দুটো বিপরীতার্থক শব্দ নিয়ে বাঙালির দুই আইকন বিস্তর ভাবনা চিন্তা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ “বিশ্বনাগরিক” শব্দটা আমাদের দিয়েছেন, আর সত্যজিৎ রায় তাঁর সারাজীবনের কাজে সিধু জ্যাঠা, প্রফেসর শঙ্কুর মত বিশ্বনাগরিককে আঁকার পর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ পর্যটক মনমোহনের মাধ্যমে “কূপমণ্ডূক” হতে বারণ করেছেন। বাঙালি নিজেকে বিশ্বনাগরিক বলে পরিচয় দিতে বিলক্ষণ ভালবাসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যত দিন যাচ্ছে, তার মধ্যে কূপমণ্ডূকতার লক্ষণগুলোই প্রকট হতে দেখা যাচ্ছে। বাঙালির সংস্কৃতি নিয়েও গর্বের শেষ নেই। সংস্কৃতি প্রায় নির্বাচনী ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেকের ধারণা কালচার শব্দটা বাংলাই। সেই কালচারেই আপাদমস্তক কূপমণ্ডূকতা দেখা যাচ্ছে। গোপালকৃষ্ণ গোখেল দেড়শো বছর আগে বলেছিলেন আজ বাংলা যা ভাবে, কাল ভারত তাই ভাবে। তা নিয়ে আমরা আজও গর্ব করি। অথচ এখন শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা — সবেতেই ভারত আজ যা ভাবছে, বাংলা আগামী পরশুও ভেবে উঠতে পারবে বলে ভরসা হচ্ছে না।
গুরুগম্ভীর ব্যাপার বাদ দিয়ে হাসি তামাশা নিয়েই আলোচনা করা যাক। হাতে হাতে স্মার্টফোন আর শস্তা ইন্টারনেটের কারণে এখন অ্যামাজন, নেটফ্লিক্সের মত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আর ইউটিউবের রমরমা। এসবে বিনোদন বলতে শুধু সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ বোঝায় না, স্ট্যান্ড আপ কমেডিও বোঝায়। মানে একজন শিল্পী মাইক হাতে লোক হাসান। ব্যাপারটা কিছুটা বক্তৃতা, কিছুটা অভিনয়। কিন্তু উদ্দেশ্য লোক হাসানো। সারা পৃথিবীতেই ব্যাপারটা এখন দারুণ জনপ্রিয়। তবে এই স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানরা শুধু লোক হাসানোয় থেমে নেই। সারা পৃথিবীতে গত কয়েক বছরে গণতন্ত্রের সঙ্কটে এঁরা প্রতিবাদী স্বর। এই বিদূষকদের পিচকিরি থেকে ছুটে আসা রসিকতার রঙে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন, জেয়ার বলসোনারো, নরেন্দ্র মোদী, অ্যাঞ্জেলা মেরকেল, জাস্টিন ট্রুডো — সকলের কাপড় চোপড় নষ্ট হচ্ছে। ট্রেভর নোয়া, হাসান মিনহাজরা রীতিমত তারকা হয়ে উঠেছেন অল্প সময়েই। ব্রিটিশ কমেডিয়ান জন অলিভার হাসানোর শিল্পকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর শো লাস্ট উইক টুনাইট রীতিমত খবরের বুলেটিন। শুধু পরিবেশনের আঙ্গিকে নয়, বিষয় নির্বাচন আর গবেষণার গভীরতাতেও। সারা পৃথিবীর শাসক, ক্ষমতাশালী, অতি ধনীরা তাঁর রসিক বুলেটিনের চাঁদমারি।
ইউরোপ, আমেরিকার বিদূষকদের সুবিধা এই, যে তাঁদের বিরুদ্ধে গণ আক্রমণ বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হয়নি এখনো। ভারতে হয়েছে, হচ্ছে। কুণাল কামরা শো করতে গিয়ে বাধা পেয়েছেন একাধিক জায়গায়, অনলাইন হুমকি তো পেয়েই থাকেন। আরেক বিদূষক বরুণ গ্রোভার তো একটা শোতে হাসতে হাসতে বলেছিলেন “আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে ‘এত যে হুমকি পান, ভয় করে না?’ আমি বলি আমার আগে তো কামরার নম্বর আছে। ওর ভাল মন্দ কিছু একটা হয়ে যাক, তারপর ভয় পাব।” এসবের ফলে যা হয়েছে, তা হল ভারতে বিদূষকরা হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রতিবাদের মুখ। ক্ষমতা যত টুঁটি টিপে ধরছে, এঁরা তত বেপরোয়া হচ্ছেন। কুণালের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টকে অবমাননার অভিযোগ আনা হয়, তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন। তার কয়েক মাস আগেই জনপ্রিয় দক্ষিণপন্থী সংবাদ পরিবেশককে তাঁরই কায়দায় প্রশ্ন করার “অপরাধে” কুণালের বিমানে চড়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় ছ মাসের জন্য। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে মুনাওয়ার ফারুকির উপর আক্রমণ। শোতে ঢুকে পড়ে তিনি কী বলতে পারেন (বলেননি কিন্তু), তা ধরে নিয়ে গ্রেপ্তারি এবং দিনের পর দিন বিনা জামিনে হাজতবাস করানো হয়েছে দিনের পর দিন। স্বাধীন ভারতে দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা কোন মানুষের সাথে রাষ্ট্রের এরকম ব্যবহার বিরল। কুণাল মুনাওয়ারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আইনি লড়াইয়ে সবরকম সাহায্য করেছেন।
দেশ বিদেশের বিদূষকরা যখন এরকম ধুন্ধুমার কাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন, তখন বাংলার বিদূষকদের দেখুন। বিভিন্ন বাংলা চ্যানেলে লাফটার চ্যালেঞ্জ মার্কা একাধিক অনুষ্ঠান দেখা যায়। তার উপর আছে ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল। এতজন হাস্যরস উৎপাদন করছেন অথচ কারোর রসিকতা কোন নেতা নেত্রী আমলা ব্যবসায়ীর গায়ে লাগছে না। কারণ লোক হাসাতে বাঙালি বিদূষকরা কেবল বেঁটে লোককে বেঁটে, মোটা লোককে মোটা বলছেন আর অতি স্থূল, নারীবিদ্বেষী যৌন রসিকতা করছেন। নিজস্ব কুয়োয় নিরাপদ হাসি চলছে। অথচ এমন নয় যে বাংলার রাজনীতি বৈকাল হ্রদের মত নির্মল আর ডেড সি-র মত শান্ত। গত এক-দেড় দশকে জানা গেছে এখানে একজন রাজনীতিবিদ আছেন, যিনি প্রতিপক্ষকে খুনের হুমকি দেন কারণ তাঁর মস্তিষ্কে ঠিকমত অক্সিজেন যায় না। আরেকজন আছেন, যিনি সাংবাদিকের পশ্চাদ্দেশে পিন ফোটাতে চান। আরো একজন আছেন, যিনি গরুর দুধ থেকে নিষ্কাশন করতে পারেন। অতি সম্প্রতি আবার এক দম্পতিকে পাওয়া গেছে, যাঁদের বৈবাহিক জীবনের সবকিছুই রাজনীতির স্বার্থে প্রকাশ্য। তার উপর আছে দলবদলান্তে ভোল বদল। এক কথায় বাংলার জমি এখন হাসি তামাশার পক্ষে অতি উর্বর। কুণাল কামরার ভাষায় বলতে গেলে “কাঁহা মিলেগা ইতনা কনটেন্ট?” এমনও বলা যায় না যে সাধারণ দর্শক এসব নিয়ে হাসি তামাশা পছন্দ করেন না। হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকে তাঁরা বাংলার রাজনীতি নিয়ে অনর্গল রসিকতা করছেন, রসিকতা শেয়ার করছেন। আসলে বাঙালি বিদূষকদের সেই মেধা নেই, সেই সাহস নেই — যা থাকলে ভাঁড় মোসাহেব হয়ে থাকেন না, বিদূষক হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস
হাস্যরস উৎপাদনে বাঙালির এই কূপমণ্ডূকতা দ্বিগুণ দুঃখজনক, কারণ উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হুতোম প্যাঁচার নকশার প্রবল শ্লেষ থেকে শুরু করে শরচ্চন্দ্র পণ্ডিত, সুকুমার রায়, রাজশেখর বসু হয়ে সদ্য শতবর্ষ পার করা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ যে হাস্যরসের পরম্পরা প্রতিষ্ঠা করেছেন বাঙালির সাহিত্যে, সিনেমায়, মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাস্যকৌতুক বলায় — তা কখনো সমকালীন সমাজ, রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে যায়নি। উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ না করে শুধু এইটুকু বলা থাক, ভানুবাবুর ‘নবরামায়ণ’ যদি এ যুগে অ্যামাজন বা নেটফ্লিক্সের জন্য তৈরি করা হত, তাহলে ক্ষমতাসীনরা প্রবল তাণ্ডব করতেন। হয়ত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে নির্বাসনের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হত। উনি অবশ্য পিছু হটতেন বলে মনে হয় না। সে যুগে বামপন্থী সংগঠন করার জন্য টালিগঞ্জে কাজ না পেয়ে ডোন্ট কেয়ার মনোভাব নিয়ে যাত্রা করতে চলে গিয়েছিলেন। এ যুগে হয়ত বলতেন “তগো ইন্ডাস্ট্রি নিয়া তোরা থাক। আমাগো ইউটিউব চ্যানেলে আমি ড্যাং ড্যাং কইরা অভিনয় করুম।”
উত্তরবঙ্গে সংবাদে প্রকাশিত