‘ওদের’ প্রতিবাদ

হিন্দু প্রতিরোধের যখন এত শক্তি যে অন্য ধর্মের ইমাম বদলে দিতে পারে তখন নিজের ধর্মে নিশ্চয়ই আরো বড় বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে? তাহলে খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে একটা হিন্দু প্রতিরোধ হোক না

সারা পৃথিবীর উগ্র দক্ষিণপন্থীদের তো বটেই, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষদের মধ্যে অনেকেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করেই থাকেন “ওরা নিজেদের ধর্মের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না।” যখন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তর্কবিতর্কে আর সব যুক্তি ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন এই যুক্তিটাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে ভেসে ওঠার চেষ্টা করে অনেকে। সামগ্রিকভাবে এই অভিযোগটার সত্যতা বা অসত্যতা নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না। আপাতত একটা ঘটনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছি।
কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের শাহি ইমাম বরকতিবাবু একের পর এক ফতোয়া জারি করে ইদানীং বেশ নাম করেছিল। ধর্মের চেয়ে রাজনীতিতেই যে বাবুর আগ্রহ বেশি তা বুঝতে কারো বাকি ছিল না। এবং লোকটি নিজেকে এতই মাতব্বর ভাবতে শুরু করেছিল যে সরকারী নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গাড়িতে লাল বাতি নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। লোকটার বিরুদ্ধে আমার হিন্দু বন্ধুবান্ধবদের মতই মুসলমান বন্ধুদের মধ্যেও বেশ কিছুদিন ধরে অসন্তোষ লক্ষ্য করছি — শুধু ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নয়, তার বাইরেও। আমাকে রোজই টিপু সুলতান মসজিদের সামনে দিয়েই অফিস যেতে হয়। ফলে প্রায় একবছর আগে থেকে আমার চোখে পড়েছে বিভিন্ন বিষয়ে ঐ এলাকার প্রধানত মুসলমান ব্যবসায়ীদের ঝোলানো পোস্টার, যেগুলো বরকতিবাবুর ঠিক উলটো কথা বলেছে। শেষমেশ গত সপ্তাহে দেখলাম একটা পোস্টারে বলা হয়েছে রাজনীতিকে মসজিদের বাইরে রাখা হোক। তারপরেই জানা গেল কয়েকদিন আগে মসজিদে ঢোকার মুখে বরকতিবাবুকে কিছু মুসলমান যুবক কয়েক ঘা দিয়েছেন। তারপর জানা গেল তার ইমাম পদটি গেছে।
মজার কথা আমাদের দক্ষিণপন্থীরা এখন বলতে শুরু করেছেন এটার কৃতিত্ব হিন্দুদের। মুসলমানরা এই রাজ্যটা দখল করে নিচ্ছিল। হিন্দুরা প্রবল প্রতিরোধ করেছে। তাতেই ঘাবড়ে গিয়ে নাকি মমতা এটা করালেন।
অর্থাৎ ডানদিকের বাবুরা মনে করেন মুসলমানদের মসজিদ, তাদের ইমাম — এসব তারা পরিচালনা করে না, তাদের নিজস্ব কোন মতামত নেই। বেশ কথা। তাহলে এরপর থেকে মুসলমানরা কেন প্রতিবাদ করে না এই কথাটা আর কখনো বলবেন না। মুসলমানরা যখন এতই ঠুঁটো জগন্নাথ তখন তারা আর প্রতিবাদ করবে কী করে? আপনারাই বলরাম হয়ে ওদের কাজগুলো করে দিন।
আরো অনুরোধ করি, হিন্দু প্রতিরোধের যখন এত শক্তি যে অন্য ধর্মের ইমাম বদলে দিতে পারে তখন নিজের ধর্মে নিশ্চয়ই আরো বড় বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে? তাহলে খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে একটা হিন্দু প্রতিরোধ হোক না। সবর্ণ বিবাহের বিরুদ্ধে একটা হিন্দু প্রতিরোধ হোক। হিন্দুদের বাধ্য করুন পাত্র/পাত্রী চাই এর বিজ্ঞাপনে “caste no bar” লিখতে। রাজ্যে নাহয় আপনাদের ভাষায় মমতাজের সরকার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান — এসব রাজ্যে গোরক্ষকবাহিনীর মত একটা বাহিনী হোক না যারা দলিতদের কুয়োয় যারা কেরোসিন তেল ঢেলে দেয় তাদের বেদম পেটাবে। হিন্দু প্রতিরোধের শক্তিতেই তো এন্টি-রোমিও স্কোয়াড হয়েছে? তা ঐ শক্তি দিয়ে একটা এন্টি-হাঙ্গার স্কোয়াড করুন না। হিন্দু প্রতিরোধের এত শক্তি আর দেশের ৭৮% হিন্দুর একজনও যাতে খালি পেটে না ঘুমোয় তার ব্যবস্থা করতে পারবেন না? ২২% মুসলমানের কথা নাহয় না-ই ভাবলেন। তাদের তো এতবছর ধরে আমরা দেশদ্রোহীরা খাইয়েদাইয়ে মোটা করেছি। আপনাদের রাজত্বে নাহয় তারা না-ই খেল।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

Leave a Reply

%d bloggers like this: