মমতা ব্যানার্জি বাংলা ছবির জন্য এত বছর ধরে এত করলেন, এতজনকে এত পুরস্কার দিলেন, আর কাজের সময়ে টলিউডকে কাজে লাগিয়ে ফেলল বিজেপি!
নিশ্চয়ই ভাবছেন সিনেমার আলোচনার সূচনা এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা দিয়ে কেন? কী করা যাবে বলুন? যে মাল্টিপ্লেক্সে ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে ঠিক পাশের স্ক্রিনেই চলছিল অক্ষয় কুমারের ওএমজি ২। শো শুরু হওয়ার আগে লবিতে বসে দেওয়ালে লাগানো এলইডি স্ক্রিনে ওই ছবির প্রোমোশনালে দেখেছিলাম শিবের বেশে অক্ষয়কে। ফলে ছবি শুরুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পর্দায় ত্রিশূল হাতে শিব এবং তাঁর মারামারি করার দৃশ্য দেখে ভাবলাম, এই রে! হল কর্তৃপক্ষ ভুল করে এই ছবি চলতে চলতে ওই ছবি চালিয়ে দিল না তো! শুধু কি দৃশ্য? সাউন্ড ট্র্যাকে তখন ঝাঁ ঝাঁ করে বাজছে আজকালকার ডিজে বাজানো ভক্তিগীতির কায়দায় রচিত “বম বম সত্যান্বেষী” (পরেও যতবার ব্যোমকেশ অপরাধীকে ধাওয়া করে ততবার বাজে)। শ্রাবণ মাস চলছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সিনেমা হলের চেয়ে ওই গান অনেক বেশি মানানসই তারকেশ্বরে যারা বাবার মাথায় জল ঢালতে যাচ্ছে তাদের জমায়েতে। গোয়েন্দা গল্প নিয়ে তৈরি ছবিতে ওই দৃশ্য আর এই গান ঢুকে পড়ার যুক্তি হিন্দুত্ববাদের প্রচার ছাড়া আর কী হতে পারে?
এমনিতে কোনো টেক্সটের পুনর্কথনে দোষ নেই, যদি তার পিছনে নিবিড় পাঠ থাকে। মুশকিল হল, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গরহস্য উপন্যাস তো বটেই, গোটা ব্যোমকেশ সমগ্র ঘেঁটেও এমন একটা বাক্য দেখানো শক্ত যেখানে লেখক ব্যোমকেশ বক্সীর নামটার দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কোনোরকম ঈশ্বরত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বরং উল্টোটাই সত্যি। বিশ্বসাহিত্যের বহু প্রথিতযশা গোয়েন্দার চেয়ে ব্যোমকেশ বেশি আটপৌরে। আর্থার কোনান ডয়েল প্রায় প্রতি গল্পে শার্লক হোমস যে আর পাঁচজন মানুষের চেয়ে আলাদা তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। শরদিন্দু কিন্তু বারবার ব্যোমকেশের সাধারণত্বই যে তার বিশেষত্ব সেকথা প্রমাণ করেছেন। তাই সে তার বয়সী যে কোনো ছেলের মতই তদন্ত করতে গিয়েও প্রেমে পড়ে যায় এবং সত্যবতীকে বিয়ে করে। এমনকি গোটা ব্যোমকেশ সাহিত্যে ব্যোমকেশ-সত্যবতীর সন্তানকে শরদিন্দু স্রেফ ‘খোকা’ বলে গেছেন। সে যুগে গড়পড়তা বাঙালি ছেলেদের ডাকনাম হিসাবে খোকা বা খোকন বহুলপ্রচলিত ছিল। এখানে ব্যোমকেশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী করে তুলতেই যে শিব সাজানো হয়েছে, তার প্রমাণ সে শিব সেজে দাঁড়িয়ে থেকে দেশের সম্পদ বিদেশে চালানকারী সাহেবকে ধরে ফেলেই বলে, কোহ-ঈ-নূর নিয়ে গেছ বলে সবই নিয়ে যাবে? সাহেব অবশ্য নেহাতই ক্রেতা। বিক্রেতা যে ভারতীয় তাকে বিস্তর ঝাড়পিটের পর ধরে ফেলে জটাধারী ব্যোমকেশ বলতে ছাড়ে না যে এইসব লোককে শাস্তি দিতেই ব্যোমকেশকে বারবার ফিরে আসতে হবে। টুক করে অবতারবাদও ঢুকিয়ে দেওয়া গেল।
বস্তুত এই ছবির ব্যোমকেশ চরিত্র একটি ধারাবাহিকতা তৈরি করল। কিছুদিন আগে অরিন্দম শীল নির্দেশিত ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ওয়েব সিরিজে প্রথমবার ফেলুদা এনকাউন্টার করে অপরাধী মেরেছে। এবার বিরসা-দেব জুটি ব্যোমকেশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসাবে দেখালেন। তৃণমূল কংগ্রেস দলের সাংসদ দেব আবার এই ছবির অন্যতম প্রযোজকও বটে। অর্থাৎ টলিউডের মাধ্যমে বাংলার দুই জনপ্রিয় গোয়েন্দা যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ মডেল আর গুজরাট মডেল আপন করে নিলেন।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ ভাল হোক আর মন্দই হোক, সত্যান্বেষীকে শিব বানিয়ে ফেলা নির্দেশক বিরসা দাশগুপ্ত ও চিত্রনাট্যকার শুভেন্দু দাশমুন্সীর শৈল্পিক মুনশিয়ানা বলে মেনে নেওয়া যেত, যদি এই প্রবল জাতীয়তাবাদী গোয়েন্দাটি বাকি ছবিতে চিরাচরিত ধুতি-শার্ট বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকতেন। কিন্তু তিনি অধিকাংশ দৃশ্যেই রীতিমত সুটেড বুটেড। শরদিন্দুর ব্যোমকেশও এতখানি সায়েব ছিল না। অবশ্য সেই ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ব্যোমকেশকে মিলিয়ে দেখতে গেলে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে। কারণ সিরিজের একেবারে প্রথম গল্পেই লেখক জানিয়ে দিয়েছিলেন, ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা বলতে ঘোর অপছন্দ করে। ব্যোমকেশ অজিতকে বলেছে “ডিটেকটিভ কথাটা শুনতে ভাল নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ।” এখানে দেখা যাচ্ছে তাকে টিকটিকি বলে উল্লেখ করলেও ব্যোমকেশের আপত্তি নেই।
সবচেয়ে বড় যে বদলটি ঘটানো হয়েছে এই ছবিতে, তা হল সত্যবতীকে (রুক্মিণী মৈত্র) গর্ভাবস্থায় দাদা সুকুমারের কাছে না পাঠিয়ে ব্যোমকেশ, অজিতের সঙ্গে অকুস্থলে পাঠানো হয়েছে। সত্যবতীর সহচরীর প্রয়োজনে পুরন্দর পাণ্ডের সুগৃহিণী স্ত্রীকেও হাজির করা হয়েছে। এই পরিবর্তনটি নিঃসন্দেহে জরুরি ছিল। কারণ দেব অভিনীত ব্যোমকেশ যত ভাল দৌড়তে পারে, মারামারি করতে পারে, সত্যান্বেষণে তত দড় নয়। দুর্গে না গিয়েও স্রেফ শুনে শুনে রামকিশোরের পরিবারের সদস্যদের চরিত্র বিশ্লেষণ সত্যবতীই অনেকটা করে দেয়। এমনকি নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ থেকে কয়েক লাইন আউড়ে গুপ্তধনের সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার কাজটাও সে-ই করে দেয়। অর্থাৎ সত্যবতী একাই ব্যোমকেশ এবং অজিতের কাজ করে দিতে পারে। তাও আবার ঘরে বসে, মিস মার্পলের মত। কেন যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের দীর্ঘ তালিকায় মমতা, শিবরাজ সিং চৌহান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আগাথা ক্রিস্টির নামটাও রাখা হল না? অবশ্য ব্যোমকেশ শিব হয়ে উঠলে সত্যবতীকে তো পার্বতী হতেই হয়। এর জন্যে কোনো বিদেশিনীর কাছে কেনই বা কৃতজ্ঞ থাকতে হবে?
আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট
সত্যান্বেষণে গিন্নী অনেকখানি সাহায্য করে দিলেও ব্যোমকেশকে বিস্তর কায়িক পরিশ্রম করতে হয়েছে। গল্পে ছিল ব্যোমকেশ-অজিতকে দুর্গ থেকে তাড়াতে নির্বিষ ঢ্যামনা সাপ ছেড়ে দেওয়ার কথা। সে সাপকে ধরেছিল পুলিস কনস্টেবল সীতারাম। এই ছবির সাপটি রীতিমত বিষধর এবং সাপ সম্পর্কে গবেষণায় আজ পর্যন্ত যা যা জানা গেছে, সেসবকে কাঁচকলা দেখিয়ে সে রীনা রায় অভিনীত নাগিন (১৯৭৬) ছবির মত মানুষ মারার উদ্দেশ্য নিয়েই ঘরে ঢোকে। আরেকটু হলেই ঘুমন্ত অজিতের (অম্বরীশ ভট্টাচার্য) ভবলীলা সে সাঙ্গ করে দিয়েছিল। ব্যোমকেশ খালি হাতে সেই সাপকে ধরে ঝুড়িতে পুরে ফেলে। এতদ্বারা বোধহয় দেব তাঁর পরের ছবি বাঘাযতীন-এ খালি হাতে বাঘ মারার রিহার্সালও করে নিলেন। হলই বা কম্পিউটার জেনারেটেড। তবে সম্ভবত দেবকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে বেঢপ চশমাখানা সামলাতে। বাংলা ছবির বাজেটের কি এতই করুণ অবস্থা যে তাঁর মুখের গড়নের সঙ্গে মানানসই একখানা চশমা পাওয়া যায়নি? সারাক্ষণই বাঁকা মনে হয়। যেন ঠিক চেপে বসেনি, এখুনি খুলে পড়ে যাবে। প্রযোজক দেব কি অভিনেতা দেবের এই অসুবিধা খেয়াল করেননি?
সত্যবতীর চরিত্রে রুক্মিণীর একমাত্র গুণ হল তাঁর রূপ।
অম্বরীশ ছাড়া ছবির বাকি অভিনেতাদের প্রায় সকলকেই দেখে মনে হয়েছে তাঁরা থতমত খেয়ে আছেন, ঠিক কী করতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। সে জন্যে তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। সাবেকি বাঙালি ভদ্রলোক রামকিশোরের চরিত্রে রজতাভ দত্তকে যদি খামোকা স, শ সবই s-এর মত উচ্চারণ করতে হয় তাহলে নিজের ভূমিকা গুলিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আরও গুলিয়ে যাওয়ার মত চরিত্র রামকিশোরের নায়েব চাঁদমোহন দত্তের (শঙ্কর দেবনাথ)। তিনি রীতিমত বাঙাল ভাষায় কথা বলেন, অথচ বেশভূষা খাঁটি হিন্দি বলয়ের মুনশিদের মত। বল্লভপুরের রূপকথা ছবিতে প্রধান চরিত্রে মন ভরিয়ে দেওয়া সত্যম ভট্টাচার্য এখানে কিছুতেই খলনায়ক হয়ে উঠতে পারলে না। মণিলালের চরিত্রে তিনি যেন সেই বল্লভপুরের ভালমানুষ রাজাই রয়ে গেলেন। শরদিন্দু তাঁর খলনায়কদের ব্যোমকেশের প্রতিস্পর্ধী হিসাবে গড়ে তুলেছেন বহু গল্পেই। পথের কাঁটা, চিড়িয়াখানা-র মত দুর্গরহস্য উপন্যাসেও তাকে শেষ পর্যন্ত ধরা যায় না। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেবকে অপরাধী ফাঁকি দিল – এ জিনিস কোথায় কার ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করবে কেউ বলতে পারে না। তাই পরিচালক সে ঝুঁকি নেননি। ক্লাইম্যাক্সটা হয়েছে একেবারে হিন্দি সিনেমার মত। দেব মরার ভান করে, হারার ভান করে শেষমেশ জিতে গেছেন। ছবিতে যে পরিমাণ হিন্দি, বাংলা সংলাপ মেশানো হয়েছে তাতে বলে দিতেই পারতেন “শুনুন মণিলালবাবু, হার কর জিতনেওয়ালে কো বাজিগর কহতে হ্যাঁয়।” দোষ হত না।
একমাত্র অম্বরীশই এই ছবিতে সাবলীল। কিন্তু মুশকিল হল, কোনো অজ্ঞাত কারণে বাংলা ছবির নির্দেশকরা সকলেই একমত হয়েছেন যে লালমোহনবাবু আর অজিত গোয়েন্দার বন্ধু কম, ভাঁড় বেশি। তাই তাঁকে দিয়ে বিস্তর ভাঁড়ামি করানো হয়েছে। এমনকি সিদ্ধি খাইয়ে মাতাল পর্যন্ত করা হয়েছে (শরদিন্দু সিদ্ধি খাওয়ার কথা লিখেছেন, টলমল করার কথা লেখেননি)। বাঙালি সাহিত্যিকের এমন চরিত্রচিত্রণ দেখলে শরদিন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন নির্ঘাত।
সবই বোঝা গেল, কিন্তু শেষে লগ্নজিতা চক্রবর্তীর গলায় ‘ও যে মানে না মানা’ কেন বেজে উঠল তা ঠিক বোধগম্য হল না। সবাই তো সবকিছু মেনে নিল। শরদিন্দু যেমন লিখেছেন তেমনভাবেই তুলসী আর রমাপতির বিয়ে হল, সত্যবতী মা হল, এমনকি রামকিশোরের দুই দুর্দান্ত ছেলের বাঁদরামিও প্রশমিত হল। তাহলে? রবীন্দ্রনাথের গান কি তুলসীপাতা, যে বাংলার সংস্কৃতির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সবকটি নৈবেদ্যের উপর একখানা করে দিতেই হবে?
নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত