“কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত বলতে তোর কী মনে পড়ে, তোপসে?”
“মোদী বনাম মমতা।”
জয়বাবা ফেলুনাথ ছবির সংলাপ অদল বদল করে নিয়ে আজকাল সোশাল মিডিয়ায় অনেক মিম ঘুরে বেড়ায়। এরকম একটা মিম তৈরি হওয়াও আশ্চর্য নয়। তবে তরুণরা না জানলেও মাঝবয়সী বা প্রবীণদের নিশ্চয়ই মনে আছে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত ব্যাপারটা একেবারেই নতুন নয়। সাংবিধানিকভাবেই রাজ্য সরকারগুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় পিগমি করে রাখা হয়েছে এবং এই সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস দরকার — এই দাবিতে সবচেয়ে সরব ছিলেন যে মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর নাম জ্যোতি বসু। বস্তুত, আশির দশকে অকংগ্রেসি রাজ্যগুলোর কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিত বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৭-এ তৈরি হওয়া বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র তাঁর আপিলা-চাপিলা গ্রন্থে সেকথা সবিস্তারে লিখেছেন। আজকের বাংলা সংবাদমাধ্যম এই সংঘাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু সেদিনের সরকারকে বিস্তর টিটকিরি সহ্য করতে হয়েছিল। বলা হত, কেন্দ্রের টাকা না পাওয়া নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে সরকার নিজের দায়িত্ব এড়াচ্ছে।
ব্যাপারটা যে তা ছিল না, বরং সমস্ত রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বাড়ানোর জন্য অতি প্রয়োজনীয় লড়াই ছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ১৯৮৩ সালে শ্রীনগরে রাজ্যগুলোর দাবি জোরদার করতে ফারুক আবদুল্লার ডাকা সম্মেলনে খসড়া দাবি সনদ তৈরি করার জন্য গঠিত উপসমিতির সঞ্চালক হিসাবে অশোকবাবুর উপস্থিতি। ঐ বছরই ডিসেম্বরে কলকাতায় জ্যোতিবাবুর আমন্ত্রণে ঐ মর্মে আরো একটি বৈঠক হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে যখন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকারকে পদচ্যুত করেন, তখন জ্যোতিবাবুর নির্দেশে অশোকবাবু দিল্লী গিয়ে কংগ্রেস বিরোধীদের সভায় যোগ দেন এবং পরদিন শ্রীনগরে রাজ্যপালের সাথে দেখা করে প্রতিবাদ করেন; কাশ্মীরের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদর দপ্তরের ব্যালকনি থেকে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে ভাষণও দেন।
১৯৮৩-তে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের জন্য গঠিত সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতে হবে — এ ছিল সেইসময় জ্যোতিবাবু, অশোকবাবুদের জোরালো দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তা মানেনি। মানলে মমতা দেবীর জগদীপ ধনখড়কে সহ্য করতে হত না। তার চেয়েও বড় কথা, জম্মু ও কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া; দিল্লীর রাজ্য সরকারকে আইন বদলে ফেলে ঠুঁটো জগন্নাথ করে দেওয়া এবং মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার, মুখ্যসচিবকে নিয়ে টানাটানি করে পশ্চিমবঙ্গে অস্থিরতা তৈরি করা — যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর এই ধারাবাহিক আঘাত হানা বিজেপির পক্ষে শক্ত হত।
আরও পড়ুন Has the CPI(M) forgotten its strong federal roots?
দুর্ভাগ্যজনক যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্যে পূর্বসুরীদের এই লড়াইয়ের ইতিহাস সিপিএমের বর্তমান নেতৃত্বের মনে আছে, এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে “তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে তীব্র মেরুকরণ হয়ে যায়। নির্বাচনী ফলাফলের এটিই সম্ভবত মূল কারণ।” নির্বাচনের প্রচারেও সিপিএমের (বা সংযুক্ত মোর্চার) পক্ষ থেকে এই বাইনারি ভাঙতে চাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। গত এক মাসের ঘটনাবলীকে সিপিএম নিজেই কিন্তু ওই বাইনারির ঊর্ধ্বে উঠে দেখতে পারছে না। ভোট পরবর্তী এই লড়াই যে কেবল বিজেপি বনাম তৃণমূল নয়, বরং কেন্দ্রীয় সরকার বনাম রাজ্য সরকার — তা তারা এখনো বুঝছে না। মন্ত্রীদের গ্রেপ্তারিকে সিপিএমের আইনজীবী নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য চটজলদি সমর্থন করেছিলেন। পার্টির মতামত তাঁর সঙ্গে মেলেনি, কিন্তু সে জন্যে বিকাশবাবুকে তিরস্কার করা হয়েছে বলেও খবর নেই। মুখ্যসচিবের ঘটনায় সুজন চক্রবর্তী যদিও বলেছেন এটা কেন্দ্রের প্রতিহিংসামূলক আচরণ, সাথে জুড়ে দিয়েছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের সমালোচনা।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিধানসভা, লোকসভায় অনুপস্থিত দলের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো-টাঠামো নিয়ে ভেবে লাভ কী? উত্তর হল, বাইনারি ভেঙে যে বিরোধী পরিসর পুনরায় দখল করা এখন সিপিএমের লক্ষ্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে গেলে সেই পরিসরই আর থাকবে না। কারণ কেন্দ্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতা চলে যাওয়া একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ঠিক আগের ধাপ।
উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত