অমর্ত্য সেন, ক্লিকটোপ আর মাদাম তুসো

অমর্ত্যকে গালি দেওয়ার কাজটাও কেবল বাঙালিরাই করছেন। বিজেপির মধ্যেও কেবল তথাগত, দিলীপ ঘোষরাই। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

আনন্দবাজার পত্রিকা স্মরণীয় শিরোনাম দেওয়ার জন্য বিখ্যাত। এই তো সেদিন পেলের প্রয়াণে শিরোনাম হল ‘আমার সম্রাট স্বপ্নে থাক’। শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’ পড়া থাকলে পাঠকের কাছে এই শিরোনামের রস কিঞ্চিৎ ঘনীভূত হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু না থাকলেও রসে তিনি পুরোপুরি বঞ্চিত হবেন না। খবরের কাগজে এই ধরনের শিরোনামকেই সেরা বলে ধরা হয়ে এসেছে চিরকাল। অমর্ত্য সেন যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন আমার মত যাদের সবে গোঁফদাড়ি গজিয়েছিল, তাদের নির্ঘাত এই মধ্যবয়সে এসেও মনে আছে সেই অবিস্মরণীয় শিরোনাম – ‘মর্তের সেরা পুরস্কার বাংলার অমর্ত্যর’। তখন ইন্টারনেট থাকলেও সোশাল মিডিয়া ছিল না, সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে ক্লিক আদায় করার চাপ ছিল না, ক্লিকটোপের প্রয়োজন ছিল না। এখন আছে। অনিবার্যভাবে ওয়েব মাধ্যমের এই কৌশল অন্য মাধ্যমগুলোতেও ঢুকে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে খবরের কাগজের সাংবাদিকদের কাজের মূল্যায়নও মালিকরা করছেন কোন প্রতিবেদনে ওয়েবে কতগুলো হিট হল তা দিয়ে। কোনো কোনো কাগজ অনলাইন সংস্করণের জন্য আলাদা কর্মীবাহিনী না রেখে এক মাইনেয় দুটো কাজই করিয়ে নিচ্ছে সাংবাদিকদের দিয়ে। ফলে খবরের কাগজের শিরোনামেও সত্যনিষ্ঠা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, বুদ্ধির দীপ্তি, ভাষার নৈপুণ্য গুরুত্ব হারাচ্ছে, প্রাধান্য পাচ্ছে শিরোনামে “অশ্বত্থামা হত” বলে চোখ টেনে নিয়ে প্রতিবেদনে বেশ পরের দিকে “ইতি গজ” বলার প্রবণতা। সেই ধারাতেই দিন তিনেক আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন নিয়ে শীতের বাংলা কদিন উত্তপ্ত। তার শিরোনাম – মমতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য, বলেই দিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ‘ভারতরত্ন’ অমর্ত্য সেন।

এই শিরোনামে চোখ পড়া মাত্রই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে অমর্ত্য মমতা ব্যানার্জিকে একটা শংসাপত্র দিয়েছেন। এমনকি যে পাঠক মমতার অনুরাগী এবং/অথবা তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক, তাঁর পক্ষে এমন ভেবে নেওয়াও অসম্ভব নয় যে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে অমর্ত্য মমতাকেই যোগ্যতম বলেছেন। কারণ অমর্ত্যের বিজেপিবিরোধিতা সর্বজনবিদিত; তিনি তো আর নরেন্দ্র মোদীকে যোগ্যতম বলবেন না। এই ধারণা আরও দৃঢ় হবে মমতার প্রতিক্রিয়া জানলে। তিনি বলেছেন “অমর্ত্য সেন বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত, আমাদের অন্যতম গর্ব। তাঁর পর্যবেক্ষণ আমাদের পথ দেখায়। তাঁর উপদেশ আমাদের কাছে আদেশ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চয় সবাইকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।” যেন অমর্ত্য তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন।

অথচ আনন্দবাজারের প্রতিবেদনটা পড়তে গেলে একেবারে অন্য সত্যের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। আসলে সংবাদসংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই)-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে অমর্ত্য অনেক কথাবার্তা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটা ছিল ইংরেজিতে। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে মমতার ক্ষমতা সম্পর্কে অমর্ত্যের নিজের ব্যবহৃত শব্দগুলো হল, “It’s not that she does not have the ability to do it. She clearly has the ability. On the other hand, it’s yet not established that Mamata can pull the forces of public dismay against the BJP in an integrated way to make it possible for her to have the leadership to put an end to the fractionalisation in India.”

এই ability শব্দটার বাংলা তর্জমা ক্ষমতা এবং যোগ্যতা – দুইই হতে পারে। অমর্ত্য যদি qualification শব্দটা ব্যবহার করতেন তাহলে তিনি যে যোগ্যতাই বুঝিয়েছেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকত না। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় তিনি যোগ্যতাই বুঝিয়েছেন, তাহলেও পরের শব্দগুলো অমর্ত্যের অনাস্থার ইঙ্গিত। নিজের মত করে তর্জমা না করে বরং আনন্দবাজারের প্রতিবেদন থেকেই গোটা উক্তিটা তুলে দেওয়া যাক – “এমন নয় যে তাঁর এটা করার ক্ষমতা নেই। এটা খুব স্পষ্ট, তাঁর সেই ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে, এটা এখনও প্রতিষ্ঠিত নয় যে, মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে জনগণের হতাশার জায়গাগুলোকে এক ছাতার তলায় এনে ভারতে বিভেদের রাজনীতির অবসান ঘটাতে নেতৃত্ব দেবেন।”

কিমাশ্চর্যম তৎপরম! শিরোনামের ‘যোগ্য’ প্রতিবেদনে এসে ‘ক্ষমতা’ হয়ে গেল! অর্থাৎ মমতার যোগ্যতা হল অশ্বত্থামা। সে যে মৃত সে খবর শিরোনামে দিয়ে অনলাইনে ক্লিক এবং অফলাইনে জোর আলোচনা নিশ্চিত করার পর প্রতিবেদনে ক্ষমতার কথা বলা হল, পাঠককে নিচু স্বরে জানিয়ে দেওয়া হল, যে মারা গেছে সে দ্রোণাচার্যের পুত্র নয়, একটা হাতি মাত্র। এ যে সম্পাদকমণ্ডলীর সচেতন সিদ্ধান্ত তাতে সন্দেহ নেই, কারণ অমর্ত্য ability শব্দটা কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে অত বড় কাগজের সম্পাদকমণ্ডলী তো দূরের কথা, কোনো সাধারণ পাঠকেরও সন্দেহ থাকবে না প্রসঙ্গ জানা থাকলে। সোশাল মিডিয়ার যুগে অপ্রাসঙ্গিকভাবে মহাপুরুষদের উদ্ধৃত করা অতিমারীতে পরিণত হয়েছে অনেকদিন হল। এই কৌশলে কেউ প্রমাণ করতে চান রবীন্দ্রনাথ বা আম্বেদকর মুসলমান, খ্রিস্টানদের মোটেই সুবিধের লোক মনে করতেন না। কেউ আবার স্বামী বিবেকানন্দকে বামপন্থী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। সেই কুঅভ্যাসকে প্রশ্রয় না দিয়ে আমরা বরং আনন্দবাজারের তর্জমা থেকেই দেখে নিই অমর্ত্য কী প্রসঙ্গে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন “আমার মনে হচ্ছে, একাধিক আঞ্চলিক দল আগামী দিনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। আমার মনে হয়, ডিএমকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দল। তৃণমূলও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবাদী পার্টির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু আমি জানি না, এই মুহূর্তে তারা কী অবস্থায় রয়েছে।”

স্পষ্টতই অমর্ত্যের মাথায় রয়েছে তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এবং তার সাপেক্ষে লোকসভায় ডিএমকে, তৃণমূল কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি লোকসভায় কত আসন পেতে পারে সেই হিসাব। এই রাজ্যগুলোর সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে ওই তিন দলের প্রাপ্ত আসন যোগ করলে দাঁড়ায় ৪৮৫ (তৃণমূল ২১৫ + ডিএমকে ১৫৯ + সমাজবাদী পার্টি ১১১)। এই তিন রাজ্যে মোট লোকসভা আসনের সংখ্যা ১৬১ (পশ্চিমবঙ্গ ৪২ + তামিলনাড়ু ৩৯ + উত্তরপ্রদেশ ৮০)। সাধারণত একটা লোকসভা আসনের মধ্যে থাকে সাতটা বিধানসভা আসন। আন্দাজ পাওয়ার জন্য তৃণমূল, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টির ৪৮৫ আসনকে সাত দিয়ে ভাগ করলে দাঁড়ায় প্রায় ৭০। এই সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য আগেই বলেছেন ২০২৪ নির্বাচন বিজেপি একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে জিতে যাবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি সঠিক প্রমাণিত হলে বিজেপির আসন সংখ্যা এখনকার চেয়ে কমে যাবে, ত্রিশঙ্কু লোকসভা হওয়াও অসম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, সেক্ষেত্রে ৭০টা আসন অমূল্য। সেই কারণেই আঞ্চলিক দলগুলোর কথা বলা।

কিন্তু বিধানসভা আর লোকসভা নির্বাচন যে এক নয় সেকথা অমর্ত্য বিলক্ষণ জানেন। উপরন্তু লোকসভা নির্বাচন আসতে আসতে এই রাজ্যগুলোর ভোটারদের এই দলগুলো সম্পর্কে মতও বদলাতে পারে নানা কারণে, হয়ত ইতিমধ্যে বদলেও গেছে। সেসব মাথায় রেখেই তিনি যোগ করেছেন “কিন্তু আমি জানি না, এই মুহূর্তে তারা কী অবস্থায় রয়েছে।” এতৎসত্ত্বেও ক্লিকটোপ ফেলতে এবং নিঃসন্দেহে সম্পাদকীয় নীতির কারণে শিরোনামে এসে গেল, অমর্ত্য বলেছেন মমতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমও পত্রপাঠ এই নিয়ে হইচই শুরু করে দিল।

এ পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল। সংবাদমাধ্যম এমনটাই করে থাকে, করা তাদের ব্যবসায়িক স্বাধীনতা। হয়ত বাকস্বাধীনতাও। আমাদের বাকস্বাধীনতা হল এমন আচরণের সমালোচনা করা। মুশকিল হল, ব্যাপার সেখানে থেমে থাকেনি। বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থী বাঙালিরা ৮৯ বছরের লোকটাকে গালাগাল দিতে নেমে পড়েছেন। তথাগত রায়ের মত দক্ষিণপন্থী, যাঁরা প্রায়শই বলে থাকেন অমর্ত্য অর্থনীতি কিস্যু জানেন না (অর্থাৎ প্রযুক্তিবিদ তথাগত অর্থনীতি জানেন), তাঁরা ওঁকে নিজের বিষয়ের বাইরে কথা বলতে নিষেধ করছেন। এদিকে তৃণমূল শাসনে তিতিবিরক্ত অনেক বামপন্থী অমর্ত্যকে ‘চটিচাটা’ তকমা দিচ্ছেন। ঠিক যেভাবে বিজেপির সমালোচনা করলেই অমর্ত্যকে তাদের ট্রোলবাহিনী কংগ্রেসের ধামাধরা বলে অভিহিত করে। নোবেলজয়ী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যাঁর এ দেশে কোনোদিন পা না রাখলেও চলে, তাঁর যে কারোর ধামা ধরার বা চটি চাটার প্রয়োজন নেই তা এদের বোঝাবে কে?

আরও পড়ুন রেউড়ি সংস্কৃতি: যে গল্পে ডান-বাম গুলিয়ে গিয়েছে

সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী কিন্তু মমতার ক্ষমতা সম্পর্কে অমর্ত্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তারপর নিজের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বলেছেন, বিজেপিবিরোধী শক্তিগুলিকে এক করা দূরের কথা, মমতা বরং তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চেষ্টা করবেন।

#EISAMAY “অমর্ত্য সেন সঠিক সংশয় প্রকাশ করছেন যে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজোট করতে পারবেন? আমরা বলছি একজোট করার বদলে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলি যাতে একজোট না হতে পারে তৃণমূল তার চেষ্টা করছে” মন্তব্য সুজন চক্রবর্তীর ⁦@SUJAN_SPEAK⁩ #CPIM #TMC #BJP PIC.TWITTER.COM/IJZIID5DZY— prasenjit bera (@prasenjitberaES) January 14, 2023

কিন্তু তাতে কী? কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মুখে ছাই দিয়ে সোশাল মিডিয়ার যুগে সব বাম দলেই কমবেশি ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ চালু হয়ে গেছে। সেই প্রথা মেনে সিপিএম কর্মী, সমর্থকরা বিভিন্ন মাত্রায় অমর্ত্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেই চলেছেন। তাঁদের সবচেয়ে ভদ্র অংশ বলছে, বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে। কেউ কেউ আবার গভীর পর্যবেক্ষণের পর মন্তব্য করছে অমর্ত্য নাকি বেশ কিছুদিন হল মমতার ধামা ধরেছেন। কারোর বক্তব্য, এসব শান্তিনিকেতনে নিজের জমি, বাড়ি বাঁচাতে হার্ভার্ডের অধ্যাপকের মরিয়া চেষ্টা। বিজেপি সমর্থক বাঙালিরাও মোটামুটি এইসব অভিযোগই তুলছে বৃদ্ধের বিরুদ্ধে। অমর্ত্য সেনের চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে মেম বিয়ে করেছেন বলে নোবেল পেয়েছেন – এই পুরনো অভিযোগটা এখনো ট্রাঙ্ক থেকে বের করে মাঘের রোদে মেলে দেওয়া হয়নি।

পরিতাপের বিষয়, যদিও পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে সারা দেশের সংবাদমাধ্যমে লেখালিখি হয়েছে এবং প্রায় একই সময়ে দ্য ওয়ার ওয়েবসাইটের সাংবাদিক করণ থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারকে আরও বিশদে এবং কঠোরতম ভাষায় তুলোধোনা করেছেন, তা নিয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ায় প্রায় কোনো আলোচনা নেই।

অমর্ত্যকে গালি দেওয়ার কাজটাও কেবল বাঙালিরাই করছেন। বিজেপির মধ্যেও কেবল তথাগত, দিলীপ ঘোষরাই। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এমনকি বিজেপিবিরোধী বিদ্বানদের গাল না পাড়লে যাঁর ভাত হজম হয় না, সেই অমিত মালব্য পর্যন্ত এখন পর্যন্ত একটা টুইট করেননি। অথচ শেষ জীবিত পৃথিবীবিখ্যাত বাঙালিকে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী বাঙালিরা স্রেফ অপছন্দের রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে একটি মন্তব্যের কারণে যা খুশি তাই বলে চলেছেন।

বাঙালি মেধার এহেন অবনমন কৌতুককর। আনন্দবাজার ক্লিকটোপ ফেলেছে এবং সে টোপ গেলা মানুষের সংখ্যাধিক্য প্রমাণ করছে, শিরোনাম পেরিয়ে প্রতিবেদন অবধি যাওয়া লোকেরা আজকাল ব্যতিক্রম। আরও মজার কথা হল, ওই কাগজটাকে যাঁরা বাজারি কাগজ বলে হেলা শ্রদ্ধা করেন চিরকাল, সেই বামপন্থীরাও এই টোপ কম গেলেননি। অর্থাৎ প্রকাশ্যে বাজারি বলে গাল দিলেও পড়ার বেলায় ওই কাগজটাই পড়েন। শুধু তাই নয়, সম্ভবত কেবল ওটাই পড়েন। নইলে অন্য একাধিক জায়গায় প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারের প্রতিবেদন থেকেই জেনে ফেলতে পারতেন, অমর্ত্য মমতাকে কোনো শংসাপত্র দেননি।

অমর্ত্য সেন ভগবান নন। দুনিয়ার সব ব্যাপারে তিনি যা বলবেন তাই মেনে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বস্তুত সমাজবিজ্ঞানে ঠিক আর ভুলের সীমারেখা স্থির নয়, ফলে অত বড় পণ্ডিতের বক্তব্যকে একজন কলেজপড়ুয়াও চ্যালেঞ্জ জানাতেই পারে। কিন্তু যা খুশি বলা আর ভিন্নমত পোষণ করা এক জিনিস নয়। বামফ্রন্ট আমলে বেশ কয়েকবার অমর্ত্য সেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমালোচনা করেছিলেন, সরকার একমত হয়নি। একবার তো অমর্ত্যকে ভুল প্রমাণ করতে গণশক্তির পাতায় কলম ধরেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত।

আজকের পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য এসব কথা স্মরণ করিয়ে লাভ নেই। ডান, বাম নির্বিশেষে মাদাম তুসো মার্কা মৃণাল সেনে মজে থাকা বাঙালি ভিন্নমত হতে গেলে যে লিখতে হয়, নিদেনপক্ষে প্রতিপক্ষের বক্তব্য পুরোটা পড়তে হয় – সেকথা কেন বিশ্বাস করতে যাবে?

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

সেতু ভাঙলেও টাল খায় না গুজরাট মডেল

সারা দেশের ভদ্রলোক শ্রেণি গুজরাট বলতে অজ্ঞান। কি চমৎকার রাস্তা! সবরমতীর ধারটা কি দারুণ করেছে! লোকের কত টাকা! দিল্লি থেকে কন্যাকুমারী – সর্বত্রই মুগ্ধতার কারণগুলো মোটামুটি এক। বাঙালি ভদ্রজনের মুগ্ধতার দুটো অতিরিক্ত কারণ আছে – ১) ওখানে কত ইন্ডাস্ট্রি, ২) ওখানে কেউ চাকরি বাকরি নিয়ে মাথায় ঘামায় না, সবাই ব্যবসা করে। এই মুগ্ধ জনতার সাথে খানিকক্ষণ কথা বললেই টের পাওয়া যায় এঁরা গুজরাট বলতে বোঝেন আমেদাবাদ, বড়জোর ভদোদরা। তলিয়ে জিজ্ঞেস করলে বেরিয়ে পড়ে বেড়াতে গিয়ে আমেদাবাদের বাইরে কেবল গির অরণ্যের সিংহ দেখেছেন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বলতেও এঁরা কলকাতাই বোঝেন, মহারাষ্ট্র বলতে মুম্বাই। ফলে বামপন্থী বা ডানপন্থী যা-ই হোন, গুজরাট মডেলে এঁদের অগাধ আস্থা। তবে স্বপ্নের গুজরাটে বেমক্কা সেতু ভেঙে পড়লে কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েন।

মোরবিতে মেরামতির জন্য সাত মাস বন্ধ থাকা সেতু দিন পাঁচেক হল খোলা হয়েছিল, রবিবার ভর সন্ধেবেলা ভেঙে পড়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে খুলে দেওয়ার আগে নাকি সুরক্ষা শংসাপত্রও নেওয়া হয়নি। উন্নয়নের গুজরাট বলে কথা, উন্নয়ন কি আর লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রাখা যায়? কর্মবীর নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য। কয়েক হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি ডুবে যাবে জেনেও যেখানে সর্দার সরোবর বাঁধ তৈরি করা হয় বহু বছরের আন্দোলন দুরমুশ করে দিয়ে।

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন পর্যন্ত শ দেড়েক মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। তাতে কী-ই বা এসে গেল? গুজরাটে অনেক কাজ হয়, তার মধ্যে খানিকটা দুর্নীতি তো হবেই। আমাদের এখানে তো কাজই হয় না – এমন ধারণা দিয়েই অনেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা করবেন সন্দেহ নেই। আসলে উন্নয়ন মানে যে শহরের উন্নয়ন; অর্থাৎ ফ্লাইওভার, রাস্তা, সেতু, পার্ক, রেলিং, ফুটপাথ নির্মাণ – একথাই আমরা শিখেছি। অমর্ত্য সেন বাঙালি বলে আমাদের দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু তিনি উন্নয়নের যে অন্যতর সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে আমাদের আগ্রহ নেই। তাঁর কাজের ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদ মহবুব উল হকের তৈরি হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে গুজরাট সচরাচর মাঝের সারির উপরে উঠতে পারে না। ২০২১ সালেও অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ সমেত ১৯ রাজ্যের সঙ্গে গুজরাট মিডিয়াম এইচডিআই ক্যাটেগরিতেই ছিল। সে রাজ্যের অনেক জায়গায় যে ছেলেমেয়েরা সাঁতরে নদী পেরিয়ে স্কুলে যায়, শিক্ষার হাল ভাল নয়, স্বাস্থ্যের হাল ভাল নয় – এসব খবরও বাসি। কিন্তু ওসবে আমরা আমল দেব কেন? পেল্লাই কারখানা হলেই যে প্রচুর কর্মসংস্থান হয় না, উন্নয়ন হয় না সেসব আমরা এখনো টের পাইনি যে। তাই তো পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর এখনো রাজনৈতিক চাপান উতোরের বিষয়।

আরও পড়ুন কী ঢাকছে সরকারি চোলি? কেনই বা ঢাকছে?

সংবাদসংস্থা আইএএনএস জুন মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, গুজরাটে বেকার সমস্যা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে গ্রাম পঞ্চায়েতের এক্সিকিউটিভ প্রধানের ৩৪০০ শূন্য পদে চাকরির জন্য ১৭ লক্ষ আবেদন পত্র জমা পড়েছিল। কিন্তু গুজরাট বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনের প্রচারের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায় ওসব কোনো ইস্যু নয়। ইস্যু হল হিন্দুত্ব। অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলছেন টাকায় লক্ষ্মী, গণেশের ছবি ছাপানো উচিত আর বিজেপির বিদায়ী মন্ত্রিসভা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার জন্য কমিটি গঠন করছে। সেতু ভেঙে পড়া এমন কী ব্যাপার? জীবন মৃত্যু তো ভগবানের হাতে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত