শিক্ষণীয়

শিক্ষা নেওয়া সবসময় ভাল। পিঠে লাঠির বাড়ি পড়ার আগে নেওয়া গেলে আরো ভাল

আজকাল লিখতে ইচ্ছে করে না খুব একটা। আর কতদিন যা লিখতে ইচ্ছে করে তা লেখা যাবে তাও অনিশ্চিত। তাই দুটো কথা লিখে দিই। না লিখে আর থাকা গেল না বলেই লিখছি, নইলে কাউকে “বোর” করার ইচ্ছা নেই।

একজন সাংবিধানিক প্রধান (বেচারা সংবিধান) আপত্তি করেছেন ওয়েস্ট বেঙ্গলের লোকেরা কেন ইস্টবেঙ্গলকে সমর্থন করে তাই নিয়ে। তার জবাবে সকলে বলাবলি (এবং লেখালিখি) করছেন যে এটা ভুলভাল কথা বলে খবরে থাকার চেষ্টা, উনি ফুটবল তো জানেনই না, ইতিহাসও জানেন না ইত্যাদি।
এগুলো সবই ঠিক কথা। কিন্তু কথায় বলে প্রাজ্ঞ লোকের প্রজ্ঞার চেয়ে মূর্খের মূর্খামি দেখে অনেক বেশি শেখা যায়। এখানেও কিন্তু শেখার উপাদান আছে। কী সেটা?
হিন্দুত্ববাদীদের (“রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপতির কোন দল হয় না” কথাটা এখন “সদা সত্য কথা বলিবে” রকমের বাতিল প্রবাদ) চিরকালই বাংলাদেশের হিন্দুদের দুঃখে বুক ফাটে। তাদের দীর্ঘদিনের ঘোষিত দাবী হল বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা ভারতে চলে আসে তাদের শরণার্থী হিসাবে এ দেশে আশ্রয় দিতে হবে। আর যে মুসলমানরা আসে তাদের অনুপ্রবেশকারী গণ্য করে ফেরত পাঠাতে হবে। ২০১৪ সালে সরকারে আসার পর একে কাজে পরিণত করতে তারা বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। আসামে এন আর সি চলছে পুরো দমে (তাতে আসলে কী ঘটছে তা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না), অন্যদিকে নতুন নাগরিকত্ব আইন হচ্ছে। সেই আইনে বলা হচ্ছে যে কোন দেশ থেকে জাতিগত হিংসার শিকার হয়ে চলে আসা হিন্দুরা (বৌদ্ধ, জৈন, শিখ সকলকেই সাপটে হিন্দু ধরে নেওয়া হয়েছে অবশ্য) এ দেশে নাগরিকত্বের অধিকার পাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ বা পূর্বতন পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের প্রতি হিন্দুত্ববাদীরা সহানুভূতিশীল। অনেকটা সেই কারণেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালদের মধ্যে বিজেপির সমর্থন ক্রমবর্ধমান। যাঁরা নিজেরা বাঙাল তাঁরা জানেন যে আত্মীয়স্বজন অনেকেই ভাবছেন “হোক বাংলায় এন আর সি। ওরা আমাদের বাপ ঠাকুর্দাদের খেদিয়ে দিয়েছিল, বিজেপি এসে ওদেরও একটু দিক।”
তা ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তো মূলত বাঙালরাই। দেশভাগ বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু আগে তৈরি ক্লাব হলেও ইস্টবেঙ্গলের হার জিতের সঙ্গে যে উদ্বাস্তু হয়ে এ পারে চলে আসা বাঙালদের হাসি চোখের জল মিশে থাকে তা বাঙালি মাত্রেই জানে। সাংবিধানিক প্রধানবাবুও বিলক্ষণ জানেন। যদি উনি মোহনবাগান সমর্থক হন, তাহলে তো আরো বেশি করে জানেন। সেক্ষেত্রে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের জন্যে তো ওঁর বিশেষ ভালবাসা থাকার কথা ছিল। উল্টোটা হল কেন?
ব্যাপারটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালদের জন্যে শিক্ষণীয়। শিক্ষা নেওয়া সবসময় ভাল। পিঠে লাঠির বাড়ি পড়ার আগে নেওয়া গেলে আরো ভাল।

একজন লোক জোম্যাটোর মাধ্যমে খাবার কিনতে চেয়েছিল। শেষ অব্দি অর্ডার বাতিল করে কারণ খাবার দিতে যার আসার কথা ছিল সে মুসলমান। আর আমাদের ইনি বিরাট হিন্দু, মোছলমানের ছোঁয়া খান না। তা জোম্যাটো বিরাট হিন্দুটিকে বলেছে খাবারের কোন ধর্ম নেই, খাবার নিজেই একটা ধর্ম। উপরন্তু জ্যোমাটোর বাবু আবার বলেছেন আমরা এসব অন্যায় আব্দার রাখব না, তাতে যা হয় হবে। বলতেই গেল গেল রব উঠেছে, হাজার হাজার বছরের ধর্ম একটা ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মালিকের খোঁচায় নাকি রসাতলে যাচ্ছে। অতএব ধর্ম অন্তপ্রাণ হিন্দুরা সবাই মিলে অ্যাপটি আনইনস্টল করতে লেগেছে।
এ সম্বন্ধে কিছু শুকনো কথা বলার আছে। প্রথমত, জোম্যাটো বেশ করেছে। শুধু তাই নয়, যে লোকটি অর্ডার বাতিল করেছে তার কাজটা বস্তুত অস্পৃশ্যতা। দেশে অস্পৃশ্যতাবিরোধী আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী লোকটিকে অভিযুক্ত করা যায় কিনা সেটা আইনজ্ঞরা বলতে পারবেন, তবে নীতিগতভাবে এটা অস্পৃশ্যতাই।
দ্বিতীয়ত, আমাদের অফিসের পাশেই একটা নাম করা রেস্তোরাঁ থাকায় বিভিন্ন ডেলিভারি অ্যাপের হয়ে কর্মরত ছেলেদের সাথে আমাদের অল্প স্বল্প আলাপ আছে। যে কোন পেশার লোকের যে ন্যূনতম নিরাপত্তা প্রাপ্য তা তাদের নেই। ছেলেগুলো মোটামুটি লেখাপড়া জানা এবং বাইক চালায় দেখে ভুল করবেন না। এরা আক্ষরিক অর্থেই দিন আনে দিন খায়। ফলত ক্ষিদে পেলে পিঠের বাক্স খুলে অন্যের অর্ডার দেওয়া খাবারও খায়। ওদের জায়গায় আমি থাকলে আমিও খেতাম। বেশ করতাম।
সারা পৃথিবীতে মানুষের শ্রমকে বড় লোকেরা শস্তায় কিনে নিয়ে আরো বড়লোক হচ্ছে। তাই একুশ শতকের অর্থনীতিতে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হল দালালি। নানারকমের দালালি, যেখানে বিনিয়োগ তেমন কিছু নয় কারণ আসল পুঁজিটা হল শ্রম, যা খুব শস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। শুধু ভারতের জোম্যাটোর ডেলিভারি বয়রা নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামাজনের কর্মীরাও একদম ভাল নেই। সেই কারণেই কদিন আগে প্রাইম সেলের দিনগুলোয় তারা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল।
এসবের প্রতিবাদ করতে চান? খুব ভাল কথা। এইভাবে শ্রমিকদের শোষণ করার জন্যে অ্যামাজনকে গালাগাল দিন, জোম্যাটোকেও গালাগাল দিন। তা বলে সংখ্যাগুরু বাঁদরামির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে পাবলিসিটি স্টান্ট বলে উড়িয়ে দেবেন না। যদি এটা স্টান্ট হয় তাহলে এমন ঝুঁকিপূর্ণ স্টান্ট যা দেখানোর ঝুঁকি আজকের ভারতে বিশেষ কেউ নেবে না। আমাদের কোটিপতি ক্রিকেটারদের দেখছেন না? বিমুদ্রাকরণকে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ বলে দিতে পারেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে, অথচ নানা অজুহাতে যখন বেছে বেছে একটাই সম্প্রদায়ের মানুষকে খুন করা হয় তখন এঁরা অন্তত পাবলিসিটির জন্যেও একটা কথা বলেন কি? রূপোলি পর্দার তারকারাও তথৈবচ। সর্বকালের সবচেয়ে বড় তারকাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন গণপিটুনি নিয়ে। তো তিনি বলেছিলেন তিনি নাকি বিষয়টা ঠিক জানেন না। অর্থাৎ এই স্টান্টটা দেখাতে অমিতাভ বচ্চনও ভয় পান।
উনপঞ্চাশজন নানা পেশার বিশিষ্ট মানুষ অবশ্য দেখিয়েছিলেন স্টান্টটা। ফল কী? পাটনা হাইকোর্টে তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। বোঝা গেল কতটা বিপজ্জনক এই স্টান্ট? সেই স্টান্ট যদি নিজেদের পুরো ব্যবসার ঝুঁকি নিয়ে জোম্যাটো কর্তৃপক্ষ দেখিয়ে থাকেন তাহলে আপনার অবশ্যই হাততালি দেওয়া উচিৎ। অবশ্য আপনি যদি প্রকাশ্যে লিবারাল আর মনে মনে হিন্দুত্ববাদী হন তাহলে আলাদা কথা।

%d bloggers like this: