দুঃসময়ে নিজের সবটুকু নিংড়ে দিলেন জওয়ান শাহরুখ

জওয়ান ছবিতে শাহরুখ অভিনীত একটা চরিত্রের নাম আজাদ। সে মেয়েদের নিয়ে নিজের এক ফৌজ গড়ে তোলে। সে ফৌজের লক্ষ্য দেশের ভাল করা। এক অর্থে আজাদ হিন্দ ফৌজই বটে।

অসংখ্য ছবি হয়, তাই বহু মানুষ নায়ক হন। তাঁদের অনেকেই জনপ্রিয় হন, কিন্তু মাত্র কয়েকজন এমন উচ্চতায় পৌঁছন যে নিজের ইন্ডাস্ট্রিটাকে কাঁধে তুলে নিতে পারেন – একসময় টলিউডকে যেভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। আরও কম সংখ্যক শিল্পী এত বড় হয়ে ওঠেন যে সিনেমাজগৎ ছাড়িয়ে যে সমাজে, যে দেশে দাঁড়িয়ে আছেন তাকে প্রভাবিত করতে পারেন। পারলেও সাহস করে সে দায়িত্ব পালন করেন আরও কম শিল্পী। এমনকি উত্তমকুমারও পালন করেননি। তাঁর সময়ের পশ্চিমবঙ্গে ঘটে চলা রাজনৈতিক, সামাজিক সংঘর্ষ কোনোদিন তাঁর ছবিতে ঢেউ তোলেনি। সরোজ দত্তের হত্যাও কোনোদিন তাঁর কাজে উঁকি মারেনি। শাহরুখ খান সেই বিরল শিল্পী যিনি দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে এই দায়িত্ব পালন করলেন জওয়ান ছবিতে। তিনি যখন অতখানি সাহস করেছেন, তখন আমি সামান্য সাহস দেখাই। বলেই ফেলি – এই ছবি একবার দেখার ছবি নয়, বলিউডের ইতিহাসে মাইলফলক হিসাবে যে ছবিগুলোকে ধরা হয় তাদের পাশে জায়গা হবে এই ছবির। যদি ভারত বা ইন্ডিয়া নামের দেশটা বাঁচে, আমার মৃত্যুর বহুকাল পরে এবং যাঁরা এ লেখা পড়ছেন তাঁদের সকলের মৃত্যুর পরেও মেহবুব খানের মাদার ইন্ডিয়া ছবির সঙ্গে এক বাক্যে উচ্চারিত হবে অ্যাটলির এই ছবির নাম।

না, সিনেমাবোদ্ধারা ‘মাস্টারপিস’ বলতে যা বোঝেন এ ছবি তার ত্রিসীমানায় যায়নি। এমন একটা শটও নেই যা স্রেফ দৃশ্য হিসাবেই সিনেমাবোদ্ধার চোখে লেগে থাকবে। এ ছবিতে আর পাঁচটা নাচ-গান-মারামারির ছবির মতই গাড়ি উড়ে গিয়ে পড়ে, নায়ক একাই জনা বিশেক দুর্বৃত্তকে শেষ করে দেন। এসব অপছন্দ হলে বা ঘন্টা তিনেকের জন্য বিশ্বাস করে নিতে আপত্তি থাকলে (যাকে শিল্প সমালোচনার ভাষায় সাহেবরা বলে “willing suspension of disbelief”, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় অবিশ্বাস স্থগিত রাখা) এ ছবি না দেখাই শ্রেয়। কিন্তু ঘটনা হল এ ছবি যে ঘরানার, সেই ঘরানায় এগুলো অবাস্তব নয়। নির্দেশক অ্যাটলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রযোজক গৌরী খান আর শাহরুখ কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতবেন বলে ছবি করেননি। এখানে তাঁদের লক্ষ্য যত বেশি সম্ভব দর্শকের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সেই বার্তা দিতে তাঁরা সেই চলচ্চিত্রভাষাই ব্যবহার করেছেন যে ভাষা তাঁরা গুলে খেয়েছেন এবং এ দেশের আপামর দর্শক যার সঙ্গে কয়েক প্রজন্ম ধরে পরিচিত। এ “ভাষা এমন কথা বলে/বোঝে রে সকলে/ উঁচা নিচা ছোট বড় সমান।” তাহলে এমন কী করা হল এই ছবিতে, যার জন্য বলছি এই ছবি বলিউড ছবির মাইলফলক? সেই আলোচনায় আসব। শুরুতেই বলে দিই, সাদা চোখে অন্তত চারটে স্তর দেখতে পেয়েছি এই ছবির। সেই স্তরগুলোর আলোচনাই আলাদা আলাদা করে করব। কেউ আরও বেশি স্তরের খোঁজ পেতে পারেন, যদি তাঁর উঁচু নাক, চোখ ছাড়িয়ে মস্তিষ্ককেও ঢেকে না ফেলে।

প্রথম স্তর: ইশতেহার

এই স্তর নিয়েই সবচেয়ে কম শব্দ খরচ করব। কারণ ছবির মুক্তির দিনই ভাইরাল হয়ে যাওয়া ক্লিপের দৌলতে সবাই জেনে ফেলেছে কীভাবে সরাসরি শাহরুখ দেশের মানুষের উদ্দেশে গণতন্ত্রের সার কথাগুলো বলেছেন, যা অনেকের মতেই দেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বার্তা। কিন্তু ওই ক্লিপটাই শেষ কথা নয়। আসলে জওয়ান এক আদ্যন্ত রাজনৈতিক ছবি। আমরা প্রায় ভুলে গেছি যে রাজনীতি মানে শুধু এই দল আর ওই দল নয়। পরিচালক অ্যাটলি আর শাহরুখ দলাদলি বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাইরেও যতরকম রাজনীতি আছে প্রায় সবকটা নিয়ে দর্শককে ভাবতে বাধ্য করেছেন। লিঙ্গ রাজনীতি থেকে পরিবেশ রাজনীতি – সবই এই ছবির বিষয়বস্তু।

নব্য উদারবাদী অর্থনীতির যুগে, ভারতের ইতিহাসে ক্রোনি পুঁজিবাদের সেরা সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয়তম তারকার ছবিতে খলনায়ক হিসাবে দেখানো হল একজন শিল্পপতিকে। কালী গায়কোয়াড় (বিজয় সেতুপথী) সমস্তরকম পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মকানুনকে কাঁচকলা দেখিয়ে কারখানা তৈরি করেন, অনুমতি না পাওয়া গেলে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করেন না। স্থানীয় মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর হওয়ায় গোটা পঞ্চাশেক কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল – ভারতের বহু এলাকার মানুষের এই ইচ্ছাপূরণের দৃশ্যও দেখিয়ে দিয়েছেন অ্যাটলি। শুধু এই কারণেই জওয়ানকে ঐতিহাসিক বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। তবে যে কথা কেউ বলছেন না, তা হল এই ছবি শুধু নানাভাবে বিজেপিকে আক্রমণ করেনি। এ ছবিতে শুধু গৌতম আদানি বা নরেন্দ্র মোদীর ছায়া পড়েনি, রেয়াত করা হয়নি কংগ্রেস আমলকেও। এসে পড়েছে ১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা, ছায়া পড়েছে বোফর্স কেলেঙ্কারিরও।

সূক্ষ্মতর রাজনৈতিক প্রসঙ্গ পরবর্তী স্তরগুলোর আলোচনায় আসবে। আপাতত এটুকু বলে শেষ করা যাক যে সম্ভবত এতখানি সোচ্চার রাজনীতি শাহরুখের ছবিতে এসে পড়তে পারত না প্রযোজক হিসাবে তামিল ছবির নির্দেশককে না নিলে। ইদানীং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দৌলতে এবং বেশকিছু ছবি হিন্দিতে ডাব হয়ে বিশ্বজুড়ে মুক্তি পাওয়ার ফলে আমরা জানি যে তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম ভাষার ছবিতে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে আনা বা রাজনীতিকেই কেন্দ্রে বসিয়ে দেওয়া চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে জলভাত। সে রজনীকান্তের নাচ-গান-মারামারির ছবিই হোক, আর জয় ভীম কিম্বা কান্তারা। দক্ষিণ ভারতের ছবির এই গুণ বলিউডি ব্লকবাস্টারে নিয়ে আসা হল।

দ্বিতীয় স্তর: ভারততীর্থ

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে ‘আমাদের’ মত দেখতে নয়, সুতরাং ‘ওরা’ ভারতীয় নয়। এই ধারণা আমাদের অনেকেরই চেতনে বা অবচেতনে বদ্ধমূল। দেশের রাজধানী দিল্লিতে অনবরত ওঁদের ‘চিঙ্কি’ শব্দটা শুনতে হয়। কলকাতার লোকেরা অনেক বেশি পরিশীলিত, বুদ্ধিমান। তাই ‘নাক চ্যাপটা’ ইত্যাদি কথাগুলো ওঁদের সামনে বলা হয় না, একান্ত আলোচনায় হয়। মণিপুর যে ভারতের মধ্যে পড়ে না তার প্রমাণ তো গত তিন মাসে ভারত সরকারের আচরণেই পাওয়া যাবে। অথচ এ ছবি শুরুই হয় চীনের সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশে। নায়কের প্রাণ বাঁচে প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামে, আধুনিক চিকিৎসার সুযোগসুবিধা থেকে বহু দূরে আদিবাসী চিকিৎসা পদ্ধতিতে। সারা দেশকে যখন রামভক্ত হতে বাধ্য করা হচ্ছে, তখন মরণ হতে নায়ক জেগে ওঠেন ভীষণদর্শন, বাকি ভারতের কাছে অনেকাংশে অপরিচিত, বৌদ্ধ দেবতা মহাকালের মূর্তির সামনে গ্রামের মানুষের কাতর প্রার্থনায়। চীনা সেনাবাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করেন গ্রামকে (জাতীয়তাবাদী সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা বোধহয় ওখানেই কাত। বাকি ছবিতে তাঁদের পক্ষে আপত্তিকর যা কিছু দেখানো হয়েছে, ক্ষমাঘেন্না করে দিয়েছেন)।

প্রান্তিক, সংখ্যালঘু মানুষকে কাহিনির কেন্দ্রে স্থাপন করার এই ধারা বজায় থেকেছে গোটা ছবি জুড়ে। অরুণাচলের ওই গ্রামের এক বাসিন্দা চিত্রনাট্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গত শতকের আটের দশক পর্যন্তও হিন্দি ছবিতে আমরা যা দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, সেই ধারা মেনে এই ছবিতে শাহরুখের ঘনিষ্ঠরা সবাই ভারতের নানা সংখ্যালঘু বা নিপীড়িত সম্প্রদায়ের মানুষ। মুসলমান, শিখ, গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান অথবা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে পর্যন্ত হিন্দি ছবিতে নায়ক হিন্দু হলেও তার প্রাণের বন্ধু হবে একজন মুসলমান – এটা প্রায় নিয়ম ছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে হিন্দি ছবির মুসলমানরা হয়ে গেলেন দুরকম – হয় সন্ত্রাসবাদী, নয় অতিমাত্রায় দেশভক্ত পুলিসকর্মী বা সৈনিক। যে ভারততীর্থের স্বপ্ন দেখতেন রবীন্দ্রনাথ, তা বাস্তবে না থাক, অন্তত বলিউডি ছবিতে দেখা যেত। বহুকাল পরে এই ছবিতে ফেরত এসেছে।

আজকের ভারতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত যেসব জনগোষ্ঠী, তাদের মধ্যে অবশ্যই পড়েন মেয়েরা। শুধু যে অনেক জায়গায় ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নয়। এতকাল ধরে অর্জিত মেয়েদের সামাজিক অধিকারগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলাও আরম্ভ হয়ে গেছে। জিনস পরা, চাউমিন খাওয়া খারাপ মেয়ের লক্ষণ – এমন হাস্যকর কথা বলার পাশাপাশি বিরুদ্ধ মতের মহিলাদের কুৎসিত ভাষায় সংগঠিত ট্রোলিং, বেছে বেছে মুসলমান মেয়েদের অনলাইন নিলাম – এসবও চালু হয়েছে। ক্রমশ পিছন দিকে হাঁটতে থাকা, বিষাক্ত পৌরুষের উদযাপনে জবজবে এই ভারতে শাহরুখ তাঁর অতিমানবিক কাজকর্ম করেন এক দল মেয়েকে নিয়ে। তাঁর দুই নায়িকার এক নায়িকা ঐশ্বর্য (দীপিকা পাড়ুকোন) কুস্তিতে তুলে আছাড় মারেন শাহরুখকে। অন্য নায়িকা নর্মদা (নয়নতারা) একজন কুমারী মা। ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলা যে দেশে ফ্যাশন সে দেশে ‘মা’ শব্দের অনুষঙ্গে মুসলমানবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বার্তাও দেওয়া হয়েছে ছবির গোড়ার দিকেই। কীভাবে? সে আলোচনায় যাব না, কারণ তাতে স্পয়লার দেওয়া হবে।

এমন ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ বলিউডি ছবিতে আর কখনো দেখা যাবে না – এ আশঙ্কা গত দু-তিন দশকে জোরালো হয়ে উঠেছিল, এখনো সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসমুদ্রহিমাচলকে ৫৭ বছর বয়সেও উদ্বেল করতে পারা নায়ক অন্তত শেষবার করে দেখালেন।

তৃতীয় স্তর: বলিউড অমনিবাস

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, প্রস্থেটিক মেক আপ, ঝাঁ চকচকে সেট সত্ত্বেও এই ছবির আত্মার খোঁজ করলে দেখা যাবে সেটা জওহরলাল নেহরুর আমলের বিনোদনমূলক অথচ সামাজিক বার্তা দেওয়া, এমনকি ভেদাভেদহীন দেশ গঠনের, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখানো ছবির আত্মা।

মনে রাখা ভাল যে নেহরু-ঘনিষ্ঠ রাজ কাপুর, দিলীপকুমার, দেব আনন্দরা সেই হিন্দি সিনেমার মুখ হলেও চিত্রনাট্য, পরিচালনা, গান লেখা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় স্বমহিমায় ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত একগুচ্ছ মানুষ। অর্থাৎ হিন্দি সিনেমা শাসন করতেন নেহরুর মত নরম সমাজবাদীর কাছের লোকেরা আর সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ক্রমশ সেই প্রভাব কমতে শুরু করে। ভারতীয় বামপন্থীরা ক্রমশ যাহা জনপ্রিয় তাহাই নিকৃষ্ট – শিল্প সম্পর্কে এই অবৈজ্ঞানিক ধারণায় নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেন। যেহেতু এ দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় বলিউড, সেহেতু ওটাই যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তাতে আর সন্দেহ কী? ফলে বামপন্থীরা বলিউড দখলে রাখার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। বলিউড যে দেশের গরিবগুরবো মানুষের ভাবনা তৈরি করায় বড় ভূমিকা নেয় সেসব তাঁরা বোঝেননি। তবু দেশের রাজনীতির সার্বিক ঝোঁক বাঁদিকে ছিল বলে এবং বলিউডে একদা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের তখনো উপস্থিতি ছিল বলেই হয়ত আটের দশকেও রেলের কুলিকে নায়ক বানিয়ে ছবি হয়েছে এবং কুলি (১৯৮৩) ছবির পোস্টারে দেখা গেছে অমিতাভ বচ্চনের হাতে কাস্তে, হাতুড়ি – একেবারে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতীক যে বিন্যাসে থাকে সেই বিন্যাসেই।

কিন্তু শাহরুখ যতদিনে বলিউডে এসেছেন ততদিনে সেসব প্রভাব প্রায় অদৃশ্য। দেশের রাজনীতিও ডানদিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ১৯৯১ সালে নেহরুর সমাজবাদকে তাঁর দলই আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে বাজার অর্থনীতি চালু করে। পরের বছর জুন মাসে মুক্তি পায় শাহরুখের প্রথম ছবি দিওয়ানা। তার ছমাসের মধ্যেই ধূলিসাৎ করা হয় বাবরি মসজিদকে। হিন্দি সিনেমা থেকে ক্রমশ উধাও হতে শুরু করে গরিব, মধ্যবিত্ত। তারপর থেকে নায়করা বিত্তশালী। প্রাসাদোপম বাড়ি, গাড়ি, নিজস্ব হেলিকপ্টার, অনেকে আবার অনাবাসী ভারতীয়। অথচ সাবেকি হিন্দু ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি সেই নায়করা ভারি বিশ্বস্ত। মেয়ের বাবার অমতে প্রেমিকাকে বিয়ে করে না। অন্তরঙ্গ মেয়ে বন্ধু প্যান্ট পরলে, খেলাধুলো করলে তাকে বিয়ে করার যোগ্য মনে করে না। করে যখন সে ‘মেয়েলি’ হয়ে যায় তখন। পালক পিতা নিজের পরিবারের চেয়ে নিচু শ্রেণির মেয়েকে বিয়ে করতে চাওয়ায় বাড়ি থেকে বার করে দিলেও শ্রদ্ধা টোল খায় না। শাহরুখ নিজের সেরা সময়ে সেইসব ছবিতেই অভিনয় করে এসেছেন। আজ, তিন দশকের বেশি সময় ইন্ডাস্ট্রিতে কাটানোর পর যখন নিজের মনোমত সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন, তখন কিন্তু শাহরুখ দেখালেন নেহরুর আমলের হিন্দি ছবি। একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে জন্ম নেওয়া, ছোটবেলাতেই অনাথ নায়ক। নিশ্চয়ই সমাপতন নয় যে এই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া বিস সাল বাদ ছবির দারুণ জনপ্রিয় গান ‘বেকরার কর কে হমে য়ুঁ ন যাইয়ে’ আর ১৯৫৫ সালের রাজ কাপুর অভিনীত শ্রী ৪২০ ছবির ‘রামাইয়া ওয়স্তাওয়ইয়া’।

এখানেই শেষ নয়। বস্তুত, যদি আপনার স্মৃতি ঠিকঠাক কাজ করে, জওয়ান ছবির মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন বলিউডের এতকালের কিছু আইকনিক ছবিকে। শাহরুখের চরিত্রে খুঁজে পাবেন তাঁর পূর্বসূরিদের। জিস দেশ মেঁ গঙ্গা বহতি হ্যায় (১৯৬০) ছবির রাজ কাপুর, আরাধনা (১৯৬৯) ছবির রাজেশ খান্না, দিওয়ার (১৯৭৫) ছবির শশী কাপুর, শাহেনশাহ (১৯৮৮) ছবির অমিতাভকে খুঁজে পেতে খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যাঁরা দেখে ফেলেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন জওয়ানের শরীরে শোলে (১৯৭৫) ছবির চিহ্নগুলোও। বলা বাহুল্য, শাহরুখ মাঝেমধ্যেই উস্কে দিয়েছেন নিজের রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করা ছবিগুলোর স্মৃতিও।

অথচ যা নেই তা হল এই শতকের হিন্দি ছবির কোনো প্রভাব, কোনো সংযোগ। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা আদর্শবাদী পুলিস অফিসারকে হিন্দি ছবিতে আমরা শেষ দেখেছি সম্ভবত মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত শূল (১৯৯৯) ছবিতে। এই শতকের বলিউডি পুলিস অফিসার মানেই তো ট্রিগারমত্ত, যা আজকের বুলডোজার রাজের মঞ্চ তৈরি করেছে। অব তক ছপ্পন (২০০৪) ছবির নানা পাটেকর, শুটআউট অ্যাট লোখাণ্ডওয়ালা (২০০৭) ছবির সঞ্জয় দত্ত, সুনীল শেঠি, আরবাজ খানরা আইন-আদালতের ধার ধারেন না। তাঁরা ‘শুট টু কিল’ নীতিতে বিশ্বাসী। আর আছেন দাবাং সিরিজের সলমান খান, সিঙ্ঘম সিরিজের অজয় দেবগনরা। জওয়ান ছবির পুলিস অফিসার কিন্তু একেবারেই গত শতকের হিন্দি ছবির পুলিস অফিসারদের মত। সমাপতন কিনা জানি না, উইকিপিডিয়া বলছে শূল ছবিটার স্বত্ব এখন গৌরী-শাহরুখের রেড চিলিজ এন্টারটেনমেন্টের হাতেই। এ ছবিতে অবশ্য আছেন এক দেশপ্রেমিক বিক্রম রাঠোর, যাঁর মানুষ খুন করতে হাত কাঁপে না। কিন্তু তিনি অক্ষয় কুমার অভিনীত রাউডি রাঠোর (২০১২) ছবির সমনামী নায়কের মত পুলিস অফিসার নন। তরুণ নির্দেশকের হাত ধরে প্রবীণ শাহরুখ বোধহয় বুঝিয়ে দিলেন তিনি কোন ধরনের ছবির পক্ষে।

আরও পড়ুন বল্লভপুরের রূপকথা: খাঁটি বাংলা ছবি

বামপন্থীরা বলিউডকে অবজ্ঞা করেছিলেন, দক্ষিণপন্থীরা করেনি। তাই ক্রমশ তাদেরই হাতে চলে যাচ্ছে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যমের রাশ। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যায় সাজানো প্রোপাগান্ডা ছবি তৈরি হচ্ছে। কাশ্মীর ফাইলসকেরালা স্টোরি-র পর আসছে দ্য ভ্যাক্সিন ওয়ার। ২০২৪ সালে বিজেপি ফের জয়যুক্ত হলে বলিউডি ছবিকে যে আর চেনাই যাবে না তাতে সন্দেহ নেই। জওয়ানের গুরুত্ব সেক্ষেত্রে হয়ে যাবে দ্বিগুণ, কারণ এই একখানা ছবিতে ধরা রইল হিন্দি ছবির সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য যা তাকে স্বাধীনোত্তর ভারতের অন্যতম ঐক্য বিধায়ক করে তুলেছিল। এমনি এমনি জওয়ানকে মাইলফলক বলিনি। এখানেই অবশ্য বলতে হবে এই ছবির একমাত্র ব্যর্থতার কথা। সমস্ত আইকনিক হিন্দি ছবির প্রাণ ছিল গান। সঙ্গীত পরিচালক অনিরুধ রবিচন্দর কিন্তু গানগুলোকে সেই উচ্চতার ধারে কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। এমন একটা গানও নেই যা মনে গেঁথে যায়।

চতুর্থ স্তর: যা ব্যক্তিগত তাই সর্বজনীন

ছবির আলোচনায় এখন পর্যন্ত একবারও শাহরুখের চরিত্রের নাম করিনি। তার একটা কারণ অবশ্যই স্পয়লার দিতে না চাওয়া। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় কারণ ছবিটা নিজে। এখানে ব্যক্তি শাহরুখ একাধিকবার চরিত্রের খোলস ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছেন। প্রসেনিয়াম থিয়েটারে চরিত্রের দর্শকাসনে নেমে আসার মত ব্যতিক্রম ঘটিয়ে একেবারে শেষ পর্বে যে তিনি পর্দার বেড়া ভেঙে সরাসরি দর্শকদের উদ্দেশে কথা বলার উপক্রম করেছেন তা তো সবাই জেনেই গেছেন। কিন্তু তার আগেই বেশ কয়েকবার যখনই ক্যামেরা তাঁকে ক্লোজ আপে ধরেছে, তিনি ভক্তদের উদ্বেল করে দেওয়ার মত কোনো অঙ্গভঙ্গি করেছেন, তখন নেপথ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে বেজেছে কয়েকটা কলি যার সবটা বুঝতে পারা শক্ত। বোঝার আগ্রহও প্রেক্ষাগৃহের কারোর তেমন ছিল না। এটুকুই যথেষ্ট যে তার মধ্যে ‘কিং খান’ কথাটা ছিল। শাহরুখ অভিনীত চরিত্রের নামে কিন্তু খান নেই।

এইভাবে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে সামনে এনেছেন বলেই, না ভেবে উপায় থাকে না যে নিজের ব্যক্তিজীবনকে এই ছবির আখ্যান বোনার সুতো হিসাবে ব্যবহার করেছেন শাহরুখ। তাঁর ভক্তরা নিশ্চয়ই জানেন, যাঁরা জানেন না তাঁরা ফরীদা জালালের নেওয়া এই সাক্ষাৎকার শুনলে জানতে পারবেন যে শাহরুখের বাবা মীর তাজ মহম্মদ খান স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের জেনারেল শাহনওয়াজ খান মীরের ঘনিষ্ঠ এবং আত্মীয়।

জওয়ান ছবিতে শাহরুখ অভিনীত একটা চরিত্রের নাম আজাদ। সে মেয়েদের নিয়ে নিজের এক ফৌজ গড়ে তোলে। সে ফৌজের লক্ষ্য দেশের ভাল করা। এক অর্থে আজাদ হিন্দ ফৌজই বটে। মজার কথা, এ দেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীতে মেয়েদের নিয়ে আলাদা ব্রিগেড গড়ে তোলার ঘটনা আজাদ হিন্দ ফৌজেই প্রথম। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের রানী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিগেডের সঙ্গে শাহরুখের মহিলা ব্রিগেডের আরও একটা সাদৃশ্য ছবিটা দেখামাত্রই ধরা পড়বে। সেকথা উহ্য রাখলাম স্পয়লার দেব না বলেই।

শাহরুখের একখানা সংলাপ নিয়ে বিজেপিবিরোধীরা বিশেষ উল্লসিত এবং বলা হচ্ছে ওটা তাঁর ছেলে আরিয়ানকে যারা গ্রেফতার করেছিল তাদের উদ্দেশে বলা – ‘বেটে কো হাথ লগানে সে পহলে বাপ সে বাত কর’। এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে সেকথা ভেবেই ওই সংলাপ লেখা হয়েছে, কিন্তু উপরের সাক্ষাৎকার শুনলে মনে হয় জওয়ান ছবিটা অনেক বেশি করে নিজের বাবার প্রতি শাহরুখের শ্রদ্ধাঞ্জলি। সাক্ষাৎকারের শেষ ৩-৪ মিনিটে বাবা দেশ এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে কী কী বলেছিলেন শাহরুখ তার বিবরণ দেন। সে বিবরণে জওয়ানের পদশব্দ শোনা যায়। নেহাত ঠাট্টা করেই ছবির শেষের দিকে আনা হয়েছে লায়ন কিংপ্রসঙ্গ। কিন্তু ঠাট্টার আড়ালে লুকিয়ে আছে চোখের জল। সিম্বার মত ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছিলেন শাহরুখ। অ্যাটলির মুনশিয়ানায় বার্ধক্যের দ্বারে পৌঁছে মহাতারকা প্রায় দর্শকের অলক্ষ্যে পূরণ করে নিলেন বাবার সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার অপূর্ণ ইচ্ছা। স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবার থেকে যা শিখেছেন সবটুকু নিংড়ে দিলেন দর্শকের জন্য, দেশের দারুণ দুঃসময়ে।

শিল্পীরাই এসব করতে পারেন। একজন শিল্পী এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা পারেন?

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

ভারত বনাম ইন্ডিয়া: আমাদের সেই তাহার নামটি

মোহন ভাগবত বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে।

যা রটে তার কিছু

যেদিন বিজেপিবিরোধী জোটের নামকরণ হল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স, সংক্ষেপে ইন্ডিয়া, সেদিন সঙ্ঘ পরিবারের প্রবল বিরোধী এক অগ্রজ বন্ধু বলেছিলেন “সবই ভাল, কিন্তু সেই অ্যাংলোফাইল নামটাই ধরে থাকতে হল? ইন্ডিয়া না করে কোনোভাবে ভারত করা গেল না নামটা?” তিনিও অবশ্য স্বীকার করেছিলেন, গত এক দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে যেভাবে বিজেপিই ঠিক করে দিয়েছে ইস্যু কোনটা আর বিরোধীরা কেবল তার বিরোধিতা করে গেছে, সেই ধারা উলটে দিয়েছে ওই নাম। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, সরকারি দলের মুখপাত্র এবং তাদের কুখ্যাত আই টি সেল হিমশিম খাচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক আলোচনার যে মানদণ্ড তারাই তৈরি করেছে, তাতে ইন্ডিয়া নামধারী কাউকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা চলে না। বললেই পালটা আক্রমণ হবে “তার মানে আপনি অ্যান্টি-ইন্ডিয়া?” নাম যে সবকিছু নয়, চরম দেশদ্রোহী কোনো দলও নিজের নামের সঙ্গে দেশের নাম জুড়তেই পারে – এই যুক্তির বাজার বিজেপি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে বহুকাল হল। বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের নাম বদলে প্রয়াগরাজ রাখা হয়েছে, মোগলসরাই হয়ে গেছে দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। এগুলো তো প্রাচীন জায়গা, সাম্প্রতিককালে ঝাঁ চকচকে শহর হয়ে ওঠা গুরগাঁওয়ের নাম পর্যন্ত বদলে গুরুগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির ঔরঙ্গজেব রোডেরও নাম বদলে গেছে। কারণ বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার মনে করে নাম ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্যাঁচে পড়ে শেক্সপিয়র সাহেবের মত নামে কী আসে যায় বললে নিজেদের সমর্থকরাই শুনবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখনিঃসৃত বাণী সমর্থকদের কাছে অমৃতসমান। তাই তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নামেও ইন্ডিয়া থাকে বলে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হল না দেখে শেষ চেষ্টা ছিল ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে ‘ঘমন্ডিয়া’ বলা। কিন্তু দেখা গেল, ওটা ‘মিত্রোঁ’ বা ‘ভাইয়োঁ ঔর বহনোঁ’-র অর্ধেক জনপ্রিয়তাও অর্জন করতে পারল না। ফলে নামের লড়াইটা তখনকার মত ইন্ডিয়া জোট জিতেই গিয়েছিল।

কিন্তু হার স্বীকার করে নেওয়া বিজেপির স্বভাব নয়। হলে একাধিক রাজ্যে ভোটে না জিতেও তারা সরকার গঠন করতে পারত না। তাছাড়া সত্যোত্তর পৃথিবীর বাস্তবতা বিজেপির মত করে কেউ বোঝে না। তারা জানে, আজকের দুনিয়ায় বাস্তবে কী ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে বড় কাজ হল মানুষ কী জানছে এবং জেনে কী ভাবছে তা নিয়ন্ত্রণ করা। অতএব যা ভাবলে আমার সুবিধা লোককে সেটাই ভাবাতে হবে, অন্য কথা ভাবার ফুরসত দেওয়া চলবে না। সুতরাং অবিলম্বে চলে এল জল্পনা কল্পনা চালানোর মত বিষয় – এক দেশ, এক নির্বাচন। আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসবে ঘোষণা করা হল এবং কী নিয়ে আলোচনা হবে তা সংসদীয় প্রথায় প্রকাশ না করে গোদি মিডিয়াকে দিয়ে সম্ভাবনা হিসাবে ভাসিয়ে দেওয়া হল এক দেশ, এক নির্বাচনের কথা। এতে বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল এই পরিকল্পনার বিরোধিতায়, নিজেদের সরকারবিরোধী বক্তব্যগুলো আর মানুষের সামনে তুলে ধরার সময় রইল না। জনপরিসর থেকে হারিয়ে গেল মণিপুর, হরিয়ানার দাঙ্গা, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, বিদেশের সংবাদমাধ্যমে আদানি গ্রুপের আর্থিক দুর্নীতির নতুন প্রমাণ সামনে আসায় তাদের বিরুদ্ধে ফের ওঠা যৌথ সংসদীয় তদন্তের দাবি। এক দেশ, এক নির্বাচন নিয়ে হইচই না কাটতেই সরকারপক্ষ নিয়ে এসেছে আরেক অনন্ত জল্পনার বিষয় – দেশের নাম ইংরেজিতেও ইন্ডিয়া থেকে বদলে ভারত করে দেওয়া হবে কি?

এমনিতে বিজেপির ভোটসর্বস্বতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্রেফ ভোটে জেতার জন্যে তারা করতে পারে না এমন কাজ নেই। ফলে এক দেশ, এক নির্বাচন চালু করা অথবা দেশের নাম বদলানোর দিকেও এগোতেই পারে। বিজেপির পুরনো বন্ধু এবং উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ইদানীং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া মায়াবতী যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন রাজনৈতিক সংগঠন বা জোটের নামে ইন্ডিয়া ও ভারত শব্দ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করার আবেদন নিয়ে, হাস্যকরভাবে ইন্ডিয়া জোটকে দায়ী করেছেন বিজেপিকে দেশের নাম বদলে দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য, তাতে এই সন্দেহ জোরদার হয়। কিন্তু এহ বাহ্য। আলোচনাটা আরেকটু গভীরে গিয়ে করা দরকার।

যেখানে বাঘের ভয়

লক্ষণীয় যে এক দেশ, এক নির্বাচন এখনো স্রেফ জল্পনার বিষয় হলেও (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটা কমিটি তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করা হয়নি) দেশের নাম সরকারিভাবে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত সরকারের তরফ থেকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতিকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ লিখে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা স্রেফ কারোর স্বপ্নার্দ্র বিছানার জিনিস হয়ে নেই, সরকারি কাগজপত্রে লিখিত আকারে এসে পড়েছে। সুতরাং সাধারণ মানুষের এ নিয়ে আলোচনা না করে উপায় নেই। কারণ এতে আমার-আপনার – জনপ্রিয় লব্জে বললে করদাতার – টাকা জড়িয়ে আছে। মানে সমস্ত সরকারি কাগজপত্রে যদি কাল থেকে ‘গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ হয়ে দাঁড়ায় ‘গভমেন্ট অফ ভারত’, তাহলে স্রেফ লেটারহেড ছাপাতে কত কোটি টাকা খরচ হবে ভাবুন।

ইদানীং সরকার এবং তার ন্যাওটা সংবাদমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিখ্যাত ক্রিকেটার, চিত্রতারকা ইত্যাদি বিশেষ অজ্ঞরা সরকারের যে কোনো কার্যকলাপের উপকারিতা প্রমাণ করতে প্রথমেই বোঝায় কাজটা করলে করদাতাদের কত টাকা বাঁচবে। ১৯৯১ সালের পর থেকে যেমন সরকার এবং তার ন্যাওটারা অহোরাত্র বোঝাত ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’, এ খানিকটা সেইরকম। যেমন ‘এক দেশ এক নির্বাচন ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচবে’, ‘ভর্তুকি তুলে দেওয়া ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচে’। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় ওটাই সরকারের কাজের ভালমন্দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড, তাহলে কিন্তু সর্বত্র ‘ইন্ডিয়া’ বদলে ‘ভারত’ করার পরিকল্পনাকে কোনোভাবেই ভাল বলা যাবে না। কারণ এতে করদাতাদের টাকা তো বাঁচবেই না, উলটে একগাদা টাকা খরচ হবে। টাকার কথা যখন উঠলই, তখন খেয়াল করিয়ে দেওয়া যাক – শুধু গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া নেই, আছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াও। সেটাও কি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ভারত হবে? হলে টাকা কি নতুন করে ছাপা হবে? সেক্ষেত্রে পুরনো নোটগুলোকে কি চলতে দেবে সরকার? নাকি আরও একচোট নোটবন্দির খাঁড়া ঝুলছে আমাদের মাথার উপরে?

কথাটাকে সোশাল মিডিয়া জোক মনে হচ্ছে? মনে রাখবেন, দেশের বর্তমান সরকার জোকারের মত সব এলোমেলো করে দিতেই ভালবাসে। তাতে মানুষের প্রাণ গেলেও কুছ পরোয়া নেই। রাজ কাপুর অভিনীত জোকার নয়, হিথ লেজার বা জোয়াকিন ফিনিক্স অভিনীত জোকার। তার অন্তত দুটো প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে – নোটবন্দি আর চার ঘন্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন।

ভারত এক খোঁজ

অবশ্যই শুধু করদাতাদের টাকা খরচ হবে বলে ভারত নাম ব্যবহারে বিরোধিতা করা চলে না। ও রাস্তায় হাঁটলে শেষমেশ অনেক ভাল কাজেরই বিরোধিতায় গিয়ে পৌঁছতে হবে। ঠিক যে রাস্তায় মোদী সরকার হাঁটছে। দেশে এত ঘন ঘন নির্বাচন হয়, তাতে করদাতাদের বিপুল টাকা খরচ হয়। অতএব গোটা দেশে একসঙ্গে লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচন হোক – টাকা বাঁচবে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিয়ে টাকা বাঁচানো যদি ঠিক হয়, তাহলে কিছুদিন পরে বলা যেতেই পারে, নির্বাচন ব্যাপারটারই দরকার নেই। একশো শতাংশ টাকা বেঁচে যাবে। পঞ্চায়েত, পৌরসভা, কর্পোরেশনগুলোর ব্যাপারে নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতেই তাই বলা হবে। সুতরাং অন্য যুক্তিতে আসি।

এতদিন যাঁরা জানতেন না, তাঁরাও গত কয়েকদিনের আলোচনায় নিশ্চয়ই জেনে গেছেন যে আমাদের দেশটার নাম সাংবিধানিকভাবেই ইন্ডিয়া এবং ভারত – দুটোই। সংবিধানের একেবারে প্রথম অনুচ্ছেদেই পরিষ্কার লেখা আছে “India, that is Bharat, shall be a Union of States.”

বস্তুত সংবিধান সভার বিতর্কে নাম নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল এবং সবাই যে ইন্ডিয়া শব্দটা ব্যবহার করা নিয়ে একমত ছিলেন তা নয়। শেষমেশ দুটো নামই থেকে যায়। এমন নয় যে ভারত নামটাকে ব্রাত্য করে দিয়ে স্রেফ বিদেশি লব্জের ইন্ডিয়াকেই দেশের সরকারি নাম করে দেওয়া হয়েছিল, যা এখন দক্ষিণপন্থীরা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আদৌ ইন্ডিয়া কেন? সব ভাষাতেই ভারত নয় কেন? আমার বন্ধু যা বলেছেন সেটা কি সত্যি? ইন্ডিয়া শব্দটা কেবল ভারতের অ্যাংলোফাইলরা, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষাসর্বস্ব উচ্চকোটির লোকেরা ব্যবহার করেন? ও নাম আপামর ভারতবাসীর পছন্দের নাম নয়?

এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে মনে রাখা ভাল, বহু ভাষাভাষী এবং ভাষার ভিত্তিতে তৈরি প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত দেশ ভারতে এক রাজ্যের মানুষের সঙ্গে অন্য রাজ্যের মানুষের সংযোগের ভাষা কী হওয়া উচিত, সরকারি কাজের ভাষা কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে স্বাধীনতার আগে থেকেই বিতর্ক চলছে। এমনকি সংবিধানের ৩৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় লেখা আছে দেশের সরকারি ভাষা হবে দেবনাগরী লিপিতে লেখা হিন্দি।

তারপর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ১ নম্বরে যা-ই লেখা থাক, এই সংবিধান চালু হওয়ার পরে ১৫ বছর দেশের সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরিজির ব্যবহার চলতে থাকবে। আবার ৩ নম্বর ধারাতেই বলা হয়েছে, বর্তমান অনুচ্ছেদে (অর্থাৎ ৩৪৩ নম্বরে) যা-ই বলা থাক, ওই ১৫ বছর কেটে গেলে ইংরিজি ভাষার ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে। ৩৪৩-৩৫১ অনুচ্ছেদগুলো পড়লে হিন্দি ভাষার প্রতি সংবিধানের পক্ষপাত দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়। ৩৫১ নম্বরে তো হিন্দি ভাষার প্রসারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই অনুচ্ছেদের শেষাংশে একেবারে হেডমাস্টারি কায়দায় বলা হচ্ছে শব্দভাণ্ডার প্রসারিত করার প্রয়োজনে প্রধানত সংস্কৃতের কাছে হাত পাততে হবে (“…for its vocabulary, primarily on Sanskrit and secondarily on other languages”)। ঘটনা হল, ভারত শব্দটা এসেছে সংস্কৃত থেকে এবং ব্যবহার হয় মূলত হিন্দি ও উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলোতে। ফলে বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের মানুষের সঙ্গত কারণেই এই শব্দটাকে দেশের নাম বলে মেনে নিতে আপত্তি আছে। প্রাচীন শাস্ত্র ও পৌরাণিক সাহিত্যে যে ভারতের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কিন্তু দাক্ষিণাত্য পড়ে না। মহাভারতে কটা কথা আছে দক্ষিণ ভারত নিয়ে? বাঙালিদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, তামিল, মালয়ালমের সঙ্গে সংস্কৃতের অনেক মিল। অতএব ওগুলো সংস্কৃত থেকেই এসেছে। কিন্তু তামিলরা অনেকেই মনে করেন তাঁদের ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি। বরং দাক্ষিণাত্যের সমস্ত ভাষার জন্ম তামিল থেকে। আর্য সভ্যতার থেকে দ্রাবিড় সভ্যতা একেবারেই পৃথক। সাম্প্রতিক অতীতে তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলায় ২৬০০ বছরের পুরনো এক সভ্যতার খোঁজ মেলার পর তাকে ‘ভারতম’ সভ্যতা বলা হবে, নাকি ‘দ্রাবিড়ম’ – এই নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছিল ওই রাজ্যের রাজনীতি।

অর্থাৎ আমরা বিন্ধ্য পর্বতের এপারে আছি বলেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতিতে ভারত শব্দটার প্রাঞ্জল উপস্থিতি। কিন্তু কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সমস্ত ভারতবাসী ভারত বলেই দেশটাকে চেনেন বা চিনতে পছন্দ করেন – এরকম ভাবনায় গলদ আছে। এমনকি বাঙালিরা সকলে ভারত শব্দটাই ভাবে – এমন ধারণাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে সাপ্তাহিক কালান্তর-এ প্রকাশিত দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিপোর্টাজ ‘আমি ইন্ডিয়া’ পড়লে

এই বয়েসে আবার উদ্বাস্তু। বন্যার তিনমাস পরেও একটা তাঁবু জোটাতে পারেন নি। সমর্থ মেয়ে-জামাই আর বছর দশেকের ছেলেটাকে নিয়ে চারদিক খোলা একটা ছাউনির তলায় খড় বিছিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। অথচ এখনও ওঁর মাথা ছুঁয়ে পূর্ণিমার চাঁদ।

‘পাকিস্তান ছেড়ে কবে এসেছিলেন?’ আশ্চর্য উত্তর দিলেন বুধেশ্বরী। ছাউনি থেকে হাত নামিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন ‘আমি ইন্ডিয়া। আমি পাকিস্তান না থাকিস।’

অমোঘ সেই অভিজ্ঞতা। পাটকাঠির চাল ছাড়িয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে যে রমণী দাঁড়িয়ে, সে বলছে সে উদ্বাস্তু নয় – ভারতবাসী। সে বলছে সে ‘ইন্ডিয়া’।

আরও বড় কথা, ভারতের কেন্দ্রস্থলের যে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো সবচেয়ে জনবহুল, সেখানকার গরিব-গুরবো মানুষের মধ্যেও দেশের নাম হিসাবে ভারতের চেয়ে বেশি প্রচলিত এমন একটা শব্দ যা ভারত বনাম ইন্ডিয়া বিতর্কে বিজেপিবিরোধীদেরও উল্লেখ করতে দেখছি না – হিন্দুস্তান। স্বাধীনোত্তর দেশে আসমুদ্রহিমাচল সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে (দক্ষিণ ভারতে কিছুটা কম, কিন্তু একেবারে পারেনি তা নয়) যে জিনিসটা তা যে মুম্বাইয়ে তৈরি হিন্দি ছবি – সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বাংলায় সে ছবির জনপ্রিয়তাও কোনোদিন কম ছিল না। ভেবে দেখুন তো, হিন্দি সিনেমার সংলাপে বা গানে কতবার শুনেছেন ভারত বা ভারতীয় শব্দটা? বরং বারবার শোনা যায় হিন্দুস্তান এবং হিন্দুস্তানি শব্দ দুটো। হম হিন্দুস্তানী ছবির ‘ছোড়ো কল কি বাতেঁ, কল কি বাত পুরানি/নয়ে দওর মে লিখেঙ্গে/দিল পর নয়ী কহানী/হম হিন্দুস্তানী’ গানটা একসময় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। সে গানে আবার আরএসএস-বিজেপির প্রবল অপছন্দের লোক জওহরলাল নেহরুকে দেখানো হয়েছিল।

বলিউডের সর্বকালের জনপ্রিয়তম শিল্পীদের একজন অমিতাভ বচ্চন। তাঁর প্রথম ছবির নাম সাত হিন্দুস্তানী (১৯৬৯)। তিনি বুড়ো বয়সে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে তৈরি বেশকিছু খাজা জাতীয়তাবাদী ছবির একটায় অভিনয় করেছিলেন। সেই ছবির নাম হিন্দুস্তান কি কসম (১৯৯৯)। ওই একই নামে ১৯৭৩ সালেও একটা ছবি হয়েছিল। চেতন আনন্দ সেই ছবি বানিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে। বর্তমানে যাঁকে বলিউডের বাদশা বলা হয়, সেই শাহরুখ খানের একটা ফ্লপ কিন্তু অন্যরকম ছবির নাম ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানী (২০০০)। আরও অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। হিন্দিভাষী সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বলিউড হিন্দুস্তান শব্দটাকে এই প্রাধান্য দিত না। আরএসএস-বিজেপির প্রভাবে ইদানীং হয়ত বদল এসেছে, কিন্তু গত শতকের আট-নয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের যেসব শ্রমজীবী মানুষ বসবাস করতেন তাঁদের কদাচিৎ ভারত শব্দটা ব্যবহার করতে দেখা যেত। তাঁরা হিন্দুস্তানই বলতেন। যদিও হিন্দুস্তান শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হিন্দুদের ভূমি – হিন্দু, মুসলমান সকলেই কিন্তু দেশের নাম হিসাবে এই শব্দটাই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে এসেছেন। আজকাল কথাগুলো লেখার প্রয়োজন পড়ছে, পড়ে সন্দেহও হচ্ছে হয়ত, কিন্তু আমাদের শৈশবে স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস বা নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে যে গানটা পাড়ায় পাড়ায় মাইকে বাজতই, সেটা হল ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা/হিন্দুস্তান হমারা’। সেই গানের রচয়িতা মীর ইকবাল একসময় পাকিস্তানপন্থী হয়ে যান। সম্ভবত সেই অপরাধেই, আমাদের অখেয়ালে, ওই গানটাকে বিজেপি আমলে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছে। ইকবালের লেখাপত্র পাঠ্য থেকে বাদ দেওয়াও শুরু হয়েছে, কিন্তু সে অন্য আলোচনা। এই আলোচনায় এটুকুই বলার যে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের বিরাট অংশের মানুষ দেশকে হিন্দুস্তান নামে চিনে এসেছেন অন্তত কয়েক হাজার বছর ধরে, ভারত নামে নয়, ইন্ডিয়া নামেও নয়। ফলে ইন্ডিয়া যদি অভিজাত ভারতের লব্জ হয়, ভারতও অভিজাত ভারতেরই অন্য এক অংশের লব্জ।

‘ভারত’ আর ‘ইন্ডিয়া’ বলে অনেক আরএসএসবিরোধীও আসলে যা বোঝাতে চান তা হল দুস্তর আর্থসামাজিক ব্যবধান। ওটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। তাঁরা বলতে চান এ দেশের মধ্যে আসলে দুটো দেশ আছে। ইন্ডিয়া অংশটা লেখাপড়া শেখা, শহুরে, পেট ভরে খাওয়া দেশ। ভারত মূলত গ্রামে বাস করে, লেখাপড়া শিখবে কী, অনশনে অর্ধাশনেই তার দিন কাটে। কথাটা ঠিক, আবার ভুলও। কারণ দুটো কেন? একটু ঘোরাফেরা করলেই স্পষ্ট দেখা যায় এ দেশের মধ্যে আসলে অনেকগুলো দেশ আছে। পেশাগত কারণে এক সময় বারবার ঝাড়খণ্ড যেতাম। রাঁচি আর কলকাতা যে একই দেশের দুটো রাজ্যের রাজধানী একথা বিশ্বাস হত না কিছুতেই। কারণ প্রচণ্ড অব্যবস্থা, প্রবল অনুন্নয়ন দেখেছি। আবার সিকিম আর কেরালা বেড়াতে গিয়ে অবাক হয়ে ভেবেছি, পশ্চিমবঙ্গ এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে একই দেশে আছে কেমন করে? এ তো গেল ভিনরাজ্যের কথা। সম্প্রতি জঙ্গলমহল ঘুরে এলাম। বুঝতে বাকি রইল না যে আমি আর কাঁকড়াঝোর বা আমলাশোলের বাসিন্দারা একই দেশে বাস করি না। কিন্তু তার সঙ্গে ইন্ডিয়া আর ভারত শব্দ দুটোর কী সম্পর্ক?

আরএসএস-বিজেপি কিন্তু ওই ফারাক বোঝাতে ইন্ডিয়া আর ভারত বলে না। তারা ওই দুটো শব্দ দিয়ে কী বোঝাতে চায় তা ২০১৩ সালে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত আসামের শিলচরে যা বলেছিলেন তা খেয়াল করলেই পরিষ্কার হবে। তিনি বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে। নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা জানেন ভাগবতের ওই মন্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। আসল কথা হল গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বিরুদ্ধে ঘটানো অধিকাংশ অপরাধের অভিযোগই দায়ের হয় না। সুতরাং ইন্ডিয়াকে ভারত বানাতে চাওয়া মানে, হয় গোটা দেশটাকেই এমন করে ফেলা যেখানে পরম্পরাগত চিন্তায় ধর্ষিতারা আদৌ অভিযোগ দায়ের করবেন না, অথবা আরও সরল সমাধান – রাষ্ট্র বলবে ভারত প্রাচীন সংস্কার মেনে চলা দেশ। এখানে ধর্ষণ হয় না। এটা একটা উদাহরণ। আরও কী কী হওয়া সম্ভব ভারতে তার মাত্র একটা উদাহরণ।

আসল কথা

দেশকে মা বলে শুধু দক্ষিণপন্থীরাই কল্পনা করে তা তো নয়, ঋত্বিক ঘটকও করতেন। এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ করে থাকেন। কারণ দেশ আসলে একটা আবেগ, অর্থাৎ বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্র হল সেই বিমূর্ত ভিতের উপর গেঁথে তোলা মূর্ত ইমারত। নিজের মাকে যার যা ইচ্ছা সে তাই বলে ডাকে। ওটা বেঁধে দেওয়া অসম্ভব। বাঙালিরা মা বলে, তামিলরা আম্মা বলে, গুজরাটিরা আবার বা বলে। এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও অনেকে মামণি বলে। এক পরিবারের কথা জানি, সেখানে দুই ছেলে তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকত। কারণ কথা বলতে শেখার বয়সে ঠাকুমাকে শুনত তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকছেন, সেই অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তামিল বা গুজরাটি পরিবারগুলোর মধ্যেও খুঁজে দেখলে নির্ঘাত এরকম বিকল্প ডাকের সন্ধান পাওয়া যাবে। ও নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, কারণ ওটা আবেগের বিষয়। সন্তানের যা বলে ডাকতে ভাল লাগে, সে তাই বলবে। কেউ ভারত বলবে, কেউ হিন্দুস্তান বলবে, কেউ ইন্ডিয়া বললেও তেড়ে যাওয়ার কিছু নেই। সংবিধানপ্রণেতারা ইন্ডিয়া আর ভারত লিখেছিলেন, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন নাম হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুস্তান শব্দটা রাখেননি। হয়ত ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য ভাগ হওয়া এবং নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা দেশের সরকারি নাম হিন্দুস্তান হওয়া ভাল বার্তা দেবে না মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সে নামের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ করার জন্যেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। ভারত রাষ্ট্র পরবর্তীকালেও সরকার ছাড়া অন্য কে কোন নাম ব্যবহার করছে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন ঘামাতে চায় বলেই এত কাণ্ড করছে।

আরও পড়ুন ২০২৪ আসলে গণভোট, বহুত্ববাদী ভারতের মুখ রাহুল গান্ধী

এমনিতে নাম বদলালে কী-ই বা এসে যায়? উপরে যে ব্যবহারিক অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছি সেটা ছাড়া? লক্ষ করে দেখছি, শেখানো বুলির মত কিছু কথা আওড়াচ্ছেন বিখ্যাতরা। সুনীল গাভস্কর প্রমুখ বলছেন, বর্মার নামও তো বদলে মায়ানমার হয়েছে। তাতে ক্ষতি কী? এর উত্তর খুঁজলেই আসল ক্ষতে চোখ পড়বে। বর্মার নাম বদলে মায়ানমার করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে এবং তা কোনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাজ ছিল না। কাজটা করেছিল জুন্টা সরকার। আসল আপত্তির জায়গাটা এইখানে। ভারত সরকার যদি সত্যিই মনে করে থাকে দেশের সরকারি নাম ইংরিজিতেও ভারত করার কোনো বিশেষ প্রয়োজন আছে, তাহলে সংসদে আলোচনা করে নিয়মকানুন মেনে সংবিধান সংশোধন করে বদলাতে পারত। কিন্তু সরকারি কাগজে চুপিসাড়ে বদল করে দেওয়া অগণতান্ত্রিক। কাজটা অবশ্য বিলক্ষণ চতুরতার। কারণ এখন সংসদের বাইরে বিজেপি মুখপাত্ররা যা-ই বলুন, সংসদে আলোচনা হলে হয়ত অমিত শাহ বলবেন, বদলাইনি তো! ভারত নামটা তো সংবিধানেই আছে।

আসলে সংগঠনের শতবর্ষে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে গেল অথচ দুনিয়াসুদ্ধ লোক ইন্ডিয়া বলে ডাকছে – এ জিনিস আরএসএসের হজম হবে না। কারণ ‘ইন্ডিয়া’ নামটা এসেছে পারস্যের লোকেদের মুখের ‘হিন্দুস্তান’ ইউরোপিয় জবানে বদলে গিয়ে। ইংরেজদের এ দেশে আসতে তখনো কয়েক হাজার বছর দেরি, যীশুখ্রিস্টেরই জন্ম হয়নি। এ নাম কি সঙ্ঘ মেনে নিতে পারে? বস্তুত ‘হিন্দু’ শব্দটাও বেদ, বেদান্ত, রামায়ণ, মহাভারত – কোথাও নেই। বরং জরাথ্রুষ্টের ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ আবেস্তা-য় আছে। সঙ্ঘ তাই পারলেই তাদের বয়ানে ‘সনাতন ধর্ম’ কথাটা গুঁজে দেয়। এমনি তো আর দয়ানিধি স্ট্যালিন সনাতন ধর্মের বিনাশের ডাক দেওয়ায় বিজেপি নেতারা রণচণ্ডী হয়ে ওঠেননি। বস্তুত যে ভাষাটার প্রতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ পক্ষপাত, যা গত শতকের ছয়ের দশকে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং এখন বিজেপি ফের চাপিয়ে দেওয়ার তালে আছে, সেই ‘হিন্দি’ ভাষাও আদতে ছিল হিন্দুস্তানি (আমির খুসরো বলতেন হিন্দভি) ভাষা। সুলতানি আমল থেকে দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্য এশিয়া এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ভাষা মিশে তা গড়ে উঠেছিল। এই ভাষা দেবনাগরী আর ফারসি – দুরকম লিপিতেই লেখা চলত। হিন্দি আর উর্দু – এই বিভাজন হয়েছে মাত্র শ দুয়েক বছর আগে এবং তার পিছনে ইংরেজদের ভূমিকা কম নয়।

অর্থাৎ সঙ্ঘ পরিবারের এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্রের স্লোগান – হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান – গোটাটাই বিদেশি লব্জ ধার করা। অবশ্য জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র ধারণাগুলোই ইউরোপিয়। কস্মিনকালে ভারতে ছিল না। আগাগোড়া ধার করা জিনিস নিয়ে চললে হীনমন্যতা আসাই স্বাভাবিক, ধারের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টাও প্রত্যাশিত।

শেষ নাহি যে

বুধেশ্বরী দীপেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘হামারলা মরিলে কি দ্যাশ বাঁচিবে?’ দেশের মানুষ না বাঁচলে দেশ বাঁচে না। এখন আশু লড়াইটা দেশ বাঁচানোর, নাম বাঁচানোর নয়। যেহেতু দেশের মানুষের জন্য বিজেপি সরকার কিছুই করেনি, তাই দেশের মানুষকে ঝুটো গর্ব দিয়ে এবং বিরোধীদের সে গর্ব সামলানোর কাজে ব্যস্ত রেখেই তারা উতরোবার চেষ্টা করছে। যুগপৎ নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত করছে। অর্থাৎ রথ দেখা এবং কলা বেচা। ২০২৪ নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীরা পুনর্নির্বাচিত হলে দেশের নাম কেন, দেশের লোকেদের নামও বদলে দিতে পারে। কেউ আটকাতে পারবে না। ফলে এখন বিরোধীদের দায়িত্ব এক দেশ এক নির্বাচন বা নাম পরিবর্তনের মত কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থেকেও সরকারের অকর্মণ্যতা এবং বিপজ্জনক কাজগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো, বিকল্প হাজির করা। নইলে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির ঘূর্ণিতে ডুবে মরতে হবে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী অবশ্য নির্বাচন এবং নাম নিয়ে ডামাডোলের ঊর্ধ্বে উঠে আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে সংসদে আলোচনার জন্য নটা বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু বিজেপি যে বিনা আলোচনায় সংসদ চালাতে এবং নিজেদের পছন্দের বিল পাস করাতে সিদ্ধহস্ত তা আমরা জেনে গেছি। ইন্ডিয়া জোট তাদের একতা বাইরের মত সংসদের ভিতরেও দেখাতে পারে কিনা, দেখিয়ে বিজেপির যা ইচ্ছা তাই করা আটকাতে পারে কিনা, তার উপরে নির্ভর করছে আমরা আগামী বছর কীরকম নির্বাচন দেখব। তার চেয়েও বড় কথা, দেশের ভিতটা থাকবে কিনা। ভিত না থাকলে ইমারত টেকে না।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

অমিতাভ মুখ খুললেন, তবে শরশয্যায়

এই বাজারে কোনো প্রোডাকশন হাউস মহাভারতের মত বিশাল প্রকল্প হাতে নেবে এমন সম্ভাবনা কম। তবু যদি তেমন কিছু হয়, পিতামহ ভীষ্মের চরিত্রের জন্য অমিতাভ বচ্চনের চেয়ে ভাল কাউকে ভাবা যায় কি?

একসময় খবরের কাগজের বিনোদনের পাতায় নিয়মিত ব্যবধানে খবর বেরোত, বলিউডে বা টলিউডে অমুক নির্দেশক মহাভারত বা মহাভারত অবলম্বনে কোনো বড় বাজেটের ছবি করছেন। তার কটা শেষপর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে বা বক্স অফিসে সফল হয়েছে জানি না। তবে ওরকম খবর বেরোলে কদিন প্রকাশিত কাস্টিং নিয়ে সিনেমাভক্তদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা চলত। কে কোন চরিত্রে অভিনয় করছে আর কোনটা করলে ভাল হত – এই আলোচনায় দিব্যি সময় কাটত। অতিমারীর সময় থেকেই এ দেশের সিনেমাশিল্প সংকটে। বলিউড রীতিমত বেকায়দায়। এক ওটিটিতে রক্ষা নেই, বয়কট দোসর। তার উপর হিন্দিতে ডাব হয়ে বলিউডকে টেক্কা দিচ্ছে তামিল, মালয়ালম, কন্নড় ভাষার ছবি। এই বাজারে কোনো প্রোডাকশন হাউস মহাভারতের মত বিশাল প্রকল্প হাতে নেবে এমন সম্ভাবনা কম। তবু যদি তেমন কিছু হয়, পিতামহ ভীষ্মের চরিত্রের জন্য অমিতাভ বচ্চনের চেয়ে ভাল কাউকে ভাবা যায় কি? ইংরেজিতে ‘এল্ডার স্টেটসম্যান’ বলে একটা কথা আছে। মহাভারতের আখ্যানে সেই এল্ডার স্টেটসম্যান নিঃসন্দেহে ভীষ্ম। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব পক্ষে যোগ দিলেও পাণ্ডব পক্ষের কাছে তিনি শ্রদ্ধাভাজন তাঁর প্রজ্ঞা, প্রবীণতা এবং বহু বিষয়ে নিরপেক্ষ বিচারক্ষমতার কারণে। অমিতাভ এখন যে বয়সে পৌঁছেছেন, সিনেমার জগতে তাঁর অভিজ্ঞতার যা দৈর্ঘ্য এবং বৈচিত্র্য, ওই জগতের বাইরেও ভারতের সব ক্ষেত্রের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তাঁর যা গ্রহণযোগ্যতা, তাতে আর কাকে এল্ডার স্টেটসম্যান বলা যায়?

এহেন অমিতাভ ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন তা নিয়ে হইহই পড়ে গেছে। হ্যারি পটারের ভক্তরা জানেন, জাদুর দুনিয়ায় ভল্ডেমর্টের নামোচ্চারণ বারণ। আজকের ভারতে তেমনি বাকস্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করা বারণ, করলেই ঝামেলা হয়। আজকের ভারতে বিখ্যাত কেউ যদি বলেন বাকস্বাধীনতা আছে, তাহলেই সরকারপক্ষের লোকেরা উদ্দাম নৃত্য শুরু করেন, যাঁরা বলেন নেই তাঁদের এই সুযোগে আরেকবার মিথ্যাবাদী, দেশদ্রোহী ইত্যাদি বলে নেন। ফলে অভিযুক্ত দেশদ্রোহীরা বিখ্যাতকে বলেন “ব্রুটাস, তুমিও”? আর যদি অমিতাভের মত কেউ বলে ফেলেন বাকস্বাধীনতা নেই, তাহলে তো মহাপ্রলয়। সরকারপক্ষ বলেন, এত বড় কথা! বাকস্বাধীনতা নেই? “আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে – /সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।” কিন্তু অমিতাভের মন্তব্যের পরে কিঞ্চিৎ উলটপুরাণ দেখা গেছে। কামড় পরিবার, থুড়ি, সঙ্ঘ পরিবারের ট্রোলবাহিনীর মাথা অমিত মালব্য অমিতাভের প্রশংসা করেই টুইট করেছেন। কারণ মন্তব্যটা কলকাতায় করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে। অতএব মালব্যের ব্যাখ্যা, অমিতাভ ‘টাইর‍্যান্ট’ মমতার মুখের সামনে আয়না ধরেছেন। এমন টাইর‍্যান্ট যার রাজত্বে নির্বাচনোত্তর হিংসা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক-নির্বাচন হিংসা বা নির্বাচনোত্তর হিংসা নিঃসন্দেহে বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী, কিন্তু বাকস্বাধীনতা ব্যাপারটার সীমা ওটুকুর মধ্যেই বেঁধে দেওয়ার চালাকি বিজেপির আই টি সেলের প্রধান ছাড়া আর কে-ই বা করবেন? আই টি সেলের আর যে দোষই থাক না কেন, সোশাল মিডিয়ার যুগে কোন জিনিসটা লোকে ভাল ‘খায়’ তা বুঝতে ওদের মত কেউ পারে না। অমিতাভের ভক্তকুল যে এখনো বিজেপির ভক্তকুলের চেয়ে বড়, ফলে এই মন্তব্যের জন্য চিরাচরিত প্রথায় তাঁকে আক্রমণ করলে যে হিতে বিপরীত হতে পারে তা চট করে বুঝে নিয়ে বন্দুকের নল মমতার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মালব্য। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন অর্ধসত্য প্রচার করার সহজাত ক্ষমতায় তৈরি অরিজিৎ সিংয়ের গান গাওয়ার ভিডিও ক্লিপ। সে ক্লিপে সুকৌশলে কেটে দেওয়া হয়েছে ‘বোঝে না সে বোঝে না’ গানের লাইন দুটো, রয়েছে শুধু ‘রং দে তু মোহে গেরুয়া’। যাতে দেখলেই মনে হয়, মমতার অনুরোধে গান গেয়ে অরিজিৎ বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি গৈরিক বাহিনীর লোক। অরিজিৎ তা হতেই পারেন, হওয়া তাঁর বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তর্গত। কিন্তু ঘটনা হল, ওই চতুর এডিটিং ছাড়া শুধু সেদিনের ঘটনা দিয়ে অরিজিতের সমর্থন প্রমাণ হয় না।

এ শুধু বিজেপি প্রোপাগান্ডা। স্বভাবতই পাল্টা প্রচারে নেমে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, নেতৃত্বে সোশাল মিডিয়ার মুক্তিসূর্য মহুয়া মৈত্র। দু পক্ষে যা চলছে তাকে আমরা গেঁয়ো লোকেরা বলি প্যাঁচাল পাড়া। আমাদের রাজনৈতিক বিতর্ক এখন প্যাঁচাল পাড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে অমিতাভের বক্তৃতা নিয়ে নিবিষ্ট আলোচনার অবকাশ ছিল। তিনি সিনেমার লোক, সিনেমার কথাই বলেছেন। সিনেমার বহু আগে আমাদের দেশের নাচ, গান, নাটকের মত শিল্পমাধ্যমগুলোর উৎস ছিল ধর্মস্থানগুলো, সেকথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সিনেমা আসার পর পরাধীন ভারতে কীভাবে সেন্সরকে ফাঁকি দিয়ে ইংরেজবিরোধী বক্তব্য ছবিতে ঢুকিয়ে দিতেন শিল্পীরা – সে ইতিহাস টেনে এনেছেন। ১৯৫২ সালের সিনেমাটোগ্রাফ আইনের কথা বলেছেন এবং তারপরেই বলেছেন “মঞ্চে উপবিষ্ট আমার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে আজও নাগরিক স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে।” সহকর্মী বলতে সেখানে তখন উপস্থিত বলিউডের শাহরুখ খান, রানী মুখার্জির মত তারকারা। টলিউডের কে নয়?

সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় ভাবাবেগের দোহাই দিয়ে কীভাবে একের পর এক ফিল্ম, ওয়েব সিরিজকে আক্রমণ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা – সেকথা কারোর অজানা নয়। মাত্র কয়েকদিন হল প্রকাশিত হয়েছে শাহরুখ ও দীপিকা পাড়ুকোনের মুক্তির অপেক্ষায় থাকা পাঠান ছবির বেশরম রঙ্গ গানের ভিডিও। সোয়া তিন মিনিটের ভিডিওতে দীপিকার বিকিনির রং বদলেছে বারবার, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁকে কেন গেরুয়া (নাকি কমলা?) বিকিনিতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাহরুখের বাহুবন্ধনে দেখা গেছে তা নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ বছরের গোড়ায় লাল সিং চাড্ডা মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই সোশাল মিডিয়ায় ছবিটাকে বয়কট করার ডাক দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।

কারণ আমির খান একবার বলেছিলেন দেশের যা অবস্থা হচ্ছে তাতে স্ত্রী কিরণ রাও একদিন আলোচনা করেছিলেন, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত কিনা। এরকম অসংখ্য উদাহরণ গত কয়েক বছরের ঘটনাবলী থেকে দেওয়া যায়। পদ্মাবত ছবি নিয়ে কী কাণ্ড হয়েছিল নিশ্চয়ই কেউ ভোলেননি। ছবির শুটিং চলাকালীন সেটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া দিয়ে শুরু, দীপিকার নাক কেটে নেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। ছবির নাম প্রথমে ছিল ‘পদ্মাবতী’, রাজপুত বীরদের দৌরাত্ম্যে শেষমেশ নাম বদলে ছবির মুক্তি নিশ্চিত করতে হয়েছিল পরিচালক সঞ্জয় লীলা বনশালীকে। অথচ ছবিটা রীতিমত হিন্দুত্ববাদী। একে প্রচলিত কাহিনিকে ইতিহাস বলে দেখানো হয়েছে, তার উপর আলাউদ্দিন খিলজী যেন নরখাদক। অর্থাৎ এই ছবি জলজ্যান্ত প্রমাণ যে ভারতে বাকস্বাধীনতা এমন বিপন্ন, সকলকে খুশি না করে সিনেমা বানানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে কতিপয় প্রযোজক, নির্দেশকের এক বিশেষ ধরনের ছবি সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এই আবহে অমিতাভ ওই কথাগুলো বলেছেন। মালব্য মোটেই বোকা লোক নন। অমিতাভের কথা প্রসঙ্গে এসব আলোচনা যে অনিবার্য তা তিনি ভালই জানেন। সে আলোচনা গুলিয়ে দিতেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে নির্বাচনী হিংসার কথা টেনে এনেছেন।

মুক্তকণ্ঠে অমিতাভের প্রশংসা করা যেত দেশের আজকের অবস্থায় এই কথাগুলো বলার জন্য, কারণ তাঁর কথার দাম যে সকলের চেয়ে বেশি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু অসুবিধা আছে। বিজেপির প্রোপাগান্ডার জবাবে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল যা যা বলছে ‘তাতে ঠাকুরঘরে কে রে, আমি তো কলা খাইনি’ মনোভাব স্পষ্ট। মুক্তিসূর্য মহুয়াও অমিতাভকে বাংলার জামাই-টামাই বলে আলোচনার গভীরে না গিয়ে তুই বেড়াল না মুই বেড়াল স্তরেই থাকার চেষ্টা করেছেন। কারণ সিনেমার কৈলাস পর্বতের বাসিন্দা অমিতাভ খবর না রাখলেও মহুয়া বিলক্ষণ জানেন রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর আক্রমণ বাদ দিলেও পশ্চিমবঙ্গে বাকস্বাধীনতা কী দারুণ স্বাস্থ্যের অধিকারী। ফ্যাসিবাদের সাত-সতেরো লক্ষণ তাঁর কণ্ঠস্থ, তাই তিনি জানেন ভবিষ্যতের ভূত বলে একটা বাংলা ছবি সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের ছাড়পত্র পাওয়ার পরেও পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ হলে দেখানো হচ্ছিল না। নির্মাতাদের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দৌড়তে হয়েছিল।

সেই ছবির পরিচালক অনীক দত্ত তার আগের কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবে চতুর্দিকে বাংলা ছবির দিকপালদের ছবির বদলে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি থাকার নিন্দা করেছিলেন।

অমিতাভের প্রশংসা করা যাচ্ছে না ঠিক এই কারণেই। তিনি জরুরি কথা বলেছেন, কিন্তু কায়দাটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। কারোর নাম না করে কিছু ভাল ভাল কথা বলা যে যুগপৎ শিরোনামে আসা নিশ্চিত করা আর বিপদসীমার বাইরে থাকার কৌশল তা তাঁর মত শোম্যান ভাল করেই জানে। উপরন্তু পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য প্রবীণতা আর অভিজ্ঞতাতেই শেষ নয়। আমরা জানি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময়ে ভীষ্ম টুঁ শব্দটি করেননি। না, একটু ভুল হল। দ্রৌপদী নিজের সম্মানরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসাবে প্রশ্ন করেন, পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির কি নিজের আগে পাঞ্চালীকে বাজি রেখে হেরেছিলেন, নাকি পরে? যদি নিজেকে আগে বাজি রেখে হেরে থাকেন তাহলে তো দ্রৌপদীর উপর অধিকার আগেই হারিয়েছেন। সুতরাং পাঞ্চালী বিজিত নন। এ প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম বলেছিলেন এসব কূটতর্কের বিষয়। এ দিয়ে মীমাংসা হতে পারে না। তাছাড়া যুধিষ্ঠির নিজেই তো ধর্মপুত্তুর। তাঁর মত করে ধর্ম আর কে বোঝে? অমিতাভও কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে যা যা ঘটেছে তা নিয়ে কখনো মুখ খোলেননি। যে বলিউডের তিনি বেতাজ বাদশা, তার উপর একের পর এক আক্রমণেও নিশ্চুপ ছিলেন। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর গোটা বলিউডকে মাদকাসক্ত বলে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে বিজেপির তরফে, অমিতাভ-পত্নী জয়া রাজ্যসভায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন, অমিতাভ কিন্তু মুখ খোলেননি। আজ হঠাৎ চৈতন্যোদয় কী কারণে তা বোঝা শক্ত।

অবশ্য কবি বলেছেন “প্রভাত কি রাত্রির অবসানে।/যখনি চিত্ত জেগেছে, শুনেছ বাণী,/তখনি এসেছে প্রভাত।” অমিতাভের চিত্ত যদি শেষমেশ জেগে থাকে তাতে ক্ষতি নেই। তবে যুগে যুগে অবতারের রূপ বদলানোর মত কংগ্রেস আমলে যিনি কংগ্রেসি, উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং যাদবের রমরমার কালে অমর সিংয়ের মিত্রতায় যিনি সপরিবারে সমাজবাদী, যিনি কুছ দিন তো গুজারো গুজরাত মেঁ ক্যাম্পেনে দেশের বারোটা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা জ্যোতির্লিঙ্গকেই দেশের একতার প্রতীক বলতে আপত্তি করেন না, তাঁর চিত্ত হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করছে এ কথা সহজে বিশ্বাস হতে চায় না, এই আর কি।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

মঞ্চে অন্য যাঁরা ছিলেন তাঁদের উপস্থিতিও যে বিশ্বাস উৎপাদনে সহায়ক নয় তা বলাই বাহুল্য। মুখ্যমন্ত্রী বা কলকাতার মহানাগরিকের কথা বাদই দিলাম। অমিতাভ যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, ঠিক পিছনেই দেখতে পেলাম পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর মুখ। অমিত শাহের মত প্রবল গণতান্ত্রিক মানুষ কলকাতায় এসে যাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন, সঙ্গীতের ব্যাপারে বিশুদ্ধবাদী, প্রচারবিমুখ সেই অজয়বাবু সিনেমার উৎসবে কী করছিলেন কে জানে! এঁদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাকস্বাধীনতার জন্য হা হুতাশ করেছেন অমিতাভ। অবশ্য শরশয্যাই তো ভীষ্মের নিয়তি।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: