এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট; ওঁরা গ্ল্যাডিয়েটর নন, ক্রিকেটার

বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, এশিয়া কাপের সময়ে কি জওয়ানরা লড়েন না? তা যদি হয় তাহলে তো আরও বেশি করে ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া উচিত।

ম্যাচে তখন টানটান উত্তেজনা। টিভির পর্দায় দেখা গেল ওভারের মাঝখানে দীর্ঘদেহী হার্দিকের খর্বকায় রিজওয়ানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। চমকে যাওয়ার পর রিজওয়ানও ভালবেসে টেনে নিলেন হার্দিকের হাত। ম্যাচের আগের কদিন টুইটারে ভাইরাল হয়েছিল একটা ভিডিও। চোটের কারণে এশিয়া কাপ ক্রিকেট থেকে ছিটকে যাওয়া শাহীন আফ্রিদি মনমরা হয়ে প্র্যাকটিসের মাঠের ধারে বসেছিলেন। বিরাট কোহলিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বিরাট জিজ্ঞেস করলেন পা কেমন আছে। আফ্রিদি বললেন, আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছি, যেন আপনার ফর্ম ফিরে আসে।

এই আবহে খেলা হল রবিবারের ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ। এর আগের ম্যাচ হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ২০২১, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি উপলক্ষে। সে ম্যাচ দাপটে জিতেছিল পাকিস্তান। এবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল। শেষপর্যন্ত তফাত গড়ে দিলেন পান্ড্য, ভারত জিতল। কিন্তু কোনো ম্যাচেই কোনো অবাঞ্ছিত উত্তাপ তৈরি হয়নি। বরং সাম্প্রতিককালে ভারত বনাম ইংল্যান্ড খেলা হলে ম্যাচের আগে, পরে এবং মাঝে বেশ কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা গেছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশীর খেলা বরং ঠিক সেভাবেই হল যেভাবে হওয়া উচিত – ব্যাট বলের লড়াইতে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়ল না, কিন্তু মুখের হাসিটি বজায় রইল। শুধু তা-ই নয়, পাক ব্যাটার ফখর জমান আউটের আবেদন না হলেও বল ব্যাটে লেগেছে বুঝতে পেরে নিজেই হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। তবু কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে সিরিজ খেলা হবে না।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

শেষ ভারত-পাকিস্তান টেস্ট খেলা হয়েছিল ২০০৭ সালে আর শেষ একদিনের ম্যাচ ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে। দীর্ঘকাল হল ভারত বহুদলীয় প্রতিযোগিতার বাইরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে না। আবার আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বহুদলীয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে না। কেন খেলে না? কারণ স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরার ভাষায় “জওয়ান সীমা পে লড় রহে হ্যাঁয়”। তাহলে বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, এশিয়া কাপের সময়ে কি জওয়ানরা লড়েন না? শান্ত হয়ে বসে টিভিতে খেলা দেখেন? তা যদি হয় তাহলে তো আরও বেশি করে ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া উচিত। প্রক্সি ওয়ারে সীমান্তের এপারে ওপারে নিয়মিত যে জওয়ানদের প্রাণ যায়, সেগুলো বেঁচে যাবে। আসল কথা, নিয়মিত খেলা হলে প্রত্যেকটা ম্যাচ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করা আর সম্ভব হবে না। মাঠে ক্রিকেটারদের হাসিঠাট্টা, স্বাভাবিক ব্যবহার দেখতে দেখতে এপারের দেড়শো কোটি আর ওপারের কোটি পঁচিশেক মানুষ যদি বিশ্বাস করতে শুরু করে, প্রতিবেশী দেশের মানুষ মানেই ইবলিশের বাচ্চা বা রক্তপিপাসু জেহাদি সন্ত্রাসবাদী নয়, তাহলে সমূহ বিপদ দুই দেশের শাসকদেরই। তখন দেশের বেকারত্ব, দেশের মুদ্রাস্ফীতি, দেশের সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে। সে বিপদ এড়াতে কালেভদ্রে ম্যাচ হবে, পিচে পপিং ক্রিজ চিহ্নিত করতে টানা লাইনটাকে নিয়ন্ত্রণরেখার সাথে তুলনা করে সম্প্রচারকারী সংস্থা বিজ্ঞাপন দেবে আর প্রগলভ রবি শাস্ত্রীর কণ্ঠে শোনানো হবে – এটা স্টেডিয়াম নয়, কলিসিয়াম। ওরা ক্রিকেটার নয়, গ্ল্যাডিয়েটর। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই খেলার মাঠ লড়াইয়ের মাঠ হয়ে উঠবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত