দেশপ্রেম না ছাই

বাস্তবটা হল আপনি যতবড় ক্রিকেটপ্রেমীই হোন, বি সি সি আই একটি স্বশাসিত সংস্থা। আপনি তার ঘন্টা করতে পারেন। আর ক্রিকেটাররা সেই সংস্থার বেতনভুক কর্মচারী। তারা বি সি সি আই এর কাছে দায়বদ্ধ। আপনার জাত্যভিমানের বন্দুক আপনি তাদের ঘাড়ে রাখেন কোন অধিকারে?

ভারতের হয়ে খেলতে নামা ১১ জন ক্রিকেটারকে কেন আপনার জাত্যভিমান রক্ষার দায়িত্ব নিতে হয় বলুন তো? আপনি কে? ওদের কাউকে আপনি দলে নির্বাচিত করেছেন? সে যোগ্যতা আছে? ক্রিকেটাররা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত তাদের কাছে দায়িত্ববোধ দাবী করলে, প্রত্যেকটা কাজের জবাবদিহি চাইলে তো বলবেন দেশবিরোধী কাজ হচ্ছে। তাহলে যাদের মাইনেকড়ি আপনি দেন না, যাদের যোগ্যতার বিকাশে আপনার কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই, যারা জাতীয় দলে নির্বাচিত হয়েছে নিজেদের যোগ্যতায় (যদি ঘুরপথেও হয়ে থাকে তাতেও তো আপনার কোন ভূমিকা নেই) তারা কেন দেখতে যাবে ম্যাচ জিতে আপনার কোন অহঙ্কার বজায় থাকল কিনা বা হেরে গিয়ে আপনার সম্মানে আঘাত লাগল কিনা?
আপনি বলবেন “আমি দেখি, পয়সা খরচা করি, সেইজন্যই ক্রিকেটে এত টাকা। তাই ওরা ধনী।” তা দ্যাখেন কেন? কেউ আপনাকে বাধ্য করেছে দেখতে? মোদীজি মাইনে পান আপনার আমার আয়করের টাকা থেকে। আইন অনুযায়ী আমি সেটা দিতে বাধ্য, তার বিনিময়ে মোদীজির সরকার আমাকে বিভিন্ন পরিষেবা দিতে বাধ্য, আমার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। কিন্তু আইন আপনাকে ক্রিকেট দেখতে বাধ্য করে না। আপনার ভাল না লাগলে আপনি ক্রিকেট দেখবেন না। পয়সা খরচ করবেন না। চুকে গেল। এভাবে যদি অনেকেই না দেখেন তাহলে বি সি সি আই, মানে কোহলি যে কোম্পানির কর্মচারী, তাদের রোজগার নিঃসন্দেহে কমবে। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে কোহলির দামও কমবে। ফলে তার আয় কমবে। কিন্তু কতটা আয় হলে তার মাইনে বাড়বে বা কমবে কিম্বা কমবে কিনা সেসব কিস্যু আপনার হাতে নেই। কারণ তাকে টাকা দেয় কতকগুলো কোম্পানি। কোহলির দায় অতএব তাদের কাছে, আপনার কাছে নয়।আপনি আসলে ভাবেন বি সি সি আই আপনার সম্পত্তি তাই ক্রিকেটাররাও আপনার সম্পত্তি। এরকম ভাবেন কারণ আপনাকে ভাবানো হয়। চতুর হোটেলমালিক যেমন হোটেলে পা রাখামাত্রই বলেন “নিজের মতন করে থাকবেন, স্যার। আপনাদেরই তো হোটেল।” কিন্তু বাস্তবটা হল আপনি যতবড় ক্রিকেটপ্রেমীই হোন, বি সি সি আই একটি স্বশাসিত সংস্থা। আপনি তার ঘন্টা করতে পারেন। আর ক্রিকেটাররা সেই সংস্থার বেতনভুক কর্মচারী। তারা বি সি সি আই এর কাছে দায়বদ্ধ। আপনার জাত্যভিমানের বন্দুক আপনি তাদের ঘাড়ে রাখেন কোন অধিকারে?
জাত্যভিমান না ছাই। আসলে তো জাতিবিদ্বেষ। ভাগ্যিস রবীন্দ্র জাদেজার নাম রবিউজ্জামান নয়। তাহলেই তো নিজের দেশের ক্রিকেটারকেও বাপ চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে মীরজাফরের আত্মীয় বানিয়ে ফেলতেন। এমন ভাব করতেন যেন ঐ রান আউটটা না হলেই ভারত হৈ হৈ করে জিতে যেত। তা কোটি কোটি ভারতবাসীর অবদমিত ক্যানিবালিজম চরিতার্থ করার দায় বারবার ক্রিকেটারদের কেন নিতে হবে? শুধু ক্রিকেটারদেরই বা কেন?
 

পূজার ছলে তোমায় ভুলে

যে লোক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসে নেতৃত্ব দিয়েছে, রক্তকরবীর ভূমিকায় লিখেছে এই নাটক রূপক নয়, সরকারী গণহত্যার প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছে, কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য গান লিখেছে, নেতাজী কংগ্রেস ত্যাগে বাধ্য হওয়ায় রুষ্ট হয়ে গান্ধীজিকে চিঠি লিখেছে — সেই লোকের ছবি দেখিয়ে বাঙালি ছেলেমেয়েকে শেখায় “নম কর। ঠাকুর।” কোন বাঙালি? যে বাঙালি স্কুলের শেষ ধাপে থাকা ছেলেমেয়েকে পইপই করে শেখায় “কলেজে যাবে পড়াশোনা করতে, রাজনীতি করতে নয়”

rabindranath

একদা এক সহপাঠিনীকে আমার বেশ পছন্দ ছিল, প্রায় প্রেমে পড়ে যাই যাই অবস্থা। অন্য একজনের প্রতি আকর্ষণ প্রবলতর না হলে হয়ত প্রেমে পড়েই যেতাম সেইসময়। সে যা-ই হোক, সহপাঠিনীটির প্রতি আমার দুর্বলতার একটা বড় কারণ ছিল তার রবীন্দ্রপ্রীতি। মেয়েটিকে দেখতে বিলক্ষণ ভাল, আমার সাথে চিন্তাভাবনায় দিব্য মিল বলে মনে হত। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা মেয়েটির গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত চমৎকার লাগত। সে রবিবাবুর গল্প, কবিতা, উপন্যাসও গুলে খেয়েছিল। অতএব আমি ভীষণই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম একসময়। এখন ভেবে শিউরে উঠি, সত্যিই তার প্রেমে পড়ে গেলে কি দুর্দশাই না হত দুজনেরই।
অন্য অনেক হাফসোলপর্ব পেরিয়ে আমার গিন্নীর সাথে প্রেম, অতঃপর বিবাহের পরে ক্রমশ আবিষ্কার করলাম যে আমার সেই সহপাঠিনী আদ্যন্ত মুসলমানবিদ্বেষী। ভারতবর্ষ দেশটা যে হিন্দুদের এবং আর সকলেরই এখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকা উচিৎ — এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। জানতে পেরে শুধু অবাক নয়, রীতিমত আহত হয়েছিলাম। প্রেমিকা না-ই হল, বন্ধু তো বটে। এমন একজন মতের মানুষকে পরম বন্ধু ভেবে বসেছিলাম বুঝতে পারলে নিজের বোধবুদ্ধি সম্পর্কেই প্রশ্ন জাগে মনে। অবশ্য সেটা ২০১৪ গোড়ার দিক। অনেক কাছের লোককেই অচেনা লাগতে শুরু করার সময়। এখনকার মত অতটা গা সওয়া হয়নি তখনো ব্যাপারটা। কিন্তু অভ্যেস হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত আমার যেটা অবিশ্বাস্য লাগত সেটা হল রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকা একজন মানুষের মধ্যে মানবতাবোধের এরকম অভাব, ভারতীয়ত্ব সম্পর্কে এরকম একপেশে ধারণা কী করে জয়ী হয়?
পরবর্তীকালে আরো অনেকের সাথে মিলিয়ে দেখে যা বুঝলাম সেটা হল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের বাঙালিদের এত যে গর্ব, এত গদগদ ভাব — সব ভাঁওতা। রবীন্দ্রনাথকে আমরা বহুকাল হল বাদ দিয়েছি, পড়ে আছে এক ঠাকুর। লক্ষ্মীর পাঁচালি যেমন লোকে বুঝে বা না বুঝে গড়গড় করে পড়ে আমরা তেমন ওঁর গোটা কুড়ি গান আর ডজনদুয়েক কবিতা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিখি এবং পারফর্ম করি। কথাগুলো কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে না। ফলে যে প্রতিযোগিতায় ‘ভারততীর্থ’ আবৃত্তি করে প্রথম হয় সে রামমন্দির নির্মাণে করসেবা করতে অযোধ্যা চলে যায়। যে দিদিমণি রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় “বাংলার মাটি বাংলার জল” গায় সে মুসলমান ছাত্রীর এনে দেওয়া জল খায় না। আরো দেখলাম রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো বড় একটা কেউ পড়ে না। ফলে রবীন্দ্রনাথকে একজন অরাজনৈতিক, সাঁইবাবাসুলভ লোক বলেই বেশিরভাগ বাঙালি মনে করে।
কি আশ্চর্য! যে লোক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসে নেতৃত্ব দিয়েছে, রক্তকরবীর ভূমিকায় লিখেছে এই নাটক রূপক নয়, সরকারী গণহত্যার প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছে, কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য গান লিখেছে, নেতাজী কংগ্রেস ত্যাগে বাধ্য হওয়ায় রুষ্ট হয়ে গান্ধীজিকে চিঠি লিখেছে — সেই লোকের ছবি দেখিয়ে বাঙালি ছেলেমেয়েকে শেখায় “নম কর। ঠাকুর।” কোন বাঙালি? যে বাঙালি স্কুলের শেষ ধাপে থাকা ছেলেমেয়েকে পইপই করে শেখায় “কলেজে যাবে পড়াশোনা করতে, রাজনীতি করতে নয়।”
এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের শক্তি নন, আমাদের দুর্বলতা। যে কোন মধ্যমেধার চলচ্চিত্র পরিচালক বা নিম্নরুচির মেগা সিরিয়াল নির্মাতা একখানা লাগসই রবীন্দ্রসঙ্গীত গুঁজে দিয়েই নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে অন্তত পয়সা উঠে যাবে। লেখাপড়া জানা বাঙালিও এমন বিহ্বল হয়ে দেখবে যে মনে হবে ঋত্বিক বা সত্যজিতের ছবি দেখছে।
আসলে ভদ্রলোকের থেকে আমরা নিয়েছি লবডঙ্কা কিন্তু দিয়েই চলেছি — অবজ্ঞা। জেনে এবং না জেনে। “তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি”।