
২০২০ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন “করোনাকে পাশবালিশ করে নিন।”১ অর্থাৎ করোনা থাকবে, করোনাকে নিয়েই চলতে হবে। তখন করোনার প্রথম ঢেউ চলছে, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়নি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) থেকে শুরু করে কোনো দেশের কোনো দায়িত্বশীল সংস্থাই করোনার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর সেই মন্তব্য অনেককেই বিস্মিত করেছিল, মন্তব্যের সমালোচনা হয়েছিল, বিলক্ষণ হাসিঠাট্টাও হয়েছিল। কেউ কেউ অবশ্য চোখের সামনে গাদা গাদা মানুষকে মরতে দেখেও দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন, যে করোনা কোনো রোগই নয়, স্রেফ চক্রান্ত। এঁদের মধ্যে যাঁরা দক্ষিণপন্থী তাঁরা বলতেন চীনের চক্রান্ত, আর বামপন্থীরা বলতেন স্বৈরাচারী শাসকদের গণতন্ত্র ধ্বংস করার চক্রান্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অতি বিচক্ষণ বলেই পাশবালিশের পরামর্শ দিয়েছেন, এ কথা সেইসময় জোর গলায় একমাত্র ওঁরাই বলেছিলেন। পরে যখন বিজ্ঞানীরা বললেন অন্য অনেক ভাইরাসের মত করোনাও ক্রমশ শক্তি হারিয়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মত হয়ে যাবে কিন্তু মরবে না, তখন ওঁরা সোল্লাসে বলেছিলেন, হুঁ হুঁ বাওয়া, আমরা তখনই জানতুম। মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে হাসাহাসি করা? উনি কি না জেনে কথা বলেন?
এখন ২০২২ সালের জানুয়ারি মাস, সারা পৃথিবীতে ভ্যাক্সিন দেওয়া চলছে। এ দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখের মধ্যে সকলকে বিনামূল্যে ভ্যাক্সিন দেওয়া না হয়ে থাকলেও অনেক মানুষ ভ্যাক্সিন পেয়েছেন। কোনো কোনো দেশে বুস্টার ডোজও দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বহু প্রাণ নিয়ে চলে গেছে, ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের হাত ধরে তৃতীয় ঢেউ এসে পড়েছে। অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে ভাইরাসটা ছড়াচ্ছে আগের চেয়েও দ্রুত, কিন্তু ক্ষতি করার শক্তি আগের চেয়ে কম।২ আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে এমন মানুষের সংখ্যা কম, মৃত্যুহারও কম। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে, কারণ তাদের মতে আমাদের হাতে ওমিক্রন সম্পর্কে এখনো যথেষ্ট তথ্য নেই।৩ কিন্তু যা নিশ্চিত, তা হল শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মত অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। ওমিক্রন বলে নয়, অতিমারির শুরু থেকেই দেখা গেছে খুব কম শিশুকেই কোভিড-১৯ কাবু করতে পারছে। তবু পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা স্কুলে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছে না। অর্থাৎ করোনাকে পাশবালিশ করে নেওয়ার ক্ষমতা যাদের সবচেয়ে বেশি, তাদেরই বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইরোলজি সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান সম্পর্কে যাঁরা দু বছর আগে নিঃসন্দেহ ছিলেন, এখন দেখা যাচ্ছে তাঁরাই স্কুল কেন খোলা হল না, যেটুকু খোলা হয়েছিল সেটুকুও কেন বন্ধ করে দেওয়া হল — তা নিয়ে বিস্তর রাগারাগি করছেন।
বাকি পৃথিবীর গবেষণা যা-ই বলুক, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন অতিমারির শুরু থেকেই নিঃসন্দেহ যে করোনা সবচেয়ে বেশি ছড়ায় স্কুল, কলেজ আর লোকাল ট্রেন থেকে। লোকাল ট্রেন বন্ধ রেখে বা কমিয়ে দিয়ে রাস্তাঘাটের ভিড় কমানোর ভাবনা কতটা হাস্যকর তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না। বরং স্কুল খোলা সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা বলা দরকার।
১ নভেম্বর ২০২১ থেকে দিল্লিতে সমস্ত ক্লাসের জন্য ৫০% হাজিরার শর্তে স্কুল খুলে গিয়েছিল, গত কয়েকদিন করোনা আবার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফের বন্ধ করা হয়েছে।৪ একই সময়ে কোভিড বিধি মেনে খুলে গিয়েছিল কেরালার স্কুলগুলোও।৫ কর্ণাটকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছিল ২৫ অক্টোবর। সম্প্রতি আক্রান্ত বাড়তে থাকায় অনেক স্কুলে বড়দিনের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। মহারাষ্ট্রে হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস শুরু হয়েছিল অক্টোবর মাসের গোড়াতেই,৬ প্রাথমিক স্তরের শিশুদের ক্লাস শুরু হয়েছে ডিসেম্বরে।৭ পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ডে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস চালু হয়ে গিয়েছিল ২ আগস্টেই৮, দীপাবলির পর থেকে নীচু ক্লাস এবং প্রাথমিক স্কুলগুলোও খুলেছে৯। বলাই বাহুল্য, প্রয়োজন হলে সব রাজ্যের সরকারই ফের স্কুল বন্ধ করার নির্দেশ দেবেন। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এতগুলো রাজ্যে সমস্ত শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুল খুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে বিচক্ষণ মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি সত্ত্বেও হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে বিধানসভা নির্বাচন ছিল। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভোটকর্মী হতে হবে বলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা সে যাত্রায় ভ্যাক্সিন পাননি, তাঁদেরও সরকার চাইলে সত্বর ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতেন। তারপর স্কুল খোলা যেতে পারত। সেসব করা হয়নি। সুতরাং মনে করা অমূলক নয় যে দিল্লির আপ সরকার, মহারাষ্ট্রের শিবসেনার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার, ঝাড়খণ্ডের জেএমএম-কংগ্রেস সরকার, এমনকি কর্ণাটকের বিজেপি সরকারেরও স্কুলশিক্ষা নিয়ে মাথাব্যথা আছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের নেই।
মুখ্যমন্ত্রী যে করোনাকে পাশবালিশ করে ফেলতে বলেছিলেন, সেটা কিন্তু স্রেফ কথার কথা নয়। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে নয়। অনেক ক্ষেত্রেই করোনাকে বুকে জড়িয়েই এগোনো হয়েছে, যেমন নির্বাচন। ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে স্কুল, কলেজ একটানা বন্ধ থেকেছে; এই কয়েক মাসের জন্য খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল। রাজ্যের সবচেয়ে বড় দুটো পরীক্ষা — মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক— বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচন হয়েছে যথাসময়ে, ভরপুর প্রচার সমেত। কেবল বিধানসভা নয়, সামান্য দেরিতে হলেও কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। রাজ্যের বাকি কর্পোরেশন এবং ছোট পৌরসভাগুলোর নির্বাচনও পাশবালিশ নিয়ে খেলতে খেলতেই হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। বড়দিন, নতুন বছর উদযাপন করতে যারা পার্ক স্ট্রিটে ভিড় জমিয়েছিল, তাদের পাশবালিশের অধিকারকেও সরকার সম্মান দিয়েছেন। গঙ্গাসাগরের তীর্থযাত্রীদেরও পাশবালিশের অধিকার সুরক্ষিত।
স্কুল, কলেজ ফের বন্ধ করে দেওয়ায় যে ক্ষতি তার তবু কিছুটা পরিমাপ হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, সমাজসেবী সংস্থার কল্যাণে এবং কিছুটা সোশাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা জানতে পেরেছি বিশেষত গ্রামাঞ্চলে স্কুলশিক্ষার কী অপরিসীম ক্ষতি এর মধ্যেই হয়ে গিয়েছে। ক্লাসে ফার্স্ট হয় যে মেয়ে, তার বিয়ে হয়ে গেছে — এমন খবরও আমাদের অজানা নেই। কিন্তু যে ক্ষতির কোনো পরিমাপ হয়নি, হয়ত হবেও না, তা হল মাসের পর মাস লোকাল ট্রেন বন্ধ করে রাখার ক্ষতি। কেবল শহর ঘেঁষা মফস্বল নয়, দূর গ্রামেরও বিপুল সংখ্যক মানুষকে রুটিরুজির জন্য নিত্য কলকাতায় আসতে হয়। সেই আসা যাওয়ার প্রধান মাধ্যম হল হাওড়া, শিয়ালদা থেকে ছাড়া লোকাল ট্রেন। শুধু যাত্রীদের কথা বললেও সবটা বলা হয় না। এই লোকাল ট্রেনে হকারি করে দিন গুজরান হয় বহু মানুষের। লোকাল ট্রেন বন্ধ রাখা মানে তাঁদের জীবিকারও সর্বনাশ করা। মার্চ ২০২০ থেকে অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত কতজন লোকাল ট্রেনের হকার আত্মহত্যা করেছেন তার কোনো পরিসংখ্যান কখনো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আর অনাহারে মৃত্যু বলে তো এ দেশে, এ রাজ্যে কিছু হয় না আজকাল। রাত দশটা অব্দি লোকাল ট্রেন চললে আশা করি হকাররা সপরিবারে অন্তত অর্ধাহারের উপযোগী রোজগার করতে পারবেন।
তা এসবের প্রতিকার কী? প্রতিকার নেই। কারণ কোনো সরকার যখন পাশবালিশের বেশি ভেবে উঠতে পারে না, তখন খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্যের কথা বলার দায়িত্ব নিতে হয় বিরোধীদের। অধিকার কী তা যখন মানুষ ভুলে যায়, গণতন্ত্রে তা মনে করিয়ে দেওয়ার, অধিকার আদায়ের আন্দোলন করার দায়িত্ব বিরোধীদের। কিন্তু এ রাজ্যের বিরোধীরাও নিজ নিজ পাশবালিশ নিয়ে ব্যস্ত। প্রধান বিরোধী দল বিজেপির পাশবালিশ হল হিন্দুত্ব। স্কুল, কলেজ, লোকাল ট্রেন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। উপস্থিত লোকলস্করও নেই, কারণ অনেকেই এসেছিল তবু আসে নাই। নির্বাচনের পর তৃণমূলে ফিরে গেছে। আর যে বিরোধীরা বিধানসভায় আসনের নিরিখে শূন্য হলেও এখনো কিছুটা লোকবলের অধিকারী, তাদের পাশবালিশ হল সোশাল মিডিয়া। ফেসবুক, টুইটার খুললেই সিপিএম নেতা, কর্মীদের পোস্ট দেখে জানা যাচ্ছে (১) স্কুল, কলেজ বন্ধ রাখা হীরক রাজার পাঠশালা বন্ধ করে দেওয়ার সমতুল্য এবং একই উদ্দেশ্যে করা; (২) পশ্চিমবঙ্গের গোটা গোটা প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এর ফলে; (৩) লোকাল ট্রেন কমালে আরও বেশি ভিড় হবে, তাতে বরং সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা বাড়বে। আরও নানা কথা যা সকলেরই জানা আছে। বিকল্প বামেরাও ফেসবুক বিদীর্ণ করে এসব বলছেন, সঙ্গে থাকছে করোনা কীভাবে গণতন্ত্রের সর্বনাশ করেছে তার উল্লেখ।
উভয় পক্ষই যা বলছেন সঠিক বলছেন, কিন্তু মুশকিল হল সোশাল মিডিয়ায় ওসব লেখার জন্যে তো আমাদের মত অক্ষম নিষ্কর্মারা রয়েছে। বিরোধী রাজনীতির লোকেদের তো এগুলো নিয়ে রাস্তায় নামার কথা। কোথায় আইন অমান্য? কোথায় স্কুল খোলার দাবিতে নবান্ন অভিযান? কোথায় লোকাল ট্রেন যেমন চলছিল তেমন রাখার দাবি নিয়ে রাস্তায় বসে পড়া? সুজনবাবু, সেলিমবাবু, সূর্যবাবুরা মমতা ব্যানার্জির ভূমিকার নিন্দা করে এন্তার লাইক কুড়োচ্ছেন। দীপঙ্করবাবু সর্বভারতীয় নেতা, ফলে ওঁর নীরবতা নিয়ে অভিযোগ করা চলে না। উনি পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে টুইট করার মধ্যেও যাননি গত কয়েক দিনে। নেতারা যে পথে চলেন, স্বাভাবিকভাবে কর্মীরাও সে পথেই চলবেন। ফলে সোশাল মিডিয়ায় সরকারের অগণতান্ত্রিকতা নিয়ে লেখালিখির পাশাপাশি বড়দিনে যারা ফুর্তি করতে বেরিয়েছিল তাদের নির্বুদ্ধিতা, ভোগবাদ ইত্যাদিকে আক্রমণ করা চলছে। যেন ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফুর্তি স্থগিত করে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব ছিল না, যেন সাধারণ মানুষ এতই অবাধ্য যে এ বছর সরকার পার্ক স্ট্রিটে সমস্ত উদযাপন বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিলেও বৈপ্লবিক কায়দায় সান্টা ক্লসের টুপি পরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আরও মজার কথা, বিপ্লবীরা সেইসব দিন আনি দিন খাই লোকেদের কথা ভুলেই গেছেন, যাঁরা বছরের এই সময়টায় মানুষ ফুর্তি করতে বেরোয় বলে দুটো পয়সা রোজগার করতে পারেন।
রাজ্যের এই দুর্দশা দেখে কারোর হয়ত চোখে জল আসতে পারে, তবে হাসছে পাশবালিশ।
তথ্যসূত্র
১। https://bangla.hindustantimes.com/
৩। https://fortune.com/2021/12/30/omicron-less-dangerous-covid-too-soon-to-know-who-warns/
https://nagorik.net এ প্রকাশিত