আমাদের কেউ নেই

এই মেরুকরণে বেশিরভাগ মুসলমান ভোট আর কিছু হিন্দু ভোট তাঁর দিকে পড়লেই তো কেল্লা ফতে। রামনবমীর মিছিলের পরে বোধহয় বুঝেছেন অঙ্ক মিলছে না, তাই এখন আবার নিজেকে বড় হিন্দু প্রমাণ করতে নেমে পড়েছেন। তাঁর পার্টি বজরংবলীর পুজো করছে। তিনি পুরীর মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছেন, উল্টোরথেও জ্বলজ্বল করছেন। কিন্তু যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এখন দুই ধর্মের নেতাদের গরম গরম বাণী দিচ্ছেন। এতদিন যে ইদ্রিশ আলিদের পুষলেন, সে পাপ ভাগীরথীতে ধোয়া যাবে কি?

মমতা ব্যানার্জি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির — একথা ঘুমচোখে জিজ্ঞেস করলে বোধহয় পার্থ চ্যাটার্জিও বলবেন না। তবু রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যে অভিযোগ করেছেন সেটাকে অবিশ্বাস করার কারণ দেখছি না। তার কারণ দুটো। প্রথমত, কেশরীনাথ ত্রিপাঠী প্রাক্তন আর এস এস প্রচারক। আর এস এস দ্বারা শিক্ষিত একজন লোক ভারতীয় সংবিধানকে খুব সম্মান করে এবং নিজের সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন না করার ব্যাপারে খুব সচেতন — এরকম দাবী করলে ভক্তরা যা-ই বলুন, প্রেতলোকে গোলওয়ালকর, হেড়গেওয়াররা খুব রেগে যাবেন। দ্বিতীয়ত, বিজেপি ব্লক সভাপতির মত কথা এই ভদ্রলোক বলেই থাকেন। কদিন আগে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারেও বলেছেন।
কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল ওভাবে কথা বলার সুযোগ ত্রিপাঠীমশাইকে কে করে দিল? উত্তর একটাই। মমতা ব্যানার্জি নিজে।
দেড়শো কোটির দেশে আজকাল মানুষ অপ্রতুল, কিন্তু গরুর কোন অভাব নেই। এক গরুর নিজের ভগবানের মহত্ত্বে এত ঠুনকো বিশ্বাস যে অন্যের ধর্মস্থানে তাঁকে না বসালে শরীরটা বেশ হিন্দু হিন্দু লাগে না। আরেকপাল গরুর আবার নিজের ধর্মের উপরে বিশ্বাস এত ঠুনকো যে সামান্য ফটোশপের ধাক্কাতেই তার অপমান হয় এবং ভাঙচুর, বাড়ি পোড়ানো, মারধর (গণপিটুনিরও দাবী ছিল) না করলে নিজেদের যথেষ্ট মুসলমান মনে হয় না।
কিন্তু কথা হচ্ছে মনে মনে তো অমন অনেকেই ভাবে। এই পরিমাণ হিংসা ছড়ানোর সাহস এদের হয় কখন? তখনই হয় যখন বিশ্বাস থাকে যে “আমার কিস্যু হবে না।” মমতা ব্যানার্জির সরকার সেই বিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল কোন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ছিল না। ২০১১ র পর থেকে, ২০১৬ র পরে বিশেষত, একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। সৌভাগ্যক্রমে এর জেরে এখন পর্যন্ত কোন প্রাণহানি হয়নি, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। নইলে আরো বড় আকার নিত। এই ঘটনাগুলোর সবকটাতেই পুলিশ পৌঁছেছে হিন্দী সিনেমার পুলিশের মত দেরীতে। মালদা, চন্দননগর, ধূলাগড়, খড়গপুর, নদীয়া, অধুনা বাদুড়িয়া — এই সংঘর্ষগুলো কেন আগে থাকতে আটকানো গেল না সেটাও বড় প্রশ্ন। প্ররোচনা যে যাকেই দিয়ে থাক, সে প্ররোচনায় আগুন জ্বলার আগেই জল ঢালা গেল না কেন? সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ তাহলে আছে কী করতে?
আসল কথা মমতা এক ভয়ঙ্কর খেলা শুরু করেছিলেন। এখন আর সামলাতে পারছেন না। বিজেপির হিন্দু মৌলবাদের মোকাবিলা করার বদলে মুসলমান মৌলবাদীদের তোল্লাই দিচ্ছিলেন। বস্তুত ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই দিচ্ছিলেন। মুসলমানদের উন্নয়নের জন্যে হাতেকলমে কিছু করার বদলে নজর ছিল মাথায় কাপড় দিয়ে নমাজ পড়ার ভঙ্গিতে ছবি তোলার দিকে। হাস্যকরভাবে সরকারী হোর্ডিং এ লেখা হচ্ছে “নমস্কার এবং সালাম।” যেন বাঙালি মুসলমান কখনো “নমস্কার” শব্দটা উচ্চারণ করে না। এতে কোন গরীব মুসলমানের কোন উপকার হয়নি। যা হয়েছে তা হল ইসলামিক মৌলবাদীদের বিশ্বাস তৈরি যে “দিদি আমাদের কিচ্ছু বলবে না” আর অন্যদিকে হিন্দু মৌলবাদীদের কাজ সহজ করা। তারা দিব্যি হিন্দুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারছে “দিদি ওদের লোক। হিন্দুবিরোধী।” একইসঙ্গে মমতার আমলে গ্রামে, মফঃস্বলে গত কয়েকবছরে আর এস এস কিভাবে বেড়েছে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় সেটাও দিদির ইচ্ছা।
আদরের দিদি ভেবেছিলেন আর এস এস বাড়লে মুসলমানরা ভয় পাবে, তাঁকে রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে দেখবে আর ঢেলে ভোট দেবে। অন্যদিকে মুসলমান মৌলবাদীদের ভয়ে হিন্দুরা যদি বিজেপির দিকে ঢলে পড়ে তো পড়ুক। এই মেরুকরণে বেশিরভাগ মুসলমান ভোট আর কিছু হিন্দু ভোট তাঁর দিকে পড়লেই তো কেল্লা ফতে। রামনবমীর মিছিলের পরে বোধহয় বুঝেছেন অঙ্ক মিলছে না, তাই এখন আবার নিজেকে বড় হিন্দু প্রমাণ করতে নেমে পড়েছেন। তাঁর পার্টি বজরংবলীর পুজো করছে। তিনি পুরীর মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছেন, উল্টোরথেও জ্বলজ্বল করছেন। কিন্তু যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এখন দুই ধর্মের নেতাদের গরম গরম বাণী দিচ্ছেন। এতদিন যে ইদ্রিশ আলিদের পুষলেন, সে পাপ ভাগীরথীতে ধোয়া যাবে কি?
এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে রাজ্যের প্রধান প্রশাসক কী বললেন? না তিনি রাজ্যপালের কথায় এতটাই অপমানিত যে পদত্যাগ করবেন ভেবেছিলেন। চমৎকার। বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, দাদু সুযোগ পেয়ে চেঁচামেচি করছেন আর মা ছেলেমেয়েদের কী করে বাঁচাব সেটা না ভেবে বললেন “আমি অত্যন্ত অপমানিত। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাব ভাবছিলাম। তারপর ভাবলাম আমি তো শ্বশুরমশাইয়ের মা নই, আমি ছেলেমেয়েদের মা। তাই গেলাম না। কিন্তু যেতে আমার দু মিনিট লাগবে।”
সঙ্কটমুহূর্তে পদত্যাগ যাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া, তিনি হচ্ছেন আমাদের মুখ্য প্রশাসক! আমাদের যে কে বাঁচাবে!
বিঃ দ্রঃ তৃণমূল, বিজেপি, জামাত ইত্যাদি ছাড়াও এ রাজ্যে আরেকটা রাজনৈতিক শক্তি নাকি আছে বলে খবর। তাদের নাম বামফ্রন্ট। তারা গরু নয়, কচ্ছপ। গতকাল কলকাতায় তারা একটা গনগনে মিছিল করেছে। কিসের বিরুদ্ধে? কলেজ স্কোয়ারে মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে। নিষিদ্ধ করার ঘোষণাটা হয়েছিল প্রায় মাসখানেক আগে। অতএব ধৈর্য ধরতে হবে। আর মাসখানেক পরে ওঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে কিছু একটা করবেন আশা করা যায়।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading