এই স্তম্ভে আমার প্রথম লেখা ছিল সিপিএমের প্রচারে ব্যবহৃত টুম্পাসোনা প্যারডি নিয়ে। সেই ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল, ইউটিউবে কয়েক কোটি হিট হয়। কারো কারো অপছন্দ হলেও, শেয়ার, লাইক এবং ইউটিউব হিটের সংখ্যাই প্রমাণ করে বহু মানুষ সেই ভিডিও পছন্দ করেছিলেন। সেই ভিডিও তখন একাধিক কাগজে খবর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিপিএম নেতারা দাবি করেছিলেন যুবসমাজের ভাষায়, সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলার ক্ষেত্রে তাঁদের যে ঘাটতি, ওই ভিডিও তা পূরণ করার প্রচেষ্টা। সোশাল মিডিয়ায় সাফল্য প্রমাণ করে তাঁরা সফল। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন সংস্থা যেভাবে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছতে চায়, বামপন্থীরাও সেইভাবে বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন ভোটারদের কাছে। বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো নিজেদের ক্যাম্পেনের সাফল্য মাপে আর্থিক বর্ষের শেষে বিজ্ঞাপিত পণ্য বা পরিষেবার বিক্রির পরিসংখ্যান দেখে। সেই যুক্তি মানলে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল যেহেতু দেখাচ্ছে বামেদের হাত খালি, সেহেতু টুম্পাসোনাও যে ফ্লপ তা এবার মেনে নেওয়া দরকার। যে যুবসমাজকে ওঁরা ধরতে পেরেছেন বলে ভাবছিলেন, তাঁদের কত শতাংশ ভোট দিয়েছেন তা বিস্তারিত ফলাফল এলে তবেই বোঝা যাবে। কিন্তু রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ যে তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেছেন তা পরিষ্কার। এবার তাহলে ভাবার সময়, কোথায় ভুল হল? তীব্র বামবিরোধী মানুষও ভাবেননি যে স্বাধীন ভারতে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের সবচেয়ে খারাপ ফল বামেরা এবার করবে।
চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে সম্পূর্ণ ফলাফল হাতে নিয়ে পর্যালোচনা পর্যন্ত। কিন্তু প্রাথমিকভাবে যা বোঝা যাচ্ছে, তা হল জনগণের ভাবনা চিন্তার সাথে বামপন্থীদের চিন্তাভাবনার দুস্তর ফারাক। ইদানীংকালে বামপন্থী কর্মীদের মধ্যে, বিশেষত তরুণদের মধ্যে, এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাঁরা মনে করেন সোশাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। টুম্পাসোনা নিয়ে আপ্লুত হওয়াও তারই প্রকাশ। সন্দেহ নেই যে সমস্ত আলোচনায় উঠে আসে বিজেপি কিভাবে হাজার হাজার হোয়াটস্যাপ গ্রুপকে ব্যবহার করে ভুয়ো খবর এবং নিজেদের বার্তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়ে ২০১৪ থেকে নির্বাচন জিতে চলেছে। কিভাবে টুইটারের হ্যাশট্যাগ যুদ্ধ চালিয়ে তাদের বহু শাখাবিশিষ্ট প্রোপাগান্ডা মেশিনারি ভোটারের মস্তিষ্কের দখল নেয়। এসবের বিরুদ্ধে লড়তে হবে ঠিক কথা, কিন্তু মানুষের সাথে নিবিড় যোগাযোগের যে কোন বিকল্প নেই, সেকথা বললে আজকালকার অনেক সিপিএম কর্মী বেশ রেগেই যান। “ওসব করে আজকাল আর জেতা যায় না” — এটা তাঁদের অনেকের প্রিয় বাক্যবন্ধ।
আরও পড়ুন বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র
আপত্তি উঠবে, যে তরুণ সিপিএম কর্মীরা কি গত বছরের লকডাউনের সময় থেকে শুরু করে উম্পুনের বিপর্যয় হয়ে এখনকার দ্বিতীয় কোরোনা ঢেউয়ে একেবারে নীচের তলার মানুষের পাশে থাকেননি? নিঃসন্দেহে থেকেছেন। তৃণমূল বা বিজেপির উপস্থিতি বরং সেখানে নগণ্য। এই মুহূর্তেও দলমত নির্বিশেষে বহু মানুষ অক্সিজেন সিলিন্ডার, অ্যাম্বুলেন্স বা হাসপাতালের বেডের দরকারে রেড ভলান্টিয়ার্সের খোঁজ করছেন। গ্রীন ভলান্টিয়ার্স বা স্যাফ্রন ভলান্টিয়ার্স বলে কিছুর অস্তিত্ব কারোর জানা নেই। কিন্তু সিপিএম নেতৃত্বের ভাবা প্রয়োজন, কর্মীদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ভোট বাক্সে উঠছে না কেন? স্পষ্টতই মানুষ কোন ইস্যুকে ভোটের ইস্যু বলে মনে করেন, তা বুঝতে তাঁদের ভুল হচ্ছে। তাঁরা মনে করছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ আছে। অথচ দেখা গেল ভোটারদের কাছে প্রধান ইস্যু ছিল বিজেপি শাসনের ভয়। কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো, দুর্নীতি — যেগুলো বামেদের ইশতেহার এবং নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রে ছিল — তার চেয়ে ভোটারদের বেশি জরুরি মনে হয়েছে বিজেপি জিতলে এনআরসি, সিএএ-র বিপদের কথা। হয়ত এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে চাকরি না পাওয়ার চেয়েও তরুণ ভোটারদের বড় বিপদ মনে হয়েছে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াডের হুমকিকে। সোশাল মিডিয়ার বিজেপির সাথে টক্কর দেওয়া বামেরা এসব বুঝতেই পারেননি, তাই মাটিতে দাঁড়িয়ে না পেরেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে টক্কর দিতে, না পেরেছেন বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে।
উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত