শুধু কুস্তির পদক নয়, দেবতার গ্রাসে আজ সবার সন্তান

যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

অলিম্পিক নয়, এশিয়ান গেমস নয়, কমনওয়েলথ গেমস নয়, এমনকি সাফ গেমসও নয়। স্রেফ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জেতা একখানা পদকের পিছনেও কত বছরের পরিশ্রম, কত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ত্যাগস্বীকার থাকে তা যে কোনো ক্রীড়াবিদকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। আরও বেশি করে টের পাওয়া যায় একটুর জন্য পদক জিততে পারেননি যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে। প্রয়াত মিলখা সিং জানতেন, কলকাতার ছেলে জয়দীপ কর্মকার জানেন, আগরতলার মেয়ে দীপা কর্মকারও জানেন সারাজীবনের পরিশ্রমের পর তীরে এসে তরী ডুবলে কেমন লাগে। অথচ গোটা দুনিয়ায় চতুর্থ হওয়াও সারাজীবনের সাধনা ছাড়া সম্ভব নয়।

সেই ১৮৯৬ সালে শুরু হয়েছিল আধুনিক অলিম্পিক। সোয়াশো বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। অথচ হকি দলের পদকগুলো বাদ দিলে কতজন ভারতীয় অলিম্পিক পদক জিতেছেন তা আজও এক হাতের কড়ে গুনে ফেলা যায়। এ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় যে ১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে শ্যানন মিলার একটা অলিম্পিক থেকেই পাঁচটা পদক জিতে নেবেন বা একা মাইকেল ফেল্পসের আলমারিতেই থাকবে প্রায় আড়াই ডজন অলিম্পিক পদক। দেশটা চীনও নয় যে ছোটবেলা থেকে পদকজয়ী অলিম্পিয়ান তৈরি করতে যত্ন নেবে দেশের সরকার। এমন দেশের ক্রীড়াবিদরা যখন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক স্তরে জেতা পদক জলে ফেলে দেবেন, তখন বুঝতে হবে পৃথিবীর সব রং মুছে গেছে তাঁদের চোখের সামনে থেকে। সূর্য নিভে গেছে।

‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় যে মা রাগের মাথায় সন্তানকে বলে ফেলেছিলেন “চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে”, নিজের কথা কানে যেতে যে অনুতাপবাণে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল, একজন পদকজয়ী ক্রীড়াবিদের “মেডেল গঙ্গায় ফেলে দেব” বলার সময়ে তার চেয়ে কম যন্ত্রণা হয় না। কারণ একটা পদক জিততে হলে সন্তান পেটে ধরার মতই দীর্ঘ শারীরিক ও মানসিক বেদনা সহ্য করতে হয়। ভারতের কুস্তিগীররা, বিশেষ করে মহিলা কুস্তিগীররা, আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তা বুঝতে চাইলে আগে এই কথাটা স্পষ্ট বোঝা দরকার।

ক্রীড়াবিদরা সফল হওয়ার পরে সমস্ত আলো তাঁদের উপর এসে পড়ে। সাফল্যের পথটার উপরে আলো ফেলা হয় না সচরাচর। ফলে স্বীকার্য যে পদক জয়ের সলতে পাকানোর পর্ব খুব বেশি মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যাঁরা মতি নন্দীর কাহিনি অবলম্বনে সরোজ দে পরিচালিত কোনি বা শিমিত আমীন পরিচালিত চক দে ইন্ডিয়া দেখেছেন, তাঁদের বলে দিতে হবে না যে স্রেফ প্রতিভায় চিঁড়ে ভেজে না। পেশাদার খেলোয়াড়ের জীবন বস্তুত ব্যথার পূজা। এমন ভয়ঙ্কর ব্যথা, যে খেলার জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা কিছু ফিল্ম সমালোচকের মনে হয়েছিল, গীতা ও ববিতা ফোগত এবং তাঁদের বাবা মহাবীর ফোগতের জীবন নিয়ে তৈরি দঙ্গল ছবিতে নারীত্বের অবমাননা দেখানো হয়েছে। মহাবীর মেয়েদের উপরে নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়েছেন, সেখানে ‘ফিমেল এজেন্সি’-র অভাব ইত্যাদি। এঁরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁশ নিয়ে তাড়া করার দৃশ্য সম্পর্কে কী ভাবেন কে জানে! যা-ই ভাবুন, পৃথিবীর সমস্ত ক্রীড়াবিদের সাফল্য ওই পথেই এসেছে। নির্মম মমতা ছাড়া সফল ক্রীড়াবিদ হওয়া যায় না।

তাহলে ভাবুন, পছন্দের খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে, নিজের বয়সী আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মত আনন্দ ফুর্তি বাদ দিয়ে, কোচের চোখরাঙানি হজম করে, খাটতে খাটতে আধমরা হয়ে গিয়ে যে পদক জেতেন একজন ক্রীড়াবিদ – সেই পদক বিসর্জন দিতে চান কোন অসহায়তায়।

ভিনেশ ফোগত, সঙ্গীতা ফোগত, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়ারা সেই অসহায়তায় পৌঁছেছেন। আপাতত হরিয়ানার কৃষক নেতাদের অনুরোধে গঙ্গায় পদক বিসর্জন দেওয়ার পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু কী হবে পাঁচদিন পরে?

হবে অশ্বডিম্ব – এই মনোভাব নিয়েই এই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তাই এই চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়েছে আমাদের কুস্তিগীরদের। সাধারণভাবে একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশের ক্রীড়াবিদদের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, ভারতের ক্রীড়াবিদদের ঘাড়ে সেসব তো আছেই। আছে একগাদা উপরি পাওনাও। বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী চলতে হয় তাঁদের। দেশের আর সবকিছুর মত খেলার জন্য বরাদ্দ টাকাও চলে যায় কর্মকর্তাদের পকেটে। আর কিছু মনে না থাকলেও কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি আর সুরেশ কালমাদির কথা কার না মনে আছে? ফলে অনেকেরই ধারণা ছিল, প্রাক্তন খেলোয়াড়দের খেলা চালানোর দায়িত্ব দিলে সব ম্যাজিকের মত বদলে যাবে। ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি, ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের দুর্নীতি – সবই আদালত পর্যন্ত গড়ানোর ফলে এসে পড়েছিল সেই সুযোগ। কিন্তু মোদী সরকারের আমলে দেখা গেল, রাজনীতিবিদদের বশংবদ প্রাক্তন খেলোয়াড়রা কিছু কম যান না। যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে প্রথম যখন লাগাতার যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন ভিনেশ, সাক্ষীরা – তখন একটা ওভারসাইট কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার কর্ণধার ছিলেন মেরি কম এবং আরেক অলিম্পিক পদকজয়ী কুস্তিগীর যোগেশ্বর দত্ত। সেই কমিটি অশ্বডিম্বই প্রসব করেছিল। নইলে যন্তর মন্তরে ধরনায় বসতেই হত না সাক্ষীদের।

মেরি কম, ঊষারা একে খেলোয়াড় তায় মহিলা। তবু তাঁরা যৌন হয়রানির অভিযোগকে পাত্তা দিচ্ছেন না, ভিনেশদের চোখের জলের দাম তাঁদের কাছে মিনারেল ওয়াটারের চেয়ে বেশি নয়। হয়ত ব্রিজভূষণের মত তাঁরাও মনে করেন ওসব পদকের দাম ১৫ টাকা। নতুন সংসদ ভবনের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন নির্বিঘ্ন করতে কুস্তিগীরদের উপর পুলিসি আক্রমণ সম্পর্কে তাঁদের নীরবতা, ব্রিজভূষণের প্রতি মৌন সমর্থন প্রমাণ করে ক্ষমতার মদের নেশা অন্য সব নেশার চেয়ে কড়া। হাজার হোক, মেরি কম মণিপুরের নির্বাচনে বিজেপির তারকা প্রচারক ছিলেন। যোগেশ্বর তো রীতিমত বিজেপি দলের সদস্য। অর্থাৎ ভারতের ক্রীড়াপ্রেমীদের অরাজনীতির সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।

কুস্তিগীরদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেরও রাজনীতি ব্যাপারটা প্রবল অপছন্দ। তাঁরা কোমলমতি। শাসক দলের সাংসদ যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও গ্রেফতার হন না, সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা ধরনায় না বসলে এফআইআর পর্যন্ত দায়ের হয় না। তবু বিরোধী দলের নেতারা কুস্তিগীরদের পাশে দাঁড়ালে কোমলমতি ক্রীড়াপ্রেমীরা নাক কোঁচকান। তাঁদের জন্য উল্লেখ থাক, আজকের অপমানিত কুস্তিগীররা কিন্তু কখনো অরাজনৈতিক ছিলেন না। ২০১৪ সালের পর থেকে চালু হওয়া ধারা অনুযায়ী তাঁরা সোশাল মিডিয়ায় মোদী সম্পর্কে এবং তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ছিলেন দীর্ঘকাল। হিন্দুত্বের রাজনীতিও তাঁদের অনেকেরই পছন্দের। মে মাসের গোড়ার দিকেও বজরং ইনস্টাগ্রামে বজরং দলকে সমর্থন করে পোস্ট করেছিলেন, পরে মুছে দেন।

তা বলে বজরংদের এই আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখার কোনো কারণ নেই। হরিয়ানার রক্ষণশীল, খাপ পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত সমাজ থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নক হয়ে যাওয়া খুব আশ্চর্যের নয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের জাতিভুক্ত এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী সৌরভেরই যদি অমিত শাহের অনুগ্রহে আপত্তি না থাকে তো বজরংদের দোষ কী? কে লড়ছেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন দাবিতে লড়ছেন। যে দেশের মেয়েদের ছোট থেকে নিকটাত্মীয়ের হাতে যৌন হয়রানি অভ্যাস করে নিতে হয়, ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অত্যাচারিত মেয়েটির পরিবার লোকলজ্জায় মুখ লুকোয় – সে দেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহিলা ক্রীড়াবিদরা তাঁদের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন; পাশে রয়েছেন পুরুষ ক্রীড়াবিদরা – একে ঐতিহাসিক বলে মানতেই হবে। কর্পোরেট পেশাদার মহিলারাও জানেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগুলো বহু জায়গাতেই এখনো দায়সারা। এই আন্দোলন তেমন অনেক কর্তৃপক্ষকেই তটস্থ করে তুলছে। ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে কুস্তির আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থার হুঁশিয়ারি।

আরও পড়ুন কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

বিজেপির রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির চেয়ে এসব অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। যদিও রাকেশ ও মহেশ টিকায়েতের মত খাপ পঞ্চায়েতের নেতার উপস্থিতি, বরাবরের বিজেপি সমর্থক ফোগত পরিবারের প্রধান মহাবীরের বিবৃতি এবং হরিয়ানার বিজেপি নেতাদের উল্টো গাওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এ ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে। মোদীর দেবতাপ্রতিম ভাবমূর্তি বিশেষ কাজে আসছে না।

অনির্বাচিত মনুবাদী সাধুসন্তরা ঢুকে পড়েছেন ভারতের সংসদে, অযোধ্যার মহন্তরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে যে আইন (Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012) আছে তা বদলানোর দাবিতে সভা করতে চলেছেন ব্রিজভূষণের সমর্থনে। বলা বাহুল্য, তাঁদের কথার ওজন আজকের ভারত সরকারের কাছে অসীম। ফলে সরকার যে তাঁদের প্রণাম জানিয়ে অর্ডিন্যান্স এনে আইন বদলে ফেলবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ঘটলে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারবে আমাদের সকলের সন্তানের ধর্ষকরা। সুতরাং ভিনেশ, সাক্ষী, বজরংদের লড়াই এখন শুধু পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদের লড়াই নয়, সমস্ত ভারতীয়ের লড়াই। সব মেয়েকে, সব শিশুকে দেবতার গ্রাস থেকে বাঁচানোর লড়াই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

নাসার আর ব্রিজভূষণ: যৌন নির্যাতনের আমরা ওরা

নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

ইন্টারনেটের যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলিগলির খবর পর্যন্ত আমরা যেভাবে রাখি, আমেরিকানরাও ভারতের খবর সেভাবে রাখেন কিনা জানি না। মার্কিন জেলগুলোতে বন্দিদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার অধিকার আছে কিনা তাও জানি না। তবে যদি থেকে থাকে, তাহলে নির্ঘাত সেখানে বসে ল্যারি নাসার আফসোস করছে ভারতে তার জন্ম হয়নি বলে। নামটা অচেনা? সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলে খেলার খবর বলতে তো আইপিএল আর আইএসএল। আন্তর্জাতিক খেলা মানে বড়জোর ভারতীয় দলের ক্রিকেট আর ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল লিগ, চার বছরে একবার বিশ্বকাপ। ফলে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দেড়শোর বেশি জিমন্যাস্টের সাক্ষ্যদানের পর দুই দশক ধরে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত নাসারের ৪০ থেকে ১৭৫ বছরের কারাদণ্ডের খবর হয়ত অনেকেরই চোখে পড়েনি বা স্মরণ নেই। নাসার ছিল ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্স, ইউ এস অলিম্পিক কমিটি এবং মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অগ্রগণ্য ডাক্তার। সেই মওকায় চিকিৎসার নাম করে সে মহিলা জিমন্যাস্টদের যথেচ্ছ যৌন নিপীড়ন করত।

এমনিতে একজন আমেরিকানের ভারতীয় হয়ে জন্মাতে চাওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং ভারতীয়রাই অনেকে আমেরিকান হয়ে জন্মাতে পারলে খুশি হত। কিন্তু নাসার মনে করতেই পারে, ভারতে জন্মালে সে স্রেফ ডাক্তার হয়ে না থেকে ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের শীর্ষ কর্তা হয়ে বসতে পারত। এমনিতেই তার বিকৃতির শিকার হওয়া মহিলাদের মুখ খুলতে বছর বিশেক সময় লেগেছে, কর্মকর্তা হলে নিশ্চয়ই তারা আরও ভয় পেত। ফলে আরও দেরিতে মুখ খুলত। খুললেও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত না গেলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা রাস্তায় বসে না পড়লে পুলিস এফআইআর পর্যন্ত নিত না। নিলেও নাসার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত, সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারত, যদি সে শাসক দলের টিকিটে নির্বাচিত সেনেটর হতে পারত। সেসব কিছুই হল না নাসার মার্কিন দেশে জন্মেছিল বলে। এসবের জন্যে যদি সে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে হিংসা করে, তাকে দোষ দেওয়া চলে কি? বিশেষ করে যখন দুজন কুস্তিগির ব্রিজভূষণের সম্পর্কে পুলিসের কাছে যে অভিযোগগুলো করেছেন তার সঙ্গে নাসারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের স্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

এমন নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের জন্যে একেবারে স্বর্গরাজ্য। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের মার্কিন কলামনিস্ট ময়রা ডোনেগান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন নাসার কাণ্ডে ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) অপদার্থতার কথা। হলিউডি থ্রিলার দেখার অভ্যাস যাঁদের আছে তাঁরা জানেন, এই এফবিআইকে প্রায়শই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে দেখানো হয়। ব্যতিক্রমী ছবি না হলে এফবিআইয়ের গোয়েন্দাদের এত তৎপর, এত সৎ বলে দেখানো হয় যেন তাঁদের চোখ এড়িয়ে মাছি গলতে পারে না। কিন্তু ডোনেগান লিখেছেন ২০১৫ সালে অলিম্পিয়ান ম্যাককেলা ম্যারোনি নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানানোর পরেও তারা নড়েচড়ে বসেনি। তারা তদন্ত শুরু করে ২০১৬ সালে যখন স্থানীয় পুলিস নাসারের একটা হার্ড ড্রাইভ থেকে ৩৭,০০০ শিশু নির্যাতনের ছবি বাজেয়াপ্ত করে। নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে জমা পড়া প্রথম অভিযোগ থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবস্থা নেওয়ার সময়টুকুতেও সে প্রায় ৭০ জন মহিলা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপরে নির্যাতন চালিয়েছে। নাসারের ঘটনা নিয়ে মার্কিন সেনেটে শুনানির সময়ে এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস রে স্বীকার করেন যে তাঁর সংস্থার গাফিলতি ছিল। কিন্তু তিনি দাবি করেন সেটা সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের ব্যক্তিগত গাফিলতি, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নয়। অথচ ডোনেগান লিখেছেন স্থানীয় পুলিস থেকে শুরু করে এফবিআই পর্যন্ত সর্বত্রই যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। গোটা আমেরিকা জুড়ে বহু মেয়ের অভিজ্ঞতাই তা বলে। সেদিক থেকে আমাদের মেয়েদের চেয়ে মার্কিন মেয়েদের অবস্থা বিশেষ উন্নত নয় বলতে হবে। কিন্তু তাহলেও তফাত বিস্তর। কোথায় তফাত?

এফবিআইয়ের গড়িমসির কথা প্রকাশ্যে এল কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেক্টর জেনারেল নাসার কাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে যে অন্তর্তদন্ত চালিয়েছিলেন তার নির্মম রিপোর্ট থেকে। উপরন্তু যে তিনটে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাসার যুক্ত ছিল, সেগুলোকেও ফল ভোগ করতে হয়েছে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে সংগঠনের প্রতিক্রিয়া সঠিক ছিল কিনা সে সম্পর্কে তদন্ত করায়। ইউ এস অলিম্পিক কমিটি একসময় ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের অনুমোদন বাতিল করে দেবে ঠিক করেছিল। অলিম্পিক কমিটির চাপে তাদের সিইও এবং প্রেসিডেন্ট কেরি পেরিকে পদত্যাগ করতে হয়। এমনকি তাঁর স্থলাভিষিক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সিইও এবং প্রেসিডেন্ট মেরি বনোকেও পদত্যাগ করতে হয় চারদিনের মাথায়, কারণ জিমন্যাস্টরা তাঁকে ওই পদে দেখতে চাননি। আসলে বনো এমন এক ল ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যা নাসারকে সাহায্য করেছিল।

অর্থাৎ ও দেশে এক প্রতিষ্ঠানের দোষ দেখে অন্য প্রতিষ্ঠান শাক দিয়ে মাছ ঢাকেনি। অলিম্পিকে সোনা জয়ী সিমোন বাইলস, অ্যালি রাইসম্যান বা ম্যারোনি, ম্যাগি নিকলদের কথা সেনেট শুনেছে, আদালতও ধৈর্য ধরে শুনেছে। তার জন্যে তাঁদের ওয়াশিংটন ডিসি বা নিউইয়র্কের ফুটপাথে গিয়ে বসতে হয়নি। একথা সত্যি, যে ব্রিজভূষণ দোষী কি দোষী নন সেকথা বিচার করবে আদালত। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের সামনে হাজির করার দায়িত্বটুকু নিতেও তো এ দেশের পুলিস বা সরকার রাজি নয়। এমনকি ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি ঊষা কদিন আগে বলে বসেছিলেন, যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করে বিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিকের মত কুস্তিগিররা নাকি দেশের বদনাম করছেন। নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

আরও পড়ুন হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস

নাসার জেল খাটছেন, ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের সেই কর্তারাও বিতাড়িত, জিমন্যাস্টরা আছেন স্বমহিমায়। বাইলস আরও একটা অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, গোটা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে আবার কোন রুদ্ধশ্বাস দেহভঙ্গিমায় তিনি তাক লাগিয়ে দেবেন। এদিকে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তিন সদস্যের অ্যাড হক কমিটির হাতে। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, এই অ্যাড হক কমিটি নাকি আসন্ন এশিয়ান গেমসের সংগঠকদের কাছে ভারত থেকে যে কুস্তিগিররা প্রতিযোগী হতে পারেন তার এক প্রাথমিক তালিকা পাঠিয়েছে। সেই তালিকায় প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের মধ্যে থেকে বজরং, ভিনেশ আছেন। তাছাড়াও আছেন রবি দাহিয়া, দীপক পুনিয়া, অংশু মালিক, সোনম মালিক। কিন্তু অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী সাক্ষী বাদ। কেন তিনিই বাদ? সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য স্মৃতি ইরানির জবাবদিহি দাবি করেছিলেন বলে কি?

দেখে শুনে মনে হয়, কদিন আগে রাতের অন্ধকারে দিল্লি পুলিসের গলাধাক্কা খাওয়ার পর ভিনেশ কাঁদতে কাঁদতে ক্যামেরার সামনে যা বলেছেন তার চেয়ে ন্যায্য কথা নেই – দেশের মেডেল জেতার পরেও যদি এত অপমান সহ্য করতে হয়, তাহলে আর কারোর কখনো মেডেল না জেতাই ভাল।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন?

এ দেশের ক্রিকেটমহল এখন ভীষণ ব্যস্ত। ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইপিএল চলছে। নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। লখনৌ সুপারজায়ান্টস অধিনায়ক কে এল রাহুল তো এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে গুরুতর চোট পাওয়ার পরে হার নিশ্চিত জেনেও দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। অতঃপর চোটের প্রভাবে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলতে পারবেন না, সামনের মাসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলতে পারবেন না। এমন বীরত্বের জন্যই তো জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান ক্রিকেটাররা। মুশকিল হল, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগত এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর দাবি, মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন আক্রমণের অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, ক্রিকেটারদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

গত ২৮ এপ্রিল ভিনেশ বলেন, ক্রিকেটারদের তো আমাদের দেশে পুজো করা হয়। তাঁরা আমাদের পক্ষ যদি না-ও নেন, অন্তত একটা নিরপেক্ষ বার্তা দিয়েও তো বলতে পারেন যে দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কেবল ক্রিকেটার নয় অবশ্য, সব খেলার তারকাদের কাছেই আবেদন ছিল ভিনেশের। তারপর থেকে অভিনব বিন্দ্রা আর নীরজ চোপড়া – ভারতের ইতিহাসে যে দুজন অলিম্পিকে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন, দুজনেই ওই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। সদ্যপ্রাক্তন টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাও দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বিশেষ হেলদোল নেই। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র মহিলাদের জাতীয় দলের শিখা পাণ্ডে মুখ খুলেছেন। সদ্য চালু হওয়া মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনার কোনো বক্তব্য নেই। জাতীয় দলের অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌরও চুপ। প্রাক্তনদের মধ্যে হরভজন সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ইরফান পাঠান সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। একমাত্র নভজ্যোৎ সিং সিধু সশরীরে ভিনেশ, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল কপিলদেব ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কবে ন্যায়বিচার পাবে?

স্পষ্ট বক্তা হওয়ার জন্য যাঁর বিপুল খ্যাতি, সেই বিরাট কোহলি স্পিকটি নট। যাবতীয় বাহাদুরি গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খরচ করছেন। নারীবাদীরা প্রায়শই বিরাটকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি জীবনে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার অবদান স্বীকার করেন বলে, তাঁর ব্যর্থতায় ট্রোলরা অনুষ্কাকে টার্গেট করলে বিরাট মুখ খোলেন বলে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে বিরাটই একমাত্র পুরুষ যিনি নিজের বউকে ভালবাসেন। তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন একমাত্র অস্কার মঞ্চে বউকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্রিস রককে ঘুঁষি মেরে দেওয়া উইল স্মিথ। দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি বিরাটের ভালবাসা আমাদের পাড়ার রানাদার পর্ণা বউদির প্রতি ভালবাসার চেয়ে মহত্তর কিছু মোটেই নয়। বরং হয়ত কিছুটা নিকৃষ্টতরই। কারণ রানাদা রাস্তাঘাটে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে কাউকে বিশ্রীভাবে কথা বলতে দেখলে অন্তত একটু ধমকা-ধমকি করেন। কিন্তু দেশের লাঞ্ছিত মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে বিরাটের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

মনে রাখা ভাল, অনুষ্কা নিজেও কম নারীবাদী নন। তিনি একদা সুনীল গাভস্করের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ গাভস্কর বলেছিলেন অনুষ্কার বোলিংয়ে অনুশীলন করে বিরাটের লাভ হবে না। সেই অনুষ্কাও আজ চুপ। চুপ মানে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। দুটিতে কেমন জীবন উপভোগ করছেন তার তত্ত্বতাল্লাশ দিব্যি দিয়ে যাচ্ছেন টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে। তবে গাভস্করের বিরুদ্ধে লম্বা বিবৃতি দিয়েছিলেন, অলিম্পিয়ান মহিলাদের প্রতিবাদ নিয়ে এক লাইনও লেখেননি। অবশ্য পরীক্ষায় আনকমন প্রশ্ন এসে গেলে আমরাও সে প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম।

গম্ভীর আবার দিল্লি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। সেই দিল্লির যন্তর মন্তরেই কুস্তিগীরদের অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। যদিও ওই এলাকা গম্ভীরের কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু তিনি একজন জনপ্রতিনিধি তো বটেন। অবশ্য উনি সাংসদের দায়িত্ব খুব মন দিয়ে কোনোদিন পালন করেছেন বলে অভিযোগ নেই। উনি সারাবছর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ান, আইপিএলের সময়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন। কদিন পরে হয়ত ওই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সারাবছরই বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াবেন। কারণ লখনৌ সুপারজায়ান্টসে তাঁর পদটির নাম গ্লোবাল মেন্টর, আর ওই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার টি টোয়েন্টি লিগে দল কিনে বসে আছেন। আর কোথায় কোথায় কিনবেন কে বলতে পারে? এমন বিশ্বনাগরিকের কি আর যন্তর মন্তরের অবস্থান বিক্ষোভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কূপমণ্ডূকতা মানায়?

পিভি সিন্ধু, সায়না নেহওয়ালদেরও মুখে কুলুপ। ছবারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কম তো পিটি ঊষা গোত্রের, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির অতি ঘনিষ্ঠ, তাই নীরব। গত কয়েকদিন অবশ্য তাঁর রাজ্য মণিপুরে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। বিজেপি তাঁকে এত গুরুত্ব দেয় যে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে বলতে হচ্ছে “মাই স্টেট ইজ বার্নিং, কাইন্ডলি হেল্প”। যে নিখাত জারীনকে একসময় স্রেফ জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে অবজ্ঞা করতেন মেরি, সেই দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিখাত কিন্তু সরব হয়েছেন।

প্রাক্তন সাংসদ ভারতরত্ন ‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ডাগআউটে নিদ্রা গিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন? তবু তো দয়া করে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মুখ খুলেছেন। লর্ডসের ব্যালকনির চিরস্মরণীয় ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ভারী বিনীতভাবে বলেছেন, ওদের লড়াই ওরা লড়ুক। আমি তো খবরের কাগজে পড়ছি, যা জানি না তা নিয়ে তো কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে শচীন, সৌরভ দুজনেই কন্যাসন্তানের পিতা।

সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় তারকা খেলোয়াড়দের যা ইতিহাস, তাতে এঁরা মহম্মদ আলি হয়ে উঠবেন বলে কেউ আশা করে না। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা কিন্তু সাতে পাঁচে না থাকার নীতি অনেকটাই ত্যাগ করেছেন। ওঁরা এখন শচীন বা ঊষার মত শাসক দলের প্রসাদ গ্রহণ করে রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন, এ পদ সে পদ গ্রহণ করছেন, গম্ভীরের মত ভোটে লড়ে সাংসদ বা বিধায়কও হচ্ছেন। যাঁদের অত এলেম নেই তাঁরাও কোহলির মত করে নোটবন্দি হওয়া মাত্রই তা কত বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন তার বিরোধিতা করে টুইট করেছিলেন। সেওয়াগের মত কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস। শহিদ হওয়া সৈনিকের মেয়েকে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার জন্য ট্রোল করতেও ছাড়েননি। কেবল সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দরকার পড়লেই এঁরা কেউ নীরব হয়ে যান, কেউ এক-দু লাইনে কাজ সারেন। সেওয়াগ, কপিলদেব, হরভজন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মানুষ। কুস্তিগীরদের আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন হরিয়ানার কুস্তিগীররাই। তা না হলে এতেও ওই তিন প্রাক্তন মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

যে পদকজয়ী অলিম্পিয়ানরা আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি-ঘনিষ্ঠই ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে বা জয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করতে এঁদেরও কামাই ছিল না। এখন চোখের জলে সেসবের দাম দিতে হচ্ছে। এখনো যে মহাতারকারা নীরব, তাঁদের দেখে একটাই ভয় হয়। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়মোলারের অনুসরণে এঁদের না কোনোদিন আওড়াতে হয়, প্রথমে ওরা এসেছিল কুস্তিগীরদের জন্যে। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কুস্তিগীর নই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: