বল্লভপুরের রূপকথা: খাঁটি বাংলা ছবি

হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল, এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

এক গল্প হাজারবার বললে সে আর এক গল্প থাকে না, পালটে পালটে যায়। মানুষের জীবনের মত। এক চরিত্রের মুখ দিয়ে এই কথাটি পরিচালক ছবির শুরুতেই বলে দিয়েছেন। তাই বাদল সরকারের নাটক দেখা না থাকলেও বল্লভপুরের রূপকথা দেখতে অসুবিধা হয় না। আমরা দুর্ভাগা প্রজন্ম। বাদল সরকারের নামটুকুই শুনেছি, কেউ কেউ তা-ও শুনিনি। আমরা কেবল সত্যজিৎ রায়কে চিনি। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য যথার্থই অনুমান করেছিলেন, হলে ঢুকে আমরা কেউ সঙ্গের দর্শককে জিজ্ঞেস করে ফেলতেই পারি “বাদল সরকারটা আবার কে?” তাই গোড়াতেই সেসব দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রফেসর শঙ্কুর মত দেখতে লোকটি যে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যশিল্পী তা সিনেমা দেখতে গিয়ে জানা হয়ে গেল।

পরিচালকের বুকের পাটা দেখে অবাক হতে হয়। মেগাসিরিয়ালে অভ্যস্ত দর্শককে তিনি একে তো বাদল সরকার চেনাচ্ছেন, তার উপর আবার আখ্যান সম্বন্ধে সচেতন করছেন! মিশকালো অন্ধকারে নৌকো বাইতে বাইতে যে মাঝি আখ্যান সম্পর্কে ওই চিরসত্য উচ্চারণ করছে তার নাম রসিক। অরসিকের কাছে রস নিবেদন করার দুর্ভাগ্য যেন আমার না হয় – বিধাতার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন প্রাচীন কবি। অনির্বাণ সে ঝুঁকি নিয়েছেন। তাঁর এত আয়োজন বৃথা যেত যদি বিদেশি ছবি থেকে বাদল সরকারের হাত ঘুরে তাঁর কাছে আসা আখ্যানটিকে রসোত্তীর্ণ করতে না পারতেন। সে পরীক্ষায় তিনি সফল। তাঁর আখ্যান রসে টইটম্বুর। হলভর্তি দর্শক প্রায়ই হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এ ছবি একটিমাত্র রস পরিবেশন করেনি। এমনকি হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল (pun), এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট অধিনায়কদের একজন, সৌরভ গাঙ্গুলি, একটা কথা খুব বলে থাকেন – একজন অধিনায়ক ততটাই ভাল, যতটা ভাল তাঁর দল। কথাটা চলচ্চিত্র পরিচালকের বেলাতেও বোধহয় খানিকটা খাটে। যে পরিচালকের হাতে বাদল সরকারের লেখা সংলাপ, সত্যম ভট্টাচার্য (ভূপতি), শ্যামল চক্রবর্তী (মনোহর), দেবরাজ ভট্টাচার্যের (সঞ্জীব) মত উৎকৃষ্ট অভিনেতা থাকেন, তাঁকে হাস্যরসের জন্য ইদানীংকালের বাংলা ছবিতে ব্যবহৃত উপরে উল্লিখিত মধ্যমেধার কৌশলগুলোর কাছে হাত পাততে হবেই বা কেন? তবে ক্রিকেট দলের অধিনায়কের একটা সুবিধা থাকে যা পরিচালকের নেই। দলের ব্যর্থতায় নেহাত প্যাঁচে পড়লে অধিনায়ক নির্বাচকদের ঘাড়েও কিছুটা দায় চাপিয়ে দিতে পারেন, পরিচালকের সে উপায় নেই। অনির্বাণ থিয়েটারের অভিনেতাদের নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। ফেল করলে কারোর দিকে আঙুল তোলার উপায় থাকত না। কিন্তু তাঁর নির্বাচিত অভিনেতারা প্রত্যেকেই চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ের মত খেলেছেন।

অনিবার্যভাবে মনে পড়ে সদ্যপ্রয়াত তরুণ মজুমদারের কথা। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগে অনুপকুমারকে নায়কের চরিত্রে রেখে তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলা ছবির ইতিহাসে সর্বকালের সেরা হিট ছবিগুলোর অন্যতম – পলাতক (১৯৬৩)। স্রেফ শক্তিশালী চিত্রনাট্য আর অভিনয় দক্ষতা হিট ছবির রসায়ন হতে পারে তার অকাট্য প্রমাণ। অনির্বাণও তারকাবিহীন, এমনকি রুপোলি পর্দার অভিনেতাবিহীন ছবি করেছেন। তরুণের সময়ে তবু টলিউড সংকটাপন্ন ছিল না। এখন কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছবি যদি শেষপর্যন্ত বিপুল সংখ্যক দর্শকের আশীর্বাদধন্য হয়, তাহলে কী করলে ছবি হিট হয়, সে প্রশ্ন নতুন করে ভাবতে হবে সকলকেই। শীর্ষ মন্তাজেই ইঙ্গিত রয়েছে – গোয়েন্দা, ভূত, নস্ট্যালজিয়া সবই কপচানো হয়ে গেছে। কোনোটাই বিশেষ কাজ দেয়নি। তরুণ পারতেন রুচিসম্মত অথচ জনপ্রিয় ছবি তৈরি করতে। সে ছবি সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনের উচ্চতার শিল্প হত না হয়ত। কিন্তু স্রেফ শহুরে ও অনাবাসী বাঙালি দর্শকের জন্য তৈরি চলচ্চিত্রোৎসবমুখী ভানও তাতে থাকত না। একইসঙ্গে গ্রাম ও শহরের দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারে, এমন বাংলা ছবি বিশ-তিরিশ বছর হল তৈরিই হয় না। অভিজ্ঞরা বলেন অমন ছবি নাকি সম্ভবই নয়, কারণ গ্রাম আর শহরের দর্শকের রুচির তফাত বিস্তর। অথচ বিশ্বায়নের যুগে গোটা দুনিয়াটাই গ্লোবাল ভিলেজ – এমনটাই তো জেনে আসছি। বাস্তবিক দার্জিলিং থেকে মেদিনীপুর – সর্বত্রই তো পৌঁছে গেছে ওটিটি। তবু? বল্লভপুরের রূপকথা আখ্যানে এবং উপস্থাপনে গ্রাম, শহরের সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছে। দেখা যাক তা সফল হয় কিনা।

অভিনয়ের কথা হচ্ছিল। ছবি দাঁড়িয়ে আছে ভূপতি, ছন্দা (সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়), মনোহর আর সঞ্জীবের চরিত্রের উপর ভর দিয়ে। তাঁদের অভিনয় তো নিখুঁত বটেই, ছোটখাটো চরিত্রগুলোতেও এত নির্মেদ অভিনয় আজকাল বাংলা ছবিতে সুলভ নয়। ভূপতির তিন পাওনাদার সাহা (কৃপাবিন্দু চৌধুরী), শ্রীনাথ (সুরজিৎ সরকার) আর পবনের (সুমন্ত রায়) সংলাপ বলার ঢং, হাঁটাচলা, তাকানো – সবকিছুই হাসির উদ্রেক করেছে। অথচ যথেষ্ট অবকাশ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অতি-অভিনয় করেননি। ইংরেজিতে যাকে কমিক টাইমিং বলে তাতে অবশ্য সবার উপরে মনোহর চরিত্রে শ্যামল। গোটা ছবিতে তিনি ভাবলেশহীন মুখে আর সকলকে হাসিয়ে গেলেন।

সত্যম চারশো বছর আগেকার রোম্যান্টিক, কালিদাস আওড়ানো, জমকালো পোশাক পরা রাজপুত্রের চরিত্রে যতটা সাবলীল, ততটাই দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা রায়বাড়ির প্রথম গামছা পরে ঘুমনো রাজা হিসাবে। এমনকি শুধু ভূপতির চরিত্রেও তিনি প্রয়োজনমাফিক সপ্রতিভ এবং অপ্রতিভ। কাজটা মোটেই সহজ নয়। বিশেষ করে ব্যোমকেশ আর ফেলুদার চরিত্রের একইরকম অভিনয় দেখে অভ্যস্ত চোখে সত্যমকে দেখে বলতে ইচ্ছে করে “বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে”।

দেবরাজ ভূতের ভয়ে কাবু, মিসেস হালদারের বকুনিতে ক্যাবলা অথচ বন্ধুর প্রতি আনুগত্যে অবিচল চরিত্রে দারুণ বিশ্বাসযোগ্য। অমন অভিনয় করতে পারেন আবার চমৎকার গাইতেও পারেন – এমন শিল্পী কজন পাওয়া যায়?

ওপেন টি বায়োস্কোপ ছবির নেহাত বালিকা সুরঙ্গনা এ ছবিতে গত শতকের ছয়ের দশকের লাবণ্যময়ী বাঙালি মেয়ে ছন্দার চরিত্রে দারুণ মানিয়ে গেছেন। সে শুধু তাঁর সৌন্দর্য, শাড়ি পরার ধরন বা চুল বাঁধার কায়দার জন্যে নয়। যে চোখের ভাষা সেরা সময়ের রোম্যান্টিক বাংলা ছবির নায়িকাদের অব্যর্থ অস্ত্র ছিল, সেই ভাষায় সুরঙ্গনার চোখ বারবার কথা বলেছে। পাশে দাঁড়ানো পুরুষটিকে নিজের ভাললাগা জানানোর জন্য বেশি কিছু নয়, স্রেফ তার মত দেখতে পূর্বপুরুষের পোর্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে “সুপুরুষ” বলে আড়চোখে তাকিয়ে নেওয়ার নৈপুণ্য সুরঙ্গনা চমৎকার রপ্ত করেছেন। বাঙালির প্রেমের অভিজ্ঞান, অন্তত সিনেমার পর্দায়, একসময় ছিল তার সূক্ষ্মতা। নায়িকারা সরাসরি নায়কের দিকে তাকাতেন না বা আগ বাড়িয়ে চুমু খেতেন না বলে যে ন্যাকা ছিলেন তা নয়। পাঁচের দশকেই শাপমোচন ছবিতে অবিবাহিতা সুচিত্রা সেন সটান বাবার সামনে দাদাকে জানিয়ে দিচ্ছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করতে যান কারণ “তিনি আমার স্বামী”। আবার পথে হল দেরী ছবিতে তাঁর চেয়ে নায়কের দৃষ্টিই লজ্জায় বেশি থরোথরো। সত্যমকে ধমকে দেওয়ার দৃশ্যে সুরঙ্গনাকেও তেমনই দৃঢ়চেতা দেখিয়েছে।

আরও পড়ুন অহৈতুকী পার্টিজানপ্রীতি

বল্লভপুরের রূপকথা ছবিটির এই এক মজা। আপাতদৃষ্টিতে নতুন কিছুই নেই। যা আছে তা হল বাংলা ছবির, বাংলার সংস্কৃতির চিরনতুন কিছু উপাদান যা মানুষের সর্বদা ভাল লাগে। নায়ক, নায়কের অভিভাবকসুলভ বৃদ্ধ চাকর, প্রাণের বন্ধু, নায়িকার শৌখিন এবং আধক্ষ্যাপা বাবা, জাঁদরেল মা, বাবার সঙ্গে রেষারেষি থাকা এক বুড়ো ধনী – এর কোনোটাই কি বাংলা ছবির দর্শকের কাছে নতুন? পরিচালক অনির্বাণ বা অন্যরা প্রচার পর্বে কোথাও বলেননি, অথচ দেখা গেল ছবিটি পিরিয়ড পিসও বটে। মূল নাটকের মত গত শতকের ছয়ের দশকই দেখানো হয়েছে। সেই সময়কার পোশাক-আশাক, কথা বলার ধরন, গাড়ির মডেল সবই নিখুঁত। এমনকি ছবির সঙ্গীত পর্যন্ত বাংলা গানের হারিয়ে যাওয়া মেলডির সন্ধান দেয়। অনির্বাণ, দেবরাজ, শুভদীপের সৃষ্টি ‘সাজো সাজাও এমন করে’ সাহানা বাজপেয়ীর গলায় এমন মধু ঝরায় যে সুরটি ছবি শেষ হওয়ার বহুক্ষণ পরেও কোথা থেকে যেন কানে ভেসে আসে। যন্ত্রসঙ্গীতের ঝমঝম আওয়াজে পূর্ণ খোনা গলার আধুনিক বাংলা সিনেমার গান তো শুনি আর ভুলে যাই প্রায় সহজেই। ছবির আবহসঙ্গীত পর্যন্ত আজকের বলে মনে হয় না, ভয়ের ছবির পরিবেশ সৃষ্টিকারী চেনা শব্দসম্ভারই ফিরে ফিরে আসে। যদিও তাতে ভয়ের পরিবেশ কতটা তৈরি করা গেছে তাতে সন্দেহ আছে। এই এক সমালোচনার জায়গা।

তবে চলচ্চিত্র তো শেষপর্যন্ত চিত্র। মনে রাখার মত কিছু শট না থাকলে চলে না। সেখানে সোনা ফলিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার। তাঁর তৈরি অন্ধকার ঘুরঘুট্টি বটে, কিন্তু তার মধ্যেও জঙ্গলের প্রত্যেকটি গাছ আলাদা করে দেখা যায়। দিনের বেলার শটগুলোতেও আউটডোর লোকেশনের সৌন্দর্য তাঁর ক্যামেরা চেটেপুটে নিয়েছে। তবে ভোলা যায় না বল্লভপুরের রাজবাড়িতে প্রথম পদক্ষেপের সময়ে সিনেমার পর্দা জুড়ে থাকা অন্ধকারের মধ্যে উদ্ভাসিত ছন্দার মুখের ক্লোজ আপ।

বল্লভপুরের রূপকথা শস্তা নয়, সহজ। চটকদার নয়, রংদার। নতুন নয়, চিরচেনা। পরিচালক অনির্বাণের সবচেয়ে বড় গুণ – তিনি একটি খাঁটি বাংলা ছবি বানিয়েছেন। এখানে বাঙালিকে বাঙালি বলে চেনা যায়। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল হাইরাইজ, হাইওয়ে, স্কচ আর পরকীয়ায় হারিয়ে যায়নি। হৃদয় ঘেঁটে দেখা গেছে কোথায় পাতা শীতলপাটি। ছবির শুরুতে আখ্যান সম্পর্কে যে চিরসত্য মাঝি রসিক তার পীর ঠাকুর্দার উক্তি বলে উল্লেখ করেছে, সেই সত্যই আবার শেষে দোকানদার পবন তার সন্ন্যাসীপ্রতিম ঠাকুর্দার উক্তি বলে ঘোষণা করেছে। অতি সহজে, প্রায় অলক্ষ্যে পরিচালক বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক সমন্বয় দেখিয়ে দিলেন। পুরনো কথাও বারবার বলতে হয়, বলতে বলতে নতুন হয়ে ওঠে। সেই নতুনত্বের খোঁজে বেরিয়েছেন অনির্বাণ। একেবারে শেষে দেখা গেছে তিনি নিজেকে নিয়েও রসিকতা করতে পারেন। এই ক্ষমতা যদি ধরে রাখতে পারেন তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভাল কিছু আশা করা যায়।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

আমাদের যখন সবে গোঁফ দাড়ি গজাচ্ছে, তখন ট্রেনের কামরা বা পাবলিক টয়লেটের দেয়ালে সাঁটা কিছু বিজ্ঞাপন নজর কাড়ত। সেখানে লেখা থাকত একটা কথা, যার অর্থ বুঝতে না পেরে আমরা আকাশ-পাতাল ভাবতাম এবং বন্ধু মহলে বিস্তর আলোচনা করতাম। কথাটা হল, কৈশোরের কিছু “কুঅভ্যাস” ছাড়তে না পারলে নাকি বিবাহিত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজেরা কিশোর বলেই ওখানে কোন অভ্যাসের কথা বলা হত তা জানতে আমরা যারপরনাই উদগ্রীব ছিলাম। কথাটা মনে পড়ল সদ্য ওটিটিতে মুক্তি পাওয়া ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দেখে। এই ওয়েব সিরিজের মূলধন হল ফেলুদা আর সত্যজিৎ সম্পর্কে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতা। ও জিনিসটা মানুষ মাত্রেরই থাকে, কিন্তু ওটা এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় কুঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা চিরকিশোর হয়ে পড়েছি। ফলে পুনরাবৃত্তিই আমাদের শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনুকরণই আমাদের আপ্লুত করছে। গালভরা নাম হয়েছে ‘ট্রিবিউট’। অনীক দত্ত সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁকে ট্রিবিউট দিতে ছবি তৈরি করেছেন। সে ছবির বৈশিষ্ট্য (বিজ্ঞাপন জগতের ভাষায় – ইউনিক সেলিং পয়েন্ট) হল, নামভূমিকায় যিনি আছেন তাঁকে হুবহু সত্যজিতের মত দেখাচ্ছে (অথচ চরিত্রটির নাম সত্যজিৎ নয়), আর পথের পাঁচালীর দৃশ্যগুলোর দারুণ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এতেই আমাদের আবেগে গলা বুজে আসছে। আসল পথের পাঁচালী দেখার উপায় থাকতে অনুকরণ কেন দেখতে যাব, সে প্রশ্ন করলে লোকে তেড়ে আসছে।

ব্যাপারটা শৈল্পিক হোক বা না হোক, স্মৃতিমেদুরতা (বাঙালিরা যাকে বলে নস্ট্যালজিয়া) যে লালমোহন গাঙ্গুলির ভাষায় “সেলিং লাইক হট কচুরিজ”, তাতে সন্দেহ নেই। ফলে সৃজিত মুখার্জিও নস্ট্যালজিয়া বেচতেই নেমেছেন। সিরিজের প্রথম পর্বের শুরুটাই হুবহু অনুকরণ, থুড়ি ট্রিবিউট। সোনার কেল্লা ছবিতে ফেলুদাকে পর্দায় প্রথমবার দেখানোর সময়ে শীর্ষাসনরত পদযুগল দেখানো হয়েছিল, তোপসে দৌড়ে এসে খবর দিয়েছিল মক্কেল এসেছে। এখানে পদযুগল এসেছে কয়েক সেকেন্ড পরে, প্রথমবার দেখানো হয়েছে শীর্ষাসনরত ফেলুদার মুখের ক্লোজ আপ। মুশকিল হল, অনুকরণেরও সক্ষমতা অক্ষমতা আছে। মক্কেল আসার খবর ফেলুদাকে তখুনি জানানোর দরকার পড়ে। জটায়ুর আগমন তো কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় যে তৎক্ষণাৎ জানাতে হবে। কিন্তু নির্দেশক ওসব ভাবতে যাবেন কেন? দর্শককে নস্ট্যালজিয়ায় জবজবে করে ফেলতে পারাই আসল। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

নস্ট্যালজিয়া নিশ্ছিদ্র করতে সিরিজটিকে পিরিয়ড পিসে পরিণত করা হয়েছে। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই বোধহয় এমন সিনেমা বোদ্ধা দর্শক পাওয়া যায়, যাঁরা বিশ্বাস করেন ছবি সেপিয়া টোনে রাখলেই পিরিয়ড পিস হয়ে যায়। কারণ ফেলুদারা দার্জিলিংয়ে যে হোটেলে ওঠে, তার বাইরের দেয়াল আধুনিক কায়দার। আশির দশকের ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ট্রিবিউট দিতেই বোধহয় দার্জিলিংয়ের ঠান্ডাতেও এই সিরিজের ফেলুদা টোটা রায়চৌধুরীকে ফিনফিনে পাজামা আর পাঞ্জাবির উপরে স্রেফ একটা চাদর জড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বাইরে বেরোবার সময়ে তিনি দিব্যি টি-শার্ট পরে ফেলেন। মর্নিং ওয়াকেও চলে যান আধুনিক জামাকাপড় পরে। সেইসব সময়ে আশির দশক বজায় থাকে ফেলুদা আর তোপসের পেতে আঁচড়ানো চুলে। বিরূপাক্ষ মজুমদারের পুত্র সমীরণের সঙ্গে ফেলুদার বাকযুদ্ধ অবশ্য পুরোদস্তুর রেট্রো। ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া প্রভাত রায়ের প্রতিকার ছবির কথা মনে পড়ে যায়। ভয় হয়, চোখা চোখা সংলাপ বলতে বলতে এখুনি চিরঞ্জিত আর ভিক্টর ব্যানার্জির মত টোটা আর সমীরণরূপী সুপ্রভাত দাস মারামারি শুরু করে দেবেন। ট্রিবিউট অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এই সিরিজে ফেলুদার সংলাপ সম্ভবত এমএলএ ফাটাকেষ্ট চরিত্রের অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে ট্রিবিউট। নইলে নিজের গায়ের জোর কতটা তা বোঝাতে ফেলুদা বলতে পারেন না “ঘোড়া যেমন চাঁট মেরে মানুষের মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনই বহু দেশে ঘোড়াকে কেটে তার মাংস রান্না করে খাওয়া হয়।” (তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে “সুস্বাদু। জানেন?”)

দার্জিলিংয়ে ফেলুদার কার্যকলাপ অবশ্য সৌমিত্র বা চিরঞ্জিতের চেয়েও যাঁকে বেশি মনে পড়ায় তিনি অমিতাভ বচ্চন। কারণ এই ফেলুদা চিতাবাঘের চোখে চোখ রাখতে পারেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেই গুনগুন করে গান গাইতে পারেন। সে আবার ইংরেজি গান, যেহেতু তাতে ল্যাভেন্ডার শব্দটা আছে এবং যে ধাক্কা মেরেছিল তার শরীর থেকে ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার পারফিউমের গন্ধ পেয়ে ফেলুদা তাকে চিনতে পেরেছেন। এখানেই শেষ নয়, ফেলুদা আহত, ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের উপর গোটা শরীরের ভার নিতে পারেন। তিনি আরও একটি জিনিস পারেন যা এমনকি আশির দশকের বচ্চনও পারতেন না। তা হল দু হাতে বন্দুক চালানো। সমীরণ মজুমদারের গাড়ির টায়ারে ফেলুদা গুলি করেন বাঁ হাতে, গাড়ি থেকে নেমে আবার বন্দুক তাক করেন ডান হাতে।

ভক্তরা নিশ্চয়ই বলবেন এসব পরিচালকের স্বাধীনতা। ফিল্মের সাহিত্যকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করার দায় নেই। সত্যজিৎ নিজেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প নিয়ে ছবি করার সময়ে চিত্রনাট্যে অনেককিছু বদলে দিয়েছেন। কথাটা ঠিকই। এই স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার সৃজিতবাবু এই সিরিজে করেছেন। যেমন সত্যজিতের গল্পের টফ্রানিল বড়ি হয়ে গেছে ট্রফানিল। কিন্তু সমস্যা হল, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ছদিনে লিখিত এই গল্পে (সূত্র: ফেলুদা সমগ্র ১, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯; আনন্দ) সত্যজিৎ যে টফ্রানিলের কথা লিখেছেন, সামান্য গুগল সার্চই বলে দিচ্ছে ওই ওষুধটি (Tofranil) অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, যার প্রয়োজনীয়তা বিরূপাক্ষবাবু নিজে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু Trofanil বলে কোনো ওষুধের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এ যুগের সিধুজ্যাঠা গুগল Tromanil Plus বলে একটি ট্যাবলেটের কথা বলছে বটে, কিন্তু সেটিও রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ব্যবহার হয়। তাহলে কি পরিচালক সত্যজিতের উপর কলম চালিয়ে কোনো অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত ওষুধের সন্ধান দিলেন? পিরিয়ড পিসে কি তা করা চলে? প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অবশ্য হতাশ হতে হবে। যেমন বিরূপাক্ষবাবুর বেয়ারা লোকনাথকে খুন করা হয়েছিল গলা কেটে। মৃতদেহের তলপেটের কাছেও কী করে রক্ত লাগল – এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।

গল্পের যে পরিবর্তনটিকে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ বৈপ্লবিক আখ্যা দিচ্ছেন, সেটি চিত্রনাট্যকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে তা-ও যেমন বোঝা গেল না। দার্জিলিং জমজমাট গল্পে বলিউডের নায়িকা সুচন্দ্রার উল্লেখমাত্র আছে। এই সিরিজে কিন্তু তাঁর উপস্থিতি বেশ কয়েকটি দৃশ্যে। শুধু তা-ই নয়, ফিল্মের নায়ক রাজেন রায়না ওরফে বিষ্ণুদাশ বালাপোরিয়ার সঙ্গে তাঁর উদ্দাম প্রেম আছে – একথা একেবারে শুরু থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত দর্শককে (এবং ফেলুদাকে) একটি চুম্বন দৃশ্য উপহার দেওয়া ছাড়া চরিত্রটির আর কোনও ভূমিকা নেই। নায়ক-নায়িকার সম্পর্ক বিরূপাক্ষ মজুমদার হত্যা রহস্যকে নতুন কী দিতে পারল তা বোধহয় জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না। কিন্তু সুলভ পর্নোগ্রাফির যুগেও বাঙালি দর্শকের একটি লং শটের চুম্বন দৃশ্যকে বৈপ্লবিক মনে হচ্ছে দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।

একইরকম অবাক করে গল্পের সাধারণ ভদ্রলোক হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে ‘অ্যাংগ্রি ওল্ড ম্যান’ গোছের চরিত্রে পরিণত করা। তিনি নাকি বিরূপাক্ষবাবুর উপর নজর রাখার জন্য লোক লাগিয়েছিলেন। কী উদ্দেশ্যে তার ব্যাখ্যা অবশ্য চিত্রনাট্যে নেই। উপরন্তু তিনি বলেন, “ব্লাড প্রেশার আর গেঁটে বাতের সমস্যা না থাকলে” তিনি হয়ত বিরূপাক্ষবাবুকে খুন করার চেষ্টা করতেন। এটাও কি আশির দশকের বচ্চনকে ট্রিবিউট? মানে পিরিয়ড পিস হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হঠাৎ একটিমাত্র দৃশ্যে একটিমাত্র দেয়ালে আখরি রাস্তা-র পোস্টার সাঁটা হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করছি।

আরও পড়ুন ‘অলৌকিক মেগা সিরিয়াল দেখা সমাজের সত্যজিতের ছবি দেখার কোন কারণ নেই, তিনি উপলক্ষ মাত্র’

ট্রিবিউটাভ্যাস চরমে উঠেছে ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে। কদিন পরে কলকাতা মেট্রোর উত্তমকুমার স্টেশনের আশপাশে হাঁটতে গেলে নির্ঘাত কোনো ব্যোমকেশ বা ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে। দেখা যাচ্ছে তাতেও যথেষ্ট ট্রিবিউট হয়নি। তাই সৃজিতবাবুর সিরিজে পুলক ঘোষাল জটায়ুর নারীচরিত্রহীন উপন্যাসের চিত্রনাট্যে নায়িকা আমদানি করার যুক্তি হিসাবে খাড়া করছেন শরদিন্দুর সত্যান্বেষীর বিবাহিত জীবনকে। আবার রহস্যোদ্ঘাটনের দৃশ্যে স্বয়ং ফেলুদা বলছেন চিত্রচোর গল্পের সঙ্গে নাকি বিরূপাক্ষ হত্যার ঘটনার মিল আছে। মিলটি যে কী তা আমার খাটো বুদ্ধিতে ধরা পড়ল না। শরদিন্দুর গল্পের অপরাধী তার পুরনো চেহারাটা গায়েব করার জন্য ছবি চুরি করেছিল। এ গল্পের অপরাধী তো বুঝতেই পারেনি তার একখানা পুরনো চেহারার ছবি রয়েছে নয়নপুর ভিলায়। অবশ্য আমাদের মত দর্শকের বুদ্ধির দৌড় কতটুকু তা নির্দেশক ভালই জানেন। তাই ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যগুলি বার তিনেক করে না দেখিয়ে ক্ষান্ত দেননি। বিরূপাক্ষবাবুর বুকে ছুরি মারার শটটি যে কতবার কতভাবে দেখিয়েছেন তা গুনতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।

নস্ট্যালজিয়া ছাড়া আর যে জিনিসটি এখন সেলিং লাইক হট কচুরিজ, সেটি হল গোয়েন্দা গল্প। এই দুয়ের চাপে এই সিরিজের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছেন। তাঁর নাম অনির্বাণ চক্রবর্তী। সবে গত মাসে মুক্তি পেয়েছে আরেক গোয়েন্দার কীর্তিকলাপ নিয়ে ছবি দ্য একেন। সেই ছবিতে অনির্বাণ নিজেই গোয়েন্দা। এমন একজন গোয়েন্দা যিনি বিলক্ষণ ভাঁড়ামি করেন। বাংলা প্রবাদ বলতে ভুল করেন, হাস্যকর হিন্দি বলেন। দুটি ছবিরই প্রেক্ষাপট দার্জিলিং, লোকেশনেও মিল। অনেক ফ্রেমে মনে হয় একই ছবি দেখছি। কে জানে, হয়ত শুটিংও কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। এই ডামাডোলে অনির্বাণ একেনবাবুই থেকে গেছেন, লালমোহনবাবু হয়ে উঠতে পারেননি। জটায়ু যে ভাঁড় নন তা অভিনেতা বা নির্দেশক কেউই বুঝে উঠতে পারেননি মনে হয়। বিশেষ করে অঘোরচাঁদ বাটলিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করার সময়ে অনির্বাণ যা করেছেন তা সিনেমা কেন, যাত্রার মঞ্চেও বিসদৃশ লাগে। অবশ্য বিরূপাক্ষ মজুমদারের চরিত্রে বরুণ চন্দ, মহাদেব ভার্মার চরিত্রে সুব্রত দত্ত ইন্সপেক্টর যতীশ সাহার চরিত্রে লোকনাথ দে আর সুচন্দ্রার চরিত্রে মুনমুন রায় ছাড়া এই সিরিজে প্রায় সকলেই বাড়াবাড়ি করেছেন।

ফেলুদার চরিত্রে টোটাকে দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিড়িয়াখানায় চিতাবাঘকে প্রায় কামড়াতে যাওয়া ফেলুদাকে তো মানায় না বটেই, কোনো শিক্ষিত মানুষকেই মানায় না। সোনার কেল্লায় মুকুল ভবানন্দকে দুষ্টু লোক বলে চিনতে পেরেছিল তখন, যখন সে ময়ূরের দিকে গুলি চালায়। জীবজগতের প্রতি এই সংবেদনশীলতা গোটা রায় পরিবারের অভিজ্ঞান। লীলা মজুমদারের ‘কুঁকড়ো’ গল্পেও যার প্রমাণ রয়েছে। ফেলুদাকে হি-ম্যান বানাতে গিয়ে সেই সংবেদনশীলতার জায়গায় আলিপুর চিড়িয়াখানায় যারা বাঘের খাঁচায় ঢুকে তাকে মালা পরাতে গিয়েছিল, তাদের মানসিকতা এনে ফেলা হয়েছে। সন্দীপ রায়ের ফেলুদাও অনেকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন না, কিন্তু নিদেনপক্ষে তাঁর ফেলুদা সলমন খান বা টাইগার শ্রফ মার্কা মোটা দাগের অ্যাকশন হিরো হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন না। সৃজিতের ফেলুদা যদি পেশিবহুল চেহারার, বাঘ সিংহের সাথে লড়াই করা পুরোদস্তুর একটি নতুন চরিত্র হয়ে উঠতেন, তাহলেও কথা ছিল। ভাবা যেত বিবিসির শার্লক সিরিজের মত নতুন কিছু হল। কিন্তু এক পা নস্ট্যালজিয়ার সেপিয়া নৌকায় রেখে অন্য পা হাস্যকর মাচোইজমে রাখা এই টলমলে ট্রিবিউট আপন মনে গাওয়ার মত শীর্ষ সঙ্গীতটি ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র জগৎকে কী দিল?

https://nagorik.net এ প্রকাশিত