পঞ্চায়েত নির্বাচন: আমাকে ভাবায় শাহরুখ আর সুকুমার রায়

এমনি এমনি কি আর কবীর সুমন সুকুমারকে প্রফেট বলেছেন? তিনি লাগসই করে সবই লিখে রেখে গেছেন, এক-আধটা শব্দ এদিক ওদিক করে দিলেই আজকের জন্যে আর নতুন করে কবিতা লিখতে হয় না।

পশ্চিমবঙ্গে আমার মত ভদ্রলোকেদের কাজ হচ্ছে ভোটের দিন মারামারি খুনোখুনি হলে “কোথায় চলেছি আমরা!”, “এই হিংসার কি কোনো শেষ নেই?”, “এই মৃত্যুগুলোর দায়িত্ব সব দলকে নিতে হবে”, “এতগুলো মায়ের কোল খালি হয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেবে কে?”, “এভাবে ভোট করার কী দরকার?”, “দলহীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করা উচিত”, “আর কোনো রাজ্যে এভাবে ভোট হয় না। দেশের কাছে পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট হয়ে গেল” ইত্যাদি বিশুদ্ধ বাংলা বাক্য ব্যবহার করা। শেক্সপিয়র আর শঙ্খ ঘোষ উদ্ধৃত করা। সম্পূর্ণ ভদ্রলোকচালিত বাংলার সংবাদমাধ্যম স্বভাবতই একই কাজ করে। কিন্তু ভোটের ফল বেরিয়ে গেলেই আমাদের বাংলার শব্দভাণ্ডার নেহাত অপর্যাপ্ত বোধ হয়। তখন আমাদের ছেলেবেলার আমীর খানের হিট ছবির শরণ নিতে হয় – জো জিতা উয়ো হি সিকন্দর। এমনটাই চিরকাল দেখে আসছি। তবে এবার ভোটগণনার দিনে যা দেখলাম, তাতে বিনীতভাবে সকলকে অনুরোধ করছি, নিজেদের একটু আপডেট করুন।

আমীর ইতিমধ্যে বুড়িয়ে গেছেন। পুরনো লোকেরা এখনো গল্প শোনান, বাহাত্তরের ভোট কীরকম ভয়ঙ্কর হয়েছিল। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেল সদ্য, এখনো অত পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটলে হবে? বাঙালিদের অতীতচারী জাতি হিসাবে বিস্তর বদনাম। সে বদনাম ঘোচানোর সুযোগ এবারের নির্বাচন পর্ব আমাদের দিয়েছে। এবারের ভোটের ফলকে বর্ণনা করুন বাজিগর ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ দিয়ে “হার কর জিতনেওয়ালে কো বাজিগর কহতে হ্যাঁয়।” রাজ্যের প্রাক্তন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেখুন চারদিকে বাজিগরের ছড়াছড়ি। বিরোধী দলের প্রার্থীরা জিতেও হেরে যাচ্ছেন, শাসক দলের প্রার্থীরা হেরেও জিতে যাচ্ছেন। টিভি খুলে চ্যানেল ঘুরিয়ে গেলে দেখা যাচ্ছে কোথাও জয়ী প্রার্থী জয়ের শংসাপত্র নিতে গেলে তাঁকে বলা হচ্ছে “আপনি তো হেরে গেছেন”; কোথাও আবার শাসক দলের প্রার্থী হেরে যাচ্ছেন দেখে তাঁর এজেন্ট গণনাকেন্দ্র থেকে ব্যালট তুলে নিয়ে সোজা চম্পট দিচ্ছেন। কোথাও আবার কয়েক ভোটে হেরে যাওয়া প্রার্থী বিপক্ষের ভোট পাওয়া কিছু ব্যালট তুলে নিয়ে কচমচিয়ে খেয়ে ফেলে ফের গণনা করাচ্ছেন। গণনার তত্ত্বাবধানে থাকা আধিকারিকরা সে গণনা হতেও দিচ্ছেন, তারপর জেতা প্রার্থী হেরে যাচ্ছেন, হারা প্রার্থী জিতে যাচ্ছেন। কোথাও আবার বিরোধীদের ভোট পাওয়া ব্যালটের ডানা গজাচ্ছে। তারা জানলা দিয়ে গণনাকেন্দ্রের বাইরে এসে পড়ে এদিকে ওদিকে নালা নর্দমায় ভিড় জমাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো যে একেবারে রুচিহীন এবং তাদের যারা ভোট দেয় তারাও যে রুচিহীন তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ হয় না। উড়ে গিয়ে জুড়ে বসার কি আর জায়গা নেই? নর্দমায় বসতে হবে? এর প্রতিবাদে কোনো শিল্পীর একটা কাক সিরিজ আঁকা উচিত, যেখানে দেখা যাবে কাকেরা ব্যালট খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখছে।

খাওয়া বলতে মনে পড়ল। সুকুমার রায় ‘খাই খাই’ বলে অত লম্বা একখানা কবিতা লিখলেন, তাতে নানাবিধ খাওয়ার মধ্যে যুদ্ধে যে গুলি খায় তার কথা পর্যন্ত লিখলেন, ব্যালট খাওয়ার কথাটাই লিখলেন না? তাঁর সময়ে কি ব্যালট খাওয়া চালু ছিল না? সত্যজিৎ রায় ধরণীর বাসিন্দা সুকুমারের পৌত্র সন্দীপের থেকে এ বিষয়ে অবিলম্বে বাইট নেওয়া উচিত কোনো চ্যানেলের। সুকুমার যদি নাও লিখে থাকেন, অবিলম্বে সম্পাদনা করে ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত। উন্নয়নের ধাক্কায় ইতিহাস বদলে যেতে পারে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের রাশ রানি রাসমণির হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, আর কবিতার কটা লাইন বদলাতে পারে না? আমাদের কবি মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় লিখে দিলেই হয়

খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে –
খাওয়াব ব্যালট খাওয়া, ভোট কয় যাহারে।

এমনি এমনি কি আর কবীর সুমন সুকুমারকে প্রফেট বলেছেন? তিনি লাগসই করে সবই লিখে রেখে গেছেন, এক-আধটা শব্দ এদিক ওদিক করে দিলেই আজকের জন্যে আর নতুন করে কবিতা লিখতে হয় না। এই সুবিধাটা আজকের সদাব্যস্ত কবিরা কেন নেন না বুঝি না। তাঁরা তো সুকুমারের মত নিষ্কর্মা নন, তাঁদের তো অনেক দায়িত্ব। এই কমিটি সেই কমিটির দায়িত্ব সামলানো, নতুন নতুন পুরস্কার তৈরি করা, সিনেমার গান লেখা, সিনেমায় অভিনয় করা, সিনেমা বানানো, সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে কোন ঘটনাটা (অবশ্যই ‘অরাজনৈতিক’ ঘটনা) ট্রেন্ডিং তা খেয়াল করে সেই নিয়ে পোস্ট করা, প্রয়াত বিখ্যাতদের কবে কার জন্মদিন আর কে কবে মারা গেলেন সেসব খেয়াল রাখা – এতসব কাজ করে নতুন কবিতা লেখা কি কম ঝক্কির? তার চেয়ে সুকুমারকে ব্যবহার করলেই হয়। না, এতে আমার কোনো স্বার্থ নেই। কবিতা এবং কবিরা আমার খুব পছন্দের, অনেক বাঙালিরই পছন্দের। ছোটবেলায় কবি হতে চায়নি এমন ভদ্রলোক বাঙালি কজনই বা আছে? তাই কবিদের ভার লাঘব করতে পারলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করব। সেই উদ্দেশ্যে বললাম আর কি।

আরও পড়ুন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হলে ক্ষতি নেই বিজেপির

এমনিতে আর পাঁচজন ভদ্রলোকের মত আমিও নেহাতই ছাপোষা নিরীহ লোক। আমিও উন্নয়নের পক্ষে। আমার মোটা চশমা দেখে কেউ কেউ ভুল করে মাস্টারমশাই বলে বটে, কিন্তু আমি তো আর সত্যি সত্যি মাস্টারমশাই নই। সুতরাং আমাকে কারোর বলে দিতে হবে না “আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি, মাস্টারমশাই।” আমি এমনিতেই চারপাশে যা হয় তার অনেককিছু দেখতে পাই না। চোখের পাতা আছে বন্ধ করার জন্যে, নইলে তো সৃষ্টিকর্তা ও জিনিসটা মানুষকে দিতেনই না। আমি সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে থাকি। তবে কিনা ভোটে রিগিং-টিগিং হলে চোখ বন্ধ করে নেওয়ার অভ্যাস ছিল, গণনার দিনও যে অনেককিছু দেখতে নেই সেটা জানা হয়নি এই ধেড়ে বয়সেও। তাই কিছু কিছু জিনিস চোখে পড়ে গেছে। সে কি আর আমার দোষ? সে হল চোখের দোষ। অন্যের চোখ হলে গেলে দিতাম একেবারে। উন্নয়ন না দেখে কেবল শকুনের মত ভাগাড় দেখা! অমন চোখ থাকার থেকে না থাকা ভাল।

একটাই অসুবিধা। হচ্ছে কী, এত আবর্জনা জমে গিয়ে এত বড় এলাকা জুড়ে গেছে যে উঁচু করে ফেন্সিং দিলেও চোখে পড়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু মনে করবেন না। সবটাই অভ্যাসের ব্যাপার। এও ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে। লেখাপড়া জানা ভদ্রলোক বলে কথা, আমাকে জব্দ করা অত সোজা নয়। অভ্যাস করে উঠতে পারে না গণ্ডগ্রামের অশিক্ষিত লোকগুলো, তাই তারা লড়ালড়ি করতে গিয়ে মরে। বাড়িতে চোর ঢুকলে চেঁচামেচি না করে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকাই যে সঠিক পথ সেটা ওই গোঁয়ারদের বোঝাবে কে? যা নিবি নিয়ে যা বাপু, মারামারিতে কাজ নেই। কারণ যুগ যতই বদলাক, সার কথাটি বদলায় না। সেটি কিন্তু ওই “জো জিতা উয়ো হি সিকন্দর”।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

বাংলার কূপমণ্ডূক হাসি

বাঙালি বিদূষকদের সেই মেধা নেই, সেই সাহস নেই — যা থাকলে ভাঁড় মোসাহেব হয়ে থাকেন না, বিদূষক হয়ে ওঠেন।

দুটো বিপরীতার্থক শব্দ নিয়ে বাঙালির দুই আইকন বিস্তর ভাবনা চিন্তা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ “বিশ্বনাগরিক” শব্দটা আমাদের দিয়েছেন, আর সত্যজিৎ রায় তাঁর সারাজীবনের কাজে সিধু জ্যাঠা, প্রফেসর শঙ্কুর মত বিশ্বনাগরিককে আঁকার পর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ পর্যটক মনমোহনের মাধ্যমে “কূপমণ্ডূক” হতে বারণ করেছেন। বাঙালি নিজেকে বিশ্বনাগরিক বলে পরিচয় দিতে বিলক্ষণ ভালবাসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যত দিন যাচ্ছে, তার মধ্যে কূপমণ্ডূকতার লক্ষণগুলোই প্রকট হতে দেখা যাচ্ছে। বাঙালির সংস্কৃতি নিয়েও গর্বের শেষ নেই। সংস্কৃতি প্রায় নির্বাচনী ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেকের ধারণা কালচার শব্দটা বাংলাই। সেই কালচারেই আপাদমস্তক কূপমণ্ডূকতা দেখা যাচ্ছে। গোপালকৃষ্ণ গোখেল দেড়শো বছর আগে বলেছিলেন আজ বাংলা যা ভাবে, কাল ভারত তাই ভাবে। তা নিয়ে আমরা আজও গর্ব করি। অথচ এখন শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা — সবেতেই ভারত আজ যা ভাবছে, বাংলা আগামী পরশুও ভেবে উঠতে পারবে বলে ভরসা হচ্ছে না।

গুরুগম্ভীর ব্যাপার বাদ দিয়ে হাসি তামাশা নিয়েই আলোচনা করা যাক। হাতে হাতে স্মার্টফোন আর শস্তা ইন্টারনেটের কারণে এখন অ্যামাজন, নেটফ্লিক্সের মত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আর ইউটিউবের রমরমা। এসবে বিনোদন বলতে শুধু সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ বোঝায় না, স্ট্যান্ড আপ কমেডিও বোঝায়। মানে একজন শিল্পী মাইক হাতে লোক হাসান। ব্যাপারটা কিছুটা বক্তৃতা, কিছুটা অভিনয়। কিন্তু উদ্দেশ্য লোক হাসানো। সারা পৃথিবীতেই ব্যাপারটা এখন দারুণ জনপ্রিয়। তবে এই স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানরা শুধু লোক হাসানোয় থেমে নেই। সারা পৃথিবীতে গত কয়েক বছরে গণতন্ত্রের সঙ্কটে এঁরা প্রতিবাদী স্বর। এই বিদূষকদের পিচকিরি থেকে ছুটে আসা রসিকতার রঙে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন, জেয়ার বলসোনারো, নরেন্দ্র মোদী, অ্যাঞ্জেলা মেরকেল, জাস্টিন ট্রুডো — সকলের কাপড় চোপড় নষ্ট হচ্ছে। ট্রেভর নোয়া, হাসান মিনহাজরা রীতিমত তারকা হয়ে উঠেছেন অল্প সময়েই। ব্রিটিশ কমেডিয়ান জন অলিভার হাসানোর শিল্পকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর শো লাস্ট উইক টুনাইট রীতিমত খবরের বুলেটিন। শুধু পরিবেশনের আঙ্গিকে নয়, বিষয় নির্বাচন আর গবেষণার গভীরতাতেও। সারা পৃথিবীর শাসক, ক্ষমতাশালী, অতি ধনীরা তাঁর রসিক বুলেটিনের চাঁদমারি।

ইউরোপ, আমেরিকার বিদূষকদের সুবিধা এই, যে তাঁদের বিরুদ্ধে গণ আক্রমণ বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হয়নি এখনো। ভারতে হয়েছে, হচ্ছে। কুণাল কামরা শো করতে গিয়ে বাধা পেয়েছেন একাধিক জায়গায়, অনলাইন হুমকি তো পেয়েই থাকেন। আরেক বিদূষক বরুণ গ্রোভার তো একটা শোতে হাসতে হাসতে বলেছিলেন “আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে ‘এত যে হুমকি পান, ভয় করে না?’ আমি বলি আমার আগে তো কামরার নম্বর আছে। ওর ভাল মন্দ কিছু একটা হয়ে যাক, তারপর ভয় পাব।” এসবের ফলে যা হয়েছে, তা হল ভারতে বিদূষকরা হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রতিবাদের মুখ। ক্ষমতা যত টুঁটি টিপে ধরছে, এঁরা তত বেপরোয়া হচ্ছেন। কুণালের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টকে অবমাননার অভিযোগ আনা হয়, তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন। তার কয়েক মাস আগেই জনপ্রিয় দক্ষিণপন্থী সংবাদ পরিবেশককে তাঁরই কায়দায় প্রশ্ন করার “অপরাধে” কুণালের বিমানে চড়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় ছ মাসের জন্য। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে মুনাওয়ার ফারুকির উপর আক্রমণ। শোতে ঢুকে পড়ে তিনি কী বলতে পারেন (বলেননি কিন্তু), তা ধরে নিয়ে গ্রেপ্তারি এবং দিনের পর দিন বিনা জামিনে হাজতবাস করানো হয়েছে দিনের পর দিন। স্বাধীন ভারতে দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা কোন মানুষের সাথে রাষ্ট্রের এরকম ব্যবহার বিরল। কুণাল মুনাওয়ারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আইনি লড়াইয়ে সবরকম সাহায্য করেছেন।

দেশ বিদেশের বিদূষকরা যখন এরকম ধুন্ধুমার কাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন, তখন বাংলার বিদূষকদের দেখুন। বিভিন্ন বাংলা চ্যানেলে লাফটার চ্যালেঞ্জ মার্কা একাধিক অনুষ্ঠান দেখা যায়। তার উপর আছে ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল। এতজন হাস্যরস উৎপাদন করছেন অথচ কারোর রসিকতা কোন নেতা নেত্রী আমলা ব্যবসায়ীর গায়ে লাগছে না। কারণ লোক হাসাতে বাঙালি বিদূষকরা কেবল বেঁটে লোককে বেঁটে, মোটা লোককে মোটা বলছেন আর অতি স্থূল, নারীবিদ্বেষী যৌন রসিকতা করছেন। নিজস্ব কুয়োয় নিরাপদ হাসি চলছে। অথচ এমন নয় যে বাংলার রাজনীতি বৈকাল হ্রদের মত নির্মল আর ডেড সি-র মত শান্ত। গত এক-দেড় দশকে জানা গেছে এখানে একজন রাজনীতিবিদ আছেন, যিনি প্রতিপক্ষকে খুনের হুমকি দেন কারণ তাঁর মস্তিষ্কে ঠিকমত অক্সিজেন যায় না। আরেকজন আছেন, যিনি সাংবাদিকের পশ্চাদ্দেশে পিন ফোটাতে চান। আরো একজন আছেন, যিনি গরুর দুধ থেকে নিষ্কাশন করতে পারেন। অতি সম্প্রতি আবার এক দম্পতিকে পাওয়া গেছে, যাঁদের বৈবাহিক জীবনের সবকিছুই রাজনীতির স্বার্থে প্রকাশ্য। তার উপর আছে দলবদলান্তে ভোল বদল। এক কথায় বাংলার জমি এখন হাসি তামাশার পক্ষে অতি উর্বর। কুণাল কামরার ভাষায় বলতে গেলে “কাঁহা মিলেগা ইতনা কনটেন্ট?” এমনও বলা যায় না যে সাধারণ দর্শক এসব নিয়ে হাসি তামাশা পছন্দ করেন না। হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকে তাঁরা বাংলার রাজনীতি নিয়ে অনর্গল রসিকতা করছেন, রসিকতা শেয়ার করছেন। আসলে বাঙালি বিদূষকদের সেই মেধা নেই, সেই সাহস নেই — যা থাকলে ভাঁড় মোসাহেব হয়ে থাকেন না, বিদূষক হয়ে ওঠেন।

আরও পড়ুন হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস

হাস্যরস উৎপাদনে বাঙালির এই কূপমণ্ডূকতা দ্বিগুণ দুঃখজনক, কারণ উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হুতোম প্যাঁচার নকশার প্রবল শ্লেষ থেকে শুরু করে শরচ্চন্দ্র পণ্ডিত, সুকুমার রায়, রাজশেখর বসু হয়ে সদ্য শতবর্ষ পার করা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ যে হাস্যরসের পরম্পরা প্রতিষ্ঠা করেছেন বাঙালির সাহিত্যে, সিনেমায়, মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাস্যকৌতুক বলায় — তা কখনো সমকালীন সমাজ, রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে যায়নি। উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ না করে শুধু এইটুকু বলা থাক, ভানুবাবুর ‘নবরামায়ণ’ যদি এ যুগে অ্যামাজন বা নেটফ্লিক্সের জন্য তৈরি করা হত, তাহলে ক্ষমতাসীনরা প্রবল তাণ্ডব করতেন। হয়ত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে নির্বাসনের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হত। উনি অবশ্য পিছু হটতেন বলে মনে হয় না। সে যুগে বামপন্থী সংগঠন করার জন্য টালিগঞ্জে কাজ না পেয়ে ডোন্ট কেয়ার মনোভাব নিয়ে যাত্রা করতে চলে গিয়েছিলেন। এ যুগে হয়ত বলতেন “তগো ইন্ডাস্ট্রি নিয়া তোরা থাক। আমাগো ইউটিউব চ্যানেলে আমি ড্যাং ড্যাং কইরা অভিনয় করুম।”

উত্তরবঙ্গে সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: