যারে কয় ব্যালান্স

মানে ব্যালান্স ব্যাপারটা কিরকম বুঝলেন তো? আইসিস অধ্যুষিত সিরিয়ায় দাঁড়িয়ে আমাকে বলতে হবে যে আমি ক্যাথলিক গোঁড়ামির তীব্র সমালোচক, নইলে ধরে নেওয়া হবে যে আমি আইসিসের নিন্দা করছি মুসলমান বিদ্বেষবশত। ওখানে তার শাস্তি কী জানেন তো? পিনারাই বিজয়ন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যা করলে এখানে কোটিপতি হওয়ার অফার দেওয়া হয় আর কি। সিরিয়া এই জায়গাটায় আমাদের থেকে এগিয়ে আছে এখনো। ওদের কথা কম, কাজ বেশি

বাজারে একটা জিনিসের এখন দারুণ কাটতি — ভারসাম্য, বাংলায় আজকাল যারে কয় ব্যালান্স। সবেতেই ব্যালান্স রাখতে হবে। হিন্দুর বাঁদরামির নিন্দা করলেই মুসলমানেরও কোন একটা দোষ নিয়ে যারপরনাই গাল দিতে হবে, কোথাও দলিতদের বাড়িতে উঁচু জাতের লোকেরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে জেনে আমি যদি রেগে চিৎকার করি তাহলে সিগারেটের প্যাকেটের বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মত সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলতেই হবে যে দলিতরা যদি এরকম করত সেটাও অন্যায় হত। কোথাও কোন সাঁওতাল মেয়ের উপরে পুলিসী নির্যাতনের নিন্দা করলেই আমাকে বলতে হবে “যদিও আমি সাঁওতালদের দেশবিরোধী কার্যকলাপকে সমর্থন করি না” (মানে দেশটা আমার বাপের জমিদারী আর সাঁওতালরা আমার প্রজামাত্র এবং কোন সাঁওতাল সরকারবিরোধী কিছু করল মানেই মেয়ে-বউরা আমার বৈধ খাদ্য হয়ে গেল)। আমাকে আরো বলতে হবে যে আমি সবার সমানাধিকারের পক্ষে, কাউকে কোন বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিপক্ষে। অর্থাৎ শিক্ষায় এবং চাকরিতে তফসিলি জাতি উপজাতির জন্য (আর ট্রেনে বাসে মহিলা ও বয়স্কদের ব্যাপারটা কী হবে?) আসন সংরক্ষণের বিপক্ষে। এই ভারসাম্য রক্ষা যদি আমি না করতে পারি তাহলেই আমি হিন্দুবিদ্বেষী/দেশদ্রোহী/মাওবাদী/সিকুলার। মনে রাখতে হবে এগুলো সমার্থক শব্দ।
মানে ব্যালান্স ব্যাপারটা কিরকম বুঝলেন তো? আইসিস অধ্যুষিত সিরিয়ায় দাঁড়িয়ে আমাকে বলতে হবে যে আমি ক্যাথলিক গোঁড়ামির তীব্র সমালোচক, নইলে ধরে নেওয়া হবে যে আমি আইসিসের নিন্দা করছি মুসলমান বিদ্বেষবশত। ওখানে তার শাস্তি কী জানেন তো? পিনারাই বিজয়ন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যা করলে এখানে কোটিপতি হওয়ার অফার দেওয়া হয় আর কি। সিরিয়া এই জায়গাটায় আমাদের থেকে এগিয়ে আছে এখনো। ওদের কথা কম, কাজ বেশি।
তা এই যে জনগণ ব্যালান্স দাবি করছে আমার থেকে তা নিশ্চয়ই এই জন্যে যাতে আমাদের দেশের ব্যালান্স নষ্ট না হয়? তা দেখা যাক কিরকম ব্যালান্সের মধ্যে বাস করি আমরা।
দেশের ৭৫% এর বেশি যারা তাদের ধর্মীয় নেতারা গলা উঁচিয়ে বলবে অন্যদের যেন বাড়তে না দেওয়া হয়। “বড্ড বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ চারটে পাঁচটা করে বাচ্চার জন্ম দেওয়া যাতে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকতে পারি।” মানে জনসংখ্যায় ব্যালান্স এসে যাচ্ছে বলে ভয় দেখানো এবং যেন না আসে তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে বলা।
এরপরে আবার এদেশে ব্যালান্সের কথা বলা হয় কোন মুখে?
গেরুয়া পরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী জাগতিক দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসবে অনর্গল সাম্প্রদায়িক বিষ বমনের পর এবং তাকে বলা হবে জননেতা অথচ গৃহী মুসলমানকে বলা হবে “সাম্প্রদায়িক নেতা” যেহেতু তার গালে দাড়ি আর মাথায় ফেজ।
এই দেশে ব্যালান্স বজায় রাখতে হবে।
কারোর যথেষ্ট প্রমাণ না থাকতেও ফাঁসি হবে “সমবেত বিবেক” কে উপশম দিতে আর কেউ প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েও মন্ত্রী সান্ত্রী হবে, কোটি কোটি লোকের পূজনীয় হয়ে উঠবে। পঁচিশ বছর পর কাঠগড়ায় দাঁড়ালে লোকে এমন করবে যেন বেচারা ভগৎ সিং।
এই দেশে ব্যালান্স বজায় রাখতে হবে! আমরা কি নাগরিক না ট্রাপিজের খেলোয়াড়?
এক ভদ্দরলোক আবার সারাজীবন শীতকালে খোলামাঠে লাউডস্পিকারে গান গেয়ে পয়সা কামালেন, এখন লাউডস্পিকারে নামাজ শুনে ঘুমোতে পারছেন না। লোকে দ্বিচারিতাটা ধরে দিতেই ঝুলি থেকে ব্যালান্স বার করলেন — “গুরুদ্বার, মন্দির সবের কথাই বলছি। মসজিদে আপত্তি নেই, লাউডস্পিকারে আপত্তি।” মুম্বাই শহরে থেকে গণেশ চতুর্থীর হুজ্জত নিয়ে কিন্তু কোনদিন কিছু বলেছেন বলে অভিযোগ নেই। সেই সিরিয়ায় দাঁড়িয়ে ক্যাথলিকদের সমালোচনা আর কি। তবে এঁর চালাকিকে ব্যালান্স করার মত নির্বোধও তো আছে আমাগো দ্যাশে। তেমন একজনের কল্যাণে উনি এখন কামিয়ে কামানোর চেষ্টা করছেন। নাম কামাতে সফল হয়েছেন এর মধ্যেই, অনেকদিন পর। তবে পয়সা কামাতে হয়ত সফল হবেন না কারণ যে নির্বোধ দশ লাখ দেবে বলেছিল তার বোধহয় টাকা কম পড়েছে, তাই নতুন নতুন শর্ত দিচ্ছে। আসলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করতে হয় না তো (যাদের হয় তারা ফতোয়া দেয় না কারণ তাদের টাকার দাম আছে), তাই ব্যালান্স চেক করার অভ্যাসটা নেই।
একটা গোটা দেশের এহেন কেমিক্যাল ইমব্যালান্স নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।

%d bloggers like this: