কাটমানির স্বপ্নভঙ্গ?

যে শিল্পী একসময় আমাদের বলতেন “চল যাব তোকে নিয়ে, এই নরকের অনেক দূরে। এই মিথ্যে কথার মেকি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে”, তাঁর সবচেয়ে বড় মঞ্চ হয়ে দাঁড়াল একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ

বয়ঃসন্ধির প্রেম একতরফা হলেও বিশুদ্ধ। অন্তত আমাদের বয়ঃসন্ধির প্রেম তেমনই ছিল। কারণ আমাদের স্মার্টফোন ছিল না, তাতে সুলভ পর্নোগ্রাফি ছিল না, সম্ভবত সে জন্যেই অ্যাসিড দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করা ছাড়া আর কিছু করা যায় আমরা ভেবে উঠতে পারতাম না। তা সেই বয়ঃসন্ধির প্রেম নিয়ে সবচেয়ে জীবন্ত, হৃদপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া গানটা লিখেছিলেন নচিকেতা। সে বয়সে তাঁর নীলাঞ্জনা আর আমাদের নীলাঞ্জনারা অভিন্ন ছিল।
শুধু প্রেম নয়, বয়ঃসন্ধির সবকিছুই মানুষের বহুকাল প্রিয় থাকে। হয়ত ওখানেই শৈশবের শেষ বলে। নচিকেতার জন্যেও তাই আমাদের প্রজন্মের অনেকের মনে একটা বিশেষ জায়গা আছে বা ছিল। শিল্পমূল্যে কবীর সুমন (সেযুগের সুমন চট্টোপাধ্যায়) অনেক এগিয়ে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে, মফঃস্বলে ছড়িয়ে থাকা মানুষের মনের কথা প্রায় তাঁদের ভাষায় গানের মাধ্যমে বলার ক্ষেত্রে নচিকেতার জুড়ি ছিল না। এবং সেটা বয়সের বাধা অতিক্রম করে। নচিকেতা আমাদের যেমন নীলাঞ্জনা দিয়েছিলেন, দাদু দিদাদের বৃদ্ধাশ্রম দিয়েছিলেন; শাপভ্রষ্ট বাবা, কাকাদের অনির্বাণ দিয়েছিলেন। অস্বীকার করবে কোন মূর্খ? আমরা সলিল চৌধুরীর যুগের লোক নই। আমাদের জন্যে কেউ ঘুমভাঙার গান লেখেনি। আলোর স্পর্শে দুঃখের কাল কেটে যাবে সেই স্বপ্ন আমরা দেখিনি, কারণ পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছাড়া আর কোন স্বপ্ন দেখতে শেখানোই হয়নি। প্রতিবাদের ভাষা বলতে আমরা তাই “শুনব না গান, গান শুনব না” বুঝেছি। সেই ভাষা নচিকেতাই যুগিয়েছিলেন।
সেই জায়গাটা নচিকেতা ধরে রাখতে পারতেন অনায়াসেই। কিন্তু ঐ যে অনেকে বলে, আপনি হয় যৌবনেই বিদ্রোহীর মৃত্যু বরণ করতে পারেন নয় দীর্ঘজীবী প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারেন। কথাটা নচিকেতার ক্ষেত্রে এমন নিদারুণ সত্যি হয়ে উঠবে ভাবতে পারিনি।
বেশ মনে আছে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময়ে আমাদের কোন্নগর রবীন্দ্রভবনে একবার গাইতে এসেছেন, এক প্রবীণ সিপিএম নেতাকে অনুষ্ঠান শেষে তরুণ পার্টিকর্মী উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন “যা পপুলারিটি, ভোটে দাঁড় করায় দিলে ড্যাং ড্যাং কইর‍্যা জিত্যা যাইব।” সুভাষ চক্রবর্তীর সাথে নচিকেতার ঘনিষ্ঠতা ততদিনে সুবিদিত। জানি না ইঙ্গিতটা সেদিকেই ছিল কিনা, তবে সি পি আই (এম) শেষ পর্যন্ত নচিকেতার জনপ্রিয়তাকে নির্বাচনী লড়াইয়ে ব্যবহার করেনি। রাজ্যে যখন পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করল তখন আরো অনেক ছোট বড় বিখ্যাত লোকের মতই নচিকেতাও পরিবর্তনপন্থী হয়ে উঠলেন। বামফ্রন্ট সমর্থক হিসাবে দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু সঙ্গে এও মনে হয়েছিল যে হয়ত তিনি বামফ্রন্টের দলগুলির বিচ্যুতিতে ব্যথিত, বিরক্ত একজন বামপন্থী। ভুল জায়গায় নিস্তার খুঁজছেন। ভুল তো আমি, আপনি সকলেই করি। তাছাড়া ২০০৮-০৯ থেকে মমতার প্রতি বামফ্রন্টের বাইরের বামেদের প্রকাশ্য ও গোপন সমর্থন তো ছিলই। আর তাঁর বিভিন্ন গান শুনে নকশালপন্থীদের প্রতি নচিকেতার সমর্থন বুঝে নিতেও খুব অসুবিধা হত না। তাই সান্ত্বনা ছিল।
সে সান্ত্বনা অবশ্য দ্রুত অন্তর্হিত শুরু করল যখন দেখা গেল নচিকেতার মনকাড়া গান কমে আসছে, বেড়ে যাচ্ছে রেল দপ্তরের বিভিন্ন জলসায় তাঁর অনুষ্ঠান। রেলমন্ত্রী তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবর্তনের সরকার আসার পরে মন ছুঁয়ে যাওয়া গান কমা আর অনুষ্ঠান বাড়া আরো ত্বরান্বিত হল। যে শিল্পী একসময় আমাদের বলতেন “চল যাব তোকে নিয়ে, এই নরকের অনেক দূরে। এই মিথ্যে কথার মেকি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে”, তাঁর সবচেয়ে বড় মঞ্চ হয়ে দাঁড়াল একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ। একজন শিল্পী, তিনি বাম ডান যা-ই হোন, যখন নিজের শিল্পকে অপ্রধান করে ফেলেন, যখন তাঁর রাজনীতি তাঁর শিল্পের মধ্যে দিয়ে নয়, অন্য পথে প্রকাশ খোঁজে তখন তাঁকে সন্দেহ করতেই হয়। ভাঁড়ার খালি হয়ে গেছে বলে গানের ভান করে আখের গোছাচ্ছেন — এই সন্দেহ আর অমূলক থাকে না তখন। সেই সন্দেহই ক্রমশ প্রবল হয়েছে গত কয়েক বছরে। আর এখন, যখন পশ্চিমবঙ্গে আরেক পালাবদলের কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে, তখন কাটমানি নিয়ে তাঁর গান সেই সন্দেহকে আরো বাড়িয়েই তুলল।
মানুষ ভুল করে, আবার মানুষই সেই ভুল সংশোধন করে। সে দিক থেকে মত পরিবর্তন করার অধিকার সব মানুষেরই আছে, একজন শিল্পীর তো আছে বটেই। সুতরাং নচিকেতা একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেছেন বলেই যে সারাজীবন করে যেতে হবে একথা বলার নিশ্চয়ই মানে হয় না। শিল্পীকে চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হতেই হবে এবং শেষ অব্দি নিজের বিবেকের বাণী শুনতেই হবে। কিন্তু মুশকিল হল যে সরকারঘনিষ্ঠ শিল্পীদের বিবেক একমাত্র উল্টোদিকে শক্তিশালী (সে যে উপায়েই শক্তিশালী হোক) বিরোধী দল থাকলে তবেই জাগ্রত হয়, তাদের বিবেককে যাত্রার বিবেকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায় না।
আজ সকালের কাগজে দেখলাম নচিকেতা সাফাই দিয়েছেন, গানটা সারা দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা নেত্রীদেরই বিরুদ্ধে। এবারেও একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে তাঁকে দেখা যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে বলেছেন দিদি ডাকলে তিনি নরকেও চলে যাবেন। কারণ ব্যক্তিগত সম্পর্কই তাঁর কাছে আসল, পার্টি কোন ব্যাপার না। কথাটা কেমন সিগারেটের প্যাকেটের বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মত শোনাল না? কাল সুভাষদার সাথে সম্পর্ক ভাল ছিল বলে উনি সিপিএমের ছিলেন, আজ দিদির জন্যে উনি তৃণমূলের, কাল অন্য কোন দাদার জন্যে বিজেপির হয়ে যেতেই পারেন — এমনটাই কি বলতে চাইলেন জীবনমুখী শিল্পী?

পুনশ্চ: সেদিন দেখি আমার নীলাঞ্জনা বাজার করছে। মাছ, মাংস, সবজি বিক্রেতাদের সাথে তার কথা বলার ধরণ দেখে অবাক হয়ে ভাবলাম “একে নিয়ে কবিতা লিখতাম!”

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

One thought on “কাটমানির স্বপ্নভঙ্গ?”

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading