আপনাদেরও সেভাবেই উত্তর দেব। সাংবাদিক হওয়ার ভান করবেন না। সাংবাদিক দমে যেতে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাওয়া বেরিয়ে গেল?
এরপর থেকে একই ঢঙে কথা বলা শুরু করলেন তাঁর দলের অন্য মুখপাত্ররাও। পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না। কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন ইন্ডিয়া টুডের শোতে সুপ্রিয়া সটান রাহুল কাঁওয়াল এবং রাজদীপ সরদেশাইকে বলে দিলেন, আপনাদের স্টুডিওতে তো সকাল থেকে শোকপালন চলছে বলে মনে হচ্ছে। এই আক্রমণাত্মক মেজাজ কংগ্রেসের মুখপাত্ররা বজায় রেখে চলেছেন। সম্প্রতি টাইমস নাওয়ের সাক্ষাৎকারে কপিল সিবাল নাভিকা কুমারকে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়েছেন। ভারি মোলায়েম গলায় বলেছেন, আশা করি এখন পর্যন্ত নাভিকা প্রধানমন্ত্রীর মাউথপিস নয়?
How to destroy Navika Kumar, The Kapil Sibal Way {Thread)
ক্রমশ এই রণনীতি অন্য বিরোধী দলের নেতাদেরও নিতে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সবকিছুই বাকি দেশের চেয়ে একটু দেরিতে হয় আজকাল। তাই হয়ত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অতি সম্প্রতি একেবারে পার্টিজান হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমকে কড়া ভাষায় প্রত্যুত্তর দেওয়া শুরু করেছেন। লাইভ অনুষ্ঠানে জি ২৪ ঘন্টার অ্যাঙ্কর মৌপিয়া নন্দীকে সটান বলে দিয়েছেন, দালালি করা চলবে না। ওই চ্যানেলের মালিক সুভাষ চন্দ্র যে রাজ্যসভার বিজেপি সমর্থিত সাংসদ, টেনে এনেছেন সেকথাও।
আত্মপক্ষ সমর্থনে মৌপিয়া প্রথমে ওই তথ্যটাই অস্বীকার করেছেন, তারপর সেটা সফল হবে না বুঝে জাঁক করে বলেছেন, সেলিম চাইলেও ২৪ ঘন্টা গণশক্তির মত রিপোর্টিং করবে না। তারপর, যেন হঠাৎ খেয়াল হওয়ায়, যোগ করেছেন, জাগো বাংলার মত রিপোর্টিংও করবে না।
স্বাভাবিক অবস্থায় রাজনৈতিক নেতাদের এইভাবে সাংবাদিকদের তথা সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ভারত যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং এই অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। বস্তুত অধিকাংশ তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম এখন এতটাই একচোখো হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তাদের খবর না দেখে বা না পড়ে কেউ যদি গণশক্তি আর জাগো বাংলা পড়ে নিজের মত করে ঠিক কী ঘটেছে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে হয়ত সত্যের বেশি কাছাকাছি পৌঁছবেন।
একথা পাঠক/দর্শক মাত্রেই আজকাল উপলব্ধি করেন। সেই কারণেই রবীশ কুমারের ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহক সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এমনকি কুণাল কামরার মত ঋজু বিদূষক, যাঁর মূল কাজ লোক হাসানো, তাঁর পডকাস্টও মানুষ আগ্রহ নিয়ে দ্যাখেন। সেদিক থেকে যে বাঙালি হিন্দি বা ইংরিজিতে স্বচ্ছন্দ নন তাঁদের দুর্ভাগা বলতে হবে। বাংলা ভাষায় ওই মানের কাজ এখনো হচ্ছে না।
যা-ই হোক, ধামাধরা মিডিয়ার সংকটের কথা ফেরত আসি। সম্প্রতি রিপাবলিক চ্যানেলের কর্ণধার অর্ণব মণিপুর নিয়ে মোদী সরকারের সমালোচনা করেছেন, রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিও তুলেছেন। তা নিয়ে বিজেপিবিরোধী মানুষ যুগপৎ হাসাহাসি করছেন এবং বিস্মিত হচ্ছেন। আসলে এতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই। বিজেপিকে তো বটেই, এমনকি বিজেপিবিরোধীদেরও বিস্মিত করে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও ২৬টি দলের ইন্ডিয়া জোট গড়ে উঠেছে। শেষপর্যন্ত সে জোট টিকবে কিনা সেটা পরের কথা, কিন্তু গোদি মিডিয়ার কাছে আশু সমস্যা হল এই দলগুলির অধীনে থাকা রাজ্য সরকারগুলো। গোটা দক্ষিণ ভারতে কোথাও বিজেপি সরকার নেই, অথচ ওই রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল, প্রচুর বিজ্ঞাপন পাওয়া যেতে পারে। বাড়াবাড়ি করলে বিজেপির দেখানো পথে ওই সরকারগুলো বিজ্ঞাপন দেবে না। গোবলয়ের রাজ্যগুলোর মধ্যেও বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থানের সরকার ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোর হাতে। দিল্লি, পাঞ্জাবের সরকারও তাই। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের মত বড় রাজ্য, ছত্তিসগড়ের মত উন্নতি করতে থাকা রাজ্যও ইন্ডিয়ার হাতে। তাহলে গোদি মিডিয়ার হাতের পাঁচ বলতে রইল মডেলের হাড়গোড় বেরিয়ে পড়া গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ছোট্ট রাজ্য হরিয়ানা আর মধ্যপ্রদেশ। শেষেরটি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির হাতে থাকবে কিনা তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে তেমন ব্যবসা হয় না নয়ডাকেন্দ্রিক তথাকথিত সর্বভারতীয় মিডিয়ার। কারণ তারা ওই অঞ্চল এবং তার মানুষজনকে চেনেই না। স্বভাবতই তাঁরাও এদের পাত্তা দেন না। এমতাবস্থায় স্রেফ দাঙ্গাবাজি করে চলে কী করে অর্ণব, রুবিকাদের?
লাইভ টিভিতে বিরোধী দলের নেতাদের প্রতিআক্রমণের ফলে হিন্দুত্বে একান্ত দীক্ষিত দর্শক ছাড়া আর সকলের কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা যে তলানিতে ঠেকেছে একথা বুঝতে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর পাকা মাথাদের কারোর বুঝতে বাকি নেই। বিকল্প সংবাদমাধ্যম বিপুল সরকারি বাধা সত্ত্বেও যে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে তাতেও সন্দেহ নেই। অতএব মাঝেমধ্যে বিজেপিবিরোধী ভান করতে হবে বইকি। মুশকিল হল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সম্ভবত বিজেপিও ভাবতে শুরু করেছে, এদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা করালে তা আর আগের মত প্রভাবশালী হবে না। তাই তারাও এখন ‘সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার’ ধরার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বিজেপিপন্থী লেখক, সাংবাদিক, এমনকি মন্ত্রীরাও বেশকিছু ইউটিউবারকে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেছেন। এমনটা বিজেপি আগে কখনো করেনি। এই ইউটিউবারদের অন্যতম beerbiceps বলে একজন। ইউটিউবে তার প্রায় ছয় মিলিয়ন ফলোয়ার। অতীতে সে ক্রিকেটার যজুবেন্দ্র চহল, সানি লিওন, সারা আলি খান জাতীয় মানুষের সাক্ষাৎকার নিত। এমনকি ডিমনেটাইজেশনকে ব্যঙ্গ করেও ভিডিওও বানিয়েছে একসময়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে সে পরম সাত্ত্বিক হয়ে উঠেছে। বারবার ভুয়ো খবর ছড়িয়ে ভ্রম সংশোধন করা এজেন্সি এএনআইয়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশ থেকে শুরু করে অমুক প্রভু, তমুক দক্ষিণপন্থী স্ট্র্যাটেজিস্ট – সকলেই বিয়ারবাইসেপসের শোতে উপস্থিত হচ্ছেন। বিজেপি যদি ২০২৪ নির্বাচন জিতেও যায়, রাহুল, সেলিমরা মূলধারার সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে তাঁদের তিরিক্ষে মেজাজ বজায় রাখলে হয়ত বিয়ারবাইসেপসদেরই পোয়া বারো হবে, কপাল পুড়বে অর্ণব, মৌপিয়াদের।
তবে আক্রমণের ধারাবাহিকতা থাকা চাই। সেলিম জি নেটওয়ার্কের অ্যাঙ্করকে হাঁকড়াবেন আর তাঁর দলের মুখপাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা রিপাবলিক টিভির মত আরও উগ্র দক্ষিণপন্থী চ্যানেলের বিতর্কে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করবেন, অনুষ্ঠানের আগে পরে দিলদরিয়া হয়ে ছবিও তুলবেন – তা কী করে হয়?