মৌলবাদী বনাম মৌলবাদী

এদেশে আমরা তো পারিনি এমন কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে যা দাবি করে ১৯৮৪র দেশজোড়া শিখ গণহত্যার নাটের গুরুদের শাস্তি, ২০০২ এর গুজরাটে মুসলমান গণহত্যার খলনায়কদের শাস্তি। বরং ভারতে তো উল্টোটাই হয়ে চলেছে। গণহত্যার পুরস্কারস্বরূপ মন্ত্রিত্ব পাওয়া যাচ্ছে — যেমন কংগ্রেস আমলে, তেমনি বিজেপি আমলে। গুজরাটের ঘটনায় তবু যে কজনের শাস্তি হয়েছিল তারাও মে ২০১৪র পরে গারদের বাইরে এসে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গণপিটুনিতে অভিযুক্ত রোগভোগে মারা গেলে তার মৃতদেহ জাতীয় পতাকাশোভিত হচ্ছে

বাংলাদেশের হিন্দুদের উপরে অত্যাচার হলে বোধহয় সবচেয়ে উল্লসিত হয় ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা। কারণ তখন ওটা দেখিয়ে তারা বলতে পারে “কিছু বাঞ্চোদ তবুও বলবে ভারতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে” (ভাষাটা দেখে কেউ নাক সিঁটকোবেন না দয়া করে। এই ভাষাতেই ওরা লেখে এগুলো)। কদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটা ফেসবুক পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় মন্দির, বিগ্রহ ভাঙা হয়েছে। হিন্দুবাড়িতে লুঠতরাজ, খুন, জখম ইত্যাদি করা হয়েছে। সেই ঘটনা নিয়েও উপরে যেমন বললাম তেমন পোস্ট দেখতে পাচ্ছি। যে মানসিকতা নিয়ে এই জাতীয় পোস্ট করা হয় তারমধ্যে অনেকগুলো মনুষ্যেতর যুক্তি কাজ করে। যেমন:

১) হিন্দুরা করলেই দোষ হয়ে যায়। এখন যে ওরা (মুসলমানরা) করছে!

২) আমরা তো এখনো কিছুই করিনি (দাদরি ফাদরি ভুলে যান)। দেখাব মজা, দাঁড়াও না (অর্থাৎ গোটা দেশটাকে গুজরাট বানিয়ে দেবো। যদিও বলার সময় বলব গুজরাট নিয়ে মোদীকে মিথ্যে অভিযুক্ত করা হয়। আদালত নির্দোষ ঘোষণা করেছে, ইত্যাদি)।

৩) আমাদের দেশের পাকিস্তানী এজেন্টগুলো (মানে কিছু রাজনৈতিক দল, ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী এবং কিছু সাংবাদিক যারা এখনো সংঘচালিত নয়) বাংলাদেশ, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার নিয়ে তো কিছু বলে না। যত দরদ খালি মুসলমানদের জন্য, না? কই বাংলাদেশের কেউ তো হিন্দুদের জন্য চোখের জল ফেলছে না, এদের এত মড়াকান্না কিসের জন্য?

এক এক করে উত্তর দেওয়া যাক।

১) দোষ হিন্দুরা করলেও হয়, মুসলমানরা করলেও হয়। পৃথিবীর কোথাও এমন আইন আছে শুনেছেন যে খুনীকে মাপ করে দেওয়া হয় এই যুক্তিতে যে আরো অনেকে খুন করেছে? এই যুক্তি একমাত্র সে-ই দেখায় যার উদ্দেশ্যই খুন করা।

২) এই যে তুলনামূলক আলোচনা করে বলছেন আমরা সহিষঞু, এতেই আপনারা নিজেরাই প্রমাণ করছেন সহিষঞু নন। তর্জনী উঁচিয়ে বলছেন “খবরদার অসহিষঞু বলবি না। কিছুই তো করিনি এখনো।” এ সেই সুকুমার রায়ের কবিতা হয়ে গেল “আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে। সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে এমন ভয় পেলে।” কবিতাটা পড়ে যেমন সবাই হাসে, আপনাদের কথাবার্তাও হেসে উড়িয়ে দেওয়া যেত আপনাদের হাতে ক্ষমতা না থাকলে। বস্তুত নেহরু এবং প্যাটেল আপনাদের হেসেই উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন এবং সেটাই ভুল হয়েছিল।

৩) এবার সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগে আসা যাক। প্রথমত, “পাকিস্তানী এজেন্ট” কথাটা ভীষণ বোকাবোকা। চীনা এজেন্ট বললে তাও ভেবে দেখা যেত। পাকিস্তান ভারতের রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক — এদের হাতখরচই দিয়ে উঠতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, ভারতের অগ্রগণ্য সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিলক্ষণ লেখালিখি, আলাপ আলোচনা হয়। আপনারা যথারীতি সেটা চেপে যান। রাজনৈতিক দলগুলোও সময়ে সময়ে ওদেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশ্যেই কথা বলে। নিঃসন্দেহে এদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যতটা বলে ততটা বলে না। কেন বলবে? দলগুলো এদেশের। সংবিধান তাদের এদেশের মানুষের ভালমন্দের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা এদেশের মানুষের দুর্দশা নিয়ে হইহল্লা না করে সারাক্ষণ বাংলাদেশ, পাকিস্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকবে? মৌলবাদী মস্তিষ্ক ছাড়া এরকম চিন্তার উর্বর ক্ষেত্র পাওয়া মুশকিল।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের খবর আপনি জানছেন
কি করে? জানাচ্ছে তো সেদেশের সংবাদমাধ্যম। সেগুলো চালায় কারা? সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিক কারা? সেদেশের মুসলমানরা। হিন্দুদের আক্রমণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে, বাকস্বাধীনতার উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সামনের সারিতেই আছেন মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা। কতজনের প্রাণ গিয়েছে, কতজন দেশছাড়া হয়েছে জানেন না? নাকি না জানার ভান করছেন?
চতুর্থত, সাধারণ মানুষের কথা যদি বলেন, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ঘটনার পরেও দেখলাম ফেসবুকে সবচেয়ে সরব আমার বাংলাদেশি মুসলমান বন্ধুরাই। আমি তো ঘটনাটার কথা প্রথম জানলাম তেমন এক বন্ধুর দেয়াল থেকেই। বন্ধুর কোন দেশ হয় না, ধর্ম হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে বন্ধুদের এই দুটো পরিচয় উল্লেখ না করে উপায় থাকল না, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। শাহবাগে দিনের পর দিন যারা মৌলবাদীদের শাস্তির দাবিতে হত্যে দিয়ে পড়েছিল তাদের অধিকাংশও মুসলমান। আমার অন্তত একজন বন্ধু তার মধ্যে ছিল, একথা বলতে আমি গর্ববোধ করি।
এদেশে আমরা তো পারিনি এমন কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে যা দাবি করে ১৯৮৪র দেশজোড়া শিখ গণহত্যার নাটের গুরুদের শাস্তি, ২০০২ এর গুজরাটে মুসলমান গণহত্যার খলনায়কদের শাস্তি। বরং ভারতে তো উল্টোটাই হয়ে চলেছে। গণহত্যার পুরস্কারস্বরূপ মন্ত্রিত্ব পাওয়া যাচ্ছে — যেমন কংগ্রেস আমলে, তেমনি বিজেপি আমলে। গুজরাটের ঘটনায় তবু যে কজনের শাস্তি হয়েছিল তারাও মে ২০১৪র পরে গারদের বাইরে এসে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গণপিটুনিতে অভিযুক্ত রোগভোগে মারা গেলে তার মৃতদেহ জাতীয় পতাকাশোভিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত হয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন। কারোর দিকে আঙুল তোলা আমাদের সাজে না।