দর ও দীবার পে হসরত সে নজর করতে হৈঁ
খুশ রহো অহল-এ-বতন হম তো সফর করতে হৈঁ
বাঙাল পরিবারের ছেলে আমি। দেশভাগ দেখিনি, পৈতৃকবাড়িতে মানুষ হয়েছি। কিন্তু উদ্বাস্তুর রক্ত আমার গায়ে, উদ্বাস্তুর ভাষা আমার জিভে, উদ্বাস্তুর গান আমার গলায়। ছিন্নমূল মানুষের সাথে আমার নাড়ির টান। তাই বুঝতে পারি, শুধু দাফনের সময়েই রাজা আর প্রজা এক হয়ে যায় না, শিকড় থেকে ছিঁড়ে নিলেও একইরকম যন্ত্রণা হয় রাজা আর প্রজার। তাছাড়া রাজত্ব চলে গেলে আর রাজা কিসের? অবধের গদিচ্যুত, নির্বাসিত রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের আখ্যান পড়তে আমার উৎসাহ মূলত এই কারণে। পৃথিবীজুড়ে উদ্বাস্তুদের মৃত্যুমিছিল দেখতে দেখতে, রোহিঙ্গাদের দেশহীন অস্তিত্ব আর আমাদের দেশপ্রেমিক মনুষ্যত্বহীনতার সাথে আপোষ করতে করতে তাই শামিম আহমেদের ‘আখতারনামা’ পড়তে শুরু করেছিলাম।
ফেলে আসা বাস্তুর অভাব যে বোধ করে না সে উদ্বাস্তু কিনা সেটা আমার কাছে এখনো খুব পরিষ্কার নয় কিন্তু ফেলে আসা বাড়ির দরজা জানালা, পথঘাট, জলহাওয়া, মানুষজনের জন্যে যার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় অবিরত তার উদ্বাস্তু পরিচয় অনিবার্য। অবধের শেষ রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ (সিপাহী বিদ্রোহের সময়টুকু তাঁর নাবালক পুত্র ব্রিজিস কদরের রাজত্ব বাদ দিলে) সেই অধিকারেই উদ্বাস্তু। নইলে কী করে তিনি লেখেন
দরজা দেখি দেয়াল দেখি ব্যর্থ আশে
দেশের মানুষ ভাল থেকো
চললাম এবার পরবাসে।
এ তো শুধু রাজত্ব হারানোর খেদ নয়। আখতারের (ওয়াজিদ যে নামে লিখতেন) এই যন্ত্রণার কথা পড়তে গিয়ে মনে পড়ে যায় ‘কোমল গান্ধার’ এর সেই দৃশ্য যেখানে ভৃগু অনসূয়াকে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার দৃশ্যের অভিনয় বোঝাতে মনে করিয়ে দিচ্ছে ৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার কথা। বলছে “ইমোশন মেমরি ইউজ কর না… মনে কর না, এই কলকাতাই তোমার তপোবন, ঐ যে মিছিল চলেছে ঐ হচ্ছে তোমার নবমালিকা, বনজ্যোৎস্না। ধর কোন ভিখিরি মেয়ে তোমার কাছে পয়সা চাইল… সেই মাতৃহীন হরিণশিশুটি। ভেবে দ্যাখো, যদি কোনদিন এই কলকাতা থেকে, এই বাংলাদেশ থেকে তোমাকে চলে যেতে হয়, এই কলকাতার সবকিছু তোমার পায়ে পায়ে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরবে না?”
এই অনুভূতিই ছিন্নমূল মানুষের অভিজ্ঞান। এই অনুভূতিই তো ধরা রয়েছে আখতারের মিসরায়, ঋত্বিক ঘটকের ফিল্মে। ভাবতে ভাবতেই খেয়াল হয়, যে পর্বের শুরুতে পড়ছি আখতার অবধ ছেড়ে কলকাতায় পৌঁছনোর পরেও তাঁর রাজ্য থেকে বহু মানুষ এসে বিলাপ করছেন, সেই পর্বটার নাম ‘বনপর্ব’। ঋত্বিকের মত শামিমবাবুও মহাভারতে ভর দিয়েছেন এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে। উদ্বাস্তুর ট্রাজেডি সততই এপিক — সে কপর্দকশূন্য রোহিঙ্গাই হোক আর রাজ্য হারানো বিপুল বিত্তশালী রাজা।
কিন্তু আখতার তো একমাত্র রাজা নন যাঁর রাজ্য ইংরেজরা প্রাক-সিপাহী বিদ্রোহযুগে সামান্য ছুতোয় গিলে নিয়েছিল। তাহলে এই ২০১৭য় দাঁড়িয়ে কেনই বা আখতারনামায় আলাদা করে উৎসাহ থাকতে যাবে আমাদের? বুঝতে হলে পড়ুন এই অংশটা
সেইমত যাত্রা শুরু হল। পূর্বে রইলেন জনা চারেক দক্ষ অশ্বারোহী, মধ্যখানে যুবরাজ ওয়াজিদ ও শাহজাদা সিকান্দার, পশ্চাতে কয়েকজন অনুচর। মধ্যাহ্নে যাত্রা শুরু করে তাঁরা সূর্যাস্তের সময় পৌঁছোলেন সিধৌলিতে। সীতাপুরের জমিদার রাত্রিযাপন ও ভোজনের আয়োজন করে রেখেছিলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত অশ্বগুলির এই বিশ্রামের খুব প্রয়োজন ছিল। রাধাকৃষ্ণভক্ত যুবরাজ শুনলেন, এখানেই জন্মেছিলেন বিখ্যাত কবি নরোত্তম দাস। তুলসীদাসের সময়ের এই কবি কৃষ্ণের মিত্র সুদামাকে নিয়ে লিখেছিলেন সুদামা-চরিত। বড়ো কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন সুদামা। স্ত্রী-পুত্রের গ্রাসাচ্ছাদনের ক্ষমতা পর্যন্ত তাঁর ছিল না। একদিন স্ত্রী সুশীলা বললেন, তুমি তোমার বন্ধু কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তো সাহায্য চাইতে পারো, শুনেছি তিনি এখন বিরাট মানুষ। তুমি তাঁর শৈশবের বন্ধু, নিশ্চয়ই তোমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। সুদামা প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেন না। কিন্তু স্ত্রীর পীড়াপীড়ি আর সন্তানদের মুখ চেয়ে গেলেন প্রিয় বন্ধুর কাছে। উপহার হিসাবে পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে গেলেন কৃষ্ণের প্রিয় খাদ্য, খুদ। সুদামাকে দেখে প্রফুল্ল কৃষ্ণ তাঁর অনেক আদরযত্ন করলেন। সুদামা খুব খুশি। তারপর তিনি একদিন সেখান থেকে চলে এলেন। কেন যে কৃষ্ণের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, সেটাই বলতে ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে দেখেন, তাঁর পর্ণ কুটিরের জায়গায় বিরাট অট্টালিকা, স্ত্রী-সন্তানদের দামি বেশভূষা। চমকে গেলেন তিনি। কী করে হল? স্ত্রী সুশীলা বললেন, সবই তোমার মিত্র কৃষ্ণের কৃপা। তাঁর স্ত্রী রুক্মিণী যে স্বয়ং লক্ষ্মী। এই কাহিনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন যুবরাজ। রাতে খোয়াবে দেখলেন, স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁর গৃহের সব কষ্ট লাঘব করার জন্য সুদর্শন চক্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি খোয়াবে তাঁর কাছে পৌঁছতে পারছেন না।
একজন শিয়া মুসলমানের কৃষ্ণভক্ত হওয়া লেখকের অসম্ভব কল্পনা বলে মনে হচ্ছে? যদি হয় তাহলে এই উপন্যাস আরো বেশি করে পড়া উচিৎ। কারণ ওয়াজিদ আলি শাহ এমন একজন নিষ্ঠাবান শিয়া মুসলমান যিনি ঝুলনের দিন স্বরচিত নৃত্যনাট্যে পরিখানার পরিদের নিয়ে নাচতেন, নিজে কৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয় করতেন। শুধু তাই নয়, লখনৌয়ের যোগিয়া মেলায় গেরুয়া আলখাল্লা পরে সারা গায়ে ছাই মেখে তিনি নাচতেন। আবার মহরমের দিন খালি পায়ে তাজিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাঁটতেন।
শকুন্তলার ছেলে ভরত, সেই ভরতের নামে যে ভূখন্ডের নাম ভারতবর্ষ, তা প্রাথমিকভাবে অধিবাসীদের ভাগ করে নেওয়া এক বিরাট মনোভূমি। ওয়াজিদ আলি শাহ ওরফে আখতার সেই মনোভূমির রক্তমাংসের প্রতীক। ইংরেজরা সেকথা বোঝেনি। তাই তাঁর ওসব কাণ্ডকারখানা দেখে তারা প্রচার করত রাজা উন্মাদ। ঠিক তেমনি আজকের শাসকরা যা কিছু ভারতের যৌথ সংস্কৃতি, তাকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছে। বলছে তাজমহল ভারতীয় ঐতিহ্য নয়, মোগল শাসন আসলে হিন্দুদের পরাধীনতার যুগ ইত্যাদি। এই ইতিহাস নস্যাৎ করে দেওয়ার কালে আখতারনামা আমাদের বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
ওয়াজিদ আলির শাসনকাল খুব বেশিদিন নয়, এ বই পড়তে পড়তে বোঝা যায় তিনি যে খুব দক্ষ শাসক ছিলেন তাও নয়। অন্তত যতবড় শিল্পী ছিলেন ততবড় শাসক যে ছিলেন না সেকথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। তবু একথা জোর দিয়ে বলা যাবে না যে এই ২০১৭ র ভারতের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শাসকদের তাঁর থেকে কিছুই শেখার নেই। অযোধ্যা আর কাশীর মত দুটো জায়গা ছিল যে শাসকের রাজ্যে, তিনি যেভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতেন তা থেকে আজকের শাসকদের শেখার আছে বইকি। বিশেষ করে যে শাসকরা দুর্গাপুজোর ভাসান আর মহরমের তাজিয়া কিভাবে একসাথে সামলাবেন ভেবে পান না। আখতার কিন্তু দোল আর মহরম একসাথে সামলেছিলেন।
শেষপর্যন্ত অবশ্য ইংরেজরা নিখুঁত চক্রান্তে সেই সম্প্রীতিও ধ্বংস করে। সেদিক থেকে এ বই ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, লুণ্ঠন, অতঃপর যত দোষ সব ভারতীয় শাসকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া — এসবেরও এক দলিল। বিশেষত আখতারের মৃত্যুর পর মেটিয়াবুরুজে তাঁর অবশিষ্ট স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি যে দ্রুততায় এবং নির্লজ্জায় হজম করা হয় তেমন বেহায়া চৌর্যবৃত্তি আমাদের যুগেও সুলভ নয়।
এই উপন্যাস নিয়ে অনুযোগের জায়গা কি নেই? আছে। প্রথমত, শামিমবাবু সাধারণত যেরকম পাহাড়ি ঝোরার মত গদ্য লেখেন (বিশেষ করে প্রথম উপন্যাস সাত আসমানে যা পাওয়া যায়) এখানে সেটার অভাববোধ করলাম। এ গদ্য যেন হিসেবী কর্পোরেশনের জল। হয়ত তার একটা কারণ বিষয়বস্তু। দ্বিতীয়ত, সময়ে সময়ে মনে হয় লেখক তথ্যে মনোযোগ দিতে গিয়ে গল্পের সুতোটা যেন ছেড়ে দিলেন। অবশ্য কখনোই এতটা ছাড়েননি যে ঘুড়ি কেটে যাবে কিন্তু বোধহয় কিছু তথ্য পরিশিষ্টে পাঠিয়ে দিতে পারলে ঘুড়িটা আরো নির্ভার হয়ে উড়তে পারত। যাঁর ঘুড়িতে এত রঙ তাঁর কাছে এই প্রত্যাশা পাঠকের থাকেই।
এর চেয়েও ভাল লেখা আমার মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে লিখবেন কিন্তু সন্দেহ নেই ‘আখতারনামা’ একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে — ওঁর নিজের লেখালিখিতে তো বটেই, হয়ত সমসাময়িক লেখালিখিতেও। কারণ এ বইটা আমাদের ভুলে যাওয়া অথচ জরুরী ইতিহাসের কিছু পাতা নতুন করে ছাপিয়েছে।