সাইক্লোনে ডিজাস্টার পর্ন: সব দোষ প্রতিবেদকের নয়

প্রতিবেদকরা পুতুল, এঁরাই বাজিকর। এঁরা যা দেখাতে চাইবেন, যেভাবে দেখাতে চাইবেন — প্রতিবেদকরা সেভাবেই খবর করবেন।

কয়েক বছর আগে আমার তদানীন্তন অফিসের খুব কাছেই একটা অতি পুরনো বাড়ি ভেঙে পড়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, একজন মারাও গিয়েছিল। স্বভাবতই সেই ঘটনার খবর করতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হন। কিন্তু শুধু তাঁরা নন, দেখেছিলাম বেশকিছু সাধারণ মানুষ সেখানে হাজির হয়েছেন স্রেফ ফোনের ক্যামেরায় ধ্বংসস্তুপের ছবি তুলতে। কেউ কেউ আবার অকুস্থলে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিলেন। ব্যাপারটা খুব অনন্যসাধারণ নয়। সাম্প্রতিককালে এরকম পরিস্থিতিতে এমন দৃশ্য অনেকেরই চোখে পড়েছে। আজকাল সবকিছুই বিনোদন হয়ে উঠেছে। এমনকি ধ্বংসের দৃশ্য দেখেও বিনোদন হয়। আবার শুধু দেখেই সন্তুষ্টি হয় না, অন্যকে দেখাতেও ইচ্ছা করে। সুতরাং বলাই বাহুল্য বন্যার ছবি, ধসের ছবি, ভূমিকম্পের ছবির চাহিদা আছে। ফলে টিভি চ্যানেলগুলো যে গতকাল সাইক্লোন ইয়াসের ধ্বংসলীলার ছবি তুলতে রিপোর্টারদের বিপজ্জনক এলাকাগুলোতে পাঠিয়েছিল, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সাংবাদিকতার পেশাগত নৈতিকতার প্রশ্নে পরে আসা যাবে, আগে মেনে নেওয়া দরকার যে চ্যানেলগুলো বাজারের চাহিদা মেনে কাজ করে, আর বাজারে ধ্বংসের দাম আছে। সেই কারণে ইংরেজিতে অনেকে আজকাল একে বলেন ডিজাস্টার পর্ন।

এখন কথা হল, ব্যাপারটা কি সত্যিই এরকম অবিমিশ্র অন্যায়? সংবাদমাধ্যমের কি যা ঘটেছে তা দেখানো কর্তব্য নয়? ধ্বংস হলে ধ্বংস দেখাবে না, মৃত্যু ঘটলে মৃত্যু দেখাবে না? কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ল্যাজে গোবরে কেন্দ্রীয় সরকার যে দাবি করছে সংবাদমাধ্যমের ইতিবাচক ছবি দেখানো উচিৎ; কেবল মৃত্যু, বেদনা, অব্যবস্থা, লাঞ্ছনা দেখানো উচিৎ নয় — সেটাই তাহলে ঠিক?

একেবারেই তা নয়। সত্য দেখানো নিশ্চয়ই সংবাদমাধ্যমের কাজ। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, তার ত্রুটি বিচ্যুতি ফাঁস করে দেওয়াও সংবাদমাধ্যমের কাজ। বরং কোথায় কী ভাল কাজ করল ক্ষমতাসীন মানুষ, সেটা না দেখালেও চলে। কারণ গণতন্ত্রে সেটাই তাদের করার কথা। অধিকার রক্ষিত হয়েছে, কর্তব্য করা হয়েছে — এগুলো খবর নয়, কারণ ওটাই নিয়ম। অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, কর্তব্যে অবহেলার ঘটনা ঘটেছে — এগুলোই খবর, কারণ নিয়ম ভাঙা হয়েছে। এক কথায়, যা স্বাভাবিক নয় তা-ই খবর। সাংবাদিকতার ছাত্রছাত্রীদের তাই গোড়াতেই শেখানো হয়, কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটা খবর নয়। মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটাই খবর। সুতরাং সাইক্লোন হয়নি, সেটা খবর নয়। সাইক্লোন হয়েছে, সেটাই খবর। আর যা খবর, তা টিভি চ্যানেলগুলো দেখাতে বাধ্য। যেমন বাজারে চাহিদা আছে বলে দেখানো উচিৎ, তেমনই পেশাগত নৈতিকতার দিক থেকেও দেখানো উচিৎ।

আসলে ধ্বংস দেখালেই ডিজাস্টার পর্ন হয় না; হয় ধ্বংসকে বলপূর্বক উত্তেজক, আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করলে। ২৬ মে, ২০২১ সারাদিন টিভিতে সাইক্লোন ইয়াসের কভারেজ যেভাবে চলেছে তাতে ব্যাপারটাকে যৎপরোনাস্তি উত্তেজক করে তোলার চেষ্টা পরিষ্কার। কোন চ্যানেলে সাঁতরে যাওয়া মানুষের মুখে বুম ধরে প্রশ্ন করছেন একই জায়গায় হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেদক, কোথাও প্রতিবেদক নিজেই গলা জলে। ব্যাপারটাকে উত্তেজক করে তোলা এতটাই জরুরি যে একটা চ্যানেল ২০১৬ সালের উরুগুয়ের টর্নেডোর দৃশ্যও ইয়াসের ছবি বলে দেখিয়েছে। [১]

ফলত বিরাট অংশের দর্শক প্রশ্ন তুলেছেন, এ কী রকম কভারেজ? অনেক দর্শকেরই মনে হয়েছে চ্যানেলগুলো অকারণে এই ভয়ঙ্কর ঝড়ের মধ্যে ঠেলে দিয়ে প্রতিবেদকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এই বক্তব্য আবার অনেক সাংবাদিকের গায়ে লেগে গেছে। প্রথিতযশা সাংবাদিকরা কেউ কেউ সোশাল মিডিয়ায় জবাব দিয়েছেন, এসব ঝুঁকির অ্যাসাইনমেন্ট নেওয়ার মধ্যেই সাংবাদিক জীবনের সার্থকতা। অনেকে সিনিয়রদের সাবধানবাণী উড়িয়ে দিয়ে এমন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে থাকেন। কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যে নয়। এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাব না থাকলে ভাল ভাল খবর করা যায় না, ভাল প্রতিবেদক হওয়া যায় না। অন্য অনেক পেশার বদলে এই পেশা বেছে নেওয়ার কারণ অনেকের কাছেই এইসব “থ্রিল”। বরখা দত্তের মত গোলাগুলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের খবর করার ইচ্ছা অনেক সাংবাদিকেরই থাকে। তাদের কেউ কেউ যে “ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রূকুটিতে” গাইতে গাইতে পশ্চিমবঙ্গের উপকূল এলাকায় চলে যাননি সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু একটা বুনিয়াদি প্রশ্ন আছে।

প্রশ্নটা হল এই থ্রিল কী উৎপাদন করছে? মানে সংবাদ যদি স্রেফ পণ্য হয়, তাহলে থ্রিলড সাংবাদিক কী পণ্য তুলে দিচ্ছেন ক্রেতার (অর্থাৎ দর্শকের) হাতে? সংবাদ যদি পণ্য না হয়, জনকল্যাণের পক্ষে প্রয়োজনীয় বস্তু হয়, তাহলেই বা কী কল্যাণ হচ্ছে থ্রিলড সাংবাদিকের দ্বারা? যে সাংবাদিক নিজের জীবন বিপন্ন করে গঙ্গাসাগরে বা দীঘা কি শঙ্করপুরে সাইক্লোন ইয়াসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি কী খবর সরবরাহ করছেন? ঐ সময়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি তিনি এমন কিছু জানাতে পারছেন, যা আবহাওয়াবিদদের দেওয়া তথ্য থেকে স্টুডিওয় বসে জানা সম্ভব নয়? তিনি কি এমন কোন দুর্গত মানুষের খবর বাকি দুনিয়াকে (তদ্দ্বারা সরকারকেও) জানাতে পারছেন যার খবর এমনিতে কেউ জানতেও পারত না? যদি করার মত প্রশ্ন হয় “আপনার এখন কেমন লাগছে?” বা “আপনি সাঁতার কাটছেন?”, তাহলে সেই থ্রিলের প্রয়োজন কী? এতে কোন জনকল্যাণ সাধিত হচ্ছে? পণ্য হিসাবেই বা কী এমন নতুন জিনিস দর্শককে দেওয়া হচ্ছে? সাংবাদিকতা কি এত তুচ্ছ ব্যাপার যে একজন সাংবাদিক থ্রিলড হচ্ছেন বলেই এসব দেখাতে হবে টিভির পর্দায়? ইংরেজিতে embedded journalism বলে একটা কথা চালু আছে। তার নিদর্শন আমাদের দেশে বড় একটা দেখা যায় না। বিবিসি, সিএনএন বা আল জাজিরা খুললে দেখা যায় সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, প্যালেস্তাইনের মত জায়গায় সাংবাদিকরা ঘুরে ঘুরে বহু অচেনা জায়গায় পৌঁছে যান। অজানা ঘটনা তুলে আনেন। বহু মনে রাখার মত খবর হয়, সেসব খবর করতে গিয়ে তাঁদের বহু বিপদের মধ্যেও পড়তে হয়। কেউ কেউ বিদেশ বিভুঁইয়ে বন্দী হয়ে থাকেন বছরের পর বছর, কেউ বা খুন হয়ে যান, কেউ গোলাগুলির মাঝে পড়ে গিয়ে নেহাত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। নিশ্চয়ই থ্রিলের আকর্ষণ না থাকলে কেউ অমন করতে যায় না। কিন্তু তাঁদের করা খবরগুলোর মধ্যে মৌলিক গবেষণা থাকে, পরিশ্রম থাকে, ফলে উদ্ঘাটন থাকে। অমন সাংবাদিকতা সময়সাপেক্ষ। ঝড়ের দিন ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে ছবি তুলে, পিস টু ক্যামেরা দিয়ে চলে আসার কাজ নয়। আমাদের এখানকার কজন সাংবাদিক আগামী একমাস ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পড়ে থেকে কোথায় কীভাবে জনজীবন স্বাভাবিক হল বা হল না, সরকারি সাহায্য প্রতিশ্রুতিমাফিক পৌঁছল বা পৌঁছল না — সে খবর করবেন? যদি না করেন, তাহলে বিপর্যয়ের দিনের প্রয়াসকে ডিজাস্টার পর্ন বললে দোষ কোথায়?

এবার ভাবা যাক, এই যে আমাদের চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদকরা কেউ অতটা সময় দেন না, কোন নতুন কথা তুলে আনতে পারেন না — এর কারণ কী? সকলেই অযোগ্য, অদক্ষ? বিদেশি চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদকরা সকলে দেবতা, গন্ধর্ব আর আমাদের সব প্রতিবেদক শর্টকাট খোঁজা ফাঁকিবাজ? তা তো হতে পারে না। তাহলে তফাত কোথায়?

তফাত চ্যানেলগুলো খবর বলতে যা বোঝে আর প্রতিবেদকদের যেভাবে দ্যাখে তাতে। রোজ এবিপি আনন্দ বা ২৪ ঘন্টা দ্যাখেন এমন মানুষও পাঁচজন প্রতিবেদকের নাম বলতে গেলে হোঁচট খাবেন, কিন্তু গড়গড় করে বলে দেবেন অ্যাঙ্করদের নাম। এবিপি আনন্দ আর সুমন দে অধিকাংশ মানুষের কাছেই সমার্থক, ২৪ ঘন্টা বললেই মনে পড়বে প্রয়াত অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বা মৌপিয়া নন্দীর নাম। রিপাবলিক টিভি বললেই একমেবাদ্বিতীয়ম অর্ণব গোস্বামী। অর্থাৎ প্রতিবেদকরা পুতুল, এঁরাই বাজিকর। এঁরা যা দেখাতে চাইবেন, যেভাবে দেখাতে চাইবেন — প্রতিবেদকরা সেভাবেই খবর করবেন। সঙ্গে অমুক, সঙ্গে তমুক শো চলে সব চ্যানেলেই। ভারতীয় খবরের চ্যানেলগুলোতে স্পেশাল শো মানেই সেটা অ্যাঙ্করের শো। প্রতিবেদকের শো বলে কিছু নেই। অথচ বিদেশি চ্যানেলগুলোতে কিন্তু বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রতিবেদকদের কারও কারও নিজস্ব শো থাকে। এই প্রতিবেদকরা যে কোন বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টে যেমন জীবন বিপন্ন করে খবর করেন, তেমনি পাদপ্রদীপের আলোর ভাগও পান। আবার অ্যাঙ্কররাও বেরিয়ে পড়েন অনেক সময়। আমাদের দেশের চ্যানেলগুলোতে কিন্তু ৩৬৫ দিন স্টুডিও আলো করে থাকেন সুমন, মৌপিয়া, অর্ণব, নবিকা কুমাররা। হ্যাঁ, তাঁরাও বেরোন বটে। রিও কি রাশিয়া যেতে অথবা আউট্রাম ঘাটে বিতর্কসভা সঞ্চালনা করতে। সাইক্লোন ইয়াস নিয়ে রিপোর্ট করতে নৈব নৈব চ। আমরি অগ্নিকাণ্ডের অকুস্থলে সুমনবাবুর পৌঁছে যাওয়া বা ইয়াসের প্রতিবেদনে সুচন্দ্রিমা দেবীর উপস্থিতি ব্যতিক্রম, যা নিয়মকেই সুচিহ্নিত করে। নির্বাচনের ফল প্রকাশ বা বড় কিছু ঘটলে এঁদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টিভির পর্দায় দেখা যায়, পরিশ্রম করার অসীম ক্ষমতা দেখে দর্শকদের ঘাড় শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে। ট্রাম্প বনাম বাইডেন দ্বৈরথের ফল প্রকাশের দিনগুলোতে সিএনএন-এর অ্যাঙ্কররা কিন্তু এসে বসতেন, কিছু সময় পরে আবার অন্যদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতেন।

এসবের জবাবে অবশ্যই যে যুক্তি উঠে আসবে, তা হল “ওদের অনেক টাকা, অনেক লোকজন।” ঠিক কথা। তাহলে এ-ও মেনে নেওয়া দরকার যে এখানকার টিভি চ্যানেলগুলোতে দরকারের চেয়ে কাজের লোক কম এবং তাঁরাও প্রয়োজনের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পান। অতএব থ্রিল পরের কথা, সাইক্লোন ইয়াসকে ধাওয়া করে (রিপাবলিক টিভির ভাষায়) যে চ্যানেল, তার প্রতিবেদকের প্রাথমিক চিন্তা চাকরি বাঁচানোই। তার সাধ্য কি সত্যিকারের খবরের খোঁজ করে? মহাজন যে পথে হাঁটেন সেটাই পথ, অ্যাঙ্করের পথেই প্রতিবেদককে হাঁটতে হবে। যে দেশের টিভি অ্যাঙ্কর প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে নালে ঝোলে অম্বলে হয়, সে দেশের প্রতিবেদকের ঝড়ের দিনে ডিজাস্টার পর্ন তৈরি না করে উপায় নেই। দর্শকও দেখবেন, কারণ ওখানে দাঁড়িয়ে সেলফি নিতে পারার দুধের স্বাদ এভাবে ঘোলে মিটবে।

সূত্র:

১। https://bangla.boomlive.in/fact-check/fake-news-cyclone-yaas-2016-video-of-tornado-in-dolores-uruguay-falsely-shared-as-yass-effect-in-odisha-abp-ananda-factcheck-13283

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

Leave a Reply

%d bloggers like this: