ভো ভো ভদ্রসন্তান

কী হয় পঞ্চায়েত দিয়ে? যে ভদ্রসন্তান পেটে বোম মারলেও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিনটে স্তর কী কী বলতে পারবে না, সেও জানে পঞ্চায়েতের কোন কাজ নেই। বামফ্রন্ট সরকার এইটে বানিয়েছিল কেবল টাকা মারার জন্যে। কী দরকার এমন ভোটের? তুলে দিলেই হয়। এই যে ক্যানিং লোকালে ভদ্রসন্তানদের বাড়ি রান্না করতে আসা, বাসন মাজতে আসা ছোটলোকগুলো তিন চারদিন কামাই দেয় পঞ্চায়েতে ভোট দেবে বলে —- এর দরকারটা কী রে ভাই? এইসব ছোটলোক গণতন্ত্রের বোঝেটা কী? পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো করার মধ্যে করেছে এই যে এদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে। ছোটলোকেরা অনেকে গ্রামের ভদ্রসন্তানদের টপকে প্রধান টধান হয়েছে। তা এ কি আর ভাল ব্যবস্থা রে বাপু?

শেষপর্যন্ত এক মাস্টারমশাইকে মরতে হল ভদ্রসন্তানদের “এসব আগেও হয়েছে” র এলায়িত ঔদাসীন্য থেকে জাগানোর জন্যে। হতভাগ্য প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমার রায় মরিয়া প্রমাণ করিলেন ভদ্রসন্তানগণের চেতনা মরে নাই। তাঁহারা আজিও নির্বাচনী হিংসার জন্যে সরকারকে দায়ী করিয়া গালাগাল করিতে সক্ষম।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়কার হিংসাটা নেহাত বিসদৃশ লাগায় একটু “উঃ আঃ” করতেই হচ্ছিল। তবু “এরা আসলে সিপিএমের মত সংগঠিত না তো, তাই একটু বেশি উগ্র” এসব বলে চালানো হচ্ছিল। মনোনয়ন জমা দেওয়া মিটে যেতেই ভদ্রসন্তানদের ভারী নিশ্চিন্দিভাব এসেছিল। কাগজে বেরিয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত বেশি আসন শাসক দল কখনো জেতেনি তাই খানিকটা নিন্দেমন্দ না করে উপায় ছিল না। শিক্ষিত লোক হিসাবে সমাজে একটা পরিচিতি আছে তো। এরপর তো নির্বাচন আর নির্বাচনে তো মারামারি, বোমাবাজি, খুন হয়েছে অনেক। অতএব ওতে সরকারের দোষ হয় না। নিন্দে করার দায়িত্বও নেই ভদ্রজনের।
তার চেয়ে বড় কথা যে মরল সে তো হয় এ পার্টির লোক, নয় ও পার্টির লোক। তারা তো আর কারো মা, বাপ, ভাই, বোন, ছেলেপুলে নয়। পার্টি তো করে অশিক্ষিতরা, যাদের শিক্ষিতদের মত স্বার্থপর হয়ে বাঁচার সুযোগ নেই। অতএব তারা মরলে ভদ্রসন্তানের কী-ই বা এসে যায়? ও তাপসী মালিকই বলুন আর দেবু দাস, ঊষা দাসই বলুন, ভদ্রসন্তান হলে কি আর রাজনীতির মধ্যে যেত? চেতন ভগতের কথামত নিজের কেরিয়ার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে জমাটি একখান চাকরি জুটিয়ে সক্কলের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। অতএব পরিবর্তনের সরকার ভাল সরকার। যতই লোক মারুক আর গণতন্ত্রের মা-মাসি করুক, ভি আই পি রোডটা কংক্রিটে আর রেলিঙে মুড়ে দিয়েছে, এত আলো লাগিয়েছে যে ছেলেমেয়েরা চুমু খাওয়ার আড়াল পাচ্ছে না, স্কুলমাস্টারগুলো কোন কাজ করত না, তাদের ঘাড়ে কন্যাশ্রী থেকে দিদিশ্রী সব চাপিয়ে দিয়ে খুব টাইট দিয়েছে। আর কী চাই? একেই তো বলে উন্নয়ন। কেন হিংসার প্রতিবাদ করতে যাবে ভদ্রসন্তান? এত উন্নয়নের বদলে নাহয় এক ভাই এক কবিকে দিলই দুটো গাল। কবিকে কে বলেছিল পার্টির লোকের মত কবিতা লিখতে? তিনি যদি ভদ্রসন্তানোচিত কাজ কোনগুলো সেটা ভুলে মেরে দেন, সেটা বুড়ো বয়সের ভীমরতি। তার জন্যে সরকারকে কেন গাল দেবে? সর্বেসর্বা মুখ্যমন্ত্রীকেই বা কেন দোষ দেবে?
তবু নয় ভেবে দেখা যেত যদি ভোটটা লোকসভা কি বিধানসভার হত। কিসের ভোট? না পঞ্চায়েতের। কী হয় পঞ্চায়েত দিয়ে? যে ভদ্রসন্তান পেটে বোম মারলেও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিনটে স্তর কী কী বলতে পারবে না, সেও জানে পঞ্চায়েতের কোন কাজ নেই। বামফ্রন্ট সরকার এইটে বানিয়েছিল কেবল টাকা মারার জন্যে। কী দরকার এমন ভোটের? তুলে দিলেই হয়। এই যে ক্যানিং লোকালে ভদ্রসন্তানদের বাড়ি রান্না করতে আসা, বাসন মাজতে আসা ছোটলোকগুলো তিন চারদিন কামাই দেয় পঞ্চায়েতে ভোট দেবে বলে —- এর দরকারটা কী রে ভাই? এইসব ছোটলোক গণতন্ত্রের বোঝেটা কী? পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো করার মধ্যে করেছে এই যে এদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে। ছোটলোকেরা অনেকে গ্রামের ভদ্রসন্তানদের টপকে প্রধান টধান হয়েছে। তা এ কি আর ভাল ব্যবস্থা রে বাপু? যেমন করেছিল পেছন পাকা কমিউনিস্টের দল, এখন ফল ভুগছে।
এ নিয়ে শহর, মফঃস্বল, গ্রাম সব জায়গার ভদ্রসন্তানেরাই একমত ছিলেন দুদিন আগে অব্দি। গোলমাল পাকালেন তাদেরই একজন। প্রিসাইডিং অফিসার হয়েছেন ভাল কথা, “আগেও হয়েছে” মন্ত্র জপে বুথে গিয়ে চোখকান বুঁজে থাকলেই চুকে যেত। কিন্তু এই চরম নীতিহীনতার যুগেও থাকে কিছু কিছু নীতিবাগীশ বোকার হদ্দ। এরা ভাবে ছাত্রদের সামনে অনুকরণীয় চরিত্র হয়ে ওঠাটা শিক্ষকের কাজের মধ্যে পড়ে। এই ভদ্রলোক সম্ভবত ঐ দলে। এই ধরণের লোকের সমস্যা হচ্ছে মেরুদণ্ড বলে জিনিসটা এখনো নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়নি আমাদের মত। ফলে সাহসটা অসম্ভব বেশি। লাঠিসোটা, টাঙ্গি, বন্দুক — যা-ই দেখাও না কেন, এদের ভয় পাওয়ানো মুশকিল। তা শক্ত মেরুদণ্ড তো অধুনা একটি রোগবিশেষ। সে রোগে শেষ অব্দি যা হয় তাই হয়েছে আর কি। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি চমকপ্রদ। দৃশ্যত মার খেলেন এস ডি ও, তবে আসলে চড়চাপড়গুলো কার উদ্দেশে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং প্রত্যেকটি চড় তিনি অর্জন করেছেন।
মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যু অনেক ছাত্রকে জাগিয়ে তুলেছে দেখে ভাল লাগছে। এই দারুণ দুঃসময়ে আমরা এতই দ্বিধাবিভক্ত যে ডাক্তার মার খেলে শুধু ডাক্তাররা প্রতিবাদ করেন, রাজনৈতিক কর্মী মার খেলে শুধু তার দলের লোকেরাই প্রতিবাদ করে, শিক্ষক মার খেলে শুধু শিক্ষক সমিতি প্রতিবাদ করে, ছাত্ররা মার খেলেও সেটা শুধু তাদের সমস্যা, সাংবাদিক মার খেলে… যাকগে। কথা হচ্ছে এই ব্যাপারটা শাসকও বুঝে ফেলেছে। ফলে প্রতিবাদীদের গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দেয়। জানে ঐটে করে দিলেই তারা আর কারো থেকে কোন সহানুভূতি, সমর্থন পাবে না। এবারে যেমন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সরকার লেবেল দিয়েছে “ওরা তো ভোটকর্মী নয়, শিক্ষকও নয়। ওরা এবিটিএ।” কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেমন বলে আর কি “ওরা তো ছাত্র নয়, ওরা বামপন্থী ছাত্র”, “ওরা তো কৃষক নয়, ওরা সিপিএমের কৃষক” বা এদের সব্বাইকে একেবারে থার্ড ব্র‍্যাকেটে পুরে “ওরা এন্টি ন্যাশনাল।” অস্যার্থ কেবল এটা নয় যে ঐ লেবেলের লোকেদের প্রতিবাদের অধিকার নেই। লেবেলটা আসলে চোখ মটকে বাকিদের বলা “এদের সাথে যোগ দিও না।” আমরা ভদ্রসন্তানেরাও এমন সুবোধ বালক যে সরকারী মতটা বুলির মত আউড়ে শুধু নিজে চেপে যাই তা নয়, অন্যকেও বোঝাই।
ভদ্রসন্তানদেরই আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি কিনা, তাই তেনারা যা মনে করেন সেই মতটাই প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে জঘন্যতম কান্ডগুলো করেও সরকারগুলো দিব্য “আগেও হয়েছে” বলে চালিয়ে যাচ্ছে।
— নির্বাচনের জন্যে খুন? আগেও হয়েছে।
— ধর্ষণ? আগেও হয়েছে।
— ঘোড়া কেনাবেচা? আগেও হয়েছে।
— বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশের অত্যাচার? আগেও হয়েছে।
মোদীর আছে “কংগ্রেস কে সত্তর সাল” আর দিদির “বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছর”। যদ্দিন উনি আরো সত্তর বছর আর ইনি আরো চৌত্রিশ বছর শাসন না করছেন তদ্দিন চুপটি করে থাকতে হবে। ভদ্রসন্তানরা অবিশ্যি চুপ করে থাকতে ভারী ভালবাসেন। জেগে উঠে একেকজন যা সব সমাধান দিচ্ছেন তাতে মনে হয় এর চেয়ে ঘুমোলেই বুঝি ভাল ছিল। সেদিন ভোট দেব বলে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি (সকাল সকাল গেছিলাম বলে দিতে পেরেছি, ভাইসব। আমায় মেডেল দিও), কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর সাথে আমার পেছনের ভদ্রসন্তান দেশ, জাতি, পরিস্থিতি নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা শুরু করলেন এবং দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত করলেন “ভোট অনলাইন করে দেয়া উচিৎ।” আদ্ধেক লোক কী দিয়ে ভাত খাবে তার ঠিক নেই, উনি অনলাইনে ভোট করাচ্ছেন। এবং এতদ্দ্বারা শাসক দলের বদমাইশিকে বেমালুম অস্বীকার করছেন। আসলে সেই যে আগন্তুক ছবিতে ছিল — কূপমণ্ডূক। আজকাল ভদ্রসন্তানেরা স্মার্টফোনমণ্ডূক। নিজের প্রতি ছাড়া আর কারো প্রতি কোন দায়দায়িত্ব নেই। রাজকুমার রায়ের মৃত্যুটা বড় চমকে দিয়েছে, বড় কাছের লোক মনে হচ্ছে। তাই দুদিন একটু রাগারাগি করবেন আর কি। তারপর আবার মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগাবেন। তার উপরে লেখা থাকবে “আগেও হয়েছে”, এবং যেদিন সরকার দয়া করে ভোট দেয়ার সুযোগ দেবে সেদিন সুড়সুড় করে গিয়ে আবার ওদেরই ভোট দেবেন।
অবশ্য সব ভদ্রসন্তানই এমনধারা তা বললে অন্যায় হবে। অনেকে খুব প্রতিবাদী। তেনারা জেগে উঠেই ঠিক করে ফেলেছেন এদের আর ভোট নয়। কারণটি ভারী মজার। “এসব খুনোখুনি মারামারি করছে মুসলমানরা। বিজেপি এলেই এরা সিধে হয়ে যাবে। অতএব বাংলায় বিজেপিকেই চাই।” এদের জিজ্ঞেস করুন “হ্যাঁ দাদা, অনুব্রত মন্ডল কি মুসলমান? জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক কি পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েন?” এনারা বুদ্ধিমানের মত জবাব দেবেন “আরে এরা তো আর মারামারিটা করছে না। যারা করছে তাদের নামগুলো দেখুন না। বেশিরভাগ মুসলমান। আরাবুলকে ভুলে যাচ্ছেন?” তখন যদি ধরিয়ে দেন যে যারা মার খেয়ে মরছে তাদের মধ্যেও অনেক মুসলমান, অমনি আপনি এন্টি ন্যাশনাল হয়ে যাবেন। আসল কথা সেই যে ব্রিগেডের মাঠে ২০১৪ সালে মোদীজি এসে বলেছিলেন “এখানে মমতা দিদি আছেন খুব ভাল কথা। দিল্লীতে আমায় বসান, আপনাদের দুই হাতে লাড্ডু হয়ে যাবে।” তা সেই লাড্ডু এখন গোগ্রাসে গিলছি আমরা। দু হাতের লাড্ডুতে মন ভরছে না, কোঁচড়েও চাই। তাই আবার নবান্নেও বিজেপিকে দরকার।
খান ভদ্রসন্তানগণ, পেট পুরে খান। পেটপুরে খান আর প্রাণভরে মলত্যাগ করুন। আপনারা তো আর ছোটলোক নন যে মাঠেঘাটে যেতে হবে। মোদীর স্বচ্ছ ভারত আর দিদির নির্মল বাংলার তো আপনারাই ব্র‍্যান্ড এম্বাসেডর।

বিঃ দ্রঃ তৃণমূল কংগ্রেসের কে এক অর্বাচীন এম এল এ কাল দাবী করেছেন তিনি নাকি এমন সন্ত্রাস বাম আমলেও দ্যাখেননি। ওসব গুজবে কান দেবেন না। লাড্ডু খেয়ে যান।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading