নির্বাচিত ক্রোধ

অনেকদিন আগে একটা বই পড়েছিলাম — নির্বাচিত কলাম। সে বইয়ের লেখিকা তসলিমা নাসরিন দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অগ্রগণ্য নারীবাদী, প্রগতিশীল লেখিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। নিজের দেশ থেকে মুসলমান মৌলবাদীদের যাতনায় নির্বাসিত হয়ে দীর্ঘদিন এই বাংলায় ছিলেন। একই ধর্মের উগ্রবাদীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ২০০৭ এ পশ্চিমবঙ্গের ধ্বজভঙ্গ সরকারের তাঁকে চলে যেতে বলা নিঃসন্দেহে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মৌলবাদের যাতনায় মায়ের দেশ এবং মাসির দেশ (শিবনারায়ণ রায়ের ভাষায়) ছাড়তে বাধ্য হওয়া এই সাহিত্যিক শ্রীজাত, মন্দাক্রান্তার পাশে দাঁড়াবেন আশা করছিলাম। গতকাল দেখলাম দাঁড়িয়েছেন, তবে ছায়া এড়িয়ে। ভারতের অনেক জায়গায় এখনো উঁচু জাতের লোকেরা যেভাবে নীচু জাতের ছায়া এড়িয়ে দাঁড়ায়, সেভাবে

taslima

১৯৮০ সালে মুক্তি পায় ‘হীরক রাজার দেশে’। অনেকেই মনে করেন ছবিটা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিক্রিয়া। ওটা মুক্তি পাওয়ার সময়ে ভারতে “selective outrage” কথাটা চালু হয়নি। হয়নি বলেই কংগ্রেসিরা বা ইন্দিরা সমর্থকেরা প্রশ্ন তোলেনি “এমার্জেন্সির অত্যাচার নিয়ে ছবি করেছেন। ইংরেজের অত্যাচার নিয়ে ছবি করেননি কেন?”
“Selective” আর “outrage” দুটো শব্দই ইংরিজি ভাষায় থাকলেও পাশাপাশি বসিয়ে নতুন অর্থ দেওয়ার কথা সম্ভবত ১৯১৯ সালে ইংরেজদের মাথাতেও আসেনি। নইলে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করার পরে সরকার বাহাদুর বলতেই পারতেন “Where were you when Mughals killed Sikhs in Sikh-Mughal wars? Why this selective outrage?”
ভারতীয় দক্ষিণপন্থীদের এক অনন্য অবদান এই “selective outrage”। কী বাংলা হওয়া উচিৎ এর? “নির্বাচিত ক্রোধ?” আচ্ছা উন্মাদ ছাড়া কেউ কি সবেতেই রেগে যায়? নাকি সকলে একই জিনিসে ক্রুদ্ধ হন? আপনি কখনো কোন দক্ষিণপন্থীকে দেখেছেন ভারতে বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে মুসলমান আর দলিতদের অস্বাভাবিক বেশি অনুপাত নিয়ে “outraged” হতে? পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মগুরুদের প্রভাব নিয়ে সরব হলেও গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীকে মুখ্যমন্ত্রী করায় “outraged” হননি এরকম লোকেরাই তো এদেশে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। একেও কি “selective outrage” বলা উচিৎ? যাঁরা জাকির নায়েককে উস্কানিমূলক কথাবার্তার জন্য হাতকড়া পরাতে চান কিন্তু যোগী আদিত্যনাথকে একটা সুযোগ দিতে চান তাঁদের রাগকে কি নির্বাচিত ক্রোধের দলে ফেললে খুব অন্যায় হবে?
আসলে “outrage” বা ক্রোধ একটি মানবিক অনুভূতি, যা নির্ভর করে কোন বিষয়ে একজন মানুষের “opinion” বা মতামতের উপর। দক্ষিণপন্থীদের মত হল ভারতীয় মুসলমান এবং দলিতরা মায়ের পেট থেকেই পড়েই অপরাধী হয়ে যায়। সুতরাং অন্যদের চেয়ে তারা বেশি কারারুদ্ধ হবে, এতে আর ক্রুদ্ধ হওয়ার কী আছে? পাকিস্তান, বাংলাদেশের ধর্মগুরুরা অত্যন্ত রক্ষণশীল কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ হাইটেক প্রগতিশীল অতএব তাঁর কথা আলাদা — এই হচ্ছে তাঁর সমর্থকদের মতামত। সেইজন্যেই এনার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিয়েও এঁদের কোন outrage নেই। জাকির নায়েক যে ধর্মের লোক সে ধর্মের লোকেরা সন্ত্রাসবাদী হয় তাই তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা দরকার কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ যতই প্রকাশ্য সভায় বলে থাকুন যে “একজন হিন্দু মরলে আমরা এফ আই আর করতে যাব না, কম করে দশজন মুসলমানকে মারব”, তাঁর প্রশাসক হিসাবে একটা সুযোগ প্রাপ্য যেহেতু হিন্দুরা সন্ত্রাসবাদী হয় না, আজমের বিস্ফোরণে দোষী সাব্যস্ত হলেও “activist” হয়।
এই মতামতগুলো ভাল কি মন্দ, ন্যায় কি অন্যায় সে আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু দক্ষিণপন্থীদের ক্রোধও যে নির্বাচিত সেটা কিন্তু এ থেকে বোঝা যাচ্ছে। এবং সেজন্যে তাঁদের গাল পাড়ছি না কারণ তাঁদের মতামতানুসারেই তাঁরা ক্রুদ্ধ হবেন। সেটাই স্বাভাবিক। গাল পাড়ব মতামতগুলোর জন্য, নির্বাচিত রাগের মত কোন কাঁঠালের আমসত্ত্বের জন্য নয়।
অনেকদিন আগে একটা বই পড়েছিলাম — নির্বাচিত কলাম। সে বইয়ের লেখিকা তসলিমা নাসরিন দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অগ্রগণ্য নারীবাদী, প্রগতিশীল লেখিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। নিজের দেশ থেকে মুসলমান মৌলবাদীদের যাতনায় নির্বাসিত হয়ে দীর্ঘদিন এই বাংলায় ছিলেন। একই ধর্মের উগ্রবাদীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ২০০৭ এ পশ্চিমবঙ্গের ধ্বজভঙ্গ সরকারের তাঁকে চলে যেতে বলা নিঃসন্দেহে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মৌলবাদের যাতনায় মায়ের দেশ এবং মাসির দেশ (শিবনারায়ণ রায়ের ভাষায়) ছাড়তে বাধ্য হওয়া এই সাহিত্যিক শ্রীজাত, মন্দাক্রান্তার পাশে দাঁড়াবেন আশা করছিলাম। গতকাল দেখলাম দাঁড়িয়েছেন, তবে ছায়া এড়িয়ে। ভারতের অনেক জায়গায় এখনো উঁচু জাতের লোকেরা যেভাবে নীচু জাতের ছায়া এড়িয়ে দাঁড়ায়, সেভাবে।
“শ্রীজাত, মন্দাক্রান্তার পাশে আছি কারণ আমি বাকস্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু….” সেই নির্বাচিত ক্রোধের তত্ত্ব। ওঁকে কলকাতা থেকে যখন চলে যেতে বলা হয় তখন কিছু বলেনি কেন? এরা কেবল হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলে। কোথায় ছিল এরা যখন তামিলনাডুর নাস্তিক এইচ ফারুককে হত্যা করা হল? খাগড়াগড় নিয়ে কবিতা লেখেনি কেন? ধূলাগড় নিয়ে লেখেনি কেন? রোজ কত মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়, তসলিমাকেই কত হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাই নিয়ে বলে না কেন?
“তখন বলেনি এখন বলছে কেন” যুক্তিটা কতটা খেলো সেটা আগেই বলেছি। দুরভিসন্ধিযুক্ত শাসক বা নিজের কুকীর্তি ঢাকতে ব্যস্ত কেউ ছাড়া অন্য লোক প্রতিবাদের বিরুদ্ধে এই যুক্তি খাড়া করে না। তসলিমা কেন করলেন সেটা ভাববার বিষয়। কিন্তু আর যা যা বলেছেন সেগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে।
এরা কেবল হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলে। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম কথাটা একশোভাগ সত্যি। এবার বলি, বেশ করে। এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে প্রথমেই মৌলবাদীরা যেটা করে সেটা হল তার ধর্মকে বিধর্মী আক্রমণ করেছে বলে চেঁচিয়ে মৌলবাদী নন এমন মানুষদেরও সহানুভূতি আদায় করা। তাই করেই মকবুল ফিদা হুসেনকে তাড়ানো হয়েছিল। তসলিমাও বেশ করেন কেবল মুসলমান মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। তিনিই বা কবে কালবুর্গি বা নরেন্দ্র দাভোলকারের হত্যার ব্যাপারে কড়া বিবৃতি দিলেন? উলটে বলেছিলেন কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রমাণ হয় না ভারত অসহিষ্ণু।
এবার তর্কের খাতির দূর করে বাস্তবে আসি। তসলিমা যথেষ্ট না জেনেই অভিযোগটা করে বসেছেন। শ্রীজাত ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লিখছেন। বাংলাদেশে ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে তিনি এতটাই সরব ছিলেন যে কবীর সুমন তাঁকে মুসলমানবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে প্রায় গালিগালাজ করেছিলেন ফেসবুকেই।
খাগড়াগড় নিয়ে লেখেনি কেন? ধূলাগড় নিয়ে লেখেনি কেন? প্রশ্নগুলো এমন একজন করেছেন যিনি নাকি নিজে কবিতা লেখেন। অবাক লাগছে ভাবতে যে একজন কবি প্রায় রাজনৈতিক নেতার মত ভাষায় নির্ধারণ করতে চাইছেন কবিকে কোন কোন ঘটনা নিয়ে লিখতে হবে। কবি তা নিয়েই লিখবেন যা নিয়ে তাঁর লিখতে ইচ্ছা করে। কবি সাংবাদিক নন। এটা তসলিমা জানেন না? আর ধূলাগড়? একজনও মানুষ মারা গেছে ওখানে? একটিও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে? ঘরেদোরে আগুন ধরানো হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত অপরাধে ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিলকে তাল কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়েই করা হয় বলে জানি। সোশাল মিডিয়ার গুন্ডাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়। তসলিমাকে সেই দলে ফেলতে যে মন চায় না।
খাগড়াগড়? সে তো আরেক কান্ড। বিস্ফোরণের পর থেকে মৃত অভিযুক্তের নাম বদলাতে বদলাতে কোথা থেকে কোথায় যে গিয়ে পৌঁছেছে। হাজার হাজার ডক্টর হাজরা একেবারে। এন আই এ তদন্ত করছে, কয়েকজনকে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, এদিকে যে নাকি নাটের গুরু সে গত ২৮শে মার্চ সিলেটে নিহত হয়েছে। এটা নিয়ে কবির কী লেখার ছিল বুঝলাম না। আচ্ছা একটা প্রতিপ্রশ্ন করি? এই যে কদিন আগে আজমের ব্লাস্টে দুই আর এস এস কর্মীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হল, তসলিমার কি এই নিয়ে কিছু লেখা উচিৎ ছিল? যাক গে।
মন্দাক্রান্তাকে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে তসলিমা যা বলেছেন সেটা পড়ে হাসব না কাঁদব এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। এরকম হুমকি তো কত মেয়েই পায়। এখন মন্দাক্রান্তা পেয়েছে বলে লোকে হৈ হল্লা করছে — এই হল তসলিমার খেদ। ঠিকই তো। ভারতে রোজ কত মেয়ে ধর্ষিতা হচ্ছে, হঠাৎ নির্ভয়াকে নিয়ে সকলের অত চেগে ওঠার কী দরকার ছিল ভগবান জানে। বহু মেয়ে ধর্ষণের হুমকি পায় এবং ভয়ে কুঁকড়ে যায়, চুপ করে যায়, অনেকসময় হুমকিবাজরা দেখিয়ে দেয় তারা মুখেন মারিতং জগৎ নয়। ধর্ষণের পর মেয়েটি আরো নীরব হয়ে যায়। মন্দাক্রান্তা সেনেরও উচিৎ ছিল চুপচাপ হয়ে যাওয়া, প্রয়োজন হলে ফেসবুক ছেড়ে দেওয়া, অতঃপর দরজা জানালা এঁটে বাড়িতে বসে থাকা। এরকমটাই আপনার থেকে আশা করেছিলাম, তসলিমা দেবী। এই না হলে নারীবাদী?
আপনি চালিয়ে যান, ম্যাডাম। আপনি পুরো ব্যাপারটাকেই দাঁড় করালেন বুদ্ধিজীবী বনাম বুদ্ধিজীবী হিসাবে। আপনি শ্রীজাতর পাশে আছেন কিনা সেটা তো বড় কথা নয়, বড় কথা হল আপনি দাঙ্গাবাজের রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার পক্ষে না বিপক্ষে। সে ব্যাপারে আপনি একটা শব্দও খরচ করেননি। আপনার নীরবতা মুখর।

কয়েকটা প্রাসঙ্গিক লিঙ্ক

http://www.outlookindia.com/…/taslima-questions-sri…/1018138
http://m.economictimes.com/…/wont-…/articleshow/51564448.cms
http://twocircles.net/2014dec03/1417616083.html
http://www.timesnow.tv/…/mastermind-behind-2014-burdw…/58316

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading