বল্লভপুরের রূপকথা: খাঁটি বাংলা ছবি

হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল, এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

রূপকথা

এক গল্প হাজারবার বললে সে আর এক গল্প থাকে না, পালটে পালটে যায়। মানুষের জীবনের মত। এক চরিত্রের মুখ দিয়ে এই কথাটি পরিচালক ছবির শুরুতেই বলে দিয়েছেন। তাই বাদল সরকারের নাটক দেখা না থাকলেও বল্লভপুরের রূপকথা দেখতে অসুবিধা হয় না। আমরা দুর্ভাগা প্রজন্ম। বাদল সরকারের নামটুকুই শুনেছি, কেউ কেউ তা-ও শুনিনি। আমরা কেবল সত্যজিৎ রায়কে চিনি। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য যথার্থই অনুমান করেছিলেন, হলে ঢুকে আমরা কেউ সঙ্গের দর্শককে জিজ্ঞেস করে ফেলতেই পারি “বাদল সরকারটা আবার কে?” তাই গোড়াতেই সেসব দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রফেসর শঙ্কুর মত দেখতে লোকটি যে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যশিল্পী তা সিনেমা দেখতে গিয়ে জানা হয়ে গেল।

পরিচালকের বুকের পাটা দেখে অবাক হতে হয়। মেগাসিরিয়ালে অভ্যস্ত দর্শককে তিনি একে তো বাদল সরকার চেনাচ্ছেন, তার উপর আবার আখ্যান সম্বন্ধে সচেতন করছেন! মিশকালো অন্ধকারে নৌকো বাইতে বাইতে যে মাঝি আখ্যান সম্পর্কে ওই চিরসত্য উচ্চারণ করছে তার নাম রসিক। অরসিকের কাছে রস নিবেদন করার দুর্ভাগ্য যেন আমার না হয় – বিধাতার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন প্রাচীন কবি। অনির্বাণ সে ঝুঁকি নিয়েছেন। তাঁর এত আয়োজন বৃথা যেত যদি বিদেশি ছবি থেকে বাদল সরকারের হাত ঘুরে তাঁর কাছে আসা আখ্যানটিকে রসোত্তীর্ণ করতে না পারতেন। সে পরীক্ষায় তিনি সফল। তাঁর আখ্যান রসে টইটম্বুর। হলভর্তি দর্শক প্রায়ই হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এ ছবি একটিমাত্র রস পরিবেশন করেনি। এমনকি হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল (pun), এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট অধিনায়কদের একজন, সৌরভ গাঙ্গুলি, একটা কথা খুব বলে থাকেন – একজন অধিনায়ক ততটাই ভাল, যতটা ভাল তাঁর দল। কথাটা চলচ্চিত্র পরিচালকের বেলাতেও বোধহয় খানিকটা খাটে। যে পরিচালকের হাতে বাদল সরকারের লেখা সংলাপ, সত্যম ভট্টাচার্য (ভূপতি), শ্যামল চক্রবর্তী (মনোহর), দেবরাজ ভট্টাচার্যের (সঞ্জীব) মত উৎকৃষ্ট অভিনেতা থাকেন, তাঁকে হাস্যরসের জন্য ইদানীংকালের বাংলা ছবিতে ব্যবহৃত উপরে উল্লিখিত মধ্যমেধার কৌশলগুলোর কাছে হাত পাততে হবেই বা কেন? তবে ক্রিকেট দলের অধিনায়কের একটা সুবিধা থাকে যা পরিচালকের নেই। দলের ব্যর্থতায় নেহাত প্যাঁচে পড়লে অধিনায়ক নির্বাচকদের ঘাড়েও কিছুটা দায় চাপিয়ে দিতে পারেন, পরিচালকের সে উপায় নেই। অনির্বাণ থিয়েটারের অভিনেতাদের নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। ফেল করলে কারোর দিকে আঙুল তোলার উপায় থাকত না। কিন্তু তাঁর নির্বাচিত অভিনেতারা প্রত্যেকেই চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ের মত খেলেছেন।

অনিবার্যভাবে মনে পড়ে সদ্যপ্রয়াত তরুণ মজুমদারের কথা। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগে অনুপকুমারকে নায়কের চরিত্রে রেখে তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলা ছবির ইতিহাসে সর্বকালের সেরা হিট ছবিগুলোর অন্যতম – পলাতক (১৯৬৩)। স্রেফ শক্তিশালী চিত্রনাট্য আর অভিনয় দক্ষতা হিট ছবির রসায়ন হতে পারে তার অকাট্য প্রমাণ। অনির্বাণও তারকাবিহীন, এমনকি রুপোলি পর্দার অভিনেতাবিহীন ছবি করেছেন। তরুণের সময়ে তবু টলিউড সংকটাপন্ন ছিল না। এখন কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছবি যদি শেষপর্যন্ত বিপুল সংখ্যক দর্শকের আশীর্বাদধন্য হয়, তাহলে কী করলে ছবি হিট হয়, সে প্রশ্ন নতুন করে ভাবতে হবে সকলকেই। শীর্ষ মন্তাজেই ইঙ্গিত রয়েছে – গোয়েন্দা, ভূত, নস্ট্যালজিয়া সবই কপচানো হয়ে গেছে। কোনোটাই বিশেষ কাজ দেয়নি। তরুণ পারতেন রুচিসম্মত অথচ জনপ্রিয় ছবি তৈরি করতে। সে ছবি সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনের উচ্চতার শিল্প হত না হয়ত। কিন্তু স্রেফ শহুরে ও অনাবাসী বাঙালি দর্শকের জন্য তৈরি চলচ্চিত্রোৎসবমুখী ভানও তাতে থাকত না। একইসঙ্গে গ্রাম ও শহরের দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারে, এমন বাংলা ছবি বিশ-তিরিশ বছর হল তৈরিই হয় না। অভিজ্ঞরা বলেন অমন ছবি নাকি সম্ভবই নয়, কারণ গ্রাম আর শহরের দর্শকের রুচির তফাত বিস্তর। অথচ বিশ্বায়নের যুগে গোটা দুনিয়াটাই গ্লোবাল ভিলেজ – এমনটাই তো জেনে আসছি। বাস্তবিক দার্জিলিং থেকে মেদিনীপুর – সর্বত্রই তো পৌঁছে গেছে ওটিটি। তবু? বল্লভপুরের রূপকথা আখ্যানে এবং উপস্থাপনে গ্রাম, শহরের সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছে। দেখা যাক তা সফল হয় কিনা।

অভিনয়ের কথা হচ্ছিল। ছবি দাঁড়িয়ে আছে ভূপতি, ছন্দা (সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়), মনোহর আর সঞ্জীবের চরিত্রের উপর ভর দিয়ে। তাঁদের অভিনয় তো নিখুঁত বটেই, ছোটখাটো চরিত্রগুলোতেও এত নির্মেদ অভিনয় আজকাল বাংলা ছবিতে সুলভ নয়। ভূপতির তিন পাওনাদার সাহা (কৃপাবিন্দু চৌধুরী), শ্রীনাথ (সুরজিৎ সরকার) আর পবনের (সুমন্ত রায়) সংলাপ বলার ঢং, হাঁটাচলা, তাকানো – সবকিছুই হাসির উদ্রেক করেছে। অথচ যথেষ্ট অবকাশ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অতি-অভিনয় করেননি। ইংরেজিতে যাকে কমিক টাইমিং বলে তাতে অবশ্য সবার উপরে মনোহর চরিত্রে শ্যামল। গোটা ছবিতে তিনি ভাবলেশহীন মুখে আর সকলকে হাসিয়ে গেলেন।

সত্যম চারশো বছর আগেকার রোম্যান্টিক, কালিদাস আওড়ানো, জমকালো পোশাক পরা রাজপুত্রের চরিত্রে যতটা সাবলীল, ততটাই দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা রায়বাড়ির প্রথম গামছা পরে ঘুমনো রাজা হিসাবে। এমনকি শুধু ভূপতির চরিত্রেও তিনি প্রয়োজনমাফিক সপ্রতিভ এবং অপ্রতিভ। কাজটা মোটেই সহজ নয়। বিশেষ করে ব্যোমকেশ আর ফেলুদার চরিত্রের একইরকম অভিনয় দেখে অভ্যস্ত চোখে সত্যমকে দেখে বলতে ইচ্ছে করে “বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে”।

দেবরাজ ভূতের ভয়ে কাবু, মিসেস হালদারের বকুনিতে ক্যাবলা অথচ বন্ধুর প্রতি আনুগত্যে অবিচল চরিত্রে দারুণ বিশ্বাসযোগ্য। অমন অভিনয় করতে পারেন আবার চমৎকার গাইতেও পারেন – এমন শিল্পী কজন পাওয়া যায়?

ওপেন টি বায়োস্কোপ ছবির নেহাত বালিকা সুরঙ্গনা এ ছবিতে গত শতকের ছয়ের দশকের লাবণ্যময়ী বাঙালি মেয়ে ছন্দার চরিত্রে দারুণ মানিয়ে গেছেন। সে শুধু তাঁর সৌন্দর্য, শাড়ি পরার ধরন বা চুল বাঁধার কায়দার জন্যে নয়। যে চোখের ভাষা সেরা সময়ের রোম্যান্টিক বাংলা ছবির নায়িকাদের অব্যর্থ অস্ত্র ছিল, সেই ভাষায় সুরঙ্গনার চোখ বারবার কথা বলেছে। পাশে দাঁড়ানো পুরুষটিকে নিজের ভাললাগা জানানোর জন্য বেশি কিছু নয়, স্রেফ তার মত দেখতে পূর্বপুরুষের পোর্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে “সুপুরুষ” বলে আড়চোখে তাকিয়ে নেওয়ার নৈপুণ্য সুরঙ্গনা চমৎকার রপ্ত করেছেন। বাঙালির প্রেমের অভিজ্ঞান, অন্তত সিনেমার পর্দায়, একসময় ছিল তার সূক্ষ্মতা। নায়িকারা সরাসরি নায়কের দিকে তাকাতেন না বা আগ বাড়িয়ে চুমু খেতেন না বলে যে ন্যাকা ছিলেন তা নয়। পাঁচের দশকেই শাপমোচন ছবিতে অবিবাহিতা সুচিত্রা সেন সটান বাবার সামনে দাদাকে জানিয়ে দিচ্ছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করতে যান কারণ “তিনি আমার স্বামী”। আবার পথে হল দেরী ছবিতে তাঁর চেয়ে নায়কের দৃষ্টিই লজ্জায় বেশি থরোথরো। সত্যমকে ধমকে দেওয়ার দৃশ্যে সুরঙ্গনাকেও তেমনই দৃঢ়চেতা দেখিয়েছে।

আরও পড়ুন অহৈতুকী পার্টিজানপ্রীতি

বল্লভপুরের রূপকথা ছবিটির এই এক মজা। আপাতদৃষ্টিতে নতুন কিছুই নেই। যা আছে তা হল বাংলা ছবির, বাংলার সংস্কৃতির চিরনতুন কিছু উপাদান যা মানুষের সর্বদা ভাল লাগে। নায়ক, নায়কের অভিভাবকসুলভ বৃদ্ধ চাকর, প্রাণের বন্ধু, নায়িকার শৌখিন এবং আধক্ষ্যাপা বাবা, জাঁদরেল মা, বাবার সঙ্গে রেষারেষি থাকা এক বুড়ো ধনী – এর কোনোটাই কি বাংলা ছবির দর্শকের কাছে নতুন? পরিচালক অনির্বাণ বা অন্যরা প্রচার পর্বে কোথাও বলেননি, অথচ দেখা গেল ছবিটি পিরিয়ড পিসও বটে। মূল নাটকের মত গত শতকের ছয়ের দশকই দেখানো হয়েছে। সেই সময়কার পোশাক-আশাক, কথা বলার ধরন, গাড়ির মডেল সবই নিখুঁত। এমনকি ছবির সঙ্গীত পর্যন্ত বাংলা গানের হারিয়ে যাওয়া মেলডির সন্ধান দেয়। অনির্বাণ, দেবরাজ, শুভদীপের সৃষ্টি ‘সাজো সাজাও এমন করে’ সাহানা বাজপেয়ীর গলায় এমন মধু ঝরায় যে সুরটি ছবি শেষ হওয়ার বহুক্ষণ পরেও কোথা থেকে যেন কানে ভেসে আসে। যন্ত্রসঙ্গীতের ঝমঝম আওয়াজে পূর্ণ খোনা গলার আধুনিক বাংলা সিনেমার গান তো শুনি আর ভুলে যাই প্রায় সহজেই। ছবির আবহসঙ্গীত পর্যন্ত আজকের বলে মনে হয় না, ভয়ের ছবির পরিবেশ সৃষ্টিকারী চেনা শব্দসম্ভারই ফিরে ফিরে আসে। যদিও তাতে ভয়ের পরিবেশ কতটা তৈরি করা গেছে তাতে সন্দেহ আছে। এই এক সমালোচনার জায়গা।

তবে চলচ্চিত্র তো শেষপর্যন্ত চিত্র। মনে রাখার মত কিছু শট না থাকলে চলে না। সেখানে সোনা ফলিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার। তাঁর তৈরি অন্ধকার ঘুরঘুট্টি বটে, কিন্তু তার মধ্যেও জঙ্গলের প্রত্যেকটি গাছ আলাদা করে দেখা যায়। দিনের বেলার শটগুলোতেও আউটডোর লোকেশনের সৌন্দর্য তাঁর ক্যামেরা চেটেপুটে নিয়েছে। তবে ভোলা যায় না বল্লভপুরের রাজবাড়িতে প্রথম পদক্ষেপের সময়ে সিনেমার পর্দা জুড়ে থাকা অন্ধকারের মধ্যে উদ্ভাসিত ছন্দার মুখের ক্লোজ আপ।

বল্লভপুরের রূপকথা শস্তা নয়, সহজ। চটকদার নয়, রংদার। নতুন নয়, চিরচেনা। পরিচালক অনির্বাণের সবচেয়ে বড় গুণ – তিনি একটি খাঁটি বাংলা ছবি বানিয়েছেন। এখানে বাঙালিকে বাঙালি বলে চেনা যায়। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল হাইরাইজ, হাইওয়ে, স্কচ আর পরকীয়ায় হারিয়ে যায়নি। হৃদয় ঘেঁটে দেখা গেছে কোথায় পাতা শীতলপাটি। ছবির শুরুতে আখ্যান সম্পর্কে যে চিরসত্য মাঝি রসিক তার পীর ঠাকুর্দার উক্তি বলে উল্লেখ করেছে, সেই সত্যই আবার শেষে দোকানদার পবন তার সন্ন্যাসীপ্রতিম ঠাকুর্দার উক্তি বলে ঘোষণা করেছে। অতি সহজে, প্রায় অলক্ষ্যে পরিচালক বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক সমন্বয় দেখিয়ে দিলেন। পুরনো কথাও বারবার বলতে হয়, বলতে বলতে নতুন হয়ে ওঠে। সেই নতুনত্বের খোঁজে বেরিয়েছেন অনির্বাণ। একেবারে শেষে দেখা গেছে তিনি নিজেকে নিয়েও রসিকতা করতে পারেন। এই ক্ষমতা যদি ধরে রাখতে পারেন তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভাল কিছু আশা করা যায়।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

One thought on “বল্লভপুরের রূপকথা: খাঁটি বাংলা ছবি”

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading