মেধামেধ যজ্ঞ

মানুষের পেট যেহেতু ভিসুভিয়াস নয়, সেহেতু পঁচিশ দিন কেটে যাওয়ায় জঠরাগ্নিও বোধহয় নিভে গেছে

আজ কলকাতায় মহোৎসব ছিল। এ বছরের আই পি এল এর প্রথম খেলা। রাজভবনের উল্টোদিকে বাস থেকে নেমে যখন বাঁয়ে ঘুরে হাঁটছি, তখন উলটোদিক থেকে জনস্রোত ধেয়ে আসছে। নানারকম মুখ। রংচঙে, ঝকঝকে, হাত ধরাধরি করে প্রেমিক প্রেমিকা, বাবার হাত ধরে ছেলে, নাইট রাইডার্সের জার্সি পরিহিত বন্ধুদল। সকলেরই মুখ দেখে বোঝা যায় ফুরফুরে মেজাজ, ভর্তি পেট। কারো কারো হাতে ঠান্ডা পানীয়ের বোতল। এঁদের সকলের কাছে মহোৎসবের আহ্বান এসেছে। কিছু কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে। স্বর্গের বাগানের টিকিট কেটেছেন এঁরা কড়কড়ে নোট খরচ করে। কেনই বা মেজাজ ফুরফুরে থাকবে না?

এঁদের পেরিয়ে ধর্মতলার বাস ডিপোর মধ্যে দিয়ে হাঁটছি, নাকে আসছে ফুটপাথে রাঁধা বিরিয়ানি, ডিমের কারি, মাছের ঝোল, শস্তার চাউমিন, মোগলাই পরোটা, এগ রোল, পেয়ারা, শসার গন্ধ। ধর্মতলার এই আনন্দযজ্ঞে দিনমজুর থেকে শুরু করে আমার মত এ সি ট্যাক্সি চাপতে সক্ষম মানুষ পর্যন্ত সবার নিমন্ত্রণ।

আর এইসব রূপ রস গন্ধের অনতিদূরেই বসে আছেন, বা মাথা ঘুরছে, গা বমি ভাব আসছে বলে শুয়ে আছেন — আমার মেয়ের হবু মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা। একদিন দুদিন নয়, পঁচিশ দিন ধরে কিছু না খেয়ে। এমনও হতে পারে যে আগামী দিনে হয়ত এটাই নিয়ম হয়ে যাবে। এক বৃদ্ধকে দেখলাম একটি অসুস্থ মেয়ের পাশে বসে আছেন। সম্ভবত মেয়েটির বাবা। বলা যায় না, হয়ত আমার মেয়েকেও এরকম অনশনে বসতে হবে লেখাপড়া শিখে আর আমি তখন ঐ বৃদ্ধের জায়গায় গিয়ে বসব।

এই লড়াকু ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি আমার অক্ষম, নীরব সমর্থন জানাতে কয়েক মিনিটের জন্যে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম পথপার্শ্বে, যেখানে এরা ত্রিপলের নীচে রাস্তায় বসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটাচ্ছে। বিশ্বাস করুন, জায়গাটায় কোন গ্ল্যামার নেই, কোন বিপ্লব বিপ্লব গন্ধ নেই। কয়েকশো পরীক্ষায় পাশ তরুণ তরুণীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বিশেষ কোন শব্দও নেই। সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই ঠারেঠোরে যা বলতে চাইছেন বা সরকারপক্ষ হয়ত যে আশঙ্কায় এই আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করছেন, তেমন কোন রাজনৈতিক আগুনও জায়গাটায় জ্বলছে না। মানুষের পেট যেহেতু ভিসুভিয়াস নয়, সেহেতু পঁচিশ দিন কেটে যাওয়ায় জঠরাগ্নিও বোধহয় নিভে গেছে।

আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন, মামারা, জ্যাঠারাও এই পেশায় ছিলেন, স্ত্রীও শিক্ষিকা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি যাঁদের জন্যে, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষক। শুনেছি একসময় শিক্ষকদের সংসার চালানো দুর্বিষহ ছিল, লোকে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না শিক্ষক পাত্রের সাথে। কিন্তু তখনো শিক্ষকদের এমন অসম্মান করেনি বোধহয় কোন সরকার। বিধানচন্দ্রের সরকার আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর গুলি চালিয়েছিল, সেকথা বাদ দিলে।

বেশ মনে আছে, বামফ্রন্ট আমলে একসময় স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠত প্রায়ই। ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা নিয়ে প্রার্থীদের অসন্তোষ থাকত। যোগ্য প্রার্থী ভাল ইন্টারভিউ দিয়ে বেরিয়েও চাকরি পেতেন না। আমারই এক পরিচিত বহুদূর থেকে এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে স্টেশন থেকে স্কুলে যাওয়ার রিকশায় উঠেই চালকের মুখ থেকে শুনেছিলেন “আপনার চাকরি হবে না। সেক্রেটারির লোক আছে। তাকেই নেবে।”
সম্ভবত কতকটা সেই কারণেই কলেজের জন্যে যেমন নেট বা স্লেট পরীক্ষা, সেই আদলে এস এস সি পরীক্ষা চালু করা হয়েছিল। তার সুফল আমাদের প্রজন্মের বহু শিক্ষিত ছেলেমেয়ে পেয়েছেন। আমাদের বাবা-মায়েরা জানতেন, পশ্চিমবঙ্গে আর কোন চাকরি না হোক, এস এস সি টা পাশ করতে পারলে স্কুলের চাকরি হবেই। কিন্তু তা বললে তো চলবে না। আগের সরকারের কোন ভাল কাজকেও যে পরের সরকার রেয়াত করবে, এমন দাবী এ দেশে আর করা চলে না। পরিবর্তন আর উন্নয়নের জোয়ারে পুরাতন যাক ভেসে যাক। অতএব যে পরীক্ষা প্রতি বছর হওয়ার কথা, সে পরীক্ষা প্রায় প্রতি বিশ্বকাপে হচ্ছে। সে পরীক্ষার ফলাফলে আবার এত বেশি মেধাবী ছেলেমেয়ের নাম উঠে আসছে যে মেধা তালিকা প্রকাশ করাই যাচ্ছে না। তবু এই শ দুয়েক ছেলেমেয়ে চৈত্রের গরমে রাস্তায় বসে আছে সরকারের শুভবুদ্ধি উদয়ের আশায়। অহো, কি দুঃসহ স্পর্ধা!

কয়েকদিন আগেই ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবিটা দেখছিলাম। নাজি অধিকৃত পোল্যান্ডের ক্রাকাউতে বন্দী শিবিরে দরকারী আর অদরকারী লোকেদের তালিকা বানানো হচ্ছে। একজন করে বন্দী এসে দাঁড়াচ্ছে আর নাজি কেরানি তার পেশা জিজ্ঞেস করছে। দরকারী বুঝলে পরিচয়পত্রে একরকম ছাপ, অদরকারী বুঝলে অন্যরকম। একজন বললেন “আমি ইতিহাস আর সাহিত্য পড়াই।” পত্রপাঠ অপ্রয়োজনীয় হওয়ার ছাপ পড়ে গেল। অসহায় শিক্ষক বিস্ফারিত নেত্রে বললেন “I teach history and literature. Since when it’s not essential?”

দেখে শিউরে উঠলাম। সাহিত্য, ইতিহাস — এসব পড়া যে দরকারী নয় তা তো আমরা ছোট থেকে শুনে আসছি। আর এই শেষ যৌবনে এসে দেখতে পাচ্ছি ওগুলো যাঁরা পড়ান তাঁরাও অদরকারী বলে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছেন। এই তো সেদিন এক প্রথিতযশা সাংবাদিক (অধুনা বিচারাধীন বন্দী হিসাবে শ্রীঘরে থাকায় যশে কিঞ্চিৎ টান পড়েছে অবশ্য) সদর্পে ফেসবুকে লিখে দিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের মত ফালতু বিষয় তুলে দেওয়া উচিৎ। এসব পড়ে কোন লাভ নেই। লিখলেন শুধু নয়, কয়েকশো লাইকও পেলেন। আর এস এস সি পাশ করা ছেলেমেয়েদের আন্দোলন শুরু হতেই সোশাল মিডিয়ায় অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব জন্মাচ্ছে — যারা বিজ্ঞান পড়ে তারা নাকি বেশিরভাগই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রাজ্যের বাইরে চলে যায়। পড়ে থাকে মেধাহীন বাংলা, ইংরিজি, ইতিহাসের ছেলেমেয়েরা। তাদের এস এস সি ছাড়া গতি নেই, তাই তারাই নাকি যোগ্যতা না থাকলেও চাকরি দাবী করে রাস্তা জুড়ে বসে আছে।

যারা এসব বলছে তারা বোধহয় জানে না গোটা দেশে কত হাজার ইঞ্জিনিয়ার বেকার, কত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আসন পূরণ হচ্ছে না কারণ লোকে বুঝে গেছে ওখানেও চাকরি নেই। নির্ঘাত তারা এও জানে না যে ঐ “not essential” এর তালিকায় বিজ্ঞানের শিক্ষক, গবেষকরাও ঢুকে পড়েছেন।

গত মাসের ঘটনা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারপোষিত বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ গবেষকদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, শোন বাপু, এখন টাকাকড়ি নেই। অর্ধেক মাইনে দিচ্ছি, তাই নিয়ে চুপচাপ থাকো। পরে দেবখন বাকিটা। এদিকে খবরের কাগজ খুলে দেখুন। সরকারী বিজ্ঞাপনের কমতি নেই। যত অভাব মাস্টারমশাই, দিদিমণি, গবেষকদের মাইনে দেওয়ার বেলায়। এ রাজ্যেও যেমন শিক্ষকদের ডি এ, ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার বেলায় শোনা যায় কোষাগার ফাঁকা। অথচ কার্নিভালের টাকা কম পড়ে না, থানা থেকে ডেকে ডেকে দুর্গাপুজোর টাকা দেওয়ার সময়েও টানাটানি হয় না।

আসলে ঐ যে “not essential”, ঐটেই হচ্ছে আসল কথা। যারা শেখায় তাদের যত অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া যাবে তত মানুষের শেখার আগ্রহ কমে যাবে, মগজ ধোলাই না করলেও সবাই বুঝে যাবে “বিদ্যা লাভে লোকসান, নাই অর্থ নাই মান।” তবে না হীরকের রাজা ভগবান হবে?

আর ভগবান হতে সাহায্য করি আমরা, যারা ফেসবুক ভরে আছি। আমরা ভাবছি এসব ধরনা, অনশন তো করছে বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা, যারা বাংলা মাধ্যমের স্কুলে চাকরি করতে চায়। এতে আমাদের কী? আমার ছেলেমেয়েকে তো ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে পড়াব, সে বড় হয়ে চাকরি করলে ওরকম স্কুলেই করবে। তো আমার ভারী বয়ে গেছে। কিন্তু এত নিশ্চিন্ত না থেকে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন দেখি, আপনি কয়েক লাখ টাকা খরচ করে যে স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করেছেন সেই স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা কত টাকা মাইনে পান? এ ছুতো সে ছুতোয় যে বিপুল পরিমাণ টাকা স্কুল কর্তৃপক্ষ আপনার থেকে নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত, তার কত শতাংশ শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মীদের বেতনে খরচ হচ্ছে? চিত্রটা কিন্তু ভাল নয়।

আসলে শিক্ষা এখন ব্যবসায় পরিণত। কিসের ব্যবসা? কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবসা। কাদের কাঁচামাল। কর্পোরেটের। আপনার ছেলেমেয়ে অঙ্ক করে মজা পাচ্ছে কিনা, তার মধ্যে ভবিষ্যতের গণিতবিদ তৈরি হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কেউ নিচ্ছে না। কারো সন্তান স্টিফেন হকিংয়ের মত মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনে জীবন ব্যয় করুক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা চাইছে না। কারণ ওরকম ছাত্রছাত্রীকে মানবসম্পদ হিসাবে কোন কোম্পানি কিনবে না। আর যে শিক্ষা লাভের কড়ি উৎপাদনে কাজে লাগে না, তা “not essential.” একই কারণে সাহিত্য তথা তুলনামূলক সাহিত্যও ফালতু। কোন শিক্ষক বা শিক্ষিকার প্রণোদনায় (অনুপ্রেরণায় নয় কিছুতেই) যদি এক ঘর ছাত্রছাত্রী শিহরিত হয়ে আবিষ্কার করে জীবনানন্দের কোন পংক্তি আজকের প্যালেস্তাইনের কোন কবির প্রায় অনুবাদ বলে মনে হচ্ছে, তাতে আম্বানি বা জ্যাক মায়ের কী লাভ? উল্টে বিপদ। কারণ “এরা যত বেশি শেখে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।”

অতএব, এক দিকে ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে ওঠে, যেখানকার দেয় বেতন মহার্ঘ। অন্যদিকে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন সাধারণ পড়ুয়ার নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এ রাজ্যে কম বেশি যা-ই নম্বর পাও, কলেজে ভর্তি হতে হাজার হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি না পেয়ে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকতে হয়, অথচ শিক্ষকের অভাবে স্কুল চলে না, ছাত্রসংখ্যা কমে যায়, স্কুল উঠে যায়।
দেখে শুনে আমি আপনি কী করব? বাবা-মা হিসাবে যেটুকু করতে পারি। অর্থাৎ সামর্থ্য আছে বলে বেসরকারী স্কুলে সরিয়ে নেব, বহুজাতিকের জন্যে মানবসম্পদ তৈরি করব। আর যে বাবা-মায়ের সামর্থ্য নেই, তাঁদের ছেলেমেয়ের আর লেখাপড়া শেখা হবে না, সে মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারবে না। আমরা “essential”, ওরা “not essential”। বিশ্বাস করুন, এখানে মেধার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির কোন ভূমিকা নেই।

সেলেব ভূত আর ঝরঝরে ভবিষ্যৎ

ভূশণ্ডীর মাঠটা ঠিক কোথায়? রাজশেখর লিখেছিলেন ওটা চাঁপদানির চটকল ছাড়িয়ে আরো দু তিন ক্রোশ। কিন্তু সে তো গত শতাব্দীর কথা। জনবিস্ফোরণ যেভাবে হয়েছে তাতে ঐ এলাকায় আর সে নির্জনতা কোথায়? এখন টলিউডটাই ভূশণ্ডীর মাঠ বলে সন্দেহ হয়

Bhobishyoter-Bhoot

“আমরা কিন্তু বাইজি নই”।

মাসখানেক আগের ঘটনা। চোখের জল সামলাতে সামলাতে কথাটা বলছেন বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। শুধু জনপ্রিয় নয়, সত্যিই বেশ ভাল গান করেন ভদ্রমহিলা, রবীন্দ্রনাথের গান এবং বাংলা ছায়াছবির গানে একইরকম সাবলীল, ইতিমধ্যে জাতীয় পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। এরকম একজন শিল্পী এ রাজ্যের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যশালী শহরের পৌরসভার অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে ফেরার পথে ফেসবুক লাইভ করে তিনি তাঁর বিপদের কথা ভক্তদের জানান। সেদিন পৌরসভারই কেষ্টবিষ্টু বলে যাদের মনে করা হয়েছিল, তাদের দাবী ছিল যেহেতু শিল্পীকে পয়সা দেওয়া হয়েছে গাইতে সেহেতু যতক্ষণ তাঁরা না বলছেন ততক্ষণ তিনি মঞ্চ ত্যাগ করতে পারবেন না। সেই ভিডিও দেখতে দেখতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল এটা কি পশ্চিমবঙ্গ? নাকি যে রাজ্যগুলোকে সংস্কৃতিহীন বলে আমরা বরাবর হেয় করে এসেছি, যেখানে মঞ্চে নাচতে নাচতে কোন পয়সাওয়ালা দর্শকের উল্লসিত গুলিবর্ষণে মৃত্যু হয় মহিলাদের, তেমন কোন রাজ্য? আমাদের রাজ্যে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা শিল্পী এত অপদস্থ হবেন আর আমরা নিজেদের সংস্কৃতিমান বলে দাবী করব? এটা যে প্রথম ঘটনা তাও নয়। কিছুদিন আগে আরেক মহিলা শিল্পীও কতকটা একইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন।

কিন্তু বীভৎসতা এটুকুই নয়। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়, এবং যদিও সেই শিল্পী সেখানে বলেছিলেন তিনি এই ব্যাপারটা ছেড়ে দেবেন না, যতদূর যাওয়া যায় ততদূর যাবেন, একদিন পরেই কিন্তু তিনি সংবাদমাধ্যমে তাঁর অভিযোগের অনেকটাই প্রত্যাহার করেন এবং বলেন উত্তেজনার বশে অনেক কথা বলে ফেলেছিলেন, লোকগুলোকে চিনতে তাঁর ভুল হয়ে থাকতে পারে, ইত্যাদি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আসলে তাঁকে চাপ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হল। কারা চাপ দিল? নিঃসন্দেহে সেই অদৃশ্য শক্তিই, যারা অনীক দত্তর ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছবিটাকে রাজ্যের রাজধানীর কোথাও এক দিনের বেশি চলতে দেয়নি।

“বিজেপি এসে যাবে” বলেই ভয় দেখান আর “অমুক আমলেও হয়েছিল, তমুক সময়েও হয়েছিল” বলে গুরুকে লঘু করার চেষ্টাই করুন, আমরা সবাই মনে মনে জানি এ রাজ্যে আমরা এক নিঃশব্দ সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করছি কয়েক বছর যাবৎ। এই সন্ত্রাসের চেহারা সবসময় দৃশ্যমান নয়, যাকে একেবারে দাঁত নখ বের করে তাড়া করে শুধু সে-ই স্পষ্ট দেখতে পায়। যেমন অম্বিকেশ মহাপাত্র পেয়েছিলেন বা শিলাদিত্য পেয়েছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে এই যে আড়াল থেকে ভয় দেখানো — একেই বলে আধা ফ্যাসিবাদ। পুরো ফ্যাসিবাদের সাথে এর তফাতটা ভবিষ্যতের ভূতের প্রতি যা করা হচ্ছে তার সাথে পদ্মাবতের প্রতি যা করা হয়েছিল তার তফাত। ব্যাপারটা সুন্দর বুঝিয়েছেন নট নাট্যকার কৌশিক সেন। বক্তৃতাটা এই শুনুন। সংক্ষেপে ব্যাপারটা এই যে যারা পদ্মাবত চলতে দেব না বলছিল তারা বুক ফুলিয়ে মারদাঙ্গা করে বলছিল। কেন চলতে দেবে না তাও পরিষ্কার বলছিল। আর যারা ভবিষ্যতের ভূতের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে তারা সেটা করছে শুধু ক্ষমতার ব্যবহার করেই, কোন কারণ না দর্শিয়েই। পর্দার পেছন থেকে। এই সন্ত্রাসের বলি কিন্তু আসলে আমরা সবাই। এই যে আমি এই লেখায় এখন পর্যন্ত সমানে নামোল্লেখ না করার চেষ্টা করে চলেছি সে তো সন্ত্রস্ত হয়েই। আমি, আপনি সকলেই জানি — শাসক দলের বা সে দলের মুখ্য ব্যক্তিটির নাম করতে নেই। তাদের হাতে পুলিশ আছে, পুলিশের চেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রও আছে।

এখন কথা হচ্ছে, হঠাৎ এতদিন পরে এসব কথা বলছি কেন? বলছি এইজন্যে যে রাজ্যের একটি দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়েছে। এবং হতেই প্রশংসায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। যে নেত্রী ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলেছিলেন, তিনি ৪১ শতাংশ মহিলা প্রার্থী ঘোষণা করে সহসা নারীবাদী তকমা পেয়ে গেছেন। সিমঁ দ্য বভোয়া বুঝি কবরে পাশ ফিরে শুলেন। বা হয়ত ভূশণ্ডীর মাঠে সুজেট জর্ডানের ভূতের সাথে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।

ভূশণ্ডীর মাঠটা ঠিক কোথায়? রাজশেখর লিখেছিলেন ওটা চাঁপদানির চটকল ছাড়িয়ে আরো দু তিন ক্রোশ। কিন্তু সে তো গত শতাব্দীর কথা। জনবিস্ফোরণ যেভাবে হয়েছে তাতে ঐ এলাকায় আর সে নির্জনতা কোথায়? এখন টলিউডটাই ভূশণ্ডীর মাঠ বলে সন্দেহ হয়। কারণ রাজ্যের অন্য অনেক শিল্পের মত বাংলা ছবিও তো এখন রুগ্ন শিল্প। টালিগঞ্জ পাড়ায় স্বাস্থ্যের এত অভাব যে কলাকুশলীরা দীর্ঘদিন টাকাপয়সা না পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কিছুদিন আগে। তাঁদের হয়ে আসরে নামতে হয় অশীতিপর প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা এবং মহানায়কের আসনের দাবীদার নায়ককে। যে প্রযোজক একচেটিয়া ব্যবসা খুলে বসেছিলেন তিনি আবার অধুনা বিচারাধীন বন্দি হিসাবে শ্রীঘরে। ফলে এখন ও পাড়ায় বাতি ধরবে কে? বোধহয় সমাপতন নয় যে গত এক দশকের সবচেয়ে বাজারসফল বাংলা ছবিদুটোর নাম ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ আর ‘বেলাশেষে’। ফলত “বেলা যে পড়ে এল জলকে চল” বলতে বলতে কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকা বাংলা ছবির নায়ক দেব গতবার রাজনীতির সাগরে সাঁতরাতে নেমেছিলেন। এবারে দুই নায়িকাও নেমে পড়লেন।

এঁদের প্রার্থী করার পেছনে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় থাক আর না-ই থাক, প্রার্থী হওয়ার পেছনে এঁদের পেশাগত বুদ্ধির পরিচয় বিলক্ষণ আছে। খবরের কাগজের রংচঙে ক্রোড়পত্র আপনাকে যা-ই বলুক, আসলে বাংলা ছবি কোথাও চলে না। চললে পত্রিকার বিজ্ঞাপনে যে নায়ককে সত্যজিৎ রায়ের সাথে এক ফ্রেমে ধরে ফেলা হয়েছে ফোটোশপের বদান্যতায়, তিনি সব ছেড়ে এম পি হতে চাইতেন না। বছর তিনেক আগে এক টিভি বিতর্কে অভিনেতা চিরঞ্জিতকে বলতে শুনেছিলাম, ‘হারানো সুর’ ছবির জন্য সুচিত্রা সেন যে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন, তা মুদ্রাস্ফীতির হার দিয়ে বিচার করলে আজ নাকি দু কোটি টাকা হয়। অথচ টালিগঞ্জের আজকের সবচেয়ে দামী অভিনেত্রীও (উনি তখন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেছিলেন) ঐ পারিশ্রমিকের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। অনেক ছবির বাজেটও অত হয় না। সুতরাং দেবই বলুন, মিমিই বলুন আর নুসরতই বলুন, তাঁদের রোজগারপাতি যা হয় তার অনেকটাই আসে আসলে গ্রামেগঞ্জে মঞ্চে হাত নেড়ে, হেসে, গেয়ে, নেচে। যাকে চলতি কথায় বলে মাচার অনুষ্ঠান। দুর্জনে বলে সেখানেও নাকি বাংলা ছবির অভিনেতা অভিনেত্রীদের টেক্কা দেন মেগা সিরিয়ালের লোকজনেরা। ফলত, একবার এম পি হতে পারলে পেনশনের যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, তার হাতছানিকে উপেক্ষা করবে কোন আহাম্মক?

বাংলা ছায়াছবির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। না এখানে সফল বাণিজ্যিক ছবি হচ্ছে, না ধারাবাহিকভাবে সমান্তরাল ধারার সৃজনশীল ছবি হচ্ছে। আলোর রেখাও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বামফ্রন্ট আমলে শোনা যেত রাজ্যের অন্য অনেককিছুর মত বাংলা ছবির অধঃপতনের জন্যেও নাকি বামফ্রন্ট সরকারই দায়ী। তারা আঁতেল লোকেদের জড়ো করে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে আদিখ্যেতা করে অথচ টালিগঞ্জ পাড়ার জন্যে কিছু করে না। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অমিতাভের ন্যাকা বাংলা আর শাহরুখের টোল ফেলা হাসি আমদানি করে, অতিরঞ্জিত কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে হর হর ব্যোম ব্যোম রব তুলেছিলেন। কলকাতার গণ্যমান্যরা ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই নাকি বাংলা ছবির ক্রমমুক্তি হবে। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুরা টালিগঞ্জকে পাত্তা দিতেন না। নতুন সরকার নাকি এমন পাত্তা দিলেন যে পরিচালক কজন টেকনিশিয়ান ব্যবহার করবেন তা তাঁর নিজের হাতে রইল না, বিদেশে আউটডোর শুটিঙের লাগামও পরিচালকের হাত থেকে গেল বেরিয়ে। সুমন মুখোপাধ্যায়ের মত অনেক গুণী লোক তিতিবিরক্ত হয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন।

অবশ্য হতেই পারে এসব নেহাত গুজব। কারণ টালিগঞ্জ পাড়ার তারকাদের তো এসব নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। তাঁরা সমস্ত সরকারী ও দরকারী অনুষ্ঠানে হাসিমুখে হাজির থাকেন। সে আই পি এল নিয়ে আদেখলেপনাই হোক আর বিবেকানন্দ জন্মোৎসবে মোচ্ছবই হোক। সি বি এফ সি র ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়া একটা বাংলা ছবিকে বাংলার রাজধানীতে চলতে দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়েও তো টালিগঞ্জের তারকাদের কোন উচ্চবাচ্য নেই। প্রার্থীদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, চিন্তা চেতনার অভাব নাহয় মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু তাঁদেরই ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাড়ে সর্বনাশ করা হচ্ছে দেখেও চুপ যাঁরা, তাঁরা নাকি সংসদে দাঁড়িয়ে আপামর জনসাধারণের হয়ে কথা বলবেন, তাঁদের প্রার্থী করে নাকি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়া হল।

এই দিবাস্বপ্ন দেখছেন এবং কোন এক দুর্বোধ্য আশাবাদে দেখাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের আন্তরিক অভিনন্দন। দেখতে থাকুন। সিনেমায় তো আর দেখার কিছু থাকছে না। স্বপ্নেই যা পারেন দেখে নিন।

টুপির আমি টুপির তুমি?

খেলোয়াড়রা বা দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক চাওয়া পাওয়া, ইতিহাস, ক্ষোভ, রাগ ইত্যাদি খেলার মাঠে প্রকাশ করে শাস্তি না পেলে মাঠে ক্রমশ রাজনীতিই হতে থাকবে, খেলা নয়।

২৬শে নভেম্বর ২০০৮। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা। হতাহতের সংখ্যা, আক্রমণের ব্যাপকতা, দৈর্ঘ্য — যেদিক দিয়েই বিচার করুন। সেই ঘটনার ঠিক দু সপ্তাহ পরে, এগারোই ডিসেম্বর, চেন্নাইয়ের এম এ চিদম্বরম স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের একটি টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়। গোটা ম্যাচে পিঠ দেওয়ালে ঠেকে থাকার পর, চতুর্থ দিন বিকেলে ৬৮ বলে ৮৩ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে বীরেন্দ্র সেওয়াগ ম্যাচ জেতার পথ খুলে দিয়ে যান। পঞ্চম দিন সকালে ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন, তখন দেশের নয়নমণি শচীন তেন্ডুলকর অপরাজিত শতরান করে ভারতীয় দলকে জেতান। খেলার পরে তিনি বলেন

What happened in Mumbai was extremely unfortunate and I don’t think by India winning or me scoring a hundred, people who have lost their loved ones will feel any better. It’s a terrible loss for all of them and our hearts are with them, but whatever manner we can contribute to making them feel better we’ll make that effort.

(www.telegraph.co.uk)

শোক প্রকাশে যে পরিমিতি জরুরী, তাঁর কথায় শুধু যে তা ছিল তা-ই নয়, ঐ কথাগুলোর মধ্যে এই উপলব্ধিও রয়েছে যে ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত একটা খেলাই, তার বেশি কিছু নয়। কোন জয়, কোন শতরান মানুষের মৃত্যুর ক্ষতি পূরণ করতে পারে না।

মাঝে এগারো বছর কেটে গেছে। “আশাটাও পণ্য এখন বাজার দরে / বিকোতে পারলে টাকা আসবে ঘরে।“ শুধু আশা নয়, শোকও এখন বিক্রয়যোগ্য। দেশপ্রেম তো বটেই।

তাই দেশসুদ্ধ দেশপ্রেমিকরা হাততালি দিলেন, হর্ষিত হলেন এই দেখে যে বিরাট কোহলি তাঁর দলবল নিয়ে ক্রিকেট মাঠে নামলেন সেনাবাহিনীর টুপি পরে, যে টুপিতে আবার বহুজাতিক ব্যবসায়িক সংস্থা নাইকির লোগো। অর্থাৎ ভারতীয় ক্রিকেটাররা পুলওয়ামার শহীদদের, সেনাবাহিনীর জওয়ানদের এত সম্মান করেন যে তাঁদের সম্মান জানানোর জন্যেও একটা দিন সেলসম্যান হওয়া বন্ধ রাখতে পারলেন না। স্পনসরের লোগো লাগানো টুপি যদ্দিন তৈরি হয়নি তদ্দিন ওঁরা শোকপালন স্থগিত রেখেছিলেন। পুলওয়ামায় হামলা হয়েছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। এমন নয় যে তারপর থেকে ভারতীয় দল আর মাঠে নামেনি। অথচ শহীদদের সম্মানে একটা ম্যাচের ফি দিয়ে দেব, জওয়ানদের মত ক্যামোফ্লাজ টুপি পরব — এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ধোনি, কোহলির মত বিরাট দেশপ্রেমিকদের লেগে গেল প্রায় এক মাস। আচ্ছা, সিদ্ধান্তটা এমন হল না কেন যে এই দিনটায় যেহেতু সেনাবাহিনীর টুপি পরছি, সেহেতু আমাদের জামা, জুতো, টুপি, ব্যাট, প্যাড কোত্থাও কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লোগো থাকবে না? যাঁরা জীবন দিলেন তাঁদের জন্যে এটুকু ত্যাগ করতে পারি না, অথচ দেশপ্রেম আমার উপচে পড়ছে? দেশ ভর্তি দেশপ্রেমিক বলিউড তারকা, রাজনীতিবিদ, খোদ প্রধানমন্ত্রী, তাঁর আই টি সেল — সকলে কী করে মেনে নিলেন সেনাবাহিনীর টুপির এই বেসাতি? এরপর তো কোনদিন দেখব তেরঙার মাঝখানে অশোকচক্রের পাশে জিও লোগো। দেশপ্রেমিকরা মেনে নেবেন তো? অবশ্য এতে আপত্তির আছেটাই বা কী? লালকেল্লা তো ইতিমধ্যেই ডালমিয়া রেড ফোর্ট। দেশপ্রেম তো শুধু বিরোধী কণ্ঠ রোধ করার সময়ে পবিত্র, ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে।

ক্রিকেটাররা নিজেদের এক দিনের বেতন দিয়ে দিলেন জাতীয় নিরাপত্তা তহবিলে। চমৎকার খবর। গত বছর কেরালায় ভয়াবহ বন্যা হল, সচরাচর এত বড় বন্যা হয় না। তখন ক্রিকেটাররা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কদিনের বেতন দিয়েছিলেন মনে করতে পারছি না। আমার মত দেশদ্রোহীরা অবশ্য দেশের ভাল কাজ দেখতে পান না। দেশপ্রেমিকরা কেউ মনে করিয়ে দিলে ভাল হয়। অবশ্য ত্রাণ তহবিলে দান ঠিক ফোটোজিনিক নয়। নিহত জওয়ানদের স্ত্রীরা যা-ই বলুন না কেন, সেনাবাহিনীর নাম করে কিছু করার মধ্যে যে মাচোপনা আছে বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার মধ্যে তা কোথায়?
তাছাড়া ক্রিকেটারদের মাথায় তুলতে তুলতে আমরা যে কৈলাসে তুলেছি, সেখানে বসে গঞ্জিকা সেবন না করেও তাঁদের মনে হতেই পারে ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, তাঁরাও নেহাত খেলোয়াড় নন। সকলেই সাক্ষাৎ যোদ্ধা একেকজন। বিরাট ভাবতেই পারেন তাঁর ব্যাটটা এক্কেবারে এ কে ৪৭, ধোনির হেলিকপ্টার শটে চাপিয়ে অভিনন্দন বর্তমানকে পাঠানো হলে তিনি পাক সেনার হাতে ধরা পড়তেন না। ভারতীয় দলের ক্রিকেটাররা যে নিজেদের দেবতা গন্ধর্ব বলে মনে করেন তা তো আমরা দেখেছিই কিছুদিন আগে, যখন দুই তরুণ ক্রিকেটার নিজেদের কার্তিক আর কেষ্ট জ্ঞানে টেলিভিশনের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানে বসে লীলা বর্ণনা করছিলেন। অতএব সেনাবাহিনীর জীবন নিংড়ে নেওয়া ট্রেনিং না নিয়েও, মাসের পর মাস সমস্ত শারীরিক, মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে কাজ না করেও যদি ক্রিকেটাররা মনে করেন তাঁরা আর্মি ক্যাপ পরার যোগ্য, তাঁদের ঠেকাবে কে? “সিয়াচেনে আমাদের জওয়ানরা লড়ছে” বলে যাঁরা সমালোচনার মুখ বন্ধ করেন, নিরীহ লোককে ঠ্যাঙান বা ভোট ভিক্ষা করেন — বিরাটবাহিনীর এই ধ্যাষ্টামোতে তাঁদের আহ্লাদ প্রমাণ করে সত্যিকারের জওয়ানদের প্রতি এঁদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই।

বিরাট কোহলি আজ নিজেকে সৈনিক ভেবে আমোদিত হচ্ছেন, তাঁর ব্যর্থতা এবং তাঁর দলের ব্যর্থতাকে যেদিন দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর পরাজয়ের মতই মরণবাঁচন সমস্যা মনে করবেন, সেদিন কিন্তু হেরে গেলে গালিগালাজ, মারধোর, বাড়িতে ইঁট পড়া — কোনটাকেই অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ খেলা যে শুধু খেলা নয়, ভারতীয় ক্রিকেট দল যে সেনাবাহিনীর মতই দেশরক্ষার কাজে নিযুক্ত সেটা বিরাটরা নিজেরাই তো প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছেন। ইতালিতে বিয়ে করতে যাওয়া যায়, সেই সঙ্কটে ওখানে ক্রিকেট খেলতে চলে গেলে লাভ হবে তো?

এসব কেনা বেচার বাইরেও অবশ্য কালকের দিনটা অন্য এক বিপদের জন্ম দিয়ে গেল। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল ভারতীয় ক্রিকেট সংস্থার কাছে কাঞ্চনমূল্যে আত্মবিক্রীত। তাদের ঠুঁটোপনার কারণেই সম্ভবত খেলার মাঠে সামরিক তথা রাজনৈতিক প্রতীকের প্রবেশ অনুমতি পেয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন খেলায় এ ঘটনা ঘটতে দেওয়া হবে বলে মনে হয় না। কারণ খেলার মাঠকে রাজনৈতিক, সামরিক বিষয়ে মত প্রকাশের মঞ্চ হয়ে উঠতে দিলে খেলাধুলোর রক্তাক্ত শত্রুতা হয়ে উঠতে বিশেষ সময় লাগবে না।

ফুটবলপ্রেমীদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত ফুটবল বিশ্বকাপে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে গোল করার পর আলবানিয়ার পতাকায় যে দুমুখো ঈগল থাকে সেটার সম্পর্কে ইঙ্গিত করায় ফিফা সুইজারল্যান্ডের গ্রানিত ঝাকা আর ঝেরদান শাকিরিকে জরিমানা দিতে বাধ্য করেছিল। ঐ দুজনের উদ্বাস্তু জীবন, একজনের বাবার পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ায় নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাসের কারণে বিশ্বজুড়ে এই সিদ্ধান্তের জন্যে ফিফা সমালোচিতও হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, খেলোয়াড়রা বা দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক চাওয়া পাওয়া, ইতিহাস, ক্ষোভ, রাগ ইত্যাদি খেলার মাঠে প্রকাশ করে শাস্তি না পেলে মাঠে ক্রমশ রাজনীতিই হতে থাকবে, খেলা নয়। ক্রিকেটে সেই সম্ভাবনা গতকাল তৈরি হয়ে গেল। এরপর ভারত বনাম শ্রীলঙ্কার খেলায় যদি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা রাজীব গান্ধী প্রেরিত শান্তি বাহিনীর হাতে নিহতদের স্মৃতিতে লুঙ্গি ছাপ টুপি পরে খেলতে চায় আই সি সি না বলবে কোন যুক্তিতে? এই কষ্টকল্পনারও প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের খেলায় যদি বাংলাদেশ দল পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গণহত্যায় মৃতদের স্মরণে দেখতে রক্তের ছিটের মত এমন নকশার জার্সি পরতে চায়, আটকানো হবে কোন যুক্তিতে? রাজনীতি খেলার অ্যাজেন্ডা নির্ধারণ করতে শুরু করলে অচিরেই খেলা রাজনীতির অ্যাজেন্ডা নির্ধারণ করবে। সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়। হন্ডুরাস আর এল সালভাদোরের যুদ্ধ লেগেছিল সামান্য একটা ফুটবল ম্যাচ নিয়ে। আমরা আধুনিক রাষ্ট্রের মানুষ নিশ্চয়ই এই ধ্বংসাত্মক ছেলেমানুষীর পুনরাবৃত্তি চাইব না।

শেষে একটা কথা বলার আছে। অনেকেই বলেন, খেলা কি তার পারিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন? খেলাধুলোর ইতিহাসে কখনো কি রাজনীতি ঢুকে পড়েনি? বিশ্বকাপ ফুটবলে আমরা কাকে সমর্থন করছি তার পেছনে কি রাজনীতি থাকে না কখনোই?

সত্যি কথা। খেলা বা খেলোয়াড় তার চারপাশ বাদ দিয়ে নয়। বিশ্বকাপ ফুটবলে আমাদের সমর্থনও প্রায়শই রাজনৈতিক কারণে হয়। খেলাধুলোর ইতিহাসেও বহু রাজনৈতিক ঘটনার পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে।

কিন্তু এই আলোচনায় আমাদের সমর্থনের প্রশ্নটা প্রথমেই বাদ দিতে হবে। কারণ মাঠ থেকে বহু দূরে থাকা সমর্থকের রাজনৈতিক বা সামাজিক পছন্দ অপছন্দ খেলায় প্রভাব ফ্যালে না। যাঁরা মাঠে থাকেন তাঁদের ব্যবহার নিঃসন্দেহে প্রভাব ফ্যালে। সেই কারণেই তাঁদের ব্যবহারেরও নিয়মকানুন আছে। সে নিয়ম ভাঙলে তাঁরা যে ক্লাবকে বা দেশকে সমর্থন করেন তাদের শাস্তি দেওয়ার নিয়মও আছে প্রায় সব খেলাতে। সেই কারণেই চেলসি সমর্থকরা বর্ণবিদ্বেষী গালাগালি দিলে চেলসি পার পায় না।

এবার খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গে আসা যাক। রাজনৈতিক বিবৃতির কতকগুলো অবিস্মরণীয়, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খেলার মাঠে আছে। কিন্তু সেই বিবৃতি এসেছে খেলার মধ্যে দিয়েই, আক্রমণাত্মক সামরিক পোশাকের মধ্যে দিয়ে নয়। আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃষ্টান্তটা দিয়ে শেষ করি।

বার্লিন অলিম্পিক, ১৯৩৬। অ্যাডলফ হিটলার ভেবেছিল আর্য রক্তের বিশুদ্ধতা প্রমাণের সবচেয়ে বড় মঞ্চ তৈরি করবে অলিম্পিকটাকে। অথচ তার নাজি গর্ব গুঁড়িয়ে গিয়েছিল একজন কালো মানুষের পায়ের তলায়। তাঁর নাম জেসি আওয়েন্স। নাজিবাদকে খেলার মাঠে হারিয়ে দিয়েছিল চারটে সোনার মেডেল। মার্কিন সেনাবাহিনীর পোশাক নয়।

ঐ অলিম্পিকেই হকি ফাইনালে হিটলারের জার্মানিকে ভানুমতীর খেল কাকে বলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এক ভারতীয়। তাঁর নাম ধ্যানচাঁদ। পরাধীন দেশের কালো চামড়ার লোকেদের দলের কাছে সেদিন আট গোল খেয়েছিল হিটলারের আর্য রক্তের বীরপুঙ্গবরা। শোনা যায় হিটলার নাকি ধ্যানচাঁদকে জার্মানিতে রেখে দিতে চেয়েছিল৷ হকির জাদুকর পাত্তা দেননি। তাঁর কিন্তু শস্তার জার্সি ছাড়া কিচ্ছু ছিল না।