ক্রিকেটার তুমি কার?

এই দল আর ভারতের কৃষকদের হয়ে খেলে না। প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক বছরে যারা চাকরি খুইয়েছে, এ দল তাদেরও নয়।

১৯৯৯-এর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কলকাতার আশেপাশে এ বারের মত হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ছিল না। চেন্নাইতে অবশ্য বছরের কোন সময়েই ঠান্ডা বলে কিছু থাকে কিনা তা বিতর্কের বিষয়। সেখানকার চিপকে চলছিল ভারত বনাম পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ। ৩০শে জানুয়ারি, অর্থাৎ ম্যাচের তৃতীয় দিন, বিকেলে যখন খেলা শেষ হল তখন চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য ২৭১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারতের দুই ওপেনার আউট, ক্রিজে রাহুল দ্রাবিড়। এবং আমাদের নয়নের মণি শচীন তেণ্ডুলকার। “জেতালে ও-ই জেতাবে” — সকলের এমনটাই ধারণা। ওয়াসিম আক্রাম, ওয়াকার ইউনিস, সাকলেন মুস্তাককে সামলে আর কে জেতাতে পারে? রাহুল বড়জোর ম্যাচ বাঁচাতে পারেন। আজহার পারেন না, এমনকি সৌরভ পারেন বলেও আমরা কেউ ভাবছিলাম না। পরদিন দেখা গিয়েছিল, আমরা ভুল ভাবছিলাম না।

আমরা মানে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের ছাত্ররা। বেলুড় মঠের ঠিক পাশেই আমাদের আবাসিক কলেজ; স্বামী বিবেকানন্দের নাকি স্বপ্ন ছিল এই কলেজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমাদের স্বভাব চরিত্র মোটেই অপাপবিদ্ধ ব্রহ্মচারীসুলভ ছিল না। আমরা বিলক্ষণ ক্লাস পালাতাম, স্টাডি আওয়ারে পাঁচিল টপকাতাম নানা কারণে। ক্রিকেট দেখা তার মধ্যে অবশ্যই একটা। ৩১শে জানুয়ারি ম্যাচের ফয়সালা হবে। সেদিন অবশ্য ক্লাস পালাবার দরকার ছিল না। কারণ দিনটা রবিবার। আমরা এক দঙ্গল সেদিন সকালেই হোস্টেল থেকে পলাতক। বেলুড় বাজারের আশেপাশে একগাদা ক্লাব। কোনটা সদ্যনির্মিত তৃণমূল কংগ্রেস প্রভাবিত, কোনটার বাইরে ঝোলে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা লাল পতাকা। কোনটা অমুক গ্রামরক্ষী বাহিনী, কোনটা তমুক সংঘ। আমাদের মত হোস্টেল পালানো ক্রীড়ামোদীদের জন্য সকলেরই অবারিত দ্বার। কারণ পার্টি যার যার, ক্রিকেট সবার। ভারতীয় ক্রিকেটাররাও সবার।

সেদিন সকাল থেকে আবার বেলুড়ের সর্বত্র প্রবল বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বামপন্থী আমি, আমার এক বিজেপি সমর্থক বন্ধু আর মোটের উপর অরাজনৈতিক জনা দুয়েক — এই চারজন টিভির খোঁজে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে চলেছি। এই এখানে বসে শচীনের স্কোয়ার কাট দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, পরক্ষণেই দৌড়তে হচ্ছে অন্য কোথাও, কারণ কারেন্ট চলে গেছে। শুধু আমরা চারজন নয়, একযোগে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের কলেজের বিভিন্ন ব্যাচের জনা পঞ্চাশেক। কেউ এ ক্লাবে অন্ধ ভি কে রামস্বামীর দুবার ড্রপ পড়া বলে সৌরভকে আউট দেওয়া দেখেছে, কেউ ও ক্লাবে দেখে বুঝেছে আজহারের এল বি ডব্লিউ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।

এইভাবে সারা দুপুর অক্লান্ত দৌড়াদৌড়ি করে আমরা শচীন আর নয়ন মোঙ্গিয়ার জুটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি। ধর্মসঙ্কট উপস্থিত হল শচীন নব্বইয়ের ঘরে ঢুকে পড়ার পর। দেখা গেল গোটা এলাকা একসাথে বিদ্যুৎহীন। আমরা আক্ষরিক অর্থে পথে বসে পড়েছি। তারপর কোন একজন সিনিয়র ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, ঐ মোড়ে কংগ্রেসের পার্টি অফিসে টিভি চলছে। সে রাস্তা থেকে দেখেছে। কিন্তু ওরা কি যাকে তাকে ঢুকতে দেবে? দল বেঁধে দৌড়নো হল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অফিসের দিকে। একজন বুক ঠুকে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকু, একটু খেলা দেখা যাবে? মাথা দোলানোর অপেক্ষা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সদলবলে কংগ্রেস ত্যাগ করার পর অতগুলো ছেলে একত্রে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের কোন কংগ্রেস অফিসে ঢোকেনি। কিন্তু আমি আর আমার বিজেপি বন্ধু ইতস্তত করছি। তখনো বামেদের সমর্থনে কেন্দ্রে ইউ পি এ সরকার হয়নি, বরং কয়েক বছর আগেই সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতারা কংগ্রেসের সমর্থনে সরকারে যাবেন না জেদ করে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকে দিয়েছেন। সেই কংগ্রেস অফিসে ঢুকব? আমার বিজেপি বন্ধু আবার দাবি করে সে আসলে গুজরাটি, মাত্র কয়েক পুরুষ আগেই তার পূর্বপুরুষ গুজরাট থেকে বাংলায় এসেছিলেন। সবচেয়ে বিখ্যাত গুজরাটি মহাত্মা থেকে সোনিয়া পর্যন্ত সব গান্ধীকেই সে ঘৃণা করে। তাদের ছবিওলা পার্টি অফিসে সে ঢোকে কী করে? শেষ পর্যন্ত দুজনেই অবশ্য বুক ঠুকে ঢুকে পড়লাম। শচীন জিতে গেলেন, পতাকাগুলো হেরে গেল। কারণ ওগুলো বিভিন্ন দলের পতাকা, শচীনের হাতে যে ভারতের পতাকা।

ম্যাচটা অবশ্য শচীন জেতাতে পারেননি। শেষের দিকে পিঠের ব্যথায় কাবু হয়ে চটজলদি খেলা শেষ করার চেষ্টায় বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উইকেট দিয়ে আসেন। তাঁর চারজন টিমমেট মিলে বাকি এক মুঠো রান করে উঠতে পারেননি। সেই হারের ধাক্কা এত প্রবল ছিল যে আমরা অনেকেই সেদিন সন্ধ্যায় পড়াশোনা করতে পারিনি। কেউ কেউ রাতে খেতেও যায়নি ডাইনিং হলে। এই বিষাদ কেন? কারণ ভারতীয় ক্রিকেট দল সবার হয়ে খেলে। শচীন যখন ব্যাট করতেন, আমাদের সবার হয়ে ব্যাট করতেন। বিরাট কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে, চেতেশ্বর পুজারা, ঋষভ পন্থ — সকলেই সব ভারতীয়ের প্রতিনিধি। এমনটাই আমরা জানতাম। এবার বোধহয় মেনে নিতে হবে, ভুল জানতাম। ওঁরা আসলে বি সি সি আই নামে এক প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারী। সে কোম্পানির মালিকানা এখন বিজেপি নেতা তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সুপুত্র জয় শাহের হাতে। অতএব ক্রিকেটাররা এবং ক্রিকেট এখন কেবল বিজেপি আর তার সমর্থকদের। তা নাহলে ব্যতিক্রমহীনভাবে সকলে কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে টুইট করতে যাবেন কেন? শুভমান গিল বাদে সকলেই তো এতদিন চুপ করে ছিলেন। এমনিতে তো এঁরা দেশের কোন ব্যাপারে মুখ খোলেন না, স্বর্গের দেবতাদের মত থাকেন। হঠাৎ এই বেলা একযোগে মর্ত্যে অবতরণের দরকার পড়ল কেন?

তথ্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হয় যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ২০০৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে বলেছিল, ভারতীয় ক্রিকেট দল হল “the official team of BCCI, not the official team of India”. কিন্তু তারপর আরব সাগর দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট রীতিমত কমিশন বসিয়ে বোর্ড ভেঙে দিয়ে অ্যাড হক কমিটি দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট চালিয়েছেন বেশ কিছুদিন। তারপর নতুন বোর্ড গঠন হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে অভূতপূর্ব বদল হয়েছে। রাজনীতিবিদদের ক্রিকেট প্রশাসনে অংশগ্রহণ চিরকাল ছিল। মাধবরাও সিন্ধিয়া, এন কে পি সালভে, শরদ পাওয়ারের মত কংগ্রেস নেতারা বোর্ডের সর্বোচ্চ পদেও থেকেছেন। তা বলে স্টেডিয়ামের বাইরে অরুণ জেটলির মত তাঁদের বিশাল মূর্তি বসানো হয়নি। ক্রিকেটারদের দিয়ে সরকারের প্রচার চালানো হয়নি। এখন নোটবন্দি হতে না হতেই বিরাট কোহলি পণ্ডিতের মত বলে দেন স্বাধীন ভারতে এটাই সবচেয়ে বিপ্লবী পদক্ষেপ। পুলওয়ামা বিস্ফোরণ, যার তদন্তে সরকার আদৌ মাথা ঘামাল না, সেই বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভারতীয় দল খেলতে নামে আর্মি ক্যামোফ্লাজ ক্যাপ পরে। যদি তারপর ভারতীয় ক্রিকেটাররা বা অধিনায়ক বিরাট সরকারকে প্রশ্ন করতেন পুলওয়ামার শহীদদের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী তার তদন্ত হল না কেন? ধৃত দাবিন্দর সিং কেন জামিন পেল? তাহলে তবু ঐ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকে বিশ্বাস করা যেত। যেহেতু তা করা হয়নি, সেহেতু ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সরকারী মুখপাত্র ছাড়া কিছু ভাবা শক্ত।

এই দল আর ভারতের কৃষকদের হয়ে খেলে না। প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক বছরে যারা চাকরি খুইয়েছে, এ দল তাদেরও নয়। কারণ তাদের সম্বন্ধে ক্রিকেটাররা টুইট করেন না। হঠাৎ লকডাউনে কাজ হারিয়ে যে প্রবাসী শ্রমিকরা কয়েকশো মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন, অনাহারে অর্ধাহারে বেঁচেছেন বা মারা গেছেন, তাঁদের নিয়ে টুইট করার সময়ও বাবুদের হয় না। যতই মহম্মদ সিরাজ বাবার মৃত্যু ভুলে থেকে প্রাণপণ বোলিং করে বিদেশের মাঠে জয়ের রাস্তা দেখান, এই দল নিজেকে ভারতের প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি মনে করে কিনা তা-ও সন্দেহজনক। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় নিজেদের ক্রিকেটাররা বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্যের স্বীকার হওয়ার আগে পর্যন্ত এরা #BlackLivesMatter আন্দোলনের প্রতি কোন সমর্থন জানায়নি। জর্জ ফ্লয়েড কাণ্ডের পর শুরু হওয়া ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে খেলোয়াড়রা এক হাঁটু মুড়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপরে তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, কিন্তু আই পি এল শুরু হয়েছিল ওসব ছাড়াই। ১৯ সেপ্টেম্বর আরম্ভ হওয়া প্রতিযোগিতায় ২৬ অক্টোবর হার্দিক পান্ডিয়া প্রথম ওভাবে প্রতিবাদ করেন, তাও একক প্রয়াসে। অথচ ভারত সরকারের যে কোন সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে এই ক্রিকেটাররাই এক পায়ে খাড়া। সুতরাং এই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সেই ১৯৯৯-এর মত আমি আর আমার বিজেপি সমর্থক বন্ধু — দুজনেই নিজের দল বলে দাবি করতে পারি না বোধহয়। আমার মত লোকেরা এখন সেই বন্ধুর চোখে তো বটেই, ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের চোখেও দেশদ্রোহী।

আরো দুঃখের কথা, সেদিন যে ক্রিকেটারদের সাফল্যকে নিজেদের সাফল্য বলে আমরা মনে করতাম, যাঁদের ব্যর্থতায় আমরা কান্নায় ভেঙে পড়তাম, তাঁরাও আর আমাদের সকলের নন। বিরাট নাহয় বি সি সি আই-এর চাকুরে, শচীন তো তা নন। অনিল কুম্বলেও নন। তবু তাঁরা বাকি পৃথিবীর নিন্দার হাত থেকে সরকারকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। সে কি এঁরা আম্বানিদের বেতনভুক কর্মচারী বলে? এই দুজনের বিতর্ক এড়িয়ে চলা কিন্তু জগদ্বিখ্যাত। শচীন তো বিতর্ক থেকে এতটাই দূরে থাকতে পছন্দ করতেন যে ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ডে অপরাধীদের শাস্তি হয়ে যাওয়ার পরেও বলেছিলেন তিনি নাকি ঐ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না, কিছুই দ্যাখেননি। হঠাৎ মধ্যবয়সে এসে বিতর্কের ভয় উধাও! আর আমাদের প্রথম যৌবনের বিপ্লবী অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। তিনি এখন শালগ্রাম শিলা। পদ ধরে রাখতে নিজের মেয়েকেও সোশাল মিডিয়া পোস্ট ডিলিট করতে বাধ্য করেন। অসুস্থ শরীরেও গতকাল শচীন, কুম্বলের টুইট রিটুইট করেছেন, কর্তব্যে অবহেলা নেই।

এতদিন জানতাম দুঃসময়ে বন্ধু চেনা যায়। দেখা গেল দুঃসময়ে আইকনও চেনা যায়।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

রাজদীপের দ্বীপান্তর: নিরপেক্ষতার পুরস্কার?

মনে করা হত নিরপেক্ষ থাকলে তবেই সত্য উদ্ঘাটন করা যায়; পক্ষপাতিত্ব করলে মিথ্যা প্রশ্রয় পায়। উত্তরসত্য (post truth) আর ভুয়ো খবরের যুগে এই সহজ সমীকরণ যে বাতিল হয়ে গেছে।

“সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা সমার্থক নয়। কোন দেশেই নয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিংবা যাকে বলা হয় মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা তার জন্য লড়াইটা এযাবৎ প্রধানত চলেছে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন-নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। এ লড়ায়ের মোটামুটি মানে, স্বাধীনভাবে মতামত এবং সমকালীন ঘটনাবলীর বিবরণ প্রকাশের অধিকার দাবি করেছে খবরের কাগজ। সে অধিকার মোটের উপর স্বীকৃত হয়েছে অনেক দেশে। কিন্তু খবরের কাগজের স্বাধীনতা মানে, সাংবাদিকের, এমন কী সম্পাদকেরও স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার নয়, এই সোজা কথাটা পরিষ্কারভাবে না বোঝার ফলে অনেক ক্ষোভ এবং অভিযোগ জমে উঠেছে। ক্ষোভ সাংবাদিকের মনে, অভিযোগ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।”

‘সাংবাদিকতা ও কিংবদন্তী’ প্রবন্ধে কথাগুলো লিখেছিলেন অধুনালুপ্ত ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ কাগজের একদা অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর সরোজ আচার্য। হকি খেলায় যেমন সবুজ কার্ড দেখিয়ে খানিকক্ষণের জন্য কোন কোন খেলোয়াড়কে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তেমনভাবে ইন্ডিয়া টুডে কর্তৃপক্ষ অভিজ্ঞ সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাইকে দু সপ্তাহের জন্য চ্যানেল থেকে নির্বাসন দিয়েছেন, উপরন্তু তাঁর মাইনে কেটে নিয়েছেন। এই ঘটনা নিয়ে ভাবতে গিয়ে সরোজ আচার্যের এই প্রবন্ধের কথা মনে পড়ল। সরোজবাবুর জীবদ্দশায় এ দেশে নিউজ চ্যানেল বলে কোন বস্তু ছিল না, কিন্তু এখানে সংবাদপত্রের জায়গায় অনায়াসে সংবাদমাধ্যম শব্দটা বসিয়ে নেওয়া যায়। তাতে অর্থের হেরফের হবে না, আমাদের কাজও হয়ে যাবে। জানি না রাজদীপবাবু বাংলা পড়তে পারেন কিনা, পারলেও সরোজবাবুর লেখা চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। কারণ ইনি পশ্চিমবঙ্গেই অধুনা বিস্মৃত একজন লেখক-সাংবাদিক। বাংলার দিকপাল সাংবাদিকরাই কজন এঁর নাম জানেন সন্দেহ আছে। কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা যাঁদের হতাশ করেছে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা চিন্তিত, তাঁদের জন্য এই প্রবন্ধ চিন্তার খোরাক হতে পারে।

রাজদীপবাবুর ট্র্যাজেডি হল, তিনি অর্ণব গোস্বামী ও সম্প্রদায়ের মত দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে সরাসরি সরকারি দলের মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারেননি। আবার রানা আয়ুব বা সিদ্ধার্থ বরদারাজনের মত বিজেপিকে প্রকাশ্যে দেশের শত্রু আখ্যা দিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাংবাদিকতা করার সাহস দেখাতে পারেননি। ফলে অর্ণববাবু যেখানে টাইমস গ্রুপের মত বিরাট কর্পোরেট সংস্থার চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের মালিকানায় চ্যানেল খোলার রেস্ত পেয়ে গেছেন; সিদ্ধার্থবাবু যেখানে ওয়েব মাধ্যমে চলে গিয়ে মূলত পাঠকের অনুদানের উপর ভিত্তি করে সরকারি আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও নিজে সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝেন তা চালিয়ে যাচ্ছেন; সেখানে রাজদীপবাবুকে নিজের হাতে তৈরি চ্যানেল সস্ত্রীক ছেড়ে আসতে হয়েছে কয়েক বছর আগে। ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গা যেভাবে রিপোর্ট করেছিলেন, তার জন্য বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা তাঁকে নিত্য গাল পাড়ে, বাগে পেয়ে আমেরিকার রাস্তায় কয়েক ঘা বসিয়েও দিয়েছিল। অথচ এখন রাহুল কাঁওয়াল, গৌরব সাওয়ান্তের মত ব্যাজহীন বিজেপি মুখপাত্রের সাথে বসে সাংবাদিকতার ভান করতে হয়। আর সেজন্যে এমনকি বিজেপি বিরোধী সাধারণ মানুষও রাজদীপবাবুর উপর রুষ্ট। প্রবীণ সাংবাদিকের লাঞ্ছনার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করার বদলে অনেকেই বলছেন, যে জন আছে মাঝখানে, তার ঠাঁই নাই কোনখানে — একথা রাজদীপবাবুকে বুঝতে হবে।

পুঁজিবাদী আনন্দবাজার গ্রুপের কাগজের সাংবাদিক অথচ মার্কসবাদী সরোজবাবু তাঁর প্রবন্ধে সারা পৃথিবীর একাধিক প্রবাদপ্রতিম সংবাদপত্র ও সম্পাদকের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন “ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ভীরুতা, কপটাচরণ, দাস-মনোভাব ইত্যাদির অভিযোগ আনবার কোনো অর্থই হয় না। অন্য সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের যেমন তাদের কাজ সম্পর্কে কতকগুলি নির্দেশ মেনে চলতে হয় সাংবাদিকদেরও তেমনি। অন্য সব প্রতিষ্ঠানেও কাজের নীতি নির্ধারণ এবং দায়ভাগটা সাধারণ কর্মীর ইচ্ছা অনুযায়ী হয় না, হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব গণতান্ত্রিক উপায়ে সমানভাবে ভাগ করে দেবার পদ্ধতি সোভিয়েট ইউনিয়নেও আবিষ্কৃত হয়নি। ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ যেমন কলকারখানায়, তেমনই খবরের কাগজেও…”

এই কথাটা উপলব্ধি করতে পারলে রাজদীপবাবুর ত্রিশঙ্কু অবস্থা নিয়ে রাগ করা অযৌক্তিক হয়ে পড়ে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সঙ্গতভাবেই এই প্রশ্ন আসে, যে একই যুক্তিতে রাহুল, গৌরব, হিন্দি চ্যানেলগুলোর আরো উগ্রভাষী রুবিকা লিয়াকত, রোহিত সারদানাদের বা বিভিন্ন কাগজের সম্পাদকদের ছাড় দেওয়া হবে না কেন? তাঁদেরও তো মালিকের মর্জি মেনে চলতে হয়। যদি রবীশ কুমার এনডিটিভি-তে চাকরি না করে রিপাবলিক টিভিতে চাকরি করতেন, তাহলে কি তাঁর পক্ষে এখনকার মত সাংবাদিকতা করা সম্ভব হত?

এতক্ষণ সরোজ আচার্যের প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে গেলে অপ্রাসঙ্গিকতার দিকগুলো বুঝতে হবে। এর জন্য প্রবন্ধকার দায়ী নন, দায়ী সময়।

প্রথমত, সরোজবাবু যে সময়ের লোক, সেই সময়ের সংবাদমাধ্যমের মালিকরা যেরকম পুঁজির প্রতিভূ ছিলেন, তার সাথে আজকের পুঁজির চরিত্রগত ফারাক অনেক। সেই সময় আমাদের দেশের কাগজের মালিকরা, সে আনন্দবাজার পত্রিকার মালিক সরকারবাবুরাই হোন আর হিন্দুস্তান টাইমসের মালিক বিড়লা কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের গোয়েঙ্কা, ব্যবসায়িক স্বার্থে কাগজ চালিয়েও মনে করতেন কাগজের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের কথা বলা, রাষ্ট্রশক্তির গলদ প্রকাশ করা। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার এই চিন্তাভাবনার পিছনে অবশ্যই বড় কারণ ছিল। ১৯৯১ পরবর্তী নিও-লিবারাল পুঁজি কিন্তু লাভের কড়ি ছাড়া কিছু নিয়েই ভাবতে রাজি নয়। ফলে এখন তার স্বার্থ আর রাষ্ট্রশক্তির স্বার্থ অভিন্ন, কারণ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা পরিত্যক্ত। রাষ্ট্রের উপর অতি ধনীদের নিয়ন্ত্রণ গত তিরিশ বছরে বাড়তে বাড়তে এখন চূড়ান্ত। অতএব আগে সংবাদমাধ্যমের মালিকরা অনেক বিষয়ে সম্পাদককে স্বাধীনতা দিতেন, এখন আর দেন না। সচেতন সাংবাদিক অস্বীকার করতে পারবেন না, যে এখন স্রেফ প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ মেনে চলা মানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায়, ঠিক তার উল্টোটা করা। এ অবস্থা সরোজ আচার্যের প্রবন্ধের কালে ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, ঘুষখোর সাংবাদিক চিরকাল ছিল। পি সাইনাথের পেইড নিউজ নিয়ে কাজ এবং কোবরাপোস্টের স্টিং অপারেশন দেখিয়ে দিয়েছে, এখন ঘুষ নেয় খোদ সংবাদমাধ্যম। অতএব এ যুগে সম্পাদক প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে চলাকেই যদি চূড়ান্ত মনে করেন, তাহলে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে তিনি সাংবাদিকতা করছেন না, মালিকের ব্যবসার প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন সাংবাদিকতা, ইংরেজিতে যাকে বলে ফ্রিলান্স জার্নালিজম, তার পরিসর ছিল নিতান্ত সংকীর্ণ। সঠিক অর্থে স্বাধীনতাও তাতে ছিল না। কারণ খবর প্রকাশের জন্য কোন না কোন সংবাদমাধ্যমের দ্বারস্থ হতেই হত। অতএব বিবেক দংশন মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী? এখন ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়ার যুগ। নয় নয় করে কম সাংবাদিক ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে সাংবাদিকতা করছেন না। রোজগারের নিরিখে কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের চাকরির তুলনায় এখনো সেসব নগণ্য, কিন্তু কর্পোরেট যথার্থই বুঝেছে যা বলে দেওয়া হচ্ছে, হুবহু তাই লিখতে বা দেখাতে সাংবাদিকের দরকার হয় না। তাই ছাঁটাইয়ের হিড়িক পড়েছে। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে সাংবাদিকতা করা না হয় না-ই গেল, নিজের চাকরিটা বাঁচানো যাবে কি? যাবে না। এখানে আমরা অবশ্যই সম্পাদক স্তরের সাংবাদিকদের কথা বলছি, কারণ যে সাংবাদিকরা কর্পোরেট মইয়ের নীচের দিকে আছেন, তাঁদের সামনে বিকল্প নেই। কোন পেশাতেই তাঁদের স্তরের লোকেরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বে থাকেন না। কিন্তু উপরতলার লোকেরা স্রেফ চাকরি বাঁচানোর জন্য দিনকে রাত, রাতকে দিন করেন — এমন ছেঁদো যুক্তি আর হয় না। এ হেন সম্পাদকদের শরীরী ভাষাও প্রমাণ করে, তাঁরা যা করছেন সোৎসাহে করছেন। কথাটা যেমন টিভি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমন কাগজের সম্পাদকদের ক্ষেত্রেও সত্যি। কাগজের সম্পাদকদের পাঠক দেখতে পান না, এই যা।

রাজদীপ সরদেশাই ঠিক এখানেই মার খেয়ে গেলেন। এনডিটিভি বা সিএনএন-আইবিএন আমলে যিনি ছিলেন পরিপাটি সাংবাদিক, ইন্ডিয়া টুডের বিভিন্ন শো-তে প্রায়শই তাঁকে অপটু জোকার বলে মনে হয়, কারণ রাহুল বা গৌরবের স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর মধ্যে থাকে না। স্টুডিওর অতিথিরাও লাইভ অনুষ্ঠানে তাঁকে বিজেপি বিরোধী বলে ঠেস দেন, আর তিনি প্রাণপণে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তিনি নিরপেক্ষ। ভুল হোক আর ঠিক হোক, মানতেই হবে, সাংবাদিকতায় সারা পৃথিবীতেই দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত ধারণা ছিল, সাংবাদিকের একমাত্র দায়বদ্ধতা নিরপেক্ষতার প্রতি। কারণ মনে করা হত নিরপেক্ষ থাকলে তবেই সত্য উদ্ঘাটন করা যায়; পক্ষপাতিত্ব করলে মিথ্যা প্রশ্রয় পায়। উত্তরসত্য (post truth) আর ভুয়ো খবরের যুগে এই সহজ সমীকরণ যে বাতিল হয়ে গেছে, অনেককেই তা এখনো বোঝানো যায় না। রাজদীপবাবু তেমন লোকেদেরই একজন। এঁরা এখনো বোঝেননি, সাংবাদিকের একমাত্র দায়বদ্ধতা সত্যের কাছে, যা এখন অধিকাংশ সময়ে রাষ্ট্রের বিপক্ষে যাবে। কারণ মিথ্যা এখন তার অন্যতম হাতিয়ার। ফলে মতামতহীন সাংবাদিকতার এখন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, রাজদীপ মতামতহীন হয়েই ডুবলেন। ২৬শে জানুয়ারি দিল্লির রাজপথে যে কৃষকের মৃত্যু হয়, তাঁর সম্বন্ধে নিজের চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে উনি পুলিসের বক্তব্য (ট্র্যাক্টর উল্টে মৃত্যু) আর আন্দোলনকারী কৃষকদের বক্তব্য (পুলিশের গুলি ট্র্যাক্টর উল্টে যাওয়ার কারণ) — দুটোই বলেন। আসলে সাংবাদিকের ঠিক তাই করার কথা। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, তাঁর চ্যানেলের মালিক তা চাইছেন না। তিনি চাইছেন কেবল পুলিসের বক্তব্যটাই প্রচারিত হোক। দেরিতে উপলব্ধি করে রাজদীপ কৃষকদের বক্তব্য জানিয়ে যে টুইট করেছিলেন তা মুছে দেন এবং কারণ হিসাবে পুলিসের বক্তব্য লেখেন। তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। কেবল মালিক শাস্তি দিয়েছেন তা নয়, দুটো রাজ্য সরকার রাজদীপের বিরুদ্ধে (সঙ্গে আরো পাঁচজনের বিরুদ্ধে) রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এফ আই আর করেছে। এর চেয়ে তিনি কেবল পুলিসের বক্তব্যই বলতে পারতেন।

নির্বাসন এবং মাইনে কাটা যাওয়ার পর, ২৯শে জানুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমসে নিজের কলামে রাজদীপ ২৪ বছর বয়সী নবরীত সিং-এর মৃত্যুর জন্য ফের ট্র্যাক্টর উল্টে যাওয়াকেই দায়ী করেছেন। এই শুভ বুদ্ধির উদয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয় কিনা সেটাই এখন দেখার। ভবিষ্যতে তিনি সরোজ আচার্যের নিম্নলিখিত কথাগুলো মনে রেখে এগোলে হয়ত উভয়সঙ্কট এড়াতে পারতেন। অন্তত যে বাংলা জানা দর্শকরা রাজদীপের নিরপেক্ষতা নিয়ে রুষ্ট, তাঁরা পড়ুন। সমস্যাটা বুঝতে পারবেন। এই কথাগুলো আজও একইরকম সত্যি:

“খবরের কাগজ [পড়ুন সংবাদমাধ্যম] জনসাধারণের সেবক হোক বা না হোক, গোড়ার কথা হল খবরের কাগজ আর পাঁচ রকম জিনিসের মতই ‘প্রপার্টি’ অর্থাৎ সেই প্রপার্টির স্বত্ত্বাধিকার যতক্ষণ সব বিষয়ে শেষ কথা বলতে অধিকারী ততক্ষণ সংবাদপত্রের [সংবাদমাধ্যমের] স্বাধীনতা, জন স্বার্থরক্ষা ইত্যাদি বিষয় প্রপার্টির স্বার্থদ্বারা নিয়ন্ত্রিত।”

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

প্রসঙ্গ কৃষক-আন্দোলন: প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর কে জানায়?

অধুনা ক্ষমতার বিরুদ্ধে কলম ধরলে কারাবাস হয় পরে, আগে সাংবাদিকের চাকরি যায়।

দেশে একটা কৃষক-আন্দোলন চলছে। দেশে মানে ‘সন্ত্রাসবাদীদের জায়গা’ কাশ্মিরে নয়, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নয়, এমনকি ‘দুর্বোধ্য’ ভাষায় কথা বলা তামিলনাডু, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা বা কেরলেও নয়। আন্দোলনটা চলছে খোদ রাজধানী দিল্লিকে ঘিরে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে অনেকগুলো কৃষক সংগঠনের সদস্যরা দিল্লির এই হাঁড়-কাঁপানো শীতে পথে বসে আছেন সপরিবার। তাঁরা ভারত বন্‌ধ ডাকলেন, বিজেপি ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল সমর্থন করল। এই আন্দোলনের দাবিগুলো কী কী? খুব লম্বা কোনও দাবি সনদ নেই। অতিমারির মওকায় বিনা আলোচনায় অর্ডিন্যান্স জারি করে, পরে সংসদে বুলডোজার চালিয়ে (রাজ্যসভায় ভোটাভুটি হতে না দিয়ে) পাশ করিয়ে নেওয়া কৃষি আইনগুলো বাতিল করতে হবে, আর প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল বাতিল করতে হবে— দাবি এটুকুই। দাবিগুলো কি ন্যায্য, না অন্যায্য? সরকার যে বলছে এই আইনগুলোতে কৃষকদের ভালই হবে— সে কি নেহাত বানানো কথা? মনে এসব প্রশ্ন জাগলে আপনি কোথায় যাবেন? খবরের কাগজ পড়বেন অথবা টিভি দেখবেন তো? কিন্তু সেখানে এসবের উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

প্রথমত, সর্বভারতীয় খবরের চ্যানেল আপনাকে অনেক বেশি করে দেখাবে চিনকে ভারত ‘কেমন দিল’ (যদিও চিনই প্রতিনিয়ত ভারতকে ‘দিয়ে চলেছে’ সীমান্তবর্তী এলাকায়। বদলে ভারত বিবৃতি ছাড়া বিশেষ কিছুই দিতে পারেনি এখনও পর্যন্ত); পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর একদা-ঘনিষ্ঠ নেতা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন কিনা, দিলে কবে দেবেন, আর কে-কে অপেক্ষমান যাত্রীর তালিকায় আছেন, ইত্যাদি। সর্বভারতীয় কাগজগুলোতে এসব খবরের পাশাপাশি ঢালাও লেখা থাকবে নরেন্দ্র মোদি ‘মন কি বাত’-এ কী বললেন। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমও তথৈবচ। টিভি খুলে বিজেপি আর তৃণমূলের প্রত্যেকটি গ্রামীণ ঝগড়ার পুঙ্খানুপুঙ্খও আপনি জেনে যাবেন, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় থাকবেই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বহুবিলম্বিত ডিএ প্রাপ্তির ঘোষণা (যেন মহানুভব সরকারের দয়ার শরীর, তাই ওটা দিচ্ছেন)। বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে এলে যে ধরনের ঘোষণা দেশের সব সরকারই করে থাকে, সেগুলোও পাবে যথাযোগ্য মর্যাদা। কৃষক-আন্দোলনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে কেবল কোনও সংবাদসংস্থার প্রতিভাবান আলোকচিত্রী আন্দোলনকারীদের দৃষ্টিনন্দন ছবি তুলতে পারলে তবেই। সঙ্গে থাকবে দুই কি তিন কলমে ছড়ানো একটুকরো খবর (যা আন্দোলনের শুরুর কয়েকদিন ছবিহীন এক কলম বা দু কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল)। ‘এরপর অমুক পাতায়’…

দ্বিতীয়ত, এটুকু খবরেও আপনাকে তথ্য দেওয়া হবে যৎসামান্য। ‘সরকারের ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে’, ‘কৃষকরা বলছেন’-জাতীয় ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি শব্দবন্ধে আপনাকে কেবল জানিয়ে দেওয়া হবে ব্যাপারটা খুব পুঁদিচ্চেরি (টেনিদার ভাষায়) এবং সত্বর মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কৃষকদের দাবিদাওয়া সম্বন্ধে আপনি তেমন কিছু জানতে পারবেন না, তার ভালমন্দ নিয়ে কোনও গভীর আলোচনা পাবেন না, আন্দোলনকারীদের সম্বন্ধে বা আন্দোলনের প্রধান নেতাদের মতামত কিংবা রাজনীতি নিয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারবেন না।

তবুও তো আপনি জেনে যাচ্ছেন। কী করে জানতে পারছেন? ভেবে দেখুন, আপনি জানছেন মূলত সোশাল মিডিয়া থেকে। বিভিন্ন খবর ও মতামতের সাইটের লিঙ্ক শেয়ার হচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। কোনও-কোনও সাংবাদিক অকুস্থল থেকে সরাসরি টুইট করছেন। আপনি সেখান থেকেই জানতে পারছেন। কিন্তু ওভাবে জানার সমস্যা হল, যাঁরা এই আন্দোলনের পক্ষে, তাঁদের কাছে কৃষকদের বার্তা পৌঁছাচ্ছে, আর যাঁরা বিপক্ষে তাঁরা নির্বিবাদে ‘খালিস্তানি জুজু’ দেখে যাচ্ছেন। তথাকথিত স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো যে নিরপেক্ষতার কথা বলে অনবরত, ‘বোথ সাইডস অফ দ্য স্টোরি’ নামক যে জিনিসটার পোশাকি আলোচনা চলে, সেটাকে এইভাবে তারাই ধ্বংস করে দিচ্ছে।

কিন্তু এমন হচ্ছে কেন? এককথায় বিজেপি মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে বললে এর উত্তর হয় না। কারণ কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করা, তার পিছনে দুরভিসন্ধি আবিষ্কার করা ভারতের (প্রায় সব দেশেরই) সংবাদমাধ্যমের পুরনো অসুখ। তফাত এইটুকু যে, অতীতে কৃষক-শ্রমিক বিরোধী সরকারও আলোচনার প্রয়োজন স্বীকার করত, মোদি-সরকার বাধ্য হয়ে আলোচনায় বসেছে। ভেবেছিল, এর আগের আন্দোলনগুলোকে যেমন শহুরে নকশাল বা পাকিস্তানিদের আন্দোলন বলে দেগে দিয়ে দাঙ্গা আর দমননীতি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া গিয়েছিল— এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই করা যাবে। তাহলে আর একটু তলিয়ে দেখা যাক, কেন এ হেন অবহেলা।

মূলধারার সংবাদমাধ্যম বলতে বোঝায় খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোকে। আমাদের দেশে বিরাট পুঁজি না থাকলে দৈনিক সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল চালানো বরাবরই দুষ্কর। ফলে কাগজ আর চ্যানেলের মালিকরা সকলেই বড়-বড় শিল্পপতি। টাইমস গ্রুপের জৈনদের মতো অনেকের সংবাদ-ব্যবসাটাই মূল ব্যবসা। আবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের মালিক গোয়েঙ্কারা বা হিন্দুস্তান টাইমসের বিড়লারা অন্য নানা ব্যবসাতে আছেন, আবার সংবাদের ব্যবসাতেও আছেন। সংবাদের ক্রেতা কারা? মূলত ভদ্রলোকেরা, চাষাভুষোরা নন। নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে নিশ্চয়ই মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তাতে সংবাদমাধ্যমের ক্রেতার চাহিদা বদলে যায়নি। যে পাঠক কাল কোনওমতে সংসার চালাতেন, তিনিও আজ হাতে কিছু বেশি টাকা পেয়ে বহু বছরের বড়লোকের মতোই শেয়ার বাজারের খবর চান, ব্যাঙ্কক বা ফুকেত বেড়াতে যান। কাল যে শ্রমিক কারখানায় ধর্মঘট করে দাবি আদায় করতে চাইতেন, আজ তাঁর আইটি এঞ্জিনিয়ার সন্তান ধর্মঘট করার অধিকার জরুরি বলে মনে করে না, ধর্মঘট কর্মনাশা বলেই মনে করে। তার সকালবেলার কাগজ তাকে তার পছন্দের কথাই পড়াতে চায়, তার প্রিয় চ্যানেল সে যা শুনতে চায় বা দেখতে চায় তা-ই দেখায়। নীল বিদ্রোহের যুগের হরিশ মুখার্জির কথা ভেবে লাভ নেই। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের ভারতীয় প্রেসের কথা ভেবেও লাভ নেই। তখন পুঁজিপতি কাগজ মালিকদেরও লক্ষ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুঁজি যে পুঁজির নিয়মেই চলবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলনকে কেনই বা সে গুরুত্ব দিতে যাবে?

এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেরই মন বিদ্রোহ করবে। আজকের ডিসটোপিয়া কি একেবারেই নতুন নয়? হ্যাঁ, নতুনত্ব নিশ্চয়ই আছে।

কৃষক-আন্দোলনের খবরকে প্রাপ্য গুরুত্ব না-দেওয়া এক জিনিস, আর আন্দোলনকে সরাসরি অতীতের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া আরেক জিনিস। এটা নতুন, তবে এ-ও মনে রাখা ভাল যে, গত দশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেগে দিয়েছে এই মিডিয়াই, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও পাকিস্তানের চক্রান্ত বলে দেগে দিয়েছে এই মিডিয়াই। সেদিক থেকে এবারের আচরণটাও নতুন নয়।

আসলে লাভের কড়ি মূল কথা হলেও, দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্তও সংবাদমাধ্যমের মালিকরা মনে করতেন, কিছুটা সামাজিক দায়িত্ব তাঁদের আছে। এর পিছনে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি হয়তো একটা কারণ। অথবা হয়তো ভারতীয় মধ্যবিত্তের দুর্বলতর মানুষের প্রতি যে সহমর্মিতা ছিল, সেকথা মাথায় রেখে সংবাদমাধ্যম সবরকম লড়াই আন্দোলনকেই খবর হিসেবে দেখতে বাধ্য হত। এখন আর সে দায় নেই, কারণ মধ্যবিত্ত বদলে গেছে— ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চলতি কৃষক-আন্দোলনের অন্যতম নেতা হান্নান মোল্লা সখেদে যা বলেছেন। হেতু যা-ই হোক, সংবাদমাধ্যমের মালিকরা আগে মনে করতেন সংবাদসংগ্রহ বিশেষজ্ঞের কাজ এবং সংবাদ পরিবেশন মানে আসলে, মোটের উপর, ক্ষমতার দোষত্রুটি প্রকাশ করা। সেই কারণেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধি জরুরি অবস্থা জারি করেও সংবাদমাধ্যমকে পোষা তোতাপাখি বানাতে পারেননি। বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, কুলদীপ নায়ারের মতো সম্পাদকরা কারাবাস করে ফেরত এসে আবার কলম ধরতে পেরেছেন। অধুনা ক্ষমতার বিরুদ্ধে কলম ধরলে কারাবাস হয় পরে, আগে সাংবাদিকের চাকরি যায়। আজকের মালিক সংবাদসংগ্রহ চান না, চান মুনাফা বৃদ্ধির জন্য বিত্তবান ক্ষমতাশালীর অনুগ্রহ। যেমন দিল্লিতে, তেমনই রাজ্যে-রাজ্যে। এ কাজে বিশেষজ্ঞ লাগে না, লাগে যা-বলেন-তাই-লিখি বাহিনী। তাই চতুর্দিকে সাংবাদিক ছাঁটাই হচ্ছে, কাগজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, চ্যানেল তুলে দেওয়া হচ্ছে এমন একটা সময়ে, যখন স্বাধীনতার পরে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, সামাজিক বিভাজন তুঙ্গে, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারগুলো নেহাত কথার কথা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ যখন আরও বেশিসংখ্যক এবং বেশি সমালোচক সাংবাদিক দরকার ছিল, সেই সময় সংবাদসংগ্রহের কাজটাই তুলে দেওয়া হচ্ছে। অজুহাত হিসেবে কয়েক মাস আগে ছিল কোভিড-১৯, এখন অর্থনৈতিক মন্দা। সিংঘুতে সংবাদসংগ্রহ করতে যাবে কে, লোক কোথায়? লোক যেন না থাকে সে ব্যবস্থাই তো করা হয়েছে সযত্নে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মালিক রামনাথ গোয়েঙ্কাকে একবার এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন “আপনার অমুক রিপোর্টার খুব ভাল কাজ করছে।” রামনাথ তৎক্ষণাৎ সেই রিপোর্টারকে বরখাস্ত করেন। এখন যুগ বদলেছে। কোথায় কে কোন কাগজের সম্পাদক হবেন, অমুক চ্যানেলের তমুক জেলার সংবাদদাতা কে হবেন, তা-ও ঠিক করছেন মন্ত্রীরা। রবীশ কুমারের মতো কয়েকজন কথা শুনছেন না, ফলে দেখাই যাচ্ছে “ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কাহার পিছু পিছু”। সুতরাং কোনটা খবর কোনটা নয়, কোনটা কত বড় খবর সেটাও যে মন্ত্রীসান্ত্রীরাই ঠিক করে দিচ্ছেন তা বোঝা কি খুব শক্ত?

আমরা যারা কাগজের পাঠক আর টিভির দর্শক, তারা না-বুঝলেও আন্দোলনকারী কৃষকরা বিলক্ষণ বোঝেন। তাই বেশকিছু চ্যানেলের সাংবাদিককে প্রোপাগান্ডা সংগ্রহে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে।

তথ্যসূত্র

https://theprint.in/theprint-essential/what-is-electricity-amendment-bill-2020-and-why-farmers-are-opposing-it/555186/
https://indianexpress.com/article/india/hannan-mollah-idea-exchange-farmer-protests-farm-laws-7094428/
https://www.firstpost.com/india/bad-journalism-makes-a-lot-more-noise-raj-kamal-jhas-speech-at-ramnath-goenka-awards-3088184.html

https://4numberplatform.com এ প্রকাশিত

%d bloggers like this: