২০১৪ সালের পর থেকে যতবার ভারতমাতা শব্দটা আমাদের শুনতে হয়েছে রাজনৈতিক আলোচনায়, ততবার প্রাক-স্বাধীনতা যুগে বা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জন্মানো ব্যক্তিরাও বোধহয় সারাজীবনে শোনেননি। যে দেশে জন্মেছি সে দেশকে মা বলে কল্পনা করায় এমনিতে কোনো অন্যায় নেই। কেবল উগ্র জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থীরা নয়, আদৌ নেশন ব্যাপারটাতেই বিশ্বাস ছিল না যে রবীন্দ্রনাথের, তিনিও জন্মভূমির উদ্দেশে লিখেছেন “সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে।” কিন্তু নিজের দেশকে আরও অনেককিছু হিসাবেই কল্পনা করে থাকে অনেকে। সাহেবরা মাদারল্যান্ড, ফাদারল্যান্ড দুটোই বলে থাকে। শিল্পী মানুষদের তো কথাই নেই। যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো ছবিতে নীলকণ্ঠ বাগচীর ভূমিকায় ঋত্বিক ঘটক চোখ বড় বড় করে বললেন “প্রেমে পড়ে গেলাম”। তারপর সোজা তাঁর ক্যামেরা দেখাতে শুরু করে বাংলার প্রকৃতি। চুম্বন এড়িয়ে (নাকি চুম্বনের পর?) দৌড়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যাওয়া প্রেমিকা দুর্গাকে পর্দায় দেখা যায় পরে এবং ক্ষণেকের জন্য। বাজতে শুরু করে “আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি” এবং ক্যামেরা ঘুরে বেড়ায় জলে জঙ্গলে পাহাড়ে আকাশে। গোটা গানেই প্রেমে বিহ্বল তৃপ্তি মিত্রের চেয়ে বেশি করে দেখা যায় জন্মভূমিকে।
কিন্তু দেশকে নিয়ে এইসব নানারকম ভাবনা এ দেশের ঠারেঠোরে বারণ হয়ে গেছে ২০১৪ সাল থেকে। দেশকে মা বলেই ভাবতে হবে, বন্দে মাতরম গাইতে হবে। যারা গাইতে আপত্তি করবে তারা সব দেশদ্রোহী। এমনকি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় স্তোত্রটিও গাইতে হবে খেলার আগে, সিনেমা দেখার আগে একেবারে সাবধান পোজিশনে দাঁড়িয়ে। বসে থাকা মহাপাপ। হুইলচেয়ারে বসে থাকলেও ভারতমাতার অপমান এবং তার শাস্তি ‘পাকিস্তানি’ বলে গালমন্দ করা। তা এমন একনিষ্ঠ মাতৃভক্তদের দেশে নিশ্চয়ই আশা করা অন্যায় নয় যে নারীর সম্মান একেবারে শিখরে পৌঁছবে। অন্য সব দেশ আমাদের দেখে শিখবে কেমন করে মেয়েদের সম্মান করতে হয়। ট্রেনে বাসে কোনো পুরুষ চোরাগোপ্তা মেয়েদের জামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেবে না, কনুই দিয়ে গুঁতো মারবে না বুকে, বাস ব্রেক কষার অজুহাতে এসে পড়বে না গায়ে। পড়লেও মেয়েরা টুঁ শব্দটি করার অপেক্ষা। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত মাতৃভক্তরা তার সে অবস্থাই করবে কীচকের যে অবস্থা করেছিলেন ভীম। পুরাণই তো আমাদের ইতিহাস আর আমরা এত সভ্য জাতি, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব না? এও নিশ্চয়ই আশা করা চলে যে অফিস কাছারিতে যৌন হয়রানি বলে কিছু থাকবে না, কারণ সেসব করলেই মাতৃভক্ত রাষ্ট্র তার লম্বা হাত বাড়িয়ে চাকরিসুদ্ধ বধ করবে দুঃশাসনটিকে। ধর্ষণ শব্দটার তো কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, কারণ সেই কবে রামভক্ত, সীতা মাইয়ার ভক্ত লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন, ধর্ষণের শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। তিনি যখন মার্গদর্শকমণ্ডলীর সদস্য, তখন দেশের সরকার কি আর ওই মার্গে না গিয়ে পারে?
কিমাশ্চর্যম তৎপরম! ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলার এবং ঘাড় ধরে বলানোর ধুম বেড়েই চলেছে, অথচ আট থেকে আশির ভারতীয় মহিলারা ধর্ষিত হচ্ছেন, খুন হচ্ছেন। কখনো কাঠুয়ার মত শিশুকে দিনের পর দিন মন্দিরে গুম করে রেখে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলা হচ্ছে, কখনো হাথরাসের মত প্রমাণ লোপাট করতে খোদ পুলিস এসে বুক ফুলিয়ে টিভি ক্যামেরার তোয়াক্কা না করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ধর্ষিতার দেহ। উন্নাওয়ের মত ধর্ষিতার বাবা খুনও হয়ে যাচ্ছেন অনেকসময়। আরও আশ্চর্য, ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল বেরোচ্ছে। সে মিছিলের নেতৃত্বে থাকছেন ভারতমাতার সবচেয়ে বড় ভক্তদের দলের নেতা, মন্ত্রীরা। ধর্ষিতার হয়ে মামলা লড়ছেন যে মহিলা আইনজীবী তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন বার অ্যাসোসিয়েশনের লোকেরাই। তিনি আশঙ্কা করছেন ধর্ষিত হতে পারেন, খুনও হতে পারেন।
এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ধর্ষক বলে প্রমাণিত এবং সাজা পাওয়া অপরাধীরাও ভারতমাতার পরম ভক্ত সরকারের সিদ্ধান্তে সদাচরণের জন্য মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। জেল থেকে বেরোলে তাদের মালা পরিয়ে বীরের সম্মানও দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ভারতমাতার পুজো হচ্ছে আর তাঁর কন্যাসন্তানদের গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো হচ্ছে। ধর্ষণ যে কোনো গুরুতর অপরাধই নয় তা দেশসুদ্ধ লোককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। উন্নাওয়ের প্রাক্তন বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার, যিনি ধর্ষিতার বাবাকে খুন করার অপরাধে হাইকোর্টের আদেশে দশ বছর জেল খাটছেন, তিনি এ বছর জানুয়ারি মাসে মেয়ের বিয়ের জন্য হপ্তা দুয়েক অন্তর্বর্তী জামিন পেয়েছিলেন। গতকাল হরিয়ানার ভারতমাতার পরমভক্তদের সরকার ৩০ দিনের প্যারোলে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছে গুরমীত রাম রহিমকে, যিনি একাধিক ধর্ষণ ও খুনের মামলায় ইতিমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ২০২৩ সালের সাত মাসে দুবার বাইরে আসা হয়ে গেল তাঁর। বলা যায়, মাঝেমধ্যে ছুটি কাটাতে জেলে যান।
এইসব ধর্ষকদের ঘটনায় মিল একটাই। এঁরা বর্ণহিন্দু, অত্যাচারিত মহিলারা হয় মুসলমান, নয় দলিত। কে জানে! হয়ত কাঠুয়ার আসিফা, গুজরাটের বিলকিস বানো বা হাথরাসের দলিত মেয়েটি ভারতমাতার প্রতিভূ নয়। কে ভারতমাতার সন্তান আর কে দেশদ্রোহী তা তো আর ভারতমাতা ঠিক করেন না, ঠিক করেন তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত সন্তানরা। তাঁরা হয়ত ঠিক করেছেন ওদের ভালমন্দে ভারতমাতার কিছু এসে যায় না। কিন্তু দস্তুরমত হিন্দু আন্তর্জাতিক পদকজয়ী কুস্তিগীররাও ভারতমাতার প্রতিভূ নন? ভিনেশ ফোগত, সঙ্গীতা ফোগত, সাক্ষী মালিকরা দিনের পর দিন রাস্তায় বসে রইলেন; পুলিস তাঁদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। তবু ব্রিজভূষণ শরণ সিং কিন্তু গ্রেফতার হলেন না। উল্টে গতকাল গ্রেফতার না হয়েই জামিন পেয়ে গেলেন।
এমন দেশে মণিপুরের মত একটা ছোট্ট রাজ্যে কয়েকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাকে উলঙ্গ করে পথে পথে ঘোরানো হবে, যে পুরুষের যেমন ইচ্ছা স্পর্শসুখ অনুভব করবে, দল বেঁধে ধর্ষণ করবে – এ আর এমন কী ব্যাপার? ভারতমাতার সবচেয়ে বড় ভক্ত, বেচারা স্বঘোষিত প্রধান সেবক উপরে বর্ণিত কোনো ঘটনাই জানতেন না। হঠাৎ কাল মণিপুরের ঘটনাটা জানতে পেরে বেজায় ব্যথা পেয়েছেন, রেগেও গেছেন। এরকম বেদনা শেষ দেখা গিয়েছিল বিবেক ওবেরয়ের মধ্যে। যখন তিনি নরেন্দ্র মোদীর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে জ্বলন্ত গুজরাট দেখে বলেছিলেন “মেরা গুজরাট জ্বল রহা হ্যায়!” এই বেদনায়, এই রাগে কার যে কী এসে গেল তা বোঝা মুশকিল। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে সরানোর ব্যবস্থাও করেননি, নিজে গিয়ে দাঁড়াবেন আগুন নেভাতে – এমন কথাও বলেননি। বরং বীরেন সগর্বে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এমন তো শয়ে শয়ে ঘটনা ঘটেছে, সেইজন্যেই তো ইন্টারনেট বন্ধ করা ছিল। এমন মাতৃভক্তির কোনো তুলনা হয়? এমন শয়ে শয়ে ঘটনা আটকাতে পারেননি বলে কোনো আফসোস নেই। কিন্তু এতে ভারতমাতার ভাবমূর্তি যেন খারাপ না হয় সেদিকে তিনি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। তাই তো এসব ঘটনা প্রকাশ পায়নি এতদিন। অতএব যত দোষ সোশাল মিডিয়ার।
অবশ্য খামোকা উত্তেজিত হচ্ছি। ঠিকই তো বলেছেন বীরেন সিং। ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের লজ্জা তো সমাজের নয়; সরকারেরও নয়। যত লজ্জা সবটাই তো যে মহিলা লাঞ্ছিত তাঁর। এটাই তো সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধ। আমরাও তো সেই মূল্যবোধ নিয়েই চলি। তাই আমাদের বাড়ির মেয়েরা অনেক লাঞ্ছনার ঘটনা স্রেফ চেপে যায়। বহু ধর্ষণে আজও পুলিসে ডায়রিই হয় না, কারণ আমার বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে এ আমার লজ্জা। বাড়ির সমস্ত পুরুষ (এবং মহিলার) লজ্জা। এই আমরাই তো ভোট দিয়ে ভারতমাতার এই সন্তানদের হাতে দেশের দায়িত্ব তুলে দিয়েছি। এঁরা তো আর তালিবানদের মত একে ৪৭ হাতে জোর করে ঢুকে পড়েননি সংসদে, বিধানসভাগুলোতে। ফলে ওই কুকি মহিলাদের জামাকাপড় খুলে নিয়েছি তো আমরা সবাই। উলঙ্গ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়েছি আমরাই। আমরা, যারা কোথাও না কোথাও সংখ্যাগুরু। এখনো আমাদেরই কতজন বনলতা সেনগিরি করে যাচ্ছে সোশাল মিডিয়ায় – কবে কোথায় কোন সরকারের আমলে কোন মহিলার সঙ্গে কী করা হয়েছিল। গুজরাটের ধর্ষিত মহিলাদের কথা উঠলেই আমরা টেনে আনি ধর্ষিত কাশ্মীরি পণ্ডিত মহিলাদের কথা অথবা নোয়াখালিতে ধর্ষিত মহিলাদের কথা। মেইতেইরাও অনেকেই সেই রাস্তা ধরে নিয়েছে। তাদের কোনো কোনো সংগঠন আবার দাবি করেছে, উলঙ্গ করে হাঁটানো হয়েছে বটে, কিন্তু ধর্ষণ করা হয়নি।
আরও পড়ুন কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?
আমরা দেখছি, জনগণমনয়ধিনায়করাও দেখছেন। ড্যাবডেবিয়ে দেখছেন। নিজের মাকে নগ্ন দেখার পাপে সোফোক্লিসের ট্র্যাজেডির রাজা অয়দিপাউসকে অন্ধ হয়ে যেতে হয়েছিল। নিজেই নিজের চোখ উপড়ে নিয়েছিল সে। তবু তো অয়দিপাউস পাপটা করেছিল নিজের অজ্ঞাতে। আমরা সজ্ঞানে এই যে পাপ করে চলেছি এর শাস্তি কী?
নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত