অবসাদের গল্প: বিপন্ন বিস্ময়ের গল্পকার গৌতম

গল্পের দিন ফুরিয়েছে। পৃথিবীতে যত গল্প ছিল সবই বলা হয়ে গেছে, নতুন কিছু বলার নেই। কেবল নতুনভাবে বলা সম্ভব।

এই কথাগুলো ইদানীং খুব শোনা যায়। সোশাল মিডিয়ায় প্রবল জনপ্রিয় বক্তা থেকে শুরু করে সাহিত্যের বাজারের বিরুদ্ধে ঝান্ডা উঁচিয়ে বসে থাকা প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যিক পর্যন্ত অনেকেই বলে থাকেন। এই মতের লোকেরা এমনভাবে কথাগুলো বলেন যেন ভারি নতুন কিছু বলা হচ্ছে, অথচ এদেশে কয়েক হাজার বছর ধরে নেহাত নিরক্ষর মানুষও বলে আসছেন “যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে”। সব গল্পই আসলে নানা চেহারায় মহাভারতে আছে। তা বলে তো মানুষের গল্পের খিদে কমে যাচ্ছে না। বই এবং ই-বুক তো বটেই, অডিও বুকের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাও সে কথাই প্রমাণ করে। জনপ্রিয়তায় অবশ্য অনেক সাহিত্যিকের আপত্তি আছে, কারণ ওটা বাজার নির্ধারিত। কিন্তু বাংলার বাজারবিরোধী লেখকদের কাছে যিনি দেবপ্রতিম এবং নিজের লেখায় গল্পের গঠন নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন, এমনকি বলেছেন (মুনিরা সুলতানাকে) “ফর্ম এবং কনটেন্ট দুটো আলাদা বিষয় নয়। ফর্মটাই বিষয়”, সেই দেবেশ রায়ও জীবনের একেবারে শেষদিকে বলেছেন (শমীক ঘোষকে) “আমি নিজেকে সাহিত্যিক বলি না। বলি কথোয়াল। স্টোরিটেলার।” অতএব গল্পকে বাতিল করা সম্ভবত কাজের কথাও নয়। গল্পে গল্প থাকবে, নাকি একখানা সন্দর্ভ হয়ে ওঠাই তার কর্তব্য – সেসব তর্ক শেষ হবার নয়। কিন্তু গল্পকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সমস্যা হল, অনেক গল্প না বলাই থেকে যায়। এত বড় পৃথিবী, এত মানুষ, একেক মানুষের মাথার ভিতরে অপরিসীম সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হর্ষ-বিষাদ এবং অবসাদ। সেসব না বলাই থেকে যাবে গল্প, সন্দর্ভ, প্লট, আখ্যান ইত্যাদি জটিল বিতর্কের তাড়নায় – এমন আশঙ্কা ইদানীং আমার মত ছাপোষা পাঠকের মনে ঘনিয়ে ওঠে। গৌতম চক্রবর্তীর প্রথম গল্পের বই আটটি অবসাদের গল্প এইসব জটিলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে বলেই স্পর্শ করতে পারে।

গল্পের বইতে ভূমিকা জিনিসটি সুলভ নয়। এ বইতে কিন্তু সাহিত্যিক স্বপন পাণ্ডা ভূমিকা লিখেছেন। সেখানে লেখক সম্পর্কে লিখেছেন “তিনি গল্প বলতে নারাজ। ন্যারেটিভের চলনে তাই কোনও একরৈখিক কাহিনিরও আভাস রাখতে চান না।” দ্বিতীয় বাক্যটার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়েও প্রথম বাক্যের সঙ্গে ভিন্নমত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। এই কৃশকায় বইয়ের আটটি গল্প পড়ে আমার ঘোরতর ধারণা, গৌতম আসলে গল্পই বলতে চান, কিন্তু স্বগতোক্তির মত করে। কারণ অবসাদ এমন এক ব্যক্তিগত অনুভূতি, যা হাট করে কারোর কাছে কেউ বলতে চায় না। অথচ স্ববিরোধ এই, যে অবসাদ যার আছে সে আসলে প্রবল একাকিত্বের শিকার – কারোর কাছে নিজের কথা বলতে পারলে হালকা বোধ করত। এ বইয়ের প্রত্যেকটি লেখাই আসলে সেই একা মানুষটির গল্প, যে ভাবছে – “সকল লোকের মাঝে ব’সে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?” এগুলো এমন গল্প, যেগুলো না বলে থাকা যাচ্ছে না, অথচ খুব বেশি লোক না শুনলেই যেন লেখক আশ্বস্ত বোধ করবেন।

নইলে কেন লেখা হবে ‘আমাদের একজন’ গল্পের এইসব লাইন?

‘কোনখানে? কোন্ দিকে? আর কতক্ষণ গো?’ তার মনে হয় পেছন থেকে মিনমিন করে ওঠে কোনো একজন। কেউ শুনতে পায় না; কেউ উত্তর দেয় না। আগুপিছু করে সবাই আগের মতন হেঁটে চলে। সে চোখ বোজে। হঠাৎ করে কথা বলে ওঠা মানুষের স্বর; অনিশ্চয়তায়, এলোমেলো করে ফেলা কতগুলো পায়ের শব্দ, দু-কান চুঁইয়ে তার করোটির ভেতর প্রবেশ করে।

এই চূড়ান্ত ব্যক্তিগত গল্প লেখক কেন বলতে চান তা স্পষ্ট বোঝা যায় যখন হৃদয়ঙ্গম হয়, যে আমাদের এই একজন শুধুমাত্র একজন নয়। আমরা অনেকেই বা প্রত্যেকেই। কারণ একটু পরেই লেখা হয়

…তারই মতন মুখ, চোখ, নাক, হাতের লোকটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলে, “সরে দাঁড়াও। ভেতরে যাব।” লোকটা আরও একটু কুঁকড়ে গিয়ে সরে দাঁড়ায়। সে ভেতরের দিকে যেতে যেতে শুনতে পায় তার থেকে আরও একটু খাটো লোকটার ভারী গলা, “কী ম্যাডাম, কোথায় চললেন!”

আবার খানিক পরে

…এই সদ্য প্রাপ্ত ন্যাংটো কমনীয় শরীরের আস্তরণের তলায় মেয়েছেলেটি অল্প অল্প ছটফট করে আর তার মনে হয় এখন এই শরীরের ওপরে সে খালি পায়ে হাঁটতে পারে যেমন একটু আগে তাদের উপদলটি হেঁটেছিল জলাভূমির ওপর ফেলা নরম মাটির ওপরে। মেয়েটি এখন আদতে একটা নরম বিছানার সমার্থক। সে শূন্য বিছানার ওপর উপুড় হয়।

 তোমার হাতে ওটা কীসের বই দেখি। তাদের সঙ্গে এতক্ষণ নীরবে হেঁটে চলা মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে। হাত থেকে বইটা নিয়ে আপাত গম্ভীর লোকটা উলটে-পালটে কিছুক্ষণ দেখে এক জায়গায় থেমে যায়। শান্ত ভাবে বলে, “এই লেখাটা তো আমার অনুবাদ করা।”

পাঠক সামান্য অন্যমনস্ক হলেই খেই হারিয়ে ফেলবেন। কারণ গল্পকার আপন মনে বলে চলেছেন, শুনতে হলে কান খাড়া করে একেবারে তাঁর ঠোঁটের কাছে গিয়ে শুনতে হবে। অত কষ্ট করতে যে পাঠক রাজি নয়, তাকে অবসাদের গল্প কেনই বা শোনাতে যাবে কেউ?

সারা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমে দুরকম সংবাদের আধিক্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে – ১) আত্মহত্যার খবর, ২) সাদা কলারের চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের খবর। একথা কারোর অজানা নয় যে মানুষ অবসাদ থেকে আত্মহত্যা করতে পারে এবং চাকরি গেলে অবসাদ তৈরি হতে পারে। বিশেষত সাদা কলারের শ্রমিকরা – যাঁরা বংশগৌরব, ডিগ্রির গৌরব এবং সামাজিক অপমানের আশঙ্কায় কারখানার শ্রমিকদের মত চাকরি গেলে অন্য কোনো কায়িক শ্রমে যুক্ত হতে পারেন না – তাঁরা যে অবসাদের শিকার হতে পারেন, একথা বুঝতে মনস্তত্ত্ববিদ হওয়ার দরকার পড়ে না। ২০০৮-০৯ সালের আর্থিক মন্দার সময়ে, তারপর কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়ে এমন বহু মানুষ অবসাদের শিকার হয়েছেন, আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ দুম করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হিসাবের খাতায় সেগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু। অনেকে কোনোমতে টিকে গেছেন, কিন্তু আমূল বদলে গেছে জীবনযাত্রা। বাংলা গল্পে এঁদের বড় একটা দেখা যায় না। কম্পিউটার, সফটওয়্যার, হ্যাকিং – এসব আসে নেহাত প্রপ হিসাবে, গল্পের সময়কাল বোঝাতে বা আধুনিকতা আরোপ করতে। কখনো বা মৃদু পর্নোগ্রাফিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে। এসবের পিছনের থাকা মানুষগুলো আসে না। গৌতম না লিখলে গ্রে হ্যাট হ্যাকারের অবসাদের গল্প কে লিখত কে জানে!

তবে কেবল বিষয়ের অভিনবত্বে চমকে দেওয়ার মত গল্প গৌতম একটিও লেখেননি। বোঝা যায় তাঁর তা উদ্দেশ্যই নয়। ‘রোহনের যেসব কথা কেউ কেউ জানে’ গল্পে মাত্র ১১ পাতায় তিনি একবিংশ শতকের পুঁজিবাদের সমস্ত জালনিবদ্ধ রোহিতের গল্প লিখে ফেলেছেন, বয়ানটা একজন গ্রে হ্যাট হ্যাকারের – এই যা। যে পাঠক কখনো ছাঁটাই হয়েছেন বা গত কয়েক মাসে বিশ্বব্যাপী সাদা কলারের চাকরিতে ছাঁটাইয়ের খবরে শঙ্কিত হয়ে প্রতি মুহূর্তে সকলের চোখ এড়িয়ে নিজের মেলবক্স দেখছেন, তাঁকে বলে দিতে হবে না নিচের অনুচ্ছেদটির সাহিত্য মূল্য

এই মনঃস্তত্ত্ব আমার জানা এবং অতি পরিচিত। পিঙ্ক স্লিপ পাওয়ার পর আমি নিজে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন আমার মতন আরও সত্তর জন চাকরি খুইয়েছিল। কেউ কেউ সোজা মদের দোকানে আর কেউ মাঠে ঘাটে সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছিল [বেড়িয়েছিল]। আমি ঘণ্টা দুয়েক হেঁটেছিলাম। দিন তিনেক লেগেছিল আমার স্বাভাবিক হতে। আমি তো প্রোগ্রামিং ছাড়া কিছুই জানতাম না। চোখ বুজে ধীরে ধীরে নিজেকে এরপরের সাত বছর হাতের কাছে যা কাজ পেয়েছি, যে কাজ পেয়েছি তাই করতে নিজেকে বাধ্য করেছি। গুচ্ছের পর্ন ওয়েবসাইট আর মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বানিয়ে দিয়েছি, কখন [কখনও] যে কোম্পানিতে কাজ করেছি তাদের জন্য, কখনও এককভাবে। এ ছাড়াও বানিয়েছি হাজার হাজার জুয়াচুরি আর জালিয়াতি করবার অ্যাপ্লিকেশন। এইভাবেই ধীরে ধীরে একসময় হ্যাকিং-এর প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়।

তবে আনমনে গল্প বলার যে শৈলী এ বইতে প্রতিষ্ঠা করেছেন গৌতম, এই গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ প্রায় ইশতেহার হয়ে উঠে সেই শৈলীর সঙ্গে শত্রুতা করেছে।

আগ্রহীরা গুগলে ‘union for software professionals India’ দিয়ে সার্চ মেরে দেখতে পারেন

এই লাইনটির অবসাদের গল্পে জায়গা পাওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। আর যা বেসুরে বেজেছে তা হল ‘স্ক্রিপ্ট’ গল্পটি। আলাদাভাবে এটি একটি চমৎকার গল্প, অত্যন্ত মনোগ্রাহী, শেষ পর্যায়ে একেবারে শ্বাসরোধকারী থ্রিলার। কিন্তু কোনোভাবেই অবসাদের গল্প নয়।

আমাদের অর্থনৈতিক অসহায়তায় অবসাদ ইতিমধ্যেই অতিমারীতে পরিণত হয়েছে। সম্মিলিত অন্যমনস্কতায় আমরা তা খেয়াল করি না। অর্থনৈতিক অসহায়তা কীভাবে যৌনতাকে প্রভাবিত করে তা অননুকরণীয় ভঙ্গিতে লিখেছিলেন অশোক মিত্র। সেই ১৯৬৮ সালে তিনি লিখেছিলেন “সংসারে সংস্থান নেই, দেড়শো-দুশো টাকার আয়ে বাবা-মা-তিন ভাই-এক পুত্রবধূ-দুই অনূঢ়া বোন-তিন ভ্রাতুষ্পুত্র-পুত্রীর অন্নের জোগান, ভাইয়ের বেকার-ব’সে থাকা, বাবার যক্ষ্মা, বর্ষায় শৌচাগারের-শয়নঘরের একাকার হয়ে-যাওয়া, অভাব, মেজাজ-খারাপ, পরস্পরকে দোষারোপ, কান্না, তিক্ততা, মনের সুকোমল বৃত্তিগুলির ধীরে ধীরে শুকিয়ে-আসা। এই পরিবেশে, এমনকি তেইশ বছরের আপাত-উঠতি শরীরেও, স্তন আর স্তন থাকে না, দুদিনেই তা হেলে প’ড়ে মাই হয়ে যায়।”

গৌতম লিখেছেন আজকের যৌনতার বয়ান

আমার অবসন্ন মন হারিয়ে যায় বিকেলের হলুদ সমুদ্রে; আচ্ছন্ন হয় হাজার হাজার কদাকার হলুদ ঢেউয়ের স্মৃতিতে। আমার ক্লান্ত শরীর আছড়ে পড়ে পৌলমীর শীর্ণ লাল শরীরের ওপর, একটু আশ্রয়ের খোঁজে। কোনো আধমরা গাছের শেকড়ের মতন আমি পৌলমীর শরীর হাতড়ে বেড়াই একটু বাঁচার তাগিদে। পৌলমী আঁকড়ে ধরে বিজ্ঞাপনের লাল আলোয় দেখা অলীক অতিমানবকে, একটু নির্ভরতা পাওয়ার জন্য। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাওয়া শহরের বৈশিষ্ট্যহীন রাতে আমাদের মন, আমাদের চেতনা, আমাদের শরীর আস্তে আস্তে খোলস ছাড়ে। আশায়, নিরাশায়, ক্ষোভে, যন্ত্রণায়, করুণ আর্তিতে আমাদের শরীর ক্রমাগত ডেকে চলে। সমুদ্রের পাড়ে ঢেউ ভাঙার শব্দে, তুচ্ছ শব্দের মতন আমাদের গোঙানি চাপা পড়ে যায়। হোটেলের ঘরের চার দেয়াল নির্লিপ্তভাবে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। ধীরে ধীরে আরও একটি রাত হারিয়ে যায়।

গল্পটির নাম ‘হলুদ সমুদ্র’। নীল সমুদ্রকে দুজন ভরা যৌবনের নারী-পুরুষের কেন হলুদ মনে হয়, কেন একটির পর একটি রাত মধুময় হয়ে ওঠে না, হারিয়ে যায় – তা জানতে গেলে পৌঁছতে হবে গল্পের শেষ লাইনে। তাই বলছি, গৌতম গল্পই বলেছেন এবং কান খাড়া করে, টানটান হয়ে বসে শোনার মত গল্প বলেছেন। সামান্য এলিয়ে বসলেও এসব গল্প কানে ঢুকবে না।

আরও পড়ুন দিলীপবাবুর দান: জীবনানন্দ দাশ

আলাদা করে বলা দরকার এই বইয়ের প্রচ্ছদের কথা। গাঢ় নীল প্রেক্ষাপটের উপর কালো চৌকো জায়গার মধ্যে একটি মুখের ছবি এঁকেছেন সর্বজিৎ সরকার। সম্ভবত কল্পনাটি এসেছে ‘মুখাবয়ব: একটা সময়ের বিবরণ’ নামক অবর্ণনীয় গল্পটি থেকে। কিন্তু অবসাদগ্রস্ত মানুষের মুখ কেমন করে আঁকা যায়? একবিংশ শতকের যেসব মানুষের অবসাদের গল্প গৌতম লিখেছেন, তাদের মুখ তো দেবদাস ছবির দিলীপকুমার বা শেষ অঙ্ক ছবির শেষদিকের উত্তমকুমারের মত হতে পারে না। কারণ এদের অবসাদের কারণ আরও আধুনিক বলে আরও ব্যাপ্ত, আরও গভীর। সর্বজিতের ছবি বরং মনে পড়িয়ে দেয় এদভার্দ মুঙ্কের ‘দ্য স্ক্রিম’ নামের ছবিটিকে। প্রচ্ছদের এই মানুষটি যদি চিৎকার করতে পারত, তাহলে বোধহয় তাকে মুঙ্কের ছবির মানুষটির মতই দেখাত। কিন্তু অবসাদ তো চিৎকৃত হয় না, নীরবে কুরে কুরে খায়। ভিতরের সেই ক্ষয় ছবিতে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। এ যুগের অবসাদ তো আসলে এক বিপন্ন বিস্ময়, যা আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। গৌতম সেই বিপন্ন বিস্ময়ের গল্প লিখেছেন, সর্বজিৎ প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তুলেছেন।

আটটি অবসাদের গল্প
লেখক: গৌতম চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ: সর্বজিৎ সরকার
প্রকাশক: কেতাব-ই
দাম: ২০০ টাকা

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত

মুখবন্ধে সম্পাদক জয়দীপ বসু ও তাঁর সহকারী সায়ন মুখার্জি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, স্রেফ প্রচ্ছদ দেখলেও টের পাওয়া যাচ্ছে যে এ বই ততটা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস নয়, যতটা ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস।

ভারতের ফুটবল এখন কোথায় দাঁড়িয়ে তা সংক্ষেপে বোঝাতে হলে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দলগুলো ঝাঁ চকচকে হোটেলে সর্বোচ্চ মানের সুযোগসুবিধা নিয়ে থাকে, বিমানে যাতায়াত করে; জাতীয় গেমসে সোনার পদক জয়ী বাংলা দলের ফুটবলাররা বাড়ি ফেরেন দু রাত ট্রেনে কাটিয়ে। ট্রেনে চড়ায় কোনো অন্যায় নেই, অপমানও নেই। কিন্তু দু ধরনের ফুটবলের দুস্তর ব্যবধান এতে স্পষ্ট হয়। ভারতীয় ফুটবল অবশ্য এভাবেই চলে। রাজ্য দল দূরের কথা, জাতীয় দলও ক্লাব দলগুলোর মত সুযোগসুবিধা ভোগ করে না। ভারতের জাতীয় দলের পরিচর্যায় ইদানীং বিপুল উন্নতি হয়ে থাকলেও দীর্ঘকাল জাতীয় দলে খেলা সম্মানের, সেখানে দেশপ্রেম জড়িত – এই আবেগের শাক দিয়ে পারিশ্রমিকের মাছ ঢেকে রেখেছিলেন ফুটবল কর্তারা। তখন থেকেই ভারত আন্তর্জাতিক ফুটবলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ফুটবলোন্নত দেশেই ক্লাব ফুটবল বেশি অর্থকরী, তার গ্ল্যামারও বেশি। তা বলে জাতীয় দল হেলা শ্রদ্ধার পাত্র নয়। সুনীল ছেত্রী ব্যক্তিগত দক্ষতায় লায়োনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর পাশে জায়গা করে নিলেও আন্তর্জাতিক ফুটবল মানচিত্রে কিন্তু ভারতীয় দল কোথাও নেই। অথচ ফুটবলে যখন বিশ্বকাপ নয়, অলিম্পিককেই মনে করা হত সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার মঞ্চ, তখন এই ভারতই ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে চতুর্থ হয়েছিল। এই অবনমনের ইতিহাস ধরা পড়েছে ভারতীয় ফুটবল দলের ৭৫ বছরের ইতিহাস নিয়ে লেখা বক্স টু বক্স বইতে।

মুখবন্ধে সম্পাদক জয়দীপ বসু ও তাঁর সহকারী সায়ন মুখার্জি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, স্রেফ প্রচ্ছদ দেখলেও টের পাওয়া যাচ্ছে যে এ বই ততটা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস নয়, যতটা ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস। তরুণ ফুটবলপ্রেমীদের প্রায়শই হা হুতাশ করতে দেখা যায় ভারত বিশ্বকাপ ফুটবলের ত্রিসীমানায় পৌঁছতে পারে না বলে। অথচ তাঁদের ধ্যান জ্ঞান ক্লাব ফুটবল। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেলতে পারল কি না পারল তা নিয়ে যত আগ্রহ তার ছিটেফোঁটাও জাতীয় ফুটবল দল নিয়ে দেখা যায় না। সুনীল ছেত্রী যদি বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড় না হয়ে প্রাক্তন হতেন তাহলে তাঁর কীর্তি নিয়ে কার কতটা আগ্রহ থাকত যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সন্দেহ নেই এর জন্যে অনেকখানি দায়ী ভারতীয় ফুটবল দলের সাফল্যের অভাব। ১৯৭০ সালের এশিয়ান গেমস আর মারডেকা কাপে ব্রোঞ্জ মেডেলের পর বলার মত সাফল্য আর কোথায়? সাফ কাপ বা এশিয়ান চ্যালেঞ্জ কাপের খেতাব যে খুব বড় কোনো সাফল্য নয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় এশিয়ান কাপের মূলপর্ব বা বিশ্বকাপের যোগ্যতামান পর্বের খেলা এসে পড়লেই। কিন্তু ব্যর্থতার ইতিহাসও তো জানা জরুরি। সম্ভবত সাফল্যের ইতিহাস জানার চেয়েও বেশি জরুরি, কারণ ব্যর্থতার সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসই সাফল্যের ইমারত গড়ার মশলা। আইএসএলে মত্ত ফুটবলপ্রেমীদের সামনে সেই ইতিহাস তুলে ধরার কাজ করেছে বক্স টু বক্স। ফুটবলপ্রেমীদের প্রেম কতটা এ বইয়ের কপালে জুটবে তা বলা শক্ত, কিন্তু নথি হিসাবে এ বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

তথ্য সংকলন করা পরিশ্রমসাধ্য হতে পারে, অসম্ভব নয়। কিন্তু কেবল তথ্য ইতিহাস হয়ে ওঠে না। পাহাড়প্রমাণ তথ্য ঘেঁটে একজন বা দুজন যদি ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস লিখতেন তাহলে গভীরতায় ঘাটতি থাকতে পারত, একপেশে ইতিহাস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ হল দুই সম্পাদক এবং পরিসংখ্যানবিদ গৌতম রায় ছাড়া আরও ১৪ জন ফুটবল সাংবাদিকের বয়ানে ইতিহাসকে তুলে ধরা। বাকি পৃথিবীর সাংবাদিকতায় ‘সুপার স্পেশালাইজেশন’-ই দস্তুর। কিন্তু ভারতে তা নানা কারণে অসম্ভব। অতিমারীর আগে পর্যন্ত তবু ফুটবল সাংবাদিক, ক্রিকেট সাংবাদিক, টেনিস সাংবাদিক – কাজের এরকম বিভাজন অন্তত বড় সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখা যেত। করোনার ধাক্কা থেকে নিজেদের লাভের কড়ি বাঁচাতে গিয়ে মালিকরা ওটুকুও লাটে তুলে দিয়েছেন। এমন আবহে এই বইয়ে হায়দরাবাদের ফুটবল নিয়ে লিখেছেন সেখানকার সাংবাদিক (এন গণেশন ও জি রাজারমণ), বাংলার ফুটবল নিয়ে কলকাতার সাংবাদিক (পুলকেশ মুখোপাধ্যায়), কেরালা (লেসলি জেভিয়ার), গোয়া (মার্কাস মারগুলহাও), মুম্বাই (মারিও রডরিগেজ) সম্বন্ধে লিখছেন সেখানকার অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা; পাঞ্জাব (এস এস শ্রীকুমার) ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল (বৈভব রঘুনন্দন) নিয়ে বিশেষজ্ঞরা – এই ব্যবস্থার জন্য সম্পাদকদের আলাদা প্রশংসা প্রাপ্য। ভারতীয় ফুটবল দলের সাফল্য-ব্যর্থতার ইতিহাস নথিবদ্ধ করতে হলে যে এইসব এলাকার ফুটবল নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা দরকার, এই ভাবনাও প্রশংসার যোগ্য।

এত বড় দেশের খেলা নিয়ে আলোচনা বিকেন্দ্রীভূত হলে তবেই যে গভীর হয় তার বড় প্রমাণ পুলকেশবাবুর প্রবন্ধ ‘Royal or Not, Bengal’। পিকে ব্যানার্জি, অমল দত্ত বা বাঘা সোমের কোচিংয়ের খ্যাতি তো দেশজোড়া। কিন্তু কজন জানেন হুগলী-ব্যান্ডেল এলাকার অশ্বিনী বরাটের কথা? পুলকেশবাবু লিখেছেন, সুরজিৎ সেনগুপ্তের বাঁ পা প্রথম দিকে তেমন সচল ছিল না। অশ্বিনী (নিজের অঞ্চলে ভোলাদা নামে খ্যাত) বেশ কিছুদিন প্র্যাকটিসের প্রথম আধ ঘন্টা সুরজিৎকে ডান পায়ে বল ছুঁতে বারণ করে দিয়েছিলেন। তার ফলে ১৯৭৩ সালের রোভার্স কাপের প্রথম প্র্যাকটিস সেশনের পরেই সুরজিতের ক্লাব কোচ পিকে স্ত্রীকে চিঠিতে লেখেন তাঁর নতুন ছাত্রটির মধ্যে এক বিরল গুণ দেখা যাচ্ছে। তার দুটো পা-ই সমান সচল।

এমন মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে রাজ্যভিত্তিক প্রবন্ধগুলোর সবকটাতেই। তবে ভারতীয় দলের সর্বকালের সেরা কোচ সৈয়দ আব্দুল রহিমের শহর এবং মহম্মদ হাবিব, আকবর, সাবির আলির মত ফুটবলারের জায়গা হায়দরাবাদ নিয়ে প্রবন্ধটি অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের এই শতকের গোড়ায় দশ বছর সাসপেন্ড থাকার অনুল্লেখে। ভারতীয় ফুটবলে হায়দরাবাদের যে স্থান ছিল সেখান থেকে আজ স্রেফ এক আইএসএল ফ্র্যাঞ্চাইজে পরিণত হওয়ার ঘটনাক্রমে দেশের ফুটবল মানচিত্রে ওই দীর্ঘ অনুপস্থিতি অবশ্যই বড় কারণ।

ভারতীয় ফুটবল দল কীভাবে অলিম্পিক আবির্ভাবেই ইউরোপকে চমকে দিয়েছিল, এক অজ্ঞাতনামা ব্রিটিশ সাংবাদিকের কলমে সেই বয়ান দিয়ে আরম্ভ হয়েছে বক্স টু বক্স, আর বইয়ের দ্বিতীয় অংশ শুরু হয়েছে জয়দীপবাবুর লেখা ‘Doomsday: Cash vs Country’ দিয়ে। জাতীয় দলের পাতাল প্রবেশের সেই শুরু। এ লেখার শুরুতেই দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে যেমন তেমনভাবে ফুটবলারদের জাতীয় দলের খেলিয়ে নেওয়ার যে প্রচেষ্টার কথা লিখেছি, তার সূচনাবিন্দু রয়েছে জয়দীপবাবুর ওই প্রবন্ধে।

১৯৮২ এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি হিসাবে ১৯৮১ থেকেই লম্বা শিবির এবং মারডেকা কাপে অংশগ্রহণ ছাড়াও জাতীয় দলের জন্য একাধিক টুরের বন্দোবস্ত করেছিল সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ)। কিন্তু ফুটবলারদের জন্য যথাযোগ্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা হয়নি। ১৯৮১ সালের গোড়ায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে জাতীয় দলের শিবির বসে। খেলোয়াড়দের রাখা হয়েছিল নির্মীয়মান স্টেডিয়ামে মশামাছিতে ভর্তি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। তার উপর তাঁদের ১৯৮১-৮২ মরসুমে ক্লাবের হয়ে খেলার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছিল না। বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন খেলোয়াড়রাও নাছোড়বান্দা। ফুটবল ফেডারেশন তখন তাঁদের লিখিত বিবৃতি দিতে বলে, যে তাঁরা ক্যাম্প ছেড়ে ক্লাবের হয়ে খেলতে যেতে চান এবং জাতীয় দলের টুর্নামেন্টের আগে আবার ফেরত আসবেন। জয়দীপবাবু লিখেছেন, ওই মর্মে দেওয়া বিবৃতিতে সই করে বেরিয়ে যাওয়া খেলোয়াড়দের ‘রেবেলস’, ‘ডেজার্টার্স’, ‘অ্যান্টি-ন্যাশনালস’ আখ্যা দেয় সংবাদমাধ্যমগুলো। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই ফুটবলারদের কড়া নিন্দা করে। জ্যোতিবাবু স্বয়ং বিধানসভায় মুলতুবি প্রস্তাবের জবাবে এঁদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। এসবের জেরে ভাস্কর গাঙ্গুলি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রসূন ব্যানার্জি, প্রশান্ত ব্যানার্জির মত ফুটবলাররা প্রায় একমাস বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি বলে উল্লেখ করেছেন জয়দীপবাবু। কলকাতার তিন প্রধান, যারা ওই খেলোয়াড়দের উস্কেছিল, তারাও পাশে দাঁড়ায়নি। শেষমেশ খেলোয়াড়দের বাবা-মায়েরা ফেডারেশন সেক্রেটারি অশোক ঘোষের কাছে ক্ষমা চান, কিন্তু ফেডারেশন অনমনীয় মনোভাব বজায় রাখে। নিয়ম করা হয়, জাতীয় শিবিরে সুযোগ পেলে মেডিকাল কারণ না থাকলে বা বাদ না পড়লে শিবির ছেড়ে যাওয়া চলবে না।

তখনো ভারতীয় ফুটবলে পেশাদারি কাঠামো তৈরি হয়নি। কিন্তু খেলোয়াড়রা অনেকেই যে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেন এবং ক্লাবগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট ভাল পারিশ্রমিক পান তা গোপন ছিল না। ফেডারেশন সেই ব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোয় নিয়ে এসে কোনো বিকল্পের কথা ভাবতে পারত। তা না করে গা জোয়ারি ব্যবস্থা করা হয়। শেষপর্যন্ত অধুনালুপ্ত ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিলের কর্তা প্রয়াত ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশর মধ্যস্থতায় দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া ফুটবলাররা সে মরসুমে ক্লাবের হয়ে খেলার অনুমতি পান এবং মরসুমের পর থেকে এশিয়ান গেমসের শিবিরে থাকবেন বলে ঠিক হয়। জাতীয় শিবিরে থাকলে মাসে ২,০০০ টাকা করে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়। জয়দীপবাবু যথার্থই লিখেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা হলেও সম্মানহানি আটকানো গেল না। জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার সম্মান, ফুটবলারদের সম্মান।

অবশ্য জাতীয় দলের খেলার গুরুত্ব লঘু করে দেওয়ার সর্বনাশা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আগেই। তা নিয়ে বিশেষ কাউকে লেখালিখি করতে দেখা যায় না। জয়দীপবাবু এই একই প্রবন্ধে সবিস্তারে সে সম্পর্কে লিখেছেন। বস্তুত প্রবন্ধটি শুরুই হয় ১ জুন, ১৯৭৩ তারিখের ঘটনা দিয়ে। সেদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সশরীরে দিল্লি গিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী (খেলাধুলো তখন ওই মন্ত্রকের অধীনে) নুরুল হাসানকে জানিয়ে আসেন, কলকাতার তিন প্রধানের পক্ষে মারডেকা কাপের জন্য জাতীয় শিবিরে খেলোয়াড় পাঠানো সম্ভব নয়। কারণ তখন কলকাতা ফুটবল লিগ পুরোদমে চলবে। সে বছর মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড়দের ছাড়াই ভারত মারডেকা কাপে যায় এবং ষষ্ঠ স্থানে শেষ করে। জয়দীপবাবুর মতে, নকশাল আন্দোলন পরবর্তী বাংলার যুবসমাজকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সিদ্ধার্থশঙ্কর কলকাতার ফুটবলকে ব্যবহার করেন। আদতে ক্ষতি হয় ভারতীয় ফুটবলের। ক্লাবের স্বার্থে জাতীয় দলের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া চলে – এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায় একজন মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে। এসব পড়তে পড়তে তির্যক হাসি না হেসে পারা যায় না। কারণ যে কলকাতা লিগের খেলার জন্য জাতীয় দলের খেলাকে তুচ্ছ করা হয়েছিল, সেই কলকাতা লিগ আজ ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মোহনবাগান সগর্বে বলে দিতে পারছে তারা লিগে খেলবে না। সেকালের কর্মকর্তারা মনে করতেন কলকাতা লিগ খেতাবের চেয়ে বড় পুরস্কার ফুটবল বিশ্বে নেই, আজকের কর্তারা মনে করেন আইএসএল খেললেই মোক্ষলাভ, কলকাতা লিগ ফালতু। মাঝখান থেকে ভারতীয় ফুটবল গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছে, এগোতে পারছে না।

ঠিক সে কথাই লিখেছেন ধীমান সরকার। তাঁর প্রবন্ধের নাম ‘Going Around In Circles’। তিনি শুরুতেই অপ্রিয় সত্যটা বলে দিয়েছেন। ১৯৯৮ থেকে ২০২২ – এই আড়াই দশকে শুটিং, বক্সিং, ভারোত্তোলন, ব্যাডমিন্টন, কুস্তির মত যেসব খেলায় ভারত অলিম্পিকে যেত স্রেফ অংশগ্রহণ করতে; সেসবে পদক জিতে ফেলেছে, বিশ্বনাথন আনন্দ প্রথম ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার হিসাবে শুরু করে পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছেন। অথচ ভারতীয় ফুটবল দল লুই ক্যারলের থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস গল্পের অ্যালিসের মত প্রাণপণ দৌড়েও সেই দক্ষিণ এশিয়ার এক শক্তিশালী দলই হয়ে রয়েছে। আই লিগকে দুয়োরানিতে পরিণত করা আইএসএল যে ভারতীয় ফুটবলে কোনো যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারেনি, বরং ভারতের ক্লাব ব্যবস্থার আরও ক্ষতিই করেছে তা ধীমানবাবুর লেখায় স্পষ্ট। এমতাবস্থায় জাতীয় দলের উন্নতির আশাও যে দুরাশা তা উচ্চারণ করতে তিনি কসুর করেননি।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

বক্স টু বক্স এভাবে ইতিহাস আলোচনার মধ্যে দিয়ে বর্তমান বিশ্লেষণ ছাড়া আরও একটা জরুরি কাজ করেছে, তা হল ভারতীয় দলের হয়ে অবিস্মরণীয় খেলা দেখানো যে কিংবদন্তীরা আজকের প্রজন্মের অচেনা, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ডাঃ টি আওকে নিয়ে লিখেছেন শারদা উগ্রা, তুলসীদাস বলরামকে নিয়ে সিদ্ধার্থ সাক্সেনা, রহিম সাহেবকে নিয়ে জয়দীপবাবু। অত্যন্ত মূল্যবান অরুণ সেনগুপ্তের নেওয়া সুধীর কর্মকারের সাক্ষাৎকারও। নিজের খেলা, নিজের প্রজন্মের খেলা এবং বর্তমান প্রজন্মের খেলার মান সম্পর্কে এত নির্মোহ মূল্যায়ন করতে আজকাল কোনো খেলার প্রাক্তনদেরই দেখা যায় না।

দু মলাটের মধ্যে শ আড়াই পাতায় ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের নানা দিক জানতে চাইলে, বর্তমানকে ভাল করে বুঝতে চাইলে বক্স টু বক্স চমৎকার। ভুয়ো খবরের যুগে ভারতীয় ফুটবল দলের ১৯৫০ বিশ্বকাপে না খেলা নিয়ে নিয়মিত ব্যবধানে যে গুজবটা ছড়ানো হয়ে থাকে সোশাল মিডিয়ায়, তা খণ্ডন করতেও সাহায্য করবে কাশীনাথ ভট্টাচার্য এবং জয়দীপবাবুর লেখা দুটো প্রবন্ধ। তবে কিছু অসঙ্গতি এড়ানো গেলে ভাল হত। যেমন সায়নবাবুর ‘Golden Quarter’ বলছে ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের পর ইউরোপ টুরে একটা ম্যাচে আজাক্স আমস্টারডামকে ভারতীয় দল হারিয়েছিল ৫-১ ব্যবধানে। কিন্তু শারদা উগ্রার লেখায় ব্যবধানটা হয়ে গেছে ২-১। প্রথম তথ্যটাই সঠিক, কিন্তু এই অসঙ্গতি পাঠককে দিগভ্রান্ত করবে। যে বইতে যত্ন করে ভারতীয় দলের ৭৫ বছরের গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান পর্যন্ত সৃজন করা হয়েছে, ছাপা হয়েছে একগুচ্ছ মূল্যবান ছবি, সে বইতে এ ধরনের ভুল কাম্য নয়।

বক্স টু বক্স
সম্পাদনা: জয়দীপ বসু
প্রকাশক: আইএমএইচ
দাম: ৬৫০ টাকা

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

সুখেন মুর্মুর চদরবদর: অচেনার আনন্দ, অজানার সংকট

ওলট পালট করে দিতে এই গল্পকার সিদ্ধহস্ত। ডাক্তার বর্মণের ভাই নিজের বাবা-মায়ের কাছেও এতই তুচ্ছ যে তার নামকরণ হয় ফাক্তার।

বাঙালির যৌনতা নিয়ে ছুতমার্গ আছে, বাঙালি পাঠক সাহিত্যে যৌনতা এসে পড়লেই নাক সিঁটকায় আর লেখকরাও সযত্নে যৌনতা এড়িয়ে যান — এই বহু পুরনো অভিযোগের ধার ইদানীং কমে গেছে। কারণ মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে পাঠকদের যৌনতা নিয়ে অস্বস্তি বিলক্ষণ কমে গেছে, লেখকরাও আর তত সলজ্জ নেই। অনেকেই যথেষ্ট “সাহসী”। কিন্তু অধিকাংশ যৌনতার বর্ণনা একমাত্রিক, একঘেয়ে। এক লেখকের যৌনতার বর্ণনা অন্যের গল্পে বসিয়ে দিলে তফাত করা যাবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যায়, মহিলা লেখক বর্ণিত যৌনতাও একইরকম দামি অন্তর্বাসশোভিত, পুরুষের মনোরঞ্জনমূলক। সম্ভ্রান্ত মহিলার স্তনসন্ধির ওপারে উঁকিঝুঁকি মেরে পাঠককে কিছুটা নিষিদ্ধ আনন্দের শিহরণ দেওয়া ছাড়া সে বর্ণনা কিছুই করতে পারে না। তাই চমকে না উঠে উপায় থাকে না, যখন পড়ি:

এবার যে মানুষটা ঘরে আসে সে যেন অন্যরকম আলতাফ। নরম, ভালোবাসাময়, সেই সাদির সময়কার আলতাফের মতো মনে হয়। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখে বিদ্যুৎ খেলে যায় আরতির। স্তনবৃন্তে দাঁত ফুটিয়ে আলতাফ হোসেন টাকা চায়। ঘাড়ের থেকে চুলের গোছা সরিয়ে চুমু খেলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আরতি। গোপন কয়েকটি টাকার কথা কবুল করে ফেলে। মারের মুখে কঠিন মেয়ে আরতি। সে-ই কিনা আদরে গলে গলে যায়। তার নিচু টালির চালের ছোট্ট ঘরের বিছানায় ঘুমন্ত ছেলেরা জেগে গেছে টের পায় না। টের পায় না অবশ হতে হতে বাষ্প হওয়ার সময়, ভুলে যায় দিন-রাত প্রতীক্ষার নাম ধরে ডাকার সময়গুলো। এভাবেই মেঘ থেকে মেঘে ঘন হয় আলিঙ্গন। ওষ্ঠের কাঁপন, লালা, ঢুকিয়ে দেওয়া জিহ্বামূল, অবশ অবশ সব খুশিতে না-পাওয়ার দিনগুলো মুছে যায় জলরঙা ছবির মতো। দেওয়াল থেকে নেমে-আসা ক্যালেন্ডারে নায়ক নায়িকার ছবিগুলি জ্যান্ত হয়। শরীর শরীর বলে ডাকে। প্রেম প্রেম বলে বাতাসে ওড়ায় আগুন, ছাই, বিষাদ। আলতাফের সবল শরীরের নীচে পিষ্ট হতে হতে টের পায়, এমনকি একদানা সোনার নাকছাবিটাও আলতাফ আদরে সোহাগে খুলে নিল…

পাঠক, ভুল কারণে উত্তেজিত হয়ে পড়বেন না যেন। তীব্র যৌনতার বর্ণনা উদ্ধৃত করে দুই ভিন্ন ধর্মের নরনারীর যৌন সঙ্গমকে গৌরবান্বিত করছি না। যৌনতা যে মনোমুগ্ধকর হয়েও হরণের হাতিয়ার হতে পারে, তা লিখে ফেলার মুনশিয়ানাকে তারিফ করছি মাত্র। লিখেছেন এণাক্ষী রায়। গল্পের নাম ‘ই-সেভেনের বারান্দা’। আরতির নাম আসলে আরতি নয়। তার নাম আয়েষা, সে আলতাফের বেগম। আয়েষাকে আরতি সাজতে হয় কারণ আমার আপনার মত ফ্ল্যাটমালিকরা আয়েষাকে আরতি জেনে সংসারের প্রায় সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু আসল পরিচয় জানলে রাতারাতি তাড়িয়েও দেয়। দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালানোর জন্য পরিচারিকার চাকরি আরতির কতটা দরকার, তা আলতাফের প্রেমের বহর দেখে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন। যদি না যৌনতার বর্ণনাটাই আপনাকে অভিভূত করে থাকে।

এণাক্ষীর গল্পের চতুর্থ বই সুখেন মুর্মুর চদরবদর অবশ্য বারবার অভিভূত করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। যেমন বিষয় নির্বাচনে, চরিত্র চিত্রণে; তেমনি গদ্যের বর্ণময়তায়। নাম গল্পটার কথাই ধরুন। নামটা পড়েই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠেছেন তো? আমিও তাই করেছিলাম। এই গল্পের খেঁকুরে চেহারার ভদ্রলোকটিও হেসেছিল। আমরা কি আর জানি, চদরবদর একটা শিল্পমাধ্যম, যাতে আছে পুতুলনাচ দেখানো, গান গাওয়া, সারিন্দা বাজানো? গল্পের খেঁকুরে ভদ্রলোকের হাসি আপনি যতক্ষণে দেখতে পাবেন, ততক্ষণে আর তার অজ্ঞতায় আপনার হাসার উপায় থাকবে না। কারণ টের পাবেন, ওই হাসি প্রকৃতপক্ষে গল্পকারের রামচিমটি। অবশ্য ওই চিমটিতে আমাদের কী-ই বা এসে যায়? আমরা তো সুখেন মুর্মুর সহমর্মী নই, তার লুপ্ত হতে চলা বংশানুক্রমিক পেশার সংকট আমাদের সংকট নয়। সরকার টাকা দিচ্ছে গাছ কাটার অপকারিতা প্রচার করতে, আবার সেই সরকারই বহু সুপ্রাচীন গাছ কাটতে বলছে। তাহলে কোনটা উচিত কাজ? এই সংশয়ও আমাদের নয়। কারণ গাছ কাটা পড়লে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোনো প্রেত আমাদের বলে উঠবে না “সুঁখেন, মেলা টাকা পায়ে ব্যাবাক ভুলি যাবা ধরিছিস বাউ!” আমরা বরং বিডিওর মত নিঃসংশয়। “উন্নয়ন তো দরকার!” তবে আমাদের দ্বিধাহীন জগতে সুখেন মুর্মুকে এনে ফেলে আমাদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে ফেলে দেন গল্পকার। বোঝা যায়, বাপ্পাদিত্য মণ্ডলের তৈরি প্রচ্ছদে যে পুতুলগুলো নাচছে সেগুলো শুধু সুখেন মুর্মুর পুতুল নয়, সে নিজেও পুতুল। তাকে দক্ষতর বাজিকর নাচাচ্ছে। গল্পটা পড়ার পর সন্দেহ হবে, আমাকেও কেউ নাচাচ্ছে না তো?

অস্বস্তির অবশ্য এখানে শেষ নয়, শুরু। এমন সব মানুষের গল্প এ বইতে এণাক্ষী আমাদের বলছেন, যাদের অস্তিত্ব যত কম জানা যায় তত স্বস্তিতে থাকা যায়। ধরুন আপনি যদি জানতে পারেন

এই ডিজিটাল যুগেও মেলায় মেলায় তাঁবু খাটিয়ে নাচ-গান হয়, এইসব দলগুলোকে বলে চিত্রহার। সার্কাসের দলের মতো তাঁবু নিয়ে নিয়ে ঘোরে চিত্রহার মালিকেরা। নায়ক নায়িকা ছাড়াও আরো নাচিয়ে লাগে। শাহরুখ খানের গায়ে সারাক্ষণ আঠার মতো লেপ্টে থাকতে চায় হিয়া। হিয়া মনে মনে শাহরুখ খান বললেও ছেলেটার আসল নাম রাজ। আবার রাজটাও আসল নাম নয়, নাচের দলের নাম। আসল নামের হদিশ হিয়া জানে না। নাচের সময় ভুল হলে হাত, কোমর এসব ধরে স্টেপ ঠিক করে দেয় শাহরুখ খান। এই স্পর্শটুকুর জন্য বারবার স্টেপে ভুল করে হিয়া। নিজের কাপড় গোঁজা বুকটা এগিয়ে ঠেকিয়ে দেয় শাহরুখ খানের শরীরে। প্রধান ড্যান্সার হবার জন্য এসব করতে হয় বুঝে গেছে হিয়া।

“ওই মেয়েগুলো ওইরকমই” বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন তো? ওভাবে পার পাবেন না। ‘চিত্রহার’ গল্পের হিয়া কিন্তু শহরের প্রান্তের “নেপালি বস্তি থেকে” আসা মেয়ে নয়। সে আমার আপনার মত পরিবারের ভাল স্কুলে পড়া মেয়ে। কেবল “কালো বলে হিয়া সবসময়ই হীনমন্যতায় ভোগে…পারতপক্ষে অঙ্কিতার পাশে পাশে হাঁটতে চায় না ও। অঙ্কিতার পাশে দাঁড়ালে যেন নিজের কালো রঙটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।” পেরেন্টস-টিচার মিটিংয়ে অন্য মেয়েদের বাবা-মায়ের পাশে হিয়ার বাবা-মা বেমানান। তারাও হিয়ার বাবাকে ছোটলোক ভাবে, কারোর জন্মদিনে হিয়ার নেমন্তন্ন হয় না। হিয়া ব্রেকড্যান্স স্কুলে ভর্তি হতে চায় সবাইকে দেখিয়ে দেবে বলে। “বিপাশা বসু তো কালো, নায়িকা কাজলও কালো। ওরা যদি নায়িকা হতে পারে হিয়া কেন পারবে না?” ক্যান্সারের গ্রাসে চলে যাওয়া মা আর মদ্যে নিমজ্জিত বাবার মেয়ে চিত্রহারের মেয়ে হয়ে যায়। বহু বছর পরে, মা মারা যাওয়ার পরে “মাঠ-ঘাট পেরিয়ে রাত কাঁপিয়ে মুম্বাইয়ের ট্রেন চলে যায় অনেক দূরে। শুকনো পাতা থেকে ডানাগুলো খসে খসে পড়ে। হিয়ার এখন কখনো-কখনো মনে হয় — ওটা ফিরতি ট্রেন, সে ফিরে আসছে। কিন্তু কোথায় ফিরছে সেটা কিছু মনে আসে না।” যে মেয়ে ফিরে আসতে চায় সে কি খারাপ মেয়ে? কেন খারাপ? নাকি সে ভাল মেয়ে? কেন ভাল? পকেটের পয়সা দিয়ে অ্যাপ থেকে ই-বুক ডাউনলোড করে পড়বেন। তা থেকে এতসব হিং টিং ছট প্রশ্ন উঠে এলে কেমন ফেলতেও পারছি না, ওগরাতেও পারছি না অবস্থা হয় না, বলুন?

গল্প পড়েন কেন? চেনাকে নতুন করে চেনার জন্য, নাকি অচেনাকে চেনার জন্য? এ বই কিন্তু মূলত দ্বিতীয়টার জন্য। ভাবুন, এই শরৎকালে আপনি পড়ছেন ময়নার কথা (‘অসুরকন্যা’):

ও যা-দেখে অন্য কেউ দেখতে পায় না কেন! নীল আকাশে ফটফটে সাদা হাঁসগুলো উড়ে যায়। ওদের দুই-একটা পালক খসে পড়ে চেল নদীর ধারে। সেখানে পাথর ফুঁড়ে ওই পাখনার গাছ গজায় তখন। ওই বিষবাতাস ফরফর ক’রে পালকগুলো বাতাসে উড়িয়ে দেয়। ওই সাদা হাঁসের উড়ে যাওয়া, ওই হাঁসের পাখনার গাছ আর কেউ দেখতে পায় না। মনটা টনটনায় ময়নার। ঢ্যাঙ্কুরাকুড় শব্দ শোনা যায় মনের মধ্যে। এই শব্দটা কানে বাজলেই বাতাসে আরও বিষ ভরে ওঠে। বাতাসটা তখন ভারী ভারী ঠেকে। এই সময় বাগানের থেকে বোনাস পাওয়া যায়। তবু নতুন জামা কাপড় কেনে না ময়নারা।

কেন কেনে না? এণাক্ষীর গল্প কেবল সেই প্রশ্নের উত্তরে আটকে থাকে না। দুষ্ট আর শিষ্টের প্রতীক একেবারে উল্টে দেন তিনি।

ওলট পালট করে দিতে এই গল্পকার সিদ্ধহস্ত। ডাক্তার বর্মণের ভাই নিজের বাবা-মায়ের কাছেও এতই তুচ্ছ যে তার নামকরণ হয় ফাক্তার (‘লাল ঘোড়া কালো ঘোড়া’)। এফিডেভিট করিয়ে অমিতাবচ্চন নাম নিলেও সে তুচ্ছতা ঘোচে না। সেই ফাক্তারকেই এক নিমেষে কাউবয় গ্রেগরি পেক করে তোলেন এণাক্ষী। আর নিরুচ্চারে সীমান্তবর্তী গ্রামের পটভূমিতে লিখিত এই গল্পের নায়িকা হয়ে ওঠে ২০১১ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানি খাতুন — এমনই তাঁর কলমের জোর।

গল্প বলার এমন জাদুশক্তির অধিকারী যাঁরা হন, বোধহয় তাঁরাই দেখাতে পারেন ‘কন্যাঋণ’ গল্পের মত সংযম। শেষ ওয়েব পেজে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত এই গল্পকে প্রবীণ সাহিত্যিকের সাথে এক কন্যাপ্রতিম অনুরাগিনীর মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনীর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে এই কাহিনী গল্পে, কবিতায়, মুক্তগদ্যে চর্বিতচর্বণ করে প্রায় বিতৃষ্ণা ধরিয়ে দিয়েছেন এক প্রথিতযশা সাহিত্যিক। এণাক্ষীর জাদুকাঠি সেই বস্তাপচা কাহিনীকে কাঁপন ধরানো উপসংহার দিয়েছে। শেষ কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করার লোভ গল্পকারের চেয়েও বেশি সংযমে সামলে নিলাম। কারণ সবই সমালোচনা থেকে জেনে নেবেন — পাঠকের এই ফাঁকিবাজি এণাক্ষীর প্রাপ্য নয়।

কেতাব-e অ্যাপ প্রকাশিত এই ই-বুকের দাম ১০০ টাকা। বাংলায় লেখালিখি করা পশ্চিমবাংলায় এমনই অভিশাপ, যে দামটা এক প্লেট শস্তা বিরিয়ানির চেয়েও কম। আপনি যদি নতুন কিছু পড়তে চান, অচেনাকে ভয় না করেন — তাহলে এই দাম আপনার কাছে বাধা হবে না। তবে এমন হতেই পারে, যে গল্পের বইতে আপনি এসব চান না। সাহিত্যের কাছে আপনার মুখ্য চাহিদা ভাষার সৌন্দর্য। তাহলেও এ বই আপনাকে হতাশ করবে না। আর জ্বালাব না প্রিয় পাঠক। এ বইয়ের সবচেয়ে সুখপাঠ্য গল্পের খানিকটা দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করি:

ফুটন্ত জলে লম্বা লম্বা চাপাতা ফেললে, একটু পর আস্তে আস্তে হালকা করে রঙ বেরতে থাকে। অল্প অল্প করে সমস্ত জলটাই রঙিন হয়ে ওঠে একসময়। ভোরের আকাশটাকেও তেমন লাগে। অল্প অল্প করে হালকা লালচে রঙ ছড়িয়ে পড়তে পড়তে পুব দিকটা একসময় লাল হয়ে ওঠে। ভোরের আকাশটা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় একরকম করে ফুটে ওঠে।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

হৃদয়ে ভোরের শব্দ: কোলাহলহীন কবিতা

শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীরও প্রেমের চুম্বন দরকার হয় লড়াইয়ের জ্বালানি হিসাবে

অনস্বীকার্য যে সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কিন্তু বাংলা ভাষার অধোগতি যত দ্রুত হচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়েই যেন কবিযশপ্রার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় ফেসবুক টাইমলাইনে কবিতার (যেগুলো পৃথিবীর কোন সংজ্ঞা অনুযায়ী কবিতা নয়) প্রাবল্যে বমি পায়। সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে যখন সত্যিকারের কবিতা মাথা তুলে দাঁড়ায়, তখন বুকের ভেতর থেকে যে শব্দ কানে আসে সেটাই ‘হৃদয়ে ভোরের শব্দ’।

অনাড়ম্বর মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রচ্ছদ উল্টে প্রথম কবিতাটা পড়তে গিয়েই যখন পাই

আশ্চর্য মুহূর্তরা রোদ্দুরের ধারে শুয়ে
অগ্নিশুদ্ধ প্রতীক্ষায় লীন

তখন সহসা বিশ্বাস হতে চায় না এটা কৌস্তভ দাশগুপ্তের প্রথম কবিতার বই।

বিশ্বাস করতাম না, যদি কৌস্তভ আমার স্কুলবেলার বন্ধু না হত। বিশাল চেহারা অথচ ঈষৎ লাজুক। নিতান্ত ঘনিষ্ঠতা না হলে কৌস্তভের ভাবনার হদিশ পাওয়া মুশকিল। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিলাম গোটা হাইস্কুল জীবন এক ক্লাসে পড়ে, অনেক সময় এক বেঞ্চে বসেও কৌস্তভের প্রাণের মাঝে যে এত সুধা আছে সে খবর পাইনি।

হৃদয়ের শব্দ শুনতে পাওয়ার জন্য যে নৈঃশব্দ্য জরুরী, তা প্রতিনিয়ত খান খান হয়ে যাচ্ছে। এ বইটার সবচেয়ে বড় গুণ হল পড়তে পড়তে চারপাশের সেই কোলাহল ক্রমশ আর কানে পৌঁছায় না। মন চলে যায় এমন এক সময়ে যখন প্রেম অনুভবের বিষয় ছিল, উদযাপনের নয়। এ ধরনের কবিতার বা সাহিত্যের একটা সমালোচনা চিরকাল ছিল, হয়ত থাকবেও। সেটা হল এগুলো সমকাল থেকে বিযুক্ত। এই সমালোচনা কোনদিন আমার মাথায় ঢোকেনি। প্রেমের চেয়ে মহত্তর মানবিক অনুভূতি কিছু আছে বলে জানি না, আর অনুভূতি চিরকালীন। আলাদা করে সমকালীন হওয়ার কোন প্রয়োজন তার আছে বলে মনে হয় না। কৌস্তভ যখন লিখছে

আজ কি তবে শিশির বলে ভুল করেছি তোমার চোখের জল?
আজ কি তবে ভোর ছিল না?… শুধুই ছিল ধূসররঙা শোকের চলাচল?

তখন সে নিঃসন্দেহে সব কালের সব প্রেমিকের জিজ্ঞাসাকেই লিখে ফেলছে, এ কালের প্রেমিকের তো বটেই। আমার অবশ্য আরো একটা কথা মনে হয়।

বার্টোল্ট ব্রেখট বলেছিলেন অন্ধকার সময়েও গান হবে, অন্ধকার সময়টাকে নিয়েই গান হবে। ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু সেটাও শেষ কথা নয়। অন্ধকার সময়েও আলোর গান গাইতে হবে। নইলে অন্ধকারের আগে যে আলো ছিল সে বিশ্বাস হারিয়ে যাবে। গল্প, উপন্যাস, সিনেমার কথা জানি না। কিন্তু অন্ধ মেয়েকে জ্যোৎস্নার ধারণা কবি ছাড়া আর কে দেবেন? তাই দারুণ ধ্বংসের মধ্যে, লড়াইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও স্রেফ প্রেমের কবিতা লিখেছে বলে কোন কবিকে পলায়নী মানসিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না। শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীরও প্রেমের চুম্বন দরকার হয় লড়াইয়ের জ্বালানি হিসাবে। তেমনি ধ্বংস, রক্তপাত, প্রতিবাদের কবিতার মতই নীচের পংক্তিগুলোর প্রয়োজনও ফুরোবার নয়।

মেদুর বর্ষায় রাঙানো ভরসায়
দুপুর জলে ভেজা অন্তরীপ
সাঁকোটি পার করে এসেছি, ভেসে গেছি,
সোনালুগাছ রাখে একলা টিপ

তাহলে কৌস্তভের প্রথম কবিতার বই কি নিখুঁত, ত্রুটিমুক্ত? এক্ষুণি দু চারজন প্রথিতযশা কবির সাথে তুলনা করে ফেলা উচিৎ ওকে? বন্ধুবান্ধবদের লেখা নিয়ে তেমন আদিখ্যেতা করার একটা চল হয়েছে বটে, তবে আমি সে রাস্তায় যাব না। কারণ যে কোন কবিতালেখককে শেষ পর্যন্ত নিজের লেখার উপর ভর দিয়েই দাঁড়াতে হয়, বন্ধুদের উচ্ছ্বাসের উপর নয়।
খামতির কথা বলতে গেলে বলতেই হয় এই বইয়ের বেশ কিছু কবিতায় বয়ঃসন্ধির ছেলেমানুষী প্রেমের স্মৃতি কাব্যগুণকে ছাপিয়ে গেছে। সেই কবিতাগুলো মননে বা প্রকরণে অন্যগুলোর উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। দু এক জায়গায় সম্ভবত মুদ্রণ প্রমাদও ঘটেছে, ফলে রসভঙ্গ হচ্ছে। তদসত্ত্বেও প্রথম কবিতার বই লোভী করে তুলল। কৌস্তভের কবিতা এরপর কোন দিকে যায়, প্রেমের কোন অদেখা দিক কৌস্তভ এরপর দেখায় — এইসব জানার লোভ।

যে কবিতাটা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, সেই তিন নম্বর কবিতাটা সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার লোভ আর সামলাতে পারছি না। মধুরেণ সমাপয়েৎ।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি তখন, স্নান সারছে তোদের বাড়ি
থমকে আমার চিলেকোঠায়, দুইখানি চোখ সুদূর পাড়ি
বৃষ্টি এলো, বৃষ্টি এলো! চল ছাদে চল তাড়াতাড়ি
পূবের দিকে বাবার জামা, পশ্চিমে মা দিদির শাড়ি
এইবেলা না তুললে পরে সবটা ভিজে একসা হবে
বৃষ্টিবিকেল, আমার দুচোখ আটকে গেছে কোথায় কবে!
বসতবাড়ির নীল মরসুম, চটজলদি ফুলের টবে
শব্দ কিছু দিই উড়িয়ে, শব্দ কিছু থাক নীরবে

কাঁধের ডানে ছাপা শাড়ির শরীর জুড়ে দমকা হাওয়া
একটা জীবন ছোট্ট ভারী, আমার তোমায় দেখতে পাওয়া
আয় বৃষ্টি যায় বৃষ্টি, জমছে কথা বলতে চাওয়া
ইচ্ছেগুলো স্টীমারঘাটে, ইচ্ছেরা সব নৌকা বাওয়া

নিঝুম রাতের রূপকথারা অসীম নাভি মেঘলা ক্ষত
শূন্য দু’হাত তোমার টানে শ্রাবণধারায় রমণরত
হঠাৎ যেন নেই কেউ নেই, সামনে দাঁড়াও দেবীর মত
দশ দিকে থাক আঁধারজীবন, মাঝখানে প্রেম লজ্জানত
বৃষ্টি এলো, বৃষ্টি এলো! যাচ্ছি ধুয়ে অতর্কিতে
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি তখন… জ্যোৎস্না লুকোয় ১০ এর B তে

আখতারনামা : বিস্মৃত ইতিহাস

একজন শিয়া মুসলমানের কৃষ্ণভক্ত হওয়া লেখকের অসম্ভব কল্পনা বলে মনে হচ্ছে? যদি হয় তাহলে এই উপন্যাস আরো বেশি করে পড়া উচিৎ। কারণ ওয়াজিদ আলি শাহ এমন একজন নিষ্ঠাবান শিয়া মুসলমান যিনি ঝুলনের দিন স্বরচিত নৃত্যনাট্যে পরিখানার পরিদের নিয়ে নাচতেন, নিজে কৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয় করতেন। শুধু তাই নয়, লখনৌয়ের যোগিয়া মেলায় গেরুয়া আলখাল্লা পরে সারা গায়ে ছাই মেখে তিনি নাচতেন। আবার মহরমের দিন খালি পায়ে তাজিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাঁটতেন

akhtarnama

দর ও দীবার পে হসরত সে নজর করতে হৈঁ
খুশ রহো অহল-এ-বতন হম তো সফর করতে হৈঁ

বাঙাল পরিবারের ছেলে আমি। দেশভাগ দেখিনি, পৈতৃকবাড়িতে মানুষ হয়েছি। কিন্তু উদ্বাস্তুর রক্ত আমার গায়ে, উদ্বাস্তুর ভাষা আমার জিভে, উদ্বাস্তুর গান আমার গলায়। ছিন্নমূল মানুষের সাথে আমার নাড়ির টান। তাই বুঝতে পারি, শুধু দাফনের সময়েই রাজা আর প্রজা এক হয়ে যায় না, শিকড় থেকে ছিঁড়ে নিলেও একইরকম যন্ত্রণা হয় রাজা আর প্রজার। তাছাড়া রাজত্ব চলে গেলে আর রাজা কিসের? অবধের গদিচ্যুত, নির্বাসিত রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের আখ্যান পড়তে আমার উৎসাহ মূলত এই কারণে। পৃথিবীজুড়ে উদ্বাস্তুদের মৃত্যুমিছিল দেখতে দেখতে, রোহিঙ্গাদের দেশহীন অস্তিত্ব আর আমাদের দেশপ্রেমিক মনুষ্যত্বহীনতার সাথে আপোষ করতে করতে তাই শামিম আহমেদের ‘আখতারনামা’ পড়তে শুরু করেছিলাম।
ফেলে আসা বাস্তুর অভাব যে বোধ করে না সে উদ্বাস্তু কিনা সেটা আমার কাছে এখনো খুব পরিষ্কার নয় কিন্তু ফেলে আসা বাড়ির দরজা জানালা, পথঘাট, জলহাওয়া, মানুষজনের জন্যে যার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় অবিরত তার উদ্বাস্তু পরিচয় অনিবার্য। অবধের শেষ রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ (সিপাহী বিদ্রোহের সময়টুকু তাঁর নাবালক পুত্র ব্রিজিস কদরের রাজত্ব বাদ দিলে) সেই অধিকারেই উদ্বাস্তু। নইলে কী করে তিনি লেখেন

দরজা দেখি দেয়াল দেখি ব্যর্থ আশে
দেশের মানুষ ভাল থেকো
চললাম এবার পরবাসে।

এ তো শুধু রাজত্ব হারানোর খেদ নয়। আখতারের (ওয়াজিদ যে নামে লিখতেন) এই যন্ত্রণার কথা পড়তে গিয়ে মনে পড়ে যায় ‘কোমল গান্ধার’ এর সেই দৃশ্য যেখানে ভৃগু অনসূয়াকে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার দৃশ্যের অভিনয় বোঝাতে মনে করিয়ে দিচ্ছে ৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার কথা। বলছে “ইমোশন মেমরি ইউজ কর না… মনে কর না, এই কলকাতাই তোমার তপোবন, ঐ যে মিছিল চলেছে ঐ হচ্ছে তোমার নবমালিকা, বনজ্যোৎস্না। ধর কোন ভিখিরি মেয়ে তোমার কাছে পয়সা চাইল… সেই মাতৃহীন হরিণশিশুটি। ভেবে দ্যাখো, যদি কোনদিন এই কলকাতা থেকে, এই বাংলাদেশ থেকে তোমাকে চলে যেতে হয়, এই কলকাতার সবকিছু তোমার পায়ে পায়ে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরবে না?”
এই অনুভূতিই ছিন্নমূল মানুষের অভিজ্ঞান। এই অনুভূতিই তো ধরা রয়েছে আখতারের মিসরায়, ঋত্বিক ঘটকের ফিল্মে। ভাবতে ভাবতেই খেয়াল হয়, যে পর্বের শুরুতে পড়ছি আখতার অবধ ছেড়ে কলকাতায় পৌঁছনোর পরেও তাঁর রাজ্য থেকে বহু মানুষ এসে বিলাপ করছেন, সেই পর্বটার নাম ‘বনপর্ব’। ঋত্বিকের মত শামিমবাবুও মহাভারতে ভর দিয়েছেন এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে। উদ্বাস্তুর ট্রাজেডি সততই এপিক — সে কপর্দকশূন্য রোহিঙ্গাই হোক আর রাজ্য হারানো বিপুল বিত্তশালী রাজা।
কিন্তু আখতার তো একমাত্র রাজা নন যাঁর রাজ্য ইংরেজরা প্রাক-সিপাহী বিদ্রোহযুগে সামান্য ছুতোয় গিলে নিয়েছিল। তাহলে এই ২০১৭য় দাঁড়িয়ে কেনই বা আখতারনামায় আলাদা করে উৎসাহ থাকতে যাবে আমাদের? বুঝতে হলে পড়ুন এই অংশটা

সেইমত যাত্রা শুরু হল। পূর্বে রইলেন জনা চারেক দক্ষ অশ্বারোহী, মধ্যখানে যুবরাজ ওয়াজিদ ও শাহজাদা সিকান্দার, পশ্চাতে কয়েকজন অনুচর। মধ্যাহ্নে যাত্রা শুরু করে তাঁরা সূর্যাস্তের সময় পৌঁছোলেন সিধৌলিতে। সীতাপুরের জমিদার রাত্রিযাপন ও ভোজনের আয়োজন করে রেখেছিলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত অশ্বগুলির এই বিশ্রামের খুব প্রয়োজন ছিল। রাধাকৃষ্ণভক্ত যুবরাজ শুনলেন, এখানেই জন্মেছিলেন বিখ্যাত কবি নরোত্তম দাস। তুলসীদাসের সময়ের এই কবি কৃষ্ণের মিত্র সুদামাকে নিয়ে লিখেছিলেন সুদামা-চরিত। বড়ো কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন সুদামা। স্ত্রী-পুত্রের গ্রাসাচ্ছাদনের ক্ষমতা পর্যন্ত তাঁর ছিল না। একদিন স্ত্রী সুশীলা বললেন, তুমি তোমার বন্ধু কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তো সাহায্য চাইতে পারো, শুনেছি তিনি এখন বিরাট মানুষ। তুমি তাঁর শৈশবের বন্ধু, নিশ্চয়ই তোমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। সুদামা প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেন না। কিন্তু স্ত্রীর পীড়াপীড়ি আর সন্তানদের মুখ চেয়ে গেলেন প্রিয় বন্ধুর কাছে। উপহার হিসাবে পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে গেলেন কৃষ্ণের প্রিয় খাদ্য, খুদ। সুদামাকে দেখে প্রফুল্ল কৃষ্ণ তাঁর অনেক আদরযত্ন করলেন। সুদামা খুব খুশি। তারপর তিনি একদিন সেখান থেকে চলে এলেন। কেন যে কৃষ্ণের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, সেটাই বলতে ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে দেখেন, তাঁর পর্ণ কুটিরের জায়গায় বিরাট অট্টালিকা, স্ত্রী-সন্তানদের দামি বেশভূষা। চমকে গেলেন তিনি। কী করে হল? স্ত্রী সুশীলা বললেন, সবই তোমার মিত্র কৃষ্ণের কৃপা। তাঁর স্ত্রী রুক্মিণী যে স্বয়ং লক্ষ্মী। এই কাহিনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন যুবরাজ। রাতে খোয়াবে দেখলেন, স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁর গৃহের সব কষ্ট লাঘব করার জন্য সুদর্শন চক্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি খোয়াবে তাঁর কাছে পৌঁছতে পারছেন না।

একজন শিয়া মুসলমানের কৃষ্ণভক্ত হওয়া লেখকের অসম্ভব কল্পনা বলে মনে হচ্ছে? যদি হয় তাহলে এই উপন্যাস আরো বেশি করে পড়া উচিৎ। কারণ ওয়াজিদ আলি শাহ এমন একজন নিষ্ঠাবান শিয়া মুসলমান যিনি ঝুলনের দিন স্বরচিত নৃত্যনাট্যে পরিখানার পরিদের নিয়ে নাচতেন, নিজে কৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয় করতেন। শুধু তাই নয়, লখনৌয়ের যোগিয়া মেলায় গেরুয়া আলখাল্লা পরে সারা গায়ে ছাই মেখে তিনি নাচতেন। আবার মহরমের দিন খালি পায়ে তাজিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাঁটতেন।
শকুন্তলার ছেলে ভরত, সেই ভরতের নামে যে ভূখন্ডের নাম ভারতবর্ষ, তা প্রাথমিকভাবে অধিবাসীদের ভাগ করে নেওয়া এক বিরাট মনোভূমি। ওয়াজিদ আলি শাহ ওরফে আখতার সেই মনোভূমির রক্তমাংসের প্রতীক। ইংরেজরা সেকথা বোঝেনি। তাই তাঁর ওসব কাণ্ডকারখানা দেখে তারা প্রচার করত রাজা উন্মাদ। ঠিক তেমনি আজকের শাসকরা যা কিছু ভারতের যৌথ সংস্কৃতি, তাকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছে। বলছে তাজমহল ভারতীয় ঐতিহ্য নয়, মোগল শাসন আসলে হিন্দুদের পরাধীনতার যুগ ইত্যাদি। এই ইতিহাস নস্যাৎ করে দেওয়ার কালে আখতারনামা আমাদের বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
ওয়াজিদ আলির শাসনকাল খুব বেশিদিন নয়, এ বই পড়তে পড়তে বোঝা যায় তিনি যে খুব দক্ষ শাসক ছিলেন তাও নয়। অন্তত যতবড় শিল্পী ছিলেন ততবড় শাসক যে ছিলেন না সেকথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। তবু একথা জোর দিয়ে বলা যাবে না যে এই ২০১৭ র ভারতের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শাসকদের তাঁর থেকে কিছুই শেখার নেই। অযোধ্যা আর কাশীর মত দুটো জায়গা ছিল যে শাসকের রাজ্যে, তিনি যেভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতেন তা থেকে আজকের শাসকদের শেখার আছে বইকি। বিশেষ করে যে শাসকরা দুর্গাপুজোর ভাসান আর মহরমের তাজিয়া কিভাবে একসাথে সামলাবেন ভেবে পান না। আখতার কিন্তু দোল আর মহরম একসাথে সামলেছিলেন।
শেষপর্যন্ত অবশ্য ইংরেজরা নিখুঁত চক্রান্তে সেই সম্প্রীতিও ধ্বংস করে। সেদিক থেকে এ বই ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, লুণ্ঠন, অতঃপর যত দোষ সব ভারতীয় শাসকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া — এসবেরও এক দলিল। বিশেষত আখতারের মৃত্যুর পর মেটিয়াবুরুজে তাঁর অবশিষ্ট স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি যে দ্রুততায় এবং নির্লজ্জায় হজম করা হয় তেমন বেহায়া চৌর্যবৃত্তি আমাদের যুগেও সুলভ নয়।
এই উপন্যাস নিয়ে অনুযোগের জায়গা কি নেই? আছে। প্রথমত, শামিমবাবু সাধারণত যেরকম পাহাড়ি ঝোরার মত গদ্য লেখেন (বিশেষ করে প্রথম উপন্যাস সাত আসমানে যা পাওয়া যায়) এখানে সেটার অভাববোধ করলাম। এ গদ্য যেন হিসেবী কর্পোরেশনের জল। হয়ত তার একটা কারণ বিষয়বস্তু। দ্বিতীয়ত, সময়ে সময়ে মনে হয় লেখক তথ্যে মনোযোগ দিতে গিয়ে গল্পের সুতোটা যেন ছেড়ে দিলেন। অবশ্য কখনোই এতটা ছাড়েননি যে ঘুড়ি কেটে যাবে কিন্তু বোধহয় কিছু তথ্য পরিশিষ্টে পাঠিয়ে দিতে পারলে ঘুড়িটা আরো নির্ভার হয়ে উড়তে পারত। যাঁর ঘুড়িতে এত রঙ তাঁর কাছে এই প্রত্যাশা পাঠকের থাকেই।
এর চেয়েও ভাল লেখা আমার মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে লিখবেন কিন্তু সন্দেহ নেই ‘আখতারনামা’ একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে — ওঁর নিজের লেখালিখিতে তো বটেই, হয়ত সমসাময়িক লেখালিখিতেও। কারণ এ বইটা আমাদের ভুলে যাওয়া অথচ জরুরী ইতিহাসের কিছু পাতা নতুন করে ছাপিয়েছে।

%d bloggers like this: