“আমরা কিন্তু বাইজি নই”।
মাসখানেক আগের ঘটনা। চোখের জল সামলাতে সামলাতে কথাটা বলছেন বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। শুধু জনপ্রিয় নয়, সত্যিই বেশ ভাল গান করেন ভদ্রমহিলা, রবীন্দ্রনাথের গান এবং বাংলা ছায়াছবির গানে একইরকম সাবলীল, ইতিমধ্যে জাতীয় পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। এরকম একজন শিল্পী এ রাজ্যের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যশালী শহরের পৌরসভার অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে ফেরার পথে ফেসবুক লাইভ করে তিনি তাঁর বিপদের কথা ভক্তদের জানান। সেদিন পৌরসভারই কেষ্টবিষ্টু বলে যাদের মনে করা হয়েছিল, তাদের দাবী ছিল যেহেতু শিল্পীকে পয়সা দেওয়া হয়েছে গাইতে সেহেতু যতক্ষণ তাঁরা না বলছেন ততক্ষণ তিনি মঞ্চ ত্যাগ করতে পারবেন না। সেই ভিডিও দেখতে দেখতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল এটা কি পশ্চিমবঙ্গ? নাকি যে রাজ্যগুলোকে সংস্কৃতিহীন বলে আমরা বরাবর হেয় করে এসেছি, যেখানে মঞ্চে নাচতে নাচতে কোন পয়সাওয়ালা দর্শকের উল্লসিত গুলিবর্ষণে মৃত্যু হয় মহিলাদের, তেমন কোন রাজ্য? আমাদের রাজ্যে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা শিল্পী এত অপদস্থ হবেন আর আমরা নিজেদের সংস্কৃতিমান বলে দাবী করব? এটা যে প্রথম ঘটনা তাও নয়। কিছুদিন আগে আরেক মহিলা শিল্পীও কতকটা একইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন।
কিন্তু বীভৎসতা এটুকুই নয়। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়, এবং যদিও সেই শিল্পী সেখানে বলেছিলেন তিনি এই ব্যাপারটা ছেড়ে দেবেন না, যতদূর যাওয়া যায় ততদূর যাবেন, একদিন পরেই কিন্তু তিনি সংবাদমাধ্যমে তাঁর অভিযোগের অনেকটাই প্রত্যাহার করেন এবং বলেন উত্তেজনার বশে অনেক কথা বলে ফেলেছিলেন, লোকগুলোকে চিনতে তাঁর ভুল হয়ে থাকতে পারে, ইত্যাদি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আসলে তাঁকে চাপ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হল। কারা চাপ দিল? নিঃসন্দেহে সেই অদৃশ্য শক্তিই, যারা অনীক দত্তর ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছবিটাকে রাজ্যের রাজধানীর কোথাও এক দিনের বেশি চলতে দেয়নি।
“বিজেপি এসে যাবে” বলেই ভয় দেখান আর “অমুক আমলেও হয়েছিল, তমুক সময়েও হয়েছিল” বলে গুরুকে লঘু করার চেষ্টাই করুন, আমরা সবাই মনে মনে জানি এ রাজ্যে আমরা এক নিঃশব্দ সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করছি কয়েক বছর যাবৎ। এই সন্ত্রাসের চেহারা সবসময় দৃশ্যমান নয়, যাকে একেবারে দাঁত নখ বের করে তাড়া করে শুধু সে-ই স্পষ্ট দেখতে পায়। যেমন অম্বিকেশ মহাপাত্র পেয়েছিলেন বা শিলাদিত্য পেয়েছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে এই যে আড়াল থেকে ভয় দেখানো — একেই বলে আধা ফ্যাসিবাদ। পুরো ফ্যাসিবাদের সাথে এর তফাতটা ভবিষ্যতের ভূতের প্রতি যা করা হচ্ছে তার সাথে পদ্মাবতের প্রতি যা করা হয়েছিল তার তফাত। ব্যাপারটা সুন্দর বুঝিয়েছেন নট নাট্যকার কৌশিক সেন। বক্তৃতাটা এই শুনুন। সংক্ষেপে ব্যাপারটা এই যে যারা পদ্মাবত চলতে দেব না বলছিল তারা বুক ফুলিয়ে মারদাঙ্গা করে বলছিল। কেন চলতে দেবে না তাও পরিষ্কার বলছিল। আর যারা ভবিষ্যতের ভূতের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে তারা সেটা করছে শুধু ক্ষমতার ব্যবহার করেই, কোন কারণ না দর্শিয়েই। পর্দার পেছন থেকে। এই সন্ত্রাসের বলি কিন্তু আসলে আমরা সবাই। এই যে আমি এই লেখায় এখন পর্যন্ত সমানে নামোল্লেখ না করার চেষ্টা করে চলেছি সে তো সন্ত্রস্ত হয়েই। আমি, আপনি সকলেই জানি — শাসক দলের বা সে দলের মুখ্য ব্যক্তিটির নাম করতে নেই। তাদের হাতে পুলিশ আছে, পুলিশের চেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রও আছে।
এখন কথা হচ্ছে, হঠাৎ এতদিন পরে এসব কথা বলছি কেন? বলছি এইজন্যে যে রাজ্যের একটি দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়েছে। এবং হতেই প্রশংসায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। যে নেত্রী ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলেছিলেন, তিনি ৪১ শতাংশ মহিলা প্রার্থী ঘোষণা করে সহসা নারীবাদী তকমা পেয়ে গেছেন। সিমঁ দ্য বভোয়া বুঝি কবরে পাশ ফিরে শুলেন। বা হয়ত ভূশণ্ডীর মাঠে সুজেট জর্ডানের ভূতের সাথে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।
ভূশণ্ডীর মাঠটা ঠিক কোথায়? রাজশেখর লিখেছিলেন ওটা চাঁপদানির চটকল ছাড়িয়ে আরো দু তিন ক্রোশ। কিন্তু সে তো গত শতাব্দীর কথা। জনবিস্ফোরণ যেভাবে হয়েছে তাতে ঐ এলাকায় আর সে নির্জনতা কোথায়? এখন টলিউডটাই ভূশণ্ডীর মাঠ বলে সন্দেহ হয়। কারণ রাজ্যের অন্য অনেক শিল্পের মত বাংলা ছবিও তো এখন রুগ্ন শিল্প। টালিগঞ্জ পাড়ায় স্বাস্থ্যের এত অভাব যে কলাকুশলীরা দীর্ঘদিন টাকাপয়সা না পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কিছুদিন আগে। তাঁদের হয়ে আসরে নামতে হয় অশীতিপর প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা এবং মহানায়কের আসনের দাবীদার নায়ককে। যে প্রযোজক একচেটিয়া ব্যবসা খুলে বসেছিলেন তিনি আবার অধুনা বিচারাধীন বন্দি হিসাবে শ্রীঘরে। ফলে এখন ও পাড়ায় বাতি ধরবে কে? বোধহয় সমাপতন নয় যে গত এক দশকের সবচেয়ে বাজারসফল বাংলা ছবিদুটোর নাম ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ আর ‘বেলাশেষে’। ফলত “বেলা যে পড়ে এল জলকে চল” বলতে বলতে কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকা বাংলা ছবির নায়ক দেব গতবার রাজনীতির সাগরে সাঁতরাতে নেমেছিলেন। এবারে দুই নায়িকাও নেমে পড়লেন।
এঁদের প্রার্থী করার পেছনে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় থাক আর না-ই থাক, প্রার্থী হওয়ার পেছনে এঁদের পেশাগত বুদ্ধির পরিচয় বিলক্ষণ আছে। খবরের কাগজের রংচঙে ক্রোড়পত্র আপনাকে যা-ই বলুক, আসলে বাংলা ছবি কোথাও চলে না। চললে পত্রিকার বিজ্ঞাপনে যে নায়ককে সত্যজিৎ রায়ের সাথে এক ফ্রেমে ধরে ফেলা হয়েছে ফোটোশপের বদান্যতায়, তিনি সব ছেড়ে এম পি হতে চাইতেন না। বছর তিনেক আগে এক টিভি বিতর্কে অভিনেতা চিরঞ্জিতকে বলতে শুনেছিলাম, ‘হারানো সুর’ ছবির জন্য সুচিত্রা সেন যে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন, তা মুদ্রাস্ফীতির হার দিয়ে বিচার করলে আজ নাকি দু কোটি টাকা হয়। অথচ টালিগঞ্জের আজকের সবচেয়ে দামী অভিনেত্রীও (উনি তখন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেছিলেন) ঐ পারিশ্রমিকের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। অনেক ছবির বাজেটও অত হয় না। সুতরাং দেবই বলুন, মিমিই বলুন আর নুসরতই বলুন, তাঁদের রোজগারপাতি যা হয় তার অনেকটাই আসে আসলে গ্রামেগঞ্জে মঞ্চে হাত নেড়ে, হেসে, গেয়ে, নেচে। যাকে চলতি কথায় বলে মাচার অনুষ্ঠান। দুর্জনে বলে সেখানেও নাকি বাংলা ছবির অভিনেতা অভিনেত্রীদের টেক্কা দেন মেগা সিরিয়ালের লোকজনেরা। ফলত, একবার এম পি হতে পারলে পেনশনের যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, তার হাতছানিকে উপেক্ষা করবে কোন আহাম্মক?
বাংলা ছায়াছবির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। না এখানে সফল বাণিজ্যিক ছবি হচ্ছে, না ধারাবাহিকভাবে সমান্তরাল ধারার সৃজনশীল ছবি হচ্ছে। আলোর রেখাও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বামফ্রন্ট আমলে শোনা যেত রাজ্যের অন্য অনেককিছুর মত বাংলা ছবির অধঃপতনের জন্যেও নাকি বামফ্রন্ট সরকারই দায়ী। তারা আঁতেল লোকেদের জড়ো করে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে আদিখ্যেতা করে অথচ টালিগঞ্জ পাড়ার জন্যে কিছু করে না। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অমিতাভের ন্যাকা বাংলা আর শাহরুখের টোল ফেলা হাসি আমদানি করে, অতিরঞ্জিত কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে হর হর ব্যোম ব্যোম রব তুলেছিলেন। কলকাতার গণ্যমান্যরা ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই নাকি বাংলা ছবির ক্রমমুক্তি হবে। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুরা টালিগঞ্জকে পাত্তা দিতেন না। নতুন সরকার নাকি এমন পাত্তা দিলেন যে পরিচালক কজন টেকনিশিয়ান ব্যবহার করবেন তা তাঁর নিজের হাতে রইল না, বিদেশে আউটডোর শুটিঙের লাগামও পরিচালকের হাত থেকে গেল বেরিয়ে। সুমন মুখোপাধ্যায়ের মত অনেক গুণী লোক তিতিবিরক্ত হয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন।
অবশ্য হতেই পারে এসব নেহাত গুজব। কারণ টালিগঞ্জ পাড়ার তারকাদের তো এসব নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। তাঁরা সমস্ত সরকারী ও দরকারী অনুষ্ঠানে হাসিমুখে হাজির থাকেন। সে আই পি এল নিয়ে আদেখলেপনাই হোক আর বিবেকানন্দ জন্মোৎসবে মোচ্ছবই হোক। সি বি এফ সি র ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়া একটা বাংলা ছবিকে বাংলার রাজধানীতে চলতে দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়েও তো টালিগঞ্জের তারকাদের কোন উচ্চবাচ্য নেই। প্রার্থীদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, চিন্তা চেতনার অভাব নাহয় মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু তাঁদেরই ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাড়ে সর্বনাশ করা হচ্ছে দেখেও চুপ যাঁরা, তাঁরা নাকি সংসদে দাঁড়িয়ে আপামর জনসাধারণের হয়ে কথা বলবেন, তাঁদের প্রার্থী করে নাকি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়া হল।
এই দিবাস্বপ্ন দেখছেন এবং কোন এক দুর্বোধ্য আশাবাদে দেখাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের আন্তরিক অভিনন্দন। দেখতে থাকুন। সিনেমায় তো আর দেখার কিছু থাকছে না। স্বপ্নেই যা পারেন দেখে নিন।
বাস্তবচিত বিশ্লেষণ।