ভেসে যাব?

আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে গত এক দশকে দশমীতে ঠাকুর বিসর্জন দেয় এরকম পুজোর সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে এবং একাদশীতে বিসর্জন দেওয়া হয় এমন ঠাকুরের সংখ্যাও ক্রমশ কমছে। সুতরাং আজকের দিনে একটা বিশেষ দিনে প্রশাসনিক সুবিধার জন্যে ভাসান বন্ধ রাখতে বললে ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্ন উঠে যাওয়া বেশ বিস্ময়কর

দুটো কাগজের রিপোর্ট পড়লাম, আরো নানা জিনিস যা সবাই পড়ছে তাও পড়লাম। কিছু পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু যা নিয়ে সংশয় থাকছে না সেটা হল পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এর আগে কোন মুখ্যমন্ত্রী কবে দুর্গাপুজোর ভাসান হবে আর কবে হবে না তা ঘোষণা করেননি, কাজটা পুলিশকর্তা বা অন্য মন্ত্রীদের করতে দিয়েছিলেন। কেন? নিশ্চয়ই তাঁদের অন্য কাজ ছিল, ফলে উৎসবের খই ভাজা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর উৎসব নিয়ে উৎসাহ বরাবরই বেশি, এক্ষেত্রেও তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
ওঁত পেতে থাকা হায়েনার দল এমন সুযোগ ছাড়তে পারে না, ছাড়েওনি। “হিন্দু খতরে মে হ্যায়” কথাটা বাঙালি হিন্দুর কানে ভাসিয়ে দিয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী, পরিবারে কজন বিদেশবাসী আছে তা নিয়ে গর্ব করা বাঙালিও এই ঢপের চপ গপ গপ করে খেয়েছে, খাচ্ছে। একবারও ভেবে দেখছে না। ভাবলে বুঝতে পারত যে রাজ্যের বড় বড় পুজোগুলোর আয়োজক শাসকদলের নেতারা, যে রাজ্যের সরকার পারলে ইতুপুজোতেও ছুটি দিয়ে দেয়, শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় ভাসান নিয়ে মোচ্ছব করেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে — সে রাজ্যে হিন্দুর কোন খতরা নেই। সংখ্যালঘু তোষণ থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর অত্যুৎসাহে যেটা হল সেটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা এমন একটা কারণে মুসলমানবিদ্বেষ ছড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেল যেটার সঙ্গে বাংলার মুসলমানদের কোন সম্পর্কই নেই। তাঁরা কেউ কখনো দাবী করেননি মহরমের তাজিয়ার জন্যে ভাসান বন্ধ রাখতে হবে। বলবেনই বা কেন? হিন্দু খতরায় থাকা বাংলায় এবছরও তো অসংখ্য পুজো কমিটির দায়িত্বে তাঁরাই আছেন। নিজেদের পুজোর ঠাকুরগুলো ভাসানোর ব্যবস্থাও তো তাজিয়া বার করার পাশাপাশি তাঁদেরই করতে হবে।
ক্ষতি যা হওয়ার ইতিমধ্যেই হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হাইকোর্টের আদেশ মেনে নিয়ে পুজো এবং মহরম যাতে শান্তিপূর্ণভাবে মেটে তার ব্যবস্থায় এইবেলা মন দিলে ভাল করতেন, কিন্তু উনি তো উনিই। আরো পাঁচটা গরম মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত ব্যাপারটাকে টেনে নিয়ে না গেলে, উত্তেজনা আরো না ছড়ালে ঠিক তৃপ্ত হতে পারছেন না বোধহয়।
যদি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য ঠিক হয় অর্থাৎ ১৯৮৩ আর ৮৭ সালে সত্যিই মহরমের জন্যে একাদশীর দিন ভাসান বন্ধ থেকে থাকে তাহলে প্রশ্ন ওঠে গত দুবছর ধরে যারা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছে, তারা কি ঐ দুবছর পুজো করেনি? তাহলে সেইসময়ে আদালতে যায়নি কেন? বা সেইসময়ে যারা পুজো করেছিল তাদের তখন কেন মনে হয়নি যে ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ হচ্ছে, হিন্দু খতরে মে হ্যায়? হঠাৎ ২০১৭ সালে এসে কেন মনে হল যে একদিন পরে ভাসান করতে বলা মানে ধর্মাচরণের অধিকারে হস্তক্ষেপ? আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে গত এক দশকে দশমীতে ঠাকুর বিসর্জন দেয় এরকম পুজোর সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে এবং একাদশীতে বিসর্জন দেওয়া হয় এমন ঠাকুরের সংখ্যাও ক্রমশ কমছে। সুতরাং আজকের দিনে একটা বিশেষ দিনে প্রশাসনিক সুবিধার জন্যে ভাসান বন্ধ রাখতে বললে ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্ন উঠে যাওয়া বেশ বিস্ময়কর।
এবার একটা জোরালো আপত্তি উঠবে জানি। “এই তাহলে সেকুলারিজম? আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমাদের সবসময় সংখ্যালঘুদের জন্যে স্যাক্রিফাইস করতে হবে কেন? ওদের ধর্মাচরণ মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, আমাদের মৌলিক অধিকার নেই?” হক কথা। এবার তাহলে মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা হোক।
ভারতীয় সংবিধানের ২৫(১) ধারায় সব নাগরিককে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং স্বাস্থ্য বজায় রেখে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কাউকে দুর্গাপুজো করতে বাধা দেননি, বিসর্জনেও বাধা দেননি। দিলেও কিন্তু সেটা অসাংবিধানিক না-ও হতে পারত। যেমন দমকল বিভাগ যদি বলত কোন পুজোমন্ডপ বিপজ্জনক, দুর্ঘটনাপ্রবণ। তাহলে তাদের পুজো করার অনুমতি সরকার না-ই দিতে পারত। অর্থাৎ আপনি ধর্মাচরণ করবেন বলে অন্য লোককে বিপদে ফেলতে পারেন না। ওটা আপনার মৌলিক অধিকার নয়। যাদের অনুমতি দেওয়া হল না তারাও আদালতে যেতেই পারে। আদালত কি তাদের আর্জি শুনবে? কে জানে!
বিপদের কথা আসছে কেন? আসছে কারণ বিসর্জনের সময়ে পথে বা ঘাটে ঝগড়াঝাঁটি, এমনকি হাতাহাতি মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সঙ্গে যদি মহরমের তাজিয়া যোগ হয়, বিশেষ করে ২০১৭র ভারতে তথা বাংলায় সেটা সামলানো যে যথেষ্ট শক্ত তা কি বুঝতে খুব অসুবিধা হয়? এটা আইনশৃঙ্খলারক্ষার প্রশ্ন। সেটা যার দায়িত্ব, সেই রাজ্য সরকার যদি বলে “আমি পারব না”, তাহলে আমি তাকে অযোগ্য বলে তেড়ে গালাগাল দেবই। কিন্তু “কিচ্ছু হবে না” বলে উড়িয়ে দেব কি? জানি না। ক্ষমতাহীন নাগরিক হিসাবে শুধু আশা করি বিচারকরা যাতে খারাপ কিছু না ঘটে তার ব্যবস্থা করবেন, ব্যাপারটা রাজ্য সরকারের হাতে ছেড়ে রাখবেন না, বিশেষ করে যে সরকার তাঁদের প্রবল তিরস্কারের পাত্র।
তবে বিচারকদের রায় শোনার পর থেকে একটা প্রশ্ন বড্ড জ্বালাচ্ছে, সেইটা সবশেষে বলি। সংবিধানেরই ১৯(১)(ডি) চলাচলের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। মানে ভারতের যে কোন নাগরিক দেশের মধ্যে যে কোন জায়গা থেকে যে কোন জায়গায় চলাচল করতে পারে। তা কলকাতায় একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা আছে যার নাম মহাত্মা গান্ধী রোড। সেই রাস্তায় বেশ কিছুদিন হল দিনের বেলায় দেখেছি প্রাইভেট গাড়ি চলতে দেওয়া হয় না। এখন কয়েকজন গাড়ির মালিক মিলে যদি আদালতের কাছে গিয়ে বলেন যে সরকার এতদ্দ্বারা আমাদের চলাচলের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে, আদালত কি সেই আর্জি শুনবে? তারপর মামলায় যদি সাব্যস্ত হয় সত্যিই চালকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তাহলে কি আদালতের নির্দেশে মহাত্মা গান্ধী রোডে প্রাইভেট গাড়িও চলবে? এইভাবে যে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া সরকারের কাজ তার সবই কি বিচারপতিরা নেবেন? সেভাবে দেশ চলবে তো?

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading