ভারত বনাম ইন্ডিয়া: আমাদের সেই তাহার নামটি

মোহন ভাগবত বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে।

যা রটে তার কিছু

যেদিন বিজেপিবিরোধী জোটের নামকরণ হল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স, সংক্ষেপে ইন্ডিয়া, সেদিন সঙ্ঘ পরিবারের প্রবল বিরোধী এক অগ্রজ বন্ধু বলেছিলেন “সবই ভাল, কিন্তু সেই অ্যাংলোফাইল নামটাই ধরে থাকতে হল? ইন্ডিয়া না করে কোনোভাবে ভারত করা গেল না নামটা?” তিনিও অবশ্য স্বীকার করেছিলেন, গত এক দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে যেভাবে বিজেপিই ঠিক করে দিয়েছে ইস্যু কোনটা আর বিরোধীরা কেবল তার বিরোধিতা করে গেছে, সেই ধারা উলটে দিয়েছে ওই নাম। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, সরকারি দলের মুখপাত্র এবং তাদের কুখ্যাত আই টি সেল হিমশিম খাচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক আলোচনার যে মানদণ্ড তারাই তৈরি করেছে, তাতে ইন্ডিয়া নামধারী কাউকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা চলে না। বললেই পালটা আক্রমণ হবে “তার মানে আপনি অ্যান্টি-ইন্ডিয়া?” নাম যে সবকিছু নয়, চরম দেশদ্রোহী কোনো দলও নিজের নামের সঙ্গে দেশের নাম জুড়তেই পারে – এই যুক্তির বাজার বিজেপি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে বহুকাল হল। বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের নাম বদলে প্রয়াগরাজ রাখা হয়েছে, মোগলসরাই হয়ে গেছে দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। এগুলো তো প্রাচীন জায়গা, সাম্প্রতিককালে ঝাঁ চকচকে শহর হয়ে ওঠা গুরগাঁওয়ের নাম পর্যন্ত বদলে গুরুগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির ঔরঙ্গজেব রোডেরও নাম বদলে গেছে। কারণ বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার মনে করে নাম ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্যাঁচে পড়ে শেক্সপিয়র সাহেবের মত নামে কী আসে যায় বললে নিজেদের সমর্থকরাই শুনবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখনিঃসৃত বাণী সমর্থকদের কাছে অমৃতসমান। তাই তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নামেও ইন্ডিয়া থাকে বলে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হল না দেখে শেষ চেষ্টা ছিল ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে ‘ঘমন্ডিয়া’ বলা। কিন্তু দেখা গেল, ওটা ‘মিত্রোঁ’ বা ‘ভাইয়োঁ ঔর বহনোঁ’-র অর্ধেক জনপ্রিয়তাও অর্জন করতে পারল না। ফলে নামের লড়াইটা তখনকার মত ইন্ডিয়া জোট জিতেই গিয়েছিল।

কিন্তু হার স্বীকার করে নেওয়া বিজেপির স্বভাব নয়। হলে একাধিক রাজ্যে ভোটে না জিতেও তারা সরকার গঠন করতে পারত না। তাছাড়া সত্যোত্তর পৃথিবীর বাস্তবতা বিজেপির মত করে কেউ বোঝে না। তারা জানে, আজকের দুনিয়ায় বাস্তবে কী ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে বড় কাজ হল মানুষ কী জানছে এবং জেনে কী ভাবছে তা নিয়ন্ত্রণ করা। অতএব যা ভাবলে আমার সুবিধা লোককে সেটাই ভাবাতে হবে, অন্য কথা ভাবার ফুরসত দেওয়া চলবে না। সুতরাং অবিলম্বে চলে এল জল্পনা কল্পনা চালানোর মত বিষয় – এক দেশ, এক নির্বাচন। আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসবে ঘোষণা করা হল এবং কী নিয়ে আলোচনা হবে তা সংসদীয় প্রথায় প্রকাশ না করে গোদি মিডিয়াকে দিয়ে সম্ভাবনা হিসাবে ভাসিয়ে দেওয়া হল এক দেশ, এক নির্বাচনের কথা। এতে বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল এই পরিকল্পনার বিরোধিতায়, নিজেদের সরকারবিরোধী বক্তব্যগুলো আর মানুষের সামনে তুলে ধরার সময় রইল না। জনপরিসর থেকে হারিয়ে গেল মণিপুর, হরিয়ানার দাঙ্গা, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, বিদেশের সংবাদমাধ্যমে আদানি গ্রুপের আর্থিক দুর্নীতির নতুন প্রমাণ সামনে আসায় তাদের বিরুদ্ধে ফের ওঠা যৌথ সংসদীয় তদন্তের দাবি। এক দেশ, এক নির্বাচন নিয়ে হইচই না কাটতেই সরকারপক্ষ নিয়ে এসেছে আরেক অনন্ত জল্পনার বিষয় – দেশের নাম ইংরেজিতেও ইন্ডিয়া থেকে বদলে ভারত করে দেওয়া হবে কি?

এমনিতে বিজেপির ভোটসর্বস্বতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্রেফ ভোটে জেতার জন্যে তারা করতে পারে না এমন কাজ নেই। ফলে এক দেশ, এক নির্বাচন চালু করা অথবা দেশের নাম বদলানোর দিকেও এগোতেই পারে। বিজেপির পুরনো বন্ধু এবং উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ইদানীং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া মায়াবতী যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন রাজনৈতিক সংগঠন বা জোটের নামে ইন্ডিয়া ও ভারত শব্দ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করার আবেদন নিয়ে, হাস্যকরভাবে ইন্ডিয়া জোটকে দায়ী করেছেন বিজেপিকে দেশের নাম বদলে দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য, তাতে এই সন্দেহ জোরদার হয়। কিন্তু এহ বাহ্য। আলোচনাটা আরেকটু গভীরে গিয়ে করা দরকার।

যেখানে বাঘের ভয়

লক্ষণীয় যে এক দেশ, এক নির্বাচন এখনো স্রেফ জল্পনার বিষয় হলেও (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটা কমিটি তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করা হয়নি) দেশের নাম সরকারিভাবে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত সরকারের তরফ থেকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতিকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ লিখে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা স্রেফ কারোর স্বপ্নার্দ্র বিছানার জিনিস হয়ে নেই, সরকারি কাগজপত্রে লিখিত আকারে এসে পড়েছে। সুতরাং সাধারণ মানুষের এ নিয়ে আলোচনা না করে উপায় নেই। কারণ এতে আমার-আপনার – জনপ্রিয় লব্জে বললে করদাতার – টাকা জড়িয়ে আছে। মানে সমস্ত সরকারি কাগজপত্রে যদি কাল থেকে ‘গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ হয়ে দাঁড়ায় ‘গভমেন্ট অফ ভারত’, তাহলে স্রেফ লেটারহেড ছাপাতে কত কোটি টাকা খরচ হবে ভাবুন।

ইদানীং সরকার এবং তার ন্যাওটা সংবাদমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিখ্যাত ক্রিকেটার, চিত্রতারকা ইত্যাদি বিশেষ অজ্ঞরা সরকারের যে কোনো কার্যকলাপের উপকারিতা প্রমাণ করতে প্রথমেই বোঝায় কাজটা করলে করদাতাদের কত টাকা বাঁচবে। ১৯৯১ সালের পর থেকে যেমন সরকার এবং তার ন্যাওটারা অহোরাত্র বোঝাত ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’, এ খানিকটা সেইরকম। যেমন ‘এক দেশ এক নির্বাচন ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচবে’, ‘ভর্তুকি তুলে দেওয়া ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচে’। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় ওটাই সরকারের কাজের ভালমন্দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড, তাহলে কিন্তু সর্বত্র ‘ইন্ডিয়া’ বদলে ‘ভারত’ করার পরিকল্পনাকে কোনোভাবেই ভাল বলা যাবে না। কারণ এতে করদাতাদের টাকা তো বাঁচবেই না, উলটে একগাদা টাকা খরচ হবে। টাকার কথা যখন উঠলই, তখন খেয়াল করিয়ে দেওয়া যাক – শুধু গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া নেই, আছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াও। সেটাও কি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ভারত হবে? হলে টাকা কি নতুন করে ছাপা হবে? সেক্ষেত্রে পুরনো নোটগুলোকে কি চলতে দেবে সরকার? নাকি আরও একচোট নোটবন্দির খাঁড়া ঝুলছে আমাদের মাথার উপরে?

কথাটাকে সোশাল মিডিয়া জোক মনে হচ্ছে? মনে রাখবেন, দেশের বর্তমান সরকার জোকারের মত সব এলোমেলো করে দিতেই ভালবাসে। তাতে মানুষের প্রাণ গেলেও কুছ পরোয়া নেই। রাজ কাপুর অভিনীত জোকার নয়, হিথ লেজার বা জোয়াকিন ফিনিক্স অভিনীত জোকার। তার অন্তত দুটো প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে – নোটবন্দি আর চার ঘন্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন।

ভারত এক খোঁজ

অবশ্যই শুধু করদাতাদের টাকা খরচ হবে বলে ভারত নাম ব্যবহারে বিরোধিতা করা চলে না। ও রাস্তায় হাঁটলে শেষমেশ অনেক ভাল কাজেরই বিরোধিতায় গিয়ে পৌঁছতে হবে। ঠিক যে রাস্তায় মোদী সরকার হাঁটছে। দেশে এত ঘন ঘন নির্বাচন হয়, তাতে করদাতাদের বিপুল টাকা খরচ হয়। অতএব গোটা দেশে একসঙ্গে লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচন হোক – টাকা বাঁচবে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিয়ে টাকা বাঁচানো যদি ঠিক হয়, তাহলে কিছুদিন পরে বলা যেতেই পারে, নির্বাচন ব্যাপারটারই দরকার নেই। একশো শতাংশ টাকা বেঁচে যাবে। পঞ্চায়েত, পৌরসভা, কর্পোরেশনগুলোর ব্যাপারে নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতেই তাই বলা হবে। সুতরাং অন্য যুক্তিতে আসি।

এতদিন যাঁরা জানতেন না, তাঁরাও গত কয়েকদিনের আলোচনায় নিশ্চয়ই জেনে গেছেন যে আমাদের দেশটার নাম সাংবিধানিকভাবেই ইন্ডিয়া এবং ভারত – দুটোই। সংবিধানের একেবারে প্রথম অনুচ্ছেদেই পরিষ্কার লেখা আছে “India, that is Bharat, shall be a Union of States.”

বস্তুত সংবিধান সভার বিতর্কে নাম নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল এবং সবাই যে ইন্ডিয়া শব্দটা ব্যবহার করা নিয়ে একমত ছিলেন তা নয়। শেষমেশ দুটো নামই থেকে যায়। এমন নয় যে ভারত নামটাকে ব্রাত্য করে দিয়ে স্রেফ বিদেশি লব্জের ইন্ডিয়াকেই দেশের সরকারি নাম করে দেওয়া হয়েছিল, যা এখন দক্ষিণপন্থীরা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আদৌ ইন্ডিয়া কেন? সব ভাষাতেই ভারত নয় কেন? আমার বন্ধু যা বলেছেন সেটা কি সত্যি? ইন্ডিয়া শব্দটা কেবল ভারতের অ্যাংলোফাইলরা, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষাসর্বস্ব উচ্চকোটির লোকেরা ব্যবহার করেন? ও নাম আপামর ভারতবাসীর পছন্দের নাম নয়?

এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে মনে রাখা ভাল, বহু ভাষাভাষী এবং ভাষার ভিত্তিতে তৈরি প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত দেশ ভারতে এক রাজ্যের মানুষের সঙ্গে অন্য রাজ্যের মানুষের সংযোগের ভাষা কী হওয়া উচিত, সরকারি কাজের ভাষা কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে স্বাধীনতার আগে থেকেই বিতর্ক চলছে। এমনকি সংবিধানের ৩৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় লেখা আছে দেশের সরকারি ভাষা হবে দেবনাগরী লিপিতে লেখা হিন্দি।

তারপর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ১ নম্বরে যা-ই লেখা থাক, এই সংবিধান চালু হওয়ার পরে ১৫ বছর দেশের সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরিজির ব্যবহার চলতে থাকবে। আবার ৩ নম্বর ধারাতেই বলা হয়েছে, বর্তমান অনুচ্ছেদে (অর্থাৎ ৩৪৩ নম্বরে) যা-ই বলা থাক, ওই ১৫ বছর কেটে গেলে ইংরিজি ভাষার ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে। ৩৪৩-৩৫১ অনুচ্ছেদগুলো পড়লে হিন্দি ভাষার প্রতি সংবিধানের পক্ষপাত দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়। ৩৫১ নম্বরে তো হিন্দি ভাষার প্রসারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই অনুচ্ছেদের শেষাংশে একেবারে হেডমাস্টারি কায়দায় বলা হচ্ছে শব্দভাণ্ডার প্রসারিত করার প্রয়োজনে প্রধানত সংস্কৃতের কাছে হাত পাততে হবে (“…for its vocabulary, primarily on Sanskrit and secondarily on other languages”)। ঘটনা হল, ভারত শব্দটা এসেছে সংস্কৃত থেকে এবং ব্যবহার হয় মূলত হিন্দি ও উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলোতে। ফলে বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের মানুষের সঙ্গত কারণেই এই শব্দটাকে দেশের নাম বলে মেনে নিতে আপত্তি আছে। প্রাচীন শাস্ত্র ও পৌরাণিক সাহিত্যে যে ভারতের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কিন্তু দাক্ষিণাত্য পড়ে না। মহাভারতে কটা কথা আছে দক্ষিণ ভারত নিয়ে? বাঙালিদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, তামিল, মালয়ালমের সঙ্গে সংস্কৃতের অনেক মিল। অতএব ওগুলো সংস্কৃত থেকেই এসেছে। কিন্তু তামিলরা অনেকেই মনে করেন তাঁদের ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি। বরং দাক্ষিণাত্যের সমস্ত ভাষার জন্ম তামিল থেকে। আর্য সভ্যতার থেকে দ্রাবিড় সভ্যতা একেবারেই পৃথক। সাম্প্রতিক অতীতে তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলায় ২৬০০ বছরের পুরনো এক সভ্যতার খোঁজ মেলার পর তাকে ‘ভারতম’ সভ্যতা বলা হবে, নাকি ‘দ্রাবিড়ম’ – এই নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছিল ওই রাজ্যের রাজনীতি।

অর্থাৎ আমরা বিন্ধ্য পর্বতের এপারে আছি বলেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতিতে ভারত শব্দটার প্রাঞ্জল উপস্থিতি। কিন্তু কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সমস্ত ভারতবাসী ভারত বলেই দেশটাকে চেনেন বা চিনতে পছন্দ করেন – এরকম ভাবনায় গলদ আছে। এমনকি বাঙালিরা সকলে ভারত শব্দটাই ভাবে – এমন ধারণাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে সাপ্তাহিক কালান্তর-এ প্রকাশিত দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিপোর্টাজ ‘আমি ইন্ডিয়া’ পড়লে

এই বয়েসে আবার উদ্বাস্তু। বন্যার তিনমাস পরেও একটা তাঁবু জোটাতে পারেন নি। সমর্থ মেয়ে-জামাই আর বছর দশেকের ছেলেটাকে নিয়ে চারদিক খোলা একটা ছাউনির তলায় খড় বিছিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। অথচ এখনও ওঁর মাথা ছুঁয়ে পূর্ণিমার চাঁদ।

‘পাকিস্তান ছেড়ে কবে এসেছিলেন?’ আশ্চর্য উত্তর দিলেন বুধেশ্বরী। ছাউনি থেকে হাত নামিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন ‘আমি ইন্ডিয়া। আমি পাকিস্তান না থাকিস।’

অমোঘ সেই অভিজ্ঞতা। পাটকাঠির চাল ছাড়িয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে যে রমণী দাঁড়িয়ে, সে বলছে সে উদ্বাস্তু নয় – ভারতবাসী। সে বলছে সে ‘ইন্ডিয়া’।

আরও বড় কথা, ভারতের কেন্দ্রস্থলের যে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো সবচেয়ে জনবহুল, সেখানকার গরিব-গুরবো মানুষের মধ্যেও দেশের নাম হিসাবে ভারতের চেয়ে বেশি প্রচলিত এমন একটা শব্দ যা ভারত বনাম ইন্ডিয়া বিতর্কে বিজেপিবিরোধীদেরও উল্লেখ করতে দেখছি না – হিন্দুস্তান। স্বাধীনোত্তর দেশে আসমুদ্রহিমাচল সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে (দক্ষিণ ভারতে কিছুটা কম, কিন্তু একেবারে পারেনি তা নয়) যে জিনিসটা তা যে মুম্বাইয়ে তৈরি হিন্দি ছবি – সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বাংলায় সে ছবির জনপ্রিয়তাও কোনোদিন কম ছিল না। ভেবে দেখুন তো, হিন্দি সিনেমার সংলাপে বা গানে কতবার শুনেছেন ভারত বা ভারতীয় শব্দটা? বরং বারবার শোনা যায় হিন্দুস্তান এবং হিন্দুস্তানি শব্দ দুটো। হম হিন্দুস্তানী ছবির ‘ছোড়ো কল কি বাতেঁ, কল কি বাত পুরানি/নয়ে দওর মে লিখেঙ্গে/দিল পর নয়ী কহানী/হম হিন্দুস্তানী’ গানটা একসময় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। সে গানে আবার আরএসএস-বিজেপির প্রবল অপছন্দের লোক জওহরলাল নেহরুকে দেখানো হয়েছিল।

বলিউডের সর্বকালের জনপ্রিয়তম শিল্পীদের একজন অমিতাভ বচ্চন। তাঁর প্রথম ছবির নাম সাত হিন্দুস্তানী (১৯৬৯)। তিনি বুড়ো বয়সে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে তৈরি বেশকিছু খাজা জাতীয়তাবাদী ছবির একটায় অভিনয় করেছিলেন। সেই ছবির নাম হিন্দুস্তান কি কসম (১৯৯৯)। ওই একই নামে ১৯৭৩ সালেও একটা ছবি হয়েছিল। চেতন আনন্দ সেই ছবি বানিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে। বর্তমানে যাঁকে বলিউডের বাদশা বলা হয়, সেই শাহরুখ খানের একটা ফ্লপ কিন্তু অন্যরকম ছবির নাম ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানী (২০০০)। আরও অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। হিন্দিভাষী সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বলিউড হিন্দুস্তান শব্দটাকে এই প্রাধান্য দিত না। আরএসএস-বিজেপির প্রভাবে ইদানীং হয়ত বদল এসেছে, কিন্তু গত শতকের আট-নয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের যেসব শ্রমজীবী মানুষ বসবাস করতেন তাঁদের কদাচিৎ ভারত শব্দটা ব্যবহার করতে দেখা যেত। তাঁরা হিন্দুস্তানই বলতেন। যদিও হিন্দুস্তান শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হিন্দুদের ভূমি – হিন্দু, মুসলমান সকলেই কিন্তু দেশের নাম হিসাবে এই শব্দটাই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে এসেছেন। আজকাল কথাগুলো লেখার প্রয়োজন পড়ছে, পড়ে সন্দেহও হচ্ছে হয়ত, কিন্তু আমাদের শৈশবে স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস বা নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে যে গানটা পাড়ায় পাড়ায় মাইকে বাজতই, সেটা হল ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা/হিন্দুস্তান হমারা’। সেই গানের রচয়িতা মীর ইকবাল একসময় পাকিস্তানপন্থী হয়ে যান। সম্ভবত সেই অপরাধেই, আমাদের অখেয়ালে, ওই গানটাকে বিজেপি আমলে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছে। ইকবালের লেখাপত্র পাঠ্য থেকে বাদ দেওয়াও শুরু হয়েছে, কিন্তু সে অন্য আলোচনা। এই আলোচনায় এটুকুই বলার যে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের বিরাট অংশের মানুষ দেশকে হিন্দুস্তান নামে চিনে এসেছেন অন্তত কয়েক হাজার বছর ধরে, ভারত নামে নয়, ইন্ডিয়া নামেও নয়। ফলে ইন্ডিয়া যদি অভিজাত ভারতের লব্জ হয়, ভারতও অভিজাত ভারতেরই অন্য এক অংশের লব্জ।

‘ভারত’ আর ‘ইন্ডিয়া’ বলে অনেক আরএসএসবিরোধীও আসলে যা বোঝাতে চান তা হল দুস্তর আর্থসামাজিক ব্যবধান। ওটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। তাঁরা বলতে চান এ দেশের মধ্যে আসলে দুটো দেশ আছে। ইন্ডিয়া অংশটা লেখাপড়া শেখা, শহুরে, পেট ভরে খাওয়া দেশ। ভারত মূলত গ্রামে বাস করে, লেখাপড়া শিখবে কী, অনশনে অর্ধাশনেই তার দিন কাটে। কথাটা ঠিক, আবার ভুলও। কারণ দুটো কেন? একটু ঘোরাফেরা করলেই স্পষ্ট দেখা যায় এ দেশের মধ্যে আসলে অনেকগুলো দেশ আছে। পেশাগত কারণে এক সময় বারবার ঝাড়খণ্ড যেতাম। রাঁচি আর কলকাতা যে একই দেশের দুটো রাজ্যের রাজধানী একথা বিশ্বাস হত না কিছুতেই। কারণ প্রচণ্ড অব্যবস্থা, প্রবল অনুন্নয়ন দেখেছি। আবার সিকিম আর কেরালা বেড়াতে গিয়ে অবাক হয়ে ভেবেছি, পশ্চিমবঙ্গ এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে একই দেশে আছে কেমন করে? এ তো গেল ভিনরাজ্যের কথা। সম্প্রতি জঙ্গলমহল ঘুরে এলাম। বুঝতে বাকি রইল না যে আমি আর কাঁকড়াঝোর বা আমলাশোলের বাসিন্দারা একই দেশে বাস করি না। কিন্তু তার সঙ্গে ইন্ডিয়া আর ভারত শব্দ দুটোর কী সম্পর্ক?

আরএসএস-বিজেপি কিন্তু ওই ফারাক বোঝাতে ইন্ডিয়া আর ভারত বলে না। তারা ওই দুটো শব্দ দিয়ে কী বোঝাতে চায় তা ২০১৩ সালে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত আসামের শিলচরে যা বলেছিলেন তা খেয়াল করলেই পরিষ্কার হবে। তিনি বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে। নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা জানেন ভাগবতের ওই মন্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। আসল কথা হল গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বিরুদ্ধে ঘটানো অধিকাংশ অপরাধের অভিযোগই দায়ের হয় না। সুতরাং ইন্ডিয়াকে ভারত বানাতে চাওয়া মানে, হয় গোটা দেশটাকেই এমন করে ফেলা যেখানে পরম্পরাগত চিন্তায় ধর্ষিতারা আদৌ অভিযোগ দায়ের করবেন না, অথবা আরও সরল সমাধান – রাষ্ট্র বলবে ভারত প্রাচীন সংস্কার মেনে চলা দেশ। এখানে ধর্ষণ হয় না। এটা একটা উদাহরণ। আরও কী কী হওয়া সম্ভব ভারতে তার মাত্র একটা উদাহরণ।

আসল কথা

দেশকে মা বলে শুধু দক্ষিণপন্থীরাই কল্পনা করে তা তো নয়, ঋত্বিক ঘটকও করতেন। এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ করে থাকেন। কারণ দেশ আসলে একটা আবেগ, অর্থাৎ বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্র হল সেই বিমূর্ত ভিতের উপর গেঁথে তোলা মূর্ত ইমারত। নিজের মাকে যার যা ইচ্ছা সে তাই বলে ডাকে। ওটা বেঁধে দেওয়া অসম্ভব। বাঙালিরা মা বলে, তামিলরা আম্মা বলে, গুজরাটিরা আবার বা বলে। এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও অনেকে মামণি বলে। এক পরিবারের কথা জানি, সেখানে দুই ছেলে তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকত। কারণ কথা বলতে শেখার বয়সে ঠাকুমাকে শুনত তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকছেন, সেই অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তামিল বা গুজরাটি পরিবারগুলোর মধ্যেও খুঁজে দেখলে নির্ঘাত এরকম বিকল্প ডাকের সন্ধান পাওয়া যাবে। ও নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, কারণ ওটা আবেগের বিষয়। সন্তানের যা বলে ডাকতে ভাল লাগে, সে তাই বলবে। কেউ ভারত বলবে, কেউ হিন্দুস্তান বলবে, কেউ ইন্ডিয়া বললেও তেড়ে যাওয়ার কিছু নেই। সংবিধানপ্রণেতারা ইন্ডিয়া আর ভারত লিখেছিলেন, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন নাম হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুস্তান শব্দটা রাখেননি। হয়ত ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য ভাগ হওয়া এবং নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা দেশের সরকারি নাম হিন্দুস্তান হওয়া ভাল বার্তা দেবে না মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সে নামের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ করার জন্যেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। ভারত রাষ্ট্র পরবর্তীকালেও সরকার ছাড়া অন্য কে কোন নাম ব্যবহার করছে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন ঘামাতে চায় বলেই এত কাণ্ড করছে।

আরও পড়ুন ২০২৪ আসলে গণভোট, বহুত্ববাদী ভারতের মুখ রাহুল গান্ধী

এমনিতে নাম বদলালে কী-ই বা এসে যায়? উপরে যে ব্যবহারিক অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছি সেটা ছাড়া? লক্ষ করে দেখছি, শেখানো বুলির মত কিছু কথা আওড়াচ্ছেন বিখ্যাতরা। সুনীল গাভস্কর প্রমুখ বলছেন, বর্মার নামও তো বদলে মায়ানমার হয়েছে। তাতে ক্ষতি কী? এর উত্তর খুঁজলেই আসল ক্ষতে চোখ পড়বে। বর্মার নাম বদলে মায়ানমার করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে এবং তা কোনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাজ ছিল না। কাজটা করেছিল জুন্টা সরকার। আসল আপত্তির জায়গাটা এইখানে। ভারত সরকার যদি সত্যিই মনে করে থাকে দেশের সরকারি নাম ইংরিজিতেও ভারত করার কোনো বিশেষ প্রয়োজন আছে, তাহলে সংসদে আলোচনা করে নিয়মকানুন মেনে সংবিধান সংশোধন করে বদলাতে পারত। কিন্তু সরকারি কাগজে চুপিসাড়ে বদল করে দেওয়া অগণতান্ত্রিক। কাজটা অবশ্য বিলক্ষণ চতুরতার। কারণ এখন সংসদের বাইরে বিজেপি মুখপাত্ররা যা-ই বলুন, সংসদে আলোচনা হলে হয়ত অমিত শাহ বলবেন, বদলাইনি তো! ভারত নামটা তো সংবিধানেই আছে।

আসলে সংগঠনের শতবর্ষে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে গেল অথচ দুনিয়াসুদ্ধ লোক ইন্ডিয়া বলে ডাকছে – এ জিনিস আরএসএসের হজম হবে না। কারণ ‘ইন্ডিয়া’ নামটা এসেছে পারস্যের লোকেদের মুখের ‘হিন্দুস্তান’ ইউরোপিয় জবানে বদলে গিয়ে। ইংরেজদের এ দেশে আসতে তখনো কয়েক হাজার বছর দেরি, যীশুখ্রিস্টেরই জন্ম হয়নি। এ নাম কি সঙ্ঘ মেনে নিতে পারে? বস্তুত ‘হিন্দু’ শব্দটাও বেদ, বেদান্ত, রামায়ণ, মহাভারত – কোথাও নেই। বরং জরাথ্রুষ্টের ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ আবেস্তা-য় আছে। সঙ্ঘ তাই পারলেই তাদের বয়ানে ‘সনাতন ধর্ম’ কথাটা গুঁজে দেয়। এমনি তো আর দয়ানিধি স্ট্যালিন সনাতন ধর্মের বিনাশের ডাক দেওয়ায় বিজেপি নেতারা রণচণ্ডী হয়ে ওঠেননি। বস্তুত যে ভাষাটার প্রতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ পক্ষপাত, যা গত শতকের ছয়ের দশকে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং এখন বিজেপি ফের চাপিয়ে দেওয়ার তালে আছে, সেই ‘হিন্দি’ ভাষাও আদতে ছিল হিন্দুস্তানি (আমির খুসরো বলতেন হিন্দভি) ভাষা। সুলতানি আমল থেকে দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্য এশিয়া এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ভাষা মিশে তা গড়ে উঠেছিল। এই ভাষা দেবনাগরী আর ফারসি – দুরকম লিপিতেই লেখা চলত। হিন্দি আর উর্দু – এই বিভাজন হয়েছে মাত্র শ দুয়েক বছর আগে এবং তার পিছনে ইংরেজদের ভূমিকা কম নয়।

অর্থাৎ সঙ্ঘ পরিবারের এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্রের স্লোগান – হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান – গোটাটাই বিদেশি লব্জ ধার করা। অবশ্য জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র ধারণাগুলোই ইউরোপিয়। কস্মিনকালে ভারতে ছিল না। আগাগোড়া ধার করা জিনিস নিয়ে চললে হীনমন্যতা আসাই স্বাভাবিক, ধারের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টাও প্রত্যাশিত।

শেষ নাহি যে

বুধেশ্বরী দীপেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘হামারলা মরিলে কি দ্যাশ বাঁচিবে?’ দেশের মানুষ না বাঁচলে দেশ বাঁচে না। এখন আশু লড়াইটা দেশ বাঁচানোর, নাম বাঁচানোর নয়। যেহেতু দেশের মানুষের জন্য বিজেপি সরকার কিছুই করেনি, তাই দেশের মানুষকে ঝুটো গর্ব দিয়ে এবং বিরোধীদের সে গর্ব সামলানোর কাজে ব্যস্ত রেখেই তারা উতরোবার চেষ্টা করছে। যুগপৎ নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত করছে। অর্থাৎ রথ দেখা এবং কলা বেচা। ২০২৪ নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীরা পুনর্নির্বাচিত হলে দেশের নাম কেন, দেশের লোকেদের নামও বদলে দিতে পারে। কেউ আটকাতে পারবে না। ফলে এখন বিরোধীদের দায়িত্ব এক দেশ এক নির্বাচন বা নাম পরিবর্তনের মত কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থেকেও সরকারের অকর্মণ্যতা এবং বিপজ্জনক কাজগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো, বিকল্প হাজির করা। নইলে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির ঘূর্ণিতে ডুবে মরতে হবে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী অবশ্য নির্বাচন এবং নাম নিয়ে ডামাডোলের ঊর্ধ্বে উঠে আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে সংসদে আলোচনার জন্য নটা বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু বিজেপি যে বিনা আলোচনায় সংসদ চালাতে এবং নিজেদের পছন্দের বিল পাস করাতে সিদ্ধহস্ত তা আমরা জেনে গেছি। ইন্ডিয়া জোট তাদের একতা বাইরের মত সংসদের ভিতরেও দেখাতে পারে কিনা, দেখিয়ে বিজেপির যা ইচ্ছা তাই করা আটকাতে পারে কিনা, তার উপরে নির্ভর করছে আমরা আগামী বছর কীরকম নির্বাচন দেখব। তার চেয়েও বড় কথা, দেশের ভিতটা থাকবে কিনা। ভিত না থাকলে ইমারত টেকে না।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

যত দোষ ক্রিকেট খেললে: ভারত-পাক বৈরিতার আজব শর্তাবলী

বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বা এশিয়া কাপের মত প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা পড়লে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিস্ময়করভাবে সিয়াচেনের জওয়ানদের খরচের খাতায় ফেলে দেয়।

 

শচীন তেন্ডুলকর-পরবর্তী প্রজন্মের সেরা ভারতীয় টেস্ট ব্যাটার বিরাট কোহলি যে খেলোয়াড়জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ আজ পর্যন্ত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর একটি টেস্টও খেলা হয়নি। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের টেস্ট দল যথেষ্ট সমীহ করার মত। বাঁহাতি পেসার শাহীন আফ্রিদি তিন ধরনের ক্রিকেটেই নতুন বলে উইকেট তুলে নেওয়ার ব্যাপারে দারুণ ধারাবাহিক। সঙ্গে আছেন তরুণ গতিময় পেসার নাসিম শাহ আর জীবনের প্রথম ছটা টেস্টেই ৩৮ উইকেট নিয়ে ফেলা লেগস্পিনার অবরার আহমেদ। এই বোলিংয়ের বিরুদ্ধে বিরাটদের দাঁড় করিয়ে দিলে খেলা কতটা চিত্তাকর্ষক হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম এই মুহূর্তে সব ধরনের ক্রিকেটে বিশ্বের সবচেয়ে ধারাবাহিক এবং নয়নাভিরাম ব্যাটারদের একজন। মহম্মদ রিজওয়ান ব্যাট হাতে এত সফল যে এখন তিনি কখনো কখনো স্রেফ ব্যাটার হিসাবে খেলছেন, উইকেটরক্ষা করছেন প্রাক্তন অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। পাকিস্তান বহুকাল পরে পেয়ে গেছে একজন ওপেনারকে, যাঁর বয়স এখন মাত্র ২৩, কিন্তু এমন কিছু কাণ্ড করে বসে আছেন যা অতীতে শুধুমাত্র সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। যেমন প্রথম ছটা টেস্টে তিনি যত রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রানের রেকর্ড আছে শুধুমাত্র সুনীল গাভস্কর, ডন ব্র্যাডম্যান আর জর্জ হেডলির। এই মুহূর্তে ১৪টা টেস্ট খেলে শফিকের রান ১২২০। এর মধ্যেই চারটে শতরান করে ফেলেছেন, যার একটা আবার দ্বিশতরান। এই পাক ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি, মহম্মদ সিরাজ বা অশ্বিন-জাদেজার একটা লড়াইয়ের কথা ভাবলে জিভে জল আসবে যে কোনো ক্রিকেটরসিকের। আস্ত সিরিজ হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এখানেই মুশকিল।

কোনো অতিনাটকীয় ঘটনা না ঘটলে কোহলি অবসর নেওয়ার আগে এরকম সিরিজ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। যদি দুই দলই ২০২৫ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠে তাহলে হয়ত একবার এই ঘটনা ঘটতে দেখা যেতে পারে, কারণ বহুদলীয় প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত খেললে ভারত সরকার বা ভারতীয় বোর্ড আপত্তি করে না। বিশেষত যদি খেলাটা হয় তৃতীয় কোনো দেশে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সিরিজ? নৈব নৈব চ। কেন? এককথায় উত্তর দিতে গেলে বলতে হবে “সিয়াচেন মেঁ জওয়ান হমারে লিয়ে লড় রহে হ্যাঁয়।”

ব্যাপারটার সূত্রপাত ২০০৮ সালে। সে বছর ১৮ অগাস্ট বিরাট প্রথমবার ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন আর ২৬ নভেম্বর মুম্বইয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ঘটনায় দেড়শোর বেশি মানুষের প্রাণ যায়। আক্রমণকারীদের পাক যোগ প্রমাণিত হয়। পরের বছর, অর্থাৎ ২০০৯ সালে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর ভারতে প্রায় সব মহল একমত হয় যে ওই পরিবেশে ক্রিকেট খেলা হওয়া সঙ্গত নয়। ফলে মহেন্দ্র সিং ধোনির দলের আর পাকিস্তানে যাওয়া হয়নি। সেবছরই লাহোরে সফররত শ্রীলঙ্কা দলের টিম বাস এবং আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারিদের গাড়ির উপর সন্ত্রাসবাদীরা গুলি চালায়। বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার, রিজার্ভ আম্পায়ার এহসান রাজা এবং শ্রীলঙ্কার সহকারী কোচ পল ফারব্রেস আহত হন। আটজন পাকিস্তানি নাগরিক মারাও যান। স্বভাবতই তারপর বহুবছর কোনো দেশের দলই পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলতে যেতে রাজি হয়নি। তারপর থেকে দীর্ঘকাল সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর দুবাই বা শারজার মাঠই হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের ‘হোম গ্রাউন্ড’।

তারপর কিন্তু গঙ্গা এবং সিন্ধু দিয়ে বিস্তর জল গড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানের টালমাটাল রাজনীতির নিয়ম মেনে অসংখ্যবার সরকার বদল হয়েছে, পাক আদালতের রায়ে জামাত-উদ দাওয়া প্রধান হাফীজ সঈদের মত কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদীর কারাবাস হয়েছে। ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা পাকিস্তান সম্পর্কে খড়্গহস্ত হলেও তাদের প্রিয় নেতা নরেন্দ্র মোদী আচমকা পাক প্রধানমন্ত্রীর নাতনির বিয়েতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইকে অভূতপূর্ব স্বাধীনতা দিয়ে ভারতের পাঠানকোট সেনা ছাউনিতে ‘তদন্ত’ করতে দিয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ আয়োজনের কথা উঠলেই – সিয়াচেন… । এই পর্বে পাকিস্তান দল ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতে এসে একদিনের ম্যাচ এবং টি টোয়েন্টি সিরিজ খেলে গেছে। তবে তখনো ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। মোদীজি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আর দ্বিপাক্ষিক সফর হয়নি। বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বা এশিয়া কাপের মত প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা পড়লে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিস্ময়করভাবে সিয়াচেনের জওয়ানদের খরচের খাতায় ফেলে দেয়। সম্ভবত বহুকাল পরে এই দুই দলের একটা ম্যাচের টিকিট ও বিজ্ঞাপন থেকে যত টাকা রোজগার করে যতগুলো পক্ষ, তাতে আদিগন্ত বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানের কষ্ট চাপা পড়ে যায়।

ব্যবস্থাটা ততদিন দিব্যি চলছিল যতদিন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ভারত পাকিস্তানে যাবে না, কিন্তু প্রয়োজনে তাদের ভারতে এসে খেলতে হবে – এটা সুবোধ বালকের মত মেনে নিচ্ছিল। এখন আর মানতে চাইছে না। কারণ সাত বছর হল সফলভাবে পাকিস্তান সুপার লিগ আয়োজিত হচ্ছে, যেখানে ভারত ছাড়া আর সব দেশের ক্রিকেটাররা খেলতে যান। উপরন্তু গত দুবছরে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশও পাকিস্তানে এসে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলে গেছে। ফলে টাকার জোরে এবং/অথবা রাজনৈতিক কারণে ভারতীয় বোর্ড তাদের যেখানে ইচ্ছে খেলতে বাধ্য করবে, অথচ নিজেরা পাকিস্তানে খেলতে যাবে না – এ জিনিস পাক বোর্ড মানবে কেন? তাই সম্প্রতি এশিয়া কাপ নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বহুকাল আগে থেকে ঠিক ছিল এবারের এশিয়া কাপ হবে পাকিস্তানে। কিন্তু ভারতীয় দল কিছুতেই পাকিস্তানে যাবে না। বিস্তর দড়ি টানাটানির পর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা বাদে অন্যগুলো নিজের দেশে খেলবে আর ভারত খেলবে শ্রীলঙ্কায়; সুপার ফোর স্তরের খেলাগুলো দুই দেশ মিলিয়ে খেলা হবে এবং ফাইনালও হবে শ্রীলঙ্কায় – এরকম দোআঁশলা ব্যবস্থা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব অন্যায় আবদার চিরকাল চলবে না।

চলার প্রয়োজন কী – সে প্রশ্নটাও তোলার সময় এসেছে। ২৬/১১-র পরেও বহুবার অন্য খেলার পাকিস্তান দল ভারত সফরে এসেছে, ভারতীয় দলও পাকিস্তানে গেছে। ২০২০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে এক মজার কাণ্ড হয়েছিল। ভারতের ক্রীড়ামন্ত্রক এবং সর্বভারতীয় সংস্থা দাবি করেছিল তারা নাকি কোনো দলকে পাঠায়নি, ওদিকে ওয়াগা সীমান্ত পার হয়ে আস্ত একটি দল পাকিস্তানে হাজির হয়।

এ মাসেই চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হকিতে পাকিস্তান খেলে গেল। এসবে বোধহয় সিয়াচেনের বরফও গলে না, ২৬/১১-তে মৃত মানুষদের স্মৃতিকেও অসম্মান করা হয় না। মজার এখানেই শেষ নয়। আসন্ন এশিয়ান গেমসে সোনা জিতলে ভারতীয় হকি দল সরাসরি প্যারিস অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। কিন্তু না পারলে যোগ্যতার্জন পর্বের খেলায় যোগ দিতে হবে, যা হবে পাকিস্তানে। হকি ইন্ডিয়ার প্রধান দিলীপ তিরকে ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, সেরকম হলে দল পাকিস্তানে খেলতে যাবে।

আরও পড়ুন এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট; ওঁরা গ্ল্যাডিয়েটর নন, ক্রিকেটার

তাহলে কি অলিম্পিক টিকিটের চেয়ে জওয়ান, শহিদ, মৃত নাগরিকদের প্রাণের দাম কম? নাকি একমাত্র ক্রিকেট দলেরই দায়িত্ব তাঁদের প্রাণের দাম দেওয়া? সে দায়িত্বও বিশ্বকাপ-টাপ এসে পড়লে কদিনের জন্য ভুলে থাকার লাইসেন্স দেওয়া আছে নাকি বোর্ডকে? এ তো বড় রঙ্গ জাদু!

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট; ওঁরা গ্ল্যাডিয়েটর নন, ক্রিকেটার

বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, এশিয়া কাপের সময়ে কি জওয়ানরা লড়েন না? তা যদি হয় তাহলে তো আরও বেশি করে ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া উচিত।

ম্যাচে তখন টানটান উত্তেজনা। টিভির পর্দায় দেখা গেল ওভারের মাঝখানে দীর্ঘদেহী হার্দিকের খর্বকায় রিজওয়ানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। চমকে যাওয়ার পর রিজওয়ানও ভালবেসে টেনে নিলেন হার্দিকের হাত। ম্যাচের আগের কদিন টুইটারে ভাইরাল হয়েছিল একটা ভিডিও। চোটের কারণে এশিয়া কাপ ক্রিকেট থেকে ছিটকে যাওয়া শাহীন আফ্রিদি মনমরা হয়ে প্র্যাকটিসের মাঠের ধারে বসেছিলেন। বিরাট কোহলিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বিরাট জিজ্ঞেস করলেন পা কেমন আছে। আফ্রিদি বললেন, আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছি, যেন আপনার ফর্ম ফিরে আসে।

এই আবহে খেলা হল রবিবারের ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ। এর আগের ম্যাচ হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ২০২১, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি উপলক্ষে। সে ম্যাচ দাপটে জিতেছিল পাকিস্তান। এবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল। শেষপর্যন্ত তফাত গড়ে দিলেন পান্ড্য, ভারত জিতল। কিন্তু কোনো ম্যাচেই কোনো অবাঞ্ছিত উত্তাপ তৈরি হয়নি। বরং সাম্প্রতিককালে ভারত বনাম ইংল্যান্ড খেলা হলে ম্যাচের আগে, পরে এবং মাঝে বেশ কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা গেছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশীর খেলা বরং ঠিক সেভাবেই হল যেভাবে হওয়া উচিত – ব্যাট বলের লড়াইতে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়ল না, কিন্তু মুখের হাসিটি বজায় রইল। শুধু তা-ই নয়, পাক ব্যাটার ফখর জমান আউটের আবেদন না হলেও বল ব্যাটে লেগেছে বুঝতে পেরে নিজেই হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। তবু কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে সিরিজ খেলা হবে না।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

শেষ ভারত-পাকিস্তান টেস্ট খেলা হয়েছিল ২০০৭ সালে আর শেষ একদিনের ম্যাচ ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে। দীর্ঘকাল হল ভারত বহুদলীয় প্রতিযোগিতার বাইরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে না। আবার আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বহুদলীয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে না। কেন খেলে না? কারণ স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরার ভাষায় “জওয়ান সীমা পে লড় রহে হ্যাঁয়”। তাহলে বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, এশিয়া কাপের সময়ে কি জওয়ানরা লড়েন না? শান্ত হয়ে বসে টিভিতে খেলা দেখেন? তা যদি হয় তাহলে তো আরও বেশি করে ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া উচিত। প্রক্সি ওয়ারে সীমান্তের এপারে ওপারে নিয়মিত যে জওয়ানদের প্রাণ যায়, সেগুলো বেঁচে যাবে। আসল কথা, নিয়মিত খেলা হলে প্রত্যেকটা ম্যাচ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করা আর সম্ভব হবে না। মাঠে ক্রিকেটারদের হাসিঠাট্টা, স্বাভাবিক ব্যবহার দেখতে দেখতে এপারের দেড়শো কোটি আর ওপারের কোটি পঁচিশেক মানুষ যদি বিশ্বাস করতে শুরু করে, প্রতিবেশী দেশের মানুষ মানেই ইবলিশের বাচ্চা বা রক্তপিপাসু জেহাদি সন্ত্রাসবাদী নয়, তাহলে সমূহ বিপদ দুই দেশের শাসকদেরই। তখন দেশের বেকারত্ব, দেশের মুদ্রাস্ফীতি, দেশের সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে। সে বিপদ এড়াতে কালেভদ্রে ম্যাচ হবে, পিচে পপিং ক্রিজ চিহ্নিত করতে টানা লাইনটাকে নিয়ন্ত্রণরেখার সাথে তুলনা করে সম্প্রচারকারী সংস্থা বিজ্ঞাপন দেবে আর প্রগলভ রবি শাস্ত্রীর কণ্ঠে শোনানো হবে – এটা স্টেডিয়াম নয়, কলিসিয়াম। ওরা ক্রিকেটার নয়, গ্ল্যাডিয়েটর। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই খেলার মাঠ লড়াইয়ের মাঠ হয়ে উঠবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

পরমাণু বোমার রাজনৈতিক ক্ষতিসাধনের প্রমাণ এই যুদ্ধ

লক্ষ করে দেখুন, এই মুহূর্তে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি শোষণমূলক, অগণতান্ত্রিক, বুলডোজার-নির্ভর শাসন চলছে।

ইউক্রেনকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সদস্যপদ দিতে উদগ্রীব। ইউরোপিয়ান কমিশন শুক্রবার (১৭ জুন, ২০২২) ভোলোদিমির জেলেনস্কির দেশকে সদস্য করে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। সাতাশটা সদস্য দেশের অনুমোদন পেলেই ইউক্রেন পুরোদস্তুর পশ্চিমি দেশ হয়ে উঠবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন দের লেয়েন বলেছেন, ইউরোপ চায় ইউক্রেন “ইউরোপিয়ান ড্রিম” যাপন করুক। কথাগুলো শুনতে চমৎকার। কিন্তু পড়ে কি মনে হচ্ছে, কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কথা বলা হচ্ছে? অথচ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর প্রায় চার মাস কেটে গেছে। ক্রমশ একের পর এক এলাকায় যুদ্ধ ছড়িয়েছে এবং সাধারণ মানুষও আক্রান্ত হয়েছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। যত দিন যাচ্ছে সেসব অভিযোগ বেড়েই চলেছে। যদিও ইউক্রেনের মত ছোট্ট একটা দেশ যত সহজে হেরে যাবে বলে মনে করা হয়েছিল, তত সহজে তারা হারছে না। রাশিয়া চার মাসেও আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারেনি। কিন্তু ইউক্রেন বিশ্বের অন্য শক্তিগুলোর কাছ থেকে যতটা সাহায্য আশা করেছিল, তা পেয়েছে কি? এই প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা দরকার। কারণ আমাদের সকলের ভবিষ্যতের ইঙ্গিত এখান থেকে পাওয়া যাবে।

রাশিয়া যে যে কারণে ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল, তার অন্যতম হল গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটোর সাথে ইউক্রেনের আশনাই। পুতিন যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের ভেক ধরে রাশিয়ায় একনায়কতন্ত্র চালান, তা নিয়ে সারা বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক মতের লোকেরই বিশেষ সন্দেহ নেই। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর মুখেই মার্কিন বিদেশনীতির ঘোরতর বিরোধী নোয়ম চমস্কি বলেছিলেন, পুতিনের জায়গায় মহাত্মা গান্ধী রাশিয়ার কর্ণধার হলেও ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে আরও কাছাকাছি, আরও কাছে এসো বলা মেনে নিতেন না। ন্যাটো তৈরি হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধের আমলে, সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোর প্রতিস্পর্ধী সংগঠন হিসাবে। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই আজ তিরিশ বছর, ন্যাটো কিন্তু পূর্ব ইউরোপে ডালপালা বিস্তার করেই চলেছে। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, এটা নেহাত মার্কিনবিরোধী বামপন্থী যুক্তি। ইউক্রেন একটা স্বাধীন দেশ। সে যদি মনে করে রাশিয়ার পাড়ায় বাস করেও ভ্লাদিমির পুতিনের অপছন্দের আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের সাথে অভিসারে যাবে, তাতে কার কী বলার থাকতে পারে? কিন্তু কথা হল, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে জেলেন্সকি যে বারবার ন্যাটোর সাহায্য প্রার্থনা করলেন, তার ফল কী? ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে তো সারা পৃথিবীর মানুষ মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের কথাবার্তা শুনে আশঙ্কা করছিলেন, ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যাবে। তেমন কিছু ঘটল না তো!

যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু সপ্তাহের মধ্যেই (৯ মার্চ) জেলেন্সকি বলে দিয়েছিলেন ইউক্রেন আর ন্যাটোর সদস্য হতে চায় না। কারণ ন্যাটো ইউক্রেনকে যুক্ত করতে তৈরি নয়। তৎসত্ত্বেও ২৪ মার্চ ব্রাসেলসে ন্যাটোর যে জরুরি বৈঠক হয় সেই বৈঠকে তিনি বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ যথেষ্ট নয়। “আপনাদের এক শতাংশ যুদ্ধবিমান আর এক শতাংশ ট্যাঙ্ক আমাদের দিন। আমাদের কিনে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। যদি আমাদের ওগুলো দিয়ে সাহায্য করেন, তাহলে আমরা একশো শতাংশ সুরক্ষিত হতে পারি।” ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রঁ কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন “ন্যাটো ঠিক করেছে এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সাহায্য করবে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে না জড়িয়ে।” ইউক্রেনের প্রেমের এই প্রতিদান দিল ন্যাটো। এ যেন এক পৃথিবী লিখব বলে একটা খাতাও শেষ না করার মত প্রেম। আর এতদিন পরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ‘ক্যান্ডিডেট মেম্বারশিপ’ (চূড়ান্ত সদস্যপদ পেতে সাধারণত বছর দশেক লাগে) দেওয়া হল জড়োয়ার গয়নার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইমিটেশন দুল উপহার দেওয়া।

কেন এমন করল ন্যাটো? এক কথায় এর উত্তর সম্ভবত – পরমাণু শক্তি। মনে করুন পরমাণু বোমা যদি ১৯৩০-এর দশকেই আবিষ্কৃত হত, তাহলে অ্যাডলফ হিটলার একের পর এক অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে নিল দেখেও ইংল্যান্ড, ফ্রান্স যেমন বিনীতভাবে হাত কচলাচ্ছিল; ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করার পরেও হয়ত সেভাবেই চালিয়ে যেত। তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস কী হত ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। পরমাণু শক্তি আমাদের কী কী ক্ষতি করেছে তা নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন হিরোশিমা-নাগাসাকি, চেরনোবিল, ফুকুশিমা, তেজষ্ক্রিয়তা – এসব নিয়েই বেশি কথা হয়। কিন্তু পরমাণু বোমার অস্তিত্ব আমাদের যে বিপুল রাজনৈতিক ক্ষতি করেছে তা চট করে স্মরণে আসে না। পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আজকের বিশ্বে তার প্রতিবেশে যদৃচ্ছা মাস্তানি করতে পারে। ছোট দেশগুলোর পক্ষ নিয়ে কেউ লড়তে আসবে না, কারণ পরমাণু বোমার ভয়। এ এমন এক শক্তি, যার পরিমাণ বাড়লে শক্তি বাড়ে না। ধরুন রাশিয়ার একশোটা পরমাণু বোমা আছে, আমেরিকার আছে পাঁচশোটা। আমেরিকা তবু রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। কারণ একখানা উড়ে এসে পড়লেই তো যথেষ্ট। তারপর ফিরে পাঁচখানা ছুঁড়লেই বা কী লাভ হবে? হপ্তা দুয়েক আগেই বাইডেন বলে বসেছিলেন, চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে আমেরিকা সামরিকভাবে তার মোকাবিলা করবে। অনতিবিলম্বেই কিন্তু হোয়াইট হাউস এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, চীন সম্পর্কে আমেরিকার দীর্ঘকালীন নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সোজা কথায়, ঢোঁক গেলে। কারণটা একই।

তাহলে আমাদের নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত তো? কারণ ভারত পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। আমরা তো প্রয়োজন পড়লে এ তল্লাটে যা ইচ্ছে তাই করতেই পারি। আমরা গান্ধী-নেহরুর দেশ বলেই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করাকে অন্যায় মনে করব, সে যুগ চলে গেছে। আমাদের দেশনায়কদের এখন আরাধ্য ইজরায়েল, যাদের অস্তিত্ব ও বিস্তার প্যালেস্তাইনকে গিলে নিয়ে। তাহলে?

আরও পড়ুন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ

হাতে বিষের নাড়ুর মত বোমা আছে বলে অত আহ্লাদিত হবেন না। কারণ আমাদের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রও (চীন ও পাকিস্তান) পরমাণু শক্তিধর। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিপদ অন্যখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে ইউরোপের কী হত, বাকি পৃথিবীর কী হত সেকথা থাক। জার্মানির মানুষের কী হত ভাবুন। নাজিদের সবচেয়ে বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তো সে দেশের মানুষই। আরও কত গ্যাস চেম্বার হত, ইহুদী ফুরিয়ে যাওয়ার পর কাদের সেগুলোতে ঢোকানো হত ভেবে দেখুন। যুদ্ধের হাওয়ায় নাজি জার্মানির অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছিল একটা সময়ে। যুদ্ধ মিটে গেলে কী হত? কত মানুষ অনাহারে মারা যেতেন? লক্ষ করে দেখুন, এই মুহূর্তে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি শোষণমূলক, অগণতান্ত্রিক, বুলডোজার-নির্ভর শাসন চলছে। তা নিয়ে অন্য কোনো দেশ সমালোচনা করলেই চট করে বলা হয় “আভ্যন্তরীণ বিষয়”। এ নেহাত কাকতালীয় ঘটনা নয়। এই দেশগুলোর শাসকরা জানে, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, গ্যাস চেম্বার বা তার চেয়েও খারাপ কিছু ঘটে গেলেও অন্য কোনো দেশ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কোনো দেশের মানুষকে মুক্ত করার কথা স্বপ্নেও ভাববে না। কারণ পুতিন, মোদী, জিনপিংদের হাতে আছে একটা সর্বশক্তিমান ব্রিফকেস। সুতরাং পরমাণু শক্তিধর দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের বরং বেশি দুশ্চিন্তায় থাকা উচিত। আমরা স্বাধীন নই, পরমাণু শক্তির অধীন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ভারত-পাক না হলে যাদের লাভ, হলে তাদের বেশি লাভ

তবে কি রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসায়িক লাভ করার রাস্তা তৈরি করা হয় ভারত-পাক ম্যাচে? মোটেই না।

১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে যখন সীমান্তে আমাদের জওয়ানরা লড়ছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

সুনীল গাভস্করকে যদি কেউ এই প্রশ্নটা করে বসে, তাহলে ভদ্রলোকের দেশপ্রেম বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রমাণ করা মুশকিল হবে। কারণ তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ায় অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেই দলে গাভস্কর, বিষাণ সিং বেদি আর ফারোখ ইঞ্জিনিয়ার যেমন ছিলেন, তেমনি পাকিস্তানের ইন্তিখাব আলম, আসিফ মাসুদ, জাহির আব্বাসরাও ছিলেন। এমনকি যুদ্ধ নিয়ে সেই দলে রসিকতাও হত। যেমন সহখেলোয়াড় রিচার্ড হাটন (ইংল্যান্ড) বলেছিলেন যুদ্ধ করতে করতে ফারোখ যদি ইন্তিখাবের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেন, তাহলেও ইন্তিখাব মরবেন না। ওঁর পেটে চর্বি এতই বেশি, যে বেয়নেট ওখানেই আটকে যাবে। এসব কথা গাভস্কর ‘সানি ডেজ’ নামে তাঁর বইতে সকৌতুকে লিখেছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি বহু স্মরণীয় ইনিংস খেলেছেন, এমনকি শেষ টেস্ট ইনিংসেও অসম্ভব কঠিন পিচে প্রায় শতরান করে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ ব্যাটসম্যান গাভস্কর পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের যারপরনাই জ্বালাতন করেছেন। তবু, সত্যিকারের যুদ্ধ চলাকালীনও পাক ক্রিকেটারদের সাথে কী ধরনের বন্ধুত্ব বজায় ছিল তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়। আরও বোঝা যায়, ভারত বা পাকিস্তানের সরকারও এই ক্রিকেটারদের একসাথে খেলা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাঁদের কাজ তখন যুদ্ধ পরিচালনা করা। তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ক্রিকেটারদের কাজ ক্রিকেট খেলা, তাঁরাও সেটাই করছিলেন। যে দেশের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে সে দেশের ক্রিকেটারদের সাথে খেললে মহাভারত অশুদ্ধ হবে — এমন ভাবার ফুরসত ছিল না কারোর।

কিন্তু যুগ বদলেছে। ১৯৯৯ সালের পর থেকে ভারত-পাক যুদ্ধ আর হয়নি (প্রক্সি ওয়ার ১৯৪৭ থেকে কখনো থেমেছে কিনা সন্দেহ)। তবু পাকিস্তানের সাথে ক্রিকেটীয় সম্পর্ক রাখলে সীমান্তের জওয়ানদের অসম্মান করা হবে — এমন বলা হয়। পাকিস্তানের ছায়া মাড়ানোও বারণ। তাই আইপিএলে পর্যন্ত পাকিস্তানের ক্রিকেটার বা কোচ নেই বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। দু দেশের মধ্যে শেষবার সাদা বলের সিরিজ খেলা হয়েছিল ২০১২-১৩ মরসুমে আর শেষ টেস্ট সিরিজ ২০০৭ সালে। যখন কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে, তখন কিন্তু জওয়ানদের অসম্মান করা হল বলে ভারত সরকার মনে করেন না। ফলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বা বিশ্বকাপে ম্যাচটা হয়। এই ম্যাচে আইসিসির লক্ষ্মীর ভান্ডার উপচে পড়ে। পৃথিবীর যেখানেই খেলা হোক, অনাবাসী ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা মাঠ ভরিয়ে দেন। সরাসরি টিভি সম্প্রচারের সেদিন মোচ্ছব। যে প্রবল দেশপ্রেমিকরা এমনিতে দু দেশের মধ্যে খেলাধুলোর তীব্র বিরোধী, তাঁরা কেউ ম্যাচটা বয়কট করার ডাক দেন না। টুইটারে টিভি বন্ধ রাখার কোনো হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেনও চলে না।

আসলে সবার উপরে ব্যবসা সত্য, তাহার উপরে নাই। খেলা না হলে রাজনৈতিক লাভ, কিন্তু নিয়মিত খেলা হয় না বলেই আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলা হলে ব্যবসায়িক লাভ দ্বিগুণ। আর সে লাভে হস্তক্ষেপ করলে মহাশক্তিধর নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহও অসুবিধায় পড়বেন। তাই রাত পোহালে ওয়ার্ল্ড টি২০-তে যে ভারত-পাক ম্যাচ, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হানার প্রতিবাদে সেই ম্যাচে খেলা উচিত নয় — এমন বিবৃতি দেন গিরিরাজ সিংয়ের মত কম গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতারা। অনুরাগ ঠাকুর বা অমিত শাহ নন। অমিতবাবুর সুপুত্র নিজেই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের হর্তাকর্তা, চাইলেই তো ম্যাচ বয়কট করাতে পারতেন। বিরাট কোহলিদের মাত্র কয়েকটা পয়েন্টের লোকসান হত। কিন্তু পিতা পুত্রকে অমন করতে বলবেন না, কারণ আসল লোকসান হত কয়েকশো কোটি টাকার। কেবল বোর্ড নয়, সরকার-বান্ধব বহু ব্যবসায়ীর।

আরো পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

তবে কি রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসায়িক লাভ করার রাস্তা তৈরি করা হয় ভারত-পাক ম্যাচে? মোটেই না। জর্জ অরওয়েল খেলাধুলো সম্পর্কে বলেছিলেন, এ হল গুলিবর্ষণ না করে যুদ্ধ। কালেভদ্রে হওয়া ভারত-পাক ম্যাচে দু দেশের ক্রিকেটমোদীদের মধ্যে ঘৃণার বান ডাকে, সোশাল মিডিয়ায় খিস্তির ঢল নামে। দু দেশের সরকার তো তেমনটাই চান। বরং অন্য সময় এই ঘৃণা জিইয়ে রাখতে বাড়তি প্রয়াসের দরকার হয়, এই ম্যাচের আগে, পরে পায়ের উপর পা তুলে মজা দেখা যায়।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: