সেতু ভাঙলেও টাল খায় না গুজরাট মডেল

গুজরাট

সারা দেশের ভদ্রলোক শ্রেণি গুজরাট বলতে অজ্ঞান। কি চমৎকার রাস্তা! সবরমতীর ধারটা কি দারুণ করেছে! লোকের কত টাকা! দিল্লি থেকে কন্যাকুমারী – সর্বত্রই মুগ্ধতার কারণগুলো মোটামুটি এক। বাঙালি ভদ্রজনের মুগ্ধতার দুটো অতিরিক্ত কারণ আছে – ১) ওখানে কত ইন্ডাস্ট্রি, ২) ওখানে কেউ চাকরি বাকরি নিয়ে মাথায় ঘামায় না, সবাই ব্যবসা করে। এই মুগ্ধ জনতার সাথে খানিকক্ষণ কথা বললেই টের পাওয়া যায় এঁরা গুজরাট বলতে বোঝেন আমেদাবাদ, বড়জোর ভদোদরা। তলিয়ে জিজ্ঞেস করলে বেরিয়ে পড়ে বেড়াতে গিয়ে আমেদাবাদের বাইরে কেবল গির অরণ্যের সিংহ দেখেছেন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বলতেও এঁরা কলকাতাই বোঝেন, মহারাষ্ট্র বলতে মুম্বাই। ফলে বামপন্থী বা ডানপন্থী যা-ই হোন, গুজরাট মডেলে এঁদের অগাধ আস্থা। তবে স্বপ্নের গুজরাটে বেমক্কা সেতু ভেঙে পড়লে কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েন।

মোরবিতে মেরামতির জন্য সাত মাস বন্ধ থাকা সেতু দিন পাঁচেক হল খোলা হয়েছিল, রবিবার ভর সন্ধেবেলা ভেঙে পড়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে খুলে দেওয়ার আগে নাকি সুরক্ষা শংসাপত্রও নেওয়া হয়নি। উন্নয়নের গুজরাট বলে কথা, উন্নয়ন কি আর লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রাখা যায়? কর্মবীর নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য। কয়েক হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি ডুবে যাবে জেনেও যেখানে সর্দার সরোবর বাঁধ তৈরি করা হয় বহু বছরের আন্দোলন দুরমুশ করে দিয়ে।

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন পর্যন্ত শ দেড়েক মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। তাতে কী-ই বা এসে গেল? গুজরাটে অনেক কাজ হয়, তার মধ্যে খানিকটা দুর্নীতি তো হবেই। আমাদের এখানে তো কাজই হয় না – এমন ধারণা দিয়েই অনেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা করবেন সন্দেহ নেই। আসলে উন্নয়ন মানে যে শহরের উন্নয়ন; অর্থাৎ ফ্লাইওভার, রাস্তা, সেতু, পার্ক, রেলিং, ফুটপাথ নির্মাণ – একথাই আমরা শিখেছি। অমর্ত্য সেন বাঙালি বলে আমাদের দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু তিনি উন্নয়নের যে অন্যতর সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে আমাদের আগ্রহ নেই। তাঁর কাজের ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদ মহবুব উল হকের তৈরি হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে গুজরাট সচরাচর মাঝের সারির উপরে উঠতে পারে না। ২০২১ সালেও অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ সমেত ১৯ রাজ্যের সঙ্গে গুজরাট মিডিয়াম এইচডিআই ক্যাটেগরিতেই ছিল। সে রাজ্যের অনেক জায়গায় যে ছেলেমেয়েরা সাঁতরে নদী পেরিয়ে স্কুলে যায়, শিক্ষার হাল ভাল নয়, স্বাস্থ্যের হাল ভাল নয় – এসব খবরও বাসি। কিন্তু ওসবে আমরা আমল দেব কেন? পেল্লাই কারখানা হলেই যে প্রচুর কর্মসংস্থান হয় না, উন্নয়ন হয় না সেসব আমরা এখনো টের পাইনি যে। তাই তো পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর এখনো রাজনৈতিক চাপান উতোরের বিষয়।

আরও পড়ুন কী ঢাকছে সরকারি চোলি? কেনই বা ঢাকছে?

সংবাদসংস্থা আইএএনএস জুন মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, গুজরাটে বেকার সমস্যা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে গ্রাম পঞ্চায়েতের এক্সিকিউটিভ প্রধানের ৩৪০০ শূন্য পদে চাকরির জন্য ১৭ লক্ষ আবেদন পত্র জমা পড়েছিল। কিন্তু গুজরাট বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনের প্রচারের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায় ওসব কোনো ইস্যু নয়। ইস্যু হল হিন্দুত্ব। অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলছেন টাকায় লক্ষ্মী, গণেশের ছবি ছাপানো উচিত আর বিজেপির বিদায়ী মন্ত্রিসভা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার জন্য কমিটি গঠন করছে। সেতু ভেঙে পড়া এমন কী ব্যাপার? জীবন মৃত্যু তো ভগবানের হাতে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading