যত দোষ ক্রিকেট খেললে: ভারত-পাক বৈরিতার আজব শর্তাবলী

বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বা এশিয়া কাপের মত প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা পড়লে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিস্ময়করভাবে সিয়াচেনের জওয়ানদের খরচের খাতায় ফেলে দেয়।

ক্রিকেট

 

শচীন তেন্ডুলকর-পরবর্তী প্রজন্মের সেরা ভারতীয় টেস্ট ব্যাটার বিরাট কোহলি যে খেলোয়াড়জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ আজ পর্যন্ত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর একটি টেস্টও খেলা হয়নি। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের টেস্ট দল যথেষ্ট সমীহ করার মত। বাঁহাতি পেসার শাহীন আফ্রিদি তিন ধরনের ক্রিকেটেই নতুন বলে উইকেট তুলে নেওয়ার ব্যাপারে দারুণ ধারাবাহিক। সঙ্গে আছেন তরুণ গতিময় পেসার নাসিম শাহ আর জীবনের প্রথম ছটা টেস্টেই ৩৮ উইকেট নিয়ে ফেলা লেগস্পিনার অবরার আহমেদ। এই বোলিংয়ের বিরুদ্ধে বিরাটদের দাঁড় করিয়ে দিলে খেলা কতটা চিত্তাকর্ষক হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম এই মুহূর্তে সব ধরনের ক্রিকেটে বিশ্বের সবচেয়ে ধারাবাহিক এবং নয়নাভিরাম ব্যাটারদের একজন। মহম্মদ রিজওয়ান ব্যাট হাতে এত সফল যে এখন তিনি কখনো কখনো স্রেফ ব্যাটার হিসাবে খেলছেন, উইকেটরক্ষা করছেন প্রাক্তন অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। পাকিস্তান বহুকাল পরে পেয়ে গেছে একজন ওপেনারকে, যাঁর বয়স এখন মাত্র ২৩, কিন্তু এমন কিছু কাণ্ড করে বসে আছেন যা অতীতে শুধুমাত্র সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। যেমন প্রথম ছটা টেস্টে তিনি যত রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রানের রেকর্ড আছে শুধুমাত্র সুনীল গাভস্কর, ডন ব্র্যাডম্যান আর জর্জ হেডলির। এই মুহূর্তে ১৪টা টেস্ট খেলে শফিকের রান ১২২০। এর মধ্যেই চারটে শতরান করে ফেলেছেন, যার একটা আবার দ্বিশতরান। এই পাক ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি, মহম্মদ সিরাজ বা অশ্বিন-জাদেজার একটা লড়াইয়ের কথা ভাবলে জিভে জল আসবে যে কোনো ক্রিকেটরসিকের। আস্ত সিরিজ হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এখানেই মুশকিল।

কোনো অতিনাটকীয় ঘটনা না ঘটলে কোহলি অবসর নেওয়ার আগে এরকম সিরিজ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। যদি দুই দলই ২০২৫ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠে তাহলে হয়ত একবার এই ঘটনা ঘটতে দেখা যেতে পারে, কারণ বহুদলীয় প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত খেললে ভারত সরকার বা ভারতীয় বোর্ড আপত্তি করে না। বিশেষত যদি খেলাটা হয় তৃতীয় কোনো দেশে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সিরিজ? নৈব নৈব চ। কেন? এককথায় উত্তর দিতে গেলে বলতে হবে “সিয়াচেন মেঁ জওয়ান হমারে লিয়ে লড় রহে হ্যাঁয়।”

ব্যাপারটার সূত্রপাত ২০০৮ সালে। সে বছর ১৮ অগাস্ট বিরাট প্রথমবার ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন আর ২৬ নভেম্বর মুম্বইয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ঘটনায় দেড়শোর বেশি মানুষের প্রাণ যায়। আক্রমণকারীদের পাক যোগ প্রমাণিত হয়। পরের বছর, অর্থাৎ ২০০৯ সালে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর ভারতে প্রায় সব মহল একমত হয় যে ওই পরিবেশে ক্রিকেট খেলা হওয়া সঙ্গত নয়। ফলে মহেন্দ্র সিং ধোনির দলের আর পাকিস্তানে যাওয়া হয়নি। সেবছরই লাহোরে সফররত শ্রীলঙ্কা দলের টিম বাস এবং আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারিদের গাড়ির উপর সন্ত্রাসবাদীরা গুলি চালায়। বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার, রিজার্ভ আম্পায়ার এহসান রাজা এবং শ্রীলঙ্কার সহকারী কোচ পল ফারব্রেস আহত হন। আটজন পাকিস্তানি নাগরিক মারাও যান। স্বভাবতই তারপর বহুবছর কোনো দেশের দলই পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলতে যেতে রাজি হয়নি। তারপর থেকে দীর্ঘকাল সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর দুবাই বা শারজার মাঠই হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের ‘হোম গ্রাউন্ড’।

তারপর কিন্তু গঙ্গা এবং সিন্ধু দিয়ে বিস্তর জল গড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানের টালমাটাল রাজনীতির নিয়ম মেনে অসংখ্যবার সরকার বদল হয়েছে, পাক আদালতের রায়ে জামাত-উদ দাওয়া প্রধান হাফীজ সঈদের মত কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদীর কারাবাস হয়েছে। ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা পাকিস্তান সম্পর্কে খড়্গহস্ত হলেও তাদের প্রিয় নেতা নরেন্দ্র মোদী আচমকা পাক প্রধানমন্ত্রীর নাতনির বিয়েতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইকে অভূতপূর্ব স্বাধীনতা দিয়ে ভারতের পাঠানকোট সেনা ছাউনিতে ‘তদন্ত’ করতে দিয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ আয়োজনের কথা উঠলেই – সিয়াচেন… । এই পর্বে পাকিস্তান দল ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতে এসে একদিনের ম্যাচ এবং টি টোয়েন্টি সিরিজ খেলে গেছে। তবে তখনো ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। মোদীজি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আর দ্বিপাক্ষিক সফর হয়নি। বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বা এশিয়া কাপের মত প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা পড়লে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিস্ময়করভাবে সিয়াচেনের জওয়ানদের খরচের খাতায় ফেলে দেয়। সম্ভবত বহুকাল পরে এই দুই দলের একটা ম্যাচের টিকিট ও বিজ্ঞাপন থেকে যত টাকা রোজগার করে যতগুলো পক্ষ, তাতে আদিগন্ত বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানের কষ্ট চাপা পড়ে যায়।

ব্যবস্থাটা ততদিন দিব্যি চলছিল যতদিন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ভারত পাকিস্তানে যাবে না, কিন্তু প্রয়োজনে তাদের ভারতে এসে খেলতে হবে – এটা সুবোধ বালকের মত মেনে নিচ্ছিল। এখন আর মানতে চাইছে না। কারণ সাত বছর হল সফলভাবে পাকিস্তান সুপার লিগ আয়োজিত হচ্ছে, যেখানে ভারত ছাড়া আর সব দেশের ক্রিকেটাররা খেলতে যান। উপরন্তু গত দুবছরে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশও পাকিস্তানে এসে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলে গেছে। ফলে টাকার জোরে এবং/অথবা রাজনৈতিক কারণে ভারতীয় বোর্ড তাদের যেখানে ইচ্ছে খেলতে বাধ্য করবে, অথচ নিজেরা পাকিস্তানে খেলতে যাবে না – এ জিনিস পাক বোর্ড মানবে কেন? তাই সম্প্রতি এশিয়া কাপ নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বহুকাল আগে থেকে ঠিক ছিল এবারের এশিয়া কাপ হবে পাকিস্তানে। কিন্তু ভারতীয় দল কিছুতেই পাকিস্তানে যাবে না। বিস্তর দড়ি টানাটানির পর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা বাদে অন্যগুলো নিজের দেশে খেলবে আর ভারত খেলবে শ্রীলঙ্কায়; সুপার ফোর স্তরের খেলাগুলো দুই দেশ মিলিয়ে খেলা হবে এবং ফাইনালও হবে শ্রীলঙ্কায় – এরকম দোআঁশলা ব্যবস্থা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব অন্যায় আবদার চিরকাল চলবে না।

চলার প্রয়োজন কী – সে প্রশ্নটাও তোলার সময় এসেছে। ২৬/১১-র পরেও বহুবার অন্য খেলার পাকিস্তান দল ভারত সফরে এসেছে, ভারতীয় দলও পাকিস্তানে গেছে। ২০২০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে এক মজার কাণ্ড হয়েছিল। ভারতের ক্রীড়ামন্ত্রক এবং সর্বভারতীয় সংস্থা দাবি করেছিল তারা নাকি কোনো দলকে পাঠায়নি, ওদিকে ওয়াগা সীমান্ত পার হয়ে আস্ত একটি দল পাকিস্তানে হাজির হয়।

এ মাসেই চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হকিতে পাকিস্তান খেলে গেল। এসবে বোধহয় সিয়াচেনের বরফও গলে না, ২৬/১১-তে মৃত মানুষদের স্মৃতিকেও অসম্মান করা হয় না। মজার এখানেই শেষ নয়। আসন্ন এশিয়ান গেমসে সোনা জিতলে ভারতীয় হকি দল সরাসরি প্যারিস অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। কিন্তু না পারলে যোগ্যতার্জন পর্বের খেলায় যোগ দিতে হবে, যা হবে পাকিস্তানে। হকি ইন্ডিয়ার প্রধান দিলীপ তিরকে ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, সেরকম হলে দল পাকিস্তানে খেলতে যাবে।

আরও পড়ুন এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট; ওঁরা গ্ল্যাডিয়েটর নন, ক্রিকেটার

তাহলে কি অলিম্পিক টিকিটের চেয়ে জওয়ান, শহিদ, মৃত নাগরিকদের প্রাণের দাম কম? নাকি একমাত্র ক্রিকেট দলেরই দায়িত্ব তাঁদের প্রাণের দাম দেওয়া? সে দায়িত্বও বিশ্বকাপ-টাপ এসে পড়লে কদিনের জন্য ভুলে থাকার লাইসেন্স দেওয়া আছে নাকি বোর্ডকে? এ তো বড় রঙ্গ জাদু!

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

Leave a Reply

%d bloggers like this: