লাঠালাঠি নয়, গলাগলি

৩৩ এর পল্লী যে অপরাধে অপরাধী, একই অপরাধে রামকৃষ্ণও কি অপরাধী নন?

বিজয়া দশমীর মিষ্টির স্বাদ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কথাগুলো বলে ফেলা যাক, কারণ আমাদের স্মৃতি অতি দুর্বল।

বেশ কয়েক দশক হল একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দারুণ ধর্মনিরপেক্ষ এক জাতি, তাই তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোরও সামাজিক চরিত্রটাই বড় কথা, ধর্মীয় চরিত্রটা নয়। উৎসবটা মূলত সংখ্যাগুরু হিন্দুদের উৎসব হলেও সংখ্যালঘু মুসলমানরাও এতে সানন্দে অংশগ্রহণ করেন, করতে কোন বাধাও নেই। কিন্তু গত কয়েক দিনে প্রমাণ হয়ে গেছে যে বাঙালি হিন্দু, মুসলমানকে নজরুলই যথার্থ বুঝেছিলেন। সে কথায় পরে আসছি।

ব্যাপারটা কী? না বেলেঘাটা ৩৩ এর পল্লী এবারের পুজোয় সর্বধর্ম সমন্বয় নিয়ে ভেবেছেন। তাই তাঁদের পুজো মণ্ডপে আজানও বেজেছে। আর যেই না বেজেছে, অমনি বহু বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার খোলস খসে পড়েছে। বজরং দলের বাঁদরদের নিয়ে বেশি চিন্তিত নই। সেই একটা প্রাচীন কবিতা আছে না “কুকুরের কাজ কুকুর করেছে” ইত্যাদি? তা মৌলবাদী সংগঠনের কাজ তারা করেছে। মণ্ডপে গিয়ে অশান্তি করার চেষ্টা করেছে, অকৃতকার্য হয়ে থানায় এফ আই আর করেছে। পুলিশ কোন আইনের কোন ধারায় এসব এফআইআর গ্রহণ করে সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার বিষয় নয়। চিন্তার বিষয় সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানদের উষ্মা প্রকাশ। এই সাধারণদের মধ্যে আবার প্রগতিশীল, এমনকি বামপন্থীরাও আছেন। আশঙ্কা, আতঙ্ক এখানেই।

এক নিকটাত্মীয় একটি হোয়াটস্যাপ মেসেজ ফরোয়ার্ড করলেন। পড়লে চট করে মনেই হবে না কাজটা হিন্দুত্ববাদী আই টি সেলের। অবশ্য ইদানীং তো বাংলার প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের কেউ কেউ ও দলে ভিড়েছেন, হয়ত তাঁদের কাউকে দিয়েই লেখানো বার্তাটা। উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।

ওই দুর্গাপুজো থিম যে শিল্পীর মস্তিষ্কপ্রসূত তাঁর নাম রিন্টু দাস। তাঁর কথায়, “আমাদের থিমের বিষয় হচ্ছে যে আমরা সবাই এক, কেউ একা নই। সাম্প্রদায়িকতা ভুলে সবাই যাতে সম্প্রীতির পথে চলি সেই বার্তায় দেওয়া হয়েছে। মায়ের হাতে অস্ত্র নেই। সেটা যুদ্ধ ভুলে শান্তির বার্তা।”
এখন আমরা কি জানি এই আযানে আসলে কী বলা হয়। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের ও কোনও ধারণা আছে? আসুন আযানের বাংলা অনুবাদটা পড়া যাক।
* আল্লাহু আকবর – আল্লাহ সর্বশক্তিমান।
*আশহাদু-আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই।
*আশহাদু-আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ – আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত দূত।
*হাইয়া আলাস সালা – নামাজের জন্য এসো।
*হাইয়া আলাল ফালা – সাফল্যের জন্য এসো।
*আল্লাহু আকবর – আল্লাহ সর্বশক্তিমান।
*লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই।
*মহম্মদ রসুলুল্লাহ- মহম্মদ ই একমাত্র রসুল, মানে আল্লার দূত।
এবার ভাবুন, সামনে দুর্গা প্রতিমা। মাথার উপরে দেবাদিদেব মহেশ্বর। পাশে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী আর সরস্বতী। তাঁদের অকালবোধনে আবাহন করা হয়েছে। মাইকে বাজছে: আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই!
এই হল প্রোগ্রেসিভ, অসাম্প্রদায়িক বাঙালির জ্ঞানের গভীরতা!
(দেশপ্রেমিক বানানাদি অপরিবর্তিত)

আমি আরবি ভাষা জানি না, ইসলাম ধর্মাবলম্বীও নই। ফলে আজানে যা বলা হয় তার অর্থ সত্যিই এই কিনা জানি না। তবে কত আর অবিশ্বাস করব? তাই ধরেই নিলাম এখানে সঠিক অনুবাদই করা হয়েছে। তা আপত্তির হেতুটা বোঝার চেষ্টা করে দেখি।

আজানে বলা হচ্ছে আল্লাই সর্বশক্তিমান, আল্লা একমাত্র উপাস্য, মহম্মদ আল্লার একমাত্র দূত। হিন্দু দেবদেবীদের পূজাস্থলে এসব কী কথা! এ জিনিস কখনো ওখানে বাজানো যায়!

ব্যাপারটা সর্বধর্ম সমন্বয়ের থিমের সঙ্গে কেন অসঙ্গতিপূর্ণ ঠিক বুঝলাম না। সব ধর্মেই তো সেই ধর্মকেই সর্বোত্তম সত্য বলে দাবী করা হয়। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে উদাহরণ দিই। যদিও হিন্দুধর্মের কোরান শরীফ বা বাইবেলের মত নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ নেই (বস্তুত হিন্দুধর্ম আদৌ কোন একক ধর্ম কিনা তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিলক্ষণ তর্ক আছে), তবু বাড়িতে বাড়িতে শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাওয়া যায়। আমি আবার বামুন বাড়ির ছেলে হওয়াতে ছোট থেকে বাড়িতে রোগা, মোটা, বেঁটে, লম্বা — নানা চেহারার গীতা দেখছি। অনিচ্ছায় দুবছর এবং পরে স্বেচ্ছায় দুবছর সংস্কৃত পড়তে হয়েছিল। তা বাড়ির একটা গীতা খুলে দেখলাম সপ্তম অধ্যায়ের সপ্তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন

মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদন্তি ধনঞ্জয়
ময়ি সর্ব্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।

অর্থ কী?

হে ধনঞ্জয়, আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই। মালায় যেভাবে মণিগুলো সুতোয় গাঁথা থাকে, আমার মধ্যে সেইভাবে সর্বভূত এবং সমস্ত জগৎ গ্রথিত।
তার আগেই, চতুর্থ অধ্যায়ে, রয়েছে প্রায় সকলের পরিচিত পঁয়ত্রিশতম শ্লোকটা

শ্রেয়ান স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ।।

অর্থাৎ নিজের ধর্মে যদি দোষত্রুটি থাকে এবং পরের ধর্মে না থাকে, তাহলেও পরধর্মের চেয়ে নিজ ধর্ম ভাল। নিজের ধর্মে থেকে মৃত্যুও ভাল, পরধর্ম পালন করা ভয়াবহ।

যদি বা দ্বিতীয় শ্লোকে ধর্ম বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তা নিয়ে সূক্ষ্ম তর্কের অবকাশ আছে, প্রথম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ যা বলছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই বলছেন। আজান দেওয়ার সময়ে যেমন বলা হয় আল্লাই সর্বশ্রেষ্ঠ, শ্রীকৃষ্ণও বলছেন তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তা হোয়াটস্যাপবাবুদের যুক্তি অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ এত বড় কথা বলে দেওয়ার পরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস যে কলমা পড়েছিলেন, গবেষকসুলভ অনুসন্ধিৎসায় খ্রীষ্টধর্মও পালন করেছিলেন সেটা কি উচিত কাজ হয়েছিল? “প্রোগ্রেসিভ অসাম্প্রদায়িক বাঙালির” জ্ঞানের না হয় গভীরতা নেই, পরমহংসকেও কি পরম মূর্খ বলবেন তাহলে? ৩৩ এর পল্লী যে অপরাধে অপরাধী, একই অপরাধে রামকৃষ্ণও কি অপরাধী নন? এঁরা তো কেবল অস্থায়ী মণ্ডপে মাটির মূর্তির উপস্থিতিতে নমাজ বাজিয়েছেন, তিনি তো খোদ দক্ষিণেশ্বরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পুরোহিত হয়ে অন্য ধর্মের দেবতার উপাসনা করেছেন।

মজার কথা (না, চিন্তার কথা) এই নিয়ে আপত্তি শুধু রামকৃষ্ণের চেয়েও বড় হিন্দুরাই করছেন না। মুসলমানরাও করছেন। তাঁদের কারো কারো ধারণা সর্বশক্তিমান আল্লা এতে হিন্দু দেবদেবীদের কাছে ছোট হয়ে গেলেন। আল্লাকে ছোট করা এত সহজ বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা এক কথায় মৌলবাদী। নইলে অন্য ধর্মের লোক তাঁর ধর্মের প্রার্থনা লোককে জানালে আপত্তি হবে কেন? অন্য ধর্মের লোক কোরান পড়লে কি আপনি রেগে যান, না খুশি হন? খুশি হওয়ারই তো কথা। উল্টোদিকেও তাই। কোনো মুসলমান ভালবেসে বেদ, উপনিষদ পড়েন জানলে রেগে যায় যে হিন্দু, সে যেমন মৌলবাদী, প্যান্ডেলে নমাজ শুনে যে মুসলমান রেগে যায় সেও মৌলবাদী ছাড়া কিছু নয়। এখন সঙ্ঘ পরিবারের যুগ, দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হল হিন্দুরা, তাই বজরং দল হল্লা করতে সাহস পায়, এঁরা পান না। এই যা তফাত।

আরেকটা মতও প্রচার হচ্ছে। অনেক মুসলমান নাকি আহত এই জন্যে যে আজান ব্যাপারটা প্রার্থনা, গান নয়। অতএব এটাকে পুজো মণ্ডপে বাজানো মানে আজানের অসম্মান। কী অদ্ভুত যুক্তি! পুজোর জায়গাতেই তো আজানের ব্যবহার করা হচ্ছে। আজানের সাথে কোমর দুলিয়ে কোনো সিনেমাবনিতা নাচছেন বলে তো খবর নেই। এতে আজানের অসম্মান হয়? এ যুক্তির সাথে তো হোয়াটস্যাপের যে বার্তার উল্লেখ করলাম তার কোন পার্থক্য নেই। আমারটা সেরা, তাকে অন্য কিছুর পাশে রাখলেই তার অসম্মান হয় — এই তো বলতে চাওয়া হচ্ছে আসলে।

তথাকথিত প্রগতিশীল যারা, তাদের বুদ্ধি বেশি। তাই তারা চালাকি করে বলছে “সর্বধর্ম সমন্বয়ের কোন প্রয়োজন নেই, সহাবস্থান হলেই যথেষ্ট।” শুনে মনে পড়ল আমার এক হিন্দুত্ববাদী প্রাক্তন বন্ধুর কথা। তার সাথে তর্ক হতে হতে একদিন বলেছিলাম “তুই কী চাস? মুসলমানদের মেরে ফেলা হোক বা ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক?” তার উত্তর ছিল “তা কেন? থাকুক এক পাশে। লাঠালাঠিরও দরকার নেই, গলাগলিরও দরকার নেই।”

মুসলমান নাগরিককে বাড়ি ভাড়া দেয় না যারা, মুসলমান হলে আবাসনে ফ্ল্যাট কিনতে দেয় না যারা তাদেরও কিন্তু আসলে বক্তব্য এটাই। তুমি বাপু তোমার এলাকায় থাকো, আমি আমার এলাকায় থাকি। এককথায়, সমন্বয়ের দরকার নেই, সহাবস্থানই যথেষ্ট। যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী প্রগতিশীল সমন্বয় বাতিল করে সহাবস্থানের তত্ত্ব খাড়া করেন, তিনি আসলে মুসলমানদের কোণঠাসা করার ব্যাপারীদেরই সাহায্য করেন। আর যে বামপন্থীরা এই তত্ত্ব সমর্থন করেন, তাঁদের উপযুক্ত বিশেষণ আমি খুঁজছি। এখনো পাইনি।

তাছাড়া এই প্রগতিশীলরা কে হরিদাস পাল যে সমন্বয়কে বাতিল করবেন? এ দেশে কয়েক হাজার বছর ধরে ধর্মীয় সমন্বয় হয়েই চলেছে। কোনো শাসক শুরু করেননি, অনেক শাসক আটকাতে চেয়েও পারেননি। সাধারণ মানুষ নিজের বুদ্ধি বিবেচনায় এই সমন্বয় করে চলেছেন। হিন্দুদের সত্যনারায়ণ কখন সত্য পীর হয়ে যান টের পাওয়া যায় না। ওলাউঠায় গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত একসময়। তা থেকে তৈরি হয়েছে ওলাবিবি। ওলাবিবির থানে হিন্দু, মুসলমান উভয়েই যান। কত মাজারে যে সন্তানহীনা হিন্দু মহিলারা সন্তান প্রার্থনা করেন তার কোন সেন্সাস হয়নি আজ অবধি। গতবছর বন্ধু মৃণালের শ্বশুরালয় পশ্চিম মেদিনীপুরের মোগলমারি গ্রামে গিয়েছিলাম। সে গ্রামের চালু মন্দির দূর থেকে দেখলে মসজিদ বলে ভুল হওয়া বিচিত্র নয়। ইসলামিক স্থাপত্যের অভিজ্ঞান যে গম্বুজ তা রয়েছে মন্দিরের মাথায়, দেয়ালে মসজিদের মত নকশা কাটা জাফরি। সুফি সাধকদের কথা তো বলতে শুরু করলে শেষ হবে না। দুজন কাওয়ালি গায়কের কথা বলি।

বন্ধু উজ্জ্বলের কল্যাণে বছর দুয়েক আগে শুনেছিলাম ফরীদ আয়াজ আর আবু মুহাম্মদের গান “ইয়াদ হ্যায় কুছ ভি হামারি”। সেখান গোকুল ছেড়ে চলে যাওয়া কানাইকে রাধিকা জিজ্ঞেস করছেন তাঁর কথা মনে আছে কিনা। কীভাবে কানাইয়ের খবর পেতে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন তার উদাহরণ হিসাবে বলছেন “পইয়াঁ পড়ি মহাদেবকে যা কে”। শেষ দিকে রয়েছে “ম্যায় কৌন হুঁ ঔর কেয়া হুঁ ইয়ে রিজওয়ান (জন্নতের দারোগার নাম) সে পুছো / জন্নত মেরে অজদাদ (পূর্বপুরুষ) কি ঠুকরায়ি হুয়ি হ্যায় / ফিরতি থি কিঁউ মারি মারি।” অর্থাৎ কৃষ্ণের প্রেয়সীর পূর্বপুরুষদের জন্নতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তিনি কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী হয়েছেন বলে। এই সমন্বয় যাঁরা চান না, যাঁরা বলেন এই সমন্বয় জগাখিচুড়ি, তাঁরা হিন্দু বা মুসলমান কারোর ভাল চান না।

অল ইন্ডিয়া রেডিওর তৈরি যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ না শুনলে বাঙালির শারদোৎসব শুরু হয় না, সেই অনুষ্ঠানের যন্ত্রশিল্পীদের অনেকেই ছিলেন মুসলমান। সেটা কি সহাবস্থানের উদাহরণ নাকি সমন্বয়ের উদাহরণ? সহাবস্থানবাদীরা কি বলবেন ঐ শিল্পীদের বাদ দিয়ে করা উচিত ছিল অনুষ্ঠানটা বা ঐ শিল্পীদের নিজে থেকেই বলা উচিৎ ছিল আমরা বাজাব না? এরপর কি শুনব বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের উচিত ছিল “হায় রাম” বোল বাদ দিয়ে “ইয়াদ পিয়া কি আয়ে” গাওয়ার আদেশ মেনে নিয়ে পাকিস্তানেই থেকে যাওয়া? নাকি শুনব নজরুলের অতগুলো শ্যামাসঙ্গীত লেখা ঠিক কাজ হয়নি? হিন্দুরাষ্ট্রবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমরা এভাবে সাভারকর-জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বকেই মেনে নেব নাকি?

কেউ কেউ আপত্তি করছেন এই বলে যে দৈনন্দিন জীবনে যখন মুসলমানদের এক সূত্রে বেঁধে নেওয়ার প্রচেষ্টা ক্রমশ তলানিতে ঠেকছে, তখন এ সমস্ত “দ্যাখনাই” ব্যাপারের কোন দরকার নেই। প্রথমত, ৩৩ এর পল্লী ওরকম থিম না করলে কি রোজকার জীবনে মুসলমানদের প্রান্তিক করে দেওয়ার চেষ্টা কিছুমাত্র কম হত? আর ওই মণ্ডপ হওয়াতেই বা দুই সম্প্রদায়ের ব্যবধান ঘোচানোর প্রচেষ্টায় আমাদের বাধা দিচ্ছে কে?

দ্বিতীয়ত, কিছুটা দ্যাখনাইয়েরও প্রয়োজন আছে বইকি। যুগটাই দৃশ্য শ্রাব্য উদ্দীপকের যুগ। নইলে মুসলমানদের রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে চুপিসাড়ে খুন করলেই তো হিন্দুত্ব ব্রিগেডের কাজ চলে যেত। প্রকাশ্য জায়গায় পিটিয়ে মারার দরকার কী? গণপিটুনির ভিডিও তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই বা কী? আসলে ওরা এমন করে শুধু সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্যে নয়, এমনটাই যে স্বাভাবিক, এরকম যে করাই যায় তা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে। এদের সাথে লড়তে গেলে আমাদেরও বেশি বেশি করে দেখানো দরকার যে পুজো আর নমাজ পাশাপাশি চলাটাই স্বাভাবিক।

আমাদের একজন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। তিনিও বলতেন যে আমার ভাই তাকে ছাদে উঠে চেঁচিয়ে আহা, ভাই বুকে এসো, বলার দরকার নেই। বললেই বরং বোঝা যায় কোন গোলমাল আছে। কথাটা সাধারণ অবস্থায় ঠিক। কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথও তো বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনে পথে নেমে সকলের হাতে রাখী পরালেন। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন গঙ্গাতীরে রাখীবন্ধন উৎসব করে জোড়াসাঁকোয় ফেরার পথে রবীন্দ্রনাথ সটান নাখোদা মসজিদে ঢুকে পড়লেন। ওঁরা তখন বাইরে দাঁড়িয়ে আশঙ্কা করছেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে। অথচ কিছুক্ষণ পরেই সহাস্য রবীন্দ্রনাথ ইমামের হাত ধরে বেরিয়ে এলেন রাখী পরিয়ে। তাহলে দ্যাখনাই কাজ করলেন কে? রবীন্দ্রনাথ, না ইমাম? নাকি দুজনেই? তার চেয়েও বড় কথা, কাজটা অন্যায় হয়েছিল কি?

আর দ্যাখনাই বলছেন কাকে? কোনো মুসলমান ব্যক্তি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে গেছেন এমন ছবি দেখেও দেখছি অনেকে অসন্তুষ্ট। এগুলো নাকি সংখ্যাগুরুর কাছে প্রিয় হওয়ার জন্যে দ্যাখনাই। মানে কি এই কথাটার? কোন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ পুজোয় নতুন জামাকাপড় কেনেন, ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোন হিন্দুদের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্যে? পশ্চিমবঙ্গের বহু পুজো কমিটি চালান যে মুসলমান কর্মকর্তারা, তাঁরা কি আসলে হিন্দুদের প্রিয় হতে চান? এইভাবে ব্যক্তিমানুষকে, তার সাধ আহ্লাদকে ধর্মীয় পরিচিতির কারণে অপমান করা যায়? তাহলে আমি যখন আমার মুসলমান বন্ধুর বাড়ি ইফতারে যাই, সেটা আসলে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করতে যাই? হোস্টেলজীবনে আমরা যে মুসলমান সহপাঠীদের ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময়ে হুমকি দিতাম “খাবার দাবার না আনলে ঢুকতে দেব না হোস্টেলে”, সেটা তাহলে সংখ্যালঘুর উপরে সংখ্যাগুরুর শক্তির আস্ফালন ছিল?

আমাকে আমার মত থাকতে দাও, তুমি তোমার মত থাকো — এই অনুপম রায়ে আসলে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের হাত শক্ত হচ্ছে। অনেক প্রগতিশীল, বামপন্থী হিন্দু এবং মুসলমানের যেসব বক্তব্য এবার পুজোয় শুনলাম তাতে বুঝলাম এঁরাও হিন্দুত্ববাদীদের মত হিন্দু, মুসলমান পৃথগন্ন হয়ে থাকলেই খুশি। কদিন পর এমনও বলতে পারেন যে হিন্দু-মুসলমানে বিয়ে টিয়েও না হলেই ভাল হয়। সেই আমার বন্ধুর মত আর কি। লাঠালাঠি চাই না, গলাগলিও চাই না।

নজরুলের কথা বলেছিলাম গোড়াতেই। তিনি ঠিক যা বলেছিলেন সেটা দিয়ে শেষ করি

আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেন না, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি।

%d bloggers like this: