লিয়েন্ডার মনে রাখতে পারেন জয়পাল সিং মুন্ডাকে

লিয়েন্ডার

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অন্তত একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। বলেছিলেন, খেলা হবে। তা সারাক্ষণই খেলা হচ্ছে। কেবল রাজনীতিবিদ নয়, সত্যিকারের খেলোয়াড়দেরও টেনে আনা হচ্ছে এই খেলায়। বাংলার ক্রিকেট দলের দুই প্রাক্তন অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্লা আর মনোজ তিওয়ারি আগেই তৃণমূল কংগ্রেসের ঘর আলো করে ছিলেন। লক্ষ্মী মন্ত্রী হয়েছেন, মনোজ বিধায়ক। প্রবীণ ফুটবলার প্রসূন ব্যানার্জি সাংসদ হয়েছেন, অপেক্ষাকৃত নবীন দীপেন্দু বিশ্বাসও তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক হয়েছেন। পরে দলে থেকে কাজ করতে না পেরে বিজেপিতে চলে গেছেন। কোনোদিন হয়ত, প্রয়াত অশোক মিত্রের ভাষায়, সন্ধের কনে দেখা আলোয় ফিরেও আসবেন। কিন্তু গতকাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা করেছেন, তার তুল্য ঘটনা খুব বেশি নেই। অলিম্পিকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে পদক জেতা ভারতীয়ের সংখ্যা হাতে গোনা। ওই কৃতিত্ব প্রথম যিনি অর্জন করেছিলেন, সেই লিয়েন্ডার পেজকে মমতা নিজের পার্টিতে নিয়ে এসেছেন

লন্ডন অলিম্পিকে বোঞ্জ পদক জয়ী কুস্তিগির যোগেশ্বর দত্ত বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বেজিং অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী বক্সার বিজেন্দর সিং আবার কংগ্রেসে। এথেন্স অলিম্পিকে শুটিংয়ে রুপো জেতা রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর শুধু বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন নয়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। কিন্তু এঁরা কেউই কংগ্রেস আর বিজেপির বাইরে যাননি। লিয়েন্ডারকে মমতা একটি আঞ্চলিক দলে নিয়ে এলেন।

এলেন তো, কিন্তু করবেন কী? কেবল অলিম্পিয়ান নয়, ভারতের ফুটবল, ক্রিকেট দলের বহু তারকাই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন; মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক হয়েছেন। শচীন তেণ্ডুলকরের মত কেউ কেউ কোনো দলে যোগ না দিলেও রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হয়েছেন। কিন্তু করেছেন কী? দেশের মানুষের কী উপকার হয়েছে তাঁদের রাজনীতির ময়দানে আসায়? প্রাক্তন ক্রিকেটারদের রাজনীতিতে অবদান তো মনে করাই মুশকিল। মনসুর আলি খান পতৌদি খোদ ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। কুড়ি বছর পরে ইন্দিরার পার্টির টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও সুবিধা হয়নি। কীর্তি আজাদ, চেতন চৌহান রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দিল্লির ক্রিকেটের রাজনীতিবিদদের উদরস্থ হওয়া পর্যন্ত বাঁচাতে পারেননি। মহম্মদ আজহারউদ্দিন সাংসদ হিসাবে স্মরণীয় কিছু করেছিলেন এমন দাবি নিজেও করবেন না। হালের নভজ্যোৎ সিং সিধু এখনো বেশি জনপ্রিয় ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জের বিচারক হিসাবে।

আরও পড়ুন ভারতীয় দলের জার্সি এখন বিজেপির সম্পত্তি

স্রেফ হিসাব রাখার স্বার্থে বাইচুং ভুটিয়া, পারগত সিংয়ের মত অনেকের নাম করা যায়। পদাধিকারী হওয়া যদি রাজনীতিতে সাফল্য বলে ধরা হয় তাহলে অবশ্য প্রাক্তন খেলোয়াড়দের অনেকেই সফল। হয়ত সেই সাফল্যই তাঁদের লক্ষ্য ছিল। তাই কোনো ছোট দলে নয়, হয় কংগ্রেসে বা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। বড় দলের টিকিটে জেতার সম্ভাবনা বেশি, জিতলে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগও আসতে পারে। সেই যুক্তিতে লিয়েন্ডার বঙ্গ তৃণমূলে যোগ দিলে না হয় বোঝা যেত। গোয়া বিধানসভায় তৃণমূলের টিকিটে জিতে কি মন্ত্রী হওয়া যাবে? ভবিষ্যৎ বলবে।

খেলা থেকে রাজনীতিতে গিয়ে কোনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন, এমন লোকের কথা ভাবতে গেলে আজও কিন্তু একজনের কথাই মনে আসে — আদিবাসী মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা জয়পাল সিং মুন্ডা। ১৯০৩ সালে তৎকালীন বিহারের খুঁটি জেলায় জন্মানো এই আদিবাসী নেতা ১৯২৮ অলিম্পিকে সোনা জয়ী ভারতীয় দলকে লিগ স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যদিও নকআউট ম্যাচগুলোতে খেলেননি। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার আগে থেকে তিনি আদিবাসীদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবি জানিয়ে গেছেন। সে দাবি পূর্ণ হয়েছে তাঁর মৃত্যুরও তিন দশক পরে। ভারতের সংবিধান সভার সদস্য হিসাবে এক স্মরণীয় বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, আমার মত মানুষদের পুরো ইতিহাসটাই হল অনাদিবাসীদের দ্বারা অবিরাম শোষিত ও স্থানচ্যুত হওয়ার ইতিহাস। মাঝে মাঝে কিছু বিদ্রোহ আর বিশৃঙ্খলার ইতিহাস। তবু আমি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কথায় বিশ্বাস রাখছি। আপনাদের সবার এই কথায় বিশ্বাস রাখছি, যে আমরা স্বাধীন ভারতে একটা নতুন অধ্যায় শুরু করব, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে, আর কেউ অবহেলিত হবে না।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading